বর্তমানে কেল্লার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নবাব হুমায়ুন জা’র হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। কিন্তু মজার বিষয় হল, নবাবি আমলে এর নাম হাজারদুয়ারি ছিল না। নবাবরা বলতেন ‘বড়ে কোঠি’, অন্যদিকে ইংরেজরা বলতেন নিউ প্যালেস। বড়ে কোঠি হঠাৎ করে হাজারদুয়ারি কিভাবে হয়ে উঠল? এই প্রশ্ন আমার মাথাতেও ঘুরছিল, আর তার উত্তর খুঁজতে নবাব পরিবারের প্রবীণ সদস্য – শিক্ষক গবেষক ডঃ রেজা আলি খান এবং বর্তমানে নবাব বাহাদুর অফ মুর্শিদাবাদ পদের যোগ্য উত্তরাধিকারী – সৈয়দ মুহাম্মাদ আব্বাস আলি মির্জার দ্বারস্থ হয়েছিলাম বছর পাঁচেক আগে। তাঁরা দুজনই আমাকে জানিয়েছিলেন, স্থানীয় বাঙালি জনসাধারণই প্রাসাদের অজস্র দরজার জন্য বড়ে কোঠিকে হাজারদুয়ারিতে পরিণত করেছে।
চলুন, এবার হাজারদুয়ারি প্রাসাদ তৈরির পেছনের গল্প জানা যাক। এইসব গল্প আমি নবাব পরিবারের প্রবীণ সদস্য এবং ‘নিজামত লেটারস’ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। ‘নিজামত লেটারস’ হল নবাবদের সাথে ইংরেজদের নানান বিষয়ে লেখা অজস্র চিঠিপত্র। সেইসব চিঠি পড়লে নবাবি আমলের বহু অজানা রোমাঞ্চকর তথ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। নাজাফি বংশীয় (মীরজাফরের বংশধর) নবাবদের আর্থিক দুর্দশার কারণে তাঁদের বসবাস করার উপযুক্ত প্রাসাদের বড্ড অভাব দেখা দিয়েছিল – সে কথা আগের পর্বেও বলা হয়েছে। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই নবাবরা কেল্লার ভেতরের পুরোনো, জরাজীর্ণ, স্যাঁতসেঁতে প্রাসাদেই বসবাস করতেন। তবে যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেত, তখন নবাবসহ নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা ইংরেজদের কাছে নতুন প্রাসাদের জন্য আবেদন নিবেদন জানিয়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখতেন। নিজামত পরিবারের সেই সব আবেদন-নিবেদনে তেমন কোনো কাজই হত না। এই বিষয়ে ঘন ঘন চিঠি পাঠালে, ইংরেজ কর্তপক্ষ কেল্লায় এসে প্রাসাদ তৈরির জায়গা ঠিক করে, সেই জায়গা মেপে, প্রাসাদ তৈরির জন্য একটা আনুমানিক খরচের হিসাব করতেন – ব্যস, এইটুকুই। কেল্লায় কোনো নতুন প্রাসাদ তৈরি হত না। এর পেছনে দায়ী ছিল নবাবদের অর্থাভাব, আর ইংরেজদের অনীহা। আসলে আমি যে সময়ের কথা বলছি (ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিক), সেই সময় নবাবরা একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিলেন, ফলে নানা বাহানায় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রাপ্য ন্যায্য ভাতা প্রতিনিয়ত কমিয়ে দিচ্ছিল। এমতাবস্থায়, কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই হয়তো নবাবদের জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করে অর্থ নষ্ট করতে চাইছিল না।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে, নিজামত পরিবারের সদস্যদের জমে থাকা অর্থ ও সম্পদ দিয়ে ইংরেজ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ‘নিজামত তহবিল’ তৈরি করে, সেখানকার জমানো টাকা নিজামত পরিবারের সদস্যদের উন্নতিকল্পে এবং বাসগৃহ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ করে। সেই অর্থের কিছু অংশ দিয়েই বড়ে কোঠি বা হাজারদুয়ারি প্রাসাদ নির্মাণের আয়োজন শুরু হয়।
প্রথমে প্রাসাদ তৈরির জন্য কেল্লার ভেতরে – ভাগীরথীর তীর বরাবর – একটি স্থান নির্বাচন করা হয়। তারপর প্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই সময়ের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ডানকান ম্যাকলিয়ডকে। প্রাসাদ তৈরির বহু আগে থেকেই সেটি তৈরির নানান সরঞ্জাম সংগ্রহ শুরু হয়ে গিয়েছিল। হাজারদুয়ারি তৈরির জন্য লালবাগ বা মুর্শিদাবাদ শহরের নিকটবর্তী তালগাছি গ্রাম থেকে মাটি নিয়ে ইট তৈরি করা হয়েছিল বলে জানা যায়। সেই গ্রামের অস্তিত্ব আজও রয়েছে এবং সেখানে অদ্ভুত ভাবেই অজস্র পুকুরের দেখা মেলে। কথিত রয়েছে, যে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের জন্য ইট তৈরি করতে যে মাটির প্রয়োজন তা মেটাতেই এই গ্রামে প্রচুর গর্ত তৈরি হয় এবং পরে তাতে জল জমে সেগুলি এক সময় পুকুরে পরিণত হয়।
অবশেষে বড়ে কোঠির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সেই শুভ দিন এল ১৮২৯ সালের ২৯শে আগস্ট। সেদিন কেল্লার ভেতরে বহু ইংরেজ আধিকারিকরাও উপস্থিত ছিলেন। নবাব হুমায়ুন জা স্বয়ং সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে, একটি সোনার ইট গেঁথে, প্রাসাদের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যে নবাব নাজিম নিজে প্রাসাদের ভিতের ভিতরে নামলেও, সেখান থেকে উঠতে পারেননি – কারণ ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করে নবাব নাকি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। মাটির নীচে, অত গভীরে হয়তো অক্সিজেন কম ছিল। যাই হোক, অজ্ঞান অবস্থায় তাঁর ভৃত্যরা উপরে তুলে নিয়ে এসে শুশ্রূষা করতেই নবাবের জ্ঞান ফিরে আসে। এই ঘটনাটি সে সময়ে বেশ শোরগোল ফেলেছিল। হাজারদুয়ারি প্রাসাদের নির্মাণকার্যে ইট গাঁথা, দেওয়াল প্লাস্টার ও বাড়ির ছাদ তৈরির কাজে আজকের সিমেন্ট-বালির পরিবর্তে ব্যবহার করা হত ‘চুন-সুরকি’। এই মিশ্রণ তৈরি করতে ব্যবহৃত হত চুন, সুরকি (ইটের গুঁড়ো), মেথি-ভেজা জল, চিটে গুড় এবং প্রচুর ডিমের কুসুম। ১৮২৯ সালের আগস্টে প্রাসাদ তৈরির কাজ শুরু হয়ে, শেষ হয় ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। তিনতলা এই নতুন প্রাসাদ তৈরি হল গ্রিসিয়ান ডোরিক শিল্পকলায়। প্রাসাদটি লম্বায় প্রায় ৪২৬ ফুট, চওড়ায় প্রায় ২০০ ফুট এবং উচ্চতায় প্রায় ৮০ ফুট। প্রাসাদটিতে নবাব ও তাঁর পরিবারের থাকার ও শাসনকার্য পরিচালনার জন্য অজস্র ঘর ছিল। সমগ্র প্রাসাদটি নির্মাণে খরচ পড়েছিল প্রায় সাড়ে ষোলো লক্ষ টাকা।
নতুন প্রাসাদ ‘বড়ে কোঠি’ তৈরি হলে, নবাব হুমায়ুন জা সপরিবারে সেই প্রাসাদে এক রাত কাটিয়ে তাঁর পুরোনো প্রাসাদেই ফিরে গেলেন। ইউরোপীয় কায়দায় তৈরি বড়ে কোঠি বা হাজারদুয়ারি নবাবের মনে ধরেনি, কারণ নতুন প্রাসাদে মহিলাদের কোনও আব্রুর ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়াও, কোনো খোলা চত্ত্বরও ছিল না যেখানে বেগমরা প্রাকৃতিক পরিবেশে নিজেদের মত সময় কাটাতে পারবেন। নবাবের প্রাসাদ পছন্দ না হওয়ায়, এই প্রাসাদ একপ্রকার ইংরেজদের হাতেই চলে যায়। ইংরেজদের কোনো আধিকারিক কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদে এলে এই প্রাসাদেই তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হত। তবে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের দোতলায় ছিল নবাবের দরবার হল। সেটা অবশ্য নবাব ব্যবহার করতেন। দরবার হলটি ছিল গোলাকৃতি। দরবার হলের মাথায় ছাদের মধ্যিখানে রয়েছে গ্রিক শিল্প-কলায় সজ্জিত একটি বিরাট আকারের গম্বুজ, যেখানে রয়েছে স্কাই লাইট। গম্বুজকে কেন্দ্র করেই, কিছুটা নিচের দিকে রয়েছে চারটি ঝরোখা - যেখান থেকে বেগমরা দরবারে কোনো আলোচনা হলে তা দেখতে পেতেন। এই হলের সেই গম্বুজের নীচে বড় লোহার চেন দিয়ে বাঁধা একটি বিরাট আকৃতির আকর্ষণীয় ঝাড়বাতি ঝুলছে, যা নবাব নাজিমকে রাণী ভিক্টোরিয়া উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। নবাব হুমায়ুন জা তাঁর দরবার হলে বসার জন্য একটি নতুন সিংহাসন তৈরি করিয়েছিলেন। নবাব হুমায়ুন জার পূর্বে বাংলা সুবার নবাব নাজিম, বাংলার সুবেদার মুঘল শাহজাদা সুজা খানের নির্মিত কালো পাথরের তৈরি জৌলুশহীন মসনদে বসেই শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু নবাব হুমায়ুন জা ছিলেন অত্যন্ত শৌখিন নবাব, ফলে নবাব হয়ে তিনি সোনার কাজ করা রুপোর সিংহাসন তৈরি করিয়েছিলেন। সিংহাসনটি একটি মার্বেলের চৌকির উপর রাখা হয়েছিল। সিংহাসনের মাথায় রয়েছে একটি রুপোর ছাতা এবং সামনে রয়েছে একটি রুপোর হুঁকো। দরবার হলের পূর্বদিকে রয়েছে কমিটি রুম। সেখানে রয়েছে নবাব মনসুর আলি খান ফেরাদুন জা’র আরও একটি সোনার কাজ করা রুপোর সিংহাসন। সিংহাসনের দু’ পাশে আছে হাতির দাঁত-বাঁধানো দু’টি সোফা। প্রাসাদের ভেতরে ছিল বিরাট একটি ডাইনিং হল। সেই ডাইনিং হল রয়ে গেলেও, ডাইনিং টেবিলটি সেখানে আর নেই।
নবাব হুমায়ুন জা’র মৃত্যুর প্রায় ৬৫ বছর পর এ. সি. ক্যাম্পবেল নামক এক ইংরেজ আধিকারিক হাজারদুয়ারির নীচতলায় অবস্থিত তোষাখানায় নবাবদের মূল্যবান রত্নখচিত অলংকার দেখেছিলেন। সেখানে তাঁর নজরে পড়েছিল পাঁচটি হীরা, যা নবাবের পাগড়িতে এবং কোমর-বন্ধনীতে ব্যবহার করা হত। এই হীরাগুলির আকার ছিল প্রায় পৌনে এক ইঞ্চি, যেগুলি এক সময় দিল্লির বাদশাহ নবাবকে উপহার হিসেবে প্রদান করেছিলেন। এছাড়াও পাগড়ি বা মুকুটে লাগানোর জন্য পায়রার ডিমের আকারের অপর একটি হীরাও দেখেছিলেন। এ ছাড়াও, পদ্মফুলের মত দেখতে হীরা-খচিত হার, ছোট- বড় হীরা ও চুনি-খচিত শিরোভূষণও ছিল সেখানে। তোষাখানায় আরও ছিল মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমলের হীরা, চুনি ও মোতি-খচিত একটি নেকলেস – যেখানে বাদশাহর নাম ও ১০১৮ হিজরি খোদাই করা ছিল। এ ছাড়াও ছিল জর্জ চতুর্থ উইলিয়ামের নবাব হুমায়ুন জা’কে দেওয়া রত্নখচিত একটি ক্রস। তোষাখানায় তিনি আরও দেখেছিলেন – সাদা, লাল, গোলাপি, হলুদ, সবুজ ও কালো রঙের হীরা-খচিত একটি বকপাখি, তিনজোড়া হীরা ও চুনি খচিত বাজুবন্ধ, এছাড়াও হীরা ও চুনি-খচিত আরও কয়েকটি অলঙ্কার সহ রত্নখচিত বেশ কয়েকটি তলোয়ারও। সেই তলোয়ারগুলির কয়েকটি ছিল আবার মুঘল বাদশাহের দেওয়া উপহার। এই সমস্ত রত্নখচিত অলংকারের আজ আর দেখা মেলে না।
হাজারদুয়ারিতে রয়েছে একটি অস্ত্রাগার। সেখানে রয়েছে তরবারি, বল্লম, খঞ্জর, ছোট ছোট কামান, মাসকেট, এক ও একাধিক নলাযুক্ত বন্দুক, ছোট ছোট পিতলের কামান (নৌকায় রাখার জন্য), চাকু, লোহার তৈরি যুদ্ধের পোশাক, লোহার তৈরি মাথা-ঢাকার বর্ম, ফারসি লিপিযুক্ত গন্ডারের চামড়ার ঢাল-সহ আরও বহু কিছু। অস্ত্রাগারে নবাব আলিবর্দি খান, সিরাজউদ্দৌলার তরবারি সহ নবাব মীরকাশিমের দ্বি-মুখী জুলফিকার তরবারিও রয়েছে। এ ছাড়াও, অস্ত্রাগারে ইংরেজ ও জার্মানদের তরবারির নিদর্শনও পাওয়া যায়। প্রাসাদে রয়েছে বিভিন্ন নবাবদের অজস্র তৈলচিত্র। শুধু নবাবদেরই নয়, সেই সঙ্গে তাদের দেওয়ান এবং ইংলন্ডের রাজা-রাণী সহ বহু ইংরেজ আধিকারিকের তৈলচিত্র প্রাসাদের বিভিন্ন গ্যালারিতে সাজানো রয়েছে। এইসব ছবি ছাড়াও নবাবি আমলের বহু ঘটনা, ও নানা স্থাপত্যের তৈলচিত্র রয়েছে। এছাড়া আছে নবাবদের ব্যবহৃত একটি ঘোড়ায় টানা ও একটি উটে টানা গাড়ি, দু’টি মোটর গাড়ি, শৌখিন ও দুষ্প্রাপ্য নানান আসবাব পত্র, পালকি, হাওদা, নবাব ও ইংরেজদের বিভিন্ন আদেশনামা, চুক্তিপত্র, বহু দুষ্প্রাপ্য দলিল-দস্তাবেজ সহ আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য সামগ্রী। প্রাসাদটি সাজানো হয়েছে মিউজিয়াম হিসেবে। প্রাসাদের ভিতর আছে একটি বৃহৎ গ্রন্থাগার, যেখানে ফার্সি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রায় ১৪০০০ গ্রন্থ রয়েছে। গ্রন্থগারে জনসাধারণের অবাধ প্রবেশ নিষেধ, তবে কোনো ব্যক্তি গবেষণার উদ্দেশ্যে অনুমতি সাপেক্ষে গ্রন্থগারটি ব্যবহার করতে পারেন।
কেল্লার ভিতরে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে হাজারদুয়ারি প্রাসাদে নবাবের দরবার বসত। বিশেষ করে বেরা উৎসবের সময় নবাব রাজকীয় পোশাকে সজ্জিত হয়ে হাজারদুয়ারির দরবার হলের সিংহাসনে বসতেন। সঙ্গে থাকতেন নবাবের আধিকারিকসহ আমন্ত্রিত অথিতিরা। এছাড়াও হাজারদুয়ারি প্রাসাদ তৎকালীন কেল্লার মানমর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। নবাব এ প্রাসাদে বসবাস না করলেও তাঁর নবাবিয়ানা বিরাজ করত হাজারদুয়ারি চত্বর জুড়ে। প্রাসাদের সামনে ভাগীরথী নদীতে বাঁধা থাকত নবাব ও বেগমের নৌকা – যা এক মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি করত।
নিজামত পরিবারের কিছু প্রবীণ মানুষদের বলতে শুনেছি যে অওধের সুলতান ওয়াজিদ আলি শাহ তাঁর রাজ্যপাট হারিয়ে, সুবিচারের জন্য লখনউ থেকে জলপথে কলকাতা যাওয়ার পথে, মুর্শিদাবাদে তাঁর নৌকা থামিয়েছিলেন নবাব মনসুর আলি খান ফেরাদুন জা’র সাথে দেখা করার জন্য। সেদিন বাংলার নবাব নাজিমের অনুরোধে সুলতান ওয়াজিদ আলি শাহ নাকি কয়েকদিন মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারি প্রাসাদে অতিবাহিত করে পুনরায় কলকাতার উদ্দেশ্যে নৌকা ভাসিয়েছিলেন ভাগীরথীতে। আমি এই ঘটনার বহু প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোথাও এই ঘটনার কোনো লিখিত তথ্য পাইনি। তবে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের দরবার হলের ঠিক বিপরীতে একটি ঘরের এক কোণায় একটি বাঁধানো তৈলচিত্র রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে অওধ সুবার বিভিন্ন সময়ের শাসকরা একসাথে একটি ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এই ছবিটি আমাকে অবাক করেছিল, কারণ এমন ছবি আমি এর আগেও দেখেছি, এবং অওধের শাসকদের এক বংশধরের কাছে শুনেছিলাম, যে সেখানকার শাসকেরা তাদের বংশের সমস্ত নবাবদেরকে একটি মাত্র ছবিতে এঁকে সেই ছবি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে উপহার হিসেবে প্রদান করতেন। খুব সম্ভবত এই তৈলচিত্রটিও সুলতান ওয়াজিদ আলি শাহ, নবাব মনসুর আলি খান ফারাদুন জা’কে উপহার হিসেবেই দিয়েছিলেন। এই চিত্রটিই সুলতান ওয়াজিদ আলি শাহের হাজারদুয়ারিতে আসার বড় প্রমাণ হতে পারে।
১৯০২ সালে লর্ড কার্জন কোনো এক কাজে মুর্শিদাবাদে এসে হাজারদুয়ারিতেই উঠেছিলেন। লর্ড কার্জনকে হাজারদুয়ারিতে স্বাগত জানাতে সমগ্র প্রাসাদ সেজে উঠেছিল। সেদিন হাজারদুয়ারির সিঁড়ি ভরে উঠেছিল খাকি পোশাকে সজ্জিত ও মাথায় লাল পাগড়ি পরিহিত নবাবের রক্ষীবাহিনীতে। সাথে ছিল নবাবি প্রশাসনের বহু উচ্চপদস্থ আধিকারিকসহ নিজামত পরিবারের সদস্যবৃন্দ। সিঁড়ির উপরের চাতালে, সিংহাসনে বসেছিলেন নবাব হাসান আলি মির্জা, আর তাঁর একপাশে প্রিন্স ওয়াসিফ আলি মির্জা ও অন্য পাশে প্রিন্স নাসির আলি মির্জা দাঁড়িয়েছিলেন লর্ড কার্জনকে বরণ করে নেওয়ার জন্য। সিঁড়ির নিচে পর পর ১৩টি সুসজ্জিত হাতি ও বেশ কিছু ঘোড়া দাঁড়িয়েছিল। লর্ড কার্জন কেল্লার ভেতরে প্রাসাদ চত্বরে প্রবেশ করলে তাঁকে সেলামি তোপ দেগে সম্মান জানানো হয়েছিল।
হাজারদুয়ারির হাজার কথা বলতে গেলে বলে শেষ হবে না। এই নিয়ে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। মুর্শিদাবাদে আগত বহু পর্যটক আজও মনে করেন হাজারদুয়ারি প্রসাদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা তৈরি করেছেন। কিছু গাইডের কল্যাণে এমন একটি কথাও চালু আছে, যে এটা নকল হাজারদুয়ারি, আসল হাজারদুয়ারি নাকি গঙ্গায় তলিয়ে গেছে। আজ নবাব মীরজাফর ভারতীয় উপমহাদেশের খলনায়ক হলেও, তাঁর বংশধরের তৈরি হাজারদুয়ারি প্রাসাদ কিন্তু বাংলা তথা সমগ্র দেশের গর্ব। এই প্রাসাদ দেখতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক মুর্শিদাবাদে আসেন।
সাধারণভাবে আমরা জানি, যে হাজারদুয়ারিতে কোনো নবাব বসবাস করেননি। কিন্তু নিজামত পরিবারের মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারি, মুর্শিদাবাদের তৃতীয় নবাব বাহাদুর সৈয়দ ওয়ারিশ আলি মির্জা কলকাতা থেকে প্রায় প্রতিমাসেই মুর্শিদাবাদে আসতেন এবং হাজারদুয়ারিতেই উঠতেন।
নবাবের মৃত্যুর পর নিজামত পরিবারের অনেকেই হাজারদুয়ারি প্রাসাদে মাঝে মাঝে থাকতেন, নিজামত পরিবারের সদস্যদের মানসপটেও রয়েছে হাজারদুয়ারির অজস্র স্মৃতি, যা তাঁরা তাঁদের বেঁচে থাকার, ভালো থাকার রসদ হিসেবে বুকে আগলে রেখেছেন। নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা আজও হাজারদুয়ারিকে বড়ে কোঠি বলতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ভাবতে অবাক লাগে, এক সময় যে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ নিজামত পরিবারের গর্বের কারণ হত, অধিগ্রহণের পর তাঁদের সেই হাজারদুয়ারি প্রাসাদেই ছোট পদের সামান্য চাকরি নিয়ে, এমনকি সামান্য প্রহরীর চাকরি নিয়েও কোনোরকমে সংসার চালাতে হয়েছে, আজও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাজারদুয়ারির জৌলুসও ক্রমশ অস্তমিত হয়ে পড়ছিল। নবাবি আমল অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, এত বড় প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণ করা মুশকিলও হচ্ছিল, তাই মুর্শিদাবাদ শহরের কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ চাইছিলেন, এই ঐতিহাসিক প্রাসাদটি সরকার অধিগ্রহণ করুক। তবেই এই নবাবি আমলের সাক্ষ্য এই প্রাসাদটি ভালো থাকবে, এবং তার ইতিহাসও রক্ষিত হবে। যদিও প্রাসাদ অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে বলার মত মানুষেরও অভাব ছিল না। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ, বিংশ শতকের আটের দশকে এই ঐতিহাসিক প্রসাদটিকে অধিগ্রহণ করে মিউজিয়ামে পরিণত করেন। কেল্লার অন্যান্য প্রাসাদগুলি ধ্বংস হয়ে গেলেও, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের হস্তক্ষেপের ফলে আজও হাজারদুয়ারি প্রাসাদটি নবাবি আমলের গৌরব বহন করে চলেছে।