মাত্র ৫২ বছর বয়স। ১৯৬৮ সালে জন্ম। তাঁকে ২০১০ সালে কলকাতা বইমেলায় দেখেছি, দূর থেকে। সেবার বইমেলার থিম দেশ ছিল মেক্সিকো, কর্তৃপক্ষ তাঁকে আমন্ত্রণ করেছিলেন সেবার। তখনও জানা ছিল না তাঁর এদেশে আসার মহিমা কী! খোর্খে লুইস ভোলপি এস্কালান্তে সংক্ষেপে খোর্খে ভোলপি মেক্সিকোয় জন্মগ্রহণ করেন এই সেদিন ১৯৬৮ সালে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে একটি গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পাঠকের নজরে পড়েন। ভোলপিকে প্রথম চিনেছিলাম ‘ক্র্যাক জেনারেশন’-এর লেখক হিসেবে। ১৯৯৬ সালে এই জেনারেশনের পাঁচ লেখক হিস্পানিক সাহিত্যের বুম যুগের প্রতিস্পর্ধী লেখক হিসেবে একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন পাঁচজনে পাঁচটি উপন্যাস লিখে। মেক্সিকোর ইগনাসিও পাদিইয়া (১৯৬৮–২০১৬), এলোই উররুস (জন্ম ১৯৬৭), পেদ্রো আঙ্খেল (জন্ম ১৯৬৬) সহ তরুণ এই লেখকেরা চমকে দিয়েছিল অবিস্মরণীয় বুম যুগের সাহিত্য ধারার বাইরে এসে একটি ধারা জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করায়।
কিন্তু এ লেখায় সেই আন্দোলন নয় বরং বলা যাক ঔপন্যাসিক ভোলপি, প্রাবন্ধিক ভোলপির কথা। ‘En busca de Klingsor’ মানে ‘ক্লিংসরের খোঁজে’ (ইংরেজি তরজমায়—In Search of Klingsor) এই উপন্যাসটিই ছিল ভোলপির প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যযাত্রার প্রথম উদাহরণ। যদিও লেখালিখি চলছিল, আগেই বলেছি, ষোলো বছর বয়স থেকে। ১৯৯৩ সালেই প্রকাশ পেয়েছে উপন্যাস A pesar del oscuro silencio বা ‘অন্ধকার নীরবতা ভেদ করে’। তারপর প্রায় নিয়মিত উপন্যাস লিখে গেছেন প্রতি এক বা দু-বছর অন্তর। কিন্তু ‘ক্লিংসরের খোঁজে’ উপন্যাসটি বুঝিয়ে দিয়েছিল এক অবিশ্বাস্য জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে। ১৯৯৯ সালে স্পেনের অভিজাত প্রকাশনী সেইক্স বাররাল থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির বিষয়টি নতুন নয় কিন্তু তাকে দেখা হয়েছে যে ভঙ্গিতে সেটি নতুন।
উপন্যাসটিতে পড়ি ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের পরে তরুণ উত্তর আমেরিকান পদার্থবিদ ফ্রান্সিস পি বেকনকে পাঠানো হয় হিটলারের ঘনিষ্ঠ এক তথাকথিত ‘বিখ্যাত’ বৈজ্ঞানিক ‘ক্লিংসর’কে খুঁজে বের করতে। সে নাকি ছিল দারুণ ক্ষমতাশালী। বেকন এখানে প্রায় ‘গোয়েন্দা’র ভূমিকায় যায় জার্মানির এক জেলখানায়। সেখানে ৪০ বছর ধরে বন্দি আছেন গুস্তাভ লিঙ্কস যিনি পরমাণু বোমা গবেষণা কার্যে হাইজেনবার্গের ডানহাত ছিলেন, এবং হিটলারের বিরুদ্ধে তথাকথিত ষড়যন্ত্র করার অপরাধে বন্দি হয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। সেটি একটি পাগলাগারদ। ১৯৮৯ সালের এক শরতে গণতান্ত্রিক রিপাবলিক জার্মানির এক পাগলাগারদে বসে বিজ্ঞানী গুস্তাভ লিঙ্কস বেকনকে সেইসব ঘটনা বলতে থাকেন। সালটা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা আর কয়েক মাস পরেই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাবে। একজনের পর একজন মহান জার্মান বিজ্ঞানীর কথা উঠে আসে, তাদের কাজকর্ম বিশেষ করে পরমাণু বোমা আবিষ্কারের পথে তাদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হতে থাকে সুনিপুণ কলমে। উপন্যাসে একটি রাশিয়ান নারীচরিত্র উঠে আসে। তার নাম আইরিন। সে আবার বেকনকে নিঃসংশয়ে জানায় যে গুস্তাভ লিঙ্কই আসলে ক্লিংসর স্বয়ং। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ না পেয়ে বেকন তাকে সোভিয়েত বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। তারা আবার তাকে ৪২ বছরের কারাবাস ঘোষণা করে। উপন্যাস জটিল হয়ে ওঠে যখন এই ‘তদন্তে’র পাশাপাশি বেকনের নিজের ব্যক্তিজীবনের জটিলতা তুলে ধরা হয়। তার মার্কিননিবাসী দুটি নারীর সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা। কালো মেয়ে ভিভিয়ান, তার প্রেমিকা, এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। আবার অন্যদিকে তার বাগদত্তা এলিজাবেথ যাকে সে ভালোবাসে না এবং শেষে মাঝপথে ত্যাগ করে নিজের কেরিয়ার নষ্ট করে। অন্যদিকে গুস্তাভ লিঙ্কের জীবনের এক ত্রিভুজ সম্পর্ক বোনা হয়েছে তার স্ত্রী মারিয়াননে আর তার বন্ধুর হেইনরিখের স্ত্রী নাতালিয়ার মধ্যে। এই হেইনরিখ আবার হিটলারের বিরুদ্ধে তথাকথিত ষড়যন্ত্রে জড়িয়েছিল।
উদ্দিষ্ট ‘বিজ্ঞানী’ ক্লিংসর কি আদৌ কেউ ছিলেন কেউ নাকি পুরোটাই হিটলারের বাহিনীর মনগড়া চরিত্র, যাতে বিরুদ্ধ শক্তিরা ধোঁয়াশায় থাকে! উপন্যাসের শেষেও এর উত্তর দেন না লেখক। অথচ পরতে পরতে প্রশ্ন তুলতে থাকেন বিংশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনার নেপথ্যকাহিনির দিকে, যার মধ্যে বহু মিথ জড়ানো রয়েছে আজও। মহান পদার্থবিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের সম্বন্ধে একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরেন যার দিকে পাঠকের মন দ্রব হয়ে পড়ে। বোমা আবিষ্কারের অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক কাটাকুটির ভেতর ঘটনাবলি এগোয়। একজন হাইজেনবার্গ চান বিজ্ঞানের জন্য গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। আর এই সব কাণ্ডকারখানা এক রোম্যান্টিক প্রেমের ষড়যন্ত্রে ভরপুর গল্পকথার ওপরে বোনা হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই এর সমাধান ঘটে না। কোনো বিমূর্ত, তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে অবতরণ ঘটে না শেষমেশ। কারণ এটি বিজ্ঞানের পেপার বা গোয়েন্দাকাহিনি কোনোটাই নয়।
ক্র্যাক আন্দোলনের লেখকদের বৈশিষ্ট্য তাঁরা চিরকালীন রোম্যান্টিকতাকে প্রশ্ন তোলেন। বোর্খেস ও কোর্তাসারের লিখনশৈলীর জটিলতা থেকে তারা অনুপ্রাণিত হয়। দেশ মানেই মহান অতএব তার সমস্ত রাজনৈতিক কাজগুলি চোখ বুজে সদর্থক ভেবে ন্যারেটিভ সাজানোর বিপরীতেই দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁরা। এই উপন্যাসটি সেভাবেই দেখতে হয়। এটিকে ঠিক কোনো রহস্য উন্মোচনের মতো সীমিত এলাকায় আটকে রাখাই উচিত নয়। বিজ্ঞান ও তার টুকিটাকি এত সহজ ভঙ্গিতে লেখায় জড়িয়ে যে আলাদা করা যায় না। এমনিতেও ভোলপির লেখায় বহুবার বিজ্ঞান উঠে এসেছে। তিনি নিজেই বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে ‘ছোটোবেলায় বিজ্ঞান পড়ব এটাই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু যথেষ্ট নম্বর তুলতে পারিনি সে শাখায় পড়ার জন্য। তাই আজীবন তা আমার প্যাশন হিসেবেই রয়ে গেছে’। আর ঠিক সে কারণেই বিজ্ঞানের কচকচি বাদ গেছে, কোনো উপদেশ দান বা পাঠকের চেয়ে লেখক উঁচুতে এমন ভাবই নেই উপন্যাসে। অনেকটা খেলার ছলে পড়তে পড়তে যেন পাঠক পৃথিবীর গত শতকের সবচেয়ে নাটকীয় ও বিপজ্জনক সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে পড়েন। সমসময়ের বিজ্ঞানজগতে সাহস করে লেখক ঢুকে পড়েছেন এবং নিয়েল্স বোহ্র বা ওয়ের্নার আইজেনবার্গের মতো বিজ্ঞানীর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে কাজ করছিলেন যাঁরা তাঁদেরও প্রশংসার চোখে লেখা হয়েছে উপন্যাসে। এটিকে তাই শুধু ‘অনুসন্ধান’মূলক উপন্যাস বলা উচিত নয় বরং দুনিয়া তোলপাড়কারী রহস্যময় কিছু মহান বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের প্রতি এক সন্নিবেশ দৃষ্টিপাত বলা যেতে পারে।
ভোলপির এই উপন্যাস গাবো মার্কেসের ছায়া থেকে বেরিয়ে, কার্লোস ফুয়েন্তেসের Aura বা ‘আভা’, কিংবা Terra nostra বা ‘আমাদের ভূমি’ ইত্যাদি বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাসের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সপাটে এক নির্দিষ্ট যুব পাঠকসমাজকে চুম্বকের মতো টেনে নিল। বলা যায় ভাসিয়ে নিল।
এতক্ষণ একটি ট্রিলজির প্রথমটিকে নিয়েই বলে গেলাম। কারণ এটি পঁচিশটি ভাষায় অনূদিত এবং বহুল সমাদৃত ও পুরস্কারধন্য। এই ট্রিলজির দ্বিতীয় বইটি El fin de Locura বা ‘পাগলামির শেষ’ প্রকাশিত হয় একই প্রকাশনী থেকে ২০০৩ এবং শেষটি প্রকাশ পায় ২০০৬ সালে No sera la tierra বা Season of Ash (অনুবাদ—আলফ্রেড ম্যাক)। তিনটি উপন্যাসে তিন নারী, তিন গল্প ও তিন জীবন একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে যায় শিকড়ে যেভাবে শিকড় জড়ায়। এর মধ্যে আমি যতদূর খোঁজ করতে পেরেছি দ্বিতীয় বই, El fin de Locura-র কোনো ইংরেজি তরজমা হয়নি।
ভোলপির তন্নিষ্ঠ চরিত্রটি বোঝা যায় যে তৃতীয় উপন্যাসের রাশিয়ান নারীচরিত্র জীববিজ্ঞানী ইরিনা গ্রানিনাকে আঁকতে তিনি রাশিয়ান ভাষা শেখেন এবং সেই দেশে গিয়ে এক বছর থাকেন। শুধু বিভিন্ন রাশিয়ান লেখককে চেনার জন্য, সমাজ-সংস্কৃতিকে জানার চেষ্টায় এটি করেন।
প্রাবন্ধিক ভোলপিও বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। এমনকি সে প্রবন্ধ সম্মানজনক পুরস্কার জিতে নিয়েছে। ওঁর লেখার মূল দৃষ্টি কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক। এখনকার দুনিয়ায় বিজ্ঞানকে এভাবে লেখার স্টাইলে পালটে ফেলা এক নতুন আবিষ্কার মানতেই হবে। লেখক বহুপ্রসবী সেকথা বলা যায়। মাত্র পঞ্চাশ পেরিয়েছে অথচ এখনও পর্যন্ত ৭৪ টি বই লিখে ফেলেছেন। যার বেশিটাই বেস্ট সেলার হয়ে আছে। প্রচুর বই ইংরেজিতে অনুবাদও করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার যে বইটি পেয়েছে সেটি কথা প্রথমেই আলোচনা করেছি। এ ছাড়াও বেশ ক-টি পুরস্কার আছে তাঁর ঝুলিতে। তবে সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার পাঠকপ্রিয়তা। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক। নিয়মিত বেশ ক-টি পত্রিকায় লিখেও থাকেন পৃথিবীর বেশ ক-টি দেশে। ২০১০ সালে তিনি এ দেশে আসেন এবং তখন সাহিত্য আকাদেমি-প্রাপ্ত অনুবাদক শ্যামল ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এই সূত্রে তিনি তাঁর প্রবন্ধে ভট্টাচার্যের কাজের কথা বিস্তারিত লেখেনও। এই বিষয়টি বাঙালি পাঠক জানেন ক-জন সে বিষয়ে সন্দেহ। শ্যামল ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘বুখারি’ একটি বিশ্বমানের উপন্যাস যার জন্যই তিনি সাহিত্য আকাদেমি পেয়েছেন। এর সমাদর বাঙালি পাঠক না করুন মেক্সিকোর অন্যতম তুমুল জনপ্রিয় লেখক জানিয়েছেন তাঁর পাঠকদের।প্রসঙ্গের বাইরে হলেও এ গর্বের কথা এ প্রবন্ধে না লিখে পারলাম না।
ভোলপি ২০১৮ সালে লিখলেন Una Novela Criminal এবং প্রকাশ হওয়া মাত্র সেটি অতি সম্মানজনক আলফাগুয়ারা পুরস্কার পায় এবং বেস্ট সেলার। আশ্চর্য হই এই বিচ্ছুরণ দেখে। একে প্রতিভাধর এবং ভবিষ্যতের লেখক স্বীকার না করে আমাদের উপায় নেই। ১৬ বছর বয়সে যে যাত্রা শুরু তা বাহান্নতেও ‘বেস্ট সেলার’ হয়ে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক মূল্যবান লেখা উপহার দেবেন সে কারণে লেখকের সৃষ্টিতে নজর রাখাই যায়। আর কে না জানে যা কিছু জনপ্রিয় তাই সাধারণ নয়।