(স্নাতক পর্যায়ে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমি আমার জীবনের নানান ক্ষেত্রে নারীবাদী হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকি। আমার জন্য নারীবাদী আত্ন পরিচয় রাজনৈতিক পরিচিতির বাইরে নয়। এই প্রবন্ধে জেন্ডার সংবেদনশীল বিষয়ে কাজ করার কতগুলো এমপিরিক্যাল অভিজ্ঞতা পাঠকের কাছে হাজির করার প্রয়াস চালিয়েছি। “আমি কী নারীবাদী?” আমার এই বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রার উত্তর কোনভাবেই এই প্রবন্ধ নয়।)
‘বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতি’ [১] ফরম্যাল এবং ইনফরম্যাল সাক্ষাৎকার নিয়ে শেষমেশ আমাকে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসরত ‘ধর্ষিত’ নারীদের সাথে কথা বলার অনুমতি দেয়। প্রায় দেড় মাস নানার প্রশাসনিক ঝুটঝামেলা চুকিয়ে বিএনডব্লিওএলএ থেকেই আমাকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেদিনও অন্য দিনগুলোর মতো আমি অফিসের ওয়েটিং রুমে বসা। আমার থেকে ৫/৬ হাত দুরে বড় ঘোমটার আরেকজন নারী বসে অপো করছেন। আমি সম্ভবত কোন কারণে উদ্বিগ্ন ছিলাম কিংবা যাই হোক আমি পাশের নারীটিকে ভালভাবে লক্ষ্য করিনি। তবে এতটুকু বুঝেছিলাম ঐ নারীও কোন কাজে এসেছে। হঠাৎ নারীটির মাথা থেকে ঘোমটা পড়ে গেলো, অন্যমনস্ক অবস্থাতেই আমি তার পূর্ণ চেহারা স্পষ্ট করে দেখতে পেলাম। কোন এক অজানা আশংকায় আমি জোরে চীৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে ‘হিস্টিরিয়া’ রোগীর মতো কাঁপতে লাগলাম। আমি এতক্ষণ যে নারীকে দেখছিলাম তার মুখের ডান পাশ কোনভাবেই ‘অসুন্দর’ নয়, ভীষণ রকম ‘মেয়েলী সুন্দর’। কিন্তু বাম পাশে চোখ, নাক কিছুই নাই, কেবল একতাল কাদার মতো। কিছুণের মাঝে আমি ঐ নারীর সাহায্যেই ধাতস্থ হলাম। আমার ভীষণ লজ্জা হচ্ছিল। এই প্রথম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি বুঝে নিয়েছিলাম আমি ‘স্বাভাবিকত্বের’ মাঝে আটকে আছি, আমার মনস্তত্ব ‘যা কিছু অস্বাভাবিক’ তাকে এড়িয়ে যায়। আমি ধর্ষিত এসিডদগ্ধ নারীকে দেখে ভয় পাই। আমার গবেষণার ধর্ষণ কেবল অসম্মতির যৌন মিলন নয়। আমাকে নৃশংসতার বহুরূপী চড়াই উৎড়াই পাড় করতে হবে। শুরু হল আমার ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ বোঝাপড়ার পথ চলা”।
এই আত্মকথন আমার নিজের। আমি ‘অভিজ্ঞতায় ধর্ষণ, বহুমাত্রিক সহিংসতা, নারী জীবনের পুনর্গঠন’ শীর্ষক আমার (২০০৬-২০০৭ সময়কালে কৃত) গবেষণার মাঠ পর্যায়ের তথ্য হিসেবে এই স্মৃতি লিপিবদ্ধ করেছি। নারীর প্রতি সহিংসতা গবেষণার কেন্দ্রে রয়েছে নারী জীবনের ‘পরতের পর পরতের’ [২] ভয়াবহ নিপীড়ন অভিজ্ঞতার বহুরূপ।
নৃবিজ্ঞানের জেন্ডার পঠনপাঠনের কোর্স পড়তে পড়তে নারী হিসেবে আমার মাঝে যৌন নিপীড়ন নিয়ে নানান রকমের সচেতনতা তৈরী হয়েছিলো। তারপরেও ব্যক্তি জীবনে আমি ভাবতাম যা কিছু আমার জীবনে দমনমূলক, নিপীড়নমূলক তার কারণ কোন না কোন ভাবে আমি, আমার অসাবধানতাই আমাকে উৎপীড়নের সুযোগ করে দিচ্ছে কিংবা আমি যেহেতু নারী তাই নিপীড়িত হবই। এই লালিত বোঝাপড়া সমেত আমি ধর্ষিত নারীদের নৃশংস নিপীড়ন অভিজ্ঞতা শুনতে শুরু করি।
ধর্ষিত নারীদের নিপীড়ন অভিজ্ঞতার কথন শুনতে শুনতে গবেষক আমার জীবন মূল্যবোধ, ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে থাকে। সহিংসতাবিদ্ধ নারীর সাথে আমার ‘যন্ত্রণা’ বোধে মিলের জায়গা তৈরী হয়। ১৮ জন নারীর যৌন উৎপীড়ন অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে করতে, লেখতে লেখতে কখনও আমি রেগে উঠি, কখনও আমার অসহায় লাগতে থাকে, আমার গা গুলিয়ে বমি আসতে থাকে, আমি হাঁপিয়ে উঠি, প্রতিনিয়ত অসুস্থ বোধ করি। আমি দেখতে থাকি মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে বসবাসে অভ্যস্ত আমার আজীবন ‘নির্ভরতা আর শ্রদ্ধার’ সম্পর্কগুলো ভাঙ্গতে শুরু করেছে, আমার মধ্যবিত্ত শ্রেণীচৈতন্যের ধরে নেয়া ধারণাগুলো (আমার বাবা, ভাই তো নয়ই আমার পরিচিত কোন মানুষই ধর্ষক হতে পারে না) নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে (তারমানে কিন্তু এই নয় যে পিতা কিংবা ভাই মাত্রই ধর্ষক)। গবেষণা আমাকে এই বোঝাপড়ায় পৌঁছে দেয় যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণীভেদে নারী আসলে কেবল ‘ভোগের বস্তু’ তাই যেকোন সময়ে, যেকোন পরিসরে, যেকোন সম্পর্কে নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারে [৩]। ‘আমি জানি কবে ধর্ষিত হই!’, ‘ধর্ষিত হলে কেউ তো কাছে থাকবে না’ এমন ভয় আমার মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। একইসাথে ‘ধর্ষণ থেকে বাঁচবো কীভাবে’ এই প্রশ্নের কোর সদুত্তর আমার জানা ছিলো না। আমার পরিবার আমার পাশে থাকবে এই ধরে নেয়া ধারণা ভেঙ্গে যাওয়ায় গবেষিত নারীর কথন শুনতে শুনতে মাঝে মধ্যে আমার মাঝে একাকীত্বের শীতল ভয় বয়ে যেতো। আমার চিন্তায় কোন বিশ্লেষণ আসে না, বিপুল তথ্যের অসহ্য যন্ত্রণার জগতে আমি শুধু নিজেকে তলিয়ে যেতে দেখি।
তথ্য, তত্ত্ব আর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি ‘ডিসারটেশন’ দাঁড় করাবার শিক্ষার্থী সুলভ প্রবল চাহিদা থেকে আমি যখন নারীবাদী বিভিন্ন লেখার সাথে পরিচিত হচ্ছি তখন আমি দেখতে পাই আমার বিশ্লেষণের মাধ্যমে যেমন একদিকে গবেষিত নারীর অভিজ্ঞতা জ্ঞান ও ক্ষমতা ক্ষেত্রে নাম পাচ্ছে, তেমনি আমার জীবনের পুরনো, ভুলে যাওয়া, অস্বস্তিকর কিন্তু নামহীন অভিজ্ঞতাগুলো স্মৃতিতে সবলে জেগে উঠছে। আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনাকে এই প্রথমবারের মতো যৌন উৎপীড়ন হিসেবে নাম দিচ্ছি, চিনতে পারছি, আমি আমার বহুদিনের ‘ভাল ভেবে নেওয়া’ সম্পর্কের উৎপীড়ক চেহারাকে পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছি, আমি আমার কাছের মানুষদের নিয়ে শংকিত হচ্ছি। এই সংকট নিপীড়িত হয়েছি এমন আশংকার, আগামী দিনে নিপীড়িত হবো এমন শংকার। এই সংকট কাছের কারও নিপীড়িত হবার আশংকার।
আমার অভিজ্ঞতাই (রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, অসহায়ত্ব) গবেষণাকে গভীরভাবে অনুধাবনের রাস্তা তৈরী করে দেয়। ধর্ষণের বেশ কয়েক বছর পর কথ্য ইতিহাসের নারী তার কথনে জীবনের সকল বাস্তবতা এবং সম্পর্ককে ধর্ষণের সাপেক্ষে বিন্যস্ত করে তার জীবনের প্রথম ধর্ষণ কিংবা একমাত্র ধর্ষণের যৌক্তিকতা ও সম্ভাবনার ক্ষেত্র নির্মাণ করে গেছে। জীবনের সব দৃশ্য আর সম্পর্ক সহিংস অভিজ্ঞতায় এসে মিলেমিশে যায়। নারী ধর্ষণকে তার জীবনের একমাত্র নিপীড়ন হিসেবে চিহ্নিত না করে বহুরূপী নিপীড়নের কথা বলে। ধর্ষণ নারীর কথনে বিদীর্ণ মুহূর্ত, ঐ সময় যখন থেকে তার জীবনের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সমস্ত সত্য ও মিথ্যা, স্বপ্ন ও বাস্তবতা, সকল সম্পর্ক, আশা ও আকাঙ্খা তার আওতার বাইরে চলে গেছে, যে সময় থেকে তার চিরচেনা পরিবেশ উল্টেপাল্টে আমূল বদলে গেছে।
কথ্য ইতিহাসের সহিংসতাবিদ্ধ নারীর মতো গবেষণা পরবর্তী সময়ে গবেষক আমি অনুধাবন করতে শুরু করি আমার জীবনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আমার পাবলিক জীবন, আমার শিক্ষা জীবনের নানা দিক ‘অভিজ্ঞতায় ধর্ষণ’ এই গবেষণা থেকে অর্জিত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে পুনর্বিন্যস্ত হচ্ছে। ধর্ষিত নারীর মতো আজ আমি আমার জীবনের ফেলে আসা ঘটনা, আমার জীবন দর্শনকে নতুন করে বিন্যস্ত করছি। নিশ্চিতভাবে গবেষণার প্রভাব কেবল আমার একাডেমিক জীবনের মাঝে স্থির নয়। গবেষণা আমার ব্যক্তিক, পাবলিক এবং পড়াশুনার জীবনে প্রভাব ফেলেছে এমনকি আমার আত্মপরিচয়েও। এই প্রক্রিয়া আজও চলমান। আজ আমি আমার অজান্তে ঘরে ও বাইরে ‘নারীবাদী’ হয়ে উঠার অভিজ্ঞতা অর্জন করছি।
দ্বন্দ্ব, রাগ, অস্বস্তি আর টানাপোড়ন
গবেষক আমি টানা ২০ দিন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে সহিংসতাবিদ্ধ নারীর সাথে কথা বলেছি। ‘আশ্রয়কেন্দ্রে কী হয়’ এ নিয়ে সমাজে নানা কথা প্রচলিত। আশ্রয়কেন্দ্রে সারাদিন থাকবো আর তাতে আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে আমার পরিবার থেকে প্রথম এই আশংকা আসে। আমাকে বাসা থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বারণ করা হয়। আশ্রয়কেন্দ্রে ‘পতিতালয়ের’ মতো ‘যখন তখন পুলিশ রেইট হয়’ এমন এক ধরে নেয়া ভয়ে আমার আর পরিবারের মাঝে টানাপোড়ন শুরু হয়। এমনকি বলা হতে থাকে আজগুবি বিষয় ‘নৃবিজ্ঞানে’ পড়তে দেয়াই উচিত হয়নি। শেষপর্যন্ত আমাকে ব্যাগে করে আমার খাওয়া, খাবার পানি নিয়ে যেতে হতো। আমার পরিবারের ভয় ছিলো আমাকে আশ্রয়কেন্দ্রে ‘কিছু একটা খাইয়ে অজ্ঞান করে খারাপ কাজ’ [৪] করিয়ে ফেলা হবে।
আমি গবেষিত এলাকায় মাঝে মধ্যে রিকশায় যেতাম। আসা যাওয়ার সময় ভাংতি টাকা না থাকলে কিংবা অন্য কারণেও আমি আশ্রয়কেন্দ্রের আশপাশের দোকানে যেতাম। আমাকে দোকানীরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো আমি আশ্রয়কেন্দ্রে কী করি, আশ্রয়কেন্দ্রের সিকিউরিটি ব্যবস্থা কেমন। আমি জানতে চাইতাম কারা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে সেটা দোকানীরা জানেন কিনা। উত্তরে প্রায়ই দোকানীরা বলতো ‘খারাপ মেয়েরা থাকে’, ‘যারা বাজে পথে গেছে এরা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে’, ‘সরকার বেশ্যাদের ধরে এনে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখে’। আমি রেগে যেতাম। আমি জানতে চাইতাম কে উনাদের বলেছে ‘খারাপ মেয়েরা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে?’। দোকানীরা আমাকে রাগ করতে বারণ করতেন এবং বলতেন ‘খারাপ না হলে বাড়ির মানুষ কি ফেলে যায়?’। আমি ৫/৬ দিনের মাথায় আশ্রয়কেন্দ্রের আশপাশের দোকানগুলোতে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। এমনকি টাকা ভাংতি না থাকলে আমি রিকশাওয়ালাকে ভাড়ার থেকে ১০/২০ টাকা বেশী দিতেও দ্বিধা করতাম না।
প্রতিদিন সকাল ৯টার দিকে আমি আশ্রয়কেন্দ্রের গেইট দিয়ে ঢুকতাম। প্রায় দিন আমি দেখতাম চার-পাঁচতলার জানালার শিকে ছোট মুখগুলো ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অত্যন্ত শান্তমনে আরোপিত আবেগহীন মনোভাবে আমার মাঠকর্ম করবার চেষ্টা করেছি, যেন ভয়াবহ নৃশংসতার বয়ানের প্রত্যেক শব্দে আমার গা গুলিয়ে না উঠে। আমি চিন্তা করতাম আমি কী ক্রমাগত আমার গবেষণাকাজে মিথ্যা ভড়ং পড়ে আছি? একারণেই কী নিপীড়নের কথা শুনলে আমার খারাপ লাগে, বমি আসে, আমি কি ধর্ষিত নারীদের মনে মনে ঘেন্না করি? আমি কান্নারত নারীকে সান্ত্বণা দেই আমার হাত ধরা, সান্ত্বনা সবই কি ভনিতা? এই প্রশ্ন আমি আমার নিজেকেই করতে থাকি। আমি ভাবতে লাগলাম যন্ত্রণার কথা শুনে আমার খুব কষ্ট হওয়াও কী আসলে মিথ্যা, ভান? ভাবতে ভাবতে আমি অনুধাবন করলাম আমি নিপীড়িত নারীকে ঘেন্না করি না বরং আমি নিপীড়ন ঘটনার বর্ণনাকে ঘেন্না করি, সম্পর্কের অবিশ্বাস নিয়ে এক ধরনের ক্রমাগত অশুচিতাবোধ আমাকে তাড়া করে ফেরে, এতোদিনের বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়া নিয়ে আমি ভয় পাই, উৎপীড়নের ভয়াবহতা আমাকে ভীতি করে।
আর তাই মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারের প্রথাগত ‘স্বাভাবিক’ [৫] নারী আমি প্রতিদিন গবেষণার জন্য যে যাত্রা করি, তাতে আমি ঐসব নারীদের কাছে যাই, যারা আমার মধ্যবিত্ত মানসিকতায় ‘অচ্ছুৎ’, যারা ‘অশুচি’, আর তাই হিন্দুদের ‘গঙ্গা’ জলে স্নানের মতো বা ধর্ষিতার অনবরত গোসলের মতো আমি প্রত্যেকদিন সাাতকার নিয়ে ফিরে এসে ডেটল সাবান আর ডেটল এ গোসল দিতাম। আমি আমার শরীরে পানি ঢেলে নিঃশব্দে কাঁদতাম, আমি আমার শ্রুত সকল পাপ থেকে নিজেকে ‘পবিত্র’ করতে চাইতাম। আমি এখনও নিজেকে প্রশ্ন করি, আমার অনবরত পানি ঢালার কারণ কী ছিল? আমি কি ‘ধর্ষিত’ নারীকে ঘেন্না করি? নাকি যে প্রক্রিয়ায় ধর্ষিতা ধর্ষণের পর অনেক ক্ষেত্রে পানি ঢালতে প্রবল হয়ে উঠে এমন কিছু কী আমার মাঝেও ঘটে? নাকি পানি ঢেলে আমি আমার সমাজে ফিরে আসি যেখানে মধ্যবিত্ত মানসিকতার বাবা, মা, ভাই, বোনের আদর্শ সর্ম্পক ও নিরাপত্তার ধারণা প্রোথিত? ঐ জীবন যেখানে কথ্য ইতিহাসের নারীর জীবনবাস্তবতার চাইতে ভিন্ন আমার জীবনে, আমার পরিচিত জগতে, আমার তথাকথিত নিপীড়নহীন অবাস্তব বাস্তবতায় আমার অভিভাবক কখনই ধর্ষক হতে পারে না। ধর্ষক মানে ‘অস্বাভাবিক’, অচেনা কোন একজন। হয়তো ‘গুন্ডা’, সন্ত্রাসী, ‘চরিত্রহীন বদমাশ’।
বাসাবাড়ির প্রতিক্রিয়া
আমার জীবনভর ভেবে নেয়া নিরাপদ সম্পর্কের প্রতি প্রত্যেক নারীর কথন প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। ধর্ষণের চিরচেনা ডিসকোর্স (ধর্ষণ কেবল রাতে ঘটে, গুন্ডা বদমাইশরা ধর্ষণ করে, অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ হয়, শালীনভাবে কাপড় পড়লে নিজেকে পুরুষের লোভের বাইরে রাখা যায়, নিজেকে ধর্ষণ থেকে বাঁচানো যায় ইত্যাদি ইত্যাদি) আমার জন্য বদলাতে থাকে, আমি সম্পর্ক ও বিশ্বাসকে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকি। আমি তীব্রভাবে মনে করবার চেষ্টা করতে থাকি অতীতের ঘটনাকে, আমার কোন্ কোন্ ‘সর্ম্পক’ অতীতে কিংবা এখন আমার উপর সহিংস আচরণ ঘটাচ্ছে সেসব উদঘাটনের জন্য আমি মনোযোগ দেই। আমি আমার এতোদিনের সম্পর্ক আর বিশ্বাসের পরীক্ষা নিতে থাকি। আমি আমার ভেবে নেয়া ‘নিদোর্ষ’ স্পর্শ নিয়ে কুটিল করে ভাবতে শিখি। আমি আমার পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে এই অভিজ্ঞতা সহভাগ করতে চাই। নারীর বহুরূপী নিপীড়ন অভিজ্ঞতার সাথে সাথে আমি আমার ‘সহিংস’ অভিজ্ঞতার বিদীর্ণ টুকরোগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টা শুরু করি।
আমি বাসায় নিজে কম্পিউটারে গবেষণার তথ্য লিপিবদ্ধকরণের কাজ করি। আমার পরিবারের সদ্যসরা পাশে বসে কখনও লেখাগুলো হাতে নেয়। ছদ্মনামের নারীর নিপীড়ন অভিজ্ঞতা পড়ে। কেউ কেউ মন্তব্য করে এই মেয়েরা মিথ্যা বলছে, কেউ কেউ মন্তব্য করে বাবা-ভাই ধর্ষক এগুলো একদম মিথ্যা কথা, বানোয়াট ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাজে বিরাজমান কথাগুলোই আমার পরিবার পুনরুৎপাদন করে। আমি তারস্বরে প্রতিবাদ জানাই। আমার মনে হতে থাকে যে প্রক্রিয়ায় আমার তথ্য পরিবারে মিথ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে একইভাবে এই তথ্য একাডেমিক কিংবা সমাজের অন্য ক্ষেত্রে অসত্য বা বানোয়াট হয়ে যাবে। বারবার আমার চারপাশের মানুষজন নানা ভাবে এটাই প্রমাণ করবার চেষ্টা চালায় যে (গবেষিত নারীদের ধর্ষক যেমন গুন্ডা মাস্তান ছিলো, তেমনি বাবা, মামাও ধর্ষক ছিলো, জারজ পরিচয়ের কারণেও নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়, ঘরে-দিনেও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, মাত্র চার বছর বয়সেও নারী শিশু যৌন ধর্ষণের শিকার হয়েছে, উচ্চবিত্তের নারীর সাথে নিম্নবিত্তের নারীও ধর্ষিত হয়েছে ইত্যাদি নানান কিছু) আমাদের পরিবারে, চেনা জগতে এমন তো নেইই আমাদের দেশের ধর্ষণ বাস্তবতাও এমন ভয়াবহ নয়। আমি প্রতিনিয়ত আমার গবেষণাকে “আমাদের নয়” এমন তীব্র আকাঙ্খায় পর্যুদস্ত হতে দেখি।
আমি আমার খসড়া লেখা আমার পরিবারের আগ্রহী সদস্য বিশেষত ১৬ বছর উর্ধ্ব নারীদের পড়ে শোনাতে শুরু করি। আমার পরিবারের নারী সদস্যরা নারীর কথ্য ইতিহাসের সাথে যেমন নিজেদের অভিজ্ঞতার অমিল খুঁজে পায় তেমনি মিলও খুঁজে পায়। অভিজ্ঞতার অমিল আমি সহ আমার মা, বোন, ভাবীদের কাছে, আমার সহযোগী নারী বন্ধুদের কাছে অভিজ্ঞতার অজানা ধরণ হয়ে উঠে। ‘বাবা ধর্ষক’ আমাদের বিচ্ছিন্ন না করে সতর্ক করে। আমার কাজ নিয়ে বাসায় আলোচনা হতে থাকে। ‘আমি পাগল হয়ে যাবো’ এমন মন্তব্য যেমন আসে, কথোপকথন চালাতে চালাতে আমার পরিবারের এক শিশুকন্যার শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা স্পষ্ট হয়ে যায়। আমরা এখন ধর্ষণ, শিশু যৌন উৎপীড়নের মতো বিষয় নিয়ে পারিবারিক আলোচনা করার সাহস অর্জন করেছি। খোলাসাভাবে পরিবারের ‘পুরুষ’ সদস্যদের উৎপীড়ক না বলতে পারলেও আমাদের কোন কোন আত্মীয় উৎপীড়ক সেটা চিহ্নিত করে পরিবারের নারী সদস্যরা একে অপরকে সতর্ক করে। যৌথ পরিবারের ভাবী-ননদের ধরে নেয়া ‘টানাপোড়নের সম্পর্ক’ এই ক্ষেত্রে এসে ন্যূনতম হয়, সহজে উৎপীড়ককে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।
গবেষণা চলাকালীন সময় থেকে গবেষক আমার নিরাপত্তার বোধে বড় রকমের পরিবর্তন আসে। আমার ঘরের দরজা গবেষণার পূর্বে আমি কেবল ‘ব্যক্তিগত’ কারণে কোন কোন সময় লক করে বন্ধ করতাম। নারীর কথন শোনার সময় থেকে রাতে মায়ের সাথে ঘুমালেও আমি আমাদের বেডরুমের দরজার লক, ছিটকিনি দুটো আটকিয়ে ঘুমাতে যাই। কারণ আমি জানি ধর্ষক কেবল অচেনা মানুষ নয়, চেনা মানুষও ধর্ষণ করে। আমি আমার পরিবারের সকল সদস্যকে ভালবাসি, বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি উৎপীড়নের বহুরূপী প্রভাব আর ধরণকে নারী অভিজ্ঞতায় চাক্ষুষ দেখেছি।
নতুন করে ‘চুদাইছে’ বলতে শেখা
‘আশ্রয়কেন্দ্রে’ কিংবা সমাজে যেখানেই থাকুক না কেন গবেষিত মধ্যবিত্ত নারীরা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবন্ধের মতো করে ঘটনার পরম্পরা রেখে অভিজ্ঞতার কথা বলে গেছে। ‘নিম্নবিত্তের’ নারী স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় কথা বলায় মধ্যবিত্ত মানসিকতার ‘অশ্লীল’ শব্দ হরহামেশাই তাদের কথনে যুক্ত হতে দেখা যায়। যেমন-‘চুদাইছে’, ‘চুদানো’, ‘ল্যাওড়া’, ‘চ্যাট মারা’। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারী আমি জ্ঞানত এই শব্দ উচ্চারণ করি না, আমার জীবন ও জগতে এই শব্দ অজানা না হলেও নিষিদ্ধ । এই শব্দ আমার কাছে ‘গালাগালি’। গবেষক হিসেবে আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ‘সম্পর্ক’, ‘সহবাস’, ‘ইজ্জতহানি’, ‘ইচ্ছেমতন ব্যবহার করল’ অস্বস্তি ও মর্যাদাহানির মূল্য জড়িত এই শব্দগুলো দিয়ে নিপীড়নকে চিনি। আমার কাছে ধর্ষণকে এই শব্দগুলোয় প্রকাশ করাই ‘স্বাভাবিক’, সম্মানের। প্রথমদিকে নারীর কথনের ‘চুদানী’ প্রত্যয়গুলো আমাকে কাঁপিয়ে দিয়ে যেতো।
গবেষণা সম্পাদনের প্রক্রিয়া শেষে আমার ব্যক্তিগত জীবনে এই রাখ-ঢাকের বালাই শেষ হয়ে গেলো। গবেষণা শেষে গবেষক আমি ‘চুদানো’, ‘চ্যাট মারা’ এসব প্রত্যয় সম্পর্কে একটা অবস্থানে চলে গেলাম। ‘বিষমযৌনতার’ যে যন্ত্রণার বোধ নারীর কথ্য ইতিহাসে শুনতে পাওয়া যায়, যেমন-‘পাচারের সময় নীচে ফেলে ৬ জন ইচ্ছেমতন কামড়, মারধোর ও গণধর্ষণ করে। নারী রক্তে ভাসে আর ধর্ষকরা হাসে, শেষে ছুরি দিয়ে যৌনাঙ্গ ফেঁড়ে দেয়া হয়’, ‘ধর্ষিতা নারীকে তার ‘হাজব্যান্ড’ সুন্দর ঘর দিয়েছে, স্বচ্ছলতা দিয়েছে। নারীকে তার স্বামী সব দেন কারণ রাতে নারীকে তার ইচ্ছাঅনিচ্ছার উর্ধ্বে বিবস্ত্র করা হয়। নারীর নিরাপত্তার বোধ আর রাতের সহবাসের যন্ত্রণার মাঝে হাজব্যান্ড নারীর সন্তুষ্টির মাত্রা জানতে চায়। নারীর মন চায় গলা চিপে ধরতে কিন্তু স্বামীই তার সতীত্ব প্রমানের রাস্তা’। ‘বিষমযৌনতা মানেই নারীর জন্য নিরানন্দের’- এই দাবি তোলা আমার মতলব নয়।
তারপরেও গবেষক আমার মনে হলো, মানুষ মানে স্বামী যা করে, স্বামী যা করে ধর্ষকও তা করে, বৈবাহিক সর্ম্পকের যৌনতাও ধর্ষণের সমান হতে পারে যখন স্বামী নারীর শরীরকে যন্ত্র ভাবে, আবার ধর্ষকও ‘স্বামীর’ মতো আচরণ করতে পারে যদি ধর্ষক নৃশংসতার চরমে না পৌঁছায়। নারীর কথনের বিষমযৌন অবদমনকে ‘সহবাস’, ‘মিলন’, ‘স্বামী-স্ত্রীর সর্ম্পক’, ‘যৌনসম্পর্ক’ এরকম প্রত্যয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না। এই শব্দগুলোর মধ্য দিয়ে যেমন যৌনমিলনকে স্বামী-স্ত্রীর সর্ম্পক বলে ‘সহজাত’ করা হয়, তেমনি ধর্ষকের যৌনমিলনকে অন্য কিছু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যাতে নারী কেবল স্বামীর সাথেই ‘আনন্দময়’ যৌনমিলনে যাবে। কেবল ধষর্কের সাথে অসম্মতি থাকবে, অঘটন ঘটবে। নারী অভিজ্ঞতায় আমি স্পষ্ট দেখতে পাই এই সীমা প্রায়ই অতিক্রমের। আবার ধর্ষক বাবা, ভাই, মামা, চাচা এরকম সর্ম্পকের কেউ নয়, বরং ধর্ষক অচেনা এই মতাদর্শও শব্দগুলোতে প্রতিষ্ঠা পায়। শিতি জনগোষ্ঠীর রাখ-ঢাকের ভাষায় যৌনতার অবদমন হয়ে উঠে অস্বস্তির। নিশ্চুপকরণের মখমলী শব্দগুলোর (ইজ্জতহানি, সম্ভ্রমহানি, সহবাস) বিপরীতে মধ্যবিত্ত মানসিকতার ‘অশ্লীল’ শব্দ ‘চুদানো’ শুনলে আমাদের অনেকেরই মুখ কুঁচকে যায়। এই কুঁচকে যাওয়াই যন্ত্রণাকে অস্বস্তির বোধ থেকে মুক্তি দেয়। এই বোঝাবুঝি থেকে আমি আমার প্রাত্যাহিক জীবনে ‘চুদানো’ শব্দ কোনরকম অস্বস্তি ছাড়া ব্যবহার করতে শুরু করি।আমার কথোপকথনে সাবলীল হয়ে উঠে ‘যৌনতা’, ‘চুদাইছে’, ‘নারী শরীর’, ‘পুরুষের মতা’, ধর্ষণ, ধর্ষক (প্রায়ই আমাকে বলা হয় একটু রেখে ঢেকে বলতে পারো না!)। পরিবারে আমি কখনও ‘তসলিমা নাসরিন’ হয়ে উঠি, প্রায়ই আমার বক্তব্য খারিজ করে দেওয়া হয়, আমি তর্ক করি। কখনও আমি বেয়াদপও হয়ে উঠি।
পরিবার আর আমার এই টানাপোড়নে আমি উপলব্ধি করি প্রথাগত অবমূল্যায়িত সহিংসতাই আমার জন্য ভীষণ যন্ত্রণার ঠেকে (সালামের উত্তরে খালুর বিশ্রী করে হাত বুলিয়ে দেয়া)। ‘চরম নৃশংস ধর্ষণের পর বেঁচে থাকা যায়!’ এই জিজ্ঞাসাই আমার নারী অভিজ্ঞতায় মূখ্য। এই সংযুক্তিতে আমার গবেষণা এলাকা আমার যাপিত জীবনের মতাদর্শে ‘জীবিত মৃত’ ধর্ষিতার বসবাস। তাদের বেঁচে থাকা আর আমার এতোদিনের তাদেরকে ‘জীবিত মৃত’ ভাববার শিক্ষা- এই দুয়ের মতাদর্শিক টানাপোড়ন এবং মতা সম্পর্কের দ্বন্দ্বে আমার নিজ অজান্তে আমি ‘নারীবাদী’ হয়ে উঠি।
শিক্ষা জীবনে ‘নারীবাদী’ আত্মপরিচিতি
আশ্রয়কেন্দ্রের নারীদের সাথে কথোপকথনের শেষ দিন আমি এসিডদগ্ধ ধর্ষিত এক নারীর সহিংস নিপীড়নের কথন শুনতে শুনতে অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি ভীষণ জ্বর গায়ে বাসায় ফিরে আসি। টানা ৮দিন আমি অচেতন ছিলাম। প্রথমবারের মতো আমার মাইগ্রেনের সমস্যা ধরা পড়ে। আমাকে আমার পিঠ সমান চুল ডাক্তারের নির্দেশে কেটে ফেলতে হয়। আমি নিজের ‘বয়কাট’ চুল [৬] নিয়ে সারাক্ষণ অস্বস্তিতে থাকতাম, লুকানোর চেষ্টা করতাম। এই সময় আমার বিভাগের শিক আমাকে ডেকে বললেন ‘তোমাকে নারীবাদী লাগছে, ইউ আর লুকিং ড্যাম গুড!’। মন্তব্য স্বস্তির ছিলো না। ‘নারীবাদী’ নিয়ে বিরাজমান ডিসকোর্স থেকে আমাকে চিহ্নিত করা হচ্ছিল, যেমন- নারীবাদী নারী ধর্ম মানে না, সংসার করে না, বাউন্ডুলে, বেয়াড়া, লিভিং টুগেদার করে, মেয়ে হয়েও সিগারেট খায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি ‘উন্নয়ন’ বিষয়ক এক কোর্সের শিক মন্তব্য করলো ‘আমার সকল বোঝাপড়া যৌনতায় reduced হয়’। আমি ভীষণ লজ্জিত হতে লাগলাম। কারণ আমি এমন নই, আমি লাজুক, বিনয়ী, আমি ‘মেয়েলী’, আমি পরিবারের বাধ্য ‘কন্যা সন্তান’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও বড় ঘোমটায় আমি নিজেকে ঢাকতে লাগলাম। আমার কাসে আসতে ভালো লাগতো না, আমি আবার অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। আমি এতোদিন ‘নারীসুলভ’ সাজে নিজেকে সাজিয়ে এসেছি (তারমানে এই নয় যে নারীসুলভ সাজই শ্রেষ্ঠ)। বড় চুল, বড় টিপ, বড় কানের দুল আমার সাজের এই দিকগুলো আমার শিক্ষা জীবনের সহযোগী বন্ধুরা ভুলে গেলো। ‘অসুস্থ বিধায় চুল কেটেছি, আমি নারীবাদী নই, আমি জানি না নারীবাদী কাকে বলে’ আমার এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য হলো না। একমাসের মাঝে আমি এই মন্তব্যকে মোকাবেলা করতে শিখলাম। মেঘনা গুহঠাকুরতার একটি উক্তিতে আমি উত্তর দিতে শুরু করলাম ‘কোন মানুষকে কি কেউ জিজ্ঞেস করে যে সে মানবতাবাদী কিনা?’ (গুহঠাকুরতা, ১৯৯৮)। আমি ‘নারীবাদী’ এটাই কি তাহলে যথার্থ নয়? আজও আমি আমার উপর আরোপিত এই নারীবাদী পরিচিতির বৈশিষ্ট্য আর শেকড় খুঁজে বেড়াই।
শেষ কথা
কথ্য ইতিহাসের ১৮ জন ধর্ষিত নারীর নৃশংস নিপীড়ন অভিজ্ঞতা উন্মোচন করতে করতে আমার ক্রোধ হতো, আমার যন্ত্রণা হতো। নারীর সাথে আমি তার নিপীড়নের বাস্তব অনুভূতি অনুভব করেছি, নারীর হাত ধরে তার অভিজ্ঞতার চড়াই পার হয়েছি। নারীর সহিংসতার বিদীর্ণ ছবি জোড়া লাগাতে লাগাতে আমি আমার জীবনের নিপীড়ন ও নিপীড়ককে চিনতে শিখেছি। গবেষক আমি আর আমার গবেষিতের প্রোপট ভিন্ন হলেও যন্ত্রণা বোধ আমাদের মাঝে একতা তৈরী করে, সহিংসতা বোঝার বোধে মিলের জায়গা তৈরী হয়। ভীতি, সংকট আর যন্ত্রণার বোধ আমি গবেষক ও আমার গবেষিতের মধ্যকার পেশাজীবি দূরত্ব কমিয়ে এনেছে। নারীর নিপীড়নের কথন যন্ত্রণায় আর্ত গবেষক আমার ব্যক্তিজীবনকে নারীর প্রতি সহিংসতার যন্ত্রণা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার কোন কৌশল আমার জানা ছিলো না।
এই প্রবন্ধে আমি আমার ‘অভিজ্ঞতায় ধর্ষণ’ এই বিশেষ গবেষণার তথ্যই কেবল হাজির করেছি। আমার জীবন বাস্তবতা অনুযায়ী গবেষণা আমার উপর প্রভাব ফেলেছে, আমার প্রেক্ষিতানুযায়ী গবেষণা অভিজ্ঞতা নানান প্রশ্ন তৈরী করেছে। সব গবেষকের জীবনে গবেষণার প্রভাব সমরূপী হবে, গবেষণার অভিজ্ঞতা সকলের জন্য সমমাত্রার হবে এই ভেবে নেয়ার কোন মানে নেই। আমি যেভাবে গবেষণা করতে গিয়ে নিপীড়ন অভিজ্ঞতাকে নিজের মাঝে ধারণ করেছি, নিজ জীবনের সাপেক্ষে নিজের মতো করে যেভাবে আমি নারীর নিপীড়ন অভিজ্ঞতাকে বুঝেছি গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ, রেপ্রিজেন্টেশনের সাথে সাথে আমার সেই বোঝাপড়া আমার জীবনবোধেও প্রভাব ফেলেছে, আমি নিজে গবেষণা প্রক্রিয়ায় কিছুমাত্রায় বদলেছি। আমার পরিবর্তনের দরুন আমার জীবনের কিছু ক্ষেত্রে বদলেছে, আমার দৃষ্টিভঙ্গিতেও রদবদল ঘটেছে। আজ আমার কাছে ধর্ষণ মানে মরে যাওয়া নয়, ধর্ষণ মানে ‘ইজ্জত চলে যাওয়া নয়’। গবেষণা প্রক্রিয়ায় আমার পরিবার, আমার নিরাপত্তা বোধ বদলেছে, ভীতি আর আশংকার ধরন বদলেছে। বিষমযৌনতা কেন্দ্রিক ‘সংসার পাতানোর’ মধ্যবিত্ত সুলভ স্বপ্ন তার রোমান্টিকতা হারিয়েছে। বদলে গেছে আমার কথা বলার ঢং। পূর্বের গালাগালি আমার মুখে সাবলীল ভাবে উচ্চারিত হয়। তাই আমি আমার নতুন আত্মপরিচিতি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার নতুন আশাবাদ এতোদূর পর্যন্ত ডালপালা ছড়িয়েছে যে আমি বিশ্বাস করতে চাই যদি সমাজ ধর্ষিত নারীকে অধস্তন না করে তাহলে ধর্ষণের কেবল শারীরিক ক্ষতি অতিক্রমণের দৈহিক ও মানসিক উভয় মতাই নারীর আছে। নারী কেবলই এজেন্সিহীন কোন শক্তি নয়।
টীকা
১.বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবি সমিতি উদ্ধারকৃত নারী কিংবা যে নারী মামলা করতে চায় বা মামলা করে অনিরাপত্তায় আছে তাদেরকে আসামী এবং নিপীড়ক এজেন্ট ও তার ক্ষমতা ক্ষেত্রে থেকে নিরাপদ রাখতে ১৯৯৩ সনে ‘আশ্রয়কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করে। সরকারের পুলিশ বিভাগের সাথে ইঘডখঅ অনেকসময় সম্মিলিতভাবে কাজ করে থাকে। নিপীড়িত নারীদের পুলিশ এই আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপত্তা হেফাজতে পাঠায়।
২. নারীর অভিজ্ঞতার সহিংসতাকে আইনীকাঠামোর নিপীড়নের ধরন কিংবা ধর্ষণের বোঝাপড়া দিয়ে কিছু ক্ষেত্রে বোঝা নাও যেতে পারে। নারী তার যন্ত্রণায় এমন কিছু বিষয়কে সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত করে যে সহিংসতা কথ্য ইতিহাসের নারীর ক্ষেত্রে প্রত্যভাবে ঘটে নাই। সহিংসতা পরতের পর পরতের মধ্য দিয়ে জড়িয়ে নারীকে বেষ্টন করে রাখে যেখানে নারী তার সত্তা এবং নিজস্বতাকে ঘিরে একাধিক সহিংসতাকে চিহ্নিত করে, যেমন- পাচার, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, বেশ্যা পরিচয়, জারজ সন্তান, ধর্ষণের শিকার হওয়ার অপরাধ ইত্যাদি ইত্যাদি।
৩. এই বোঝাপড়া আরও স্পষ্ট করতে দেখা যেতে পারে আমার অনপ্রকাশিত ৪র্থ বর্ষের একাডেমিক কাজ “অভিজ্ঞতায় ধর্ষণ, বহুমাত্রিক সহিংসতা, নারী জীবনের পুনর্গঠন”।
৪. আমাকে মেরে গুম করে ফেলা হবে, কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে যৌনমিলনের ছবি তুলে বা ভিডিও করে পর্ণোগ্রাফি বানিয়ে ফেলা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
৫. ধর্ষিত এখনও হইনি একারণে স্বাভাবিক। ধর্ষণের শিকার যাতে না হতে হয় তাই পরিবার ও সমাজের নিয়ম মেনে চলি...ঠিক করে বুক ঢেকে ওড়না পড়ি, একা কোথাও যাই না, সন্ধ্যার আগে শত কাজ থাকলেও বাসায় ফিরে আসি, ভাই-
আত্নীয়স্বজনকে বিশ্বাস করি, পুরুষ থেকে দূরে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
৬. ‘বয়কাট’ চুল মানে কানের শেষভাগ পর্যন্ত চুল কাটা। ঘাড় উদাম থাকবে।
*এই প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে “নারী ও প্রগতি” র বর্ষ: ৪, ষাণ্মাসিক সংখ্যা, জুলাই-ডিসেম্বর, ২০০৮ পত্রিকায় ।