জাঁ জেনে সম্পর্কে জাঁ পল সার্ত্রে : মলয় রায়চৌধুরী
ফেলিক্স গুত্তারি তাঁর ‘জেনে রিগেইনড’ বইতে সার্ত্রের ‘সেইন্ট জেনে: অ্যাক্টর অ্যাণ্ড মার্টিয়ার’ ( ১৯৬৩ ), ৬৫০ পৃষ্ঠার বইটাকে বলেছেন ‘সার্ত্রের তৈরি জেনের বিরাট ও অতীব ব্যয়বহুল সমাধিস্তম্ভ’ । টাইম ম্যাগাজিন অবশ্য বলেছিল ‘এ পর্যন্ত লেখা বিস্ময়কর সমালোচনামূলক গবেষণার অন্যতম।’ বইটা সম্পর্কে জেনে বলেছেন যে তিনি সন্ত নন, অভিনেতা নন, শহিদও নন ; তিনি একজন শ্রমজীবি লেখক । সার্ত্রে বলেছেন, ‘জেনে হলেন ঈশ্বর’। লুই ফার্দিনাঁ সেলিন বলেছেন, ‘ফরাসি দেশে কেবল দুজন লেখক আছেন, জেনে এবং আমি।’
জেনেকে নিয়ে এডমাণ্ড হোয়াইটও পরে ৮০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন। সার্ত্রে যেন এইরকম চরিত্র খুঁজছিলেন যার ওপরে নিজের দর্শন চাপিয়ে তিনি নিজেকেই ব্যাখ্যা করতে পারেন। তিনি জেনেকে অস্তিত্ববাদী দার্শনিকের মোড়কে পুরেও তাঁকে বের করে এনেছেন মিথ্যাবাদী, পায়ুবিক্রেতা ও ক্রেতা, নাট্যকার, অভিনেতা, চোর, সাহিত্যিক ইত্যাদি থেকে তাঁর ব্যক্তিগত অস্তিত্ববাদী নায়ককে । বইটা এতো দীর্ঘ যে মাঝে-মাঝে বিরক্তিকর লাগলেও, থেমে থেমে চিন্তার অবসর নিতে হয় ফরাসি ‘ভদ্র, সুনীতিসম্পন্ন, বিবেচক’ সমাজ থেকে বহুকাল অন্ধকারে ছাঁটাই করা জেনে নামের এই মানুষটার অন্তরজগতের সাংঘাতিক, ভয়ানক, আতঙ্কজনক প্রবণতার তলায় চাপা পড়া লোকটাকে জানবার জন্য । সার্ত্রের চোখে জেনে একজন মৌলিক অস্তিত্ববাদী নায়ক হিসাবে প্রতিভাত হন, তার কারণ জেনে শয়তানি বা পাপ বা ইভিল করার মাধ্যমেই আবিষ্কার করতে সফল হন যে প্রকৃতপক্ষে খ্রিস্টধর্মের শয়তানি ও পাপ এবং রাষ্ট্রের চোখে অপরাধ ও ইভিল কাকে বলে । সার্ত্রের মতে, জেনে জন্মেছিলেন একটি অর্থহীন, পরিপন্হী জগতে, যা ভয়, আত্মদোষ, কলুষ, কল্মষ ও ইভিলে ঠাশা এবং এই প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়া পেতে হলে এই কাজগুলোর ভেতরেই দোল খেয়ে তার বিরোধিতা করতে হবে ।
জাঁ জেনের জীবনের চরম বিকৃতিগুলোকে জেনের তৈরি করা কিংবদন্তি থেকে আলাদা করে আসল মানুষটাকে বের করে আনার জন্য এডমাণ্ড হোয়াইট জেনের বন্ধুবান্ধব, প্রেমিকের দল, প্রকাশক এবং পরিচিতজনদের থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, এবং চিঠিপত্র, সাক্ষাৎকার, জার্নাল, পুলিশের নথিপত্র, মনোবিদদের প্রতিবেদন যাচাই করে ৮০০ পাতার বই লিখেচিলেন যা সার্ত্রের থেকে একেবারে ভিন্ন অথচ গোয়েন্দা বইয়ের মতন আকর্ষক । তিনি জেনের প্রাণচঞ্চল প্রেরণার পরস্পরবিরোধিতাকে জীবনের ঘটনা থেকেই বের করে আনতে চেয়েছেন : সত্যতা ও ভণ্ডামি, বিশ্বস্ততা ও ছিনালি, কতৃত্ব ও নতিস্বীকার, সন্মান ও বেইমানি।
ফরাসি ভাষায় সার্ত্রের ( ১৯৫২ ) বইটিতে ‘কমেদিয়েন’ শব্দটি ব্যবহৃত যা ইংরেজিতে করা হয়েছে ‘অ্যাক্টর’, মূলত ‘দি থিফস জার্নাল’-এর ওপর ভিত্তি করেই জেনেকে বিশ্লেষণ করেছেন সার্ত্রে । জেনের বইটি, সার্ত্রে বলেছেন, প্রমাণ করে যে, প্রতিভা মানুষের প্রকৃতিদত্ত গুণ নয়, তা একটা পথ যা একজন লোক মরিয়া অবস্হায় আবিষ্কার করে । সার্ত্রে তাঁর ‘দি ডেভিল অ্যাণ্ড দি গুড লর্ড ( ১৯৫১ ) নাটকে গেৎজ চরিত্রটি জেনের মানসিকতা ও নৈতিকতার বোধ থেকে আহরণ করে লিখেছিলেন । আলোচক ডেভিড হ্যালপেরিন সার্ত্রের বইটি সম্পর্কে বলেছেন যে এটি একটি একক প্রতিস্বের সূক্ষ্ম, অসাধারণ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান আর সেই সঙ্গে সমকামীদের লৈঙ্গিক অবস্হানের সামাজিক-দার্শনিক বিশ্লেষণ ।
বইটা চারটে পর্বে বিভাজিত । প্রথম হলো ‘মেটামরফোসিস’ ; দ্বিতীয় ‘ফার্স্ট কনভারশান : ইভিল’ ; তৃতীয় ‘সেকেণ্ড মেটামরফোসিস : এসথেটে’ এবং চতুর্থ ‘থার্ড মেটামরফোসিস : দি রাইটার’। প্রথম পর্বে, অনাথ ও জারজ জেনের বিভিন্ন পালক পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা ও সীমাবদ্ধ জীবনধারা চিত্রিত করা হয়েছে যার সঙ্গে জেনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না । সামাজিক ও সরকারি সংস্হাগুলোর সঙ্গে জেনের পরিচয় হয় এবং সংস্হাগুলো বালকটিকে সামাজিক সরঞ্জামে পালটে ফ্যালে । ফরাসি সরকার তার তত্বাবধায়ক জানার পর বালকটি হয়ে ওঠে পালক পরিবারদের অবাধ্য এবং সংশোধনের অযোগ্য, যার দরুন সরকার তাকে ছাপ্পা দেয় ‘অভ্যাসগত অপরাধীর’ । জেনের কৈশোর ও তারুণ্যে প্রশাসন তাকে অবিরাম পিষে ফেলতে থাকে আর তরুণটি হয়ে ওঠে ভয়প্রদর্শনকারী । সে আর একা থাকে না, তার মেটামরফোসিস হয়, সমাজের নানা অপরাধী তার বন্ধু হয়ে ওঠে এবং বুঝতে পারে যে এই অপরাধীরা তাদের অপরাধের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পিত । জেনে অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন যে আইনত, প্রশাসনিকস্তরে এবং রাষ্ট্রের রসায়ানাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তিনি নির্বাচিত প্রাণী। সার্ত্রে বলেছেন যে জেনের প্রথম চুরিগুলো জেনের অন্তরজীবনের আবহ গড়ে তুলেছিল এবং তা হলো আতঙ্কের আহ্লাদ ।
বইটির দ্বিতীয় পর্বে, সার্ত্রের দার্শনিকতার মাল হয়ে ওঠেন জেনে । সার্ত্রে ব্যাখ্যা করেন ইভিল বা শয়তানি বা পাপের দার্শনিক ও তাত্বিক জটিলতা । বইয়ের এই পর্বটা বেশ দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর । জীবনী থেকে দর্শন টেনে আনেন সার্ত্রে, বিশ্লেষণ করেন নৈতিকতা, অপরাধ, যৌনকামনা এবং অন্ধকার জগতের নানা এলাকায় জেনের মতন মানুষদের একের পর এক অবিরাম দুর্ভাগ্য ও অশান্তি । জেনে নিজে এই ইভিল সম্পর্কে কী ভাবেন, তাঁর উদ্দেশ্যই বা কি তার দার্শনিক উত্তর খুঁজতে চেয়েছেন সার্ত্রে ।
তৃতীয় পর্বে ফরাসি পাঠকদের কাছে বিস্ময়কর কিংবদন্তি হিসাবে দেখা দেন জেনে। তাঁর পাঠকেরা অবাক হয়ে গাঁটকাটা, পায়ুবিক্রেতা, চোর, স্কুল-পলাতক, গৃহ-পলাতক থেকে তাঁর লেখক সত্তার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন । সমাজের স্বীকৃতি পাবার পরও জেনে ভবঘুরে, পায়ুবেশ্যা, সমকামী, চুরি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়েছিলেন । তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন এবং আমেরিকার ‘ব্ল্যাক প্যান্হার’ ও প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে বক্তৃতা দেন ; ছবি তুলে তাইলেও মাঝখানের আঙুল তুলে ধরতেন । অবশ্য গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকেও দেখা গেছে ফোটোগ্রাফারদের সামনে মধ্যমা তুলে ধরতে । যখন সমালোচকদের কাছে তিনি একজন প্রতিভাবান লেখক ও ভাবুক হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন তখন জাঁ ককতো, সার্ত্রে প্রমুখ ফরাসি সাহিত্যিকদের উদ্যোগে যাবজ্জীবনের কারাদণ্ড থেকে মুক্তি পান ।
সার্ত্রে জেনেকে সন্ত বলেছেন তার কারণ জেনে নিজের পক্ষে যে নৈতিকতাবোধ গড়ে নিয়েছেন তা আদি-নিষ্কলুষতা ও সত্য তাড়িত এবং জেনে এই অবস্হান থেকে খ্রিস্টধর্মীর ‘নষ্ট নিষ্ঠা’ স্বীকার করছেন না । মানসিক স্হিরতা পাবার অভিপ্রায়ে তাঁর নৈতিকতাবোধ একটি দ্বিমেরু সাধনী । নিজের কাছে তিনি সৎ, কেননা নৈতিকতার সাদা-কালোকে তিনি যে কোনো ধরণের জঞ্জাল ও প্রতিপন্হী সামাজিক এঁটোকাঁটা থেকে তৈরি করে ফেলতে পারেন ; তাঁর কাছে তাই বাইবেল-পড়ুয়া গির্জা-বালক আর দক্ষ পেশাদার চোরের তফাত নেই । জেনে শয়তানি বা পাপ বা ইভিলের সততা থেকে ঝুঁকে পড়েন কালো নান্দনিকতায় ; এই মেটামরফোসিস তিনি নিজেও তখন হৃদয়ঙ্গম করেননি । তাঁর তখনও মনে হতো যে শয়তানির সূর্যালোকে থেকেও তিনি নতুন এক সূর্যালোক খুঁজে পেয়েছেন, যার নাম সৌন্দর্য । এই পর্বে সার্ত্রে শিল্প ও নান্দনিক নির্ণায়ক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জেনের আত্মআবিষ্কারকে গুরুত্ব দিয়েছেন ।
চতুর্থ পর্বে, সার্ত্রে যখন জেনের তৃতীয় মেটামরফোসিসের কথা বলছেন তখন জেনে একজন প্রতিভাবান লেখক । সার্ত্রে কিন্তু বলছেন যে জেনের উপন্যাসগুলো মেকি এবং তার গদ্যও মেকি। কিন্তু মেকি হোক বা নাহোক, তাদের উৎস হলো জ্ঞাপন করার সদিচ্ছা । জেনে কায়দা করে তাঁর পাঠকদের ব্যবহার করেছেন, তিনি তাদের ব্যবহার করেছেন নিজের বিষয়ে নিজের সঙ্গে কথোপকথনের উদ্দেশে । সার্ত্রে বলেছেন যে এই বিশেষত্ব পাঠকদের দূরে সরিয়ে দিতে পারে । কোনো আলোচকই অবশ্য জেনেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাননি ; পাঠকরা বরং অবাক হয়ে প্রশংসা করেছে জেনের এই মেটামরফোসিসকে ।
১৯৬৪ সালে ‘প্লেবয়’ পত্রিকায় ম্যাডেলিন গোবিলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সার্ত্রে সম্পর্কে জেনে বলেছিলেন, “জগতে যখন সবাই শ্রদ্ধেয় বেশ্যা হতে চাইছে, তখন এরকম একজনের দেখা পেতে ভালো লাগে যে জানে যে সে একটু-আধটু ছেনাল কিন্তু শ্রদ্ধেয় হতে চায় না । সার্ত্রের বইটা সম্পর্কে ওই একই সাক্ষাৎকারে জেনে বলেছেন, যদিও তিনি পাণ্ডুলিপি পড়েছিলেন কিন্তু প্রকাশিত হবার পর বইটা তাঁকে নিদারুণ বিরক্তিতে আক্রান্ত করেছিল, কেননা অন্য একজন লোক তাঁকে উলঙ্গ করে দিয়েছিল ; যখন তিনি নিজেকে নগ্ন করেন তখন তিনি প্রয়াস করেন যাতে তাঁর ক্ষতি না হয় আর তা করার জন্য শব্দ, মনোভাব, বাদবিচার, ম্যাজিক ইত্যাদির মাধ্যমে ছদ্মবেশ ধরেন । পড়ে তাঁর তক্ষুনি মনে হয়েছিল বইটা পুড়িয়ে ফেলবেন ; বইটার চাপে কিছুদিনের জন্য তাঁর লেখালিখি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ; এক ধরণের শূন্যতা ও মানসিক অপকর্ষ সৃষ্টি করেছিল । তিনি যান্ত্রিকের মতন বহু উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতেন, পর্নোগ্রাফিক বই লিখতে পারতেন, কিন্তু সার্ত্রের বই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ওই শূন্যতাবোধ কাটাবার জন্য তিনি নাটক লেখা আরম্ভ করেন। ”
পক্ষান্তরে বইতে সার্ত্রে জিগ্যেস করেছেন, “আমি কি জেনের প্রতি যথেষ্ট ন্যায্য থাকতে পেরেছি ?” সার্ত্রের দরুণ কিন্তু জেনের প্রচার বেড়ে যায় এবং তিনি ধনী হয়ে ওঠেন, প্রতিসংস্কৃতির প্রতিনিধি । যে সমাজ একসময়ে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাকে বিদ্রূপ করার সুযোগ কখনও ছাড়েননি । সার্ত্রে বলেছেন, জেনে আমাদের দিকে আয়না মেলে ধরেন ; আমাদের উচিত তাতে নিজেদের আসল চেহারা দেখা ।
জেনের বইগুলো আর সার্ত্রের বইটির আয়নায় নিজেদের দেখে পাঠকের নিজস্ব প্রতিভাস ও পরিজ্ঞান ঘটার কথা । সুসান সোনটাগ তাঁর ‘এগেইনস্ট ইনটারপ্রিটেশান অ্যাণ্ড আদার এসেজ’ গ্রণ্হে সার্ত্রের বইটিকে বলেছেন, “ক্যানসার, হাস্যকর বাগাড়ম্বরে ঠাশা, এর আলোকিত ধারণার মালপত্রকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় চটচটে গাম্ভীর্য আর বীভৎস পুনরাবৃত্তির স্বরভঙ্গী।” প্রকাশক গালিমার সার্ত্রেকে বলেছিল জেনের সাহিত্য সংগ্রহের একটা ভূমিকা লিখে দিতে আর সেটাই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ালো ৬০০ পাতার দানব । সার্ত্রের বইটা জীবনী নয়, সাহিত্য সমালোচনাও নয় । বইটা তাঁর অস্তিত্ববাদ বোঝাবার ময়দান । সোনটাগ বলেছেন, বই লিখতে বসে সার্ত্রে তাঁর বিষয় পেয়ে গেলেন, নিজে তো ডুবলেনই, জেনেকেও ডোবালেন । সোনটাগ বলেছেন যে পাঠক যদি সার্ত্রের দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হন, তাহলে বইটার পাঠ সহায়ক হবে, অন্তত ভাসা-ভাসাভাবে। সার্ত্রেকে সঙ্গে নিয়ে পাঠক জেনে সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল মেটাতে পারবেন । তবে সার্ত্রে এতো বেশি জেনে সম্পর্কে কথা বলেছেন যে শেষ পর্যন্ত জেনে আর জেনে থাকেন না ।
এডমাণ্ড হোয়াইট ১৯৯৩ সালে নথিপত্র দেখে গবেষণার পর জেনের যে জীবনী লিখেছিলেন তাতে বলেছেন যে শৈশব-তারুণ্যের যে ঘটনাগুলো জেনে লিখেছেন তার বেশির ভাগই কাল্পনিক ও অসত্য এবং তা জেনের ব্যক্তিগত কিংবদন্তি বানাবার দক্ষতা ; সার্ত্রে এগুলোকে যাচাই না করে জেনের বানানো গল্পের ওপর নির্ভর করে বইটা খাড়া করেছিলেন । সার্ত্রে ব্যক্তিগতভাবে জেনেকে জানতেন, এবং বইতে লিখেওছেন যে জেনে ইতিহাসকে তোয়াক্কা করে না আর কিংবদন্তি দিয়ে ফাঁকগুলো ভরে দেবে । আসলে ওই কিংবদন্তি সার্ত্রের জন্য জরুরি ছিল তাঁর বইয়ের বিষয়কে কেন্দ্র করে যাতে নিজস্ব নৈতিক আর দার্শনিক তত্বকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন ।
তাঁর গদ্যের মারপ্যাঁচ দিয়ে জেনে নিজেকে ল্যাঠামাছের মতন পিচ্ছিল করে তুলেছিলেন ; গড়ে তুলেছিলেন ছায়াময় একজন “আমি”, যার ঝলক তিনি পাঠকদের দিতে থাকেন । সার্ত্রে এই ঝলকটাকে বইয়ের পাতায় গিঁথে দিয়ে অস্তিত্ববাদী প্রপঞ্চবিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেবার সুযোগ ছাড়েননি । মূলাগত স্বাধীনতাবোধ এবং নির্নিমিত্ততা হলো তাঁর তর্কের বনেদ ; ফলে আত্ম-প্রতিস্ব গড়ার জন্য জেনের বানানো কাহিনি তাঁর কাজে লেগেছে । সার্ত্রে অবশ্য বলেছেন যে জেনের গদ্য মেকি বলে জেনে একজন স্বজ্ঞাত লেখকের সম্পূর্ণ বিপরীত, তাঁর নানন্দনিকতায় সৌন্দর্যকে দখল করা প্রচেষ্টা রয়েছে কিন্তু তাঁর আকাঙ্কা নেই সৌন্দর্যের প্রতি ; মেকি গদ্যের ফলে জেনে অন্ধকার জগতের মানুষের মতন শিল্পী হিসাবেও ফন্দিবাজ, ধড়িবাজ ; লেখায় বাগ্মীতা দেখাবার চেষ্টা বেশি এবং সন্ত্রাসের যথেষ্ট অভাব রয়েছে ।
‘প্লেবয়’ পত্রিকার ১৯৬৪ সালের সাক্ষাৎকারে ম্যাডেলিন গোবিল জেনেকে জিগ্যেস করেছিলেন, “আপনি চোর, বিশ্বাসঘাতক আর সমকামী হলেন কেন ?” উত্তরে জেনে বলেছিলেন, “আমি নিজে নির্ণয় নিইনি, আমি কোনও নির্ণয় নিইনি । কিন্তু কিছু তথ্যকে স্বীকার করতে হবে। আমি চুরি করতে আরম্ভ করললুম কেননা আমি ক্ষুধার্ত ছিলুম । সমকামিতার ক্ষেত্রে আমার কোনো ধারণা নেই। সমকামিতা আমার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, আমার চোখের রঙের মতন, আমার পায়ের সংখ্যার মতন। আকর্ষণটা সম্পর্কে অবগতির পর আমি নিজের সমকামিতাকে বেছে নিলাম, সার্ত্রের মতামত যা স্পষ্ট করেছে ।”
জেনের সমকামিতা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সার্ত্রে যা বলেছেন তা অনেকটা পরস্পরবিরোধী। সমকামিতার রহস্য, সার্ত্রে বলেছেন, জেনে তাকে অপরাধের গুরুত্ব দিয়েছেন, তা প্রকৃতিবিরোধী কেবল নয়, তা কাল্পনিকও । সমকামী মানুষ একজন অলস স্বপ্নদর্শী নয়, সে একজন প্রতারক, সে একজন ভণ্ড । জেনে বেছে নিয়েছেন নারীর ভূমিকা, আর তা করেছেন কেননা তিনি একজ রাজকুমার সাজতে চান, নকল রাজকুমার ।
সার্ত্রে সমকামবিরোধী ছিলেন না । সমকামবিরোধী হতে হলে ব্যাপারটাকে কল্পনার চেয়েও বেশি কিছু মনে করতে হবে । তাছাড়া, স্বাধীনতাবোধের যে দ্বান্দ্বিকতা সার্ত্রের দর্শন স্বীকার করে তার ভিত্তি হলো হেগেলের মালিক-গোলামের দ্বান্দ্বিকতা । সার্ত্রের আত্ম-প্রতিস্বের দর্শন ‘অপর’ সম্পর্কিত দর্শন থেকে আলাদা ও জটিল । ফেলিক্স গুত্তারি বলেছেন যে সার্ত্রের এই বক্তব্য রক্ষণশীল ; সার্ত্রের সমকামের জগতে পুরুষ নারী হিসাবে নিজেকে জাহির করে । সার্ত্রের মতে নারীরা পরস্পরের প্রতিবিম্ব, তারা পরস্পরকে স্বীকার করে না । নারীবাদী লেখিকা জুডিথ বাটলার এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে জেনের গদ্য, যা প্রধানত আত্মজীবনী ও ফিকশানের মিশ্রণ, তা হলে বহুরুপীর ছদ্মবেশী ভাষা, পুরুষের লিঙ্গবাদী লালিকা এবং নিটোল প্রতিস্ব গড়ে তোলার বদলে উল্টোবাঁক নিয়ে অস্হিতিশীল করার প্রয়াস । তাঁর ‘কুইয়ার রাইটিঙ : হোমোইরটিসিজম ইন জেনেজ ফিকশান’ বইতে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন এলিজাবেথ স্টিফেন্স । তিনি বলেছেন, জেনের উপন্যাসগুলোতে গদ্যের ব্যবহার করা হয়েছে সংহতিনাশ ও পরাভূত করার কার্যপদ্ধতি হিসাবে, যে পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রথাগত ন্যারেটিভ আদলকে জেনে পালটে দিয়েছেন তাঁর উদ্ভট চরিত্রদের বিকৃত প্রভাব বর্ণনা করার খাতিরে । জেনের গদ্যে জেনে লোকটাকে সর্বত্র দেখা যায় কিন্তু লেখক জেনে মনে হয় মৃত, মাঝেমধ্যে ভুত হয়ে শব্দের ভেতরে উঁকি মারে । এই কারণেই জেনের বইগুলো পরস্পরবিরোধী ভাবনার পাঠকদের টাকে ; কারোর কাছে তিনি বৈপ্লবিক আবার কারোর কাছে প্রতিক্রিয়াশীল, সমকামিপ্রিয় এবং সমকামিভীত, পতিত এবং ফুলবাবু।
সার্ত্রের স্তরের একজন লেখক-দার্শনিক যে পরিশ্রম করেছেন তাঁর সময়ের একজন অবহেলিত লেখকের জন্য তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় । বড়ো খ্যাতিমান লেখকরা সাধারণত তরুণ ও কম খ্যাতির লেখকদের নিয়ে লেখেন না । আর এই বই তো একজন অপরাধীর বই ও ভাবনাচিন্তা নিয়ে । সার্ত্রে বলেছেন, জেনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন, কেননা জেনে চান তাঁকে ভালোবাসা হোক ; জেনের অসাধারণ বইগুলো নিজেরাই নিজেদের খণ্ডন করে । পুরুষালী সৌন্দর্যের তরুণদের সঙ্গে ভালোবাসাবাসি নিয়ে জেনের রয়েছে ফেটিশ এবং একধরণের ত্রাস ; তিনি বুঝে উঠতে পারেন না তাদের নিয়ে কি করা দরকার । জেনের বইগুলো পড়ার পর কিংবা পাশাপাশি তাঁর বই আর সার্ত্রের বই পড়লে পাঠক এই দুজনকেই গভীরভাবে জানতে পারবেন।
জাঁ জেনে নিঃসন্দেহে একটি চিত্তাকর্ষক জীবন কাটিয়েছিলেন, ককতো, জিয়াকোমেত্তি, গিন্সবার্গ, ইয়াসের আরাফাত, সার্ত্রের মতন বন্ধুবান্ধব, ব্ল্যাক প্যান্হার আর প্যালেস্টিনিয়দের প্রতি সমর্থন, ভীষণভাবে দেশাত্মবোধশূন্য, প্রচণ্ড প্রতিষ্ঠানবিরোধী, বারো বছর বয়সে স্কুল ছাড়া সত্বেও এবং সংশোধনাগার ও কারাগারে যৌবন কাটিয়েও, অবিশ্বাস্যরূপে শিক্ষিত। ১৯৪৩ সালে লেখা জেনের প্রথম বই ‘আওয়ার লেডি অব দি ফআওয়ার্স’কে অসাধারণ ফিকশান বলেছেন বিভিন্ন আলোচক ; কারাগার কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রথম পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ফেলা সত্বেও জেনে আবার স্মৃতি থেকে লিখতে পেরেছিলেন একই বই, কারাগারে বসে, তার কারণ ‘আওয়ার লেডি অব দি ফ্লাওয়ার্স’ প্রধানত জেনের অতীত আর তখনকার বর্তমানের অতিকথামূলক সৃষ্টি । স্মৃতির সঙ্গে তথ্য, কল্পনা, অযৌক্তিক স্বপ্ন, ভাবনাচিন্তা, অনুমান, দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি, স্নেহপূর্ণ অনুভূতি, সহমর্মিতা মিশিয়ে তিনি তাঁর বিচ্ছিন্নতাকে যাতে সহনযোগ্য করে তুলতে পারেন তাই জেনে নিজের গড়া জগতে জগতে প্রবেশ করেছেন বইটার মাধ্যমে এবং এই জগতটিতে অন্য কেউই হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন । এখান থেকেই তাঁর জগতের বিস্তারের আরম্ভ ।
১৯৭০ সাল থেকে জেনে দু’বছর জর্ডনে প্যালেস্টিনীয়দের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে কাটিয়েছিলেন, এবং তখনকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন ‘প্রিজনার অব লাভ’ । তিনি নিজেই একজন পরিত্যক্ত ব্রাত্য মানুষ, স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষিত হয়েছিলেন বাস্তুচ্যূত জনগণের প্রতি, এমনই এক আকর্ষণ যা তাঁর কাছে জটিল আর কালসহ হয়ে দেখা দিয়েছিল । ১৯৮৬ সালে যখন তিনি বইটি লিখছেন তখন তাঁর পরিচিতজনদের অনেকে মারা গেছেন, জেনে নিজেও মৃত্যুর কাছাকাছি, কিন্তু এই বইতে অন্ধকারজগতের লোকটি নেই ; যিনি আছেন তিনি ইহুদি-বিরোধী একজন লেখক, কেবল প্যালেস্টিনীয় উথ্থানকে সমর্থন করছেন না, তিনি বিপ্লবকে সমর্থন করছেন, সরল গদ্যে, খোলাখুলি রাজনৈতিক মতামত ব্যক্ত করছেন, বিশ্লেষণ করছেন দৃশ্যাবলীর রাজনীতি এবং আত্মপরিচয়ের সন্মোহিনী ও অননুগত বৈশিষ্ট্য । তাঁর এই শেষ বইটি, বর্তমান উপদ্রুত পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তাক্ত দ্রোহ, নিপীড়ন ও সন্ত্রাসবেষ্টিত বধ্যভূমির উদ্দেশে একটি কাব্যিক ও দার্শনিক যাত্রা ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।