সোনালী মিত্র : মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতামলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে প্রজ্ঞা ও আত্মসংযমবোধের গভীরতা, অভিজ্ঞতা ও উন্মেষ দরকার, তা হয়তো আমার নেই। ষাট দশকের বিবর্তিত কবিতা-ধারার পুরোধা যিনি,তাঁর প্রেমের কবিতাও যে স্বতন্ত্র এবং পাঠকের আত্মস্থগ্রন্থিকে অন্য রকমের স্বাদ দেবে, আজকে আর বলার প্রয়োজন আছে কি! বিশ শতকের ষাট দশকের সেই চিরযুবক মলয় রায়চৌধুরী একুশ শতকের দ্বিতীয় অধ্যায় জুড়েও যে প্রেম ও কবিতা-প্রেমিকা নিয়ে রাজত্ব করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ও একান্ত ব্যক্তিগত ভঙ্গিমায় তিনি যা লেখেন, তাতে সনাতন চিন্তাধারার ধ্যানধারণা ভেঙে যায়, গুঁড়িয়ে যায় শালীন – অশালীন গণ্ডী। তিনি অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই হয়তো বলেন, হয়তো একটু চিৎকার করেই বলেন, কিছু কথা হয়তো চিৎকার করেই বলতে হয়!
আসলে সত্যের সামনে একজন ঋষি, একজন কবি ও একজন ঈশ্বর সমান। সত্য যেহেতু সর্বদা সত্য এবং তার গ্রহণযোগ্যতা বাস্তবধর্মী, তাই সাধারণ মানুষ সবসময় সেই সত্যের সম্মুখীন হতে সাহস পায় না। দ্বিধাযুক্ত মানুষ মানিয়ে চলতে চলতে এক সময় থেমে যায়। মলয় এই ব্যাপারে আপোষহীন। নিজের রহস্যময় অভিজ্ঞতা ও কবিতা-ভাবনাকে শব্দানুভাবের মধ্যে দিয়ে প্রকাশের ব্যাপারে তিনি দ্বিধাহীন।
আটপৌরে সামাজিক মানুষের চিন্তাভাবনার স্থিরতা নেই, নির্দিষ্ট কোনও দিশাও নেই। আজকে যে সম্পদ ডাস্টবিনে প’ড়ে আছে, আগামীদিনে হয়তো সেটাই শোবার ঘরে শোভা বৃদ্ধি করবে। আত্মবিস্মৃতির মানুষ খুব বেশিদিন এক অবস্থানে থাকতে পারে না। তাই মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা বর্তমানে কিছু-কিছু পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও একদিন যে হবে না, এমন জোর করে বলার মানুষটিও কি আছে? এখন ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি বারংবার প্রকাশিত হয়, এবং বলার প্রয়োজন হয় না যে সেটি কে কবে রচনা করেছিলেন।
আমার সমকালীন সহকর্মী কবিদের নিয়ে লেখা মলয়ের প্রেমের কবিতা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব যখন এসেছিল, একটু ভয়ই পেয়েছিলাম! (অবশ্য শুধু সমকালীন কবিদের নিয়েই নয়, নামহীন কল্প-প্রেমিকাদের নিয়েও প্রেমের কবিতা লিখেছেন কবি ; হয়তো তাঁরা তাঁর জীবনে কখনও অনুপ্রবেশ করেছিলেন, আমরা জানি না, তাঁর গোপন জীবনের প্রতিটি ঘটনা জানা সম্ভবও নয়। তাই, প্রেম এখানে অনির্বাণ আগুন, শুধু পোড়ায় না,দগ্ধ হতে হতে শুদ্ধও করে।) কারণ, ওনার প্রেমের কবিতা নিয়ে কিছু বলতে চাওয়া মানে, নারী হিসাবে, পাঠিকা হিসাবে, নিজেকে ভেঙে আয়নার সামনে দাঁড়ানো। এই একাকী দাঁড়ানোর মধ্যে নগ্নতা আছে, আছে চোখকে অন্তরের মধ্যে স্থাপন করার প্রস্তাবনা। সমকালীন কবিদের নিয়ে লেখা তাঁর নিরীক্ষামূলক ( হয়তো পোস্টমডার্ন আঙ্গিকে রচিত ) প্রেমের কবিতার মধ্যে ধ্রুপদ আত্মসমর্পণ আছে, কিন্তু সেই আত্মসমর্পণে দুঃখ নেই, সারস ঠোঁটের মতো বীক্ষণের গভীরতা আছে। এই গভীরতায় মধ্যে ডুবে যেতে পারলে কবিতা সোনার খনিতে পরিণত হয়ে ওঠে, পাঠক হয়ে ওঠে সোনার কারিগর।
এখানে আলোচ্য আমার পঠিত প্রেমের কবিতাগুলি প্রধানত এই সময়ের লেখা কবিতা। সত্তর উত্তীর্ণ কবির প্রেম ও তৃষ্ণা কবিতার উপত্যকা জুড়ে ঘন সবুজ পাইনের মতো ঋজু ও স্বতন্ত্র হয়ে বিরাজ করছে। অমায়িক বাতাসে শিরশিরানির আ্হ্বান, আহ্লাদী ধানের গুচ্ছের মতো ঢলে পড়ছে এ-ওর গায়ে। ‘তানিয়া চক্রবর্তীর জন্য প্রেমের কবিতা’ কবিতাটা নিয়েই প্রথমে দেখা যাক। প্রেম যেন এখানে ভূমি, সেই ভূমি মরুভূমিই হোক বা সমতলের দোয়াস ভূমি হোক! সমস্ত ভূমিই আসলে মা! প্রতিটা মায়ের মধ্যেই আছে সন্তান উৎপাদনের সেই প্রভূত সম্ভাবনা। সেই উৎপাদন সম্ভাবনায় তো ভূমিকে মায়ের ভূমিকা দিয়েছে। কবিতার শুরুতেই সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন কবি –
”কী নেই তোর? মরুভূমির ওপরে আকাশে পাখিদের তরল জ্যামিতি
প্রতিবার — বিপদের ঝুঁকি — সম্ভাবনা — বিরোধ — সমাক্ষরেখা —
আমি তো লাল-ল্যাঙোট সাধু, আমি বাস্তব, তুই বাস্তবিকা ”
সত্যিই তো, কী নেই তোর! কী নেই- এর মধ্যেই রয়েছে সবকিছু। একটু খুঁজে দেখলে যেকোনও বস্তুর মধ্যেই প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তাই ‘কী নেই তোর’ এর মধ্যেও কবি খুঁজে পেয়েছেন সেই শাশ্বত প্রেমের বৈদিক অঙ্গীকার। এই কবিতার মধ্যে চিরকালীন যুবা কবি স্বপ্ন ও সাধের সেই সেতুটিকে খুঁজতে চেয়েছেন, যে সেতু দিয়ে আফ্রোদিতি ও সরস্বতীর নিত্য চলাচল। যে সেতু দিয়ে উপনিষদের ঋষিপুত্র পালিত গাভীর মুখে সবুজ ঘাস তুলে ধরবার জন্য ছুটে চলেন বছরের পর বছর! এই চাওয়ার মধ্যে পরাজয়ের ভীতি নেই, নেই আত্মগরিমা হারানোর ভয়! মহাভারতের সেই মৎস্যগন্ধা তরুণীটির কথা মনে পড়ে।
”টের পাই কালো বিশ্ববীক্ষায় আমার নামের স্থায়িত্ব নেই
আমি তো সাধু-প্রেমিক তোর, পৃথিবীর নাম দিসনি কেন?”
এই লাইনের মধ্যে যখন দেখি ব্যক্তিগত চাওয়াগুলি মহাবিশ্বের মধ্যে বিলীন ক’রে কবি সাধুর ভূমিকায় নতজানু দাঁড়িয়েছেন প্রেমের সামনে! এই প্রেম যেন সাধনা! প্রত্যাশাবিহীন এই সাধনার মধ্যে কবির অন্তর প্রেমের কাছে সমর্পিত ক’রে শূন্য হাতে দাঁড়িয়েছেন মহা আনন্দের দিকে। যেন তাঁর নেওয়ার কিছু নেই, যেন তাঁর প্রত্যাশা পূরণের চাপ নেই। শুধু সেই অনাদি প্রেমের নৌকায় মহাবিশ্বে ভেসে বেড়ান আছে।
বোধ এবং বোধি একাত্ম হতে পারলেই একটা সময়ের পরে প্রেম ও পূজা একাকার হয়ে যায়! যদিও মলয় যাঁদের নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছেন, তাঁরাও কেউ কেউ কবি। এই সময়ে নিজের ঢাক নিজে বাজানোর বাজারে প্রত্যেকেই যখন আত্মকে বলিদান দিয়ে নাম-প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত, তখনই কবি-মলয় এই কবিদের যাপনকেও তাঁর ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ”সোনালী মিত্র’র জন্য প্রেমের কবিতা” পড়লে কিছু লাইনে এসে চোখ আটকে যায়।
”সোনালী প্রেমিকা! তুইই বুঝিয়েছিলিস : হুদোহুদো বই লিখে
বিদ্বানের নাকফোলা সাজপোশাক খুলে দেখাও তো দিকি
কালো জিভ কালো শ্লেষ্মা কালো বীর্য কালো হাততালি”
উন্নাসিক সময়ের মানুষের প্রতি কবির শ্লেষ ঝ’রে পড়েছে ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে। নিজের নবরসের অলঙ্কারগুলিকে বলছেন কালো। তিনি কি শ্রীকৃষ্ণ? তিনি কি ওথেলো? কাউকে ভালোবাসা মানে তো শুধু তাকে ভালোবাসা নয়, তার দর্শন, তার নৈতিক বিস্তারকে ভালোবাসা। কাউকে ভালোবাসা মানে তার সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলিকে আত্মস্থ ক’রে মনের মহিমা দিয়ে তাকে স্পর্শ করা। বোধের বাইরে থেকে অন্ধের মতো কাউকে ভালোবাসার চেয়ে, তার সৃষ্টির প্রতি সম্মানিত থেকে তাকে সমর্থনের মধ্যে দিয়েও যে ভালোবাসার জন্ম হয়, মলয়ের কবিতায় সেই মগ্নচৈতন্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
আত্মসচেতন কবি স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে যে প্রেমকে ধরতে চেয়েছেন, রক্তমাংসের প্রেমের মধ্যে সেই প্রেম হয়তো-বা নেই! সাধারণভাবে প্রেমের যে আবেগ আমরা অন্যান্য প্রেমের কবিতায় এতকাল দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এই প্রেমের কবিতার মধ্যে সেই আবেগ আছে, কিন্তু সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো! পাঠক সেই লাভাস্রোতের সন্মুখীন হবার আকাঙ্খায় নিজেকে প্রস্তুত রাখতে বাধ্য। প্রকৃত অনুভবের কোনও পাঠক সোনারকাঠি ছুঁইয়ে সেই আগ্নেয়গিরির ঘুম ভাঙালেই যেন জেগে উঠবে সংবেদনের লাভাস্রোত, তারপরে মনকে ভস্ম করে দেবে।
চিরাচরিত ঔৎসুক্যের বাইরে যে আকাঙ্খা বিরাজ করে, তার খোঁজ পায় না সাধারণ মানুষেরা। আকাঙ্ক্ষা হল পাকা ও মিষ্টি ফলের মতো। যে ফলের দিকে চোখ ও ক্ষুধা হাপিত্যেশ করে ব’সে থাকে। আকাঙ্ক্ষাকে দমন না করতে পারলে আগাছার মতো বৃদ্ধি পেতে পেতে প্রকৃত ফসলকে নষ্ট করে দেয়। মলয় তাঁর প্রেমের কবিতায় এই আকাঙ্ক্ষাকে নির্মূল করেননি, কিন্তু বাড়তেও দেননি প্রকৃত পরিচর্যার মধ্যে দিয়ে। তাই অতিরিক্ত আবেগের লাগামহীন ঘোড়া পেরিয়ে যায়নি রেসকোর্স ময়দান, অন্যের আস্তানায় ঢুকে চুরি করেও খায়নি খুদকুঁড়ো। তাই তো ”ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়-এর জন্য প্রেমের কবিতা’ য় যখন কবি লেখেন –
”অসহ্য সুন্দরী, আমার নিজের আলো ছিল না
তোর আলো চুরি করে অন্ধকারে তোরই ছায়া হয়ে থাকি
তোর আর তোর বরের নাঝে শ্বাসের ইনফ্যাচুয়েশানে
অসহ্য সুন্দরী, বেহালার কোন তারে তোর জ্বর, তা জানিস?”
আসলে ভালোবাসার মধ্যে থাকাটাই জরুরি! কীভাবে আছি সেটা বড় কথা নয়। আছি, ছিলাম, এটাই জরুরি! এককেন্দ্রিক ভালোবাসার মধ্যে যে জগত আছে, সেই জগতের অধিপতি একবার হতে পারলে না-পাওয়ার ব্যর্থতা আর জড়িয়ে ধরতে পারে না। ভালোবাসা প্রধানত নিজের রক্তের গতিকে সচল ও ঠিক রাখার হাতিয়ার! আমি তোমাকে ভালবাসছি মানে নিজের অস্তিত্বকে সতেজ রাখছি। প্রতিটি ভালোবাসায় মনে হয় আগে নিজেকে ভালো রাখার সেই বর্ম, যে বর্ম পরেছিলেন কর্ণ। ভালোবাসা সেই বর্মের কাজ করে, যে বর্ম রক্ষা করে ব্যক্তিগত দুঃখ, শোক, গ্লানি, ক্ষোভ, অসহায়তা থেকে। তাই মলয়ের প্রেমের কবিতায় দেখা যায় প্রেমিকা যেই হন না কেন, তাঁর সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, সেটা প্রধান নয়। স্বামী, পুত্র, সংসার রইলই বা সেই প্রেমিকার, তাকে কবির কিছুই এসে যায় না ; তিনি তো শ্রীকৃষ্ণের মতন প্রেমে ও কুরুক্ষেত্রে সমান দরদি। তিনি তো প্রেমিকার আলোয় নিজেকে বিকশিত করতে চাইছেন। আলোকে তো আর বন্দি করে রাখা যায় না, ফাঁকফোকর গ’লে ঠিক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে আসে। কবি মুখগহ্বরের বিশ্বরূপ-দেখানো আলোর বন্যায় নিজেকে ও সবাইকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছেন, হয়েওছেন উদ্ভাসিত।
মলয় রায়চৌধুরী কবি-প্রেমিকের বয়সকে বেঁধে রেখেছেন সুনির্দিষ্ট একটা বয়সের মধ্যে। কিংবা কবি-প্রেমিকের বয়স বলেও কিছু হয় না, যেমন হয়নি রবীন্দ্রনাথের, জীবনানন্দের, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। বয়স একটা সংখ্যা ছাড়া যেন আর কিছু নয়। বয়স আমাদের মরতে শেখায়, কিন্তু ভালোবাসা শেখায় জীবনকে উপভোগ করতে! আয়ু একটা শ্বাসের নাম, শ্বাস ফুরলে আয়ু ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ফুরিয়ে যাওয়ার আগে কি ফুরিয়ে যাওয়া মানায়! ভালোবাসা বাদ দিয়ে পৃথিবীতে এসে মানুষ যেটুকু অর্জন করেছে তা হল, হিংসা, দ্বেষ, লোভ, ও ক্ষয়। দেহের সঙ্গে এইসব কিছুই যাবে না জেনেও মানুষ ক্রমশ ভালোবাসা থেকে দূরে যত সরেছে, তত বেশি করে জড়িয়ে ধরেছে এইসব রিপু-জনিত ক্ষয়! তাই মলয় রায়চৌধুরী সজ্ঞানেই, শার্ল বোদলেয়ার, পাবলো নেরুদা, এমিলি ডিকিনসন, জন কিটস, মায়া অ্যাঞ্জেলু, সিলভিয়া প্লাথ, টমাস হার্ডি প্রমুখ ইউরোপীয় ভাষার কবি-প্রেমিকদের মতো একইভাবে ভালোবাসার মধ্যে প্রবেশ করেছেন, আর এই ভালোবাসা চক্রব্যূহ নয়। এই ভালোবাসার মধ্যে প্রতিদিন পাখি জন্মায়, পাখি সভ্যতার মধ্যে দিয়ে কবি এগিয়ে যান চিরকালীন সেই প্রেমসত্যর দিকে। তাই তো কবি ”অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর জন্য প্রেমের কবিতা”য় উচ্চারণ করতে পারেন –
”মনে থাকে যেন, রাজি হয়েছিস তুই, হাত ধরে নিয়ে যাবি নরকের খাদে
রাবণের, কর্ণের, ভীষ্মের, দুর্যোধনের আর আমার জ্যান্ত করোটি
হাজার বছর ধরে পুড়ছে অক্ষরে, বাক্যে, ব্যকরণে, বিদ্যার ঘৃণায়
মনে থাকে যেন, শর্ত দিয়েছিস, আমার সবকটা কালো চুল বেছে দিবি”
এই গন্তব্যর শেষ নেই। এই এগিয়ে চলার মধ্যেই আছে জীবনের পূর্ণতা। আজকের দিনটা ভালো করে যদি বাঁচা যায়, আগামী দিনগুলি গোলাপের মতো ফুটে ওঠে। কবি এই উন্মাদ প্রেমের মধ্যে দিয়ে বাস্তব ও অধিবাস্তবের সেই নীল সীমানায় পৌঁছতে চান যেন, যেখানে জঁ আর্তুর র্যাঁবো যেতে চেয়েছিলেন। সেখানের কোন পাহাড়ি ঝর্নার জলে একবার দেহমন ডুবিয়ে তিনি চাক্ষুষ করতে চান মায়াপ্রেমের অলৌকিক সেই প্রত্যয়।
এতক্ষণ সমকালীন কবিদের নিয়ে লেখা প্রেমের কবিতা নিয়ে কিছু কথা বলেছি। এবার যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই, ফেলে আসা দিনে প্রেম কীভাবে এসেছিল কবির জীবনে দেখা যাক। ১৩৯২ সালে প্রকাশিত ‘ বাজারিণী’ কবিতাটা নিয়ে দেখা যাক, যেখানে কবি লিখেছেন –
”ত্রিশ বছরের পর এলে তুমি। তোমার আদুরে ভাষা পালটে গিয়েছে
বারবার। জানি তুমি শুভ্রা রায় নও। ওরকমভাবে একঠায়ে
সারাদিন মাথানিচু করে বসে থাকো। আমার চুলেতে পাক
ধরে গেছে। শেখাও তোমার ভাষা এইবার। দেখি কীরকম
ঠোঁট নড়ে। না্ভি খিল-খিল কেঁপে হেসে কুটি হয়। যুবকেরা
ঘিরে থাকে বহুক্ষণ তোমায় আড়াল করে। কিসের কথা যে এতো হয়
কিছুই বুঝি না। অন্তত কুড়ি বছরের ছোট হবে তুমি।”
”তুমি শুভ্রা রায় নও” তো কে তুমি? শুভ্রা রায় যদি নাই হয় কাকে খুঁজছেন কবি? এই পর্বের প্রেমের কবিতাগুলি অনেক বেশি রক্তমাংসের! অনেক অভিজ্ঞতার আঘাত ও রক্তপাতের উত্থান-পতনের সঙ্গী। ত্রিশ বছর পরে কবি কোন পুরনো শুভ্রা রায়কে খুঁজে পাননি, পেয়েছেন আজকের শুভ্রা রায়কে, যে শুভ্রা রায় অন্তত কুড়ি বছরের ছোট। মলয় তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন তাঁর চেয়ে প্রায় দুই দশক ছোটো মমতা অবস্হী নামে এক তরুণীর কথা, যিনি তাঁকে বিবাহিত জেনেও বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, এবং তরুণীটি তাঁর স্ত্রীকেও জানিয়েছিলেন যে তিনি মলয় রায়চৌধুরীকে বিয়ে করতে চান ; তার অন্যথা হলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। সেই তরুণী শেষ পর্যন্ত টয়লেটের অ্যাসিড পান করে আত্মহত্যা করেন। মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতাগুলিতে সেই ক্ষত ও হাহাকার লুকিয়ে থাকে।
প্রেম হল ঋতুফসল! ঋতুফসলকে দূর থেকে একইরকম দেখতে লাগে, একই অনুভূতিতে যেন তা ভরা থাকে। খুব নিকটে গিয়ে পর্যবেক্ষণ না করলে হয়তো ধরাও যায়নি যে প্রতিটি ফসলই স্বতন্ত্র। তাই তো আজকে যাকে খুঁজে পেয়েছেন কবি তিনি শুভ্রা রায় নন, তিনি মমতা অবস্হী, হয়তো ঋতুফসলের মতো একই অনুভূতি জাগছে, তবুও এই শুভ্রা আলাদা এক মমতাময়ী! প্রেমের এই চিরন্তন যাওয়া-আসা থাকে, পুরনোকে সরিয়ে নতুন আসে। তাই তো জীবন ও মনের যৌথযন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত আমাদের কল্প-প্রেম-বাস্তবতা এসে জাগিয়ে রাখে, জাগিয়ে রাখে ঘুম থেকে। ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মধ্যে দিয়ে যে শুভাকে প্রত্যক্ষ করেন পাঠক সেই নায়িকা কিন্তু আর তার পরের কবিতাগুলোয় এত তান্ডব নিয়ে ফিরে আসে না।যারা আসেন তাদের আবেদনে গড়িয়ে পড়ে সুরম্য লস্য, মমতাময়ীর রহস্য। মলয় রায়চৌধুরীর এই পর্বের লেখাগুলি যেন ‘ঘুম-স্বপ্ন-বাস্তব’ এই তিন আত্মনিষ্ঠুরতার অবস্থানের মধ্যে থেকে লেখা হয়েছে। প্রেম থেকে দূরত্ব গভীর হলে প্রতিটি কম্পাস ভুল সংকেত দেয়। আর একটা কবিতা একটু দেখা যাক-
”জরায়ুটা বাদ দিয়ে অমন আনন্দ কেন অবন্তিকা
তাও এই গোরস্হানে দাঁড়িয়ে গাইছিস তুই
মৃত যত প্রেমিকের গালমন্দে ঠাসা ডাকনাম
যারা কৈশোরে তোর বিছানার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে
ভুতুড়ে কায়দায় ঝুঁকে প্রেম নিবেদন করেছিল?”
জরায়ুহীন অবন্তিকাকে আমরা কি কেউ দেখিনি? মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘হাততালি’ কবিতটি যাঁকে উৎসর্গ করেছেন, তিনি মীরা বেণুগোপালন, মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনই তাঁকে বলেছিলেন যে তাঁর জরায়ু নেই! সেই মহিলার সঙ্গে মলয়ের সম্পর্ক কেমন হয়েছিল, কতোদিন ছিল, আমরা জানি না, কিন্তু সেও যে কোনো এক অবন্তিকার আড়ালে লুকিয়ে নেই তা কবিতার অন্তর্ঘাত থেকে পাঠক বুঝে যান।
হাজার হাজার অবন্তিকা আমাদের খুশি রাখার জন্য রাত জাগেন, কনডোম পরিয়ে দেন যত্ন ক’রে। রেলব্রিজের তলা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া কোনও অবন্তিকা হোক, বা নোংরা ঘরের মধ্যে এক হাতে মদ অন্য হাতে জলের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার অবন্তিকাকে তো জয়ায়ুহীন অবস্থায় দেখে অভ্যস্ত। জরায়ু থেকেও যাদের জরায়ু থাকে না, সেইসব অবন্তিকার কাছে কবি হাঁটুমুড়ে অভিবাদন জানান।
”যারা কৈশোরে তোর বিছানার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে
ভুতুড়ে কায়দায় ঝুঁকে প্রেম নিবেদন করেছিল?”
এই তথাকথিত যারা একদিন ‘ভুতুড়ে’ কায়দায় প্রেম নিবেদন করেছিল, তাদের প্রতি কবি উষ্মা প্রকাশ করেন। এই অবন্তিকা তো শাশ্বত প্রেমিকা, মদের গ্লাসের সঙ্গে সঙ্গে যাদের প্রেমিক পরিবর্তন হয়। মলয় রায়চৌধুরী এইসব নগণ্য প্রেমিকাদের প্রতি যেন দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই তাঁর মনে সঞ্চারিত হয়েছে মানবীপ্রেমের। এই প্রেমের জয়পরাজয় নেই, মোহনার দিকে ভেসে যাওয়া আছে। সময়ের দরজায় দাঁড়িয়ে সময়কে চুমু খাওয়া সোজা ব্যাপার নয়। প্রেম হল সময়ের এক অঙ্গীকারপত্র। সেই প্রেমকে প্রকৃত কবিই গ্রহণ করতে পারেন, যদি তাঁর অন্তরের মন্দিরে জ্বালিয়ে রাখতে পারেন প্রদীপ।
নামহীন বা নামযুক্ত নায়িকার প্রতি লেখা কবিতাই হোক না কেন, কোথাও যেন এসে মনে হয় এই তানিয়া, সোনালী,অনামিকা, কৃতী, অথবা অবন্তিকা সবাই যেন কোনো এক অদৃশ্য যোগসূত্রে গাঁথা একটি মালারই ফুল, যেন স্তরে স্তরে সাজানো একটিই প্রেমস্বরের বিভিন্ন সুর। অথচ কবি প্রতিটি কবিতায় বা বলা ভালো, প্রতিটি প্রেমিকার ক্ষেত্রে ন্যারেটিভ টেকনিক বা ভিন্ন আঙ্গিকের নিরীক্ষা করেছেন, যেন কবিতাই তাঁর আসল প্রেমিকা। প্রকৃতভাবে কবিকে চিনতে গেলে তাঁর কয়েকটি কবিতা নয়, বিচরণ করতে হয় একটি সম্পুর্ণ গোলক।
মলয়ের উপন্যাসগুলোতে যে ভাবে তাঁর ব্যক্তিগত রহস্যময় জীবনের নারীচরিত্ররা ছায়া ফেলেছে, ঠিক সেভাবেই কবিতাও জারিত হয়েছে একই সম্মোহনে। “ভালবাসার উৎসব” কাব্যনাট্য বা “অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস” পড়লে দেখা যায়, যে-নায়িকারা রয়েছেন তাঁরা একজন আধচেনা পুরুষের হাত ধরেও বলতে পারেন,’চলুন পালাই’। সেই মমতা অবস্হীর ছায়া, যিনি মলয়ের হাত ধরে কোনো দূরপাল্লার বাস ডিপোতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘চলুন পালাই’।
এই হাওয়াটাই দোলা দিয়ে গেছে তাঁর প্রেম সিরিজের কবিতাগুলোর মধ্যে । অদ্ভুতভাবে বাস্তবায়িত নায়িকা চরিত্রগুলোকে হাটে-মাঠে-ঘাটে এমন কি পাঠকের বুকের ভিতর খুবলে এনে হাজির করেছেন কবি তাঁর কবিতায়। এঁরা যেন কবির নিজস্ব সম্পত্তি নয়। কবি নিজেই কোথাও বলেছেন,অবন্তিকা একটি স্বনির্মিত প্রতিস্ব। এর আগে রামী, বনলতা, নীরা, সুপর্ণা ইত্যাদি ছিল কবিদের নিজস্ব নারী। অবন্তিকা সে রকম নারী নয়, সে স্বাধীন, হয়তো মীরা বেণুগোপালনের মতো। সে পাঠকের কাছে, আলোচকের কাছে, নির্দ্বিধায় হেঁটে যায়। অবন্তিকা কবির স্লেভগার্ল নয়। কবির লেখা ‘চলুন পালাই’ পর্ব থেকে প্রেম যত নির্লিপ্তির পথ ধরে যেতে চেয়েছে [ কবি স্বীকার করেছেন কখনো কখনো তাঁর জীবনে এই রোম্যান্টিক স্বত্ত্বাই তাঁকে বিপদে ফেলেছে বারবার] ততই যেন প্রেম আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে বাকশিল্পের মধ্যে দিয়ে নির্গমনের পথ খুঁজেছে কবিত্বের নির্বিবাদ আত্মা।
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে আলোচনার জন্য ক্ষুদ্র পরিসর যথেষ্ট নয়। আবার তা যদি প্রেমের কবিতা হয়, তাহলে তো আরও যথেষ্ট নয়। ঋতু বিবর্তনের মতোই ভালোবাসা বিবর্তনের মধ্যে চলা এই সময়ে, সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তার নষ্ট পরিবেশে মানুষকে ভালোবাসার কাছে ফেরত পাঠানো মোটেও সহজ নয়। মলয় এই পরমাণু-গন্ধ সময়ে, বয়সকে দুই তুড়ি মেরে সেই ঐশ্বরিক ভালোবাসার কাছে সঁপেছেন আত্মাধ্বনিকে। তারপরে ফাঁসির আসামীর মতো বয়ে নিয়ে চলেছেন ভালোবাসার সেই নবজন্ম ঐতিহ্যকেই। একদিন একদিন করতে করতে মানুষের বয়স বেড়ে যায়। আর দেখতে পায়, তার সঙ্গে জড় হয়েছে পার্থিব সম্পদ। কিন্তু নিঃশব্দে ভালোবাসা দূরে সরে গিয়েছে মানুষের থেকে। মলয় রায়চৌধুরী সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন জীবনের মধ্যে, দিতে চেয়েছেন বাঁচার প্রকৃত স্বাধীনতা, কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের সামনে শ্রীকৃষ্ণের মুখগহ্বরের আলোকোজ্বল বার্তা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।