২০২০ সাল ছিল তাঁর জন্ম শতবর্ষ। ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় দেখা আট বছর আগের এক শীতের দিনে—একটি ছোটো গল্প ‘un dia de 2030’ বা ‘২০৩০-এর একটি দিন’ পড়ে। এত ভালো লেগেছিল যে সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় অনুবাদ করে ফেলেছিলাম। সে বইতেই প্রথম পড়ি কিংবদন্তি আর্জেন্টিনীয় ট্যাঙ্গো গায়ক কার্লোস গারদেলের নাম। বিশ শতকের প্রথম অর্ধে ওঁর দাপট ছিল সম্পূর্ণ লাতিন দুনিয়া জুড়ে। বলছি উরুগুয়ের বুম যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মারিও বেনেদেত্তির কথা। সংগীত যাঁর সৃষ্টির উৎস ও ধারক ছিল। যাঁর বহু কবিতায় সুর দিয়ে রেকর্ড করা হয়েছিল। আধুনিক হিস্পানিক সাহিত্যে বেনেদেত্তি এক ব্যতিক্রমী বিপুল নাম। ব্যতিক্রমী বললাম কেননা সাধারণভাবে হিস্পানিক সাহিত্যে স্যাটায়ার, ব্যঙ্গ, রসিকতা যথেষ্ট থাকলেও বিশুদ্ধ উইট বা হিউমারের প্রচলন বেশ কম। তবুও যদি ভাবতেই হয় তাহলে বরং আধুনিক স্পেনীয় সাহিত্যের গুরু মিগেল সেরভান্তেসের দোন কিখোতে উপন্যাসের কথাই মনে আসে। সে উপন্যাসের নায়ক ও তাঁর ল্যাগব্যাগে ঘোড়া রোসিনান্তে কিংবা তাঁর সহচর মোটাসোটা এবং ধূর্ত সাঞ্চো পাঞ্জাকে নিয়ে যে সূক্ষ্ম হাস্যরসের ছবি উঠে এসেছিল পাঁচশো বছর আগে বেনেদেত্তিকে তাঁর সঠিক উত্তরাধিকারী বলা যেতেই পারে।
১৯৪৯ সালে যখন প্রথম গল্প সংকলন বের হল ‘এস্তা মানিয়ানা’বা ‘আজ সকাল’, সেখানেই প্রথম দেখতে পাওয়া গেল বিষাদকে লড়াই করবার অস্ত্র হিসেবে তিনি হিউমারকে বেছে নিয়েছেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উরুগুয়ের ১৯৪৫-এর প্রজন্মের কবি সাহিত্যিকদের একটি প্রবণতা দেখা গিয়েছিল দেশ গড়ে তোলার, জনগণের মানসিকতা গড়ে তোলার। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিজনিত ও হিটলারের নৃশংসতার কারণে তদুপরি জাপানে হিরোশিমা নাগাসাকির বোমা বুদ্ধিজীবীদের নতুন করে দায়িত্বশীল, স্বদেশপ্রেমী, মানবতাবাদী করে তুলেছিল। উরুগুয়ে ততদিনে দক্ষিণ আমেরিকার সুইৎজারল্যান্ড—এই তকমা হারিয়ে ফেলেছে। সে দেশের প্রেক্ষাপটে এই সময়েই সেখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানস তুলে ধরছিলেন বেনেদেত্তি। বেছে নিয়েছিলেন সূক্ষ্ম হিউমারের ধার। হিস্পানিক সাহিত্যে বোর্খেস, কোর্তাসার, মার্কেস, ফুয়েন্তেস, কার্পেন্তিয়ের—এঁদের রচনার মধ্যে ব্যঙ্গ বা স্যাটায়ারের যে ঝিলিক দেখা যায় তার থেকে আর একটু অন্যরকম এই হিউমারের স্বাদ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির নানান সুবিধাবাদী বিচ্যুতি, বোবাকালা হিপোক্রিসির অবস্থান, আবার তাদের ক্ষেত্রেই সমাজমুখী মানসিকতার অভিমুখ বদলে দেবার অসীম ক্ষমতা—এই দুটি ছিল তাঁর লেখা গড়ে তোলার আধার। এই শ্রেণিকে তাঁর মতো সফল ভাবে কেউ তুলে আনতে পারেননি লেখায়। সমসময়ের অন্যান্য উরুগুয়ের সাহিত্যিক খুয়ান কার্লোস ওনেত্তি বা ফেলিসবের্তো এর্নান্দেস বা ওরাসিও কিরোগা ইত্যাদি বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের ভিড়েও মারিও বেনেদেত্তি তাই অনন্য।
আশিটির বেশি বই লিখেছেন তিনি সারাজীবনে। ১৪ বছর বয়স থেকে চাকরি করতে শুরু করেন। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নানারকম পেশা নিয়েছেন জীবনে। শেষমেশ ১৯৪৪ সাল থেকে মারজিনালিয়া পত্রিকাটি সম্পাদনা শুরু করেন। এবং প্রথম যে বইটি প্রকাশ পায় সেটির নাম ‘প্রবন্ধ’। তবে ১৯৪৫ সাল থেকে উরুগুয়ের বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘মার্চা’-র সঙ্গে যুক্ত হন। সেই সম্পর্ক চলেছিল ১৯৭৪ সাল অবধি। সেইসালে উরুগুয়েতে একটি মিলিটারি অভ্যুত্থান ঘটে এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি বিশেষ ভাবে জড়িয়ে পড়েন বলে স্বৈরাচারী শাসক খুয়ান বোরদাবেরি তাঁকে নির্বাসন দেন। সেইসময় তিনি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এরপর থেকে বহুবছর নির্বাসনে কাটাতে হয় বিভিন্ন দেশে। আর্জেন্টিনা হয়ে কিউবা হয়ে পরে স্পেনের মায়োরকাতেও থাকেন। এ সমস্ত জায়গায় তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতে থাকেন এবং বই প্রকাশ করতে থাকেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলি এ সময়েই প্রকাশিত হয়।
এখানে পড়ুন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘I love you’ সহ পাঁচটি কবিতা— https://culturacolectiva.com/books/mario-benedetti-love-poems-for-your-partner
সর্বোপরি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘Primavera con esquina rota’ বা ‘কোনা ভাঙা বসন্তকাল’ এই সময়ে প্রকাশিত হয়। এর ইংরিজি অনুবাদ পাওয়া যায় ‘Spring With a Broken Corner’ নামে।
বেনেদেত্তির লেখার জগত বহুধা বিস্তৃত। প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গানরচনা, গান গাওয়া সব দিকে ছড়িয়ে আছে তাঁর প্রতিভা। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে গাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেসের সমসময়ে জন্মগ্রহণ করার জন্য ইংরেজিভাষী দুনিয়ায় সে খ্যাতির দাপটের ছায়ায় পড়ে যান তিনি। অথচ মন, মনন ও মস্তিস্কের নানান গহিন অধ্যায় যে ভাবে তাঁর কলমে উঠে এসেছে তার তুলনা আজও পাওয়া যায়নি হিস্পানিক সাহিত্যে। তাঁর মতো ভেদকারী অন্তর্দৃষ্টি এবং হিউমারের ধরন বুম যুগের আর কোনো সাহিত্যিকের লেখায় ফুটে ওঠেনি। মন্টে ভিডিও শহর ও তার মধ্যবিত্ত সমাজকে আশ্রয় করে চিরকালীন মধ্যমানসিকতাকে কত বছর আগে ফুটিয়ে তুলেছেন। ইংরিজিতে এখনও খুব বেশি অনূদিত নন অথচ লাতিন দুনিয়ায় তিনি বেস্ট সেলার আজও। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস La Tregua বা ‘সন্ধি’। উপন্যাসটি সম্পূর্ণ ডায়রি লেখার আঙ্গিকে লিখেছেন তিনি যা ইংরিজিতে Truce নামে অনূদিত। এই বইয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া চলচ্চিত্র ‘শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার ছবির’ জন্য অস্কার নমিনেশনও পেয়েছিল। বাংলায় এটি অনুবাদ করেছি আমি। এখন যন্ত্রস্থ। শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।
তবুও নিরপেক্ষ পাঠকের বিচারে তাঁকে আমি গল্পের রাজা বলে মনে করি। সারাজীবনে আটটি গল্প সংকলন প্রকাশ করেছেন। সেসব গল্পের মাধ্যমেই সরাসরি পাঠকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন তিনি। ১৯৫৯ সালে একটি গল্প লিখেছিলেন ‘dejánoscaer’ বা ‘আমাদের পতিত হতে দাও’। জেম্স জয়েস বা ভার্জিনিয়া উলফের লেখায় যে অন্তর্মুখী মনোলগ পড়েন পাঠক, এই গল্পটিতে মারিও যেন বহির্মুখী মনোলগ লিখছেন চাপা তুমুল হাস্যরসের মাধ্যমে। তিনি ভীষণভাবে স্বদেশীয় হয়েও অসম্ভব আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠেন এই ভাবে। আর-একটা গল্প ‘Punteroizquierdo’ বা বামপন্থী পয়েন্টার। ১৯৫৪ সালে লিখেছিলেন। গল্পে ফুটবল লিগের সফলতম ফুটবলারটি ঘুষ নিচ্ছে। ক্রমে সে খেলার বদলে ঘুষ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল...। যতকাল বেঁচেছেন পাঠকের হৃদয়ে রাজার মতো থেকেছেন মারিও, চিরকাল থাকবেন।
অসাধারণ এবং সুলিখিত। এক নতুন দিগন্তের খোঁজ পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। মারিও বেনদেত্তির বঙ্গানুবাদ পড়ার জন্য অপেক্ষা করবো।
আচ্ছা, এখানে 'কিখোতে' বা 'বোর্খেস' বলা হয়েছে, কিন্তু আমরা 'কিহোতে', 'বোরহেস' শুনেছি -- এটা বোধহয় ওই সাইলেন্ট J, যেটা কখনও 'খ' বা কখনও 'হ' দিয়ে উচ্চারণ হয়
মন্তব্য করার জন্য পাঠকদের ধন্যবাদ জানাই
অনেক কিছু জানতে পারলাম।