“আমার প্রথম পাঁচটি বই ছিল এক সিম্বলিক সাহিত্যের বৃত্তের মতন। কারণ সে বইগুলোয় আমি নিজের নাভির দিকে চেয়েছি। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে আমার বয়সের, প্রজন্মের, দেশের এবং শহরের মেয়েদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ছিল আমার বিষয়। বিষয়টির সব দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় প্যানোরমার মতো লিখেছি আমি। আমার মনে হয় এই ভাবনাটাই খুব বিশেষ। কারণ আমি ১৯৬০ সালে জন্মেছি। বয়ঃসন্ধির মতো জীবন কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল এক বয়ঃসন্ধির শহর ও বয়ঃসন্ধির দেশে বসে।... আমাদের প্রজন্মের মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ঢের বেশি আগ্রহ উদ্দীপক ছিল। কারণ আমার যখন কুড়ি বছর বয়স অন্যান্য দেশগুলিতে আমার বয়সী মেয়েদের মায়েরা তখন ব্রা পোড়াচ্ছেন আর আমরা রয়ে গেছি উনিশ শতকে। ১৮৫১ সালের পেনাল কোড নির্ধারিত করছে আমাদের অধিকার। মেয়েদের অর্থ থাকতে পারবে না, ব্যাংক আকাউন্ট থাকতে পারবে না, পরকীয়া মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ পাপ আর ছেলেদের জন্য জরিমানা দিলেই মুক্তি পাবার মতো বিষয়।... আমাদের সামনে সমাজে কোনো আদর্শ ছিল না। আমার নিজের মায়ের মধ্যেও কোনো আদর্শকে খুঁজে পাইনি। যে কারণে আমার Modelos de mujer (আদর্শ নারীরা) বইতে আমি প্রস্তাব দিয়েছি আদর্শ নারী হল তারাই যারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় নারী।... আমাকে লোকে মেয়েদের সাহিত্য লিখি বললে আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু তারা আমাকে এটা দেখাতে পারে না পুরুষদের সাহিত্য কোন্টা। কারণ তারা ধরেই নেয় ওগুলো মানুষ জাতির সাহিত্য, অতএব আলাদা করে উল্লেখ করার দরকার নেই। মেয়েদের সাহিত্য যেন একরকম নীচের সারির ব্যাপার এবং সে কারণেই মেয়েদের সাহিত্য তকমাটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমি মনে করি সাহিত্যের বিপুল জগতে মেয়েদের জয় এসেছে সাহিত্যের প্রতি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির জয়ের হাত ধরে। কেননা মেয়েরা তো চিরকালই লিখেছে।”
এ কথাগুলি যাঁর বলা তিনি হলেন সমসময়ের স্পেনের জনপ্রিয় লেখক আলমুদেনা গ্রান্দেস। এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি পড়ার সময় মনে রাখতে হবে স্পেনের স্বৈরাচারী শাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর মৃত্যু হয় ১৯৭৫ সালে, ১৯৩৯ সাল থেকে চলা স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে। সেই হিসাব অনুযায়ী লেখক আলমুদেনা গ্রান্দেসের বয়স কিংবা অত্যাচারীর নিগড় থেকে মুক্তি পাওয়া স্পেন দেশটির বয়সও তখন বয়ঃসন্ধির মধ্যে দিয়েই চলেছে।
১৯৮৯ সাল নাগাদ মাদ্রিদ শহরে একটি বই প্রকাশিত হয়। Las edades de Lulu বা লুলুর নানান বয়স। প্রকাশিত হওয়া মাত্র বিস্ফোরণ ঘটে স্পেনের সাহিত্যমহলে। মনে রাখতে হবে রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে যাবে অচিরেই ঠিক সেই টালমাটাল সময়ে, স্পেনের ফ্রাঙ্কোর পতনের পরে মাত্র ১৪ বছর কেটেছে তখন। স্পেন স্বৈরাচারের কালো ছায়ার আওতা থেকে সদ্য মুক্তি পেয়ে সভ্য দেশগুলির সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে এগোতে চাইছে। এবং ইন্টারনেটের বিপ্লব তখনও সাধিত হয়নি পৃথিবী জুড়ে। সেই সময় এই উপন্যাসে এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে কাপল সেক্স, থ্রিসাম সেক্স, ট্রান্সজেন্ডার, এবং অর্গাজমকে দেখা হয়েছে। টাস্কেট প্রকাশনা স্পেনের সবচেয়ে খ্যাত প্রকাশনা দুটির একটি। সেখান থেকেই বইটি বের হয় এবং আজ পর্যন্ত বইটি দশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। টাস্কেট সে বছর বইটিকে Premio de sonrisa vertical পুরস্কার দেয়। আজ পর্যন্ত বিশ্বের কুড়িটি ভাষায় সেটি অনূদিত হয়েছে।
অরণ্যে দুই নারী। শিল্পী: ফ্রিদা কাহলো
বইটির সাফল্য আলমুদেনাকে কাঙ্ক্ষিত কেরিয়ার গড়ে দেয়। ছোটো থেকেই তিনি সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলেন। তবু মা চেয়েছিলেন কোনো মেয়েলি পেশায় যাক মেয়ে। সে জন্য তিনি মাদ্রিদের বিখ্যাত কমপ্লুটেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। টুকটাক এদিক ওদিক কাজ করার ফাঁকেই বইটি লেখেন এবং পাঠকের মন জয় করে ফেলেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আলমুদেনাকে পিছনে ফিরতে হয়নি। বছর চারেক আগে আলমুদেনার একটি গল্প ‘মায়ের ভালবাসা’ অনুবাদ করেছিলাম সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকে। সেটি এত পাঠক প্রিয় হয় যে বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি তিনি স্পেন ও আধুনিক পাঠকের মনে কতখানি তীব্রতার সঙ্গে ঢুকে যেতে পেরেছেন। গল্পটি নেওয়া হয়েছিল ‘আদর্শ নারী’ বইটি থেকে। এই লেখার প্রথম পর্বে অভূতপূর্ব সফল এই বইটির কথার উল্লেখ আছে। মেয়েদের মনের ও মননের এই দিকটি আলমুদেনার আগে স্পেনীয় সাহিত্যে কেউ তুলে ধরেননি।
মাদ্রিদে জন্ম হওয়া আলমুদেনা তাঁর বাম মনোভাবের জন্য অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও পরিচিত। যদিও বাংলায় বেশির ভাগ পাঠক স্পেনের বামপন্থী ভাবধারা বলতে মূলত বার্সিলোনার মানুষদেরই বোঝেন। তিনি বাম-আন্দোলনের জন্যও চিহ্নিত। তাঁর বিখ্যাত ছ-টি উপন্যাসের সিরিজ আছে, নাম Episodios de una gurra interminable বা ‘সমাপ্তিহীন এক যুদ্ধের পর্বগুলি’। উপন্যাসগুলির নাম জুল ভের্ন-এর পাঠক, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মা, ইনেস ও আনন্দ, ডক্টর গারসিয়ার রোগীরা, বিদাসোয়ায় মারিয়ানো এবং মানোলিতার তিনটি বিবাহ। প্রতিটিই পাঠক-সমাদৃত। কিন্তু ক্রিটিক প্রশংসিত বই ‘ইনেস ও আনন্দ’। উপন্যাসটির জন্য তিনি মেক্সিকো থেকে আর-এক প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক ও লেখক এলেনা পোনিয়াতউস্কার নামাঙ্কিত পুরস্কার পান।
তাঁর লেখা স্পেনের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেখক মিগেল সেরভান্তেসের দোন কিখোতের থেকে প্রভূত প্রভাবিত। একটা সময় তিনি বলেন “সাহিত্য আমার কাছে জীবিত লোকের কাছে জীবন, যা তোমাকে তোমার জীবিত থাকার আগেও অন্য লোককে জীবিত থাকতে দেয়”। (এখানে পড়তে পারেন আলমুদেনা গ্রান্দেসের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার, ইংরেজিতে: https://przekroj.pl/en/culture/nothing-fixes-itsef-aleksandra-lipczak) ড্যানিয়েল ডেফো ও বেনিতো গালদেস এই দুজন লেখকের প্রভাবও তাঁর লেখায় দেখা যায়। আমরা ‘ডন জুয়ান’ যে চরিত্রটি কল্পনা করি স্প্যানিশে বেনিতো গালদেসই সেই বিশ্ববিখ্যাত গল্পটি লিখেছিলেন। আলমুদেনা গ্রান্দেসের লেখায় চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েলের প্রভাবও যথেষ্ট দৃশ্যমান।
আলমুদেনা ১৯৮৯ সাল থেকে প্রায় প্রত্যেক বছর অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন। অজস্র লিখে চলেছেন। ২০১৮ সালেও জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন সে দেশে। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার পাঠকমান্যতা। তিনি আমূল প্রভাবিত করেছেন নতুন যুগের লেখক বিশেষত মেয়েদের। কারোলিনা করভিল্লো-র মতো অনেক লেখক তাঁর ভাষা খুঁজে পেয়েছেন আলমুদেনার কলমে। স্পেন ইওরোপের দেশ হওয়ায় লেখায় ম্যাজিক রিয়ালিজমের প্রভাব ততখানি দেখা যায়নি কখনও যতটা লাতিন সাহিত্যে দেখেছি আমরা। হয়তো আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রভাব এর কারণ হতে পারে। স্পেনীয় সাহিত্যে বরং রিয়ালিজমের জয়জয়কার। আলমুদেনা একুশ শতকের পৃথিবীতেও এতটুকু পুরোনো যুগ বা পুরোনো মূল্যবোধের মতো বাতিল হননি নতুন যুগের কাছে। এরকমটি দেখেছি ইসাবেল আইয়েন্দের কলমে। চিলের সাহিত্যিক ইসাবেল মেক্সিকো ও আমেরিকায় থাকার সুবাদে তাঁর বহু লেখাই ইংরিজিতে অনূদিত ও বাঙালি পাঠকের কাছে পরিচিত। অবশ্য আলমুদেনা গ্রান্দেসের কিছু উপন্যাস অনুবাদ হয়েছে। যেমন আর এক সফল উপন্যাস El Corazon helado ‘বরফ হৃদয়’, বা প্রবাদ হয়ে যাওয়া লেখা La edades de Lulu ‘লুলুর নানান বয়স’ এরকম আরও কয়েকটি উপন্যাস ইংরিজিতে অনুবাদ হয়েছে। পাঠক খুঁজে পড়তে পারেন। বাংলার পাঠকের কাছে নিঃসন্দেহে অনাস্বাদিত স্বাদ এনে দেবে। একুশ শতকের সাহিত্যে সিনেম্যাটিক ডিটেইলিং-এর জয়জয়কার। তাঁর লেখায় সেরভান্তেসের উইট, বুনুয়েলের প্রচ্ছন্ন ভাব ও চলচ্চিত্রের নিপুণ ডিটেইলিং ও নিজস্ব প্রতিভা সব মিলেমিশে এক অনন্য স্টাইল তৈরি করেছে।
এঁর কথা জানতাম না। নোট করলাম, পরে পড়তে হবে।
কৌতূহল তৈরি হোল ।
আসলে স্পেনীয় সাহিত্যের বোধহয় অনেকগুলো তাক আছে। আমেরিকান, সেন্ট্রাল আমেরিকান, দক্ষিন আমেরিকান, ইয়োরোপীয়ান। বাংলায় বা এদেশে তেমন পর্ব পরিচয় করান হয় নি। কিন্তু জরুরি।
সবাইকে ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য