“আমি ক্লান্ত আমার দেশবাসীকে প্রতিদিন মারামারি করে মরতে দেখে, বাচ্চাদের অস্ত্র নিয়ে খেলাধূলা করতে দেখে, গোলাগুলির মাঝখানে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পরিবারগুলি দেখতে দেখতে, আমি ক্লান্ত তাদের সকলের সমান সুযোগসুবিধা না-পাওয়া দেখতে দেখতে। দেশের মানুষের রোজকার রুটি হল উদাসীনতা। আমি ক্লান্ত দেখতে দেখতে কলম্বিয়া কীভাবে রক্তাক্ত হচ্ছে প্রতিদিন আর আমরা একে বাঁচানোর জন্য কিছুমাত্র চেষ্টা করছি না।” কলম্বিয়ার এই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক লাউরা রেস্ত্রেপোর একটি সাক্ষাৎকার থেকে এই লাইন ক-টি তুলে ধরলাম।
আমাদের এবারের উপন্যাসের পটভূমি বোঝানোর জন্য এগুলি জরুরি। ২০০৪ সালে কলম্বিয়ায় প্রকাশিত ‘দেলিরিও’ বা ‘প্রলাপবিকার’ (ইংরেজি তরজমায় Delirium) উপন্যাসটি আজকের আলোচ্য বই। কিন্তু তার আগে লেখক লাউরা রেস্ত্রেপোকে একটু চেনা যাক। লাউরা রেস্ত্রেপোর বেশ কিছু পাঠকনন্দিত উপন্যাস আছে। যার মধ্যে Dulce Compañía বা ‘মিষ্টি সঙ্গিনী’ উপন্যাসটির জন্য মেক্সিকোর সর খুয়ানা ইনেস পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তিনি জীবন শুরু করেছিলেন ন-বছর বয়সে একটি দুঃখের গল্প লিখে। চাষিদের দুর্দশা ছিল সেগল্পের বিষয়বস্তু। স্কুলজীবনের প্রথম দশ বছর লাউরা কোনো স্কুলেই একটানা পড়তে পারেননি। কারণ বাবার ব্যবসায়ের কারণে তার স্কুল বদলাতে হত। তা ছাড়া বাবার নিজেরও স্কুলের পড়াশোনায় তত বিশ্বাস ছিল না। তিনি নিজের চেষ্টাতেই ছ-টি ভাষা শেখেন। পরে অবশ্য দর্শনে ডিগ্রি নিয়েছেন। জীবন শুরু করেন সাংবাদিকতা দিয়ে তারপর ক্রমে ১৯৮৯ থেকে প্রকাশ করতে শুরু করেন উপন্যাস। প্রথম লেখা La isla de la passion ‘আবেগের দ্বীপ’। প্রায় নিয়মিত ব্যবধানে তিনি উপন্যাস লিখে গেছেন। শেষ প্রকাশিত উপন্যাস ২০১৮ Los Divinos (স্বর্গীয় দেবতারা / ইংরেজি তরজমায় The Divine Boys)। সেবছরই তিনি কলকাতা বইমেলায় এসেছিলেন। নবনীতা দেবসেনের লেখা সম্বন্ধে জানতে উৎসাহ প্রকাশ করেছিলেন। সুদূর কলম্বিয়ার লাউরা ও ভারতের নবনীতার সাহিত্যের আদানপ্রদানই পারে অনুবাদ সাহিত্যের পাঠকদের বিশ্বসাহিত্যের বিস্তৃত আস্বাদ দিতে। তবে এখন ‘দেলিরিও’ বা ‘ডিলিরিয়াম’ উপন্যাসটি নিয়ে লেখা যাক।
উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে আগিলারের বয়ানে। আগিলার চারদিনের বিজনেস ট্রিপ সেরে হোটেলে ফিরে দেখে তার স্ত্রী কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এই চরম নাটকীয় শুরু কিন্তু গল্পটিকে গতানুগতিক থ্রিলারের দিকে নেয় না। পাঠক আশ্চর্য হয়ে জড়িয়ে যায় ক্রমশ উপন্যাসের ভাঁজে ভাঁজে। আগুস্তিনা কেন এমন আচরণ করছে সেটা জানবার জন্য, আর স্ত্রীকে প্রকৃত ভালোবাসে বলেই আগিলার মরিয়া হয়ে খুঁজতে শুরু করে এ রহস্যের মূল। আর এখানেই জড়িয়ে যায় আশির দশকের কলম্বিয়ার করুণ আর্থ-সামাজিক পটচিত্র। কলম্বিয়ার নাম জানেন, দুনিয়ার খবর রাখেন, অথচ পাবলো এসকোবারের নাম জানেন না এমন মানুষ পাওয়া বিরল। নারকো-টেররিস্ট পাবলো এস্কোবারের জীবনী নিয়েই এতাবত বহু ফিল্ম নাটক বই লেখা হয়ে গেছে। একদিকে তার রবিনহুড ইমেজ আর অন্যদিকে আমেরিকা পর্যন্ত তার নিজের ড্রাগ ব্যাবসার এলাকা দখল রাখার স্বার্থে বেকার যুবসমাজকে ক্রাইমের মোহাচ্ছন্ন পথে অজগর সাপের মতো গিলছিল। কলম্বিয়া দেশটি স্বাধীনতার পর থেকেই নানান অন্তর্দ্বন্দ্বে জেরবার ছিল এবং একটা সময় দেশটি পৃথিবীর ক্রাইম রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল। লাউরা তার উপন্যাসটির চরিত্রের সঙ্গে এই মাফিয়া সর্দারের যোগাযোগ এত বিশ্বাস্য ভাবে উপস্থাপন করেন যে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না সামান্য একজন ড্রাগ ডিলার কীভাবে একটি জনসমাজকে কী চতুরতার সঙ্গে অধঃপতনের শেষ সীমায় নিয়ে গেছিল।
পাবলো এস্কোবারের মৃত্যু। শিল্পী ফেরনান্দো বোতেরো
মূল চরিত্র আগুস্তিনা। কিন্তু আরও তিনটি চরিত্র, সব ক-টি বেষ্টিত হয়েছে তাঁকে ঘিরেই। স্বামী আগিলার, প্রেমিক মিদাস ম্যাকআলিস্টার এবং আগুস্তিনার ঠাকুরদা জার্মান বংশোদ্ভূত নিকোলাস পোরতুলিনাস। আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে বলা উচিত উপন্যাসটির মূল চরিত্র হল ‘প্রলাপবিকার’। প্রধান চারটি চরিত্রের প্রত্যেকের দৃষ্টি থেকে লেখা এই উপন্যাসের শৈলী দারুণ মনোযোগ দাবি করে। এখানে ব্যবহার করেছেন অলটারনেটিভ ন্যারেটিভ। ‘আমি’-র প্রেক্ষিতে কোনো লেখা সবসময়েই কঠিন বলে মনে করি, উপরন্তু লাউরা কোনো চিহ্ন ছাড়াই কথোপকথন বা উক্তি রেখেছেন। এর ফলে পাঠক শুধু লেখাটি উপভোগই করেন না একই সঙ্গে জড়িয়েও পড়েন। কেননা এতটুকু শিথিল পাঠ হলে ফের বাক্যের গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। এটি খুব গভীর ভাবে মানবমন নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে। আগুস্তিনা কেন পাগল হয়ে গেল সে সমাধান খুঁজতে গিয়ে তিনি পাঠককে মনের গহনের প্রলাপের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। আগুস্তিনা তার বড়োভাইয়ের বন্ধু ম্যাকআলিস্টারের প্রেমে পড়ে যে কিনা পাবলো এরস্কোবারের ড্রাগ চোরাচালানের কাজে যুক্ত। তারা এত গভীর সম্পর্কে জড়ায় যে তাদের প্রায় সন্তান হয়ে যায়। স্বেচ্ছায় গর্ভপাত না করালে সন্তানই থাকত। অথচ তারপরে আগুস্তিনা আগিলারের প্রেমে পড়ে। আগিলার বয়সে ঢের বড়ো এবং উপন্যাস জুড়ে সে স্ত্রীর পাগলামির কারণ খুঁজতে চেষ্টা চালিয়ে যায়। অনেক পরে উপন্যাসটি ১০০ পাতা পেরিয়ে যাবার পরে পাঠক টের পায় তাদের একটি শিশু জন্মের সময় মারা যায়। এই মৃত্যুকেও লেখক প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করেছেন। কলম্বিয়া দেশটির নিজস্ব মানসিকতা কখনও না বুঝেই আগিলার আগুস্তিনার পরিবারকে ভালো ভাবে না চিনেই তার প্রেমে পড়ে। এ যেন অনেকটা বোঝানো যে কলম্বিয়ায় শান্তি ফেরাতে বাইরের দেশের অযাচিত সাহায্য এগিয়ে এলেও নিজেদের মধ্যে প্রকৃত বোঝাপড়া না এলে সে মিলন যথার্থ সমাধান ও শান্তি আনতে পারে না। আগুস্তিনা কিন্তু বিয়ের পরেও ম্যাকআলিস্টারের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যায়। অথচ ড্রাগ মাফিয়াদের কাছে তাদের সম্পর্কটি অনুমোদিত ছিল না। কারণ আগুস্তিনা রোগা মেয়ে এবং তার প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হয় ম্যাকের, যে কারণে ড্রাগ ব্যাবসায় যথেষ্ট মন দিতে পারে না। সেটি এই চক্রের কাছে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিকর। অর্থাৎ ড্রাগ ব্যক্তিগত সম্পর্কেও ছড়ি ঘোরাতে চায়। আগুস্তিনার দাদুর ভেতরেও পাগলামির আভাস ছিল এবং তিনি হতাশায় জলে ডুবেই আত্মহত্যা করেছিলেন। সেখানেও কলম্বিয়া ছেড়ে ওঁর জন্মভূমি জার্মানিতে ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষা অথচ ব্যর্থ সংগীতকার হয়ে না ফিরতে পারার যন্ত্রণা একটি বড়ো ভূমিকা নেয় আত্মহত্যায়। স্ত্রীকে সারিয়ে তুলতে তাকে সাহায্য করে তার মাসিশাশুড়ি সোফি। আগুস্তিনার বাবা এই শালীর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়েছিল। অর্থাৎ আগুস্তিনার ছোটোবেলা খুব জটিল ছিল যার প্রভাব চরিত্রে পড়েছিল। তার ভাই বিচি সমকামী ঝোঁকের হওয়াতে আগুস্তিনার বাবা প্রায়ই ভাইকে মারধোর করতেন। আর এই ভাইয়ের সঙ্গে আগুস্তিনার অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। দু-ভাইবোন অনেক তুকতাক তন্ত্রবিদ্যা অভ্যাস করত ছোটো থেকে। যে কারণে আগুস্তিনার মনে হত সে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। এই জটিল চরিত্রের মধ্যে তার পাগল হওয়ার শিকড় লুকিয়ে থাকে। পুরো উপন্যাস আরও অনেক বিস্তৃত এবং চরিত্র সমাবেশে ভরা। কিন্তু লেখার উপর অসম্ভব দখল থাকায় পাঠক প্রতি মুহূর্তে টানটান হয়ে লেখায় মগ্ন থাকতে বাধ্য হয়।
কলম্বিয়ার সাহিত্যে গত পঞ্চাশ বছরে অসংখ্য লেখা হয়েছে ক্রাইমের ওপর, কিন্তু এভাবে মনস্তত্ত্ববিদের মতো ডিটেইলিং-এ কোনো লেখা হয়নি। লেখার রীতি এত নির্দিষ্ট, নিয়ন্ত্রিত যে মনে হয় সম্পূর্ণ উপন্যাসটি আগেই ভেবে লিখেছেন। একটি শব্দ বাহুল্য নয়, অযথা উপমার ভার নেই, কিন্তু বিজ্ঞানের মতো টু দ্য পয়েন্ট ভঙ্গি ও উপন্যাসের মুন্সীয়ানা। যেমন ঘটনা এগিয়েছে পাঠকও তেমন অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠায় এগিয়েছে লেখকের সঙ্গে। উপন্যাসটি সেবছর আলফাগুয়ারা পুরস্কার পায় স্পেনে। বিচারক ছিলেন বিখ্যাত লেখক খোসে সারামাগো। বইটির পরের সংস্করণের ভূমিকাও তিনিই লিখেছেন। গার্সিয়া মার্কেস লিখেছেন, “লাউরা রেস্ত্রেপো সাংবাদিকতা, তদন্ত এবং সাহিত্যগুণ তিনটির সম্মিলন ঘটিয়েছেন এই উপন্যাসে। যে ডার্ক হিউমার রয়েছে লেখায় তা কলম্বিয়ার জনগণের তখনকার মানসিকতাকেই প্রকাশ করেছে। কখনো-কখনো হিউমার বিষাক্তও হয়ে উঠেছে। অথচ কোথাও কোনো মেলোড্রামা ঘটেনি।” সবচেয়ে বড়ো কথা উপন্যাস শেষও হচ্ছে সদর্থক ভাবে। একটি চিরকুটে আগুস্তিনা আগিলারকে লিখেছে “তুমি যদি এত কিছুর পরেও আমায় ভালোবাসো তাহলে লাল শার্টটা পরবে কাল।” আগিলার সবচেয়ে টকটকে লাল শার্ট পরেই নীচে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এগিয়ে যায়। কলম্বিয়াকে জানতে এটি পড়া দরকার।