দিল্লির বাদশাহদের যেমন লালকেল্লা, ঠিক তেমনি বাংলার নবাবদেরও কেল্লা নিজামত। নামে কেল্লা হলেও দিল্লির বাদশাহদের কেল্লার সাথে বাংলার নবাবদের কেল্লার কোন তুলনাই চলে না। আসলে কেল্লা বলতে আমরা ঠিক যেমনটি বুঝে থাকি, মুর্শিদাবাদ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাগীরথী নদীর পূর্ব পাড়ের প্রায় এক কি.মি. বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত কেল্লা নিজামত ঠিক তেমনটা ছিল না। এই কেল্লা নিজামত যেন একটি প্রতীকী কেল্লা, যার ভেতরে আস্তাবল, পিলখানা বা হাতিশালা, অস্ত্রাগার – কেল্লার প্রায় কোনও বৈশিষ্ট্যই দেখা যায়না। তবুও এটি কেল্লা, যেখানে নবাব তার পরিবার পরিজনদের নিয়ে বসবাস করতেন এবং সমগ্র রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
কেল্লার কথা জানতে গেলে, আমাদের যেতে হবে দেওয়ান করতলব খান (মুর্শিদকুলি খান)-এর আমলে। দেওয়ান করতলব খানের সাথে বাংলা সুবেদার শাহজাদা আজিম-উস-শানের বিরোধ যদি চরম পর্যায়ে না পৌঁছত, তবে মুর্শিদাবাদ বাংলা সুবার রাজধানী হ’ত কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। বলতে গেলে দেওয়ান করতলব খান, একপ্রকার বাধ্য হয়েই, তাঁর দেওয়ানির প্রধান দপ্তর তৎকালীন বাংলা সুবার রাজধানী জাহাঙ্গিরনগর (ঢাকা) থেকে মুকসুদাবাদে নিয়ে এসেছিলেন আনুমানিক ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। তারপর বর্তমান কেল্লা চত্বরেই (বর্তমান চক মসজিদের স্থানে) তিনি ইরানের ইস্পাহান শহরে সাফাভিদ বংশীয় সুলতানদের অতিথি ভবন চেহেল সুতুনের অনুকরণে নির্মাণ করেন তার দেওয়ানখানা, যা ‘চেহেল সুতুন’ প্রাসাদ নামেই পরিচিতি পায়। এ তো ছিল দেওয়ানের প্রশাসনিক ভবন। বাসভবন ছিল কিছুটা উত্তরে, কুলহেরিয়া নামক স্থানে, সেখানে আরও কিছু প্রাসাদ, মসজিদ ও ইমামবড়াও ছিল। পরবর্তী সময়ে, ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান বাংলা সুবার সর্বময় কর্তা বা নবাব হলে, নবাবের বসবাস ও প্রশাসনিক কর্যকলাপ পরিচালনার জন্য একটি নিরাপদ স্থান বা কেল্লার প্রয়োজন ছিল, যেখানে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা-বেষ্টনীর মধ্যে নবাব তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতে পারবেন। তখনকার কেল্লার অবস্থান ঠিক কোথায় ছিল, সে বিষয়ে কোন প্রামাণ্য তথ্য না পাওয়া গেলেও, নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের মুখে শোনা কিছু কথা ও তৎকালীন সময়ের কিছু ধ্বংসাবশেষ, কিছু অক্ষত স্থাপত্য, সেই সময়ের নদীর গতিপথ ও কিছু পুরনো মানচিত্রের উপর ভিত্তি করে অনুমান করা যায় – মুর্শিদকুলি খানের সময়ের কেল্লা, বর্তমান কেল্লার কিছুটা পূর্বদিকে অবস্থিত কুলহেরিয়া অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
যাই হোক, বর্তমান কেল্লার সামান্য কিছু অংশ নবাব মুর্শিদকুলি খানের আমলে শুরু হলেও, এই কেল্লার সিংহভাগই নবাব সুজাউদ্দিনের আমলে নির্মিত হয়েছিল। রিয়াজ-উস-সালাতিনে বলা আছে, মুর্শিদকুলি খানের পর বাংলার মসনদে বসে সুজাউদ্দিন খান নাকি মুর্শিদকুলি খানের নির্মিত অধিকাংশ স্থাপত্য ভেঙ্গে আবার নতুনভাবে নির্মাণ করেন। নবাব সুজাউদ্দিনকে বলা হত বাংলার শাহজাহান। তিনিই বর্তমান কেল্লাকে সাজিয়েছিলেন বলে কথিত রয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে কেল্লার ভেতরের বহু স্থাপত্যের অদল বদল ঘটেছিল, এবং পরবর্তী সময় কেল্লা আয়তনেও কিছুটা ছোট হয়ে গিয়েছিল।
অবশ্য নবাবি আমলের প্রথম দিকের সেই কেল্লার অধিকাংশ স্থাপত্যই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। আজ তো আলাদা করে কেল্লার অস্তিত্ব বোঝাই দায়। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন সমগ্র রাজধানীর মধ্যে কেল্লা নিজামতের গুরুত্বই ছিল আলাদা। সমগ্র অঞ্চলটি ছিল উচ্চ নিরাপত্তায় আবৃত। কেল্লার ভিতরে প্রবেশের জন্য একটি প্রধান প্রবেশ পথ (দক্ষিণ দরজা)-সহ আরও বেশ কিছু প্রবেশ পথ (চক দরজা বা ইমামবড়া দরজা) ছিল। কেল্লার ভিতরে ছিল নবাব ও তার আত্মীয়-স্বজনদের বসবাস এবং প্রশাসনিক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য বেশ কিছু প্রাসাদ। এছাড়াও ছিল বহু মসজিদ, ইমামবড়া, চিকিৎসালয়-সহ আরও নানান প্রয়োজনীয় ছোট, বড় ভবন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন কেল্লার বহু পুরনো প্রাসাদ ভেঙে পড়েছে, তেমনই আবার সেই স্থানে নতুন প্রাসাদও গড়ে তোলা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কেল্লার ভেতরে শেষ প্রাসাদ হিসেবে বেগম মহল নির্মিত হয়েছিল। তারপর আজ পর্যন্ত আর নতুন কোনও প্রাসাদ নির্মিত হয়নি। কারণ ততদিনে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব-নাজিমরা তাদের পদমর্যাদা হারিয়ে পরিণত হয়েছিলেন শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরে। ফলে নতুন করে কোনও প্রাসাদ নির্মাণের আর্থিক সামর্থ্য তাদের ছিল না। এদিকে কেল্লার পুরনো প্রাসাদগুলিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে শুরু করেছিল। ১৮৯৭ সালের অসম ভূমিকম্প সেগুলিকে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। অন্যদিকে ১৯৬৯ সালে মুর্শিদাবাদের তৃতীয় নবাব বাহাদুর সৈয়দ ওয়ারিস আলি মির্জার মৃত্যুর পর যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে মুর্শিদাবাদের মসনদ শূন্য রয়ে যায় দীর্ঘ দিন। কেল্লার যেটুকু জৌলুশ অক্ষুণ্ণ ছিল, এই দীর্ঘ সময়ে তা-ও একেবারে শেষ হয়ে যায়।
কেল্লার ভেতরের এক সময়ের রাজকীয় প্রাসাদ আয়না মহল, আগনা মহল, সোনা মহল, চাঁদি মহলের আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে কেল্লায় শুধুমাত্র কয়েকটি প্রাসাদই অবশিষ্ট রয়ে গেছে। সেগুলি হল হাজারদুয়ারি, বেগম মহল, বালাখানা ও ওয়াসিফ মঞ্জিল। এ ছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি ইমামবড়া ও কয়েকটি মসজিদ। রয়েছে কেল্লায় প্রবেশের প্রধান ফটক দক্ষিণ দরজা। তবে কেল্লায় প্রবেশের পূর্বের (নবাব সুজাউদ্দিন খানের নির্মিত) প্রধান পথ রৌনক আফজা দরজাটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। কেল্লার একদিক ঘেরা ছিল ভাগীরথীর প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে এবং কেল্লার অন্য দিকগুলি সুউচ্চ, মজবুত ইটের দু’টি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রথম প্রাচীর এবং দ্বিতীয় প্রাচীরের মধ্যবর্তী অংশে ছিল সেনা ব্যারাক – যারা কেল্লার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করত। সমগ্র কেল্লার প্রাচীরের দিকের তিন মাথায় একটা করে ছোট মিনারের মতো স্থান থাকত, যেখানে সিপাহি থাকত এবং নবাবের নিশান যুক্ত পতাকা লাগানো থাকত। কেল্লার তিন মাথার এই পতাকা বাংলা সুবার তিন প্রদেশ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাকে বোঝাত।
কেল্লায় বিভিন্ন সময় ভাগীরথীর তীর বরাবর বিভিন্ন ঘাট গড়ে উঠেছিল, এইসব ঘাটগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘাটগুলি হল নবাব ঘাট (বর্তমানে অবলুপ্ত), বাংলো ঘাট বা ওয়াসিফ মঞ্জিল ঘাট, মোতিমহল ঘাট, সরসরিয়া ঘাট, মোরগখানা ঘাট, চক ঘাট, লাট ঘাট ইত্যাদি। আজ অবশ্য ঘাটগুলির সেই জৌলুশের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
একটা সময় ছিল যখন এই নবাবি কেল্লার জৌলুশ ছিল দেখার মত। কেল্লার প্রধান ফটক থাকত উচ্চ নিরাপত্তায় মোড়া। সেই নিরাপত্তা ভেদ করে কোনও মাছিরও কেল্লার ভেতরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। কেল্লার সেই প্রধান ফটকের পাশেই ছিল নবাবি সেপাইদের বসবাস করার ঘর। ভাগ্যের পরিহাসে আজ সেই ঘরে বসবাস করেন মুর্শিদাবাদের বর্তমান নবাব বাহাদুর সৈয়দ মহাম্মদ আব্বাস আলি মির্জা ও তার পরিবার পরিজন। নবাবি আমলে কেল্লায় প্রধান ফটক ‘দক্ষিণ দরজার’ মাথায় থাকত নহবৎখানা। সেখানে নবাবের শাহি বাদকরা সকাল-সন্ধ্যা সানাই বাজাত। সানাই-এর সেই সুর কেল্লা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ত দূর-দূরান্তে। আজ সেই দক্ষিণ দরজা অক্ষুণ্ণ থাকলেও, নেই সেই বাদকেরা। শোনা যায় না সানাইয়ের মন মাতানো সেই সুর। এক সময় কেল্লার ভেতরে সাধারণ মানুষ তো দূর, উচ্চপদস্থ আধিকারিকদেরও অবাধ বিচরণের অনুমতি ছিল না। আধিকারিকদেরও কেল্লার ভেতর চলাফেরা করার ক্ষেত্রে নানাবিধ নিয়ম কানুন মেনে চলতে হত। কেল্লার মধ্যে প্রবেশ ও প্রস্থানের সময়ও নির্দিষ্ট ছিল। অথচ আজ সেই কেল্লা বেদখল। কেল্লা চত্বরে গড়ে উঠেছে বহু হোটেল সহ অজস্র দোকানপাট। কেল্লার রাজকীয় পরিবেশ বিলুপ্ত হয়েছে বহুদিন আগেই। নবাবি আমলে সন্ধ্যার পর কেল্লার ভেতরে নিজামত পরিবারের সদস্য বাদে অন্য কারুর অবস্থান করার অধিকার ছিল না। অথচ এখন প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকেই কেল্লা-চত্বর গমগম করে ওঠে পর্যটকদের কোলাহলে।
একটা সময় কেল্লার পাশেই বয়ে চলা ভাগীরথী নদীতে ভেসে থাকত বহু দাঁড়-বিশিষ্ট নবাবি নৌকা। সেই নৌকাগুলির কোনওটি হত ময়ূর-মুখী, কোনওটি হাতি-মুখী, ঘোড়া-মুখী, কোনওটি আবার কুমির-মুখী। সব নৌকাতেই থাকত নবাবি নিশান। নবাবরা সেই নৌকায় করে যাতায়াত করতেন রাজমহল, ঢাকা কিংবা কলকাতায়। কখনও আবার নৌকা নিয়ে বেরোতেন বৈকালিক ভ্রমণে। নবাবি আমলে হাজারদুয়ারি ঘাটে সারিবদ্ধভাবে এইসব রাজকীয় নবাবি নৌকাগুলি নদীতে বাঁধা থাকত। এখনও কেল্লার সেই ঘাট রয়ে গেছে। কিন্তু সেই ঘাটে আজ আর কোনও রাজকীয় নৌকার দেখা মেলে না।
বর্তমানে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর থাকলেও, নেই সেই নবাবি আমল। কিন্তু কেল্লার নবাবি আমলের মহা আড়ম্বরে উদযাপিত হওয়া বহু উৎসব, যেমন বেরা, মহরম, নওরোজ আজও পালিত হয়ে আসছে পূর্বের রীতিনীতি মেনেই। আজও রমজান মাসে কেল্লায় বসবাসকারী নিজামত পরিবারগুলি সেজে ওঠে। আজও ঈদের দিন কেল্লার বাড়িগুলি সেজে ওঠে। নতুন পোশাকে আবৃত নিজামত পরিবারের মানুষদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে কেল্লার ভেতরের চক মসজিদ চত্বর। সমগ্র মসজিদ ভরে যায় শাহি আতরের খুশবু-তে। এই দিন কেল্লার ভেতরের নিজামত পরিবারগুলি থেকে ভেসে আসে পুলাও, বিরিয়ানি সহ আরও নানান ধরণের শাহি খাদ্যের সুবাস। সব কিছু মিলে ঈদের দিন জরাগ্রস্ত কেল্লা নিজামতে নবাবি আমল যেন পুনরায় মূর্ত হয়ে ওঠে।