ভদ্রলোকের নাম সৈয়দ আমীর মির্জা,বয়স ৮৬ বছর। থাকেন কেল্লা নিজামতের ভেতরে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সন্নিকটে একটি বাড়িতে। ভদ্রলোকের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ২০১৯ সালে, পরে আরও বহুবার দেখা হয়েছে। বর্তমানে অধিক বয়সের ভারে ও নানান শারীরিক সমস্যা জনিত কারণে ভদ্রলোক এখন ঠিক মতো হাঁটাচলাও করতে পারেন না, তবুও তাঁর সাথে কথা বললে ভদ্রলোকের আচার-আচরণ ও মার্জিত ব্যবহারই বুঝিয়ে দেয় তাঁর শরীরে আজও নীল রক্ত বইছে।
আমীর মির্জা সাহেবের বাবার নাম ছিল সৈয়দ রইস মির্জা, তিনি মুর্শিদাবাদের তোপখানা এলাকায় রইসবাগ নামে একটি বিরাট আমের বাগান তৈরি করেছিলেন। সেই বাগানে প্রায় ১২৬ রকমের আম গাছ ছিল। এই বাগান করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নবাবী আমলের বিভিন্ন স্বাদের আমগুলিকে সংরক্ষণ করা। যাইহোক, আমীর মির্জা সাহেব দীর্ঘদিন তাঁদের সেই বিরাট বাগানের দেখা শোনার দায়িত্বে ছিলেন।ফলে আম নিয়ে তাঁর প্রচুর জ্ঞান। একবার মুর্শিদাবাদের আম নিয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করেছিলাম ' আম এ মুর্শিদাবাদ ' শিরোনামে, সেই সেমিনারে আমীর সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম প্রধান অতিথি হিসেবে।সেমিনারের দিন সকালে আমি আমীর সাহেব কে তাঁর বাড়িতে নিতে গিয়েছিলাম, উনি যখন গাড়িতে উঠলেন তখন সমগ্র গাড়ি সুগন্ধে ভরে উঠেছিলো। কিন্তু এ সুগন্ধ যেন একেবারেই অচেনা অথচ রাজকীয়, অবশেষে কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে ভদ্রলোককে তাঁর মেখে আসা সুগন্ধির নাম জিজ্ঞাসা করে বসেছিলাম,আমার প্রশ্ন শুনে উনি বেশ হাসি মুখে জবাব দিয়েছিলেন ' মজমুয়া '। তিনি আরও জানিয়েছিলেন নবাবরাও এই আতরটি খুব পছন্দ করতেন।
এই ঘটনার বছর দু’য়েক পরের কথা,সেবার নবাবী আমল সংক্রান্ত কোনো একটি তথ্যর জন্য ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেখানে ভদ্রলোকের সাথে নানান আলাপ আলোচনার পর যখন তাঁকে বিদায় জানিয়ে উঠতে যাবো ঠিক সেই সময় উনি আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির ভেতরে গেলেন এবং একটি ছোট্ট বক্স নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়ে বললেন "এটা আপনার জন্য একটি সামান্য উপহার আমার পক্ষ থেকে"। আমি সেই বক্স খুলে দেখি সেখানে রাখা আছে মাজমুয়া আতরের শিশি। আমাকে অবাক হতে দেখে তিনি বললেন "সেবার যখন দেখা হয়েছিল আপনি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এই আতর নিয়ে, তাই এই আতরটি আপনার জন্য রেখেছিলাম"। আমীর সাহেবের এমন সূক্ষ্ম নবাবী মেজাজ সেদিন আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
পরে আরও অনেক বার গিয়েছি ভদ্রলোকের বাড়ি। মনে আছে একবার নানান কথা প্রসঙ্গে আমীর সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম মুর্শিদাবাদের তৃতীয় নবাব বাহাদুর ওয়ারিশ আলি মির্জার সাথে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিল সেই সম্পর্কে, তিনি জানিয়েছিলেন নবাব ওয়ারিশ আলি মির্জার সাথে তাঁর অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল, হাজারদুয়ারি প্রাসাদে নবাবের অভিষেক অনুষ্ঠানের দিনও আমীর সাহেব নবাবের আমন্ত্রণে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি আরও জানান শুধু মুর্শিদাবাদেই নয়, নবাবের কলকাতার ৮৫নং পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতেও তিনি বহু বার গিয়েছেন। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন নবাব সাহেবের মাতৃভাষা উর্দু হলেও তিনি তাঁর বেগম ও ছেলে-মেয়েদের সাথে বাড়িতে অধিকাংশ সময় ইংরেজিতেই কথা বলতেন।
লকডাউনের মধ্যেই একদিন আমীর সাহেবের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেদিন তিনি একটি কারুকার্য খচিত টুপি দেখিয়ে জানিয়েছিলেন এই টুপিটি নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জা পরতেন, তাঁর মৃত্যুর পর নবাব সাহেবের পুত্র নবাব ওয়ারিশ আলি মির্জা টুপিটি উপহার হিসেবে আমীর সাহেবকে দিয়ে বলেছিলেন, "বাবার টুপি তোমাকে উপহার দিলাম, তুমি এই টুপি পরে নামাজ পড়বে তাহলে বাবাও নেকি (পুণ্য) লাভ করবে"।
বর্তমানে আমীর সাহেবের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ভদ্রলোকের বেগম সাহেবার কাছ থেকে জানতে পারি স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে আমীর সাহেব কিছুই আর মনে রাখতে পারেন না,তাঁর জীবনের বহু স্মৃতিও মুছে গেছে মাথা থেকে,আজকাল তাঁর কথা বলতেও সমস্যা হয়,কথা বলতে গিয়ে কথা জড়িয়ে যায়। এসব শুনে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আর যেতে পারিনি আমীর সাহেবের কাছে। তবে মাঝে একবার কেল্লায় গিয়ে আমীর সাহেবকে তাঁর বাড়ির সামনে একটি চেয়ারে একা চুপ চাপ বসে থাকতে দেখেছিলাম। এখন পর্যন্ত সেটিই শেষ দেখা।