
খাভিয়ের সেরকাস। সাম্প্রতিক স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম প্রধান নাম। ম্যাজিক রিয়েলিজম-এর ধারায় বিশ্বাসী নন তিনি। বরং মনে করেন রিয়েলিজম-এর মাঝেই ঝিলিক দেয় ম্যাজিক। তাঁর লেখালিখি আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক। সেরকাসের বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘সোলদাদোস দে সালামিনা’ (সালামিনার সৈনিকেরা) পড়লেন স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক ও তরজমাকার জয়া চৌধুরী।‘এইভাবে, বুদ্ধিদীপ্ত মননে চিন্তায় উন্মাদ ও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সূক্ষ্মভাবের কবি, ফ্যাসিস্ট ভাবাদর্শে বিশ্বাসী, ফ্রাঙ্কোর সরকারে ভবিষ্যতের মন্ত্রী রাফায়েল সাঞ্চেজ মাসাস সেখানে পড়েছিলেন। একটা গুলি এসে পৌঁছোলেই যার অনিবার্য মৃত্যু হবে। কিন্তু সেই গুলিটি এসে পৌঁছল না। আর সাঞ্চেজ মাসাস? তিনি যেন ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। যেন মরণের ওপার থেকে স্বপ্নে মনে করছিলেন সবকিছু। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যা দেখছেন। বৃষ্টির ভেতর ধীর পায়ে সৈনিকটি গর্তের কিনারা পর্যন্ত হেঁটে এল। সে এমন বৃষ্টি যেন কখনও থামবে না, ঠিক যেন সৈনিকদের পায়ের নিরন্তর ভেসে আসা দুপদাপ শব্দ আর কামান ভরা গাড়ির চাকার আওয়াজের মতন অনর্গল। আর মাত্র কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে সে। রাইফেলের নল তাঁর দিকেই তাক করা, অচঞ্চল, অনুসন্ধানী দৃষ্টি, ঠিক যেমনটা শিকারি তার প্রথম শিকার ঠিক করে ফেলার পরক্ষণে থাকে। গর্তটার কিনারায় আসার মুহূর্তে ঘাসের ওপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ ছাপিয়ে কানে এল একটা চিৎকার —
“ওখানে কেউ আছে?”
তাঁকে দেখছিল সৈনিকটি, সাঞ্চেজ মাসাস নিজেও ওকে দেখছিলেন। কিন্তু তাঁর বুজে আসা চোখ ওকে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না কী দেখছে। ভেজা চুল, চওড়া কপাল আর ভ্রূময় বৃষ্টির ফোঁটা-মাখা সৈনিকের চোখে করুণা বা ঘৃণা কোনোটাই ছিল না, এমনকি তাচ্ছিল্যও নয়। বরং একটা গোপন, প্রায় অতল আনন্দ ছিল। এক ধরনের নিষ্ঠুরতায় সৌন্দর্য মাখানো যেখানে কারণকেও বাধা দিতে পারা যাচ্ছিল না আবার সেটাকে ইনস্টিংক্ট-ও বলা যাবে না। রক্তে অন্তর্গত এক অন্ধ গোঁয়ার জেদ যেরকম আচরণ করে, যা পৃথিবীর কক্ষপথে থাকার মতো অনড়, যেভাবে সমস্ত একগুঁয়ে জিনিস যেমনকার তেমনটি থেকে যায়, স্রোতে থাকা পাথরকে যেমন এড়িয়ে যায় জল, ঠিক তেমনই পিছলে যাওয়া কিছু শব্দের মতো সেটা। কেননা শব্দ বলা হয় কিছু কথা বলবার জন্য। যা অবোধ্য তাকে বোধ্য করে তুলতে। এভাবে বলা যেতে পারে যে আমাদের যা পরিচালনা করে কিংবা বাঁচিয়ে রাখে অথবা উদ্বেল করে তোলে না হলে আমরা কিংবা এই অনামি সৈনিকটি যে নিজে পরাজিত, যে এই মুহূর্তে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে যার শরীর সেই সকালে মাটি ও জলের মধ্যে মিশে প্রায় অচেনা হয়ে উঠেছে। বাদামি কাদামাটির দিকে চেয়ে তারপর একবারও সাঞ্চেসের দিকে না তাকিয়ে আকাশে মুখ তুলে চিৎকার করে বলে ওঠে সৈনিক —
“এখানে কেউ নেই!”
তারপর পেছন ফিরে চলে যায়।’
স্পেনের সাহিত্যিক খাভিয়ের সেরকাসের বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘সোলদাদোস দে সালামিনা’ (সালামিনার সৈনিকেরা) থেকে কিছু লাইন তুলে ধরলাম পাঠকের কাছে।
স্পেনের সাহিত্যিক খাভিয়ের সেরকাস (জন্ম ১৯৬২)।
স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের শেষ পর্বে ১৯৩৯ সালে ফ্রাঙ্কোর সেনা যখন বার্সিলোনা শহরের দখল নেয় তার ঠিক চারদিন আগে সান্তা মারিয়া দে কোললেল অভয়ারণ্যে উপরে উল্লিখিত ঘটনাটি ঘটেছিল। অন্যদের মতো আমারও ভাসা ভাসা ধারণা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে স্পেনে একটি গৃহযুদ্ধ হয়েছিল, যেখানে যুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতেই ফেদেরিকো লোরকা খুন হয়েছিলেন, কিংবা শেষের দিকে আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় মারা যান আন্তোনিও মাচাদো। বাঙালি পাঠক তো স্পেনকে চেনেই এইসব দিকপাল সাহিত্যিকদের মাধ্যমে।
সঠিকভাবে বলতে গেলে ১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারির কোনো এক দিনে ফ্রান্সের কোলিউরের এক হোটেলে ফ্রাঙ্কোর ন্যাশনালিস্ট দলের কাছে রিপাবলিকান দলের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী—এমন বিশ্বাসেই ভেঙে পড়ে মারা যান আন্তোনিও মাচাদো। তাঁর প্রাণের প্রিয় ভাই, আর-এক বিখ্যাত কবি মানুয়েল মাচাদোকেও ফ্রাঙ্কোর দল আগেই গ্রেপ্তার করেছিল। তিনি তখন পোর্তুগালে ছিলেন। ভাইয়ের সঙ্গেও তাঁর আর কখনও দেখা হয়নি। মারা যাবার ঠিক এক মাস আগে ফ্রাঙ্কোর ন্যাশনালিস্ট দল যখন বার্সিলোনা দখল করে নেয় তার চার দিন আগে রিপাবলিকান দলের সমর্থক আন্তোনিও, বিধ্বস্ত, হতাশ, বৃদ্ধ, নিজের মা ও ছোটো ভাই খোসেকে নিয়ে সীমান্ত ডিঙিয়ে ফ্রান্সে পালিয়ে যান। সঙ্গে আরও কয়েকজন লেখক ছিলেন—কোর্পাস বার্গা, চার্লস রিবা ইত্যাদি। আন্তোনিওর মৃত্যুর তিনদিন পরে তাঁর মা প্রয়াত হন। ছোটো ভাই খোসে তাঁর চামড়ার ব্যাগে একটুকরো কাগজে লেখা মাচাদোর অন্তিম কবিতার ক-টি লাইন উদ্ধার করেন—“এইসব নীল নীল দিনগুলি/ শৈশবের এই সূর্য”... এইসব বেদনাময় সত্যকথনের কথা গোটা পৃথিবী জানে।
কিন্তু গৃহযুদ্ধের সময় স্পেনে স্রেফ ন্যাশনালিস্ট ও রিপাবলিকান দুটি রাজনৈতিক মতই ছিল না, সেখানে ফালাঙ্গিস্ট রাজনৈতিক মতেরও বিশাল ভূমিকা ছিল। রাফায়েল সাঞ্চেজ মাসাস ছিলেন সেই দলের দর্শনের প্রবক্তা। এই দর্শনটি নিয়ে দুটি মত চালু। একদল বলেন এটি সম্পূর্ণ ভাবে ফ্যাসিস্ট দর্শনে বিশ্বাসী, আর-একদল বলেন পরবর্তী কালে ফ্রাঙ্কো জমানায় এটি সেপথ থেকে সরে গিয়ে কর্তৃত্ববাদী কনজারভেটিভ দর্শনে পরিণত হয়। যদিও তারা ক্যাথলিজমে বিশ্বাস করত সেইসঙ্গে আবার সমাজে চার্চের সরাসরি হস্তক্ষেপের বিরোধিতাও করত। স্পেনের গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য তারা স্পেনের একতায় বিশ্বাস করত, আঞ্চলিক বহুত্বকে মানত না। যেটি আবার সরাসরি রিপাবলিকানদের দর্শনের বিরোধী। তারা প্যানহিস্পানিক মতের প্রচারক ছিল। যেখানে স্পেন ছাড়াও স্প্যানিশভাষী দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলার কথা বলত। এ মতের মূল প্রচারক ছিলেন খোসে রিভেরা। রাফায়েল সাঞ্চেস তাঁর সঙ্গেই মিলে এটির দর্শন লেখেন। এক কথায় তাঁরা ডান ও বাম দুই দলের কাছেই শত্রু বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন। এমত অবস্থায় পৃথিবীর কাছে তুলে ধরা জরুরি ছিল এই দলিল।
আমরা কোথা থেকে এসেছি এই শিকড় জানা হল সভ্যতার প্রথম শর্ত। স্পেনের গৃহযুদ্ধ মানে যে কেবল কালো ও সাদা দুটি দলের লড়াই নয়, তার একটি মধ্যপন্থার মতও ছিল, যার সন্ধান বাকি বিশ্বের কাছে প্রায় অজানা ছিল অথবা স্রেফ কিছু তথ্য হয়ে রয়ে গিয়েছিল, সেই ইতিহাস পুনরুদ্ধারের কঠিন কাজটি করেছেন লেখক। শুধু তাই নয় সেটিতে প্রাণ দিয়ে দুর্গাপ্রতিমায় চক্ষুদান করে প্রাণ আনার মতো অসম্ভব আন্তরিক ভঙ্গিতে সাজিয়ে দিয়েছেন পাঠকের কাছে। বইটি যে নিপুণ পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাসে অসম্ভব পরিশ্রম করে তুলে আনা হয়েছে তা ভাবা যায় না। অথচ এক মুহূর্তের জন্যও একঘেয়ে লাগে না। মনে হয় যেন থ্রিলার পড়ছি। জীবন কখনও নাটকের চেয়েও বেশি ঘটনাবহুল সেকথা খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেখান লেখক, যার ভেতরে লুকিয়ে আছে আসলে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ও দেশের প্রতি মমতা।
উপরের এই অংশটি ছিল ইতিহাসের তথ্য। কীভাবে প্রায় অলৌকিক ভাবে সাঞ্চেজ মাসাস বেঁচে যান রিপাবলিকানদের হাত থেকে, কীভাবে রিপাবলিক দলের সমর্থক একটি পরিবারই তাঁকে বাঁচায় সে এক অবিশ্বাস্য গল্প। কিন্তু তা গল্প নয় জীবনই বটে। লেখক নিজে একটি সাংবাদিকের চরিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন এখানে। একবারও মনে হচ্ছে না কিছু আরোপিত, কিছুই কল্পিত। মনে হচ্ছে যেন ঘটনাগুলি একটার পর একটা ঘটছে। বইটি তিনটি পর্বে সাজিয়েছেন তিনি। —জঙ্গলের বন্ধুরা, সালামিনার সৈনিকেরা, এবং শেষে স্টকহোমের অ্যাপয়েন্টমেন্ট এই তিনটি পর্ব। বইটা পড়লে দেখা যাবে প্রথম পর্বটি যেন অনুসন্ধান ও সলতে পাকানোর কথা যেটি না পড়লে আগ্রহ জাগে না। দ্বিতীয় পর্বটি সম্পূর্ণ ভাবে সাঞ্চেসের অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ার পরের অংশটুকুর প্রতি আলোকপাত। কীভাবে তিনি গৃহযুদ্ধের পরে ফ্রাঙ্কোর দলের মন্ত্রী হয়ে যান এবং তাও আবার দফতরবিহীন মন্ত্রী। এবং মাত্র একবছরের মধ্যেই তাঁর পদত্যাগ ও অনেক বেশি করে লেখালেখির জগতে ডুবে যাওয়া। আমরা যখন ইতিহাস পড়ি, তখন ঝোঁক এসে যায় ঐতিহাসিক চরিত্রের পক্ষে যুক্তি সাজানোর। খাভিয়ের এখানে কিচ্ছুটি তেমন করেননি। রাজনৈতিক জীবনের আগে সাঞ্চেজ মাসাস যে একজন সাধারণ ছাত্র ও কবি ছিলেন এবং ফ্রাঙ্কোর মন্ত্রীসভায় মন্ত্রী হয়ে যান সে তথ্য দেবার সময়েও কোনো আড়ম্বর করেননি বা মিথ্যা যুক্তি সাজাননি। স্রেফ ঘটনা বলে গেছেন, পাঠককে ভার দিয়েছেন চরিত্রটিকে চেনবার। এখানে ব্যক্তিমানুষের পূজা নয়, স্পেনের ইতিহাস উদ্ধার করার আন্তরিকতা দেখতে পাই লেখার ভেতরে।
প্রাচীন গ্রিসের সালামি খাঁড়িতে ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক ও পারসিদের মধ্যে এক নৌযুদ্ধ ঘটেছিল। পারস্য সম্রাট জেরক্সেস গ্রিস দখল করবার জন্য দফায় দফায় যুদ্ধ করেছিলেন। এবং এই সালামির নৌযুদ্ধেই তাদের শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটে। সেই গৌরবকাহিনি স্মরণ করেই লেখক এই উপন্যাসের নামটি দিয়েছেন। যদিও উপন্যাসের ভেতরে তিনি বলেছেন যে সাঞ্চেসের নিজের ইচ্ছে ছিল গৃহযুদ্ধের বর্ণনা করে এই নামে একটি উপন্যাস লিখবেন। আদতে কোনোদিনই এমন নামের কোনো বই তিনি লিখে যাননি। মন্ত্রীসভায় থাকাকালীন ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য হয়। তিনি মন্ত্রীপদ ছাড়েন এবং লেখায় পুরো ডুবে যান। এই পর্বে তাঁর সম্ভবত সেরা লেখা হয়েছিল ছোটোগল্প সংকলন Las aguas de Arbolea y otras cuestiones (আর্বোলেয়ার জল এবং অন্যান্য প্রশ্নগুলি), ১৯৫৬। এইসময় প্রচুর প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লেখেন তিনি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি স্পেনীয় সাহিত্যে একটি বিশেষ জায়গায় চলে যান।
অন্য যে-কোনো লেখক বইটি এখানেই শেষ করে দিতে পারতেন। কিন্তু এখানেই আসল মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন লেখক। সেদিন কোন্ রিপাবলিকান সৈনিক ফালাঙ্গিস্ট রাফায়েল সাঞ্চেস মাসাসকে গুলি না করে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাঁকে খুঁজে বের করে এনেছেন। তিনি বার্সিলোনার সৈনিক রিপাবলিকান আন্তোনি মিরাইয়েস। গৃহযুদ্ধের পরে তিনি ফ্রান্সে চলে যান। ফ্রাঙ্কোর স্পেন ছেড়ে যে সাড়ে চার লক্ষ স্পেনীয় দেশ ছাড়েন, ইনি তাঁদের মধ্যে একজন। তবে প্রথম থেকে নয়, গৃহযুদ্ধের পরে তিনি বাম রাজনীতির সমর্থক হন। তারপর তিনি জার্মানির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের হয়ে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকেন। আট বছর যুদ্ধের পরে আকস্মিক ভাবে বেঁচে যান। পরে বাকি জীবন ফ্রান্সেই থেকে যান। লেখক প্রায় গোয়েন্দাসুলভ দক্ষতায় প্রমাণ করেন এই পর্বে যে মিরাইয়েস ছিলেন রিপাবলিকান দলের সেই সৈনিক, যারা তখন ফালাঙ্গিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। সেদিন তিনিই রাফায়েল সাঞ্চেসকে ধরতে পেরেও ছেড়ে দেন। যদিও মিরাইয়েস কখনও এটি স্বীকার করেননি, আবার কখনও তার বিরোধিতাও করেননি। বইটি এখানেই একটি ফিকশন হয়ে যায়। তবু এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। কারণ এই পর্বে লেখক নানান ঘটনা ও তথ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন সাঞ্চেস মাসা ও মিরাইয়েস দুজনেই পৃথক ভাবে যে যে ঘটনা কথা বলেছেন সব ক-টি সূত্র মিলিয়ে দেখলে এটা ভাবাই সম্ভব যে সেদিন মিরাইয়েস সাঞ্চেজ মাসাসকে প্রাণ দিয়েছিলেন। যদিও বইটি বের হবার পরে স্পেনে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়, কিন্তু কাতালুনিয়ায় তুমুল ঝড় ওঠে। কারণ স্বাভাবিক। বার্সিলোনাবাসীরা মজ্জাগত ভাবে বাম আদর্শে বিশ্বাসী, এবং সে কারণেই রিপাবলিকানদের সমর্থক। কিন্তু গোটা বইতে খাভিয়ের কোথাও দাবি করেননি ইতিহাস লিখছেন। বলেছেন তিনি গবেষণা করে এতদূর ঘটনাগুলি সাজিয়ে দিয়েছেন পাঠকের কাছে। বিচার তো তাঁরা করবেন। গৃহযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাস লেখা হয়েছিল রিপাবলিকানদের দৃষ্টি দিয়ে। ফ্রাঙ্কো গৃহযুদ্ধ জিতেছিলেন ঠিকই কিন্তু সব প্রগতিশীলদের, বুদ্ধিজীবীদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন চিরকালের মতো। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে কয়েনের দুটি দিকই দেখানো দরকার। কোথাও তো লেখা দরকার ছিল সেসময় ন্যাশনালিস্টরা কিংবা ফালাঙ্গিস্টরা কী করেছিলেন। ২০১৪ সালে আনা ম্যাকলেন এটি ইংরিজিতে অনুবাদ করেন। তার আগের বছরেই স্পেনে এটি সিনেমা হয়ে গিয়েছিল। ডেভিড ট্রুয়েবা সেটি নির্দেশ দেন। এবং সিনেমাটিও সে বছর শ্রেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফির পুরস্কার পায় সে দেশে, পরে কান চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ উল্লেখ্য বিভাগে প্রদর্শিত হয়।
খাভিয়ের সেরকাস কিন্তু এটিই প্রথম লেখা লেখেননি। সোলদাদোস দে সালামিনাস প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। তাঁর প্রথম বই ছিল ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত একটি উপন্যাসিকা El Movil (মোবাইল)। এ বই থেকে বহু পরে ২০১৭ সালে El Autor বা ‘লেখক’ নাম দিয়ে সিনেমা হয়। সেটিও প্রশংসিত হয় বহু উৎসবে। ১৯৮৯ সালে লিখেছিলেন El Inquilino (ভাড়াটে)। ১৯৯৭ সালে লেখে উপন্যাস El vientre de ballena (তিমি মাছের পাকস্থলী)। সেরকাস তখন সাংবাদিকতা করছেন স্পেনের এল পাইস পত্রিকায়। তখন তিনি সাক্ষাৎকার নিতে যান বিশ্ববিখ্যাত চিলিয়ান লেখক রোবের্তো বোলান্যিওর। তিনিই তাঁকে দেখে মনে করেন সেই বই দুটির কথা, যা পড়ে তাঁর ভালো লেগেছিল। সেরকাস অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে যান সে কথা শুনে। বোলান্যিও তখন বিশ্বে আদৃত লেখক, তিনি একজন অচেনা লেখকের লেখা পড়েছেন এবং মনেও রেখেছেন—একজন তরুণ লেখকের কাছে এর চেয়ে আনন্দের আর কীই হতে পারে। এই বোলান্যিওর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং তাঁর কাছ থেকেই বৃদ্ধ মিরাইয়েসের কথা জানতে পারেন। এবং সেখান থেকেই খোঁজ করে অবশেষে সালামিনার সৈনিক উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব লেখেন।
খাভিয়ের সেরকাস এমনিতেও রাজনৈতিক লেখালেখির দিকে উৎসাহী বেশি। এল পাইস পত্রিকায় তাঁর নিয়মিত প্রবন্ধ বের হয়। সেগুলিও রীতিমতো মনোগ্রাহী। জুলাইয়েই এক রবিবার পড়লাম তাঁর সদ্য লেখাটি। যেখানে একটা মজার কথা এখানে তুলে ধরবার লোভ সামলাতে পারলাম না। “...বুড়োরা সবাই বলে আগের দিন কত ভালো ছিল, এখন সবাই কত জটিল হয়ে গেছে...ইত্যাদি। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। আসলে আগে আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল না তাই কে মন্দ মনোভাব নিয়ে চলছে তা বুঝতে পারতাম না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বোঝার ক্ষমতা বেড়েছে কে চালাক বা কে বিপজ্জনক ইত্যাদি। কাজেই যে চালাকি বা ভালোমানুষি এখনকার পৃথিবীতে দেখছি আগেকার পৃথিবীতেও সেগুলি ছিল। অভিজ্ঞতা ছিল না বলে আমরা তা তফাৎ করতে পারতাম না...” ইত্যাদি।
বাঙালি পাঠকেরা আটের দশকের শুরু থেকে মার্কেজের সূত্রে এবং তা ছাড়াও আলেখো কার্পেন্তিয়ের, মিগেল আঙ্খেল আস্তুরিয়াস বা পরবর্তীকালের ইসাবেল আইয়েন্দের হাত ধরে ম্যাজিক রিয়ালিজমের অসম্ভব অনুরাগী। গত বছর আমি ম্যাজিক রিয়ালিজম গল্পের যে অনুবাদ বইটি প্রকাশ করেছিলাম তার বিক্রি দেখেই অনুমান করা যায় এখনও কত তীব্র সেই অনুরাগ। কিন্তু সেরকাস ম্যাজিক রিয়ালিজমে বিশ্বাসী নন। তিনি রিয়ালিজমের মাঝে ম্যাজিক ঝিলিক দেয় বলে বিশ্বাস করেন। তাঁর লেখার ধরনে সেটিই ফুটে ওঠে। অসম্ভব গবেষণা করা লেখা অথচ সূক্ষ্ম হিউমারে ভরতি সে লেখা। আয়রনি আর আত্মজীবনী—এই দুটি স্টাইল একসঙ্গে মিশে থাকে তাঁর লেখায়। La Velocidad de la luz (আলোর গতিবেগ) তাঁর পঞ্চম উপন্যাস। বরাবরকার মতোই এই বইয়ের পিছনেও তাঁর গভীর গবেষণা আছে। মার্কিন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের বেশ কিছু সত্য ঘটনা আশ্রয় করে উপন্যাসটি বিস্তার ঘটেছে। ইলিওনিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দু-বছরের অধ্যাপনার সময় আলাপ হয়েছিল কয়েকজন ভিয়েতনাম-ফেরত যোদ্ধার সঙ্গে। সেখান থেকেই সূত্র তুলে আনা। বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত এই উপন্যাসটি এই মুহূর্তে বেশ ক-টি ভাষায় অনুবাদের কাজ চলছে। তাঁর আরও বেশ ক-টি উপন্যাসের নাম এখানে অনুল্লেখিত রইল। যথেষ্ট বড়ো লেখা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। আগ্রহী পাঠক খোঁজ করলে ইংরেজিতে অনূদিত কিছু বইয়ের সন্ধান পাবেন। এই মুহূর্তে বিশ্বসাহিত্যে খাভিয়ের সেরকাস স্পেনের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি। স্বয়ং মারিও ভার্গাস ইয়োসা যার লেখা নিয়ে উচ্ছ্বসিত। ২০০৯ সালে আর-একটি অসাধারণ উপন্যাস লেখেন সেরকাস। Anatomia de instante (মুহূর্তের ব্যবচ্ছেদ)। ১৯৮১ সালে স্পেনে একটি ক্যু হয়। তাঁর ওপরে লেখা এটি। সেরকাসের বইয়ের নিয়মিত ইংরেজি অনুবাদ করেন আনা ম্যাকলেন। পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে নাম দিয়ে দিলাম—1) Soldiers of Salamis 2) The Anatomy of a Moment 3) The Speed of Light 4) The Tenant and The Motive
মৌলিক মজুমদার | 2409:4066:16:c9c8::190b:***:*** | ২৪ আগস্ট ২০২০ ০০:৫১96587দারুণ লেখা
রঞ্জন | 122.176.***.*** | ২৪ আগস্ট ২০২০ ০৯:১৬96601এই লেখা পড়ে "সোলজার্স অফ সালামিস" এর কিন্ডল ভার্সন কিনে ফেললাম। অন্য ফরম্যাটের দাম আমার নাগালের বাইরে। পড়া শুরু করেছি।
ধন্যবাদ জয়া ম্যাম। জয় গুরু!
Jaya Choudhury | 202.8.***.*** | ২৩ অক্টোবর ২০২০ ২১:৩১98822Thank you readers.