এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রানি ও কলতান - ২৫ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ মার্চ ২০২৫ | ৫৯ বার পঠিত
  • ( ২৫ )

    নীতিন এসে প্রথমেই রান্নার জায়গায় চলে গেল, মনে হয় চায়ের সন্ধানে। কলতান একটু এগিয়ে গিয়ে কাঁচা পাকা চাপদাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে বললেন, ' বিদ্যুৎদা, এস এস ... তোমাকে ট্রাবল দিলাম ... '
    --- ' আরে দূর ... কিসের ট্রাবল ? এটুকু যদি করতে না পারি, কাগজ চালাবার দরকার কি। আমি যে পয়সার জন্য কাগজ চালাই না সে তো তুমি জান ... '
    ভদ্রলোক এসে বসলেন। কলতান শঙ্করীবাবুদের দিকে তাকিয়ে বলল, ' ইনি হলেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
    দর্পণ নামে যে ইভনিং ট্যাবলয়েডটা আছে সেটা চালান ইনি ... দর্পণের মতো স্কুপ নিউজ অনেক বড় হাউসও বার করতে পারে না ... '
    ওরা তিনজনই হাত তুলে নমস্কার করলেন। বিদ্যুৎবাবুও নমস্কার করলেন। অতীন বোসদের মুখ দেখে মনে হল না তারা দর্পণের নাম শুনেছেন বলে। তারা অবশ্য বিদ্যুৎবাবুর দিকে সমীহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বোধহয় সাংবাদিক বলে।প্রকাশ ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

    বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বললেন, ' বেশিক্ষণ বসব না ... কাজ ফেলে এসেছি। আজ বিকেলের ইস্যুর লে আউটটা ইনকমপ্লিট অবস্থায় আছে। আমি একটু পরে চলে যাব ... নাও প্রিন্টগুলো নাও। দুটো ছবি আছে ... ', বলে একটা ছয় বাই চার ইঞ্চির একটা সাদা খাম তার ব্যাগ থেকে বার করে কলতানের হাতে দিলেন।
    কলতান বলল, ' অনেক ধন্যবাদ বিদ্যুৎদা। এই তো এনারা সামনেই বসে আছেন। ছবিগুলো দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন এনারা ... '
    কলতান উল্টোদিকে বসা প্রকাশ আর সব্যসাচীবাবুর দিকে দেখাল। তোমার কাগজের ছেলেদুটো কিন্তু দুর্দান্ত। অমন স্টাফ পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। যেমন দক্ষ,কৌশলী তেমনি সাহসী ... '
    --- ' হ্যাঁ, তা বলতে পার। নিরলস পরিশ্রমীও বটে। সত্যি কথা বলতে কি ওদের জন্যই কাগজটা চালাতে পারছি এখনও। এমন সব নিউজ এবং ছবি তুলে আনে যে অনেকের পালাবার কোন পথ থাকে না। কিন্তু ... যেটা বলতে যাচ্ছিলাম ... একটা ছবিতে তো দুজন না, তিনজন আছে। আর ফ্যাক্ট্রির ছবিটায় একজন, কিন্তু পেছনে একটু ব্লারড ফিগার আছে একটা। মনে হচ্ছে তো ওই ওনারা দুজন ... ', প্রকাশ আর সুজিত বর্ধনের দিকে দেখিয়ে বললেন বিদ্যুৎবাবু।
    --- ' তাই ... দেখি দেখি ... হ্যাঁ ঠিক তাই। আর এটায় ... থানার ছবিটায় তো প্রকাশবাবু, সব্যসাচীবাবুর সঙ্গে সুজিতবাবুকেও দেখা যাচ্ছে। ওই যে, উনি হলেন মিস্টার সুজিত বর্ধন ... এলাকার খুব গণ্যমান্য মানুষ ... কাউন্সিলরের খুব ঘনিষ্ঠ ... '
    বলে কলতান ছবি দুটো আবার খামে ঢুকিয়ে রাখল।
    --- ' ও বাবা ... তুমি বেশ বড় মাঠে খেলতে নেমেছ তা'লে ... দেখ বাবা একটু সামলে ... '
    --- ' বিদ্যুৎদা ... আপনি তো সবই বোঝেন, এসব খেলা সামলে খেলা যায় না। হয় মাঠে নেম না, আর নামলে অল আউট অ্যাটাকে যেতে হবে। এর মাঝামাঝি কিছু করতে গেলে অপোনেন্ট খুব স্লিপারি, পিছলে যেতে পারে ... খেলা বিফলে যাবে ... '
    --- ' হ্যাঁ, তাতে কোন সন্দেহ নেই ... ঠিক আছে তুমি খেলতে থাক ... নিশ্চয়ই সাকসেসফুল হবে, আর কোন দরকার হলে বোল ... আমি এবার উঠি ... একদম সময় নেই হাতে ... লে আউটটা ... '
    বলে বিদ্যুৎবাবু উঠে পড়লেন। কলতান তাকে গেট অব্দি এগিয়ে দিতে গেল।
    কলতান ফিরে আসার পর দেখল সুজিত বর্ধন প্যান্টের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
    কলতান সেখানে পৌঁছতে সুজিতবাবু খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
    --- ' কেসটা কি বলুন তো দাদা ... মালটা কে ? '

    কলতান অনেকক্ষণ ধরে সুজিত বর্ধনের কাছ থেকে এই প্রতিক্রিয়াটা আশা করছিল।
    অতীন বোস তেড়ে মেরে কি একটা বলতে যাচ্ছিল। কলতান তাকে হাতের ইশারায় শান্ত হতে বলল।
    বলল, ' আরে কি বলব দাদা ... মালগুলোর কোন কাজকর্ম নেই, কোথা থেকে কোথা থেকে সব ছবি তুলে নিয়ে আসে ... কিভাবে সেখানে যায়, কি করেই বা তোলে কে জানে ... কোন মানে হয় ... মানুষকে হ্যারাসমেন্টে ফেলা ... এক্সপার্ট ছেলে কিন্তু সব ... স্বীকার করতেই হবে ... হ্যাঃ হ্যাঃ ... এই তো দেখুন না ... এই যে ... দেখুন দেখুন ... লুকোছাপার কি আছে ? মোবাইল ক্যামেরায় তোলা... এগারোই মার্চ ডানকুনি থানায় ওসি র সঙ্গে আপনি আর প্রকাশভাই কি সব ডিসকাস করছেন সিরিয়াস মুখে। আর একটা ছবি হল খানাকুলের। এই যে দেখুন না ... ফ্যাক্ট্রির একটু ভিতরে প্রকাশজি দাঁড়িয়ে আছে, আর আর একটু পাশের দিকে, ভাল বোঝা যাচ্ছে না অবশ্য ... কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ওটা আপনিই। আচ্ছা আপনি কি প্রকাশজির কাফ সিরাপ কোম্পানীর বিজনেস পার্টনার নাকি ? বলে ফেলুন না ... জানতে খুব ইচ্ছে করছে .... এটাও মোবাইলে তোলা, ডেট সিক্সটিনথ মার্চ। মানে, প্রকাশবাবু যেদিন সহদেবকে নিয়ে আমার কাছে গিয়েছিল তার আগের দিন ... মানে ওখানে বসেই বোধহয় আমাকে কেসটায় জড়িয়ে নিয়ে তারপর আগাম একটা নট গিলটি ব্ল্যাঙ্কেট তৈরি করে নেবার প্ল্যানটা ছকা হচ্ছিল। কি দাদারা ঠিক বলছি তো ?
    আমার মনে হল তাই বললাম আর কি ... তবে ছবিটা তো সত্যি ...ছবি তো মিথ্যে কথা বলে না ...
    এরকম সিরিয়াস মিটিং নিশ্চয়ই আগেও হয়েছে ... কি বলেন প্রকাশজি ? '

    প্রকাশ কোন উত্তর দিল না। সুজিতবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে ছিলেন।
    তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন, ' আপনি কিন্তু হেভি রিস্ক নিয়ে ফেলছেন মিস্টার গুপ্ত। আপনি আমাকে জড়াবার চেষ্টা করছেন ... মারাত্মক রিস্ক নিচ্ছেন কিন্তু। পারবেন কিছু প্রমাণ করতে ... পারবেন ? '

    অতীনবাবু কি বলতে যাচ্ছিলেন সুজিত বর্ধনকে। শঙ্করীপ্রসাদ তাকে থামালেন। কলতানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ' ক্যারি অন ... '
    কলতান বলল, ' না, আমি আর কি প্রমাণ করব ? যাকে দিয়ে আপনারা কাজটা করালেন সাহেব, সেই প্রমাণ করবে ... '
    --- ' মানে ! পাগল কাঁহিকা ... কাকে দিয়ে কি কাজ ? ', সুজিতবাবু পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলেন।
    --- ' এবার কিন্তু আপনি রিস্ক নিয়ে ফেলছেন ... ', বলে, নীতিনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ' বল না ... তুমি তো সবই জান ... মিছিমিছি এই স্যারদের সময় নষ্ট করে লাভ কি ? '
    নীতিন আঁতকে উঠে বলল, ' ক্কি ... ক্কি ! আমি সব জানি ! কি সব বলছেন আপনি ... '
    --- ' কিছু না বলতেও পার। তাহলে আবার ব্লাড নিতে হবে ... '
    --- ' ব্লাড নিতে হবে মানে ... কার ব্লাড ? '
    --- ' বাঃ ... ডি এন এ টেস্ট করতে হলে ব্লাড লাগবে না। বেশি না, সামান্য একটুখানি। তোমার তেমন আপত্তি থাকলে দরকার নেই। আমার রুমালে লাগানো তোমার ঘাম আর চুল থেকে ডি এন এ রিপোর্ট পেয়ে গেছি। সেটা তেঁতুলতলায় কুড়িয়ে পাওয়া দশ টাকার কয়েন, একটুখানি মাটি, গুদামঘরে পাওয়া তোমার বুকের চুল জড়ানো জামার বোতাম যেটা রানির সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তিতে ছিঁড়ে গিয়েছিল আর তোমার দোকানের খানাকুলে তৈরি টফির একটা মোড়ক। টফিগুলো তো আমিও খেয়েছি ... ওই যে আমাকে দিলে না ...। খুব সুস্বাদু কিন্তু ওতেও যে কোডিন পাওয়া গেল ভায়া, ল্যাব টেস্টে ... সেদিন বিকেলে তিন্নিকে ভাগিয়ে দিয়ে রানিকে বেশ কয়েকটা খাইয়েছিলে। রানিও লোভে পড়ে টপাটপ খেয়ে ফেলে অনেকগুলো। তাতে তোমার একটু সুবিধে তো হল ... কি তাই তো ? তোমার আর একটা সুবিধে হল যদুনাথ সেদিন ছেলের অসুস্থতার কারণে অ্যাবসেন্ট ছিল। সে ব্যাপারে ধোঁয়াশা আছে অবশ্য। আমার মনে হয় প্রকাশভাই সেদিন এবং পরের দিন তাকে আসতে বারণ করেছিল এবং এই বারণ করার ব্যাপারটা গোপন রাখার জন্য তাকে কিছু টাকা দিয়েছিল। বেচারি গরীব মানুষ, কি করবে ... সে যাক, যেটা বলছিলাম ... যে নমুনাগুলো কুড়িয়ে বাড়িয়ে কালেক্ট করেছিলাম তার ডি এন এ একেবারে খাপে খাপে ম্যাচ করে গেছে। তবু ব্লাডের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে না পারলে মনটা খুঁত খুঁত করবে ... যাক সে সব এই স্যারেরা বুঝে নেবেন। আমার কাজ শুধু অঙ্কটা মিলিয়ে দেওয়া ... '
    এই সময়ে বিতান মুখার্জী হাসিমুখে বললেন, ' দাদা, অঙ্ক মিলিয়ে দিয়েছেন মনে হচ্ছে, কিন্তু কয়েকটা ভাইটাল স্টেপ বাদ দিয়ে গেলেন। স্টেপ বাদ দিয়ে গেলে এগজামিনার নম্বর কাটে যে ... '
    --- ' হ্যাঁ স্যার, ঠিক ঠিক। স্টেপগুলো লাগাচ্ছি এবার। স্টেপ বাদ গেলে তো মার্কস পাওয়া যাবে না ... '
    নীতিন একমনে কি চিন্তা করে যাচ্ছিল আমগাছটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। জামা ঘামে ভিজে যাচ্ছে।

    কলতান বলতে লাগল, ' রানিকে শেষ দেখা গেছে নীতিনের দোকানে টেনথ মার্চ বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। উইটনেস তিন্নি। দুই বোন প্রায় প্রতিদিনই বিকেলে নীতিনের দোকানে যেত কিছু না কিছু পাওয়ার আশায়। বাচ্চারা যেমন হয় আর কি। প্রকাশবাবু এবং সুজিতবাবুর সেটা জানা ছিল। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। নীতিনকে আগেই ব্লু প্রিন্ট বোঝানো ছিল। সে তিন্নিকে কোন একটা বাহানা বা কৌশলে সেখান থেকে সরায়। সাক্ষী স্বয়ং তিন্নি ... যদি প্রয়োজন পড়ে ... '
    সকলেই দেখতে পেল তিন্নি খেলা করে চলেছে নির্বিকার মুখে। তার মনের কথা পড়া কারো অসাধ্য বলা যায়। তার মাকেও দেখা যাচ্ছে না। হয়ত ঘরের কাজকর্ম করছে কিংবা কালো পুঁতির হার পরে সাজগোজ করে তৈরি হচ্ছে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য। সহদেব ওদিকে খুন্তি নেড়ে চলেছে যন্ত্রের মতো।
    শঙ্করীপ্রসাদ বললেন, ' তারপর ? গো অ্যাহেড ... '
    কলতান বলল, ' কি যেন বলছিলাম ... ও হ্যাঁ, আমার নিজের ফরেন্সিক এক্সপার্টের ফাইন্ডিং অনুযায়ী রেপ এবং মার্ডার দুটোই হয়েছে সন্ধে সাড়ে ছটার আশেপাশে মাহিরের গোডাউনের মধ্যে, কারণ এদের জন্য এর চেয়ে সেফ স্পট আর নেই। এবং তেঁতুলতলার ঝোপে বডি ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে তার ঘন্টাখানেক বাদে। না ... পি এম রিপোর্ট আমি পাইনি, যদি আদৌ পোস্ট মর্টেম হয়ে থাকে। আমি শুধু গোডাউন থেকে এবং তেঁতুলতলার ঝোপ থেকে পাওয়া স্যাম্পল ম্যাচিংয়ের বেসিসে বলছি। এই সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে সাতটা নীতিন কোথায় ছিল তার যদি কোন অকাট্য জবাব দিতে পারে দিক ... আমরা শোনার জন্য তৈরি আছি। এর পর নিজের মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে সহদেবের যখন দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল তখন নীতিন সহানুভূতিশীল বন্ধুর মতো এগিয়ে আসে এবং নাটক করে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজতে খুঁজতে টর্চ জ্বেলে সহদেবকে নিয়ে তেঁতুলতলার ঝোপের মধ্যে পৌঁছয়। তার অত সূক্ষ্মবুদ্ধি এবং কান্ডজ্ঞান নেই এটা বুঝবে যে, মাটিতে রেপড অ্যান্ড মার্ডার্ড বডি ফেলে রাখলে ভ্যাজাইনা সোয়াব মাটিতে পারকোলেট করতে পারে। রেপ তাকে করতে বলা হয়নি, শুধু মার্ডারের ইন্স্ট্রাকশান ছিল তার ওপর। কিন্তু নীতিন বোধহয় তার পারিশ্রমিকের কিছু উপরি উসুল করতে গিয়েছিল, যে ইনক্লিনিশেনটা ক্রাইম এগেনস্ট ফিমেলের ক্ষেত্রে জেনারেলি দেখা যায়। আর সেটাই হল কাল। এটা করতে না গেলে এত এভিডেন্স যে সে ফেলে যেত না এটা নিশ্চিত।

    এই হল ব্যাপার। আর বাকি থাকে মোটিভ। মোটিভের কথা আর নতুন করে কি বলব ? রানি প্রকাশভাই এবং সুজিত বর্ধন সাহেবের জোড়া অপকর্ম জেনে ফেলেছিল। এক মান্ডবী ঘটিত আর অন্যটা হল বিপজ্জনক কোডিন সিরাপের অনৈতিক এবং ক্ষতিকর ব্যবসা। পথের কাঁটা কেই বা রাখতে চায়। যদুনাথ দাসের সঙ্গে কথা বলে আমি জানতে পেরেছি নীতিন প্রায়ই প্রকাশ শ্রীবাস্তবের ফ্লোরে যেত। একজন স্টেশনারি দোকানদারের প্রকাশবাবুর সঙ্গে কি এত দরকার থাকতে পারে যে মাঝে মাঝেই কথাবার্তা বলতে যেতে হবে। আমার অনুরোধ যদুনাথকেও এই মামলায় পার্টি করা হোক। কনডিউসিভ অ্যান্ড ইউজফুল এজেন্ট হতে পারে সে।

    আর সব্যসাচীবাবুর কথা বলা দরকার। তিনি যে খুব দুর্নীতিপরায়ণ তা নয়, কিন্তু তিনি একজন পুরোপুরি অপদার্থ মেরুদন্ডহীন মানুষ। অর্থলোভীও বটে। তিনি সুজিত বর্ধন এবং প্রকাশ শ্রীবাস্তবের আজ্ঞাবহ ভৃত্য ছিলেন বলা যায়। রানির বডি কারা রিট্রিভ করল, সুরতহালের স্টেটাস কি, পোস্ট মর্টেম আদৌ হয়েছিল কিনা কিংবা হলেও তার রিপোর্ট কবে এবং কোথা থেকে আসবে সব্যসাচীবাবু তার কোন খবরই রাখেন না।
    এই সময় সব্যসাচীবাবু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ' হ্যাঁ ... পি এম রিপোর্ট এসেছে স্যার ... '
    অতীন বোস বলে উঠলেন, ' পি এম রিপোর্ট এসেছে ! কই কই ? ... '
    কলতান বলল, ' সেটা এতক্ষণ বলেননি কেন ? কোথায় ? '
    সব্যসাচীবাবু একটা লম্বা চওড়া খাম এগিয়ে ধরলেন কলতানের দিকে, ' এই যে ... আপনি যা যা বললেন হুবহু তাই আছে এতে ... পড়ে দেখেছি। এটা অবশ্য সার্টিফায়েড কপি। অরিজিনালটা থানায় আছে। এতক্ষণ ভয়ে বলতে পারিনি ... '
    --- ' কার ভয়ে ? '
    --- ' সবই তো বুঝতে পারছেন ... কি আর বলব ... মুখ খোলার সাহস আমার নেই ... আমি খুব ভয় পাই, বৌ বাচ্চা নিয়ে সংসার করি তো ... যতটা খারাপ ভাবছেন আমি ততটা খারাপ লোক নই ... ভেবে দেখবেন কলতানবাবু ... আমি নিরুপায় ... '
    কলতান এসব কথার কোন উত্তর না দিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করল, ' প্রশাসনের কি পচাগলা অবস্থা ... ঘেন্না লাগে ... ', তারপর খামটা শঙ্করীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর দিকে বাড়িয়ে ধরল।
    কলতান বলল, ' আমার একটা সাজেশন আছে স্যার। সহদেবের এস্পাউজ মান্ডবীর এগেনস্টে চার্জ এনে যেন এই কেসে ইমপ্লিকেট করা হয় ... '
    শঙ্করীবাবু বললেন, ' সেটা তো ইনডিসপেনসিবল .... নিন ধরুন অতীনবাবু ... নাউ, ইট সিমস দ্যাট উই মে প্রসিড ... এদের আগে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে কেসটা রেজিস্টার করুন। তারপর কোর্টে স্যুট ফাইল করবেন।
    এই সময় সহদেবকে রুদ্ধশ্বাসে এদিকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল।
    সে বলতে লাগল, ' সব্বনাশ হয়েছে বাবু ... মানু উঠছে না ... '
    --- ' কেন সে কোথায় ? '
    --- ' ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে ... মনে হচ্ছে বিষ খেয়েছে ... এ আমার কি হল বাবু ... ' নির্বিবাদী সরল মানুষ সহদেব কান্নাকাটি করতে লাগল।
    --- ' কি বলছ কি ! দেখি দেখি ... চল তো ... '
    কলতান জোর পায়ে হাঁটা দিল। সুজিত বর্ধন এবং প্রকাশ শ্রীবাস্তব ঝট করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বিতান মুখার্জীর পকেট থেকে একটা পিস্তল বার হয়ে এল। তিনি বললেন, ' একদম না ... একদম না ... কোন লাভ হবে না ... চারদিক পুলিশ দিয়ে ঘেরা আছে ... পালাবার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না .... জানেন না হয়ত, আমি একজন এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট ... কাজেই ... '
    সুজিত বর্ধন সাপের মতো হিসহিসে গলায় বললেন, ' এক মাঘে শীত পালায় না সেটা জানেন তো ? এটা তো সবে ফার্স্ট রাউন্ড ... '
    বিতান মুখার্জী হেসে বললেন, ' ঠিক আছে ... দেখাই যাক না, নক আউট পাঞ্চটা লাস্ট রাউন্ডে গিয়ে কে মারতে পারে ... দেশটা এখনও হিটলারের জার্মানী হয়ে যায়নি ... '

    অনেকে মিলে ধরাধরি করে মান্ডবীকে বাইরে নিয়ে এসে খাটিয়ায় শোয়াল। মনোজও ধরাধরিতে সাহায্য করল।
    অতীনবাবু বললেন, ' বাইরে গাড়ি আছে। হারি আপ ... হারি আপ ... ইমিডিয়েটলি হসপিটালাইজ করতে হবে ... কুইক কুইক ... '
    শঙ্করীপ্রসাদ বললেন, ' শি ইজ লাইকলি টু বি দ্যা প্রাইম উইটনেস অফ দিস কেস। ক্রাইম ডাজ নট পে ... ওয়ান মাস্ট রিয়ালাইজ ... হুয়েভার ইট ইজ ... '
    পিকনিকের খাওয়াদাওয়া মাথায় উঠল। এটা একটা সাজানো পার্টি তা কারোরই আর বুঝতে বাকি রইল না।
    পুলিশের একটা গাড়ি মানুর অচৈতন্য দেহ তুলে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিল ঝড়ের বেগে।

    এই সময়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে কুলচাকে ঢুকতে দেখা গেল।
    কলতান বলল, ' যাক, শেষ পর্যন্ত স্টেজের কাছে পৌঁছে গেছিস ... চিনতে অসুবিধে হয়নি তো ? '
    --- ' না না কোন অসুবিধে হয়নি। এখানে এই ইনসিডেন্টটার কথা দেখলাম সকলেই জেনে গেছে। তোমার নামও করল অনেকেই ... '
    --- ' তাই নাকি ? তুই কিন্তু বেশ দেরি করে ফেললি... '
    --- ' আর বোল না .... এমন একটা অ্যাসাইনমেন্ট ধরিয়ে দিল ... শো কি শেষ ? '
    --- ' হ্যাঁ, এখানকার পালা আপাতত শেষ। এখন খেলা হবে অন্য কোথাও ... দেখা যাক ... '
    --- ' খেলা হবে .... হাঃ হাঃ হাঃ ... এই মাঠের গেমটা কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি শেষ করে দিলে ... বেশি সময় লাগল না ... '

    কলতান বসে পড়ল। রুমাল দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ' তদন্ত করলে আবার সময় লাগে নাকি ... সময় লাগে তদন্ত ধামা চাপা দিতে চাইলে। উঃ কি গরম পড়ে গেল ... '
    স্বল্পবাক তিন্নি এসে নীরবে কলতানের গা ঘেঁসে দাঁড়াল। কলতান সস্নেহে তার কাঁধে হাত রাখল।

    ( সমাপ্ত )

    ******
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • . | ১৪ মার্চ ২০২৫ ১৭:৩৯541692
  • গুড
  • :|: | 2607:fb90:bd2d:6df:644e:4766:6400:***:*** | ১৪ মার্চ ২০২৫ ২০:৩৭541694
  • খাওয়া হলো না? সব ব্যবস্থা কী হবে এখন? এর চেয়ে খেয়েদেয়ে আলোচনাটা শুরু করলেই পারতো! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন