এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রানি ও কলতান - ২৪

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ মার্চ ২০২৫ | ৫৯ বার পঠিত
  • ( ২৪ )

    আজ শুক্রবার। মাহিরের বাগানের একধারে, সহদেবের ঘরের সামনে প্রায় একডজন গার্ডেন চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকাশই করেছে নিশ্চয়ই। আগের পিকনিকে যারা ছিল তাদেরই দেখা যাচ্ছে। আরও কেউ কেউ আসবে হয়ত। কলতান এসেছে ঘন্টাখানেক হল।
    প্রকাশ গেটের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পিছনে হাত দিয়ে। কলতান তার কাছে গেল আস্তে আস্তে। বলল, ' কারও জন্য ওয়েট করছেন নাকি ? '
    --- ' না এমনি দেখছি। আপনি আর কাউকে বলেছেন নাকি ? ' প্রকাশ বলল।
    --- ' হ্যাঁ ... আসবার তো কথা। না এলে চলবে কি করে ? '
    --- ' কেন, তারা কে ? '
    --- ' এমনি তেমন কেউ না। আবার ধরতে গেলে অনেক কিছু ... '
    --- ' ঠিক বুঝলাম না ... '
    --- ' বোঝার আর তেমন কিছু নেই। কারণ সবই বোঝা হয়ে গেছে ... '
    এই সময়ে একটা হুন্ডাই গাড়ি এসে থামল গেটের বাইরে। কলতানের কথাটা চাপা পড়ে গেল।
    কলতান বলে উঠল, ' ওই তো ... এসে গেছে ... যাক বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ... দায়িত্বটা হ্যান্ড ওভার করে দেওয়া যাবে ... '
    --- ' কিসের দায়িত্ব মিস্টার গুপ্ত ? '
    --- ' ওই যে দায়িত্বটা আপনি আমাকে দিয়েছিলেন ... আজকে সেটাই ডিসপোজ অফ করব আর কি। আপনি অত টাকা পেমেন্ট করলেন। আমার একটা রেসপনসিবিলিটি নেই ?'
    প্রকাশ শ্রীবাস্তব চোখ ছোট করে কলতানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
    বলল, ' হাঁ ... উও তো হ্যায়। পারবেন আজকে ?
    --- ' আশা তো করছি ... দেখা যাক ... '
    --- ' বহুত আচ্ছা। আপনার ওপর আমার বরাবর ভরোসা ছিল মিস্টার গুপ্ত ... '
    --- ' দাঁড়ান ... আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি ... ওনারা এদিকে আসছেন ... '

    তিনজন এসেছেন। অবশ্যই প্রাক্তন পুলিশ সুপার সুকমল পালধির ব্যবস্থাপনায়। তিনজনের মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত, বাকি দুজন কর্মরত।
    সকলেই রাজ্য পুলিশের উত্তর হাওড়া এবং হুগলি জেলার গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা। সকলেই পুলিশমহলে অত্যন্ত দক্ষ এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তিহম্পন্ন বলে পরিচিত। এরা তিনজনই কলতান গুপ্তর নানা কর্মকান্ডের সঙ্গে বেশ পরিচিত। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা শঙ্করীপ্রসাদ রায়চৌধুরী কলতানের অত্যন্ত গুণমুগ্ধ। তিনি তার বন্ধু ও একসময়ের সহকর্মী সুকমল পালধির কাছ থেকে কলতানের সম্বন্ধে অনেক শুনেছেন। কিন্তু কলতানের সঙ্গে দেখা হল এই প্রথম।
    কলতান এগিয়ে গিয়ে তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ' নমস্কার স্যার ... আসতে কোন অসুবিধে হয়নি তো ? '
    সবার আগে কর্মরত দুজনের মধ্যে একজন, মানে অতীন বোস বললেন, ' না না কলতানবাবু ... কোন অসুবিধা হয়নি। আমরা পুলিশের লোক ... আমাদের কি আর পথ ভুল হয় ... হাঃ হাঃ ... '
    কলতান হেসে বলল, ' সেটা তো ঠিকই স্যার, লোকাল থানা কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছে না। পোস্ট মর্টেম তো দূরের কথা, সুরতহালের রিপোর্টই বার করতে পারল না ... '
    অতীনবাবুর আর এক সঙ্গী বিতান মুখার্জী বললেন, ' সব খবর রাখি। কিছু করার নেই... অন্য কোন খেলা আছে পেছনে ... সবই তো বোঝেন ... '
    এবার শঙ্করীপ্রসাদ রায়চৌধুরী বললেন, ' তবে, আমরা কিন্তু ছাড়ছি না ভায়া ... কোনদিন কারো সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করিনি, সে যেই হোক। পালধি সব জানে। সে যাক, এখানে আপনার সেট আপ রেডি তো ... কেস হিস্ট্রিটা নলেজে আছে আমাদের। রিপিট করতে হবে না। মিস্টার পালধি ব্রিফ করেছেন ... '
    --- ' হ্যাঁ মিস্টার রায়চৌধুরী ... বেশি সময় নেব না ... ' কলতান বলল।
    --- ' ঠিক আছে, এক জায়গায় জড়ো করে নিন কম্পোনেন্টগুলোকে ... '
    --- ' হ্যাঁ ... আসুন ... এদিকে ... ' কলতান বলল।

    --- ' ও এই যে ... ইনি হলেন মিস্টার প্রকাশ শ্রীবাস্তব, এই এন্টারপ্রাইজের মেজ ছেলে। ইনিই আমাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন ... '
    অতীন বোস বললেন, ' ও আচ্ছা আচ্ছা ... ফ্যানট্যাস্টিক ... '
    বলে প্রকাশের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, ' খুব ভাল ... একটা কাজের কাজ করেছেন। তবে পুলিশে ছুঁলে ক' ঘা জানেন তো ... কলতানবাবু অবশ্য ঠিক পুলিশ নন, তবে পুলিশের গন্ধ তো আছে গায়ে ... '
    --- ' হ্যাঁ স্যার ... সে তো জানি ... সব জেনে শুনেই তো ওনাকে ডেকেছি ... '
    --- ' সেটা অবশ্য ভাল করেছেন, এটা স্বীকার করতেই হবে ... এতটা রিস্ক আজকালকার দিনে কেই বা নেয় বলুন ... '
    শঙ্করীপ্রসাদ বললেন, ' যাক, সেসব দেখা যাবে ... এখন চলুন ওদিকে যাওয়া যাক ... রান্নাবান্নার কদ্দুর ? '
    --- ' হ্যাঁ, চলুন ... এই হয়ে এল ... '
    বিতান মুখার্জী বললেন, ' আপনার লোকজন, যারা আসবার, সব এসে গেছে ? '
    --- ' হ্যাঁ ... এসে যাবে সব। ক'জনই বা আছে ? ওই তো ... সব্যসাচীবাবু আসছে ... '
    অতীন বোসরা তাকিয়ে দেখলেন স্থানীয় থানার বড়বাবু গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকছেন। গেটের দারোয়ান যদুনাথ তাকে সেলাম ঠুকল।
    কলতান বলল, ' ও হ্যাঁ ... যদুনাথকে বলা হয়েছে তো ... যদুনাথ দাস... আপনাদের ওয়াচম্যান। ওকেও ডাকবেন কিন্তু ... বড় ভাল লোক ... '
    ---' হ্যাঁ হ্যাঁ ... বলা হয়েছে বোধহয় ... ' প্রকাশ বলল।
    --- ' আচ্ছা চলুন ... বসা যাক ওখানে ... '
    ---‐ ' হ্যাঁ চলুন ... '

    দেখা গেল সুজিত বর্ধন একটা চেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন। মানু বা সহদেব কেউ বোধহয় চা করে দিয়েছে।
    প্রকাশ বলল, ' আপনারা চা খাবেন নাকি স্যার ? '
    শঙ্করীপ্রসাদ বললেন, ' না না ... চা টা খাব না ... একেবারে লাঞ্চ হবে ... '
    অতীন বোস বললেন, ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... কোন দরকার নেই... এই গরমে ... '
    বিতানবাবু বললেন, ' একেবারে অকাল বনভোজন ... তবে হ্যাঁ মিস্টার শ্রীবাস্তব আপনাদের গার্ডেনটা কিন্তু খুব সুন্দর ... '
    কলতান বলল, ' রিয়েলি সো ... এর রূপকার হল এই কেসের ভিকটিম রানি মাহাতোর বাবা সহদেব মাহাতো ... '
    --- ' সো স্যাড... সো স্যাড ... আলাপ হবে আলাপ হবে ... ' বললেন বিতান মুখার্জী।

    শঙ্করীবাবু বললেন, ' যাকগে, কাজটা সেরে ফেলা যাক। কলতানবাবু আপনি শুরু করুন ... '
    সুজিত বর্ধন খালি চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে শঙ্করীপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
    প্রকাশ বলল, ' কি ... কি ? '
    --- ' বিশেষ কিছু না ... আপনি যে কাজটার জন্য আমার ওপর ভরসা রেখেছিলেন সেটা কমপ্লিট করে ফেলেছি ... ' কলতান বলল।
    --- ' আচ্ছা ! মানে, জব ডান ? কালপ্রিট কোথায় ? কে কে ... '
    --- ' এই... ধরুন, আমাদের মধ্যেই আছে ... '
    --- ' মানে ? '
    --- ' সবই বলব। ব্যস্ত হচ্ছেন কেন ? তার আগে আপনাকে দু একটা কথা জিজ্ঞেস করি ... '
    --- ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... বলুন না ... আমি অলওয়েজ কোঅপারেট করতে তৈরি ... '
    --- ' ভেরি গুড। কিন্তু কোঅপারেটই যদি করতে চান এতগুলো মিথ্যে কথা বললেন কেন। এটা তো বাড়িতে কাউকে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে তাকে অপমান করার সমান ... '
    --- ' কেন ... কেন, এ কথা বলছেন কেন স্যার ? '
    --- ' এক নম্বর, আপনি বলেছেন যে ঘটনার আগের দিন, মানে এগারোই মার্চ, বুধবার আপনি ডানকুনিতে ছিলেন না ... কলকাতায় ছিলেন। এটা যে একটা ডাহা মিথ্যে কথা। সাক্ষী আছেন আপনার দাদা সুরেশজি। সেই ডেটের হিসেবের খাতায় আপনার সিগনেচার আছে। আপনি সেদিন সারাদিন বাড়িতেই ছিলেন। ঘটনার পরের দিন, মানে তেরই মার্চও আপনি ডানকুনিতে ছিলেন এবং প্রায় সারাদিন থানায় বসে ছিলেন সব্যসাচীবাবুর সঙ্গে। এ খবরটা পাকা। সূত্রটা আমি পরে জানাচ্ছি। আর এই সব্যসাচীবাবু দুবার দুরকম তথ্য দিয়েছিলেন নিজের সম্বন্ধে। প্রথম যেদিন ওনার সঙ্গে কথা বলি সেদিন উনি বলেছিলেন উনি সেদিন ভবানী ভবনে গিয়েছিলেন বিশেষ কাজে। থানায় ছিলেন না। অথচ বললেন, সুরতহালের সময় উনি প্রেজেন্ট ছিলেন। রেপ অ্যান্ড মার্ডারের ব্যাপারে উনি কনফার্মড। মাথার পেছনে মারা হয়েছে, ব্লান্ট অবজেক্ট ইনসার্ট করা হয়েছে ... এসবও বললেন, অথচ পি এম-এর জন্য বডি ট্রান্সফারের ডিটেলস জানেন না। জানেন নাকি তার সুপিরিয়ররা। এটা বোধহয় আমাকে ধোঁকা খাওয়ানোর একটা স্ট্র্যাটেজি হতে পারে। চেষ্টাটা মনে হয় যৌথ, মানে তার সঙ্গে হয়ত প্রকাশজিও আছেন। সে যাই হোক, আবার পরে যখন ওনার সঙ্গে ফোনে কথা বলি তখন জানালেন উনি সারাদিন থানাতেই ছিলেন। কল রেকর্ড আছে আমার কাছে। বললেন যে, কেউ এফ আই আর বা জি ডি করাতে আসেনি মাহির থেকে। অথচ প্রকাশজি প্রায় সারাদিন তার ঘরেই বসে ছিলেন।
    এই সময়ে সব্যসাচীবাবু ' আমি তো ... আমি তো ...' বলে কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন।
    শঙ্করীপ্রসাদবাবু তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ' আপনি চুপ করুন ... পরে বলবেন... আপনি বলুন কলতানবাবু ... '
    --- ' প্রকাশজি, আপনার দ্বিতীয় মিথ্যে হল কানপুর আর ভবানীপুর। আপনার স্ত্রী, সন্তান ভবানীপুরেই আছে আপনার শ্বশুরবাড়িতে। তিনি কেন আপনাকে ছেড়ে চলে গেছেন তার জন্য বিশেষ কোন গবেষণার দরকার হয় না। লোকাল পাবলিক, অনেকেই সব জানে। খুব সম্ভবত তিনি আপনার সঙ্গে মানিয়ে নেবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। আপনার শ্বশুরের নাম গিরিধারিলাল ..., বিল্ডিং প্রোমোটার।
    আপনার পরের মিথ্যা বা চালাকি যাই বলুন, সেটা হল ফোনের ধোঁকা। বাবার ফোন ... রুমাল চেপে, বৌয়ের ফোন এই ডানকুনিরই আশপাশ থেকে। লোকেশান ট্র্যাক করা হয়েছে। কানপুরের মেয়ে একটু হিন্দী অ্যাকসেন্ট মিক্সড করার দরকার ছিল। কাঁচা কাজ হয়ে গেছে। আসলে আপনি আমাকে একটু আন্ডারএস্টিমেট করে ফেলেছিলেন। আমাকে হায়ার করার আপনার একটা উদ্দেশ্য ছিল। সে কথায় পরে আসছি। এবার কাজের কথায় আসা যাক। আপনি আপনার বাড়িতে আমার থাকার প্রস্তাবনা আপনি নানা অজুহাতে এড়িয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু আপনি তা করেননি। এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ আপনি নিজেকে সমস্ত সন্দেহের উর্ধ্বে রাখতে চেয়েছিলেন,অন্তত আমার চোখে। কিন্তু আপনি মান্ডবীর সঙ্গে আগাম রিহার্সাল দিয়ে রাখতে পারেননি। বোঝাপড়ার অভাব হল ... '

    সুজিত বর্ধন গোল গোল চোখে কলতানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রকাশ হঠাৎ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। চিৎকার করে বলল, কি ... কি সব বলছেন আপনি ! মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি ? মান্ডবীর সঙ্গে আমার কিসের বোঝাপড়া ! বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন কিন্তু এবার ... '
    অতীন বোসও দাঁড়িয়ে উঠলেন। চেঁচিয়ে বললেন, ' আপনি বসুন ... বসুন বসুন ... যা বলার পরে বলবেন ... বসে পড়ুন ... '
    কলতান শান্ত গলায় বলল, ' হ্যাঁ, বোঝাপড়া তো বটেই। তবে এক হাতে তো আর তালি বাজে না। মানুরও এতে সায় ছিল নিশ্চয়ই ... '
    প্রকাশ আবার উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল, ' সায় মানে ... কিসের সায় ? আপনি কি বলতে চান ... আমি রানিকে মার্ডার করেছি ? '
    অতীন বোস আবার ধমকের সুরে বলল, ' আবার ... আবার ... বসুন বলছি ... '
    প্রকাশ বাধ্য হয়ে বসে পড়ল এবং সুজিত বর্ধনের সঙ্গে চোখ চাওয়া চাউয়ি হল এক পলক।
    কলতান বলতে থাকল, ' আমি কি একবারও বলেছি যে আপনি মার্ডার করেছেন ? '
    --- ' তা'লে কি বলতে চাইছেন ? পারলে কালপ্রিটকে ধরুন। এসব আবোল তাবোল মিনিংলেস কথা বলে ফালতু টাইম ওয়েস্ট করছেন কেন বেকার ... '
    --- ' বেকার বেকার, একদম বেকার। আপনি কেন যে খাল কেটে কুমির ঢোকালেন, মানে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন ... আসলে আপনি আশা করেছিলেন যে কলতান গুপ্ত পুরোপুরি ব্যর্থ হবে এবং আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ধোঁয়া তুলসিপাতা হয়ে স্বমহিমায় বিরাজ করবেন। আপনি কিছুতেই আপনার বাবার সঙ্গে আমার দেখা করাতে চাননি। বাবার নম্বর বলে নিজেরই অন্য আর একটা মোবাইলের নম্বর দিয়েছিলেন।

    সেখানে কল করার পর আপনি চালাকি করে গলাটা যাতে অন্যরকম শোনায় তাই মোবাইলে কোন কাপড় বা তোয়ালে চেপে আমার সঙ্গে আপনার বাবা সেজে কথা বলেছিলেন। গলাটা ভসভসে শোনাচ্ছিল। ওটা যে আপনারই গলা এবং আপনি আর কোথাও না নিজের ঘরে বসেই কথা বলছিলেন সেটা আমি ডিজিটাল মেকানিজম এক্সপার্ট দিয়ে টেস্ট করিয়ে নিয়েছি। রিপোর্ট আমার সঙ্গেই আছে। আর মোবাইল লোকেশকন ট্র্যাক করাটা তো কোন ব্যাপারই না। আপনি বোকার মতো কাজ করেছেন। আমার ধারণা, আপনার বাবা এরকম গুণধর ছেলের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ। তিনি মনে হয় আপনার মুখদর্শন করতে চান না। ব্যবসার কাজকর্ম করতে দিলেও ব্যবসার শেয়ার থেকে আপনাকে বের করে দিয়েছেন। আপনি চাননি আমি আপনার অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ বাবার সঙ্গে দেখা করে তার মুখে আপনার গুণপনার কথা জানতে পেরে যাই। কি ঠিক বলছি তো প্রকাশবাবু ? '
    প্রকাশ শ্রীবাস্তব কোন কথা না বলে মাথা ঝুঁকিয়ে গনগনে চোখে কলতানের দিকে তাকিয়ে রইল।

    কলতান একবার ওদিকে তাকিয়ে দেখে নিল সহদেব একটা বড় কড়াইয়ে মাংস কষছে। এখানেও ভরপুর গন্ধ ভেসে আসছে। মানুকে দেখা যাচ্ছে না কেন কে জানে। তিন্নি যথারীতি একপাশে একাকী খেলা করে চলেছে। সহদেবকে দেখে কলতানের খুব কষ্ট হল। বেচারি সব দিক দিয়ে মার খাচ্ছে। তার ওপর এই সব পিকনিক টিকনিকের হ্যাপা নিতে হচ্ছে কলতানের কথায়।
    এই সময়ে খেলা পাগল এদের ছোট ছেলে মনোজ এসে বসল। বসে মোবাইল খুলে কি একটা খেলা দেখতে লাগল।
    কলতান শঙ্করীপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ' স্যার ... আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো ... এত গরম পড়েছে ... '
    --- ' না না ... গরম টরম কোন ব্যাপার না। আর এখানে তো দক্ষিণ দিক থেকে দিব্যি হাওয়া আসছে ... ইউ প্লিজ ক্যারি অন ... ডোন্ট স্টপ ... '
    কলতান বলতে থাকল, ' প্রকাশজি আপনি বিকল্প রোজগারের একটা রাস্তা খুঁজে বার করে নিলেন। আপনার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। বেশি মাত্রায় কোডিন মিশ্রিত কাফ সিরাপ ম্যানুফ্যাকচার করা। এতে বিরাট প্রফিট আর্ন করা যায়। প্রচুর টাকা করা যায় অল্প সময়ে। খানাকুলে কাফ সিরাপ তৈরির একটা বেআইনি ফ্যাক্টরি ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। প্রশাসন জানত কি না, সেটা আমাদের দেশে অবান্তর প্রশ্ন। আপনি যে ভাবেই হোক সে কারখানাটা কিনে নিলেন। এভিডেন্স এবং উইটনেস আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হবে। চিন্তা করবেন না।
    মাহিরের ওই পিছনদিকের গোডাউনটা আপনি নিজস্ব গোডাউন বানিয়ে ফেললেন, ভরা বোতল এবং খালি বোতলের। এখান থেকে মাল পাঠানো হত বিভিন্ন জায়গায়। প্রতিবেশী দেশেও যেত, মানে এখনও যায় হয়ত। আপনি আমাকে এই গুদাম ঘরের ভিতরে একা যেতে দিয়েছিলেন ওই একই মোটিভ নিয়ে, মানে আমার চোখে নিজেকে নিপাট নিষ্পাপ প্রমাণ করা। তাছাড়া আপনি আশা করেননি যে আমি ওখান থেকে কোন স্যাম্পল কালেক্ট করতে পারি।
    সে যাই হোক, এই কাফ সিরাপ আপনাকে শুধু অর্থই দিল না। এর সঙ্গে দিল মান্ডবীকেও।
    স্বৈরিনী চরিত্রের মান্ডবী সহদেবের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী, যদি ওকে আদৌ স্ত্রী বলা যায়। সে তিন্নির মা ঠিকই, কিন্তু রানির বায়োলজিকাল মা নয়। সেটা সহদেবকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা পাবে। যাই হোক, মান্ডবী যে সুযোগের খোঁজে ছিল সেটা সে সহজেই পেয়ে গেল আপনার সংসর্গে আসার পর। আপনি এবং মানু পরষ্পরের আকন্ঠ যৌনপিপাসা মেটাতে লাগলেন প্রতিদিন রাত্রে। পেমেন্ট নিশ্চয়ই ভালই পাচ্ছিল মানু। যতই কামাসক্ত হোক, সে তো অত বোকা নয় যে এমনি এমনি শরীর দেবে। মানু আসত আপনার কাছে সহদেবের কাশি সারানোর নাম করে তাকে কাফ সিরাপ খাইয়ে ট্র্যাঙ্কুইলাইজড করে। তার বাবার ওপর এই ড্রাগ অ্যাপ্লিকেশন ব্যাপারটা রানি টেকনিক্যালি না বুঝলেও একটা বিপজ্জনক ব্যাপার বলে অনুমান করতে পারছিল খুব সম্ভবত। মান্ডবী মাঝে মাঝে রান্না বান্না করে দেবার বাহানায় দিনের বেলায়ও আসত দোতলায়। কারণ এ ধরণের জুটি সাধারণত একটা সময়ের পর বাঁধনছেঁড়া, বেপরোয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ওঠে। না হলে কেউ ব্যবহার করা কন্ডোম যেখানে সেখানে ফেলে রাখে। চিন্তা করবেন না, ওটা আমার জিম্মায় আছে। আস্তাকুঁড়ের আবর্জনা কুড়িয়ে বেড়ানোই তো আমার কাজ ... '
    ইচ্ছে করেই তিন্নির নামটা নিল না কলতান।
    বলতে লাগল, ' যদি অস্বীকার করেন, ডিএন এ মেলাতে সাধারণ একটা ব্লাড টেস্ট করলেই হবে আপনাদের দুজনের। এনাফ ফ্লুইড অ্যান্ড সোয়াব পাওয়া গেছে ওতে, দুজনেরই। অসুবিধে হবে না। এগারোই মার্চের... না না টেনথ মার্চের ওই দুপুরে, মানে রানির ঘটনাটা ঘটার আগের দিন মোস্ট প্রোব্যাবলি এরকম একটা বাঁধনছেঁড়া সেশান চলছিল আপনাদের দুজনের মধ্যে। আপনারা অন্তত একজন নীতিনের দোকানের টফি খেয়েছিলেন। খেয়ে মোড়কটা ঘরে ফেলে দিয়েছিলেন। মানুর কপাল থেকে একটা খয়েরি টিপ খসে পড়েছিল ঘরের কোথাও। আহা হা ... চিন্তা করবেন না, সব আমার জিম্মায় আছে।
    ভর দুপুরবেলার সেই হট সেশানের মধ্যে মানুর গলার হার থেকে একটা কালো পুঁথি খসে পড়ে, যেটা আপনি বা আপনার বেড পার্টনার কেউই খেয়াল করেননি।
    এদিকে তার মা অনেকক্ষণ ধরে ফিরছে না দেখে
    রানি খোঁজ নিতে দোতলায় যায় এবং আপনাদের অসাবধানতাবশত সে আপনাদের অনভিপ্রেত অবস্থায় দেখে ফেলে। অস্থির চিত্তের কারণে হয়ত দরজাটাও বন্ধ করা হয়নি। মানু আপনার ঘরে ঢুকেছিল বেলা বারোটা নাগাদ এবং মানু রানিকে নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে যায় বেলা তিনটে নাগাদ। সাক্ষী আছে, দরকার হলে হাজির করাব।
    মানু মেয়েকে এটা ওটা বুঝিয়ে ব্যাপারটা চাপাচুপি দিলেও চোখে দেখা একটা ব্যাপার মেয়েটা ভুলে যাবে কি করে। সেটা আপনাদের দুজনেরই না বোঝার কথা নয়। তাই বদনামের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে প্ল্যানটা করে ফেললেন ... '
    --- ' কি প্ল্যান ... প্ল্যান আবার কি ! আমি কি খুনি নাকি ? কি ভেবেছেন কি ? '
    প্রকাশ আবার চেঁচিয়ে উঠল।
    --- ' আরে ... আপনি আবার খামোখা উত্তেজিত হচ্ছেন। আমি কি একবারও বলেছি যে আপনি খুনি ? আপনি শুধু বলুন, আমি এতক্ষণ ধরে যা বললাম ... সেগুলো ঠিক না ভুল ... '
    প্রকাশ শ্রীবাস্তব কথাটার কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে কি ভাবতে লাগল।
    কিছুক্ষণ পরে বলল, ' নীতিন আসেনি ... নীতিন ? '
    মনোজ নির্বিকারভাবে মোবাইল থেকে এক ঝলক চোখ তুলে বলল, ' ওই যে ... '
    সকলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, নীতিন গেট দিয়ে ঢুকে এদিকে আসছে। তার পিছনেই একজন চাপদাড়িওয়ালা রোগা লম্বামতো পাঞ্জাবী পাজামা পরা ভদ্রলোককে গেটের মুখে যদুনাথের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল।
    কলতান স্বগতোক্তি করল, ' বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ... '
    সে হাত তুলে বলল, ' এই যে ...এদিকে এদিকে ...'

    ( পরের পর্বে ইতি )

    ******
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • . | ১৪ মার্চ ২০২৫ ১২:০৫541678
  • সাসপেন্স প্রায় শেষ 
  • syandi | 2402:e280:3d81:135:757f:5d6f:4e66:***:*** | ১৪ মার্চ ২০২৫ ১৫:৫০541686
  • কিন্তু মামা কে ভাগ্নীকে নাটকের শেষ অঙ্কে তাকে দরকার এবং তাকে রাখবে বলে কথা দিয়েছিল তার কি হল?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন