বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব যে ‘হয় আওয়ামী নয় বিএনপি-জামাত’ এই দ্বি-মেরু চক্কর থেকে দেশকে বের করতে চাইছেন, তা পশ্চিম বাংলার অধিকাংশের কাছেই স্পষ্ট নয়
গত ৫-ই অগাস্ট বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মুর্তি ভাঙ্গার দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দা ও সামাজিক মাধ্যমে দেখার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের একাংশের মানুষের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছে।
মুজিব-কন্যা আবার দেশছাড়া, বঙ্গবন্ধুর মুর্তির ঘাড়ে উঠে মাথায় প্রস্রাব করছে কেউ, মারছে চটি দিয়ে, বুলডোজার গর্দান নামিয়ে দিচ্ছে কোনও মুর্তির, জ্বলছে ধানমন্ডির সেই বাড়ি যেখানে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে – প্রতিটা ছবি যেন বুকে শেল বেঁধায়। এ হামলা বঙ্গবন্ধুর ওপর হামলা, এ হামলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর হামলা, যে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে পশ্চিমবাংলার বাঙালির বুক গর্বে ভরে ওঠে। যে মুজিবের “আমরা যখন মরতে শিখেছি, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না” পশ্চিম বাংলার বাঙালি আজও ভোলেনি। যে মুজিব শুধু দেশনায়ক নন, শহীদও।
পশ্চিম পাড়ের বাঙালি কিন্তু এই কথা জানেননি যে ২০২৪-এর জুলাই-অগাস্ট ছাত্র আন্দোলনেও “আমরা যখন মরতে শিখেছি, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না” চেতনা নিয়েই বুলেটের মুখোমুখি হয়েছিল হাজার হাজার তরুণী-তরুণ। তাঁদের অনেকেই অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতার লাইন থেকেঃ “রক্ত দেখলে বাড়ছে সাহস।”
প্রশ্ন হল, কেন ৫-ই অগাস্টের আগে বাংলাদেশ নিয়ে এই উদ্বেগ জন্মায়নি, যখন মুজিব-তনয়ার নির্দেশে মাত্র তিন সপ্তাহে তিনশ’র ওপর মানুষের মৃত্যু হয়, যার অধিকাংশই ছাত্র ও তরুণ? কেন কেউ জানলনা যে গণহত্যায় মেতে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা?
কেন পশ্চিমবঙ্গে ভাইরাল হয়নি আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে গুলি খাওয়ার ছবি? প্যাকেট ভর্তি জলের বোতল হাতে ঘুরতে থাকা মীর মুগ্ধ, ‘কারো পানি লাগবে, পানি?’ জিজ্ঞেস করতে করতে যে পুলিশের গুলিতে মরে গেল, তাকে কেন চিনলনা পশ্চিম বাংলা? কেন জানলনা সেই রিকশাওয়ালার কথা যে গুলিতে মৃতপ্রায় কোনও যুবককে রিকশায় তুলতে গিয়ে দেখেন এ তাঁরই ছেলে? কেন জানলনা যে মারা গেছে শুধু তরুণ-তরুণী নয়, কিশোর কিশোরীও? কেন জানলনা যে দলে দলে অভিভাবকরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন পুলিশের মুখোমুখি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য?
এর একাধীক উত্তর আছে, আমি আপাতত শুধু প্রধান দুটি কারনই উল্লেখ করছিঃ
প্রথম কারণ, ভারত ও পশ্চিম বাংলার মূল ধারার গণমাধ্যম মানুষকে হাসিনার অত্যাচারের কথা জানায়নি। দ্বিতীয়, হাসিনার পদত্যাগের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের চিত্র ও সংবাদে পশ্চিম বাংলায় সামাজিক মাধ্যম ভরিয়ে দেওয়ার মত কোনও সংগঠিত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা হাসিনা-পতনের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক শক্তি করছে।
এই পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় সাম্প্রদায়িক শক্তি ব্যাপক ভুয়ো সংবাদও প্রচার করে, যথা ব্যাপক হিন্দু নির্যাতনের খবর। ঘটনা তো ঘটেছেই, তার ওপর রং চড়ছে। ক্রিকেটার মাশরাফি মোর্তাজার বাড়িতে হামলার খবর লিটন দাসের বাড়ি হামলার ঘটনা বলে প্রচার করা হয়। পুরনো ছবি ভিডিও ভুল প্রেক্ষিতে ছড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের মুর্তি ভাঙ্গা হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। আওয়ামী লীগের অনেকেই আক্রান্ত হন কিন্তু বেছে বেছে হিন্দু পরিবারগুলির খবরই ভেসে ওঠে।
এর ফলে, মানুষ হঠাৎ জানতে পারেন যে বাংলাদেশ আবার মুসলিম মৌলবাদীরা দখল করে নিয়েছে, যারা হাসিনাকে তাড়িয়েছে, মুজিবের মুর্তি ভেঙ্গে বাড়ি পুড়িয়েছে, আর এবার হিন্দুদের তাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।
এই প্রেক্ষিতে তাই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর উল্লেখযোগ্য দিকগুলি উল্লেখ করছি।
১) ১৪-ই জুলাই থেকে ৫-ই অগাস্ট এর মধ্যে ছাত্র বিক্ষোভ যে গণবিক্ষোভে পরিণত হল, তা শুধু ওই কয়দিনের ঘটনা প্রবাহের ফল নয়। ২০০৮-এ জনপ্রিয় ভোটে ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা দেশে আর কখনও বিশ্বাসযোগ্য কোন নির্বাচন হতে দেননি। ২০১৩-র নির্বাচন বিরোধীরা বয়কট করে। এরপর ২০১৮-র নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ফলে বিরোধীরা আবার ২০২৪-এর নির্বাচনও বয়কট করে। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে হাসিনা বিরোধীদের ছাড়াই নির্বাচন করিয়ে নেন। সেই তখন থেকেই বাংলাদেশের একাংশের মানুষ মনে করতেন, হাসিনার পতন একমাত্র গণঅভ্যুত্থানেই সম্ভব, কারণ শান্তিপুর্ণ পথে পরিবর্তনের কোনও সুযোগ তিনি রাখেননি।
২) পূর্ব বাংলায় সেকুলার-লিবারাল ও সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তি ও মতাদর্শের সংঘাতের ইন্তিহাস ১০০ বছরেরও বেশী পুরনো। যদিও কোনও কিছুই পুরিপুরি সাদাকালো নয়, তবু মোটের ওপর ১৯৪৭-এ জিতেছিল তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়, ১৯৭১-এ জিতেছিল তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচয়। এরপর নানান ওলট-পালট হলেও বাংলাদেশ মূলত মুক্তিযুদ্ধ-চেতনা ও ধর্মীয় পরিচয়ের সংঘাতের আবর্তে ঘুরেছে।
৩) ১৯৭৫-এর অগাস্টে সামরিক অভ্যুত্থানে দেশের বাইরে থাকা হাসিনা ও তাঁর বোন রেহানা ছাড়া সপরিবারে মুজিব হত্যার পর মোটামুটি ১৫ বছর কেটেছে একের পর এক সেনা অভ্যুত্থান আর সামরিক শাসনে। এর মধ্যে দুই সেনা শাসক, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নিজেদের রাজনৈতিক দল গড়েন। জিয়া, যিনি নিজেও সেনা অভ্যুত্থানেই নিহত হন, বাংলাদেশ ন্যাশানালিস্ট পার্টি (বিএনপি) গঠন করেছিলেন। এরশাদের প্রতিষ্ঠিত পার্টি হল জাতীয় পার্টি। গত সাড়ে তিন দশকে বাংলাদেশ মূলত আওয়ামী লিগ ও বিএনপি এই দুই মেরুর রাজনীতিই দেখেছে। জাতীয় পার্টি ও নানান বাম দল গুলির উপস্থিতি মূলত পরিপার্শিক।
৪) বিএনপি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী নয়। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং রেডিও-তে জয়ের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শাসন কালেই মুজিব ঘাতকদের কেউ কেউ উঁচু পদ পায় ও কাউকে কাউকে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় এই অভিযোগ আছে। জিয়ার স্ত্রী, খালেদা জিয়া বিএনপির নেত্রী হিসাবে ১৯৯১-’৯৬ ও ২০০১-’০৬ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শাসন করেন।
৫) বিএনপির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতার অভিযোগ আসে মূলত জামায়াতে ইসলামীর সাথে তাঁদের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক জোটের কারণে। জামায়াত নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। রাজাকার ও আল বদরের মত কুখ্যাত ঘাতক বাহিনীর নাম জামায়াতের সাথেই সংশ্লিষ্ট।
৬) হাসিনা ১৯৮১-তে দেশে ফিরে আওয়ামী লিগের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পর আবার ২০০৮-এ জনপ্রিয় ভোটে ক্ষমতায় ফেরেন। এর পর থেকে বাংলাদেশে আর কোনও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়নি।
৭) ১৯৭০ ও ‘৮০র দশকেই আরেকটি বড় পরিবর্তন হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের চারটি মূল ভিত্তির একটি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা, যেটি ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান মুছে ফেলেন। এর পর ১৯৮৮ সালে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন।
৮) হাসিনার লড়াই সহজ ছিল না। তাঁকে শুধুই জামাতের মত মৌলবাদী সংগঠন নয়, ২০১৩-১৬ নাগাদ আল কায়দা ও আইসিস-অনুপ্রাণিত একাধীক জঙ্গি গোষ্ঠীর মোকাবিলা করতে হয়েছে। একসময় জামায়াতকে জব্দ করতে তিনি আরেক ধর্মীয় সংগঠন, হেফাজতে ইসলামের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন।
৯) কিন্তু সন্ত্রাস ও মৌলবাদ মোকাবিলার নামে তিনি ক্রমশ সমস্ত রকম রাজনৈতিক বিরোধিতার নাম ও নিশান মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। শুরু হয় গুম করে দেওয়া, ‘ক্রস ফায়ার’-এ বা ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা; নানান অভিযোগে জেলে ঢোকানো। ২০১৭-সালে একটি রায়ে সরকারের সমালোচনা করার পর প্রধান বিচারপতি বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে কার্যত দেশ ছাড়া হতে বাধ্য করা হয়। এর পর থেকেই বিচার বিভাগের ওপর ক্রমশ গভীর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে আওয়ামী লিগ। পরে দুর্নীতির দায়ে তাঁর জেলের ব্যবস্থাও করে রাখা হয়।
১০) একের পর এক জেলে ঢোকানো হয়েছে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী থেকে রাজনৈতিক বিরোধী — সব ধরণের সমালোচককে। বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করা আইনকরে নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যদের “মানহানীর” অভিযোগে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা করা বহু ব্যাক্তিকে কুখ্যাত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে জেলে ঢোকানো হয়।
১১) হাসিনা শুধু সব বিরোধীদেরই সন্ত্রাসী বা দুর্নীতিবাজ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি, তাঁর আমলেই সৃষ্ট গুমঘর ‘আয়না ঘর’-এ গোপনে স্থান হয়েছে পুলিশ বা সেনা বাহিনীর হাতে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়া বিরোধী/সমালোচকদের। তাঁর আমলে পুলিশ, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন – সবই দলদাসে পরিণত হয়। হাসিনার বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা বারংবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে; আন্তর্জাতিক মানবাধীকার সংগঠনগুলি বারবার গলা তুলেছে। কিন্তু হাসিনা চলেছেন নিজের মত।
১২) এই পরিস্থিতিতে গত দুই-তিন বছর ধরেই হাসিনার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের পারদ ক্রমেই চড়ছিল। কিন্তু বিরোধীদলগুলিকে তিনি নেতৃত্বশূন্য করে ফেলেছিলেন। হাসিনার বজ্রকঠিন শাসন এড়িয়ে প্রভাবশালী কোনও গণআন্দোলন তাঁরা গড়ে তুলতে পারেননি।
১৩) ২০২৪-এর জুলাইতে চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের বিরোধিতা করে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন হঠাৎ-ই তীব্র গতি পেয়ে যায় ১৪ তারিখ হাসিনার একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অসম্মানসূচক মন্তব্যে। কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারীদের তিনি কার্যত “রাজাকারের বাচ্চা” বলেন। এতেই আগুন জ্বলে। ছাত্র আন্দোলনের মূল কেন্দ্রে যারা ছিলেন, তাঁরা মূলত বাম-ঘেঁষা বা সেকুলার-লিবারাল। নিশ্চয়ই বিএনপির ছাত্র দল বা জামাতের ছাত্র শিবিরের সদস্য-সমর্থকরাও ছিলেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে ছিলনা।
১৪) গোটা আন্দোলনপর্ব জুড়ে, রাষ্ট্রশক্তির প্রবল নিপীড়নের মুখেও, একদিকে ছাত্ররা যেমন পিছু হঠেনি, তেমনি তারা বিএনপি বা জামাতের হাতেও আন্দোলনের রাশ যেতে দেননি। এই পরিস্থিতে বিরোধী দল গুলি ঠিক করে চুপচাপ ছাত্র আন্দোলনে কিছু লোক পাঠাতে, যাতে ভিড় বাড়ে। ছাত্ররা হাসিনাকে সরাতে সফল হলে তাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, এরকমটাই তাঁরা আশা করেন।
১৫) পুলিশকে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে দেওয়া যদি হাসিনার বেপরোয়াপনার এক অন্তিম বহিঃপ্রকাশ হয়, তবে কফিনে শেষ পেরেক হল ৪ অগাস্ট সশস্ত্র আওয়ামী লীগ বাহিনীকে পুলিশের সাথে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া। ওই একদিনে একশ’র ওপর মৃত্যু হয়, যার তিন-চতুর্থাংশেরও বেশী হল লীগ কর্মী ও পুলিশের গুলিতে মৃত আন্দোলনকারী; বাকিরা গণপিটুনিতে নিহত পুলিশ ও লীগ কর্মী। ওই দিনের ঘটনাবলী মানুষের সহ্যের সব সীমা ভেঙ্গে দেয়। ৫ তারিখ ছাত্রদের ডাকে জমায়েতের ভিড়ের বহর দেখে সেনা-পুলিশ আর গুলি চালাতে অস্বীকার করায় হাসিনার খেলা সমাপ্ত হয়।
১৬) হাসিনা পদত্যাগ করে সটান দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় ছাত্রদের কাছে দুই নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। এক দিকে ফের সেনা শাসনের সম্ভাবনা। আরেকদিকে বিএনপি-জামাত কর্তৃক ক্ষমতা দখল। সেনা-সমর্থনে বিএনপি-জামাত-জাতীয় দলের মিলিজুলি সরকারের সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু ছাত্ররা দৃঢ়তার সাথে এই সব সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করে বলে তারা যেহেতু রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে মাঠে নেমেছে, তারা সেনা শাসন বা অন্য আরেক ধরণের স্বৈরাচারী শাসন মানবে না। তারাই ঠিক করে দেবে অন্তরবর্তীকালীন সরকারের স্বরূপ কি হবে।
১৭) সোজা কথায়, যা কেউ ভাবেনি, ছাত্ররা এমন একটা সম্ভাবনা উপস্থিত করল – আওয়ামী লীগ আর বিএনপি-জামাত এই দ্বিমুখীনতার বিরুদ্ধে এক তৃতীয় সম্ভাবনা। তারা ঘোষণা করল, দ্যর্থহীন ভাবে, এক স্বৈরাচারের বিকল্প আরেক স্বৈরাচার নয়। তারা শুধু সরকার বদল নয়, গোটা কাঠামো ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘমেয়াদী বদল চান। মুজিব পরিবার, জিয়া পরিবার, এরশাদ পরিবার – এর বাইরে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলতে চান।
১৮) অন্তত ৮ই অগাস্ট পর্যন্ত, যেদিন ছাত্রদের মনোনীত তদারকি সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস, নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ যিনি নিজেও হাসিনার রোষের শিকার হয়েছিলেন, নতুন সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেন, ছাত্ররা সেনা-নিয়ন্ত্রিত সরকার ও বিএনপি-জামাত প্রভাবিত সরকার – দুই সম্ভাবনাকেই আটকে রাখতে পেরেছেন।
১৯) এর মধ্যে, ৫ তারিখ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে, বাংলাদেশের সব থানা ও রাস্তা কার্যত পুলিশ শূন্য হয়ে যায়। গণপিটুনির শিকার হওয়ার ভয়ে পুলিশকর্মীরা আর থানা বা রাস্তায় থাকতে চান নি। এই সুযোগে কিছু দুষ্কৃতি ও মৌলবাদীরা হামলা চালায় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যে, সংখ্যালঘুদের বাড়িতে, উপাসনালয়ে, সুফি মাজারে। টার্গেটের ধরণ দেখে মুসলিম মৌলবাদীদের ছাপই পাওয়া যায়। কিন্তু ছাত্র নেতৃত্ব প্রাথমিক ভাবে ঘোষণা করেছেন যারা যারা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করছে/করবে, তারা সবাই আওয়ামী লীগ, তারা আন্দোলনকে কলঙ্কিত করতে চায়। আজ তারা সরাসরি মুসলিম মৌলবাদীদের নাম নিলেন না। কিন্তু লড়াই জারি রাখতে হলে তাঁদের জামাতের নাম এক দিন না একদিন নিতেই হবে।
২০) পুলিশশূন্য দেশে এই ছাত্র নেতৃত্ব বারবার ডাক দিয়েছেন পাড়ায় পাড়ায় কমিটি গড়ে মন্দির, গির্জা পাহারা দেওয়ার জন্য; রাত জেগে পাহারা দেওয়াও হয়েছে বহু জায়গায়। তারপরও, কোনও সামাজিক উদ্যোগের পক্ষেই পুলিশের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। নৈরাজ্যে যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের পাঁচ তারকা হোটেলে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে এক জন বাদে সবাই স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী-আন্দোলনকারী। হোটেল এক দফা ভাংচুর হওয়ার পর এক দল আন্দোলনকারী উৎসাহ বশে হোটেলটি দেখতে বা জিনিসপত্র হাতিয়ে নিতে উপরের তলাগুলিতে যখন উঠেছে, তখন আরেকদল বিক্ষোভকারী নিচ তলায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পুড়ে খাক হয়ে গেছে আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক, ‘জলের গান’ গানের দলের রাহুল আনন্দের বাড়ি ও অগণন অমুল্য বাদ্যযন্ত্র।
২১) হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ও তাঁদের একাংশের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসার প্রচেষ্টা সংবাদ, ছবি ও ভিডিও পশ্চিমবঙ্গে ভাইরাল হতে থাকে। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। ২০১৪-১৫ থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মুসলিম মৌলবাদ, জঙ্গি কার্যকলাপের বাড়বাড়ন্তকে হাইলাইট করে পশ্চিম বাংলায় মুসলিম-বিদ্বেষ খুঁচিয়ে তোলার কাজ শুরু করে হিন্দু মৌলবাদী শক্তিগুলি। এরপর ২০১৮-১৯ থেকে মূলত বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক নাগরিকতা আইন (সিএএ) ও প্রস্তাবিত পঞ্জিকরণ কর্মসুচী (এনআরসি)কে সামনে রেখে ধর্মীয় মেরুকরণের কাজ শুরু হয়।
২২) ২০২৪-এর অগাস্টে কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, নদীয়া সীমানা পার হয়ে ভারতে ঢোকার লাইনের ছবি ও ভিডিও আবার পশ্চিম বাংলার হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। এই জন্যই ছাত্ররা যে স্বৈরাচার-বিরোধী ও মৌলবাদ-বিরোধী এক নতুন সরকার গড়ে তোলার কথা বলেছে, তার দ্রুত বাস্তবায়ন দুই পার বাংলার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। হাসিনা এখন অতীত। ছাত্রদের লড়তে হবে সেনার ক্ষমতা-প্রবণতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে। এটা ভুললে চলবে না, ওখানকার হিন্দু নির্যাতন দেখিয়ে এখানকার হিন্দু মৌলবাদীরা হাওয়া গরম করবে, আর সেটাকে দেখিয়ে আবার ওখানকার হুজুররা হাওয়া গরম করবে।
২৩) জামাতের বিপদ নিয়ে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব ওয়াকিবহাল বলেই মনে হল। তাদের পছন্দের ইউনূস ঘোর হাসিনা বিরোধী হলেও বিএনপি-জামাতেরও পছন্দের ব্যক্তি নন, যদিও অনেকেই বলছেন, তিনি আমেরিকার বিশ্বস্ত। বাংলাদেশ নিয়ে গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অতিতৎপরতা অনেক কন্সপিরেসি থিওরির জন্ম দিচ্ছে। ‘ভারতের কলোনি’ হয়ে ওঠার যে ক্ষোভ অনেক বাংলাদেশীর মনে আছে, তেমনি আগামীতে মার্কিন কলোনি হয়ে ওঠার বিপদের সম্ভাবনাও তাঁরা কেউ কেউ ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছেন।
২৪) ছাত্ররা আশাতীত সাফল্য দেখিয়েছে। তার পরেও দৃঢ়তা দেখিয়েছে। স্বৈরাচার না মৌলবাদ, এই প্রশ্নের বাইরে স্বৈরাচার ও মৌলবাদ উভয়কেই দূরে রাখার যে প্রকল্প তারা ঘোষণা করেছে, তার সাফল্যের ওপর শুধু বাংলাদেশ নয়, দুই বাংলার পারষ্পরিক সম্পর্কও নির্ভর করছে। এসবের সাথে তাঁরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরও বিরোধিতা করতে পারবেন কিনা সেটা অনেক বড় প্রশ্ন হয়ে যায়। কিন্তু তাঁরা যদি ‘৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা আবার ফিরিয়ে আনতে পারেন, সেটাই হবে, আমার মতে, তাঁদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এরকম কোনও উদ্দেশ্যের কথা অবশ্য তাঁরা এখনও ঘোষণা করেননি।
২৫) এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর রাখার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আরেকটা কাজ করতে পারেন। যখনই কেউ মুজিব মুর্তি ভাংচুরের প্রসঙ্গ তুলে বলতে আসবে মুসলমানদের দেশ বাংলাদেশ এত খারাপ যে জাতির জনককেও ছাড়ে না, তাঁকে আগে একবার জিজ্ঞেস করে নেবেনঃ “আর ভারতের জাতির জনকের হত্যা বিষয়ে তোমার/আপনার কি মত?” তাঁরা যদি গান্ধী হত্যার তীব্র নিন্দা না করেন, বুঝে যাবেন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যাথা নেই; না তাঁরা স্রেফ বাংলাদেশকে ব্যবহার করে এদেশের মাটিতে নিজেদের বিষবৃক্ষের ফসল তুলতে চাইছেন।
পাঁচ তারিখ হঠাৎ হাসিনা-পতনের পরের প্রশাসনিক শূন্যতার সুযোগে তিন-চার দিন দেশ জুড়ে ব্যাপক নৈরাজ্য চললেও নয় তারিখ থেকে পরিস্থিতি খানিক স্বাভাবিক হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন ব্যাপার হল, সব পক্ষ মাঠে নেমেছে। সংখ্যালঘুরা মাঠে নেমে প্রতিবাদ করছেন, “আমার মাটি ছাড়বো না, দেশটা কারোর বাপের না।” আওয়ামী লীগ রাস্তায় নেমে মিছিল করছে। বিএনপি মিছিল করছে। জামাতের ছাত্র শিবির মাঠে নেমেছে। শিবিরের মোকাবিলায় ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা মাঠে নেমেছেন। এই সবাই মাঠে থাকাটা গণতান্ত্রিক পরিবেশের আভাস দেয়, যা হাসিনা থাকাকালীন ছিল না।
বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার এখন উচিৎ, নতুন সরকারকে, নতুন নেতৃত্বকে প্রথম থেকে প্রশ্ন করা, প্রতিটি বিচ্যুতিকে প্রশ্ন করা, প্রথম থেকে চাপে রাখা, যাতে প্রশ্ন করা ও মাঠে নামার অধিকার আর হারাতে না হয়। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সব ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ – যারা পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের গুলি বা হামলার শিকার ও যারা ৫ তারিখের পর থেকে মৌলবাদী ও দুষ্কৃতি হানার শিকার। দলমত নির্বিশেষে সব পরিবারের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার মধ্যে দিয়েই এক প্রকৃত গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হতে পারে।