বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যয়নকালে চতুর্থ বর্ষে 'আন্তর্জাতিক আইনে' গার্সিয়া অ্যান্ড গারজা মামলা পড়তে হয়েছিল। মনে আছে, এ নিয়ে ক্লাসরুমে বেশ আলোচনাও হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলাটি মেক্সিকো ভার্সেস ইউএসএ, ১৯২৬ নামে পরিচিত। এই মামলাটি শেষ পর্যন্ত মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র জেনারেল ক্লেইমস কমিশনে নিষ্পত্তি হয়েছিল। মেক্সিকোর একটি দরিদ্র পরিবারের দুই সন্তান রাতের আঁধারে রিওগ্রানদে নদী সাঁতরে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষীর গুলিতে নিহত হয়। তারা এমন এক স্থানে গুলিবিদ্ধ হয় যেখানে মেক্সিকো ওযুক্তরাষ্ট্রের আইনে নদী পারাপার নিষিদ্ধ ছিল। সীমান্তরক্ষী অফিসার চোরাচালানের উপর নজর রাখার জন্যই বিশেষভাবে নিযুক্ত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কোর্ট অব মার্শাল সীমান্তরক্ষী অফিসারকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং অফিসারকে চাকরি থেকে অব্যাহতির আদেশ দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সেই আদেশের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং অফিসারকে পুনঃরায় চাকরিতে বহাল করেন। বিষয়টি মেক্সিকো-ইউএসএ জেনারেল ক্লেইমস কমিশনে বিবেচনার জন্য প্রেরণ করা হয়। আদালত সিদ্ধান্ত দেয়, অফিসারের কৃতকর্ম রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা যেভাবেই বৈধ করার চেষ্টা করা হোক না কেন এটি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো কাজ নয়। শিশু দুটির অনানুমোদিত স্থান দিয়ে নদী পারাপারের চেষ্টা নিঃসন্দেহে বেআইনি কাজ। কিন্তু কেবল এই কারণে কেনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটানো আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত বা অনুমোদিত হতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইনে ব্যক্তির প্রতি আচরণের একটি ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য মাত্রা রয়েছে। এমন কোনো আইন নেই যার মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতি এমন অমানবিক আচরণ সমর্থিত হতে পারে। সুতরাং মেক্সিকান শিশু দুটির হত্যা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী হবে। সেই মামলায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিহতের বাবা-মাকে ২ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণের চেয়ে বড় বিষয় হলো দায়ী পক্ষ দণ্ড পেয়েছে।
গার্সিয়া এবং গারজা মামলাটি অনেকদিন পরে প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে গেল। তবে এবারের ফলাফল ভিন্ন। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি। ভোরবেলা পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার অন্তর্গত চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয় বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী খাতুন। কনস্টেবল অমিয় ঘোষ গুলি করে। কাঁটাতারে দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকে ফেলানীর মৃতদেহ। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারপর থেকেই ফেলানী হত্যার বিচারের দাবি জানানো হয়। নানা ধাপের পর সেই বিচার শুরু হয় ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট। স্বাভাবিকভাবেই এ বিচার কাজ নিয়ে অনেক রকমের প্রত্যাশা ছিল। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম রক্তক্ষয়ী সীমান্ত। সেই সীমান্তের হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রথম কোনো বিচার নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই অনেক রকমের প্রত্যাশা থাকে। সীমান্তের হত্যাকাণ্ড বন্ধে এই মামলা হতে পারতো প্রথম ধাপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই পথ উন্মোচিত হয়নি। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিচারপ্রক্রিয়া।
২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে শুরু হয় ফেলানী হত্যাকাণ্ডের বিচার। সকালে কোচবিহারের সোনারীতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ১৮১ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তরে উক্ত বিচারকাজ শুরু হয়। বিএসএফ এর আইন The Border Security Force Act, 1968 অনুযায়ী গঠন করা হয় জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্ট। মোট পাঁচজন বিচারক বিচার প্রক্রিয়া চালান আর কোর্ট পরিচালনা করেন বিএসএফের গুয়াহাটি ফ্রন্টিয়ারের ডি আই জি কমিউনিকেশনস সি পি ত্রিবেদী। ১৪ আগস্ট বুধবার থেকে শুনানি শুরু হয়। কনস্টেবল অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডবিধির ৩০৪ ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুন এবং বিএসএফ আইনের ১৪৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এই অমিয় ঘোষ তাঁর ৫ দশমিক ৫৬ মিলিমিটার ইনসাস রাইফেল থেকে গুলি চালিয়েছিলেন, যাতে নিহত হয় ফেলানী। ফেলানীকে হত্যার দায়ে বিএসএফের অভিযুক্ত কনস্টেবল অমিয় ঘোষ ঘটনার পর থেকেই ক্লোজ অ্যারেস্ট থাকেন। অর্থাৎ তিনি তাঁর ইউনিটের ১৮১ নম্বর ব্যাটালিয়নের এলাকার মধ্যেই সীমিতভাবে ঘোরাফেরা করতে পারতেন। শুনানির শুরুতে অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য শোনা হয়। নিজের রাইফেল থেকে গুলি চালিয়ে ফেলানীকে হত্যা করলেও এর জন্য দোষ স্বীকার করেনি কনস্টেবল অমিয় ঘোষ। এরপর ১৯ আগস্ট ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম ও মামা আবদুল হানিফের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। জেনারেলসিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্ট ৬ সেপ্টেম্বর বিচারকাজ শেষ করে। রায়ে ভারত-বাংলাদেশসীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানী খাতুন হত্যার মামলায় অভিযুক্ত সীমান্তরক্ষী অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। রায়ের পরে বিএসএফের ১৮১ নম্বর ব্যাটালিয়নের কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দ্য বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স অ্যাক্ট ১৯৬৮ অনুযায়ী জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টের রায়ের চূড়ান্ত ছাড়পত্রের জন্য বাহিনীর মহাপরিচালকের কাছে পাঠাতে হয়। সেই প্রক্রিয়া শুরুর কথাও জানানো হয়।
দুখঃজনক হলেও সত্য, জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টের এই বিচার ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 'নো ওয়ান কিলড জেসিকা'র মতো যেন বলা হলো 'নো ওয়ান কিলড ফেলানী'! বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ব্যক্তি ফেলানীর ওপর যে নির্মম ও অমানবিক আচরণ করা হয়েছে তা কোনো আন্তর্জাতিক আইনেই সমর্থিত হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে গার্সিয়াঅ্ যান্ড গারজা মামলায় আদালতের পর্যবেক্ষণের কথা আবারও মনে করা যেতে পারে।
ফেলানী হত্যাকাণ্ড সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আইকনিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারের সঙ্গে ভবিষ্যতের আরও অনেক ঘটনার সংযোগ হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারকে এখন এ ব্যাপারে সক্রিয় হতে হবে। এতোদিন বিষয়টি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর পর্যায় থেকে দেখা হয়েছে। এখন আশা করবো বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সবাই যেখানে জানে যে অভিযুক্ত অমিয় ঘোষের রাইফেল থেকে চালানো গুলিতেই ফেলানীর মৃত্যু হয়েছে এবং মৃত্যুর পর অমানবিকভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা ফেলানীর মৃতদেহ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেওয়া নিঃসন্দেহে বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি মানুষকে বিমুখ করে তুলবে।
দ্য বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স অ্যাক্ট, ১৯৬৮ এর ১১৭ ধারা অনুযায়ী এই আদেশের বিরুদ্ধে পিটিশন দায়ের করার সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগটি অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
১১৭ ধারায় রয়েছে- 117.Remedy against order, finding or sentence of Security force Court.
(1) Any person subject to this Act who considers himself aggrieved by any order passed by any Security Force Court may present a petition to the officer or authority empowered to confirm any finding or sentence of such Security Force Court, and the confirming authority may take such steps as may be considered necessary to satisfy itself as to the correctness, legality or propriety of the order passed or as to the regularity of any proceeding to which the order relates.
(2) Any person subject to this Act who considers himself aggrieved by a finding or sentence of any Security Force Court which has been confirmed, may present a petition to the Central Government, the Director- General, or any prescribed officer superior in command to the one who confirmed such finding or sentence,and the Central Government, the Director- General, or the prescribed officer,as the case may be, may. pass such order thereon as it or he thinks fit.
২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল ভারতের সুপ্রিমকোর্ট আদেশ প্রদান করেছে যে সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যদের বিচার ক্রিমিনাল কোর্টেও করা যাবে। সুপ্রিম কোর্ট এ আদেশের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতের রায়কে সেট অ্যাসাইড করে দেয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুইজন বিএসএফ সদস্য কর্তৃক একজন কাশ্মিরী কিশোরীকে হত্যার মামলায় এমন আদেশ দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, সব ধরনের মামলা সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে করা বাধ্যতামূলক নয়। (The SC held that it was not mandatory to try all such cases in the security force court, and the commanding officer must adduce sufficient reasons on why the case should not be sent to a criminal court. It said specific provisions under the armed forces laws could not summarily take away general laws.)
কিছুটা দেরি হয়ে গেলেও সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশকে বিবেচনায় নিতে হবে। যেভাবে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স ফেলানী হত্যা মামলায় রায় প্রদান করেছে তা ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত করেছে। পাশাপাশি সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পথকে আরও উন্মুক্ত করেছে। বাংলাদেশ এবং ভারত দুটি দেশকেই সীমান্তে হত্যাকান্ডে বন্ধে ফেলানী হত্যা মামলাটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।