এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রাজনীতি ও ভদ্রলোক

    Pinaki Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ২৯৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • …গুড়্‌ গুড়্‌ গুড়্‌ গুড়িয়ে হামা খাপ্‌ পেতেছেন গোষ্ঠো মামা
    এগিয়ে আছেন বাগিয়ে ধামা এইবার বাণ চিড়িয়া নামা- চট্‌!

    এই যা! গেল ফস্কে ফেঁসে- হেঁই মামা তুই ক্ষেপলি শেষে?
    ঘ্যাঁচ্‌ ক'রে তোর পাঁজর ঘেঁষে লাগ্‌ল কি বাণ ছট্‌‌কে এসে- ফট্‌?

    রাজনীতির আঙিনায় গোষ্ঠ মামার অভাব নেই। কতো রকমের গোষ্ঠোমামা। কতো বিচিত্র তাদের খাপ! কিন্তু স্বয়ং সুকুমার রায় দেখিয়ে দিয়ে গেছেন  খাপ পাতলেই পাখি ধরা পরে না। রাজনীতির আবহে, বলা ভালো ভোটের আবহে এই খাপ অতীব সুচারু রূপ নেয় সেকথা আমরা ভালই টের পাই। কিন্তু খাপ পাতলেই তো হলও না, যেকোনো সাফল্যের পিছনে  ইচ্ছা-সক্ষমতা-সুযোগের এক ত্র্যহস্পর্শ থেকে যায়। সেই মিলন না হলে সব বুমেরাং।

    এবার আসল কথায় আসি- বিগত নির্বাচনে  হিন্দুত্ববাদী সংগঠন তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলটি কে বাংলায় ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে এই তিনের মেলবন্ধন ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। ঠিক যেমনটি করছে এই লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে দলটিকে বাংলায় অন্তত আসনের নিরিখে প্রধান দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। যে প্রকার এবং পদ্ধতি তারা অবলম্বন করেছিল, অর্থাৎ ‘খাপ’পেতেছিল নির্দ্বিধায় বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তা ছিল অভিনব।কিন্তু এহেন প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখল না, কেন? খামতি কোথায় ছিল? ইচ্ছার খামতি বললে তো দলটির নিজের অস্তিত্বের দিকেই প্রশ্ন উঠে আসবে। তবে কি সক্ষমতা আর সুযোগ? উল্টোদিকে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল সরকারী সাহায্যের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করতে উদ্দ্যত। কিন্তু তার আড়ালে তৃতীয় রিপুর নগ্ন নৃত্য। খানিক লঘু ভাবে বলতে গেলে এদের রাজনৈতিক টিউন কখনই 'ভুপালী' রাগে বাঁধা যায় না কারণ ঐ রাগে 'মা' ,'নি' নাই। কিন্তু এই আবহে কি করছে বাঙালি ভদ্রলোক যাদের হাতেই একসময় রাজনীতির রাশ থাকতো। তারাও কি পাল্টে গেল?  ধর্ম এবং দুর্নীতির আবহে কেমন আছে তারা? 

    রাজনীতির শেয়ার বাজার

    ২০২১ এ বাংলায় ভোটের হাওয়া যত বইতে শুরু করল জনমানুষে প্রচার হতে লাগলো এবারের বাংলায় পরিবর্তনের পরিবর্তন হতে চলেছে। পাড়ার আড্ডা, চায়ের দোকান, অফিস-কাছারি,ট্রেন-বাস এমনকি বাড়ির হেঁসেল থেকে কলতলা সর্বত্র এক কথা, বাংলার মসনদে নতুনের আগমন এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। হাওয়া বলতে এখানে মানুষের ধারণাকে ধরে নেওয়া যেতে পারে।একে অপরের সাথে কথা বলে যে ধারনাটি উঠে আসছিল তাকেই পথ চলতি মানুষ হাওয়া বলে মেনেও নিচ্ছিল। কিন্তু যে মাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের বিরোধ করেছিলেন, কোন জাদু বলে সেই মাটিই বিভাজনের রাজনীতির কারিগরদের আহ্বান করবে?একি কোনও ম্যাজিক, নাকি এক রাজনৈতিক অসারতার ফলে সৃষ্ট ‘শূন্যস্থান পূরণ’এর আখ্যান। ভরত মুনি তার নাট্যশাস্ত্রে বলছেন একটি মাত্র রসে নাকি নাটক হয় না। রাজনীতির উত্থান পতনে  চূড়ান্ত নাটকীয় উপাদান থাকে, আর তাই তার চালিকা শক্তিও যে কখনো একটি রস বা প্রভাবক হবে না এটাই স্বাভাবিক। ভোট পূর্ববর্তী যত ধরনের সমীক্ষা আমরা দেখেছিলাম, তার বেশীরভাগের মধ্যে একটি অদ্ভুত প্রবণতা চোখে পড়ছিল, যেটি এই লোকসভা ভোটের আগেও দেখা যাচ্ছে। প্রবণতাটি এই যে, যেসমস্ত মানুষ রাজ্যের শাসক দলকে নিজের ভোট টি দেবে বলে মনস্থ করেছে, তাদের একটি অংশ কিন্তু মনে করছে শাসক দল নাও জিততে পারে। অর্থাৎ যে মানুষটি ভোট দিচ্ছে, সে নিজেও নিজের ভোটের কার্যকারিতা বিষয়ে সন্দিহান। অবশ্যই এটি পারিপার্শ্বিক কথা বার্তা এবং নিজের ইচ্ছার মধ্যে চলা এক দ্বন্দ্বর বহিঃপ্রকাশ। এই চিন্তার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে দোদুল্যমান ভোটার। কিন্তু এহেন perception এর খেলায়  ভোটার নিজের ভোটকে অকার্যকরী মনে করে তাকে পরিবর্তন করার কথা ভেবেও ফেলতে পারে, হাজার হোক ‘আমার যখন কোনও বাঁধাধরা দল নেই তখন আমি পরাজিতের দলে যাব কেন?’- এই মানসিকতা কে লক্ষ্য করে ভোট কুশলীরা গুটি সাজিয়ে চলেছে। বাংলার ভোট রাজনৈতিক ইস্যুর সাথে technical চালের মিশেল দেখতে পেল, হয়তো দ্বিতীয়টিই প্রকট হতে চাইছিল। রাজনীতি কে অরাজনৈতিক করে শেয়ার বাজারের রীতিতে চালানোর প্রচেষ্টা প্রকট হতে লাগলো, আর তার হাত ধরেই উঠে এলো বেশ কিছু শঙ্কা ও প্রশ্ন।  

    ইতিহাস বলছে বাংলা তার মসনদ রাজনৈতিক বা গণআন্দোলনের ঐতিহ্য ছাড়া কাউকেই ছেড়ে দেয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেসিদের একচ্ছত্র শাসনের পিছনে ছিল দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের ছায়া। ষাটের দশকে এই গতিধারা কে প্রথম প্রশ্নের মুখে ফেলে বামপন্থী আন্দোলন। বাংলার বামপন্থী আন্দোলন বিভিন্ন খাতে বইলেও মূল ধারার বামপন্থী দল গুলির সাতাত্তরে ক্ষমতায় আসার পিছনে এই আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। দুহাজার এগারো তে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবাংলায় বাম শাসনের অবসান ঘটাতে সেই গণআন্দোলনের পথই বেছে নিয়েছিল। সেই আন্দোলনের অভিমুখ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুই হতে পারে, কিন্তু এটা অস্বীকার করা যায় না যে আজকের ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় থাকার অন্যতম প্রধান কারণ সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলন। ২০২১ এর নির্বাচনে প্রথমবার এই ঘরানা যেন ধাক্কা খেতে চলেছিল। যে হিন্দুত্ববাদী দল ক্ষমতায় আসবে বলে আপামর জনসাধারণ মনে করছিল বাংলার প্রেক্ষিতে তাদের বৃহৎ আন্দোলনের কোনও ইতিহাস নেই। কিন্তু তবুও এই ধরনের চিন্তা সবার মনে আসার পিছনে কিছু কারণ অবশ্যই ছিল। অতীতে বাংলায় যত গণ আন্দোলন হয়েছে তার পিছনে যেমন সাধারণ মানুষ থেকেছে, তেমনি দেখা গেছে বাঙালি বুদ্ধিজীবী এবং বাঙালির একান্ত ভদ্রলোক সম্প্রদায়কে। ভদ্রলোক তার চরিত্রের মূল বীজটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে থেকে গেছে। দলের সাথে তার বিশ্বাসের সংঘাত হলে সে নিজেই সেখান থেকে সরে গেছে। সেই অপসারণ বা বিমুক্তিই তার রাজনৈতিক অবস্থান কে স্পষ্ট করে দিয়েছে। এর মধ্যে কিছু মানুষ দল বদল ও হয়তো করেছে। রাজনীতিতে দলবদল কোনও নতুন বিষয় নয়। দলবদল কিংবা দল ভাঙ্গার সাক্ষী বাংলা বহুবার থেকেছে। কিন্তু উপযোগীতাবাদের বিকৃত রূপ কে ঢাল করে দলে দলে দলবদল-২০২১ এ যার গালভরা নাম দেওয়া হয়েছিল ‘যোগদান মেলা’- ‘বইমেলা’ প্রিয় বাঙালির কাছে অনেকটাই নতুন। শেয়ার বাজারের গতি প্রাপ্ত শেয়ার কিনে কিছুদিনের মধ্যে ফাটকা টাকা রোজগারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই ‘যোগদান মেলা’ আসলে রাজনৈতিক ফাটকাবাজির নামান্তর। উদারীকরণে সিক্ত বাঙ্গালীর কাছে শেয়ার বাজার আজ কোনও নতুন বিষয় নয় বরং তার আকর্ষণ ক্রমবর্ধমান।সেই দিক দিয়ে বিচার করলে ‘ডেটা’ নির্ভর এই রাজনৈতিক ফাটকাবাজি সাধারণ মানুষ কে আকর্ষণ করবে। এখানেই ছিল প্রথম ভয়।রাজনীতি কি তার মূলগত চরিত্রকে বিসর্জন দিয়ে কেবল ‘টেকনিকাল’বিষয় হয়ে উঠতে চাইছে?

    ভদ্রলোকের মেটামরফোসিস

    পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনীতির - যার প্রায় গোটাটাই ভদ্রলোক সমাজ নিয়ন্ত্রন করত, যে সামাজিক উত্তরণের স্বপ্ন ছিল তা আজ অবলুপ্তির পথে। ভদ্রলোকের পিছুহাঁটা বস্তুত গত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে চেনা যায়। ক্রমশ রাজনীতিতে, সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে একটা নতুন ধরণের মেজাজ ফুটে ওঠে। স্বাধীনতা পরবর্তী দশকগুলিতে নানা খাতে ক্রমবর্দ্ধমান সরকারী ব্যয় ও পরে কৃষিক্ষেত্রে সেচ, উন্নতমানের বীজ ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগে গ্রামাঞ্চলে আস্তে ধীরে অবস্থা পালটাতে থাকে। বামফ্রন্ট শাসনের প্রতিষ্ঠার পর অপারেশন বর্গা ও পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের ফলে গ্রামীণ ক্ষেত্রে আগের থেকে বেশি সম্পদের আমদানি ঘটে। ফলে তৈরি হয় এক নতুন ধরণের উপভোক্তা। সরাসরি গল্প বলা, কোন জটিল শৈল্পিক ধুসর জায়গা নেই, বরং আছে  নাটকিয়তায় ভরপুর অভিনয় রীতি যার মূল ব্যবসা ছিল জেলায়, গ্রামে। এখানেই জন্ম নেয় নতুন উপভোক্তা যাদের তথাকথিত ভদ্রলোকেরা তাদের সঙ্গে সমাসনে বসাতে না চাইলেই তারাও চোখে চোখ রেখে বলে উঠেছে ‘ আমিও কিন্তু ভদ্র বাড়ির ছেলে/মেয়ে’। প্রাথমিক ভাবে   ভদ্রলোক হতে গেলে শিক্ষা ও পারিবারিক সম্পদ থাকতে হবে, কারণ এর সাথেই জুড়ে থাকে ভদ্র পেশা। আর যেহেতু পেশা এবং শিক্ষা দুটিই উচ্চ বর্ণের পরিবারগুলির মধ্যেই বেশি পাওয়া সম্ভব, তাই ভদ্রলোকের সঙ্গে জুড়ে গেল উঁচু জাতের তকমা। 

    বাংলার বাইরে বাঙালির বহুদিন যাবত দুটি পরিচয় সর্বজনবিদিত।  বাঙালি নাকি স্বভাব বামপন্থী। চৌত্রিশ বছরের বাম জমানা এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে। বাংলার ভেতরে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে কে বড় বাম সে বিষয়ে তর্ক বিতর্ক চলতে থাকলেও, বাংলার বাইরের মানুষজন বাংলা কে বামপন্থীদের আঁতুড়ঘর হিসেবেই দেখে এসেছে। এই রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াও বাঙ্গালির একটি অন্যতম সামাজিক পরিচয়‘আনন্দ’সিনেমার ভাষায় ‘বাবুমশাই’। এই বাবুমশাই বাঙালির আদি বাবুসমাজের প্রতিভূ নয়, বরং দর্শনের দিক থেকে একে ভদ্রলোক বলাই শ্রেয়। চিন্তাশীল বাঙালি, সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি কিংবা অর্থের চেয়ে বিদ্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া বাঙালির ছবি এই ভদ্রলোকের মধ্যে ফুটে ওঠে। রাজনীতিতে ক্ষমতার কাছে থাকা এই ভদ্রলোকেরাই রাজনৈতিক ভাষ্যের সুরটি বেঁধে দিয়ে এসেছে। বহু দশক ধরে এই সুরটিই হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থী দলগুলির প্রসারের অন্তরায় ছিল। সঙ্গত কারণেই বাম ঘরানার রাজনীতিকে তারা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর বলেই মনে করতেন।

    হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি বাংলার সৃষ্টি ও কৃষ্টি বিষয়ে নিজেকে অত্যন্ত সজাগ দেখাতে গিয়ে অনুপ্রবেশের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে বাংলায় পরিচয়ের রাজনীতি কে আহ্বান করে বসেছে। পশ্চিমবঙ্গের সীমানা কেবল বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাই লঙ্ঘন করেনি, তাদের সাথে ওপার বাঙ্গালার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং বাংলার আরেকদিকে বিহার, ওড়িশার মত রাজ্যের লোকেরাও করেছে। তারা এখানে বসতি গড়ে তুলেছে।স্বভাবতই বহুদিন ধরে থাকার ফলে এই সকল মানুষের আচার বিচার সংস্কার বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এই প্রভাবের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আমরা আমাদের একান্ত নিজেদের অনুষ্ঠান কিংবা উৎসবেও পেয়ে থাকি।

    বাংলায় হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রভাব অ-হিন্দিভাষী এলাকাগুলির মধ্যে সর্বাধিক বললে অত্যুক্তি হয়না। একদিকে অবাঙ্গালী জনসমাগম এবং গণমাধ্যমের প্রভাবের ফলে হিন্দিবলয়ের সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে আমাদের অজান্তেই প্রবেশ করতে শুরু করে।এই পটপরিবর্তন শহর থেকে শুরু করে গা-সওয়া হতে হতে মফস্বলে প্রবেশ করার পর আমরা যেন এর একটা সার্বিক রূপ খুঁজে পেলাম।একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঙালির প্রিয় নেশা বলতে পান এবং  নস্যিকেই  বোঝান হতো। এমনকি শিবের উপাসক বাঙালি নেশা-ভাঙেও ওস্তাদ মানা যায়। কিন্তু সেই বাঙালি খৈনি খাওয়া শিখল কোথা থেকে? সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে যে কয়েকটি হিন্দি সিনেমা সারা ভারত কে উদ্বেলিত করেছিল তাদের মধ্যে একটি অন্যতম ছিল ‘শোলে’। এই সিনেমার অন্যতম চরিত্র গব্বর সিং এর হাতে থাকা ঐ অদ্ভুত খাদ্যটি বাঙ্গালীর নজর কাড়ে। বাঙালি প্রথম এক নতুন অভ্যাসের স্বাদ পায়, যা ক্রমে ক্রমে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। একটা সময় অবধি অবাঙালিদের কর্মকাণ্ড কলকাতা কেন্দ্রিক কিংবা বড় শহরগুলি মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গণমাধ্যম এর প্রভাবে নতুনের এই রূপ আমাদের মনে স্থান করে নিতে থাকে। উৎসবের ভুরিভোজ থেকে রূপসজ্জা কিংবা হাল আমলে বাঙালির পূজার বৈচিত্র্য এই প্রভাবের নামান্তর মাত্র। আবার এই গণমাধ্যমের মাধ্যমেই আশির দশকের শেষের দিকে বাঙালি রামায়ণ-মহাভারত দেখেছিলো। রামায়ণ মহাভারত বাঙ্গালির পরিচিত নাম। কিন্তু রামজন্মভুমি আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপের প্রাক্কালে এই ‘গণ-দর্শন’নিঃসন্দেহে ধর্মীয় রাজনীতির এক ভিত্তি ভূমি স্থাপন করতে সফল হয়েছিল। সেই সময়ে রবিবারগুলির সকালের চিত্র যে কোনও বন্ধের দিন কে হার মানাত। রবিবার ধর্মবারে রূপান্তরিত হয়ে গেল। শুধু ধর্ম কাহিনী নয় রাম এবং জাতীয়তাবাদ কে জড়িয়ে ক্রমাগত এক নতুন ভাষ্য তৈরি হতে লাগলো।কিভাবে রাষ্ট্র, পরিবার, ব্যক্তি একে অপরের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, কিভাবে রাষ্ট্র বাঁচলে পরিবার কে বাঁচানো সম্ভব কিংবা কোন পরিবারের মঙ্গল কেবলমাত্র রামের আশীর্বাদের উপর নির্ভর করে থাকে এগুলিই সিনেমার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে লাগলো। রোজা, মুম্বাই থেকে সারফারোশ' হয়ে হাম আপকে হ্যায় কৌন, বা হাম সাথ সাথ হ্যায় এর মতো সিনেমা তা দেখিয়ে দিয়েছে। চিত্র সমালোচক শিলাদিত্য সেন তার লেখায় দেখিয়েছেন এই জাতীয় চলচ্চিত্র কিভাবে আমাদের ভাবনায় ঘুরপথে ‘রামরাজ্য’কে প্রতিষ্ঠা করেছে বা ‘পাকিস্তান’ কে ক্ষণে ক্ষণে শত্রু ভাবতে সাহায্য করেছে। হিন্দি সিনেমা প্রিয় বাঙালি মনে হিন্দুত্ববাদী ভদ্রলোকচিত এজেন্ডার জেগে উঠতে থাকে।  আমাদের অজান্তেই আমাদের ‘ফিল গুড’ মগজ ধোলাই হতে থাকে।
            
    পলিটিক্স বনাম পপুলিজম

    রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা একমাত্রিক হতে নেই। তাই একদিকে যেমন গণেশের মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন, রাম সেতু কিংবা মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট খোঁজা চলতে থাকে, তেমনই তার বিপরীতে একই তালে চলতে থাকে ‘নরম হিন্দুত্ব’ এবং ফ্রাঞ্ছাইজি রাজনীতির মিশেল। ধর্ম ও দুর্নীতির দ্বৈরথে বাঙালী ভদ্রলোক এখানে অসহায়,কারণ ‘তর্কপ্রিয় বাঙালি’ এই ধরণের অ-রাজনীতি আগে প্রত্যক্ষ করেনি। এই অরাজনৈতিক চিন্তার রাজনীতি তথাকথিত বাঙালি ভদ্রলোককে বাক-রুদ্ধ করে ফেললেও আরেকটি শ্রেণি এই রাজনীতির প্রভাবে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বহুদিন ধরে বাঙালির ‘ভদ্রসংস্কৃতি’র চাপে যে জনগোষ্ঠী নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রকাশ করতে পারেনি, কিংবা তাদের চাহিদার কোন চটজলদি সমাধানের হদিশ করতে পারেনি, অথবা এতদিনের জমে থাকা ক্ষোভ রাখার কোন আধার খুঁজে পায়নি তারাই এই রাজনীতির অন্যতম বাহক হয়ে ওঠে। সৃষ্টি ও কৃষ্টির উপাদান এই শ্রেণীকে ভদ্রসমাজ  বাস্তবে  ছুঁতে না পারার ফলে রাজনীতির আঙিনায় এরা খুঁজে নিয়েছে এক স্বকীয় রাজনৈতিক ঘরানা।তথাকথিত বাম জামানার অবসানের নেপথ্যেও এই সমাজের ভূমিকা ছিল। কিন্তু একই সাথে সেই শক্তির হাত ধরে জন্ম নেওয়া সিন্ডিকেট বা ফ্রাঞ্ছাইজি রাজনীতি হিন্দুত্ববাদীদের নতুন করে জায়গা করে দিতে থাকে।

    রাজনীতিতে ব্র্যান্ডিং বিষয়টি  এতটা নগ্ন ভাবে আগে কখনো দেখা যায়নি। একটি বিক্রয় যোগ্য দ্রব্যকে যে ভাবে প্রচারের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়, সেই পথে রাজনীতির ভাষ্য ক্রমাগত এক ব্যক্তির কাল্পনিক কারিশমাকে কল্পরাজ্যের দিশারী হিসেবে তুলে ধরতে লাগলো। তবে এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ধারা নয়, এই প্রবণতা এই সময়ে সমস্ত বিশ্বেই অল্পবিস্তর দেখাযাচ্ছিল। বাংলায় এই জাতীয় রাজনৈতিক ভাষ্য বাঙালির কাছে অনেকটাই  চেনা, কিন্তু এই ভাষ্যে ছিল এক নতুনের স্বাদ। এই অরাজনৈতিক পূর্ণতা এবং রাজনৈতিক শূন্যতাই কি আগামীর চালিকা শক্তি?

    বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই জানে রসায়নাগারে বিক্রিয়ার মাধ্যম বিক্রিয়া সংগঠিত হওয়ার এক অন্যতম শর্ত। মাধ্যম আম্লিক থেকে ক্ষারীয় হয়ে গেলে যেমন বিক্রিয়ার ধরন পরিবর্তিত হয়ে যায়, ঠিক তেমনই বাংলার রাজনৈতিক বাতাবরণে ক্রমাগত বাড়তে থাকা ধর্মীয় বাতাবরণ অনেক মতের পক্ষেই শ্বাসরোধকারী হয়ে উঠতে থাকে।ধর্ম, জাতীয়তাবাদকে শিখণ্ডী করে লড়তে গিয়ে এই মৌলবাদী দল বারংবার অতীতের এক স্বপ্নের দেশের গল্প ফেঁদে বসে।মৌলবাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য সে কখনই মনে করে না যে জীবন্ত  সমস্যার সমাধান বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে হয়, বরং মৌলবাদ বলতে চায় অতীতের কোনও আকর গ্রন্থে এর সমাধান আছে।বাউম্যান এর কথায় এই হলও ‘Retrotopia’, দৃষ্টি পিছনে রেখে ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে চলা। এই পিছনে মুখ করে সামনে হেঁটে চলাকে যে বিরোধ করবে সে একই সাথে ধর্ম,জাতীয়তাবাদ এবং সুখস্বপ্নকে আঘাত করে ফেলবে।এই অবস্থায় এই রাজনৈতিক আবহ কে আঘাত করতে না পেরে যারা এই মাধ্যমের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে চাইল, তারা সকলেই  ধর্মীয় রাজনীতি জুতোয় পা গলিয়ে ফেলল। কোন দল রামনবমী করলে, তার পাল্টা হিসেবে হনুমান জয়ন্তীর বিশাল শোভাযাত্রা ক্রমে ক্রমে বাংলার রাজনীতির স্বভাব হয়ে উঠতে লাগলো।রাজনৈতিক দলের চলন বহুলাংশে তার পিছনে থাকা পুঁজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মৌলবাদ কে ইন্ধন জোগানো পুঁজি  উন্মাদনার পরিবেশ তৈরিতে বেশী আগ্রহী, ফলে ‘প্রাচীন’ভদ্রলোক এর জায়গা বিপন্ন হয়ে পড়লো।তার জায়গায় চলে এলো ‘বাস্তববাদী ভদ্রলোক’। যাদের  চাওয়া পাওয়ার সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি কখনোই সমালোচনার যোগ্য হবে না, বরং তাদের তথাকথিত বাস্তবমুখী অবস্থান সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকেই দৃঢ় করে তুলবে। এরাই হলেন ‘পোস্ট ট্রুথ ভদ্রলোক’। এই  খাদ মেশানো মূল্যবোধ বাংলার রাজনীতিতে তথাকথিত ভদ্রলোক কে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে গেছে।

    ২০২১ এ হিন্দুত্ব-বাদীদের বাংলায় ক্ষমতা দখল ব্যর্থ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা বাংলার রাজনীতিকে তাদের শর্তে চালাতে সক্ষম হয়েছে। ধর্ম কে তারা নিশ্চুপে  থাকতে দেয়নি।রাজনীতিতে ধর্মের আবেশ চিরকালই ছিল। ডান, বাম কেউই সার্বিকভাবে নিজেকে এর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন দেখাতে পারবে না, কিন্তু সেই আবেশের কোনও তরঙ্গ প্রভাব (ripple effect) সমাজে ছিলনা। বিক্ষিপ্তভাবে যে দু একটি ঘটনা ঘটেছে তা তেমন ভাবে প্রচারের আলোতেও আসেনি এবং আমাদের প্রভাবিতও করেনি। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের ক্রমাগত ধর্মীয় রাজনীতি একদিকে যেমন ইচ্ছাকৃতই এই তরঙ্গ প্রভাব তৈরি করেছে, তেমনই তাদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে বিরোধীদের একটি বড় অংশ প্রতিক্রিয়ায় এক বিপরীত হিল্লোল কে চট জলদি সমাধান হিসেবে তুলে এনেছে। তাই হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিরোধের একটি বড় অংশ বিরোধীরা তাদেরই(হিন্দুত্ববাদীদের) তৈরি করা শর্তে নির্মাণ করে চলেছে। চৈতন্যদেবের বাংলায় রাজনীতির এই বিনির্মাণ আগামী দিনে কোন দিকে চলে সেটি দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। দক্ষিণপন্থী দলটি আসনের বিচারে প্রথম না হলেও রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণে  সেই যে প্রথম এবং, একশ শতাংশ সফল, তা বলাই বাহুল্য।

    ‘গ্লোবাল ক্রাইসিস’ ও পোস্ট ট্রুথ ভদ্রলোকের জন্ম

    পোস্ট ট্রুথের চলন দেখলে বোঝা যায় ‘সত্যি’ই সে আমাদের মনের অসহায়তার অক্সিজেনে জারিত। তার অন্যতম উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে একটি অবশ্যই উগ্র জাতীয়তাবাদ কে জন্ম দেওয়া এবং তাকে ধরে রাখার জন্য উপযোগী স্লোগান, চিহ্ন, গান আমজনতার অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়াও মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা, অর্থাৎ  সরকার এবং জনগণের মাঝে মানবাধিকার নিয়ম মেনে থাকবে, কিন্তু কাজ করবে না বরং তার প্রতি এক রকমের অবজ্ঞা থাকবে এই পরিবেশ তৈরি করাও তার অন্যতম কাজ। শত্রু ভয় ও দেশের নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে মানবাধিকার সামান্য লঙ্ঘন করা চলে এই চিন্তাই জনতার দরবারে আনা হয়। একইসঙ্গে দেশের সব সমস্যার জন্যে জনগণের কাছে একটা সাধারণ শত্রু তৈরি করা হয়। সেই শত্রু সচরাচর সংখ্যাগুরুর কেউ হয় না, তবে যদি কোনও সংখ্যাগুরুর ঐ দাগিয়ে দেওয়া শত্রুর প্রতি কোনও সহমর্মিতা দেখা যায়, সেইক্ষেত্রে তাকেও লিবারেল, কিংবা জঙ্গি নাম দিয়ে একই আসনে বসানো হয়। এই কাজগুলি কে পূর্ণ রূপ দেওয়ার জন্য চাই  গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ। মিডিয়ার কাজ হবে সরকারের ‘মনের কথা’ বলা।  সরকার বা গোষ্ঠী নির্মিত সত্যই কেবল প্রচার হবে। এই সকল কাজ সুচারু রূপে সম্পন্ন করতে ধর্ম আর রাষ্ট্রের মাখামাখি আবশ্যক। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সঙ্গে দেশের নিরাপত্তাকে এক করে, তার সাধারণ মানুষের মনে এক ভয়, এক অনাহুত ভবিষ্যতের ছবি সৃষ্টি করা এই জাতীয় প্রকল্পের এক অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু এই সকল বিষয় আলোচনার পরেও আমাদের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, পোস্ট ট্রুথ প্রকল্পের ‘বাজার’ এখন এতো রমরমা কেন?

    মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠন থেকে যদি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াও যায়, যে পোস্ট ট্রুথ এর মত দক্ষিণ-পন্থী প্রকল্পের বীজ আমাদের মনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে তবুও প্রশ্ন থেকে যায় why now?  আজ আমরা এই বিষয় নিয়ে এত ভাবিত কেন? মনুষ্যসমাজ তো রাতারাতি জ্ঞানগত পক্ষপাতে দুষ্ট হয়নি, কিংবা বিষয়টি এমনও নয় যে মনুষ্যসমাজ ইতঃপূর্বে কখনো সংশয়ের দোলাচলে পড়েনি। তাহলে এখন কেন?  এক কথায় এর উত্তর না থাকলেও, এটা বলা যেতেই পারে এর অন্যতম কারণ death of romanticism in politics, রাজনীতিতে রোমান্টিসিজিমের মৃত্যু, যার চূড়ান্ত রূপ সোভিয়েতের পতন, এবং একই সঙ্গে আমাদের চোখে দেখা ভদ্রলোকের কাঠামোর ইতি। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে আশির দশকের একদম শেষ থেকে একের পর এক ঘটে চলা ঘটনা, যেমন বার্লিনের প্রাচীরের পতন, তিয়েনান্মেন স্কোয়ারের বিক্ষোভের পাশাপাশি ফ্রান্সিস ফুকয়ামা লিখে ফেলেছেন The End of History। সময় যেন বলতে চাইছিল কোনও এক চূড়ান্ত পরিণতি আগত। নব্বই দশকের শুরুতেই সোভিয়েতের পতন ছিল কফিনের শেষ পেরেক।  প্রগতিশীল চিন্তার ধারক বাহকদের কাছে  এক ভয়ানক ধাক্কা। ভারতের দিকে তাকালেও দেখা যাবে নকশাল আন্দোলনের পরিণতি বেড়া ভাঙ্গার স্বপ্নের এক রকমের পরিসমাপ্তি সূচীত করে গেছে।

    তাৎপর্য পূর্ণভাবে এই ৯০ দশকের গোরার সময় দিয়েই ভারতবর্ষেও দক্ষিণ-পন্থী কার্যকলাপের সশব্দ প্রকাশ হতে থাকে। যতদিন রাজনৈতিক রোমাঞ্চ জাগ্রত ছিল, চোখে স্বপ্ন ছিল, ততদিন মনের সকল দ্বন্দ্ব দ্বিধার মাঝে জাগ্রত ছিল রোমাঞ্চর উত্তাপ।  কিন্তু সেই রোমান্টিকতার মৃত্যু আমাদের জীবনের সকল সংশয়কে একরকমের একাকীত্বর হাতে সপে দেয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রিয় মধুবন’ গল্পের সেই লাইনটি - বিপ্লবের পথ কেবলই গার্হস্থের দিকে বেঁকে যায়! বনের সন্ন্যাসী ফিরে আসে ঘরে – যেন আমাদের গ্রাস করতে চায়। যখন কোনও স্বপ্ন থেকে না তখনই নাকি স্বপ্ন দেখার সময়, কিন্তু একদিকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং একই সঙ্গে উদারীকরণের মাধ্যমে যে নতুন যাত্রা পথের সূচনা হল, সেখানে আর সংগ্রাম, প্রতিরোধ, যৌথ খামার, বেড়া ভাঙ্গার স্বপ্ন নয়, বরং আমার চারপাশে পড়েথাকা যাকিছু আছে তাকে নিয়েই ছোট পরিবার, সুখী পরিবার রচনাতেই  মন শান্তি খুঁজে নেয়।  নিজের পরিসর কে রক্ষা করার জন্য আমরা আবার সংশয় সন্দেহ পরিবৃত জীবনে প্রবেশ করি। সংশয়ের চোখে চোখ রেখে আক্রমণ নয়, বরং সেই সংশয়ের আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের আত্মরক্ষা ব্যূহ রচনা করাই এখন মুখ্য, আর আত্মরক্ষার প্রথম শর্ত সকল ভয়ের সম্ভাবনার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখা। এই নিরাপত্তাহীনতার হাত ধরেই পোস্ট ট্রুথের প্রবেশ।

    তবুও এই সকল বিষয় জানার পরে, যদি আবার নতুন করে মানসিক স্তরেও প্রতিরোধের ইচ্ছা জাগে, তবে  মিথ্যা খবরের দুনিয়ায়  একই সঙ্গে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং স্ব-তর্ক করতেও হবে। ডিজিটাইজেশনের হাত ধরে চকিতে তথ্য এক স্থান থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। সে তথ্য সঠিক ও হতে পারে বেঠিকও হতে পারে, এমনকি সেই তথ্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও হতে পারে। তাই এই সমস্যাটি মোকাবেলা করার জন্য আমাদের যেমন সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, একই সঙ্গে বুঝতে হবে ভিন্নতাই ‘সত্য’। কেবল সমাজ নয়, আমি নিজেও ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার সমাহার। আমাদের নিজেদের মধ্যেও যেমন প্রাপ্তি সুখ আছে, তেমনই অপ্রাপ্তির ছোঁয়াও রয়েছে। আমরা দিব্যি এই দুইকে নিয়ে এগিয়ে চলি। তাই  সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা  মিডিয়ার জটিলতায় পরিত্যাগ না করে, তথ্য তল্লাশের অভ্যাস বজায় রাখতে হবে।  ইকো চেম্বারের পাশে থেকেও নিজেকে ‘ইকো ফ্রেন্ডলি’ করে না তুলতে পারলে অচিরেই আমাদেরই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চেতনা  বহুমাত্রিকের বদলে নির্ধারিত একমাত্রিক রূপ পাবে, গণতন্ত্র তার ছন্দ হারাবে।  সেই কারণেই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজের আমাদের সাবধান করে বলেছেন “সচেতন নাগরিক ছাড়া গণতন্ত্র কার্যকরী হয় না” কারণ তিনি উপলব্ধি করেছেন  ডিজিটাল যুগে, এই গণতান্ত্রিক সচেতনতাই প্রশ্নের মুখে। আমাদের আদিম প্রবৃত্তি তথা জ্ঞানগত পক্ষপাতিত্বকে হাতিয়ার করে এক ‘না-বিশ্ব’গড়ে তোলার প্রকল্পকে ধাক্কা দিতে না পারি তবে  আগামী দিনের  জন্য  শক্তিশালী গণতন্ত্র কেবল অলীক স্বপ্নই থেকে যাবে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন