ক’দিন হল বাড়িটা মেরামত করাচ্ছে বাবা। যিনি সব কাজ তদারকি করছেন, বেশ মজার মানুষ। সুমন কাকু, মুখে হাসি লেগে আছে সবসময়। একটা হলুদ হাফ হাতা শার্ট, কালো প্যান্ট আর হাতে ধরা একটা জলন্ত ফ্লেক – মোটামুটি এর’মভাবেই লোকটাকে দেখছি এই ক’দিন ধরে। বাবার সথে আগে থেকেই পরিচয় আছে, আমি মাঝেমধ্যে হাসিঠাট্টা করি ওঁর সঙ্গে। মাঝখানে একদিন বাড়িতে পার্টিশন নিয়ে কথা হচ্ছিল। আসলে আমার বাবার ঠাকুরদার বাড়ি ছিল বাংলাদেশের পটুয়াখালী গ্রামে, তো আমার পরিবারের একজন বাংলাদেশ যাবেন ক’দিন পর এবং ওই গ্রামেও একবার ঘুরে আসবেন ঠিক করেছেন – কিন্তু সমস্যা হল, কোনো আত্মীয় হয়তো ওখানে নেই এখন আর। বাবা বলছিল, দেশভাগটা না হলে হয়তো সেই গ্রামে আমাদের বাড়ি আজও থাকত এবং কিছু আত্মীয়ও হয়তো সেখানে থাকতেন। এই কথাতেই অপ্রত্যাশিতভাবেই সুমন কাকুর প্রসঙ্গ টেনে আনল বাবা। ওঁরও আদি বাড়ি বাংলাদেশ, উনি নাকি ৭১-এর যুদ্ধের সময় পালিয়ে এসেছেন এখানে; বাবা আরো বলল, যে এর চেয়েও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে ওঁর সাথে। ঠিক কী হয়েছিল জিজ্ঞেস করায় বাবা বলল, তুই ওর মুখ থেকে বরং শুনে নিস।
গল্প শুনতে যে মানুষ ভালোবাসে, তার বোধহয় গল্প বলার লোকও ঠিক জুটে যায়। পরের দিন সুমনকাকু আসতেই তাকে বললাম, তোমার বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বল। স্বভাবসিদ্ধ হাসিমুখ নিয়ে শুরু করল সুমন কাকু, “বাবাকে ওরা গুলি করে মেরেছিল। আমি আর দাদা পালিয়েছিলাম, আমাদেরও ধরেছিল, কিন্তু পরে ছেড়ে দেয়। তখনই পালিয়ে আসি এখানে।”
যে লোকটা এমনি সময় বড্ড বেশি কথা বলে, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলার সময় দেখলাম অল্প কথায় কাজ সারল – আমি আর ঘাঁটালাম না। সত্যি বলতে, জিজ্ঞেস করার সাহস হল না। সুমন কাকু কিন্তু তখনও হাসছেন, বাবার মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা বলছেন – কিন্তু তাতে কোনো দুঃখ-ক্ষোভ কিছুই নেই – কেমন যেন নির্লিপ্ত। এটাই দেশভাগের দান, এই মানুষগুলোর চোখের জল কেড়ে নিয়েছে ৪৭, ৭১ –এই বছরগুলো। এরা আর কিছুতেই আশ্চর্য হয় না।
সুমনকাকুর মত এর’ম অনেকেই আছে। যাদের ওপার বাংলার কেউ চায়নি, আর এপারেও কেউ নে নি, শূন্য থেকে শুরু করে তারা আজ নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন কিছুটা। আর কোনো কিছুই তাঁদের নাড়া দেয় না, শরীর নিয়ে এদেশে এলেও মনটা হয়তো ওই দেশেই ফেলে এসেছেন। এখনো কিছু অতিবৃদ্ধ মানুষের মুখে ‘দ্যাশ’ কথাটা শোনা যায়, তাদের চোখে অদ্ভুত একটা ঝিলিক খেলে যায় কথাটা বলার পর, আশপাশের লোক ব্যঙ্গ করে তাদের জমিজমা, বাস্তুভিটার রং চড়ানো গল্প নিয়ে, আর তাঁরা ভাবেন, ‘যদি শালারে একবার দেখাইতে পারতুম। বঙ্কিম আনন্দমঠ-এ মা যা হবেন বলেছিলেন, এখন এলে দেখবেন মা তার ভাবনার চেয়ে অনেক ভিন্ন, তার দু’কোলে দুটো সন্তান, কিন্তু কাউকেই তিনি খাওয়াতে পারেন না, আর মায়ের পিঠ বরাবর একটা কাটা দাগ – সেই দাগ যা জন্মদাগ নয় – কিন্তু মাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
দেশভাগ আমাদের কম কিছু দেয়নি। একটা পূর্ববঙ্গ, একটা পশ্চিমবঙ্গ দিয়েছে, ঋত্বিকের সুবর্ণরেখা দিয়েছে, অভিধান থেকে উদ্বাস্তু কথাটা তুলে এনে বিজয়গড়, যাদবপুর, বারাসাতের কলোনিগুলোতে এনে ঘাম, চোখের জল মিশ্রিত অস্তিত্ব সঙ্কটের গল্পগুলোয় স্থান দিয়েছে, Allen Ginsberg-এর September on Jessore Road দিয়েছে আর দিয়েছে একটা কাঁটাতার আর সেই কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া জাতির এক হতে চাওয়ার এক অলীক স্বপ্ন।