১৯৪৭ সালে ভারত দু ভাগ হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এ পরিবারের কাহিনী বলতে গেলে আমাকে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে ঢের। ১৯১৮ সালে ঠাকুরদা যখন পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার লৌহজং গ্রাম থেকে এসে ভর্তি হলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে ঠিক সে বছরেই সে কলেজ থেকেই গ্র্যাজুয়েট হলেন নেতাজী। যতটুকু শুনেছি ঢাকার স্কুলের ছেলেটি কলেজে নেতাজীকে বেশিদিন দেখবার সুযোগ পান নি। হয়ত সে কারণেই তাঁর প্রভাব ঠাকুরদার উপরে ততখানি পড়তে পারে নি। তিনি আজীবন গান্ধিবাদী কংগ্রেসী রয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি বহু বছর পরে বিবাহিত জীবনে সন্তানদের জন্ম হলে ছোট পুত্রের ডাক নামেও তার পরিচয় লেগে ছিল। আমার বাবাকে সবাই ‘গান্ধী’ নামেই সম্বোধন করত। ১৯০৫ সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হলেও স্বাধীনতা লাভের সময় পর্যন্ত নাগরিক গুরুত্বে তা ছিল অবিভক্ত বাংলায় সর্বোচ্চ স্থানে। অতএব লেখাপড়া করাই হোক বা কেরিয়ার তৈরী করা- তখন তরুণদের ঢল থাকত কলকাতামুখী। ঠাকুরদা ১৯২০ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্কলারশিপ নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হন। কিন্তু আজ ঠাকুরদা নয় বলব মায়ের বাবা মানে আমার দাদুভাইয়ের কথা।
ঢাকা জেলায় দিঘির পাড় গ্রামে ছেলেটার জন্ম হয়েছিল। ফুটফুটে গৌরবর্ণ শিশু, কাজল কালো চোখ... দেখলে চোখ ফেরানো যায় না এমনই সুন্দর। জন্মের পরে দশটা বছর সেখানেই হেসে খেলে বড় হওয়া আর পাঁচটা গ্রামের ছেলে যেভাবে হয়। এ ঘটনা প্রায় একশ বছর আগের। মানে বেশ পুরনো বাংলা ছবির সাদাকালো প্রকৃতির কোলে কাটানোর মত গ্ল্যামারের সেই দিনকাল। যা আমরা নব্বইয়ের দশকের আগে সামান্য ছুঁতে পেরেছি, আর এখন যা একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন বেঁচে থাকাটাই অলীক, সত্য কেবল স্মার্ট ফোনের স্ক্রীন।
ছেলেটির যখন দশ বছর বয়স তখন তার একটি ভাই জন্মালো। অবশ্য মাঝে তিনটি বোনও জন্মেছিল। বাবা সামান্য কাজ করে জীবিকা অর্জন করতেন কিন্তু ভাত কাপড়ের অভাব ছিল না। মা ভাই বোন বাবার সঙ্গে সুখে দিন কাটছিল। ছেলেটি খুব দুষ্টু ছিল। খেলাধুলো বিশেষ করে ফুটবলে তার দারুণ আগ্রহ এবং দক্ষতা। সেজন্য স্কুলে খেলাধূলায় নাম ডাক হয়েছিল। এমনকি ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে আসার পরে তাদের স্কুলটিমের ছবিও তোলা হয়। সে ছবি বহু বছর স্কুলের দেয়ালে টাঙানো ছিল। এখন সে স্কুলের অস্তিত্ব আছে কী না কে জানে! থাকলে হয়ত ছবিটিকেও খুঁজে পাওয়া যাবে! ছেলেটির বাবা তাঁর প্রথম মেয়ের বিয়েও দিয়ে দিলেন। কিন্তু তার কিছুদিন পর হঠাত করেই যথেষ্ট কম বয়সে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রোগশয্যায় শুয়ে যখন বুঝতে পারলেন এ যাত্রা তরী ডুববেই, তখন উপায় না দেখে শৈশব অনুত্তীর্ণ বড় পুত্রকে ডেকে তার হাতেই পরিবারের সবার দায়িত্ব দিয়ে বললেন- ‘বাবা সবাইরে দেইখ্যো। সকলের কথা শুইন্যো, সকলরে ভালবাইস্যো।’ কিছু দিন পরে খুব স্বল্প রোগভোগ করে সংসার ভাসিয়ে যখন মারা গেলেন, ছেলেটির তখন দশ বছর বয়স। মাঝে তিনটি বোন (এর একটি অবশ্য বিবাহিত তখন) আর তার ভাইয়ের বয়স দশ মাস মাত্র। বিধবা মা পড়লেন অকূল পাথারে। সদ্যজাত একটি শিশু, দুই মেয়ে আর নাবালক বড় পুত্রটিকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন বাপের বাড়ি। ফরিদপুর জেলার পন্ডিতসার গ্রামে ছিল তাঁর বাপের বাড়িটি। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে গ্রামের মানুষজন মূলত লেখাপড়া ভিত্তিক জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই হল ছেলেটির মামাবাড়ি। মামা আদর করে সদ্যবিধবা বোনকে সন্তানসহ আশ্রয় দিলেন।
তা ছেলেটি বাবার কথা রেখেছিল। বাবার মৃত্যুর আগে যেমন ছিল, তেমনই মামাবাড়িতে থাকার সময়েও বাড়ি ও আশেপাশের আর পাঁচটা গ্রামে সকলের চোখের মণি হয়েই বড় হচ্ছিল সে। বুদ্ধিমান নম্র রূপবান কিশোরটির আর একটি গুণ বিকশিত হচ্ছিল তখনই। ফুটবলে দক্ষতার পাশাপাশি পরোপকারী বলেও সে জনপ্রিয়তা লাভ করছিল। একদিকে এভাবে বড় হওয়া অন্যদিকে ক্রমে আগ্রহ শুরু হয় অনুশীলন সমিতির আদর্শের দিকে। বাংলার শত শত দামাল ছেলে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ছেলেটির জীবনটা ও দিকেই গড়াত কী না জানা যায় না। তবে তার মামাবাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব ভাল ছিল না। ছেলেটির মাও বেশিদিন বাপের বাড়ির আশ্রয়ে নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চাইছিলেন না। কৈশোর পেরনোর আগেই বড় ছেলে মনে মনে তখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। মায়ের মনের ইচ্ছে বুঝতে তার কষ্ট হয় নি। মামাবাড়িতে থাকাকালীন মামাদের সাহায্যে বাকী দু বোনেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে ততদিনে। অবশেষে ক’বছরের মধ্যেই পড়াশুনা অর্ধ সমাপ্ত রেখে দশম শ্রেণীতে পড়া চলাকালীন চার বছর বয়সী দুধের শিশু ছোট ভাই আর মাকে মামাবাড়িতে রেখে জীবিকার সন্ধানে সে পাড়ি দিল কলকাতায়।
পূর্ববঙ্গ থেকে তখন সব মানুষের স্রোতই কলকাতা অভিমুখী ছিল। যদিও তখন আর সে রাজধানী নয় কিন্তু চাকরি বাকরির সুযোগ সেখানেই পাওয়া সম্ভব। কলকাতায় এসে অনেক কৃচ্ছ্রসাধন করে অবশেষে নিমতলায় একটা কাঠের কারখানায় অ্যাপ্রেন্টিসের কাজ পেল। কারখানার মালিক ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, নাম- মুরারী সাধু। ব্যবসায়ী মানুষের নাম সাধু কেন? কেননা মুরারীমোহন পাল ছিলেন বৈষ্ণব। সারা বছরই রাধারানী- শ্যামসুন্দরের সেবা, কীর্তন, নামগান ইত্যাদি নিয়ে মজে থাকতেন। নিমতলা অঞ্চলে মুরারীমোহনের ব্যবসার খ্যাতির পাশাপাশি ভক্তির কারণেও প্রসিদ্ধি ছিল খুব। স্ত্রী সন্তান নিয়ে তাঁর পরিপূর্ণ সংসার। সেইসঙ্গে নিজের অকালমৃত বোনের মেয়েকে তিনি নিজের কাছে রেখে বড় করছিলেন। হরিভক্তির কারণে এলাকার লোকজনই তাঁর নাম দিয়েছিল “মুরারী সাধু”।
ছেলেটি তাঁর কাছে কয়েক বছর লেগে রইল। কাঠের ব্যবসার খুঁটিনাটি শিখে নিচ্ছিল দ্রুত। সে যেমন চৌখস তেমনি সৎ, বিনয়ী- এককথায় প্রাণ জুড়নো ছেলে। কিছুদিনের মধ্যেই মুরারীমোহনের বাড়ির সকলের কাছে প্রিয় হয়ে গেল।
তখন সে দিনরাত খাটে এবং ব্যবসার খুঁটিনাটি বুঝতে থাকে। সাধুর বাড়ির ভিতরে তার অবারিত আনাগোনা। মুরারীমোহনের ব্যবসাস্থল, কারখানার কাঠের গদি আর বাড়ি একসঙ্গে থাকায় আলাদা থাকবার কোন উপায়ও তো ছিল না। দুতিন বছর কাটলে একসময় মুরারী সাধু নিজেই প্রস্তাব দিলেন নিজের কাছে রেখে বড় করা মা মরা ভাগনির সঙ্গে এই পিতৃহীন ছেলেটির বিয়ে দেবেন। মেয়েটির নাম ঊষারানী এবং ছেলেটি তখন তরুণ, তাঁর নাম চিত্তরঞ্জন। দুজনের আলাপ পরিচয় এমনি অনাবিল ভাবেই হয়েছিল। ঊষার মনে মনে ভীষণ ভাল লাগত ছেলেটিকে। রূপবান ছেলেটিরও মনে মনে ছোটখাট শান্ত শ্যামলা মৃদুভাষিণী মিষ্টি মেয়েটিকে পছন্দ ছিল। অতএব একদিন দুজনে প্রজাপতির নির্বন্ধে বাঁধা পড়লেন। আশ্চর্য সমাপতন দুজনেই জীবনের বেশি সময় মামাবাড়িতে থেকে মানুষ হয়েছিলেন।
নববিবাহিত দম্পতি পূর্ববঙ্গ চলে এলেন যেখানে মা আর ভাই রয়েছে। চিত্তরঞ্জন কলকাতা থেকে টাকা পাঠালে ছোট ভাইটি পড়াশুনো করে। ততদিনে সেও যুবক হয়ে উঠছে। তাঁর অবশ্য ঝোঁক কমিউনিস্ট দর্শনে। লুকিয়ে লুকিয়ে রমনীমোহন সরকার সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকাটি জোগাড় করে আর পাশাপাশি আই এ পড়ে। এই পত্রিকাটি ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে বেশ কটি মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল ভারতের স্বাধীনতা লাভের আগে ও পরে। অভিযোগ ছিল সাম্রাজ্য বিরোধিতার।
ফিরে যাই চিত্তরঞ্জনের কথায়। বিয়ের পর থেকে তাঁদের এদেশ ওদেশের দাম্পত্যই ছিল। কেননা চিত্ত কাজ করতেন কলকাতায় আর তাঁর পরিবার থাকত পূর্ববঙ্গে। তখনকার মানুষ যেমন করত, গ্রামে পরিবার রেখে শহরে উপার্জন- এখানেও সে ব্যবস্থা রইল। বাংলা ১৩৫০ বঙ্গাব্দের কুখ্যাত মন্বন্তর মানে ১৯৪৩ -র সেই গ্রেট বেঙ্গল ফেমিনের বছরে তাঁদের প্রথম সন্তান কন্যা জন্ম নিল পূর্ববঙ্গে। কলকাতায় কাজে ব্যস্ত সদ্য পিতার স্ত্রী কন্যার জন্য বড় মন কেমন করত। গদি থেকে ছুটি পেলে কলকাতা থেকে মেয়ের জন্য ফ্রক, হরলিক্সের শিশি এসব নিয়ে যেত। বধূর জন্যও কিছু নিত অবশ্য তবে সেসব কি অত খুঁটিনাটি মেয়ে বলতে পারে নি।
মেয়ে একটু বড় হতে একসঙ্গে পরিবার রাখবেন বলে সপরিবারে চলে এলেন কলকাতার দর্জিপাড়ায়। সেখানে বাসা ভাড়া করলেন। কিন্তু সেখানেও সামান্য কমাসই ছিলেন। তখন ও জায়গার বসতবাটি হিসাবে থাকার জন্য খুব সুনাম ছিল না। কাছেই কুখ্যাত পল্লী, তায় কলকাতায় বেঁচে থাকার খরচও খুব। পরিবার নিয়ে চলে গেলেন নবদ্বীপ। সেখানেই বাড়ি ভাড়া করে সবাইকে রেখে চলে এলেন কলকাতায়। এতদিনে নিজের ব্যবসা করবেন ঠিক করেছেন। টাকাও কিছু জমেছে। এবং ভারত স্বাধীন হল সদ্য। অতএব পার্টনার নেপাল পালের সঙ্গে যৌথভাবে শুরু করলেন নিজস্ব কাঠের ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানের নাম রাখলেন “পাল ব্রাদার্স”।
এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। কঠোর পরিশ্রম এবং দুর্দান্ত ব্যবসা বুদ্ধির ফলে ব্যবসা বাড়তে লাগল হু হু করে। আর একটি কন্যাও জন্মেছে এর মাঝে। নবদ্বীপ কলকাতা থেকে অনেক দূর। পরিবার সহ উঠে এলেন আন্দুলে। বাসা ভাড়া করে থাকতে লাগলেন একসঙ্গে। কিন্তু ব্যবসাস্থল নিমতলা স্ট্রীট আর বাড়ি আন্দুল... রোজকার এই যাতায়াতের ধকল সামলাতে অসুবিধা হচ্ছিল। অতএব খুঁজতে খুঁজতে নাথের বাগান স্ট্রীটে একটা বাড়ির একতলা ভাড়া নিলেন। আরেক তলায় ভাড়াটে ছিলেন চিত্তরঞ্জনের মাসতুতো ভাইয়েরা। তাদের অবশ্য দেশভাগের আগে থেকেই বর্ধিষ্ণু পরিবার। কলকাতায় থাকছিলেন পড়াশুনোর সুবিধে হবে বলে। বাড়ির মালিক গোপাল কুন্ডু। আগে তাদের চাল ও চিনির ব্যবসা থাকলেও তখন শুরু করেছেন হোসিয়ারীর ব্যবসা – বাপী হোসিয়ারীর মালিক তিনি। সেসময় বাপি গেঞ্জি জাঙিয়া হোসিয়ারীর জগতে আজকের দিনের অবাঙালি মালিকানার প্রতিষ্ঠান লাক্স কোজি আর ডলার বিগবসের তুলনায় কম নামী ছিল না। বাঙালি হোসিয়ারী প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম বড় নাম বাপী। পুরনো কলকাতার বনেদী অঞ্চল ছিল শোভাবাজার আর তার খুব কাছেই এই নাথের বাগান স্ট্রীট। কথামৃতে আছে শ্রীরামকৃষ্ণ এই নাথের বাগান স্ট্রীট দিয়ে বহুবার যাতায়াত করেছেন। সারাজীবনে বহুবার শুনেছি মার মুখে এই তথ্য বলে আনন্দ করতে। এ বাড়িতেই চিত্তরঞ্জন ও ঊষারানী মা, ভাই ও সাত ছেলেমেয়ে সহ বহু বছর ধরে থাকতেন। গোপাল কুন্ডুদের পরিবারের সঙ্গে খুব হৃদ্যতা জন্মে যায় সবার। ও বাড়ির সেজ ছেলের সঙ্গে এ বাড়ির বড় মেয়ের মধ্যে পড়াশোনার ফলাফল নিয়ে রেষারেষি ছিল। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে পড়বার সময় কে বেশি ভাল ফল করবে তা নিয়ে কম উদবেগ ছিল না দুপক্ষের।
ব্যবসা তখন মধ্যগগনে। লক্ষ্মী উপচে পড়ছে। নিমতলার কাঠের ব্যবসায়ী মহলে সবাই একডাকে চেনে তাঁকে। যাদবপুরে জমি কিনে বাড়ি তৈরী করা শুরু করলেন। সদ্য স্বাধীন দেশে তখন রোজ কাতারে কাতারে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আসছে। দেশ গাঁয়ের যত চেনা লোক আসছে তাদের সবার ঠিকানা তখন নিমতলা স্ট্রীটের পাল ব্রাদার্স। পরিবার নিয়ে এক কাপড়ে চলে এসেছে। কোথায় থাকবে? কেন! চিত্ত পালের গদি! হ্যাঁ। রাতে গদিতেই শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন চিত্ত পাল আর খাবার ব্যবস্থা নাথের বাগানের বাড়িতে। সারাদিন বড় বড় হাঁড়ি উপুড় করে ভাতের মাড় গালা হচ্ছে, সারাদিন পাত পড়ছে লোকের। সেই ছোটখাট হাসিমুখের স্বল্পভাষী ঊষা সবাইকে রেঁধে বেড়ে খাইয়ে যত্ন করে কাজে পাঠাচ্ছেন। সাহায্য বলতে ফাইফরমাশ খাটার একটি বিহারী ছেলে-ভীম। ব্যস। দিনের বেলা কেউ কাজ খুঁজতে বেরোচ্ছে, কেউ পড়াশুনো করছে, রাতে ঠিকানা গদি। বিনি পয়সায় এমন সুবিধা কোথায় পাওয়া যাবে! ব্যবসায়ী পরিবারে যারা থাকে জানে ব্যবসার কারণেই সারাক্ষণ লোকজনের আসা লেগেই থাকে, তার মধ্যে শরণার্থীর চাপ। এতটুকু বিশ্রাম নেই, এতটুকু নিরিবিলি নেই। তাতে কি স্বামী স্ত্রী হাসিমুখে করে যাচ্ছেন সব। এমনকী শোওয়ার জায়গাও অপ্রতুল সাত সাতটি ছেলেমেয়ে, মা, ভাই, স্বামীস্ত্রী আবার এত আত্মীয় বন্ধু। লোকে বলত – “এইটা য্যান ধর্মশালা, এইখানে আইলে সকলের লগে দ্যাখা হইয়া যায়।” সত্যিই তাই। দেশে থাকতেও সম্বছরে যাদের দেখা মিলত না কলকাতা শহরে তাদের সবার ঠিকানা চিত্ত পাল। রোজ দুবেলা চল্লিশ পঞ্চাশ জনের পাত পড়ত বাড়িতে। আমি যখন মামাবাড়িতে যেতাম তখন সে বহু বছর পরের কথা। সকলেই প্রায় যে যার জীবনে দাঁড়িয়ে গেছে। তখনও পাত পড়ত ১৫/ ১৬ জন মানুষের, যাদের অর্ধেকই দাদুর এক্সটেন্ডেড পরিবারের মানুষ। মানে ওই বাংলাদেশ থেকে আসা গ্রামতুতো আত্মীয়েরা। আর অত বছর আগে তখন ১৯৬২ সম্ভবত, খাদ্য আন্দোলন শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ’৬৪ সালে আমার বাবা মায়ের বিয়ে হয়। বাবা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারে খাদ্য বিভাগে কর্মরত। চাল নেই বাজারে। মুখ্যমন্ত্রী রুটি খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। মামাবাড়িতে আমার বাবা ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিলেন বেশ কটি চালের বস্তা। সে জিনিষ কাদের সেবায় লেগেছিল? সেই সব আশ্রিত আত্মীয় পরিজনের এক্সটেন্ডেড পরিবারের মুখে অন্ন জোগাতেই।
দাদুভাই দু হাতে উপার্জন করতেন, দশহাতে ব্যয় করতেন। সে বাড়িতে থেকে আর কঠোর পরিশ্রম করে বাংলাদেশ আগত সেসব আত্মীয় বা গ্রামতুতো সম্বন্ধের মানুষজনেদের কেউ পরবর্তী কালে ভারত সরকারের চিফ ইঞ্জিনীয়ার হয়েছেন, কেউ বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আপন পর কোন বিচার ছিল না চিত্তরঞ্জনের। আজ এর ব্যবসায় মূলধন লাগবে দিলেন তাকে টাকা, কাল ওর মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না দিলেন তাকে টাকা, এভাবে মুঠো মুঠো দান করছেন তিনি। এরকমই কোন একটি সাহায্যের কারণে বড় একটা টাকার দরকার পড়ল, বিক্রি করে দিলেন ভিত হয়ে যাওয়া যাদবপুরের জমি। ঊষার বুকে বেজেছিল খুব। নিজের বাড়ির শখ কার না হয়! দুজনেই তো প্রায় অনাথ ছোটবেলা কাটিয়েছেন। কিন্তু চিত্তরঞ্জনকে ঠেকাবে কে! লোকে হাত পাতলে তিনি দেবেনই। ততদিনে নাথের বাগানের ভাড়া বাড়ি থেকে উঠে এসেছেন হরচন্দ্র মল্লিক লেনের ভাড়াবাড়িতে। পরে অবশ্য নবদ্বীপে স্বরূপগঞ্জে জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন। অনেক পরে সে বাড়িও বিক্রি করে দিতে হয়। এরই মাঝে বোন অসুস্থ হয়েছে খবর পেয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে বনগাঁ সীমান্তে বোনাই-এর বাড়ি গেলেন দেখা করতে গেলেন। চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসার সময় পথে অ্যাপেন্ডিক্স বার্স্ট করে সে মারা গেল। মর্মাহত দাদা ফিরে এলেন সঙ্গে বোনের তিনটি ছেলেমেয়ে। তাদের মা মারা গেছে, বাবা নিষ্কর্মা, বাপ তাদের দায় নেবে না। কে নেবে? কেন! চিত্তরঞ্জন পাল!
মা মারা গেলেন। শিশু চিত্ত মাকে ঘিরেই জগত চিনেছেন। বাবা তো কোন শৈশবে চলে গেছেন। অশৌচ পালন করবেন। অত্যন্ত সাধারণ জীবন ছিল তাঁর সারাটা জীবন। এক জোড়া ধুতি আর একজোড়া পাঞ্জাবি। শখের মধ্যে অনর্গল ঠোঁটে দামী সিগারেট আর প্রসাধনের মধ্যে বোরোলীন। আর বিয়েবাড়ি গেলে পাঞ্জাবির হাতা গিলে করানো হত। ব্যস এটুকুই। অশৌচ মানে কৃচ্ছ্রসাধন অতএব চেইন স্মোকার চিত্তরঞ্জন একমুহূর্তে সিগারেট বর্জন করলেন। বাকী জীবনে আর কখনও সিগারেট মুখে তোলেন নি।
কিন্তু আমি তো দেশভাগের কথা লিখতে বসেছি। ব্যক্তি চিত্তরঞ্জনের পরিণতির কথা লিখব কীভাবে বুঝতে পারছি না। এটুকু নিজের চোখে দেখা মূলধন তুলে সাহায্য করার পরিণতিতে আর্থিক অবস্থা অনেক পড়ে যায় শেষ জীবনে। অবশ্য সন্তানদের চাকরি বা বিবাহ ইত্যাদি সাধারণ কর্তব্য সবই করা হয়েছিল তাঁর। মৃত্যুর দু বছর আগেও দেখেছি ঠিক এক জোড়া ধুতি ও পাঞ্জাবি ছিল তাঁর। উপহার কেউ দিলে তা তোলা থাকত ততদিন, যতদিন না বর্তমান দুটি ধুতির একটি ছিঁড়ে যায়। সে পোশাকও নিজে হাতে কাচতেন আজীবন। ঝকঝকে শৌখিন মানুষটির বৃদ্ধ বয়সেও রূপ উপচে পড়ত। আর মুখে ছিল অনাবিল হাসি। শুধু শেষ তিনটি বছর সে হাসি মুছে গিয়েছিল। মাত্র চার মাস ক্যান্সারে ভুগে ঊষা মারা গেলে বাকী তিন বছর চিত্তরঞ্জনের মুখে আর হাসি ফোটে নি। ১৯৯২ সালে বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের পর যখন কার্ফু চলছিল কলকাতায় সেরকম এক দুপুরেই তিনি মারা যান অকস্মাৎ। সেদিনও সংসারের জন্য বাজার করে এনেছিলেন। তার একটু পরেই জাস্ট শুয়ে পড়েন। আমার সাধারণ দাদুভাই- আমার অসাধারণ প্রিয় আদর্শ এই মানুষটি।