অজিত রায়, এক অভিনব গদ্যকার : মলয় রায়চৌধুরী
মরে গেল অজিতটা। অজিত রায় মরে গেল। ওর দেহ, কালো হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জিতে, পড়েছিল হাসপাতালের স্ট্রেচারে। পড়েছিল এইজন্য বলছি, ওর পা দুটো স্ট্রেচারের ডানদিকে ছিল, বাইরে বেরিয়ে। দেখলেই টের পাওয়া যায় অনেকক্ষণ আগে মারা গিয়েছিল। শেষগতি কে করবেন তা হয়তো তখন পর্যন্ত নির্ণয় নেয়া হয়নি। স্ট্রেচারে পড়েছিল অবহেলায়। দীর্ঘ ১৫ দিন যাবত শয্যাশায়ী, এমনকি ফোনে কথা বলতেও খুব অসুবিধা হচ্ছিল অজিতের। ইমিডিয়েট দুই ইউনিট রক্ত দরকার ছিল। হসপিটলাইজ করা দরকার ছিল।
.
অজিতের সঙ্গে যোগাযোগ আমার বহুদিনের। আমার স্কুল-কলেজের সহপাঠি সুবর্ণ উপাধ্যায় সিন্দ্রিতে সায়েন্টিফিক অফিসার ছিল, সেই সময় থেকে। অজিতের একটা দোষ বা গুণ যাইই বলি, তা হলো প্রথম দিকে ওর সঙ্গে অবনিবনা হয়, তারপর মিটমাট হয়ে যায়। ওর অবাঙালি স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল না। বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল, তাই শেষ পর্যায়ে আত্মীয়-স্বজনকে কাছে পায় নি। একটা লেখায় অজিত জানিয়েছিল যে ওর মুখাগ্নি যেন ওর নিকটসম্পর্কের কেউ না করেন। শেষ পর্যন্ত কে করেছিলেন জানি না।
.
কিন্তু ও কোথায় থাকে, কী করে তা জানতুম না। সেসব জানতে পারলুম পরে। নিজের সম্পর্কে অজিত একবার লিখেছিল, “জন্মের বা নসিবের ফেরে নয়, আজ অবশ্যই বলতে পারি সৌভাগ্যের করুণায় আমি বসত করি বাঙালির পরিচিত ও গঙ্গাবিধৌত নাবাল গণ্ডির বাহিরে এমন এক বৃহত্তর পৃথিবীতে, যেথায় চাঁদ সূর্য নক্ষত্রের দিবারাত্রি অশুয়া ঝরে পড়ে, যেথায় পলাশ শিমুল শাল-শার্জম নিম সুজনের অনিবার সারি, যেথায় পাহাড় জঙ্গল নদী ও নদ-দামোদরের অবিরল করকাপাত। যে 'পশ্চিম' অজীর্ণকাতর কলকাত্তাই বাঙালিকে দেহ-উজ্জীবনের সুরাহা জুগিয়েছে। যে লাল পাহাড়ির দেশ বেঙ্গলি ড্যানচিবাবুদের ঔপনিবেশিক স্থাপত্য মেনে সুবিসারিত ভিলা, কুঞ্জ, নিবাস, ধামের হরিল্লুঠ দিয়েছিল। কিন্তু যাঁরা এখানকার মূল নিবাসীদের সঙ্গে আদ্যোপান্ত তেল ও জলের তফাৎ রেখে বিদায় নিয়েছেন। এখন বলার কথা এইটাই যে এই ভূখণ্ড সত্যিই কি বাঙালি চিনেছে? লাতেহারের জঙ্গলে গহীন বনরাজি এবং কুচকুচে 'জংলী' আদিবাসীদের সঙ্গে দু-চারদিন মিশেই দুর্বিষহ লেগেছিল বলে ডেপুটির চাকরি ছেড়ে মায়ের আঁচলে ফিরে গিয়ে স্বস্তি বোধ করেছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র। লবটুলিয়ার অপার নির্জনতায় দিনদশেক কাটিয়েই সত্যচরণের মনে হয়েছিল জনহীন জঙ্গলে এভাবে হাঁপিয়ে মরার চেয়ে কলকাতায় থাকা ঢের প্রশস্ত। আমি জন্মেছি সেই ঝাড়খণ্ডে। যাহা একদা বঙ্গভূমের দেহাংশ ছিল, ১৯৫৬ সনে পুরুলিয়ার হাত ধরে নিজ মাতৃক্রোড় রিটার্ন যেতে না পারার প্যাং (pang) এদান্তি ভুলতে পারেনি ধানবাদের বৃদ্ধকুল। কিন্তু আমি এই অনাবাল টাঁড় ধরণীতে বেশ আছি। সবচেয়ে ভালো লাগে এ অঞ্চলের নিবিড় বনভূমি, কুইন অফ ছোটানাগপুর নেতারহাট। ভালো লাগে বেতলা। ঝাড়খণ্ডের তেত্রিশ শতাংশ বনভূমি, পাহাড়, নদ-নদী, উপত্যকা ও এখানকার বহুজাগতিক ভাষা। আমি আমার এই মাতৃভূমির প্রকৃতি ও মানুষের মায়ায় মজিত। এ টাঁড়ের সব ভাষাতেই মাদল বাজে। তদানীন্তন এই দক্ষিণ বিহারের 'ছিকাছিকি' বুলির মনোরম উল্লেখ আছে বিভূতিবাবুর 'আরণ্যকে'ও, কিন্তু তিনি এই দেশটিকে দেখেছিলেন 'আউটসাইডার'-দৃষ্টিতে। বহু ক্ষেত্রে তিনি ঢপের নিদর্শন দিয়েছেন।
ঝাড়খণ্ডের সমস্ত ক্যাটাগরির আদিবাসীকে বাঙালি প্রতিষ্ঠানের মসিহস্তীরা 'সাঁওতাল' বলে চালিয়ে দিয়েছেন। হিন্দিভাষী মাত্রেই, তাঁদের চোখে 'বেহারি' কিংবা 'হিন্দুস্তানি'। বড়ই হাস্যকর ও ক্রোধ-উদ্রেকী শব্দ। মূর্খতার সুবিশাল খ্যাতি প্রতিষ্ঠানকে লজ্জানুভিলার চূড়ান্ত নিঃশেষে নিয়ে গেছে। এবার আমি বলি। পৌরাণিক যুগের 'কীকট' বর্তমানে ঝাড়খণ্ড। এ এক অপরূপ নিরালা নিজস্ব পৃথিবী। এর সঙ্গে ভারতবর্ষের আর কোনো ভূখণ্ডের সামীপ্য নেই। আমি যাঁদের সঙ্গে অহরহ মিশি, মিশে ফীলিং গুড ফীল করি, তাঁদের রয়েছে মিলিজুলি বুলি : খানিক বাংলা, কিছু মৈথিলী, খানিক খোরঠা বা কুড়মালি, কিঞ্চিৎ ভোজপুরী এবং কিছুটা ঠেট হিন্দী। অজস্র গড়া, বাইদ, বনি, হাডু, কাটা ইত্যাদি উত্তর-পদযুক্ত গ্রাম নামে এবং মহল্লা, নদী বা পাহাড়ের নামে অবশ্য অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় প্রত্নশব্দ রয়েছে এই টাঁড়ভূমে। এমনকি ধানবাদ থেকে খুব কাছেই, ভৈরবীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত 'রাজারাপ্পা'র সঙ্গে 'হরপ্পা'র ধ্বনিগত, অর্থগত মিলও মেলে, নৃতত্ত্ববিদেরা যাই কপচান।
তো, কথা হচ্ছে, কীয়ৎকাল পূর্বে, এক রাত্তিরে, রাত সাড়ে ন'টা নাগাদ আমি ধানবাদ টিশনে গিয়েছিলাম কোলফিল্ড এক্সপ্রেসের একটা আগাম টিকিট কিনতে। কলকাতা আসছি কিনা! তো, নিরিবিলি কাউন্টার থেকে টিকিটটা কালেক্ট করে রেলওয়ে ক্লাব অবধি এসেছি বাইকে, দেখি হুস-হুস করে পাঁচ-ছখানা বাইক এসে জমা হলো মাজারের মোড়ে। প্রত্যেকটি বাইকে তিনজন করে সোয়ারি। ওরা চা, চপ, সিঙ্গাড়া খেতে রুকেছে। দুতিনজনের হাতে ফুটবল। বুলি শুনেই বুঝলাম, ঝাড়খণ্ডি। দমে হুল্লোড় নিজেদের মধ্যে। জানতে চাইলাম, 'খেইলে আলি?'
'ন স্যর, যাছি খেইলতে। ম্যাচ আছে।'
'ম্যাচ! ইতো রেইতে?'
'হঁ। রাতে ম্যাচ। ফেলাড বাতি আছে ন!'
'অ। তাথেই হামি থামলি, তুদের দেইখে। ত, ম্যাচ টো কুথা?'
'আমটাল গ।'
আমটাল শুনেই রোঁয়া খাড়িয়ে গেল। বহুদিন দেখা হয়নি সে গাঁ, বড় মনোরম, স্বীয় মনের বজনিশ। বললাম, 'দাঁড়হা ক্যানে, হামিও যাছি তুদের সঁগে।'
ওরা আমায় লুফে নিল। হৈ হৈ করে দুজন ছোঁড়া চেপে বসল আমার বাইকে। উছল আনন্দ, উদল আশ নিয়ে ধাইলাম কচি পানাগুলোর সঙ্গে। একদা, যেসময় আমি 'ধানবাদ ইতিবৃত্ত' রচনায় ব্যাপৃত ছিলাম, সেই বিশ-পঁচিশ বৎসর মগরিবে আমটাল গাঁয়ের 'রইস' তথা হতদরিদ্র কেলেকুষ্টি ডিংলাপারা মানুষজনের সঙ্গে আমার হার্দ্য রিস্তা গড়ে উঠেছিল, তবে শেষোক্ত শ্রেণীর সঙ্গেই ভাবসাব প্রগাঢ়। প্রকৃতির ক্রোড়ে ওই নিরিবিলি শ্যামলসুন্দর ধরণীকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ধ্বংস করার দীর্ঘায়িত লীলাখেলাও চোখের সমুখে প্রত্যক্ষ করেছি, সেই ইতিহাসকেও এড়িয়ে যাইনি আমি। সুফসলি জমিগুলো রইসদের কুক্ষিতে। রুক্ষ অনুর্বর চটা জমিগুলো ঠেলে দেওয়া হয়েছে আদিবাসী আর গরিবগুলোর হেফাজতে। সেখানে চলে পাথর চটিয়ে মৃদু ফসল ফলাবার দুশ্চেষ্টা। দারিদ্র ঘোচে না। অভাব অস্বাস্থ্য তাদের নিরবধি নির্দয় পীড়ন করে। সেই কয়লাকুঠি এজাদের পর থেকেই ব্যাপক অরণ্য শোষণ। অরণ্যের বদলে ঝাঁটিজঙ্গলই তাদের এখন নসিবি আস্তানা। কিন্তু তাতে আরণ্যক স্বভাব লোপ পায়নি। আরণ্যক বৃক্ষকে এরা চেনে আপন মা-বাপের মতন। তাই লোভী ইউক্যালিপটাসি ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে জরুরতের টাইমে ধনুষও ধরে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কী-দেখব কী-দেখব উন্মেষ নিয়ে রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ আমটালে হাজির হয়েছি। মাঠ জুড়ে ফ্লাডবাতির অজস্র রোশনাই। কিন্তু গোটা আমটাল তমসার বৃত্তে। খেলা দেখতে তো আসিনি, এসেছি মানুষ ও গাছপালা দেখতে। এত রাতেও, কোনো কোনো ঝুপড়িতে মৃদুমন্দ লণ্ঠনের জোনাক। হালকা বাতচিৎ, মুমূর্ষু গণের আনাগোনা। কোথ্যেকে যেন কাঁচা মউলের সুবাস, দীর্ঘ মি-মি ডাক ছাগশাবকের, কচি একটা সড়ক হেঁটে গেছে সুখিয়া মুর্মুর দুখিয়া ডাড়িতে। কুথা গ মুর্মু?
বুঢ়া মুর্মু লাঠি ও লমফো হাতে সামুতে এসে খাড়ায়, লোলচর্ম মুখের অজস্র শিরা-উপশিরা কুঁচিয়ে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয় আমার পানে।
'চিহ্নতে লাইরলে খুড়া? সেই যে মটা বাইদ ধানের ভাত আর খুকরার ঝল খাওয়ালে! এক চুকা তুমাদের ইস্কচ, মানে মাৎকোং খাওয়ালে?'
'হঁ হঁ', ---- বুড়োর মেমোরি হেভি শার্প, ঝটঝটিয়ে মনে পড়ে গেল, মোড়া পেতে বসাল, ---- 'ত ঠাকুর ইতো রেতে? থাকভি ন যাভি?'
'এই ম্যাচ দেখতে আলি। সুবায় টেরেন ধৈর্তে আছে। ফিরব।'
এরপর মুর্মুর দাওয়ায় এক-এক করে এসে জমে ভুলি টুডু, দেয়ান বাস্কে, মানিজার সরেন, আমেরিকা হেমব্রম, আরো কতিপয়। কেউ আমায় মনে রেখেছে, কেউ বা অবাক নয়নে এই উল্কা-প্রতিম বেপোট লোকটাকে খালিপিলি নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে, কিন্তু থই পাচ্ছে না। চেনা বুড়োগুলো এখন আরও বুড়ো হয়েছে, পাক ধরেছে চুলে, কানে কালা, দৃষ্টি সরু, মাখনের মতো শরীল আজ শুষ্ক পাণ্ডু ও জিরজিরে। তবে, একটা কথা। এদের সরল চরিত্রে বরাবরই লক্ষ করেছি আনন্দ নেওয়ার, এবং দেওয়ার স্বাভাবিক প্রতিভা। এরা মাটি, জঙ্গল, পাহাড় খুইয়েও প্রকৃতির সাজেদা গায়। এই সিজিনেই আসছে এদের 'শহরায় বঙ্গা', এই উৎসব শুধু মানুষের নয়, গৃহপালিত গরুমহিষও তাতে শরিক। গরু নেই, গরু জীর্ণ, এক আঠি পোয়ালের জন্য দিবারাত্র কেঁদে ভাসায়, তবু এরা এখনো 'গোয়াল' পুজো করে। জাহের থানে হত্যে দেয় দুমুঠো ফসলের তরে। এদের কৃষি নেই, জমি নেই, ফসল নেই, তবু এদের সমস্ত পরব জমি ও কৃষিকে ঘিরে।
ফিরে আসছি যখন, রাত বারোটা। তখনও ওরা বিনিদ্র চোখে আমায় ঘিরে। শেষে মুর্মুর ছুটো লাতিন একটা গান শোনালো, সেও বেজায় মন-কেমনের সুরে :
নে তরা নেতে তরা মুরুম পাঞ্জা
নে তরা নেতে তরা শলাম পাঞ্জা
পাঞ্জায়ে পাঞ্জায়ে মুরুম পাঞ্জা ----
পিছায়ে পিছায়ে শলাম পাঞ্জা।
অর্থাৎ ---
'এই যে দেখনা হরিণের পদচিহ্ন / এই যে এখানে হরিণীর পদছাপ / খোঁজো খোঁজো সেই মৃগপদলাঞ্ছনা / খুঁজে দেখো সেই হরিণীর সন্তাপ'।
------ কী সুন্দর! তাই না? গানের সুরে সুরেই বোনা হয়েছে শহরায় উৎসবে আগত ওঁরাও যুবতী সিগনির করুণ আখ্যান। সেই কাহিনীতে গাঢ় আরণ্য রোমান্সের সঙ্গে মিশে আছে কালো মানুষের রক্ত ঘাম কান্নার মর্মান্তিক সরঞ্জাম।”
.
হাংরি আন্দোলনের পৃষ্ঠপটে অজিত রায় ক্ষুধা নিয়ে লিখেছিলেন, এইভাবে, “কামজ খিদে আর পেটের খিদে। দাপট কার বেশি? দুটোই কিন্তু জোরালো। দুটো খিদে দুরকমের। এরা পরস্পর নির্ভরশীল নয়। অভুক্ত অবস্থা রতিক্রিয়ায় বাধ সাধে না। খালি পেটে কিম্বা ভরপেট মোগলাই গিলে সমান তালে শরীর-শরীর খেলা জমিয়ে তোলা যায়। পেটের খিদে যে যৌনসম্ভোগের অন্তরায় নয় তার ভূরিভূরি প্রমাণ অনাহারের বলি মেয়েপুরুষের প্রজনন হেতু গণ্ডায় গণ্ডায় অভুক্ত শিশুর আবির্ভাব। গাছের আড়ালে, ফুটপাথের অন্ধকারে, রাতের সিঁড়িতে এরা দিনের পর দিন পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ায় আদমশুমারির দৃষ্টির বাইরে। যাই হোক, এটাই মানুষের যৌনতা, যা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। বহুসময়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও কাম ও যৌনতাকে গুলিয়ে ফেলেন। অথচ এ-দুটিতে মূলগত কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। কাম এক নিরপেক্ষ জীবনীশক্তি, প্রাণের নির্দিষ্ট উছ্বাস যা নিম্নস্তরের প্রাণীর মতো মানুষের মধ্যেও ক্রিয়াশীল। এই কাম যদিও সর্বদা সচেতন কর্ম নয়। পশুসমাজে কাম প্রকৃতিতাড়িত, মানুষের ক্ষেত্রেও কিছুটা। কিন্তু মানুষকে পশু থেকে পৃথক করে, কাম নয় ---- রিরংসা। প্রজাতির স্থায়িত্ব ও বংশবিস্তার কাম দ্বারা সংঘটিত হলেও, কামকে যা রমণীয় ও মানুষকে সৃষ্টিশীল করে, তা যৌনতা। যৌনতা এক বহুমাত্রিক বর্ণময় বিস্ময়। তা মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে, তাকে সমাজ ও পরিবার গঠনে ব্রতী করে, তাকে মধুর জীবনবোধ উপহার দেয় এবং তার মধ্যে রসবোধ উদ্দীপ্ত করে তাকে শিল্পী ও কবি করে। এই বহুপল্লবিত যৌনতাই আমাদের সমাজে, জীবনে, চিন্তায় ও কর্মে। আমাদের যাপন-প্রণালীর সবটাই যৌনতানির্ভর। অথচ আশ্চর্য, যৌনতার এই সর্বব্যাপ্ত কর্মজাল বহুসময়েই আমাদের কাছে অচেতন, দুর্বোধ্য। মানুষের উৎপত্তির বছরটি আমাদের জানা নেই। জানা নেই কখন হোমোসেপিয়ন্সের আবির্ভাব। কিন্তু মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যে একটি মস্তিষ্কের, মনের, এতে দ্বিমত নেই। আর বিকাশের বিশেষ এক অবস্থায় বিশেষ-বিশেষ স্থানে এটা ঘটেছিল বলেই আহারনিদ্রামৈথুনেই কেবল বদ্ধ নয় নিয়ানডার্থাল মানব-মানবী। সে অন্বেষণমুখী, বুভুৎসা তার প্রথম অস্ত্র। মনের বিকাশই মানুষকে নতুন সম্ভাবনা ও কল্পনার দিকে এগিয়েছে। মনের এই বিকাশ কামকে দেয় এক নতুন মাত্রা, মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। তখন কাম আর শুধু সন্তান উৎপাদনের সাধন নয়, তাকে রঙিন করে যৌনতা। আসে বিস্তারিত শৃঙ্গার, দেহ-মুদ্রা। তখন স্তনযুগল আর নিছক দুগ্ধপানের আকর নয়, তা অন্যতম এক যৌনাঙ্গ। এ থেকে শুরু হয় নরনারীর পারস্পরিক আকর্ষণ, প্রেমের অঙ্কুর। দক্ষিণী সৃজন-তথ্যে আছে, মানব-মানবী সৃষ্টি করতেই বিধাতার সর্বাপেক্ষা খাটনি হয়। তাই নর-নারী সৃষ্টি করে তিনি কেলিয়ে পড়েন এবং তড়িঘড়ি মহানিদ্রায় লগ-ইন করেন। ইত্যবসরে নর-নারীর দেহ সঞ্চালিত হতে থাকলে তাদের ভাবসঞ্চালনও ট্যাগ-আপ হতে থাকে, তৎলগ্নে কারুবাসনাও আনচানিয়ে ওঠে। তাদের দেহসংলগ্নতা নিচ্ছিদ্র হয়। বিধাতা জেগে উঠে দেখেন, লে হালুয়া! ----- মেয়ে-মদ্দাকে যে আলাদা আলাদা চেনাই যাচ্ছে না গো!! একদেহে পরস্পর লীন হয়ে গেছে! সৃষ্টির সমূহ বিপদ হবে ঠাহর করে তিনি অবিলম্বে ছিন্ন করেন ঐ একদেহে লীন মানবকে। তারপর বিশ্বময় ছুঁড়ে দেন ওই দুই বিভাজন। সেই মুহূর্ত থেকে ঐ একদা-এক-থাকার প্রমত্ত আনন্দের স্মৃতিতে এদান্তি হন্যে হয়ে আছে উন্মত্ত স্মৃতিকাতর নর-নারী। এই তো ভালোবাসার উৎস। বা, যৌনতার ইতিবৃত্ত। মানুষের যৌনতা আছে বলেই তার নিজেকে ঢেকে রাখার, সাজিয়ে রাখার এতসব আয়োজন। যৌনতা আছে বলেই মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য মরিয়া-স্তরের সচেষ্ট। প্রকৃতির শক্তিকে নিজের কাজে লাগাবে বলে সে কখনো প্রার্থনা করে, কখনো করে দ্বন্দ্ব। অতি ধীরে ইন্দ্রজাল জাদুর মত দেবতাদের উদ্ভব ঘটে ---- যে দেবতা তারই মত, তবে আরও শক্তিমান ও সুন্দর ----- সে যা হতে চায়। স্বভাবতই বিপরীত লিঙ্গের মানুষটি তখন আর নিছক শরীর নয়, তাকে ঘিরে তখন নানান কল্পনা, স্বপ্ন। দৈহিক মিথুন পর্যবসিত হয় মানসিক মিথুনেও। পাশাপাশি যৌনতাকে কিছুটা রীতি ও নিয়মের নিগড়ে বেঁধে ফেলতে থাকে মানুষ। ক্ৰমে তা সমাজবদ্ধ হয়। বিশ্বের সর্বত্র কিন্তু সভ্যতা একসঙ্গে হাঁটা শুরু করেনি। বিশেষত নদী-সন্নিহিত অঞ্চলে, যেখানে বেঁচে থাকার রসদ বেশি, শ্রম কম, সেখানেই ঘটেছে বিকাশ। যৌনতারও। উদ্বৃত্ত সময় ও অবকাশ মানুষকে সৃষ্টিশীল ও শ্রেষ্ঠ হতে প্রেরিত করেছে। আষঙ্গলাভের জন্যে কেবল দৈহিক বল নয়, সে খুঁজে পেতে চেয়েছে অন্যবিধ প্রকরণও। এভাবেই গীত ছড়া কবিতা নাটক সুর নৃত্য বাদ্য ও ছবির উদ্বোধন। ইতিহাস বলে, যে যে স্থানে যৌনতা স্বাভাবিক স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র সেখানেই সভ্যতা বলবান হয়েছে। প্রাচীন সভ্যতাসমূহের সর্বত্রই উন্নত জীবনের পাশাপাশি উন্নত যৌনজীবন। রোম ও গ্রিসের কথা আমরা জানি। কিন্তু আমরা অনেকে জানি না বৈদিক ভারতের কথা। বেদ রামায়ণ মহাভারত প্রভৃতি যত না ধর্মগ্রন্থ, তার চেয়ে বেশি প্রাচীন ভারতের জীবনযাপনের বর্ণনা, ইতিহাস-আলেখ্য; যদিও এসব কাব্য হওয়ায় অনেকাংশে দুর্বোধ্য। সেই বৈদিক ভারত ছিল অপেক্ষাকৃত বীর্যবান, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। কিন্তু ভারতের সর্বাধিক গৌরবের যুগ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক। এসময় যৌনতার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানেরও প্রসার তুঙ্গে। ভাবুন সেই ভারতের কথা ---- বাৎসায়নের আগেই যেখানে অন্তত দশজন কামশাস্ত্র রচনা করেছেন, এবং তাঁরা কেউই নিন্দিত নন, বরং ঋষি বলে নন্দিত। আর এই কারণেই, যৌন-উল্লাসের হেতু নাট্যশাস্ত্র রসশাস্ত্র ইত্যাদিও ভাস্বর সেসময়ে। বুদ্ধের সময় আমরা সমাজে বিত্তবতী, শিক্ষিতা, কলাকুশলী স্বৈরিনীদের দেখেছি ---- তারা সমাজে সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। গৌতমের গৃহত্যাগের আগে তাঁর যৌনজীবনের যে ছবি আমরা দেখেছি তার কাছে যৌনতার আরব্যরজনীও ম্লান। গুপ্তযুগও তো পারমিসিভ সোসাইটি, স্বাধীনতার জয়গানে ভরা ----- সেই তো স্বর্ণযুগ! বুদ্ধের সময় থেকেই ভারতীয় সমাজে উচ্চকোটির সুশিক্ষিত সুজন মানুষ একে-একে জড়ো হচ্ছেন মোক্ষ লাভের আশায়। আসলে গোটা বুদ্ধ-যুগটাই ছিল একটা পিনেনিয়ান ঢপ। ভেবে দেখুন আক্কেল কেমন, চারিধার থেকে ঠাসা জাবদা-জাবদা ইয়াং আর প্লডিং মেয়েছেলে। কিন্তু সব ছেড়েছুড়ে গুরু কিনা মাঝরাতে উধাও! ওই জন্যেই ইন্ডিয়াটা ভোগে গেছে। কেননা, বুডিজম গিলেই ভারতবর্ষ সেক্স ভুলেছে। ভুলেছে রসশাস্ত্র, মুদ্রাব্যবস্থা, বাণিজ্য। সমাজের এলিট তবকা রাতারাতি মেতে উঠল স্যালভাশনের ঠেকায়। তিন-চারশো বছর ধরে আকখা মুলুক জুড়ে শুধু চৈত, বিহার আর ধর্মসংঘ। রতি-রস-মুদ্রা-বাণিজ্য রসাতলে গিয়ে জেগে রইল, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যা ছিল শ্রেষ্ঠ আকর সেই বেদ-এর বিরোধী এক ধর্মসার দর্শন ---- 'বুদ্ধতত্ত্ব'। সমাজ তাতে কী পেল? ঘন্টা। বরং হারাল অনেক। দেব-দেউল পুতুলডলে দেশ ভরল, সেক্স-পরিপন্থী সমাজে নেমে এলো ঘোর নষ্টেন্দুকলা, ----- পারভারশান, ফ্রিজিডিটি, নন-কাল্টিভেশন আর ইনারশিয়া। খেয়াল করবেন ম্যাডাম, যুগপুরুষ-টুরুষ যত যৌন-পরিপন্থী আর অহিংসাবাজ হয়েছে ডেইলি নিউজের হেডলাইনগুলো ততই অশ্লীল আর বর্বর হতে বাধ্য। তারপর এলো মধ্য এশিয়ার সেই বর্বর, অশিক্ষিত, অসভ্য লুটেরার দল। তারা তো প্রকাশ্যে মেয়ে-বউ তুলে নিয়ে যায়। কীভাবে মুক্ত থাকবে সমাজ? কীভাবে বিকাশ ঘটবে শিল্পকলার? সব ভালো শিকেয় তুলে রেখে হিন্দু সমাজপতিরাও মেতে উঠল কূটকচালি, নীচতা, শঠতা, কুসংস্কারে। সমাজে যৌনতার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেল। তারও পর এলো মুঘল। এলোই যখন মুসলমানেরা তখন আরব-পারস্য-তুরস্ক থেকে এলে অন্তত আনতে পারত সংস্কৃতি। মন্দির ভেঙে মসজিদ, সামাজিকতা ভেঙে হিন্দু মেয়ে-বউকে তুলে, কর বসিয়ে , বড় বড় অট্টালিকা বানিয়ে, চূড়ান্ত বেলেল্লাপনা করে তারা কোথায় নিয়ে গেল ভারতবর্ষকে? এ অবস্থাতেও যৌনতার স্বাভাবিক বিকাশ থাকল অর্গলবন্দী হয়ে। আচার-সর্বস্ব পৌত্তলিক হিন্দুসমাজও মেতে থাকল বাল্য-বিবাহ, কৌলিক প্রথা, বিধবাদের জীবন্ত দাহ কিম্বা কঠোর নীরস বৈধব্য আচারে। তারপর আসিল ইংরাজ। তলোয়ার-হাতে ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা জয় তার সম্পন্ন। অহিংসা ও প্রেমের ঠাকুরকে সামনে রেখে পচা খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ ও পাপবাদ চারিয়ে দিতে লাগল ভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এরাই মধ্যযুগীয় ইউরোপে স্বাধীনতাকামী যৌনতামুখী ধারাকে এন্টি-ক্রাইস্ট ব্যভিচার ভেবে পুড়িয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্টেকের আগুনে, তাদের ডাইনি আখ্যা দিয়ে। সেই ইংরেজ নাকি আমাদের কুসংস্কার দূর করবে? বাঙালি বাবুরাই সর্বপ্রথম সাহেব হতে গেল। ইংরেজ আসায় কিছুটা উন্নত হলো বটে, কিন্তু দেবেন্দ্র ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রীদের ব্রাহ্ম মতবাদে সমাজ আরো পিউরিটান হলো। ব্রাহ্মদের ব্রহ্মভজনার চেয়ে সাহেবভজনাই বেশি। যৌনতা আরও যূপকাষ্ঠে ----- যা বাড়ল তা-ও ঐ ইংরেজ সাহেবদের ক্লেদজনিত; বাড়ল ভুঁইফোড় ধনী বাঙালি নিম্নশ্রেণী বাবুদের তেলমারা জমিদারি, বিকৃতকাম, নারী-লোলুপতা, ব্যভিচার। তদুপরি ভারত 'স্বাধীন' হইল এবং পৃথিবীর দাস হইল। দেশসুদ্ধ মানুষ কামচোর, নিষ্কর্মা, দুর্নীতিবাজ ও কমবেশি চোর হইল। উহাদের সততা নাই, উদ্যম নাই, উহাদের বল নাই; কারণ উহাদের প্রকৃত যৌনতা নাই। ভুল মূল্যবোধে বেড়ে উঠল খণ্ডযৌনতা, ন্যাকাপনা, চতুর যোনিলাভ। সাহিত্য-শিল্পে যৌনতা ব্রাত্য হলো। বিকৃতির থাপ্পড়ে গোটা একটা জাতি খোজা ব'নে গেল। অনুকম্পা ও আস্তরণ পড়তে শুরু করল যৌনতায়।
উপসংহার :
ক্ষুদে ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা সাহিত্য ধরে রাখল সেই বিকৃত ধারা। সামান্য মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকলে পাঠকও ধরে নিতে পারবেন বাংলা উপন্যাস-গল্প-কবিতা-সিনেমায় 'শুদ্ধ' প্রেম বলে যা চালানো হয়েছে এতকাল ধরে তা আসলে বিকৃতি, একধরনের প্যারানোইয়া। লিঙ্গহীন সাহিত্য যোনিহীন সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। আসলে যৌনতা না থাকলে কিছুই থাকে না। যৌনতাহীন মানুষ ক্রিয়াশীল সৃষ্টিশীল হতে পারে না। সভ্যতার এহেন দুঃসময়ে একজন অযৌন মানুষ কখনও বুদ্ধি চিন্তার বিচারে পূর্ণ সক্ষমতা পায় না। আপনি যদি রেফার করেন সেবাব্রত সন্ন্যাসীদের কথা, আমি বলব যৌনতাই তাদের উদ্বুদ্ধ করে মানব সেবায় ----- এটাই যৌনতার ট্রান্সনডেন্স, ঊর্ধায়ন। যৌনতা এক বহুধাবিস্তৃত কর্মক্ষেত্র। ভানুমাস্টারকে যে যৌনতা তার কচিবয়সী ছাত্রীর প্রতি আকৃষ্ট করায়, সেই যৌনতাই বিকাশ পাইনকে দিয়ে ছবি আঁকায়, জীবনানন্দকে দিয়ে কবিতা লেখায়, অমর্ত্য সেনকে দিয়ে অর্থনীতি ভাবায়। এই যৌনতার অবশিষ্টাংশ আছে বলেই শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান পল্লবিত হচ্ছে। ওই ক্ষুদে ব্যতিক্রমটি আছে বলেই বাংলা সাহিত্যের একটা ছোট্টো অংশ অন্তত এখনও পল্লবোন্মুখ।”
.
অজিত রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন বিহারের ধানবাদ শহরের সিএফআরআই কলোনিতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন অজিত।সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল ছোটো বয়স থেকেই। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মিলে 'অনন্যা’ নামের একটি কবিতা প্রকাশ করেন। নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ র নাম রেখেন ‘অকবিতা’। চাকরি করেছেন একটি কয়লা মার্চেন্ট অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে। কিন্তু সাহিত্যের অন্যতম সৃষ্টির জন্য সেই চাকরিটি তাকে খোয়াতে হয়। স্বভাবতই আর্থিক অবস্থায় ভেঙে পড়েন এবং তিন মাস বসে থাকবার পর সাহিত্যকেই একমাত্র রুজিরুটি হিসেবে বেছে নিয়ে ফুল টাইমার হয়ে লেখায় মনোনিবেশ করেন অজিত। তাঁর প্রথম দিকের লেখায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ছাপ থেকে গেলেও নিজের নিবিড় অধ্যয়নের প্রক্রিয়ায় তা সহজেই কাটিয়ে উঠেন এবং আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বৃহত্তর পাঠকের সামনে কথা সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন অজিত রায়। যদিও তখনো তার ভেতর বিরাজ করছিল কবি সত্তা। কাব্যগ্রন্থের মধ্যেই অজিত রায় প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, গতানুগতিক সাহিত্যের ভাষা থেকে বেরিয়ে এসে অন্যরকম কাজ করতে চান তিনি। কবিতাকে ছেড়ে গদ্য সাহিত্যকে আশ্রয় করে নিলেও তার মধ্যে কবিতার নানা প্রভাব সবসময়ই লক্ষ করা গিয়েছে। অজিত রায়ের সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে ভেঙেচুরে দেওয়া। যার কারণে বরাবর নিন্দিতও হয়েছেন তিনি। ‘যোজন ভাইরাস’ বা ‘জোখিম কোরকাপ’ উপন্যাসে সভ্য মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা পাশবিক চরিত্র গুলিকে যেভাবে তুলে ধরেছেন তিনি, তাতে সত্যিই চমকে উঠতে হয়। মানুষের জীবনের যৌন আকাঙ্খার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে গিয়ে কখনও হোঁচট খায় নি তাঁর কলম। মানুষ তাঁর সৃষ্টি গ্রহণ করবেন কিনা, তাই নিয়ে কখনো ভাবেনি অজিত, কেবল অনর্গল লিখে গিয়েছে, নিজের মতো করে। প্রবন্ধ, ইতিহাস, রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্ল্যাং, যৌনতা, অজাচার এবং আরও বিভিন্ন বিষয় অভিনবত্বের বৈচিত্রের অতীব বিস্ময়কর গদ্যের স্রষ্টা এবং বাংলা গদ্যের প্রথাগত ধারা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী গদ্য প্রযুক্তির প্রবর্তক অজিত রায়।
.
অবহেলার কথা, সাহিত্যিকদের দ্বারা, নিজেই লিখে গেছে অজিত, এইভাবে, “প্রাতিষ্ঠানিক মসিহস্তীরা এমন কুচুটে হন কেন? আমেরিকা থেকে সুনীল মলয়কে থ্রেট করলেন , 'তুমি কলকাতায় কীসব কাণ্ড করছো, .... মনে রেখো কলকাতা শহরটা আমার, আমি সেখানে রাজত্ব করব।' সুনীলের বন্ধু শক্তি স্বভাবে খুব স্বার্থপর, লোভী আর থুতু-চাটা ছিলেন। সমীর রায়চৌধুরীর চাইবাসার বাসায় গিয়ে তাঁরই টাকায় মাল খেতেন, তাঁরই শালীকে লাইন মারতেন, আবার সেই মানিকজোড় সুনীলশক্তি মওকা পেলেই সমীরকে হেয় করতেন। শক্তি তো দালালি খেয়ে সমীরকে টুপি পরিয়ে বাঁশদ্রোণীর জমিটা চড়া দামে ঝেড়ে দিয়েছিলেন। এটা খোদ সমীরদাই আমাকে প্রথম আলাপের দিন বলেছিলেন। 'যোজন ভাইরাসে'র সুখ্যাতি সইতে না পেরে একবার কলকাতায় মনীশ সিংহ রায়ের বাড়িতে আড্ডা চলাকালীন মদ্যপ হয়ে হঠাৎ কমল চক্রবর্তী বিচ্ছিরিভাবে ক্ষেপে উঠলেন আমার ওপর। সে কী কুৎসিৎ গলাবাজি। এই সেদিনও কফিহাউসে রবীন্দ্র গুহ স্মৃতিচারণের মধ্যে ঘটনাটির উল্লেখ করে বললেন, 'অজিত, ওই একটি জঘন্য ঘটনার জন্য আমি কমলকে আজীবন ক্ষমা করতে পারব না।' কথায় কথায় দিল্লির কথাও বললেন রবীনদা। বললেন, 'চাণক্য সেন আর শিশিরকুমার দাশের মধ্যেও এই কুচুটেপনা লক্ষ্য করেছি।
.
এমনি অনেক উদাহরণ। কেন এমন হয়! চেনা মানুষ দূরে সরে যায়। ওই ঘটনার পর থেকেই বইমেলায় আমি কৌরবের স্টলে যাওয়া ছেড়ে দিই এবং ক্রমশ দূরে সরে আসি। কমলদা প্রতিষ্ঠানের কোনো কেউটে মসিহস্তী নন, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বদরক্তের কণা তাঁর ভেইনে অবশ্যই নিবিষ্ট। বরং মলয়-কথিত 'ধান্দাবাজ' বলেই বেশির ভাগ লেখক স্বীকার করেন। কেন এই পরশ্রীকাতরতা, কিসের এত অহমিকা। এই বৈরীতা এবং অহমিকায় বহু চেনামুখ আমাদের জীবন ও পরিসর থেকে দূরে সরে যান, আমরা কেবল একার মধ্যে একা হয়ে একদিন কুট করে প্লাটফর্মের ভিখিরির মতো মরে যাই।
.
কিন্তু একটা কথা আমায় স্বীকার করতেই হবে, প্রতিষ্ঠানের বাইরে যাঁরা 'প্রতিষ্ঠান, এবং আরও বড়মাপের মসিহস্তী যাঁরা, যেমন সমীর, মলয়, উদয়ন, রবীন্দ্র, সুবিমল বসাক, বারীন, সুবিমল মিশ্র, অরুণেশ, নবারুণ এঁদের কাছ থেকে আমি সদাসর্বদা ভালোবাসা, স্নেহ, এমনকি শ্রদ্ধাও পেয়ে এসেছি। কেবল, এই দুই ঘাটের মাঝদরিয়ায় সন্দীপনের আমার প্রতি কি মনোভাব ছিল, সেটি পাথরচাপা রয়ে গেছে। অথবা, ভজকট। গুছিয়ে মিথ্যে বলার অসামান্য প্রতিভা যাঁদের, সহজে শনাক্তও করা যায় তাঁদের প্রকৃত মনোভাব।”
.
অজিত সম্পর্কে গৌতম মিত্র লিখেছেন, “সময়টা ১৯৮৬।আজ থেকে প্রায় ৩৬ বছর আগের কথা।অজিত রায় ধানবাদ থেকে আমাকে কবিতা পাঠিয়েছিলেন।বেশকিছু কবিতা।আর সঙ্গে কবিতা ভাবনা।জানিনা আর কোথাও অজিত রায়ের কবিতা ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে কিনা!
ঠিক সময়মতো সেই লেখা পৌঁছায়নি বলে আমার পত্রিকায় ছাপতে পারিনি।আজ এতদিন পর সেই লেখা খুঁজে পেয়ে মনে হল, যদি অজিত রায়কে নিয়ে কোনও সঙ্কলন হয়, কবিতা ভাবনা সহ কবিতাগুলো প্রকাশ করা যেতে পারে।
কবিতা ভাবনায় লিখছেন:
'বার বার আলবেয়ার কাম্যু-র কথাটা আবৃত্তি করতে মজা পাই, বল পাই।'
কী সে কথা?
'Art and rebellion will only die with the death of the last man on earth.'
অজিত রায়ও তো নিজের জীবন ও লিখন দিয়ে এই কথাটি-ই বার বার প্রমাণিত করে গেছেন।”
.
‘যুগশঙ্খ’ সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত বাসব রায় অজিত রায়ের লেখালিখিকে বলেছেন অপর সাহিত্য এবং তাঁর বক্তব্য বেশ স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন, “বাসব রায় লিখেছেন : অপর সাহিত্যের জয়”
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এবার সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য হলেন অজিত রায়। ধানবাদের সাহিত্যকার, শহর পত্রিকার সম্পাদক অজিত রায়কে ফেসবুকে বাংলাভাষায় যাঁরা লেখালিখি করেন, সবাই চেনেন বলেই মনে হয়। এই খবরের পাশাপাশি আরেকটি খবর এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, তা হল, সম্প্রতি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক্রম থেকে বাদ দিয়েছে মহাশ্বেতা দেবী, বামা ও সুকীর্থারিণীর লেখা। মহাশ্বেতার দ্রৌপদী গল্পটি বাদ পড়েছে, যার বিষয় ছিল দলিত মহিলার ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। আর দলিত লেখিকাদ্বয় বামা ও সুকীর্থারিণী দেখিয়েছিলেন পুরাণের অন্য টেক্সট। মহাশ্বেতা গোটাজীবনই লিখেছিলেন প্রান্তিক মানুষের জীবনকথা। বাংলায় বামপন্থীদের প্রাধান্য, গণনাট্য, স্বামী নবান্ন-খ্যাত বিজন ভট্টাচার্য, নকশাল আন্দোলন, এই সবকিছুর নির্যাসে মহাশ্বেতার লেখালিখি মেনে নিতে পাঠকের কোনো অসুবিধে হয়নি। জীবৎকালেই মহাশ্বেতা কাল্টের সম্মান পেয়েছেন। ছয় দশকের গোড়ায় যখন হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হয়েছিল বড় পত্রিকাগোষ্ঠীগুলো যেভাবেই হোক একে নস্যাৎ করতে উঠেপড়ে ঝাঁপিয়েছিল। ষাট বছর পর, আজ, হাংরি জেনারেশন-এর সাহিত্যকে আমি ‘অপর সাহিত্য’ বলতে চাই। তখন পর্যন্ত বাংলা গদ্যের ধরন যা ছিল, ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকরা এসে তার ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিল। যৌনতাকে দেখা হল, লেখা হল বিভিন্ন দিক থেকে। বাংলা গদ্যের বিন্যাস, বিষয়, আঙ্গিক বদলে দিয়েছিল ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকরা।
গল্প তো বটেই এমনকি কবিতায় ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকরা নিয়ে এলেন অন্য ভাষা, রূপক, ব্যঞ্জনা। পাঠক, আপনি প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতার পাশে ১৯৬০ পর্যন্ত প্রকাশিত বাংলা কবিতা, জীবনানন্দ দাশকে বাদ দিয়ে, পড়ুন, তফাত বুঝতে পারবেন। তুষার রায়ের কবিতা আর ফাল্গুনীর গল্প পড়লেই ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকদের শক্তি বোঝা যায়। তবু এই আন্দোলন তীব্র আলোড়ন তুলেই বুদবুদে পরিণত হয়েছিল। অপর সাহিত্যকে তখনকার বিগ হাউস, প্রতিষ্ঠিত লেখক তো বটেই পাঠকরাও সাগ্রহে বরণ করেনি। কিন্তু ওই আন্দোলনের ফলে বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সত্যিকারের অপর সাহিত্য।
আজ সুব্রত সেন, রণবীর পুরকায়স্থ, জয়া গোয়ালা (যদিও মৃত), সুবিমল মিশ্র, কৌশিক সরকার, অনুপম মুখোপাধ্যায়, অমিতাভ প্রহরাজ, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়রা যে ভাষায় যে বিষয় নিয়ে লেখালিখি করেন তা হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট না-হলে আমরা পেতাম না। এবং ওই আন্দোলনই বাংলা সাহিত্যের ভূগোলকেও কিঞ্চিৎ এলোমেলো করে দিয়েছিল। যার সার্থক রূপায়ণ এখন দেখা যাচ্ছে। শুধুই কলকাতা নয়, আগরতলা, শিলচর, গুয়াহাটি, তিনসুকিয়া, শিলং, ধানবাদ, শিলিগুড়ি, মেদিনীপুর, দিনাজপুর থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্বমানের লেখালিখি। আর এই অপর সাহিত্যের সার্থক প্রতিভূ হলেন অজিত রায়। তাঁর উপন্যাসের বিষয় দেখুন, যোজন ভাইরাস ছেড়ে দিন, পড়ুন হিরণ্যরেতা, চিহ্নদখলের লড়াই, বহমান নিয়ামকের সেরেস্তা, ঘামলাঘাট...। প্রতিটি উপন্যাসেই উঠে এসেছে প্রান্তিক মানুষের জীবনকথা। যা অপর জীবন। অজিত রায় নিজেও অবশ্য বাংলা সাহিত্যে অপর, কলকাতা তো নয়ই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গও নয়, উঠে এসেছেন বিহার থেকে, এখন অবশ্য ঝাড়খণ্ড। তাঁর লেখা কলকাতার এলিট একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে, এই বিষয়টিকে কে কীভাবে দেখছেন জানি না, আমার কাছে এটি অপর সাহিত্যের মূলস্রোতে প্রবেশ। এবং খুব গভীরভাবে দেখলে বুঝতে পারি, আসলে অজিত রায় নয়, শেষপর্যন্ত ক্ষুধার্ত প্রজন্ম আন্দোলন স্বীকৃতি পেল। জয় হোক অজিত রায়ের।”
.
অজিতকে আরও জানতে হলে ফিল্ম-নির্মাতা অনিন্দ্য সেনগুপ্তকে লেখা ওর এই চিঠিটায় আছে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা, “অনিন্দ্য দত্তকে খোলা চিঠি : প্রসঙ্গ 'বৈতরণী'
-----------------------------------------------------------
প্রিয় বন্ধুবর,
এই সেদিন আলপনাদি, সাহিত্যিক আলপনা ঘোষ কথা প্রসঙ্গে বললেন, অজিত, তোমার বন্ধুভাগ্যটি দারুণ! কথাটা আমি নিজেও স্বীকার করি। না হলে, নিছক 'বন্ধু' শব্দটি নিয়ে আমার কোনো দমভারিতা থাকার কথা নয়। সেইসব বন্ধুদের বন্ধুত্বের বহর এত বড় যে সেগুলি সূচিবদ্ধ মাত্র করলে নিতান্ত উলুপীর মতো স্বার্থপরতার টইটুম্বুর মাইঠালে নৈমিত্তিক হস্তব্যসনের মধ্যে ডুবে থাকা মধ্যবিত্ত ভেতো বাঙালিদের মনে হতে পারে হয় আমি গুলধাপ্পা দিচ্ছি, নয় ঢপ্। যাই হোক, অনিন্দ্য, তুমিও যে আমার সর্বময় প্রিয় বন্ধুদের একজন, বিশ্বাস করো বা নাই, তুমি কিন্তু আমার ঐ সাতাশী জনেরই এক। মেনে নিতেই হবে এমন নয়, কিন্তু তুমি তাই। ছয় মাস বিপণ্ন ও বিপর্যয়কর জীবন যাপনের মাঝে আমি একটি শব্দও লিখতে পারিনি, এবং কয় সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন লিখতে বসি, কাগজে অথবা কম্পিউটারে, পারিনি এক বর্ণও। তবে আমি নিশ্চিত এই রাইটার্স ব্লক কাটিয়ে উঠব। কিন্তু, যেটা আরও কষ্টের, এই ছয় মাসে বহু বন্ধু তাঁদের বই, লেখার পিডিএফ, ছবি, কবিতা ইত্যাদি পাঠিয়েছেন সামান্য-কিছু মন্তব্যের আশায়, সেক্ষেত্রেও আমি প্রত্যেককে নিরাশ ও দুখী করেছি। তেমনি, অনিন্দ্য, তুমি, বহুদিন হলো তোমার পরিচালনায় তৈরি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি 'বৈতরিণী' পাঠিয়েছিলে এই উজবুককে, সেই লিংক খুলে দেখার সামান্যতম তষ্টিও আমি পাইনি। কিন্তু ইদানিং তোমার তরফ থেকে বারম্বার ধমক, শব্দফেরে খোঁচা খেয়ে-খেয়ে, আর-না-পেরে, শেষমেশ ছবিটি দেখেই ফেললাম। না বললেও, তুমি অন্তত জানো, সিনেমা দেখার ব্যাপারে, মানে দর্শক হিশেবে আমি একজন উচ্চ পর্যায়ের নির্বোধ। তবু, তাকেও তুমি রাজার এই পাট দিয়েছো। বেশ। তাহলে দু-চার কথায় আমার বিশ্লেষণ সারি। মিথ্যে না-বলে বলি, আমি তোমার কিছু লেখা অবশ্যই পড়েছি, 'শহরে'ও বেশ কয়েকটি লেখা তুমি লিখেছো, কিন্তু পরিচালক হিশেবে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় এই প্রথম। তোমার প্রকৃত এরিনা, অর্থাৎ সিনেমা, সেখানে তোমার পক্ষীচক্ষু ভেদ করার কেরদানিটিও এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম। তা বলে, গোড়াতেই একশো দিয়ে দিলাম তা মনে করার কারণ নেই। বরং, ছবিটির শেষ সীনটা না-আসা অবধি লাগাতার আয়ুধই জমা হচ্ছিল মনে। তারপর, ক্রমে-ক্রমে আবিষ্কার করলাম, বুদ্ধিজীবী বাঙালির প্রাত্যহিক ডামাডোল, হতাশা, নিরাশা, বাঁচাহীনতার এঁড়েল স্তূপ থেকে ক্রমে ক্রমে পাখিরূপী অপরূপ এক কবিতা উঠে আসছে নিরান্দীয় ধুলো ঝেড়ে। এ ধরনের ছবি পুরোটাই একটি কবিতা হয়ে উঠতে পারে, গল্প তো হয়েই ওঠে। কিন্তু তুমি সেই কবিতা, কিংবা ঐ একখণ্ড গল্পের সলতেটুকু পাকিয়ে জীবনমুখী এক দেউটি জ্বালালে, পরিচালক অনিন্দ্য দত্ত। অতি কম সাধ্যে, হৃদের সাধ-মাত্র-দিয়ে, স্বল্প দৈর্ঘ্যে বৃহত্তর জীবনের বার্তা হয়ে উঠল বৈতরণী। আরও সূক্ষ্মভাবে বললে, একটি নির্বীয়মান শিখার ধিমি-ধিমি বেঁচে ওঠার কবিতা হয়ে উঠল তোমার এই 'বৈতরণী'। জানি, এক্ষেত্রে অনেকেই অনেকের নাম নেবেন, বিশেষত ফেলিনি; বাংলাও হয়ত কবিতাশ্রয়ী বেশ কিছু ছবির নাম উঠে আসবে, কিন্তু আমি আমার দেখা দুটি ছবির কথাই এখানে উল্লেখ করবো ---- অপর্ণা সেনের 'থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন', এবং, শর্মী পান্ডের 'এবং ফলগুনী'। হ্যাঁ, অন্তত বাংলায়, 'বৈতরণী' সেই পর্যায়েরই এক নির্মাণ। কবিতা যে সৃষ্টিশীল মানুষের এত কাছের, বরং, এত গভীরের, এই ছবি তাই বোধ করিয়ে দিল এই নির্বোধকে। আবার বলছি, ছবিটির লিংক বহুদিন আগেই পাঠিয়েছিলে অনিন্দ্য, দেখার গা হয়নি, যেহেতু মূল চরিত্রে সৌমিত্র। না, ভুল লিখলাম না। বিগত দশ-পনেরো বছর ধরে সৌমিত্রবাবুর যে-কটি ছবি দেখেছি, অভিনয়ে সুদক্ষ তিনি তবু তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্ব তাঁর আলাদা-আলাদা চরিত্রগুলির সম্যক ফুটে ওঠার ক্ষেত্রে বাধ সেধেছে। এটা একান্তই এই অধমের ব্যক্তিগত অনুগাম, পাত্তা দিও না বিশেষ। যাই হোক, ঐ প্রখর ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর বার্ধক্যজনিত একই প্যাটার্নের অভিনয়ের পৌনঃপুনিকতার কারণেই, সম্ভবত, গোড়ার দিকে তোমার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছবিটির প্রতি আমি কোনো আকর্ষণ ঘটেনি। এত দীর্ঘ ব্যবধানে, কেবলমাত্র বন্ধুর বারম্বার ঠেলা ও খোঁচায় শেষমেশ দেখা হয়ে গেল। ছবি দেখার ব্যাপারে আমি যে সত্যিই মিসফিট, বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু একজন সৃষ্টিশীল মানুষের চোখ আমি ধারণ করি। যে কারণে বেশ কিছু উন্নতমানের ছবি আমায় আজও লেখায় উদ্দীপিত করে। তোমার ছবির কম বাজেট এবং অল্পদৈর্ঘ্যতা অবশ্যই মাথায় ছিল, কিন্তু আমি সারাক্ষণই ভাবছিলাম কোথাও কোনোভাবে যেন ছবির কয়েকটি অংশ-অন্তত অংশত ভালো লেগে যাক, যেহেতু তুমি মধ্যখানে। হুজুর, জানাইয়া ফেলি, আমি ভ্রষ্টবুদ্ধি নহি, কালেচক্রে নিজ বাপকেও খিস্তি করিতে পারি। খিস্তির প্রচুর আঁওবাঁও খুজলাম, পেয়েছিও কিছু কিছু। যেমন, প্রথম দৃশ্যে মনেই হলো না বৃদ্ধ নিস্তেজ কবি সৌগত রায়চৌধুরী এন্ট্রি নিলেন, যিনি এলেন, তিনি প্রত্যহ টিভির স্ক্রিনে সেই একই ভাবে আসেন, আসতেন। সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল প্রাথমিক দৃষ্টে। এছাড়া, তুমি হয়ত অন্যভাবে ভেবেছিলে, কিন্তু যা হয়ে উঠেছে, এখানে ভৌতিক গল্পের অনুষঙ্গ হয়ত আছে, কিন্তু ব্যবহারে তা মার খেয়েছে। পরে বুঝলাম এটি আদৌ কোনো অকালমৃতা বালিকার মিথ বা বৈতরণী পার হবার কাহিনীই নয়, এ আসলে লাটভাঙা থাম থেকে খসে বেরিয়ে আসা ন্যাতপেতে, বিদ্ধস্ত ও বিষণ্ণ এক বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবীর ইগোর পরাজয়, এমনকি 'মৃত্যু'-ভয় ও হাহাকারের বস্তুবিসার। পরিচালক হিশেবে এক্ষেত্রে তুমি যথার্থই সার্থক। লেন্সের ভাষায় কোনো চমক নেই, কিন্তু রয়েছে এক সুদক্ষ মুনশিয়ানা। সৌগত রায়চৌধুরীর মূক অসহায়তা বিমূর্ত ভাস্কর্যে লীন হয়ে মানিপ্লান্টের মতো ডালপাত সমেত চারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অলিন্দের রুদ্ধ প্রকোষ্ঠে। আর ম্যাজিক রিয়ালিজমের কতিপয় দুরন্ত শট। সব মিলিয়ে তোমার বৈতরিণী শিল্পের ওপারের ঘাট ছুঁয়ে ফেলেছে। যদি পারো, অনিন্দ্য, নির্বোধ বন্ধুর এই অপারক রিভিউ হজম করো। বাকি তো রইলই, মুষ্টিফোনে বাকযুদ্ধ।”
.
অ্যালেন গিন্সবার্গ সম্পর্কে অজিতের এই গদ্যে বস্তুত অজিত রায়কেই আমরা খুঁজে পাই, “বন্ধুবর বাসব রায় পর-পর তাঁর দুটি পোস্টে জামিল, মলয় এবং বিশেষত গিন্সবার্গের জিগির তুলে আমায় উস্কে দিলেন কিছু লিখতে, বিশেষত সেই গিন্সবার্গ বিষয়ে। যদি বলি মার্কিন দেশের যীশু অ্যালেন গিন্সবার্গ, অতিরেক হলো কি? বুদ্ধের আবির্ভাবের মতোই আশ্চর্য কবিতাক্ষেত্রে তাঁর আগমন। আশ্চর্য, কেননা তিনি জন্মেছিলেন ---- তৃতীয় বিশ্বের কোন খোঁড়া দেশে নয়, ---- আমেরিকায়। এরিস্টটল থেকে এ অব্দি 'কাব্যাত্মক ন্যায়' নিয়ে বড়ফড়াঙ্গি চলে আসছে, কেউ কি ভেবেছেন সাহিত্য-ব্যাপারে একটা 'অন্যায়'ও দগদগ করে পাশাপাশি? যাঁরা গেঁতো, 'স্থা'-বাসী, তাঁরা কিছুতেই কবুল করেন না যে সমাজের সর্বস্থানে যেরকম অশুভ ও অশুদ্ধতা চলছে, সেখানে সাহিত্যেও আর 'শুভ' বা 'শুদ্ধতা' আশা করা যায় না। বাসববাবু ঠিকই বলেছেন, যাঁরা আজ সত্যিকারের সৃষ্টিশীল সাহিত্য করছেন, খেয়াল করবেন শব্দের ব্যবহার, ডিসকোর্স, সংকেত, প্রতীক, চিত্রকল্পে তাঁরা আমূল-চুল বদল ঘটিয়ে ফেলেছেন, বা তাঁরা সেই বদলের পক্ষপাতি। এই যে স্থা-বিরোধিতা, বা প্রতিষ্ঠানবিরুদ্ধতা, এটা আসলে একটা আবহমান লড়াই। 'যা চলছে' আর 'যা হওয়া উচিত'-এর নিরন্তর নিরলস সংগ্রাম। যা খদ্দরী প্রজাতন্ত্র, খাঁকি মিলিটারিতন্ত্র, লাল-কম্যুনিস্টতন্ত্র বা তিমূলতন্ত্রের কাছে তুমুল অবাঞ্ছিত ও তিরস্কৃত ধ্বনি। আর সেখানে, সেই ওয়াশিংটনের কথাই বলছি, কবিতা নয় ---- রয়েছে একটা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক বেনিয়া কনসেপশন, যা বিশ্ব-রাজনীতিকে জমা-খরচের নিক্তিতে পরখ করে বাজারে ছাড়ে। সম্ভবত এই কারণেই আমেরিকা ভালো কবিকে জন্ম দিয়েছে খুব কম। ওয়ালেস স্টিউইংসের দেহরক্ষার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর লেখনজগতে একা গিন্সবার্গই সেই বিরল অস্তিত্ব, 'হাউল'-সূত্রে বারংবার উচ্চারিত যাঁর নাম।
.
মহাকবি গিন্সবার্গ সম্পর্কে প্রথম পড়ি মলয় রায়চৌধুরীর বদান্যে। অতঃপর আমার জেএনইউ-প্রোডাক্ট সাংবাদিক বন্ধু পলাশ বিশ্বাসের মুখে, বিশদে। জানতে পারি, প্রতিভাবান, মেধাস্পৃহ এই হীরে বাঙালির জ্ঞানের আলোয় আসেন, তাঁর উত্তরণের যখন সবে হাতেখড়ি, প্রায় তার সমসময়ে। প্রায় আড়াই দশক ধরে তাঁর সঙ্গে বাঙালির সবিমুগ্ধ আলাপচারিতা। বহির্বিশ্বে একমাত্র বাঙালিকেই তিনি পেয়েছিলেন একান্ত আপন করে। অনেক বসন্ত দেখেছিল বাঙালি তাঁর পাশাপাশি ---- বন্ধুত্বের অনাবিল আনন্দে।
.
বাঙালির খ্যাপামিই সেই অমোঘ সূত্র-রজ্জু যে-কারণে গিন্সবার্গকে বাঙালি টানতে পেরেছিল। পাগলামি বা খ্যাপামি বাঙালির মজ্জাগত। জীবনের প্রত্যেক অংশে প্রত্যেক বাঙালিই কোনো না কোনভাবে আকুলতায় জড়িয়ে আছে। এই পাগলামি আসলে সেই সাধনা সেই সব্বনেশে প্রেম সেই প্যাশন যা এক সৃষ্টির থেকে আরেক সৃষ্টির পানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় রবীন্দ্রনাথকে, এক আরম্ভের থেকে আরেক আরম্ভের দিকে ছোটায় বিনয় মজুমদারকে, এক মানুষের থেকে আরেক মানুষের দিকে ঠেলে দেয় ঠাকুর রামকৃষ্ণকে। বাঙালির বেঁচে থাকার অবলম্বনই এই পাগলামি। ইন্টার-ডিসিপ্লিনারির চতুরন্ত টপকে বাঙালি এখন সারা বিশ্বের উঠোন দাপাচ্ছে। রাজনীতি, খেলার মাঠ, সাহিত্য, সিনেমা, গান, বইমেলা, লিটল ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, চতুর্দিকে বাঙালির ধুমা অ্যাটাক। সর্বত্র তার বুম্বাচাক! থিওরি অব কেঅস। যুক্তিভাঙার নেশামাত্রে মন মানছে না বাঙালির। এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। হয়ে যাক পাগলামির নতুন দখলতি। হুররে!
.
মার্কিন খ্যাপাদের সূচি শুরু হয়েছে সম্ভবত গিন্সবার্গের নাম দিয়ে। কী খ্যাপামিতে কী কবিত্বে তাঁর আমোঘতা পরম নিন্দুকেও স্বীকার করেন। শরৎ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, "একদিন খবর পাওয়া গেল, দু'জন আমেরিকান কবি কলকাতায় এসেছে। .... গিয়ে দেখি, প্রায় আসবাবহীন একখানা ঘরে দু'জন সাহেব এসেছে সত্যি। তাদের একজন থুপথুপ করে কাপড় কাচছে কলঘরে, অন্যজন ছুরিতে তরিতরকারি কুটছে। পরনে আন্ডারওয়্যার, খালি গা ....।" ইনিই অ্যালেন গিন্সবার্গ। নামটির সঙ্গে ল্যাজেমুড়ে জুড়ে রয়েছে 'বিট' কথাটা। ভিড়ের মধ্যেও বিটবংশকে শনাক্ত করা দুষ্কর নয়। "মেয়েরা পরে কালো মোজা, লম্বা চুল রাখে, লিপস্টিক মাখে না, আর পুরুষেরা রাখে দাড়ি আর ঘাড় বেয়ে নামা লম্বা চুল, তীব্রতম শীত ছাড়া টুপি কিংবা ওভারকোট পরে না; জামা জুতো বা দেহের পরিছন্নতা-সাধন তাদের হিসেবে অনাচার।" (বুদ্ধদেব বসু) এই বংশের আদি কবি জ্যাক কেরুয়াক। অ্যালেনের, অর্থাৎ কেরুয়াকের পরেই যাঁর স্থান এবং যিনি এই উন্মুখর আন্দোলনের স্রষ্টা, তিনি মোটেও লম্বা ছিলেন না, বরং যথেষ্টই বেঁটের দিকে, ছিপছিপে শরীর, গায়ের কালার হলদে ঘেঁষা ম্লান, চোখে চশমা, নেহাৎ 'ভদ্রলোকে'র মতোই দাড়িগোঁফ কামানো, পরিষ্কার সিঁথি-কাটা চুল কিন্তু মাথা নোয়ালে অল্প টাক। অর্থাৎ চেহারায় শাস্ত্রসম্মত লক্ষণ একটিও নেই, যদিও পালিশহীন জুতো, ইস্ত্রিহীন প্যান্ট আর গলা-খোলা কোর্তায় গোষ্ঠি-চেতনার ছাপ স্পষ্ট। ---- এই হলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ।
.
কিন্তু একটা কথা। গিন্সের সঙ্গে 'বিট' লেবেলটা সাঁটা থাকলেও, তিনি কিন্তু একেবারে আলাদা খাতের কবি। কোন নির্দিষ্ট খেপের মোহর দেগে তাঁকে চালানো যায় না। গিন্সবার্গের শেষ দিকের কবিতাগুলো দেখলে মনে হবে তিনি বিট কবিই নন, বরং আপাত বিটতন্ত্র-বিরোধী। আসলে, একটা 'হুজুগ' হিশেবে সূচনা ঘটেছিল বিট-আন্দোলনের। এবং ফেরলিংগোট্টি থেকে শুরু করে কেরুয়াক, গিন্সবার্গ এবং গ্রেগরি করসো প্রমুখ ব্যতিরেকেও হাঙ্গামার কাল জুড়ে ছিলেন কামিংস, মিলার, নরমান, গুডম্যান প্রমুখ। আন্দোলন ষাট দশকের পয়লাভাগে ছড়িয়ে পড়েছিল বার্লিন, পারি, কোপেনহেগেন প্রভৃতিতে। এবং যদি বলা বেশি না ঠেকে, বলতে পারি, তারই একটা ঢেউ গিন্সবার্গ ও তাঁর সগোত্ররা এনে আছড়েছিলেন বাংলা কবিতার তটভূমিতে, হাংরি আন্দোলন যার অনিবার্য বাই-প্রোডাক্ট। যাই হোক, এখানে বলার কথা, বিট-আদর্শ ও বিট-ধর্মের মিল কোন-কোন ক্ষেত্রে, গিন্সবার্গের কবিতায়, নেই-ই। গিন্স শেষবয়সে বুঝেছিলেন, হিটলার ব'নে পুরো গ্লোবটাকে দাপানো সহজ, কিন্তু 'আজ' (সেই বিশ শতকের শেষপাদে) 'রিভোল্ট' করে সফল হবার সুযোগ নেই। তাই, বিট পোয়েট্রি বলতেই যে দুরন্ত বেলাগাম গতির কথা মনে পড়ে, যিনি খোদ বিট আন্দোলনকে এইভাবে পরিচিত করেছিলেন এবং হাঙ্গামাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ---- সেই গিন্সবার্গের দুরন্ত প্রবহমান জীবনস্রোতের মধ্যবর্তী বিন্দুতে দণ্ডায়মান থেকেও, শেষাবধি মনে হয়েছে :
"... all movement stops
and I walk in the timeless sadness of existence,
Tenderness flowing three the buildings
My fingertips touch reality's face."
.
গিন্সবার্গ ছিলেন রাজনীতিক চেতনার মানুষ। এবং সেক্ষেত্রে কোনরকম আপোষের তেল গায়ে মাখেন নি। তাঁর সাফ কথা : "রাজনীতির কর্কশা ছবির মধ্যে কোথাও না কোথাও তার একটা মুদ্রা এমন আছেই, যেখানে স্রেফ কবিতা, কবিতা আর কবিতাই কামান দাগতে পারে।" এই চেতনা থেকেই তিনি, মার্কিন গবরমেন্টের বিখ্যাত কাস্টমস বিল্ডিংয়ের বলতে গেলে পাশেই অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের সভাগারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে পাঠ করেন তাঁর কবিতা :
"স্বর্গ যদি হয় তবে ঠিক এইরকম ---
উচ্চ আদালতে থাকবে না কোন বুদ্ধ
না রিপাবলিকান, না ডেমোক্র্যাট ..."
.
মৃত্যুর আগে একদশক তিনি কবিতায় টার্গেট করেছিলেন হোয়াইট হাউসকে। সেই হোয়াইট হাউস, যেখানে রয়েছে সিআইএ-র বাজেট, জার্মান মাথাব্যথা, সৈন্যদের লুকোনো দূরভাষী যন্ত্র আর এফবিআই-এর ছারপোকা। আমেরিকান শাসনতন্ত্রের গুঁজে দেয়া পিলপিলে বিষয়টাকে 'রাবণ' ঘোষণা করে আমেরিকান প্রয়াসকে নাম দিয়েছিলেন 'রেগনের থিইস্টিক প্যারোনিয়া'। এহেন সাহস আর কোনও আমেরিকান কবির ছিল কি?
.
বিদ্রোহ করেছিলেন গিন্সবার্গ, কিন্তু বিদ্রোহই তাঁকে 'প্রতিষ্ঠিত' করে ফেলল। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে 'হাউলে'র। আড়াইশোর বেশি ডলার ঢুকেছে ফি মাসে, তাঁর পকেটে। এখনো 'বিদ্রোহী' বলা যাবে কি তাঁকে? অথচ তিনি আজও আমাদের নমস্য। নমস্য ও শ্রদ্ধেয় তাঁর অনন্য মানব-কবিতার কারণে। এই সেই কবি যিনি শোনাতে পারেন :
"I saw the best minds of my generation destroyed
by madness, starving hysterical naked." (Howl)
.
"A bitter cold winter night
Conspirators at cafe tables
discussing mystic jails."
(Planet News)
.
হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বম্ব ফাবড়ানো হলে তিনি কি 'গান্ধীবাবা'র ভূমিকায় নেমেছিলেন? যদ্দূর শুনেছি, তিনি তখন থেকেই 'হোলিম্যান'। এমনিতে মার্কিন দেশে হোলিম্যান হওয়াটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। তামাম কলপূর্যা তো তেনাদেরই হাতে। ওঁরা সেই 'পাওয়া' আর 'ভোগে'র যথেচ্ছাচার থেকে রেহাই পেতে হোলিম্যান হতেই পারেন। কিন্তু না, অ্যালেন ওঁদের দলে নন। 'রিয়ালিটি স্যান্ডউইচেস' (১৯৬৩) থেকে শুরু করে হারপার অ্যান্ড রো প্রকাশিত তাঁর '৪৭ থেকে '৮০ সন অব্দি লেখা তাঁর সমস্ত কবিতা সংগ্ৰহ, তাঁর জার্নাল, চিঠিপত্র আর ক্যাসেটবন্দী সাক্ষাৎকার অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে শাস্ত্রীয় সভাগারে তাঁর মত ব্রাত্যজন জন্মেছেন খুব কমই।
.
বুদ্ধ, চৈতন্য আর রামকৃষ্ণর ভারতভূমিতে বাষট্টি সাল নাগাদ অ্যালেন, তাঁর বন্ধু পিটার অৱলভস্কিকে সঙ্গে নিয়ে, 'ঈশ্বর' খুঁজতে আসেননি। অধিকন্তু, এই ভাষাদেশের মরচে পড়া মানুষগুলোকে একটু চনমনিয়ে দেবার ঘোর সদিচ্ছা নিমতলা শ্মশানঘাট, খালাসিটোলা, চাইবাসা আর কাশীর পথে ঘাটে মাঠে ঘুরিয়ে মেরেছে তাঁকে। একটা কিছু গড়ে তোলার ছটফটানি তাঁকে তিষ্টতে দেয়নি একদণ্ডও। মানুষের জীবনটা দিশা না পেয়ে পুরো ভগ্নস্তূপে বদলে যাওয়ার আগেই তিনি সেটা চাইছিলেন। এটাও স্বীকার করা ভালো, যে, অ্যালেন বা বিট মানেই 'তছনছ' 'ডিস্টার্ব' 'ডেস্ট্রয়' বা 'নিছক যৌনতা' নয়। কেননা তিনি জানতেন কামশাস্ত্র-কোকশাস্ত্র সহ বাংলা ভাষায় বহু সুড়সুড়িবিদ প্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের বইয়ের গরুর গাড়ি বোঝাই সংস্করণ বাজারে গিজগিজ করছে। তিনি যে সম্পূৰ্ণ ভিন্ন ঝড় বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন ---- 'হাউল' তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
.
এখানে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই 'কৃত্তিবাসে'র সেই সংখ্যাটা (১৯৬৩, মার্চ), গিন্সবার্গের তোলা একটি ফোটোগ্রাফ ব্লক করে ছাপা হয়েছিল যাতে। ছবিটা অ্যালেনের শুধু হাত নয়, চোখ মাত্র নয়, মনেরও যুৎসই ছাপ ফুটে উঠেছিল। দোমড়ানো জীর্ণ একটি ফ্রকপরা মেয়ের ---- যাকে নিয়ে ব্যবসা চালানো হচ্ছে ---- আধশোয়া আধন্যাংটো ছবি। কভারে বোল্ড হরফে 'কৃত্তিবাস' এমত ঘোষণা করতে পেছপা হয়নি, যে, "তীব্র উদাসীন উন্মত্ত ধীমান ক্রুদ্ধ সম্ভ্রান্ত ক্ষুধার্ত শান্ত বীটনিক ভয়ংকর মগ্ন চতুর সৎ ভূতগ্রস্ত ধার্মিক ও অতৃপ্ত কবিদের ব্যক্তিগত রচনা, কবিতা ও বিস্ফোরণ।" বলা বেশি, ওই সংকলনেই কৃত্তিবাসের লেখক-কবিরা পহেলি-বার, যাকে বলে, মুখ খুললেন। মুখ খোলালেন মহাকবি অ্যালেন গিন্সবার্গ।”
.
একবার অজিত রায়কে জিগ্যেস করেছিলুম, “"অজিত, একটা কথা জানবার ছিল। নারীর যৌনতা নিয়ে লেখার সময়ে তুমি কি তার প্রেমে পড়ো ? এমন হয়েছে কি, যে লিঙ্গ দাঁড়িয়ে গেছে?"
তার উত্তরে অজিত জানিয়েছিল, “প্রশ্নটা আমার কাছে মোটেই অস্বস্তিকর ছিল না। জবাবে লিখেছিলাম, মলয়দা, তুমি ভদ্দরলোকদের মতো 'লিঙ্গ' লিখেছো কেন? 'বাণ্ড' বললে কিচাইন হবার চান্স বলে আমি সরাসরি নিজের ভাষায় নামি। 'বাঁড়া' সহজবোধ্য, স্বয়ংসিদ্ধ ও সর্বত্রগামী শব্দ। আধুনিক বিশ্বকোষ প্রণেতা বাঁড়ার নামকরণ করেছেন 'আনন্দদণ্ড'। নামটা খাসা। তবে, অনেকে বলবেন 'মদনদণ্ড'। 'সাধনদণ্ড' বলেও সুখ। কিংবা 'কানাই বাঁশি'। কলকাতার রকফেলার আর হাফ-লিটারেট গবেষকরাও এই যন্তরটিকে নিয়ে কম মেহনত করেননি। 'কলা' 'ডাণ্ডা' 'রড' 'কেউটে' 'ঢোঁড়সাপ' 'পিস্তল' 'যন্তর' 'ল্যাওড়া' 'ল্যাও' 'লাঁড়' 'লন্ড' 'মেশিন গান' 'মটনরোল' 'ঘন্টা' 'ঢেন্ঢেন্পাদ' 'খোকা' 'খোকার বাপ' 'ধন' ' নঙ্কু' 'পাইপ' 'তবিল' 'পেনসিল' 'ফাউন্টেন পেন' 'মেন পয়েন্ট' ---- আরও কী কী সব নাম দিয়েছেন ওই প্রতাপী মহাপ্রাণীকে সদা উজ্জীবিত রাখতে! বিহার-ঝাড়খণ্ড-ইউপিতে 'ল্ওড়া' আর 'লন্ড' সুপার কোয়ালিটির স্ল্যাং, যা পূর্ব ভারতের সর্বত্র একই কিংবা খানিক বিকৃত উচ্চারণে ব্যবহার হয়ে থাকে। বাঙালি জবানে সেটা হয়েছে মিনমিনে 'ল্যাওড়া' 'ল্যাউড়া' 'ল্যাও' আর 'লাঁড়'। কিন্তু বাংলার নিখাদ 'বাঁড়া' বিহারে বোঝে না, পাত্তাও পায় না। ওপার বাঙলায়ও সর্বত্র বোঝে কি? ডাউট আছে। খোদ বর্ধমান আর বীরভূমেই বাঁড়াকে বলে 'বানা'। কুমিল্লায় ধনকে বলে 'দন'। কুমিল্লা, ঢাকা আর খুলনায় 'চ্যাট' শব্দটাও চলে। ময়মনসিংহে যেটা হয়েছে 'চ্যাম'। সিলেটেও 'চ্যাম'। সিলেটে আবার 'বটই'ও বলে। বাকরগঞ্জে 'চ্যাড' 'ভোচা'। বাকরগঞ্জের মোক্ষম স্ল্যাং হলো 'মদন কল'। 'ভোঁচান' আর 'ভুন' বলে রাজশাহীতে। এছাড়া রয়েছে 'ভুন্দু' 'ভুচা'। 'বিচা' বলে ঢাকা, কুমিল্লায়। কুমিল্লায় ফের 'শোল'ও বলে। বলে, 'নসকা'। 'সাঁও' বলে ফরিদপুরে, ময়মনসিংহে। 'প্যাল' আর 'বগা' চলে ময়মনসিংহ, রাজশাহী আর সিলেটে। চাঁটগেঁয়েরা বলে 'ফোডা'। যশোরের 'পাউন্ড' এসেছে খুবসম্ভব 'পিণ্ড' থেকে। 'বাচ্চা' বলে পাবনায়। 'পক্কি' চলে খুলনা, ফরিদপুর আর ময়মনসিংহে। 'পক্কু' শিশুদের শিশ্ন, এ-বঙ্গে যেটা 'নোঙ্কু' ব 'চেনকু' কিংবা ঝুটমুট 'পক'। ময়মনসিংহে বাঁড়ার অপর নাম 'থুরি'। আরেকটা প্রতিশব্দ 'শুনা' কুমিল্লায় চল আছে। চট্টগ্রাম আর নোয়াখালিতে বলে 'সনা'। আসলে, 'সোনা'। কেউ কেউ বলে সোনা, সোনামণি। মদনার বউটা ভোরবেলা আদর করে টুলস দিত, --- ও জামাই, ওঠো, জাগো। শ্বশুরবাড়ি যাবা না? শ্বশুরবাড়ি ছিল ওর ওইটে, আর জামাই ছিল মদনের এইটে। শ্বশুরবাড়ি ভোগে গ্যাচে, ফলে এ ব্যাটা হামানচোদা জামাই এখন ঢোঁড়সাপ হয়ে স্রেফ জাবর কেটেই খালাস। 'জাবর কাটা' বোজো তো? একষট্টি-বাষট্টি। মানে, খুচরো গোনা।। মানে, হাতলেত্তি। মানে হ্যান্ডেল করা। সকলেই নাকি করে। মদনাই বলছিল, 'মেয়েরা আঙুল করে, শুনিচি বেগুনও করে।' সত্তিমিত্তে জানিনে বাপু।ভালো কথা। আরও একটা শব্দ যোগ করি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা মলয়দার এই 'লিঙ্গ'কে বলে 'লিকাম'।তো খালিপিলি এই লিকাম লইয়া পুরুষ কী করিবে? লিখিবেই বা কেন, আঁকিবেই বা কোন আহ্লাদে! ব্যাংক তাহার অচল যদি তার বাঁড়ার উপযুক্ত একটি পার্স না থাকে। বলছি, যেহেতু, বলছি আমাদের চালুচরকি সমাজের দিকে একপাক ঘুরে তাকাও, হালিতেই চোখে পড়বে যৌনতা। এ সমাজে যৌনতা মানে কিন্তু নারীক্ষেত্র। পুরুষ গৌণ। বেচছে ছাতু, দেখাচ্ছে নারীর বক্ষপট। পটকা, টিভি, মোবাইল, ভটভটির কথা না-হয় ছেড়েই দাও, ----- অপথ্যপথটি বাদে সেখানে নারীদেহের সব পার্টসই হাজির। বলে রাখি তোমায়, তুমি জানো, আমার সমস্ত উপন্যাসেই 'নারী' পুরুষের ইন্টেলেক্ট থেকে আঁকা। কিন্তু একজন বখাটে খানাখারাব হলে কি নারীদেহের মহার্ঘ পার্টসগুলোকে আমি অন্য চোখে দেখতাম? হয়ত, একদমই না। এ ব্যাপারে ভদ্দরলোক বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা। মাথার শিরোজ থেকে গোড়ের পদরজ, একটা হোলদামড়ি নারীর কী-ই না ভাল্লাগতো কালিদাসের! তবে আমার-মতো উনি কতখানি সাধুলোক ছিলেন, খটকা আছে। সাধুমণ্ডলে নারীর অষ্টোত্তর শতনাম। শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী ----- এসব তো মানুষের নিজস্ব এলেমে হয়নি, খোদ বিশ্বকর্তা নিজের হাতে গড়ে দিয়েছেন। ফের এদের মধ্যে শঙ্খিনী আর পদ্মিনী হলো 'আইটেম' বিশেষ। তেনার 'অন্তিমের মার'ও বলতে পারো। একা তুমি কেন, বাইবেলেও বলেছে, নারীই বিধাতার শেষ সৃষ্টি। 'হে শুভদর্শনা', অশোক ফরেস্টে সীতাকে দেখে রাবণ কেলিয়ে গিয়ে বলছেন, 'আমার মনে হয় রূপকর্তা বিশ্বনির্মাতা তোমায় রচনা করেই নিবৃত্ত হয়েছেন, তাই তোমার রূপের আর উপমা নেই।' অথবা, ঈভার প্রতি মিল্টন : 'ও ফেয়ারেস্ট অফ ক্রিয়েশন, লাস্ট অ্যান্ড বেস্ট / অফ অল গড'স ওয়র্কস'।
বাংলা সাহিত্যেও নারীর উপমা যে একেবারেই নেই, সেটা বললে বাওয়াল হবে। তবে আমি আমার কথাই বলব। 'যোজন ভাইরাসে' কমল রানীর বুকে কান পেতে শুনেছে সমুদ্রের কলকল। নারী সমুদ্র ছাড়া আর কী, বলো! হোক নোনা। কিন্তু নোনা থেকেই লোনা। লোনা থেকে লবণ। লবণ থেকে লাবণ্য। কত নুন খেয়েছো রানী! সব নুন কি তোমার দেহে? আর খেয়ো না। এতে সৌন্দর্য হারায়। অবিকগুলি খসে-খসে সহসা খোয়ায়। সত্যি, এক বিশাল মহাযোনি পয়োধি এই নারী। আর পুরুষ কেসটা হলো, অই উষ্ণু মাংসল অলীক পাথার-কিনারে বাল্বের ছেঁড়া ফিলামেন্টের মতো অধীর কাঁপুনি সহ দাঁড়িয়ে থাকা পৌনে ছ'ফুট লম্বা একটা হাইটেন্ডেড ও ব্যবায়ী পুরুষাঙ্গ মাত্র। মাইরি একটা কথা কী জানো, খুব কৈশোর থেকে একজন পুরুষ তার যৌন-অহংকার নিয়ে তিল-তিল করে গড়ে ওঠে, স্রেফ, একজন নারীকে জয় করবে বলে। কিন্তু সে কি সেই কাঙ্খিত নারীকে পায়! পরিবর্তে যাকে পায়, তারও তল পায় না। কী যে চায় মৃণা, মহা ধাঁধা। একেক সময় মনে হয়, কী যেন খুঁজছে, অবিরত। ওফ, টস করেও বোঝা দায় এই মেয়ে জাতটাকে। একেক সময় খটকা জাগে,নারী এক হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক শিল্প। নারী মৃত্যুর বিজ্ঞান। ডেথোলজি। আচ্ছা, এ নারী কে? এ দিনে এক, রাতে আরেক! এ নারীকে সত্যিই আমি চিনি না। পরিচিত দায়রার যথেচ্ছ-নারীর কাছে কোনোকালেই বিশেষ যাচনা ছিল না আমার। আমি এমন নারী খুঁজিনি যে শুধু ঘুমোতে আগ্রহী বা গামলা-ভরা খাদ্যে। নারীকে নারীর মুখ বা নারীর চোখ মাত্র আলাদা করে চাইনি, কেবলি। চেয়েছি টরসো মূর্ধা সৃক্ক নোলা কল্লা সিনা রাং নিতম্ব পয়োধর নাভি যোনি নবদ্বার সম্বলিত একটি পূর্ণাবয়ব নারী, যাকে স্পর্শ মাত্রের লহমা থেকে শব্দের স্রোত ধেয়ে আসবে বেবাক এবং প্রতিরোধহীন। স্ব-পরিচয়হীনা, জন্মহীনা, ইতিহাসহীনা, নিয়তিহীনা সেরকম কোনও নারী আজও আমার উপজ্ঞার বাইরে রয়ে গেছে। দ্য বেস্ট রিলেশান বিটুইন আ ম্যান অ্যান্ড আ উওম্যান ইজ দ্যাট অফ দ্য মার্ডারার অ্যান্ড দ্য মার্ডারড। দস্তয়ভস্কির কথাটাই কি তবে মোক্ষম? নারী পুরুষকে হালাল করবে, তার আগেই নারী বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত-সব বাহারি শব্দঘোঁটের বিছেহার জোর করে লাথিয়ে ভেঙে ফেলা দরকার যদ্বারা উদ্ঘাটিত হবে নারীর মৌল স্বরূপ।
খামোখা টেনশন নিও না। এটা, এই পুরুষ-সিস্টেমে স্বাভাবিক ব্যাপার। সিস্টেমটা যেহেতু পুরুষের, নারী হাজার বোল্ড হয়েও পুরুষের মতো নিজের কয়টাস চিরোতে পারে না। মানুষের সেক্সউয়াল ইন্টারকোর্স, বা কয়টাস, একটা খাড়া শিশ্নের যোনিতে প্রবেশ মাত্র নয়। সঙ্গমের ব্রড ডেফিনিশন হল, দা ইনসারশন অফ এ বাঁড়া ইনটু অ্যান অরাল, অ্যানাল, অর ভ্যাজাইনাল ওপেনিং, অ্যান্ড এ ওয়াইড ভ্যারাইটি অফ বিহেভিয়ার্স দ্যাট মে অর মে নট ইনক্লুড পেনিট্রেশন, ইনক্লুডিং ইন্টারকোর্স বিটুইন মেম্বার্স অফ দা সেম জেন্ডার্স। কিন্তু কপুলেশন বা চোদাচুদি, যা নিয়ত আমরা আত্ম-সংলাপে সহজ ভাবে ব্যবহার করি, ভদ্দরপুঞ্জে সহজ বা স্বাভাবিক উচ্চারণ নয়। কেননা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যাস্টোনিশমেন্ট আর ভ্যাজাইনাল সেন্সিবিলিটি। যে-কারণে 'চোদাচুদি' শব্দটা (যার উৎসে রয়েছে 'চোদা' ও 'চুদি' নামের দুই ভাইবোনের হাজার-হাজার বছরের মিথ-উপালেখ্য) আমাদের অন্যান্য অর্গানিক কারবার থেকে বেপোট হয়ে গ্যাছে। এ থেকেই পুরুষতন্ত্র সামাজিক ট্যাবু ম্যানুফ্যাকচার করেছে। শ্লীল-অশ্লীলের মধ্যে ভিড়িয়ে দিয়েছে কোন্দল। ওই কোন্দল আর তার অ্যাডহিরিং লুকোচাপার দরুন এদেশের ফিল্ম আর সাহিত্যেও যৌনতা দেখানো হয় পারভার্টেডলি।
কিন্তু পুরুষের চোখে বা অনুভবে মেয়েদের শরীর? এ ব্যাপারে ভদ্দরলোকই বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা! পুরুষতন্ত্রের ঢালাইঘর নারীকে ঝুটমুঠ বহু 'শেপ' দিয়েছে ---- শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী, ---- এগুলো কি বিধাতার কেরামতি? সব শালা পুরুষতন্ত্রের ধুড়কি। পুরুষের চোখে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন খেপের, বিভিন্ন নেচারের মাগি। তাদের নামও তেমনি ভেরিয়াস। নারী বলতে বুঝি একজন স্তন ও যোনি সমন্বিত মেয়েমানুষ, কিংবা এনি অবজেক্ট রিগার্ডেড অ্যাজ ফেমিনিন। ফের 'স্ত্রী' বললে, যার এঁড়িগেঁড়ি বা পোলাপান আছে, অর্থাৎ বিয়ারার অফ আন্ডাবাচ্চা। মাদি শেয়াল বা বাদুড়ানীও বোঝায়। 'রমণী' বলতে, এ বিউটিফুল ইয়াং উইম্যান, মিসট্রেস ---- এবং, যাহা রমণীয়, রমণযোগ্য 'মাল'। 'ললনা'ও মাল, তবে ওয়ানটেন লেডি। 'লল', অর্থাৎ খেলুড়ে মাগি। বিবিসি। মানে, বাড়ির বউ ছিনাল। 'অঙ্গনা' ---- আ উইম্যান উইথ ওয়েল-রাউন্ডেড লিম্বস।। 'কামিনী' ---- আ লভিং অর অ্যাফেকশনেট উইম্যান, কিংবা টিমিড মাল। কিন্তু কামিনী বললে এসব ভদ্দরলোক তাঁদের চুদাউড়ি বউটিকেই বোঝেন, মরাগরুর দালালটা সঙ্গে অং করে যে মাগিটা পালহুড়কি দিয়েছে। 'বনিতা'ও বউ, তবে 'বধূ' বলতে এঁরা বোঝেন বিয়ে করে আনা বউটি। আর, 'যোষিৎ' বলেছে যাকে সে কেবল ছুঁড়ি, গার্ল, ইয়াং উইম্যান; অ্যান আইটেম।
তো, পুরুষতন্ত্র নারীর এতসব উপনাম দিয়েছে, শুধুমুধু 'যৌনতা'র দৃষ্টি থেকেই তো! মানে, পুরুষের 'একটি-মাত্র' নারী নিয়ে মন ভরে না। তারা চায় একাধিক। একটি নারীমূর্তি গড়তে বহু মডেল ইউজ করতেন প্রাক্সিটিলিস; কারো মাই, কারো মাজা, কারো দাবনা এবং কারো-বা পাছা নিয়ে রচিত হতো তাঁর এক একটি তিলোত্তমা। আমরা পুরুষরাও এহেন একটি হাগিং, লাস্টিং, উইশিং নারীমূর্তি ধারণা করি এবং তার জন্য একটা-করে জবর স্ল্যাং বানিয়ে রেখেছি। এটা পুরুষের যৌনতার হোমওয়র্ক। কাল যেন পড়া ধরবেন স্যার। নারী বাবদ স্ল্যাং বানাতে বসে প্রথমেই যেটা, নারীদেহের খুফিয়া বিভাগে এন্ট্রি মেরেছে পুরুষ। বস্ত্র সরিয়ে উদোম করেছে, সর্বাগ্রে যাঁদের দর্শন পেয়েছে, তাঁরা যমজ, উভয়েরই নাম 'স্তন'। স্তন বোঝো তো চাঁদু? যা চিলি চিৎকারযোগে নারীর যৌবন অ্যানাউন্স করে। কিন্তু গোড়ায় গলদ। বাংলা ভাষার কুঁয়োর ব্যাঙ গবেষক-সংকলকরা যে শব্দগুলোকে স্তনের এওয়জ ভেবে টুকেছেন, তাতে স্তনের শেপ বোঝা গেলেও অ্যাপিয়ারান্স আর নেচারে গড়বড় আছে। চুচি, মাই, দুদু, বেল, বাতাবি, নারকেল, তরমুজ, লাউ, বেগুন, ডিংলা, বেলুন, হেভি ওয়েট, হেডলাইট ---- এগুলো ঠিক আছে। কিছুটা মেলে। কিন্তু আতা বা উইঢিবি কেন? স্তনের গায়ে গোঁড় আছে, না ভেতরটা ফোরা? ফের দ্যাখো, 'আনারদানা'! ওটা স্তনের দ্যোতক হলো? মানে, ডালিমের দানা! ওই সাইজের স্তন নাকি হয়! হাসলে বাংলার ডাগদার বাবু। ফের কেলিয়েছো 'নিমকি' ঢুকিয়ে। নিমকি তো ঢোকাবার জিনিশ। মানে গুদ। গুদ আর মাই এক হলো? ফের হাসালে পেঁপেসার। 'মেশিন' কেন? মেশিন তো বড়জোর ল্যাওড়া। পূর্ণযুবতীর স্তন হিশেবে 'হরিণঘাটা' চলতে পারে। তবে, 'সিঙ্গাড়া', 'পিরামিড' আর 'হাইহিল' কদাপি নহে। হে বঙ্গভাষার টুলোপণ্ডিতগণ! তোমরা স্ল্যাং-এর কিচ্চু বোজো না। তোমাদের অভিধানে অনেক ঝোলঝাল আচে। ঝুলে গ্যাচে বাবা লেতাই, কাচা তোমার খুলে গ্যাচে। বলতে চাইছি, স্ল্যাং-এ থাকবে স্তনের গঠন ও প্রকৃতি, তাতে স্তনধারিণীর বয়স ও দেহের বিভাব জেগে উঠবে, সেটাই তো কাম্য। একটি অষ্টাদশী খেলুড়ে ললনার স্তনকে কি 'আমসি' বলা যাবে, নাকি 'বেগুনপোড়া'? কোন-কোন টুলো 'চুচি'কে বাদ দিতে চেয়েছেন স্ল্যাং থেকে। লজিক হলো, ওটা সংস্কৃত মূল শব্দ 'চুচক' থেকে ভায়া হিন্দী তদ্ভব 'চুচি' থেকে সরাসরি বাংলায় এসেছে, ----- এবং অভিধান স্বীকৃতও বটে। ওভাবে দেখলে, তাহলে তো 'চুত' শব্দটাকেও ছেঁটে ফেলতে হয়। কারণ সেটিও সংস্কৃত 'চুদ' জাত তদ্ভব হিন্দী আঞ্চলিক, ----- এবং সেটিও অভিধানে ঠোর পেয়েছে, যার মূল অর্থ 'যোনি'। অভিধানে ঠাঁই পেয়েছে বলে স্ল্যাং হবে না? তাহলে 'চুতমারানি'দের কীভাবে ডাকা হবে? এভাবে, তাহলে, 'মাগি'ও বাদ যাবার কথা। যেহেতু সেটা পালি 'মাতুগাম'-এর তদ্ভব রূপ এবং তার মূল ক্ষরিত অর্থ খালিপিলি 'মেয়েমানুষ'। হিন্দী 'চুচি'তে অষ্টাদশীর লমশমি স্তনের যে ব্যঞ্জনা, সে তো বহুল চালু বাংলা 'মাই'তেও দুর্লভ। আবার ভারিভরকম পেল্লাই থন-দুটিকে তো 'তরমুজ' কিংবা 'ফজলি আম'ই বলব। বড়জোর, 'বউ ফুসলানি আম'।
স্তনের সমীপশব্দ পাচ্ছি 'বুনি' 'বুচি' 'বুটকি'। এগুলো ও-বঙ্গের। খুলনায় চুচির নাম 'ফলনা'। যেটা ময়মনসিংহে গুদের নিকনেম। কুমিল্লায় উচ্চারণদোষে স্তন হয়েছে 'তন'। আমরা বলব, 'থন'। রংপুরে 'টমটমা'। ঢাকায় স্তনযুগলের বেড়ে নাম দিয়েছে, 'জোড়ামুঠিফল'। বগুড়ায় কিশোরীর উঠন্ত চুচির নাম 'বুচি'। আমাদের এদিকে 'কুল' 'লেবু' 'পেয়ারা' দেদার মেলে। তারবাদে, টনটনে লবলবে বোঁটা দেখে কার না লালকি ঝরে! স্তনবৃন্তের কথাই বলছি, মালপোয়া বা পুলিপিঠের নয়। যা দেখে লিলিক্ষা জাগে, চোষার। তর্জনী ও বুড়ো নিশপিশ করে, দাঁতে চেপে চেবাতে জী ললচায়। স্তনবৃন্তের উপরিভাগকে বাকরগঞ্জে বলে 'পালনি'। 'বুডা' 'বুটা', এগুলোও ও-পাড়ায় চলে। তবে, আমরা সরাসরি 'বোঁটা'ই বলব। বোঁটা, বোতাম, চুমুর, কিশমিশ, নাট, সোপনাট, সুপুরি, রিঠা, ডুমুর। এছাড়া বড়জোর 'তকলি'। 'বাটিকোট' বলব বডিসকে। 'পৈতে' বলি তার স্ট্র্যাপকে। 'ব্রা' আর 'ব্রেসিয়ার' ----- দুটোই শিরশির করা শব্দ। জুড়ি নেই। কড়কড়ে বডিস বললেও অমনটা লাগে না। শকুন্তলা বলছে, 'সখী,অমন আঁট করে বাঁধিসনি,বল্কলের ভেতর বড্ড আইঢাই লাগে!' উত্তরে প্রিয়ংবদা বলছে, অত্র পয়োধর-বিস্তারয়িতৃ আত্মনঃ যৌবমেব উপালভস্ব ----- 'যে যৌবন তোর মাইদুটোকে অত বাড়ন্ত করেছে, তাকে দুষগে যা, আমাকে কেন!' এবার নিচে নামো। তলার দিকে। চোখে পড়বে পেটি। তার মধ্যমণি 'নাভি'। নাই, নায়, ঢোঁড়ি, পেটি, টুনি, পুঁতি ইত্যাদি কত নাম পড়েছে ওইটুকু গত্তে! এগুলোর মধ্যে হিন্দী 'ঢোঁড়ি' কিন্তু একটা হাইভোল্টেজ স্ল্যাং। ওটা বাংলায় তাংড়ানো উচিত। অন্তত, নারীদেহের নাভির খাটচড়ি শব্দ এর চাইতে বেস্ট আর হয় না।
তা, মলয়দা, এরকম একটি নারীদেহ লাভিত হলে দাঁড়ায় বৈকি। তখন লেকামেকা চুলোয় যাক। বাকি কথা : লিঙ্গের লিঙ্গযোগ (পড়ো 'মনোযোগ') যেখানে দরকার সেখানেই খাড়ায় কেবল। নারী বা যৌনতা নিয়ে লেখার সময় নিরাসক্ত সন্ন্যাসী হয়ে থাকতে হয়, নচেৎ লেখাটা খাড়ায় না। এবং বলি, এই লেখাটিও লেখার সময় দাঁড়ায়নি, নট ইভন হাফ এমএম।”
.
এখানে রইলো হাতের লেখা বনাম কমপিউটারে লেখা সম্পর্কে অজিতের মতামত, “আমার চতুর্থ উপন্যাস "পাপরাৎজি"র হাতেলেখা পাণ্ডুলিপি 'কৌরবে' পাঠালে, কমল চক্রবর্তীর প্রথম রিয়াক্সান ছিল, 'খুব সুন্দর হাতের লেখায় এসেছে। লেখাটাও খুব সুন্দর।' উনি অবধারিতই উপন্যাসটি না-পড়েই দ্বিতীয় বাক্যটি লিখেছিলেন, এ আর বলে দেয়ার দরকার নেই। বস্তুত, আগেকার দিনে আমরা প্রত্যেকে হাতে লিখেই লেখা পাঠাতাম। আশির দশকের গোড়ার দিকে আমার অজস্র লেখা স্রেফ হাতের লেখার গুণে দৈনিক 'আজকাল' এবং সাপ্তাহিক 'পরিবর্তনে' বেরিয়ে যায়। লেখা শব্দের মধ্যে 'হাতের লেখা' এবং লেখার বিষয় ভাবনার সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। ভাবনা ও বিষয়কে শব্দ বাক্যের মাধ্যমে আমরা রূপ দিই। শব্দ বা বাক্য যেমন বিষয়-সৌন্দর্যের ধারক, বাক্যকে অক্ষরের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাও আমাদের কালে এক শিল্পকর্মের পর্যায়ে পড়ত। সন্দীপনের হাতের লেখা জঘন্য, বাজে, কমল চক্রবর্তীর লেখা ছাপার সময় কৃষ্ণগোপাল মল্লিক ও আমাদের ফ্যাসাদে পড়তে হতো। কমল মজুমদারের হাতের লেখা ততোধিক সুন্দর ছিল, এমনকি মলয় রায়চৌধুরী, রবীন্দ্র গুহ তথা সুবিমল মিশ্রর। সুন্দর হাতের লেখা গোধূলি আলোয় কনে-দেখার মতো। চোখকে গোড়াতেই সেঁক দিয়ে দিত। কেবল দেখতে-দেখতেই ঢুকে যাওয়া যেত বুকের অলিন্দে, হোক না তা ঢাকনা-আঁটা। সবার হাতের লেখা ভালো হবেই, তা তো নয়। অনেকের সুন্দর করার চেষ্টাও থাকে না। যাঁরা ভালো লেখে, তাঁদের হতেই হবে, তার মানে নেই। আবার লেখকদের মধ্যে যাঁদের আঁকার বাতিক ছিল, অনেকেরই চমৎকার হাতের লেখা। যেমন কমলবাবু, বা সুবিমল বসাক। অন্যফুটে, মলয়দা ভালো আঁকতে পারতেন না, অথচ হাতের লেখা অতিশয় সুন্দর। আবার প্রচুর বাজে গদ্যকার ও কবির অসাধারণ হাতের লেখা। কিন্তু সে-মুতে ইন্ধন নেই। ভেজা বারুদ মার্কা। তাঁদের আর নাম নিচ্ছি না। এছাড়া অজস্র উঁচুমানিক সহ আলবালিক লেখক ও শিল্পীর বানান ও শিল্পগত ভুল দিবারাত্র চোখে পড়ে, বিজ্ঞাপনে। বাড়ি থেকে ইস্কুলের যাওনের পথে কচি ছেলেমেয়েরা দেখছে তথাকথিত 'মহান' সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ত কোনো বিজ্ঞাপন-হোর্ডিংয়ে তেল ঝাঁঝে কাঁদছেন, শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কোনো কোম্পানির বিস্কুটের শিশি নিয়ে দিব্যি আয়েশে বকেশা ঝাড়ছেন। ছেলেমেয়েরা ওই ভুল বানান ও ভুল ছবির বিজ্ঞাপনকেই সঠিক মনে করছে। আকাশ ঢেকে দেওয়া বিজ্ঞাপনমালার বানান মেলে না অনেক সময়ে সঠিক বা শুদ্ধ বানানের সঙ্গে। বইয়ের বানানের সঙ্গে মিলে না খবরের বানান। ফলে দিশেহারা নতুন প্রজন্মের কবি-লেখকরা আমাদের, এমনকি বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ-জীবনানন্দের বানান দেখে মুখ খুলে হাসতেই পারে। বিজ্ঞান ও যন্ত্র নির্ভর জীবন আমাদের। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের মাথায় ডেরা বেঁধেছে যন্ত্র। আকাশ বাতাস ছবি সাহিত্য তারা যা কিছুই দেখছে, কৃত্রিম যন্ত্রের মাধ্যমে। পড়ছে না সাহিত্য। ভাষাবোধ, ছবিবোধ তৈরি হচ্ছে না। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হাতের লেখার ক্ষমতা। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমারই নিজের হাতের লেখা কী ছিল! আজ পঁচিশ বছর কম্পিউটারে লিখে-লিখে-লিখে-লিখে, কার্যত আমার সেই মুক্তাক্ষর যন্ত্র-দানবের পাল্লায় পড়ে শূন্যে বিলীন।”
.
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য প্রথম দিকে অজিত রায়কে প্রভাবিত করেছিল। তা থেকে বেরিয়ে এলো বিহারের বাঙালি আর ধানবাদের বাংলা মিশিয়ে একটা গদ্য তৈরি করে, যার নকল করা অসম্ভব। সন্দীপন সম্পর্কে অজিতের লেখাটা পড়া যাক, “অতি অতীতকালের কথা। শীতনিশার নিশুতি। ৬ নম্বর রুটের শেষ বাসটি ফিরে গেছে গড়িয়া। আমি আর কমলদা হাজরায় দাঁড়িয়ে। কমলদা অধীর গলায় জানতে চাইল, এখন কোথায় মদ পাওয়া যায় বলতে পারো? সব দোকান তো বন্ধ হয়ে গেছে।
আমি অসহায়। কলকাতার বিলিতি মদের আন-অথরাইজড ঠেকের হদিশ আমার জানা নেই। ফের কমলদাই শান্ত গলায় বলে, চলো, বসুশ্রীর পেছন গলিটায় গিয়ে দেখি!
হাঁটা শুরু করব, হঠাৎ আমাদের দুজনের কাঁধের পেছন দিয়ে একটি ব্রাহ্মিনিক্যাল খোমা উঁচিয়ে আসে। আলো কম, কিন্তু চিনতে বিলকুল ভুল হয় না, ---- 'সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য'-র ফোর্থ কভারে এই মুখেরই ছবি আছে।
সন্দীপনকে সেই প্রথম দেখি। প্রথম কথা : 'আমার ব্যাগে আধখানা পাঁইট আছে।' তারপর আমার দিকে তাকিয়ে (এবং রিমলেস গ্লাশ নাকের ডগায় নামিয়ে) ---- 'তোমার চলে তো?'
আমি জানাই, না, আমার এখনো অন্নপ্রাশন হয়নি।
হাসলেন, 'তাহলে এ-জন্মে তোমার স্বর্গলাভ হলো না।'
.................................................................
৯০-এর গোড়া। নন্দনে ইলমাজ গুনের 'দ্য ওয়াল' দেখতে গেছি। পাশের দু-একটা সিটের পর সন্দীপন, ওঁর বন্ধুদের সঙ্গে। ছবি শুরু হবার আগে বেশ প্রফুল্লই ছিলেন। তারপর, একসময়, 'ওয়াল' শেষ হলো। শ্বাসরোধী ধূসরতায় সব-ক'টি সিট নিঃশব্দে খালি হয়ে গেল। সবাই হল ছেড়ে ধীরে, নীরবে, মৃদু কথালাপে বেরিয়ে আসছেন। একা সন্দীপন ব'সে। শবের মতো অনড় ও নিস্তেজ।
একসময় উঠে দাঁড়ালেন। আমি পাশে, কখনো পেছনে। হাঁটছেন রবীন্দ্রসদন মেট্রোর দিকে, মৃদুচরণে। তখনও নীরব, আনত শির। আঁখিদুটি চিকচিক করছে কেবল।
চৌমাথার ক্রসিং অব্দি পৌঁছে চু-উ-প দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি পেছনে। এ পর্যন্ত কথা হয়নি। ছবি দেখে আমিও যথেষ্ট বিহ্বল। কিন্তু উনি যেন অপ্রকৃতিস্থ।
অনেকক্ষণ ওইভাবে, নীরব ও আনত মাথায়, দাঁড়িয়েই রইলেন।
তারপর, ধীরে, অবর্ণনীয় বিধ্বস্ত গলায়, একটিই মাত্র কথা : 'নাঃ, সারা জীবনে কিছুই লিখতে পারলাম না। ......'
তারপর ফের চুপ।
শেষে আর ধরে রাখতে পারলেন না নিজেকে। হু-হু করে ডুকরে উঠলেন, --- 'একজন ফিল্ম ডিরেক্টার যা দেখাতে পারলো, আমি শালা একজন লেখক হয়ে, ছিঃ, কিছুই দেখাতে পারলাম না! সিনেমা বানাতে গেলে কত কী-ঈ লাগে--- লেখার জন্য তো শুধু কাগজ-কলমই যথেষ্ট ---- তাই না? কই, লিখতে তো পারলাম না! কত কী-ঈ বলার ছিল .... কত কী-ঈ ---- না হয়, না-ই ছাপতে দিতাম! পারলাম না, পারলাম না, কিছুই পারলাম না। ওঃ, পারলাম না রে অজিত, পারলাম না।'
.........................................................
লেখককে কাঁদতে হবে। এমনকি, গণসমক্ষেও। মঞ্চে নয়, ছলায় নয়। কাঁদতে হবে মন থেকে, ভাষার উৎসভূমি থেকে। যিনি কাঁদতে পারবেন না, সেই না-পারার অপারগতায়, নবকুমারের মাফিক, ----- বদার্থ মৃন্ময়ীকে বাঁচাতে পারছেন না ---- অকথ্যময় এই ক্রোধেও, অন্তত, আশরীর কেঁপে উঠবেন তিনি। এটা মাস্ট। এ না হলে বুঝতে হবে কোথাও ফক্কা থেকে গিয়েছে। একখানা ঢপ বা ঢপের চপ ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। লেখককে 'আজন্ম' এ রেওয়াজ করে যেতে হয়। যে কাঁদতে পারে মনের কালিমা তাকে ছেড়ে চলে যায়। এটা টেস্টেড। হিস্টোরিক্যালি টেস্টেড। এ যে সবাই বুঝবেন এমন মায়ের কিরা নেই। কিন্তু, টেস্টেড।
'লিখেছো প্রেরণা তোমার নিযুত বৃক্ষের ছায়া। ভেবেটেবে লিখেছো তো? কেননা এসব অনেকেই লিখে দ্যায়, পরে জানা যায় সব-মদন ডাবলবেডে একা।'
মদির ভেপারের তলায় প্যান্টের ফ্রন্ট-পকেটে দু পাঞ্জা ভরে আমার দিকে অনিমিখ দিঠি ভিড়িয়ে সন্দীপন। সঙ্গে, যোগসাজশের মতো, তাঁর সেই কুখ্যাত মিসচিভিয়াস ফরাসি হাস্যটি : 'বাঞ্চোত, জবাব দিচ্ছো না কেন?'
হ্যাঁ, ঠিকই। আমার প্রেরণা সত্যিই বিসদৃশা এক মেয়ে, খুবই বেপোট। কিন্তু কনজুগাল লাইফ নামের আজিমা দালানের কাঁথে নালিশ, তহমত, কালো-পতাকা থাকবে না, সেটি কাঁঠালের আমসত্ত্ব মাত্র। কেননা, হেজানো দাম্পত্যে একঘেয়েমি আর মুফলিসি দুই বড় জান্তব পেরিক্লিস। প্রেরণার প্রাত্যহিক সৌমনস্যও তেমনি, সেথায় নিয়ম মতো বিষাদ ও বিস্ফোরণ কোথাও, কোনো কোণে আটকে থাকে। বস্তুত, প্রেরণা এভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। সহ্য করে পর্যায়ক্রমে পুরুষের নির্পুরুষি স্পর্ধা। সয়। লেখককে, স্বামীকে। লেখক-স্বামীকে। সহনবোধ থেকে ক্রমশ বেদনার খোলসে ঢুকে পড়ে নারী। শরীর বা মেধার হাওড়ে নুড়ি হাবড়েও তরঙ্গ মেলে না আর। এভাবে, ওই টুকরো-হীরের কোথাও যদি কখনো চিজেলের ক্র্যাক পড়ে গিয়ে থাকে, সে জিম্মা তো আমারই। ওর কেন?
না, এ কথা সন্দীপনকে বলা যায় না। সন্দীপন কি এ-পয়মাশ মানতে চাইবেন?
জানতে চাই, 'এতগুলো বছর সেক্স লাইফ কিভাবে কাটালে?'
----- 'মাস্টারবেট করে। (রিমলেস গ্লাশ নাকের ডগায় নামিয়ে) ---- হ্যাঁ।'
সন্দীপন এ কথা আরও অনেককেই বলেছেন : 'জানো, আমি কিন্তু মাস্টারবেট করেই বেশি সুখ পেয়েছি।' এই দ্বৈধের পরজারিতে কতিপয় নোট পাচ্ছি :
'ধৃষ্টতা মাফ করবেন, ম্যাডাম, আপনি নাকি মনে করেন মাসে একবার কি বড়জোর দুবার সেক্স হওয়াটাই যথেষ্ট ---- এবং তাও শহিদসুলভভাবে? ... ইয়ে, আপনার কি কখনো অর্গ্যাজম হয়নি? নাকি আপনি সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়াতেও বিশ্বাসী নন বা কার্যকালে জামাকাপড় সবটা খোলেন না?'
'ইউটেরাস রিমুভ হবার পর, কিছুতেই নিতে পারত না। উঃ, আঃ, মাগো, মরে গেলাম, এইরকম বলত। মাসখানেক চেষ্টা করলাম। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, ছিঃ, আমি মানুষ না! হাল ছেড়ে দিলাম। ... লজ্জায় বন্ধুদের কাছে জানতে চাইনি যাঁদের স্ত্রীদের অমন হয়েছিল।' যখন জানতে পারি, 'ততদিনে বছরচারেক পেরিয়ে গেছে। ততদিনে সারদা কেঠো, কড়ে বিধবা।'
.......................................................
১৯৯২ সনে দ্বিতীয় উপন্যাস, 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না'। উৎসর্গ করেছিলাম যুগপৎ মলয় রায়চোধুরী আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। সন্দীপন সেটা আদৌ পড়েছিলেন বলে সন্দ আছে। 'জোখিম কোরকাপ' উৎসর্গ করেছিলাম : উদয়ন ঘোষ আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। উদয়নদা পড়েছিলেন। সন্দীপনদাও। কমেন্ট করেছিলেন, 'বানানো'। সন্দীপন কিন্তু জানতেন, জোখিমের একটিও শব্দ আমার বানানো নয়। আসলে, আমার যেটা মনে হয়, ইন্টেলেক্টের দিক থেকে মেয়েদের কাছে কখনোই খুব বেশি হাত পাতেননি তিনি। বলতেন, "মেয়েরা কী দিতে পারে জানো? শুধু সেক্স। সেটাই যদি ঠিকঠাক দেয়, ওদের কাছে আর তো কিছু চাওয়ার নেই।'' এভাবে কারো যদি মনে হয় মেয়েদের উনি খানিক ঊন-হিউম্যান বানালেন, সন্দীপন বারদিগর ঐ অনিমেষ দিঠি আছড়েই তাঁর সামনে দাঁড়াবেন। এবং, মঙ্গোলিয়ান খোমায় হাসি দাপিয়ে। এবং, রিমলেস গ্লাশ নাকের ডগায় নামিয়ে, বলবেন : 'ইয়াস, মাই ডিয়ার!'
'যোজন ভাইরাস' পড়ে ১৫ মে ২০০৪ লিখেছিলেন : "আজ ৭টা থেকে ৯।। পর্যন্ত টানা 'যোজন ভাইরাস' পড়লাম। বাংলা বই পড়তে এতক্ষণ সময় লাগে না, লাগল। এবং, একবারও ঠোঁট তুলিনি। ... ছাড়তে পারিনি এক মুহূর্তও। .... মনে হল ভূত গদ্য লিখেছে। বাংলা ভাষায় জ্যান্ত লেখকরা এ ভাষা কোথায় পাবে!"
কেন পড়েছিলেন সন্দীপন 'যোভা'? কেন বলেছিলেন এ-কথা? সন্দীপন যে যোজনের কায়েল হলেন, তার হেতুক বড়ই আলাদা। 'ভাষা', সে একটা তো বটে। তারও বেশি, থিম। যা নিয়ে খোদ সন্দীপন কখনো মাথা ঘামাননি। যোজনের ঐ থিমটাই সন্দীপনের ভালো লেগেছিল।
বলেছিলেন, ----- 'সত্যিই, স্ত্রীর কাছ থেকে দুটো জিনিশ পাওয়া যায় না, ---- এক, ভালোবাসা। দুই, যৌনতা।'
সন্দীপন তাঁর গদ্যগুলো লিখেছেন ঐ না-পাওয়ার হাশিয়ায় ব'সে। ঐ দ্বিতীয় সন্দীপনকেই আমি গ্লাসজারে দেখেছি। বনবিহারী ও হেমবরণের একটিই মাত্র আদরা-বদল 'আমি'কে। আসল সন্দীপন তথা তাঁর হাড়হদ্দ রয়েছে ঐ অদৃশ্য ও নিমজ্জমান বিটুইন-পংক্তি ছত্র-সমূহে। জীবনানন্দের কবিতার সমীপে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সন্দীপনের গদ্য, এভাবেই।”
.
অজিত রায়ের 'যোজন ভাইরাস' পড়ে সন্দীপন মন্তব্য করেছিলেন :
‘'আজ ৭টা থেকে রাত ৯।। পর্যন্ত টানা 'যোজন ভাইরাস' পড়লাম। বাংলা বই পড়তে এতক্ষণ সময় লাগে না, লাগল। এবং একবারও ঠোঁট তুলিনি। আদ্যন্ত অন্য, আলাদা জাতের ভাষা। আর ট্রিটমেন্ট। 'আয়, আমার পেছনটাও মেরে নে' ধরনের লেখা। মনে হল ভূত গদ্য লিখছে। বাংলা ভাষায় জ্যান্ত লেখকরা এ ভাষা কোথায় পাবে!'’
.
নিজেকে নিয়ে একটা লেখা আরম্ভ করেছিল অজিত, ২০০১ সালের মাঝামাঝি। অজিত লিখেছিল, “নিজের জন্য এক্সক্লুসিভলি নিজেকে নিয়ে একটা লেখা শুরু করেছি, আর, কী আশ্চর্য, নিজের ফেলে-আসা জীবন নিয়ে লিখতে বসে, এতদূর এসে দেখছি, অনেক কিছুই না-লেখা রয়ে যাবে জীবনাবধি। খানিক স্মৃতিও ধ্বসে গিয়ে থাকবে। আমি নিরঙ্কুশ, নিরন্ন, পাংশুর মতো বেঁচে আছি। শেষ যেদিন পরীক্ষায় বসি, এম.এ, একটাও ড্যাশ, কমা বা দাঁড়ি ভুল হয়নি। একুশ-বাইশের খলবলে বয়সেও কত শান্ত, সমিধ, প্রফেটের ঘিলু! অ্যাদ্দুর এতবছর টানা লিখে এসে নিজের জীবনটাকে কার্যত যা দেখলাম, নিতান্ত ছোটবেলা থেকে আমি যা যা করেছি বা ভেবেছি এবং চাঁদমারি স্বরূপ পরবর্তীকালে যা লাগাতার সামনে থেকেছে আমার, ----- সমস্তই আমার লেখালেখি ঘিরে, লেখালেখি আর লেখালেখিই ঘিরে। তার বাইরে এমন কিছুই করিনি, ভাবিনি, যা আমার আত্মজীবনীকে আলাদা মাত্রা যোগাতে পারে। অথচ, লেখালেখি-কেন্দ্রিক এই জীবন পেয়েও, চাঁদমারি সামনে রেখেও, আমি এদান্তি নিজের জীবনকে বড় এলোমেলো ছন্নছাড়া খামখেয়ালের বশে যাপন করেছি। এবং যাপনের যাবতীয় খুঁটিনাটি আমি আমার কিছু-কিছু উপন্যাসে তুলে ধরতে চেয়েও আপামর ব্যর্থ হয়েছি। পারিনি। পারলে হয়ত দেখা যেত, আমার জীবনের যেসব গল্প, তা সত্যি হলেও, গল্পের চেয়ে মারাত্মক ও নিষ্করুণ।
তাছাড়া এমনও অনেক কথা, পুশিদা অস্ত্র, আমার কান্না রাগ ব্রীড়া, বিশেষত বিকেল ঢলে চাদ্ধার সাঁঝ-মতন হলে, কালো লোমোলা বিশালদেহী আকাশের নিচে একা-একলা দাঁড়িয়ে থেকে বুকের ভেতরটা যখন একজাই ফাঁকা, ধড়াস, উজাড় আর যৎপরনাস্তি ইনসিকিওর্ড লাগে নিজেকে, এমন-যে ভয় কুণ্ঠা উদ্বেগ ত্রাস এসব গাদ পেতে থাকে যখন পিত্তির দহনপ্রদেশে, এবং যে-কোন ল্যাম্পপোস্টের তলায় বাইক খাড়িয়ে চিরকুটে টুকে নিই জীবনের মহোত্তম নোট, এবং এমনিতরো গোপন অরাজক আরও-কিছু যা আমার মা দাদা দিদি আত্মীয় বন্ধুরা কিম্বা পাশের বাড়ির ভঞ্জবাবু জানতে পারলে বাওয়াল হয়ে যাবে ----- আমি না-লেখা নিরস্ত অবস্থায় ছাড়তে পারছি না বলেই, এই নার্সিসাস টেক্সটে সমস্ত লিখে রেখে যাবো। জানি, সেসব সানুপুঙ্খ তুলে আনতে হলে যে-পরিমাণ আলাদা ভাষা, সিনট্যাক্স, শব্দের যোগান দরকার, এই মুহূর্তে আমার নেই। তবু লিখব। কেননা, আমার পরিপার্শ্বের মেকি শ্রদ্ধা ভালবাসা স্নেহ আমার চাই না। ছদ্ম ভালোবাসা আমার অভিপ্রেত না। ভাবতে পারো, এ আমার মিহি স্ববিরোধ; কিন্তু আমার খোয়ানোর আর কিছুই নেই।
অবশ্য, স্ববিরোধ কোথায় নেই? প্রেরণার সঙ্গে রফা হয়েছিল, 'দাম্পত্য' হবে না, 'স্বামী-স্ত্রী' হবে না, বাচ্চা হবে না। কেননা দাম্পত্য, এর চেয়ে খোশ মস্করা আর হয় না। আমরা জানতাম, স্বামী-স্ত্রী আর ইকুয়াল পার্টনারশিপের তামাম ভোকাবুলারিকে পুরুষতন্ত্রের দুরমুশ থুরে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মতো দুর্মদ কি আর কিছু? সুতরাং, কালক্রমে, কনজুগাল লাইফ নামের কায়েমি প্রতিষ্ঠানের কার্যত গুডডা-গুডডি ব'নেই রয়ে গেলাম আমরা দুজন। এবং, মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে আমি ধোঁকা করছি, এ আমার জীবন নয়, এ আমার ছদ্মাচার। আমি আত্মমুগ্ধ, নিজেকে ভালবাসছি। কেননা সাহিত্য করে যখন অর্থ নেই, স্বীকৃতি সামান্য, যশ যৎকিঞ্চিৎ, সাহিত্যের যেন মানেই নেই কোনো, জীবন বা সত্যের অন্বেষা নেই বেশির ভাগ লেখকের কাছে, অথচ মিডিওকার ধান্দাবাজে ভরে গেছে চত্ত্বর ----- সেখানে বউবাচ্চা ও অর্বাক গিরমি রেখে জীবন রক্ত ঘাম শেষ-প্রোটোপ্লাজম-টুকু নিঙড়ে ভাষার বনেদে কিঞ্চিৎ উখো মেরে যেতে চেয়ে আজ এতগুলো বছর, বুকে বালিশ গুঁজে, দিস্তার পর দিস্তা, পেজের পর পেজ ----- এ নিছক স্বার্থপরতা নয়, নিজেকে ভালোবাসা? পাল্টাক্ষণে মনে হয়েছে, না, বাসছি না। কোন মানুষই কি নিজেকে ভালোবাসতে পারে? তা কি নিজের প্রতি অন্যের অনুভুতি মাত্র নয়? অন্যরা আমাকে যে-যে কারণে ভালোবাসে, আমি মাত্র সেই-সেই কারণে নিজেকে ভালোবাসছি!! সে তো আত্মপ্রেম নয়, মোহ নয়। বরং অন্যকে ভালোবাসা সহজ অনেক। সেটা বোঝাও যায় চট করে। নিজেকে ভালোবাসার, আত্মাচ্ছন্ন হবার মতো পর্যাপ্ত বিবরণ বা জটিলতা আমার লেখালেখিতেও নেই যে! হয়ত এও আমার স্ববিরোধ, নিজেকে ভালোবাসতে না পারা। বা, অন্যকে দিয়ে নিজেকে দেখা। হয়ত।
আসলে কী জানো পাঠিকা, ----- তামাম জাহাজ ডুবিয়ে কলমে থিতু হয়েছি আমি, পলাইতে পথ নাই যম আছে পিছে। লেখা নিছক উপলক্ষ নয় আমার কাছে, ---- লক্ষ্য। যদি প্লেটোর 'ডিভাইন ইনস্যানিটি' কবুল না-ও করি, কিংবা রবি ঠাকুরের 'দৈববাণী' --- তাহলেও দেখছি দৈব-উন্মাদনাই কিন্তু মূলে। অন্তত, পেছন থেকে অবিরহ ধাক্কাচ্ছে কেউ, এই টের অহরহ। আমি মনে করি সাহিত্য এমন এক জিনিশ যা একজন লেখককে একা এবং সম্পূর্ণ এককভাবে করে যেতে হয়। সেখানে কোন ক্যামেরাম্যান, কোরিওগ্রাফার বা বাজনাদার তার মদতগার নয়। বাইরের তৃণমাত্র মদত ছাড়াই এক-একজন লেখক। যারা সাহিত্যকে নিছক শখের বাগোয়ানি, জীবনের সেকেন্ডারি-কিছু, বা আর্ট অব প্লে, 'কল্পনা-ক্রিয়ার স্বতন্ত্র বৃত্তি', দুধ থেকে সরের মত করে আলাদা ভাবে দ্যাখে এবং মারিয়ে যায়, তাদের পাশে এক শ্মশানে শুতেও আমার বিবমিষা। অন্যের হাগুমাখা টিন বয়ে বেড়ানোর চেয়েও বীভৎস নিজের সঙ্গে এই গুলতাপ্পি।
'বলাটাই যখন বিষয় হয়ে ওঠে, বলার ভঙ্গিটাই' ---- হ্যাঁ, গোদারের এই কথাটা হরদম মাথায় ঘুরপাক খায়। তথাকথিত ওপরবাজ ঢঙি-সাহিত্যের কোন ছকবাহার আমার আসে না। ফ্লো আসে ভেতর থেকে, একেবারে ছাঁকা, বেতরতিব। সেসব নিয়েই মুহূর্ত-ধারাপাতে নিজেকে হাজির করার চেষ্টা। কেননা আমার মনে হয়েছে আমি তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক মরফিয়ায় আক্রান্ত নিহায়ত ফিউডাল আর অতি নিকৃষ্ট কালো জঙ্গুলে মাটির বাসিন্দা, ---- বঙ্গসাহিত্যে আমার এন্ট্রি মকাইদানা স্বরূপ, আমাকে চেবানো দায়। দ্বি-সংস্কৃতি, দোগলাকৃষ্টি, মায় 'কালচারাল বাস্টার্ড', শব্দ তিনটি ঢুয়ে এনে নিজের পিঠে বসাই। কেননা এসব শব্দ, এরা আমার মৌল স্বরূপও বটে। আমার দেখা, বলা, কাঁদা, মস্করা, খিস্তি কিংবা প্রেম কোন মেট্রোপলিস সিটি থেকে বিলটি কেটে আসবে না। আমি মনে করি আমার নিজস্ব কিছু কাদা, তাকে খড়-ভুসি দিয়ে গেঁথে দিতে পারলেই এক-একটা নির্মাণ। আমার পকেটে হরদম ছেঁড়া চিরকুট আর কলম, যখন যেখানে যেরম মুড আসে, বাইক খাড়িয়ে উৎরে নিই ঝটপট, আর বাড়ি ফিরে-ফিরেই, প্যারা। ভাবি, এই খাটুনি আর কালঘাম আমার জীবন আর লেখার মাঝ থেকে খোঁচঅলা হাইফেনটুকু উখড়ে ফেলতে পারে যদি!
সুতরাং, আমি লিখি আমার জন্যে। দায়বদ্ধতা, সে এখন বাংলা শব্দকোষে হাতির দাঁত ব্যতিরেকে আর কিছু না। কেননা এসব মনে করার, বিশ্বাস করার মূল বনেদটারই আজ ভুষ্টিনাশ হয়ে গেছে। বিশ শতকের গোড়া অব্দি তবু লেখক-বুদ্ধিজীবীদের অল্প-স্বল্প শোনা হতো। কিন্তু আমাদের নিজস্ব রাষ্ট্রযন্ত্র বিদেশি প্রভুদের এঁটোকাঁটা খেয়ে গাগতর ফুলিয়ে দুম করে যেদিন চড়ে বসল মসনদে, সেদিন বা তার ঠিক পরের দিন থেকে তথাকথিত লেখক-বুদ্ধিজীবীদের শোনবার কেউ থাকল না। তখন থেকে তাঁরা মসনদের চোখে ফালতু আর পালতু সম্প্রদায়-বিশেষ। ফালতু, কেননা মসনদ বা রাষ্ট্রযন্ত্র নিজের বোধ-কাঠামো গড়ে নেওয়ার পর তার ব্যাখ্যাকারীর প্রভাব থেকেও পুরোপুরি মুক্ত হতে চায়। ব্যাখ্যা বা ভাবনা পরিহার্য হলে ভাবুক-বুদ্ধিজীবীরাও ফিজুল হয়ে যায়। আবার পালতু, যেহেতু এসব লেখক-টেখকরা যাতে মাঝেমধ্যে গিয়ে মসনদের গাঁড়ের তলায় বসে ল্যাজ নেড়ে আসতে পারে তাজ্জন্যে নানারকম খেতাব, বৃত্তি আর পুরস্কার সমেত খুলে দেওয়া হয়েছে 'সংস্কৃতি' নামে একটা নিকো পার্ক। কবি-লেখকরা সেখানে কাঁধে ঝুলি ঝুলিয়ে পদ্য পড়েন, ভিড় জুটিয়ে বুকনি ঝাড়েন আর মধ্যেমধ্যে 'সংস্কৃতি বাঁচাও' 'ভাষা বাঁচাও' বলে হাঁকও পাড়েন, ---- কিন্তু মসনদ বা তক্তা পালটে ফেলার বিষদাঁত তাঁদের নেই, মসনদ তা জানে।
অতএব, এহেন প্রেক্ষায় মধ্য বা নিম্নবিত্ত থেকে আগত একজন বাঙালি লেখক নিজের দায়বদ্ধতার টেঁটুয়া টিপে এই পর্যাপ্ত ক্রাইসিসে, পলিউশান আর পেরিক্লিস সমাজের হিপোক্রিট আবিলতায় বল্গাহীন কেঁদেই উঠতে পারে স্রেফ। সে প্রতিভাবান, রহস্যময়, শয়তান, পুণ্যাত্মা, ধড়িবাজ, দুশ্চরিত্র, পাগল, কমিউনিস্ট, তিনোমুলি, বিজু, ভিখিরি যা হোক, জড় ও অজড় দুই বিশ্বেই আজ সে পূর্ণত ত্যক্ত, বর্জিত, প্রোজঝিত। সমাজ তাকে পাত্তা দেয় না। তবু সে বিইয়ে চলেছে সহস্র-একের মুনড্রিয়ান খিচুড়ি। হাপিত্যেশ এই অংশটা কেউ পড়বে, ভালো লাগবে কারো। সে জানে প্রতিটি লেখার শেষে তার মৃত্যু, তবু।
আসলে, সে হল ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রকৃতি যত কবিতা গান ছবি মহাবিশ্বে রচনা করেছেন, তাতে তার মন ভরে না। সে আরও কিছু নতুন মাত্রা লাগিয়ে তাকে নিজের মত দেখতে, পেতে চায়। নির্মাণ করে। কবি দেখেন চুল সুন্দর, তবে বিদিশার নিশা। চোখ সুন্দর, তবে পাখির নীড়। রোদ সুন্দর, তবে কমলা রং। মানে, আমার চেতনার রঙে কান্না হল সবুজ। আমারও কিছু রং, তুলি, ইকড়ি-মিকড়ি। ভাবি, ওটা ওভাবে নয়, এভাবে। শব্দকে নতুন করে সাজাই। সে সাজুক, বাজুক। সে পরাজিত দুখি না হয়ে, আনন্দের হোক। এমন কবিতা লিখি, এমন, যেন নিজের ভেতরের সবটা, অক্ষরে। অক্ষর বেজায় দুষ্ট ছেলে, পালিয়ে বেড়ায়। আড়ালে, গোপনে। ডাকি, আয় বাবা খগেন, আয় ব্যাটা নগেন। এমন করে সাজাব তোকে, আগে কেউ দেখেনি। মানুষের ভেতরের গাছপালা পল্লবিত হয়। আমার মধ্যে যেসব দুনিয়াদারি, জগৎজীবন, রাজাগজা তারা অক্ষরে সাজলে কেমন, সেইটে দেখি। ঢালাই মিস্ত্রির সতর্কতায়, শব্দ, ফার্নেস থেকে বের করে, ঢালি। আর কী পেতে চাই আমি, লিখে? আর কোন আনন্দ?
এবং, ঐ যে ডিভাইন ইনস্যানিটি, দৈব-উন্মাদনা ---- আমৃত্যু আমি তার নিগড় থেকে মুক্ত হতে পারব না। হ্যাঁ, সেখানে এসথেটিক প্লেজারই একমাত্র ডিভিডেন্ড।”
.
অজিতের পত্রিকা ‘শহর’-এর ২৬তম সংখ্যায় একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন অনেকে। অজিতের দেয়া উত্তরগুলো থেকে স্পষ্ট হয় ওর অবস্হান।
মানস নাথ : আপনি শয়তান, নাকি ঈশ্বর?
অজিত রায় : যে কোন সৃষ্টিই হয় শয়তান কিংবা ঈশ্বরের হাত থেকে। কেননা স্রষ্টা মাত্রেই সময়ে সময়ে ঈশ্বর, আবার শয়তানও। বিশেষত গদ্যকার। গদ্যকারদের মাথাটা অনেক জটিল ও কুটিল হতে হবে। ধড়িবাজ, খেয়ালি, বেপরোয়া, শ্যেনদৃষ্টি, হারামি, সন্ন্যাসী, রুগী, জাঁবাজ, কীর্তনীয়া, জাদুবাজ সব হতে হবে তাঁকে, তবেই যুগের উপযোগী গদ্য লেখা সম্ভব। আমাকে মনি বাউরি বলেছিল, বাবুর ধান আর ধেনোর খুব পহিচান দেখছি। কথাটা ফিলজফি ঠেকেছিল। তো, কথাটা হচ্ছে ধান, ধন আর ধেনো আমাদের অভিজ্ঞান থেকে আসে। যারা ধানের চাল খায়, তারা কি ধেনোর টেষ্ট বোঝে? আমি বহুল চালু কথা-কিসসার মুখোস নুচতে চাই, ‘কথা’য় কথা-বানাবার-খেলাই গদ্যকারকে ডোবায়, ন্যারেটিভিটি, যা থেকে আমি বাঁচতে চাই। পুরো এখুনি পারছিনা হয়ত, কিন্তু মাথায় আছে। লিখছি কি, ছাই লিখছি, কী লিখছি হরদম বুঝিনা আমাকে দিয়ে কে লেখাচ্ছে, তা-ও। লিখছি কিছু, ভাবছি হয়ত অন্য। মজার উইট আনছি, হিউমার, অথচ মনটা কী বাজেরকম বিষন্ন। এমনও হয়েছে কী লিখে ফেলেছি, কতটা, পরদিন হয়ত অবাক হয়েছি পড়ে। আমি দিনরাত এক থাকি না, যেন এক সুপারি নেওয়া খুনে, ছনভন করে ঘুরে বেড়াই, কখনো নিজেকে খুব খেলো করে মিশি, কে-টির জল-বয়, মাতাড়ু, কখনো নদীতীরে একাকী দোতারা হাতে নিঃসঙ্গ বাউল। বিশ্বাস মানুন, আমাকে যা দেখতে, আমি তা-ই নিছক নই। কখনো গান্ধীর রাজনৈতিক-নৈতিকতা ধর্ষিত ইজারাদার গেরো সিং, কখনো গোদারের ছবি দেখে বেরনো ভাবুকরাম। কখনো লাইনবাজ, কখনো-বা সভ্যতা বা সম্পর্কের জটিলতার পঙ্কিল চক্রব্যুহে ফাঁসা আসামি। ……তো, মজাটা হচ্ছে, হারিয়ে যাবার তো কোন রোকটোক নেই, ফিলজফিকাল ব্যারিয়ার নেই। হারিয়ে যাই আর-কি। ওগুলো আমার ‘দেখা’ বা ‘অভিজ্ঞতা’ হয়ে উঠে আসে। কিন্তু বেশী না। দশজন লেখকও যদি ট্রান্সপারেন্ট হয়, নিজেকে হুবহু তুলে আনে, মাইরি বলছি, বাংলা সাহিত্য ফাটাফাটি হয়ে যাবে। তখন কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, ছোট বা বড় নয়, তখন প্রত্যেককেই আলাদা আলাদা চোখে দেখা হবে। পড়া হবে। এরম গড্ডালিকা চালে তো সামুদায়িক ভোজ খেতে যাই আমরা। মিথিকাল প্যারালালিজম্ বলে বাহ্যভাষায় একটা কথা আছে, কবুল করি। রুটি গুড়িয়ে চা খেত বলে ভারতচন্দ্র সৃষ্টি জানত না, এ বিশ্বাসে আনা বারণ। তবে কল্পনার সোর্ড চালাতে হবে, দ্বিমত নেই। আরে বাবা, শয়তানের কি সৌন্দর্যবোধ থাকে না? একজন চরম লম্পটও মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যায়, মালটা ‘খাসা’ বলে।
দীপঙ্কর দত্ত : আপনি সাহিত্য আর পর্নোগ্রাফির মধ্যে ভেদ মানেন না ?
অজিত রায় : পশ্চিমের সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে তথাকথিত ভাবে পোক্ত দেশগুলিতে সাহিত্য আর পর্নোগ্রাফির মাঝের গ্যাপটা খতম হয়ে গেছে। আমি মনে করি পর্নোগ্রাফি সাহিত্যেরই একটি অনিবার্য আর এস্টাবলিশড্ genre। এই তো কিছুদিন আগে Georges Betaille-এর ‘Story of the Eye’ পড়ছিলাম, যার ওপর ৪৫ পাতা সমীক্ষা লিখেছেন Susan Sontag আর Ronald Barthes, তারপর Giyotat, যাঁর ‘Eden, Eden’-এর প্রিফেস্ লিখেছেন Michel Foucault,- এঁরা প্রত্যেকে সোকল্ড পর্নোগ্রাফি লিখেই সাহিত্যিক হয়েছেন ; শেষের দিকে ফুকো নিজেও ঐরকম একটা বই নাকি লিখেছিলেন। ‘শহরে’ সুবিমল মিশ্র যে গল্পটা লিখেছেন, ‘আলো আমার আলো ওগো’, সেটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী গল্পের উৎকৃষ্ট উদাহরণ, আবার বাংলা পর্নো-সাহিত্যেরও। প্রয়োজন বা আর্জ হলে আমিও ওরকম উপন্যাস লিখব। তবে আমি তাকে আমার সাহিত্যেরই হিসসা হিসেবে স্বীকৃ্তি দেব। সাহিত্যের নির্দিষ্ট কোন বিষয় আছে বলে আমি মানি না।
বিমলকান্তি ভট্টাচার্য : আপনি কি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী নন ?
অজিত রায় : প্রথম কথা, সাহিত্যের মত নিত্য-প্রবহমান শিল্প প্রকরণের, যা কিনা গনগনে আঁচের মত, নদীর মত প্রতিমুহূর্তে প্রতিটি গড়ে ওঠা আধুনিকতা অভাবনীয় নতুনত্বের তোড়ে ভেসে যায়, দাঁড়ায় না এক মুহূর্তও, সেখানে একজন লিখিত সাহিত্যের লেখকের পক্ষে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া খুব মুশকিল। কেউ যদি বলছেন তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী, সেটা নিছক তাঁর আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া, এর তো কোন বাঁধাধরা ছক নেই। প্রতিষ্ঠান মুখিনতা আর বিরোধিতা দুটোই বহুস্তর পরম্পরায় পরস্পর হরদম মুখোমুখি। ঐ ছকের রাস্তাটা থেকে কেটে বেরিয়ে, বেরোতে থাকার মুহূর্তে যে-সব বাধা তার সঙ্গে যে সংঘাত সেটাই সেই মুহূর্তের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। কিন্তু যে মুহূর্তে চালু ছকটা ভেঙে ফেলছি, পরমুহূর্তেই আরেক ছকে বন্দী, তখন আমিই প্রতিষ্ঠান, বা প্রতিষ্ঠানমুখী। তখন আবার নিজেকে ভাঙতে হবে, পাল্টাখুন, জহরব্রত চালাতে হবে। তখন ফের সক্রিয় বিরোধিতা। এভাবে না-ফুরোনো লড়াই। ফলে কে কখন প্রতিষ্ঠানমুখী বা বিরোধী, তা নির্ণয় করার কোন উপায় নেই। তবে বাংলাবাজারে যে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’র ঝাণ্ডা উড়তে দেখছি, সেটা সহজে চেনা যায়। আনন্দবাজার, দেশ কে গুনে গুনে ক’টা গাল ডেলিভার করো, ব্যাস্, তুমি বড়কা প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব’নে গেলে। থাক তোমার পরনে অ্যাডিডাসের গেঞ্জি, নর্থস্টার জুতো, রেমন্ডের স্যুট, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সব থুতু তোমার সর্বাঙ্গে- কিন্তু তুমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী। আমি তো ভাই বাংলা লেখালেখির জগতে গত বিশ বছর ধরে যা দেখছি, কাউকেই সম্যক অর্থে অ্যান্টি-এশটাবলিশমেন্ট বলতে পারি না। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বিভিন্ন অনুষঙ্গ অনেকের মধ্যে দেখা যায়, আমার মধ্যেও আছে, কিন্তু যে-মুহূর্তে আমার রচনা-উৎপাদনের কাজ চলছে, আমি সক্রিয়, কিন্তু লেখাটা শেষ হতেই আমি মৃত, তখন আবার সেই ছকে। বাংলাবাজারে একজন সত্যিকারের প্রতিষ্ঠানবিরোধীর, মানে একই সঙ্গে যিনি থিওরি এবং প্র্যাকটিসে, সামাজিক ও ব্যাক্তিগত কারবারে সেই বিরোধিতার একটা সদা-সক্রিয় রূপ নিজের সঙ্গে মিশিয়ে চলতে পারবেন, সেরকম একজন প্রকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধীর চাহিদা তাই থেকে গেছে। তাঁকে আগাগোড়া ট্রান্সপারেন্ট হতে হবে, ভেতর-বার স্বচ্ছ হতে হবে। যিনি পর্নোগ্রাফি আর সাহিত্যে ভেদরেখা টানেন, সেই স্বঘোষিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী বাঙালীবাবুটিকে আপনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলবেন? যাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কোন প্রতিফলনই পঁয়ত্রিশ বছরের সাহিত্যচর্চায় প্রকাশিত নয়, তাঁকে? আত্মনৈরাজ্যের এই কীর্ণ ভূমিতে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ধারণাটাই এখন ভাঁওতা হয়ে গেছে। এবং লেখালেখির ক্ষেত্রে, আমি তো বলব, প্রথাবিরুদ্ধ শাস্ত্রবিরুদ্ধতাও এক ধরণের ব্যতিক্রমী মিথ।
মৌলিনাথ বিশ্বাস : তোমার কাছে জীবনের শেষ অর্থ কী? যৌনতা কি তোমাকে সৃষ্টিশীল করে? করলে, কিভাবে? আমি তাত্ত্বিক অবস্থান বুঝতে চাইছি।
অজিত রায় : বিগত এই চব্বিশ বছরে আমি হয়ত অনেক কিছু করতে পারতাম-কিন্তু, অন্য দিকে না ‘পালিয়ে’ আমি যে লেখালেখিকেই আত্মস্ফূরণের আধার বা আধেয় হিশেবে ধরেছি, বরণ করেছি, লেখালেখি ঘিরেই আমার জীবনের যা-কিছু যখন, জীবনের অর্থ বা শেষ অর্থও, বলা বেশি আমার সমস্ত ভাবনা এবং খনন এই নর্মজীবন, যা আসলে কর্মজীবন,--- একেই ঘিরে। তাতে যদি জীবনের ‘অনর্থ’ বেরোয়, তা-ও সই। আগেই বলেছি ব্যাখ্যাহীন না-ইলাজ্ ডিপ্রেশন বা অব্যক্ত মর্মপীড়ার কথা-লেখালখি, একমাত্র লেখালখিই সে-থেকে আমাকে মানসিক উপশম দ্যায়, দিতে পারে। আমি এখন জীবন আর সাহিত্যের মাঝে হাইফেনটুকুও রাখবার পক্ষপাতী নই, এটা আমার ভেতর থেকেই এসেছে। ফলত, আমি যদি নিজেকে জানতে চাই, সম্পূর্ণ আবিষ্কার করতে চাই লেখার মাধ্যমেই আমাকে তা করতে হবে। নিজের বাইরের ‘স্ব’-এর সঙ্গে ভেতরকার সংগুপ্ত ‘আমি’র ‘স্ব’-কে মেলাবার চেষ্টা-সেই আমার লক্ষ্য। প্রতিমুহূর্তের বদল-খাওয়া ‘আমি’ কে ধরা। সেই ‘সত্য’ বা ‘অর্থে’র জন্যে আত্মখনন। পাশাপাশি গদ্য, শব্দকলাপ, তার মজা বা রগড়কে উপভোগ করা।
আর, দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা, যৌনতা আমাকে সৃষ্টিশীল করে কিনা, এ প্রশ্নেরও জবাব এতখানি হতে পারে যে পৃথক একটি প্রবন্ধই হয়ে যায়। তবু চেষ্টা করি। ‘যৌনতা’ তো আমাদের বানানো শব্দ, পিতৃ্তন্ত্রের ধারণায় খরাদ করা, এবং হালের আমদানি। আগে যখন পুরুষ-প্রকৃতি সম্পর্কের ব্যাপারটা ছিল, তখন ‘যৌনতা’ ছিল না। ধর্মশাসন আর অ্যাকাডেমীর ট্যাবু ব্যাপারটার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে যৌনতা তার সনাতনী ঝংকারই ভুলে গেছে। উনিশ শতকের ফর্সারা হঠাৎ ধরে ফেলল যে যৌনতা জৈব-প্রজননের প্রবৃত্তিগত তাড়না হলেও, তাকে মন আর মগজ দিয়েও নাকি ‘করা’ যায়। যে-কারণে যৌনতার প্রতিশব্দ হিসেবে আমরা পাচ্ছি ‘কামশক্তি’ আর ‘কর্মপ্রেরণা’ শব্দ-দুটো যদিও এই ধারণা ফ্রয়েডের লিবিডো ধারণা থেকে খুব-কিছু ফারাকে নয়। ফ্রয়েড যৌনতাকে একটা স্বয়মভূ ব্যাপার ভেবে এগিয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর ‘আমি’ হয়ে গেল ‘লিঙ্গ’। মানুষের সৃজনশীলতা, ফ্রয়েড বলেছিলেন এই লিঙ্গবোধ থেকে চাগায়। এ থেকে কিছু সরে এসে, এ-যুগের তত্ত্বদর্শী মিশেল ফুকো বললেন, সমাজের যে-কোন প্রবৃত্তিগত ক্ষমতার সম্পর্ক এবং যৌন-সম্পর্কগুলো, সরাসরি আড়ালে বা আপাত-অযৌন মনে হলেও তা আসলে প্রতাপেরই স্ফূরণ। আমি এসবের কোনটাই অগ্রাহ্য করছি না, কিন্তু যদি যৌনতা বলতে এখনো শুধু জৈবিক কামতাড়নাকেই ইঙ্গিত করা হয়, দুঃখিত, ঈশ্বরের মত তথাকথিত যৌনতাকেও আমার ভাবনার ভারসাম্যে কোথাও বসাতে পারছি না। কেননা, ঈশ্বরের কথা বাদ দিলেও, সেই ‘যোনি’-উদ্ভূত যৌনতা আমার কাছে ততখানি যথার্থ, তার অনেক বেশি কল্পনা। একটা নিরাবয়ব ফোর্সের মত আমার কাছে যৌনতা। এটাকে যে-যেমনভাবে ভাবতে চাইবে, তার কাছে তা-ই যৌনতা। কেউ নারীর পায়ের টো থেকে চুলের ঘ্রাণ অব্দি সর্বত্র যৌনতা পায়, কেউ-বা-যেমন উদয়ন ঘোষ, -কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা লতা মঙ্গেশকরের গলা শুনেও সেটা ফিল্ করেন। আমার এক বান্ধবীকে দেখতাম, সুন্দর-কিছুর রসময় বর্ণনাই তাকে বেসুধ করে ফেলত, জাগতিক যা-কিছু শুধু কল্পনায় ছোঁয়া যায় অথবা অনুপম কোন কিছুর স্বপ্নই তাকে অরগ্যাজমে পৌঁছাতে দিত। নতো, আমার কাছে যৌনতা খানিক ঐরকম। যৌনতা শব্দের উচ্চারণ-মাত্রে যে আমার লিঙ্গ বা যোনি মনে পড়ে ঈশ্বর বা অদৃশ্য-শক্তি বলে ভাবি, যে আমাকে ক্রিয়েটিভ রাখছে, আমার ‘আমি’কে স্টিয়ার করছে, হোক সে ‘অহং’, কিন্তু সেই সত্য তো আমি অনুভব করছি! সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘কামুক’রাই এগিয়ে। যৌনতা, হ্যাঁ, আধুনিক অভিধায় তো তা-ই বলব। আসলে এ-দেশে, বহির্বিশ্বেও ‘তত্ত্ব’ হিশেবে যৌনতা এখন এমন পিলপিলে পর্যায়ে আছে যে বিষয়টি উত্থাপন করাই দুরূহ এবং ঝুঁকির। পিতৃতন্ত্র আর ধর্মের ট্যাবু আমাদের গবেষণা আর জ্ঞানার্জনের ফাটক রুদ্ধ করে রেখেছে। ধর্ম বা আধ্যাত্ম নিয়ে আমরা যতটা ভেবেছি, অনাস্থা আর অস্থিরতার পাল্লা যেন ক্রমশ ভারি হচ্ছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক হিশেব নেই, কিন্তু অনুমান করি অ্যান্টি-আরবান মানসিকতায়, নাস্তিকদের দিকেই যেন ভিড় বাড়ছে। যুক্তির কাছে পরাস্ত প্রফেটদের দাঙ্গা-উৎপাদক শাস্ত্রের উল্লাস। ঐ ধর্ম নিয়ে যতখানি মেতেছি আমরা, তার চেয়েও বেশি দরকার যৌনতা নিয়ে। এথোপোয়েটিক্যালি ভাবতে হবে ব্যাপারটা নিয়ে। ফ্রয়েডের ‘সৃজনশীলতা’র ব্যাখ্যাকে নারীবাদীরা মনগড়া বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, ভাবতে হবে নতুন করে। কেননা, ‘মন’ তো বস্তু-নিরপেক্ষ অন্য কিছু না। হ্যাঁ, ‘কামশক্তি’ অর্থে নয়, ‘কর্মপ্রেরণা’ বা ‘সৃজনশীলতা’ হিশেবে যৌনতাকে আমি মান্য করি।
সঞ্জীব নিয়োগী : ‘শিল্প’ ব্যাপারটাই কি একটা কৃত্রিম ব্যাপার নয়? শিল্পের কোন ধারা-ই কি এই কৃত্রিমতা (Imitation) এড়াতে পারে? সম্ভব? কীভাবে, কীভাবে নয়? এ প্রসঙ্গে ‘বাস্তবতা’র দাবি-টাবি কী উপায়ে বিশ্লেষিত হবে?
অজিত রায় : তুমি যে গোড়াতেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাথরডাঙ্গা গ্রিস থেকে মাইমেসিস শব্দটা ঢুয়ে এনে আমার পিঠে বসালে, ধন্যবাদ, সেই সুদূর প্লেটো-অ্যারিস্টটল্, হোরেস, মধ্যযুগ আর রেনেশাঁর কর্তাদের থেকে ধেয়ে আসছে শব্দটা, এটা নিঃসন্দেহে শিল্প সাহিত্যের ‘সংজ্ঞা’ নিরূপণে তুমিও সত্যের কেন্দ্র-বিন্দু থেকে খুব অল্প দূরেই আছো। অনুকরণ বা মাইমেসিস হলো সর্ববিধ কলার genus. অনুকরণের রীতি-ছন্দ, ভাষা আর সঙ্গতি। সাইকোলজিক্যালি, লেখক লেখে মূলত দুটি কারণে ----- অনুকরণ-বৃত্তি আর সঙ্গতি-বোধ। Imitation as an Aesthetic term, এটা এখনো অব্দি অগ্রাহ্য হয়ে যায়নি। চারুশিল্প বা fine art কথাটা গ্রিকরা জানত না। তাদের পরিভাষা : ‘মাইমেটিকাই টেকনাই’। All art is mimesis কথাটার প্রবর্তক অ্যারিস্টটল্ নন, প্লেটো এবং তার আগেও কথাটা চালু ছিল গ্রিসে। অনুকরণ বা Imitation শুনলে মনে হবে স্বাধীন কল্পনার চান্স নেই ----- যদ্দৃষ্টং তল্লিখিতং গোছের। তা তো আর নয়। শিল্পীরা অনুকরণ করে as they ought to be . একটু আগে যেটা বলেছি, শিল্পের অনুকরণ শুধু বাহ্যদৃশ্য বা ঘটনা নয়, তার তিনটে বিষয়- চরিত্র, আবেগ আর ক্রিয়া। এগুলো ভেতরকার জিনিশ। যে-কারণে পরবর্তীকালে সাহিত্য-শিল্পে অনুকরণের ‘বিষয়’ হয়েছে- মানুষের জীবন, জীবনের মানসিক, আত্মিক আর দৈহিক আচার। প্লেটো-অ্যারিস্টটলের সময় wit, taste, imagination, fancy, feeling এসব শব্দের আবির্ভাব ঘটেনি, ফলে ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশন্ সম্পর্কে তখন কোন ধারণা গড়ে ওঠেনি। অথচ লেখালেখি ব্যাপারটা সৃজনশীল কল্পনা বৃত্তিরই কাজ। ‘কৃ্ত্রিমতা’ কোন্ অর্থে বলছো বুঝতে পারছি না, লেখালেখি তো বাস্তবের হুবহু অনুকরণ বা প্রতিরূপ নয়, ---- সেই বাহ্যবস্তু বা বাস্তব লেখকের মনে যেভাবে প্রতিভাত, তারই প্রেজেন্টেশন্। লেখার যাদু লেখকের বুদ্ধিতে নয়, অনুভবে, কল্পনাবৃত্তিতে। শিল্প সত্যের রূপাভিব্যক্তি, সত্যের ধারণামাত্র নয়। আসলে, আমি যখন লিখি, অভিজ্ঞাত অভিজ্ঞান থেকে লিখি --- সেই জগৎটা কিন্তু অন্ধকার আর মায়ায় ঢাকা, মায়া সৃষ্টিতে দক্ষ না হলে বড় সাহিত্যিক হওয়া যায় না। অমিয়ভূষণ সম্ভবত একেই বলেতে চেয়েছেন সত্ত্বগুণ, এটা আমার চেয়ে অনেক বেশী মাত্রাই পাই কমল চক্রবর্তী লেখায়। সন্দীপন বা সুবিমলে তেমন পাই না। কমল এখনও সেজন্য আমাকে দিয়ে পড়িয়ে নেন। আসলে সাহিত্যের যে ‘কৃ্ত্রিমতা’ বা Imitation, তা কিন্তু প্রচন্ডভাবে Phantasia গোছের, জ্যান্ত। যে-কারণে মধ্যযুগে Phantasia আর Imagination শব্দ-দুটো একই অর্থে ব্যবহৃত হতো। যদিও ফ্রেকাসতোরো বলেছিলেন Phantasia হলো reproductive power আর Imagiও9nation হলো unifying power. আঠারো শতকে এসে প্রথম শব্দ পাচ্ছি ‘এস্থেটিক’। মানে ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশনের অটোনমি সাব্যস্ত না হওইয়া পর্যন্ত খাঁটি এস্থেটিকের জন্ম হয়নি। গামবাতিস্তা ভিকো থেকে এস্থেটিকের শুরু। এইভাবে ভিকো থেকে কান্ট, অনেক তত্ত্বদর্শী্রাই শিল্প-টিল্প নিয়ে নানারকম কথা বলেছেন, কিন্তু শিল্পের মূল যে-সংজ্ঞা প্লেটো-অ্যারিস্টটল অস্পষ্টভাবে দিয়েছিলেন, সেটা থেকে আলাদা বা নতুন কোন লক্ষণ কেউ নির্দেশ করতে পারেননি। অ্যারিস্টটলের ‘মাইমেসিস’ আর কান্টের ‘জাজমেন্ট’ পৃ্থক ধারণা নয়। উনিশ শতকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হেগেল, কোলরিজ, ভিক্টর কুঁজো, শেলী, হার্টম্যান, প্রুধোঁ, নীৎসে, টলস্টয় এঁরা আমাদের মাথা খারাপ করেছেন মাত্র, নতুন কিছু শোনান নি। আমাদের দেশেও রসবাদ, অলঙ্কারবাদ, নীতিবাদ, ধ্বনিবাদ, রম্যার্থবাদ এমনি আরও কতই না মতবাদ সাহিত্য শিল্পের-আত্মার পোস্টমর্টেম করবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই চেষ্টার শেষ ফল কিন্তু এক,-সবাই লেখালেখিকে অনুভব-কল্পনা-বুদ্ধিমিশেল যৌগিক মানসিক ব্যাপার বলে মনে করেন। এই প্রাগুক্ত মতবাদ আর লেখকেরা প্রত্যেকে ছিলেন ক্লাসিকাল গোষ্ঠীর, রক্ষণশীল আর এঁড়ে। সুতরাং তাঁদের উত্তরসূরীরাও, আজও, শিল্প সাহিত্যকে ‘অনুকরণ’ মনে করবেন। কিন্তু আমি মনে সাহিত্যে আজ যেরকম ভোলবদল আর পরীক্ষা চলছে, তা কোনক্রমেই নিছক ‘নকল’ হতে পারে না।
রীনা ভৌমিক : আপনি শব্দরাজ্যে অরাজকতার তাঁবেদারি করছেন?
অজিত রায় : অরাজকতার তাঁবেদারি! আমি করছি? মানে? এই কালো পতাকাটা তো পৃথিবীর সমস্ত ভাষাসাহিত্যকেই গোড়া থেকেই সয়ে আসতে হয়েছে বুন্টি। অ্যাংলো-স্যাক্সনে ফরাসি ভাষার মিক্সচার হচ্ছে যখন ইংল্যান্ডে, এইরকমই গেল-গেল হল্লা। সেই হাইব্রিডাইজেশনে লকড়ি লাগালে ইংরেজি সাহিত্য আজ এমন লাফ-মারা হতে পারত? ইওরোপের সব ভাষাই এমনি, জারগন্। সব জায়গাতেই তোমাদের দল ছিল, গেল-গেল ছিল। কথাটা হলো, মুখের কথাটা যে সাধুভাষারই অপভ্রংশ, সেইটে কেউ বলে না ; শুধু সাধুভাষাই খানিক মুখের ভাষা ঢুকেছে অমনি হারেরেরে-হারে হামলা। তারবাদে, বাংলা ভাষারই কেঁচো যদি খুঁড়তে চাও, খোঁড়ো, দেখবে এ ভাষার পাতনটাই তৈরি হয়েছে সংস্কৃত শব্দের ডোয়ার্ফ আর ঠুঁটো-নুলো আধভাঙ্গা শব্দ নিয়ে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্তরা তো বিভক্তিহীন সংস্কৃতটাকেই ‘বাংলা’ বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর মহাকবি মাইকেল মধুসূদন, উনি যখন আমাদের গ্রামে যান, তখন তো ভালো বাংলাই জানতেন না। ওই তোড়ফোড় গোছের এপিকগুলো, ওগুলো তো বেশির ভাগ আরকেইজম্ দিয়ে সারা। ডিকশনারি ঘেঁটে, পথচলতি মামুলি শব্দ এসবই ছিল মাইকেলের বেসিক নিওলজি। তাছাড়া, তার নাটকগুলো দ্যাখো, দীনবন্ধু মিত্র, ----- বেশি না, বঙ্কিমবাবুর মৃণালিনী আবার করে পড়ে দ্যাখো, ওগুলো কি হুতুম প্যাঁচার কোঠায় পড়ে না? রবীন্দ্রনাথ তো প্রথম ক’দিন ফয়সালাই করে উঠতে পারেন নি, প্রবন্ধগুলি মসনদী ঢঙে লিখবেন নাকি বীরবলী আন্দাজে। তো, আমার চেষ্টাটা, বলতে পারো, একটা তরতিব্। ঐ চলে আসা কালো পতাকার সারিতে, আরেকটা। গরম কড়াইয়ের ছনছন হলে তো কবেই উবে যেতাম।…তো, যে-কথাটা আমার তরফে বলার, আমি ভাই বিহার বাংলা ঝাড়খন্ডের ছিলকা-খাওয়া লোক, পিতৃভূমি বাঁকুড়া, মাতৃভূমি মানভূম। হাজার কিশিমের শব্দ শুনে আসছি হামাগুড়ির বয়স থেকে। কাজ করতে বসে যতরকম ভাষায় আমার দখল, তৎসম বাংলা তো বটেই, তদ্ভব, দেহাতি বাংলা, হাটবাজারের, ভাঁটিখানার বাংলা, ডেলি প্যাসেঞ্জারের বাংলা, তারপর হিন্দী, চোয়াড়ে হিন্দী, বিহারি বুলি, লালু-রাবড়ি বুলি, ভোজপুরী, মগহী, ঝাড়খন্ডী, খোরঠা, মায় উর্দু-ইংরেজি, যেটা যখন যতটুকু দরকার টপাটপ তুলে এনে গেঁথে দিই। মনে করি, একজন লেখক যতরকম শব্দ জানেন, সব ঢুয়ে এনে বসাতে হবে গাঁথুনিতে। এভাবে বাংলা সাহিত্যের ক্যানভাস স্প্রেড করবে। ‘কথা’য় নতুন জেল্লা ফুটে উঠবে। আমি সাহিত্যে শেকড়-বিহীনতার খেলাপ। মনে করি শেকড়হীন সাহিত্যপ্রচেষ্টা বা ঐতিহ্যবিরোধী সৃষ্টিপ্রযত্ন, কথাগুলি শুনতে যতই রেভলিউশ্যনারি লাগুক, গোটাগোটি এই ধাঁচের কোনও অভ্যুত্থান হতে পারে না। লেখককে, এবং সাহিত্যকে, জমিনের থেকে শব্দ ওঠাতে হবে, লোড করতে হবে। আর, ‘গদ্যে ঢালাও হিন্দী শব্দের অনুপ্রবেশ’। ছ্যা, আমি কি তাই করেছি নাকি? হাসালে দেখছি।
বারীন ঘোষাল : সাহিত্যকর্মকে তুমি বলেছো পলায়নি বৃত্তি। বলেছো, ‘কাজ আর কৃত্যের বাদাড় থেকে পালিয়ে অক্ষরের মুজঘাসে লুকনো’। এটা তুমি বিশ্বাস করো ?
অজিত রায় : পলায়ন। হ্যাঁ, বিশ্বাস করি মানে, খটকার কথায় আমি বলেছি। অবশ্য সেভাবে দেখলে মানুষ যা কিছু করছে সবেতেই, পালাচ্ছে। গান শোনা, ক্রিকেট, সোপ অপেরা, বউ-বাচ্চা সামলানো, ব্যাঙ্ক সামলানো, ভালমন্দ খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, রাতে কাজবাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়া, ঐ ঘুমোনোও কিন্তু একরকম পালানো। মানুষ এসবের মধ্যে নিজের স্বপ্নকে দ্যাখে, আর স্বপ্ন দেখবে বলে ঘুমোয়। লেখকের কাজটা তার-চে আলাদা কিছু নয়। তফাৎ এই যে, লেখক জেগে জেগে স্বপ্ন দ্যাখে।
বারীন ঘোষাল : এই পলায়ন কেন?
অজিত রায় : আমি কেন লিখি এর জবাব আত্মজীবনীতে দিয়েছি। যে, কেউ আমাকে পেছন থেকে স্টিয়ার করছে, কলকাঠি নাড়ছে। আমার মনে হয়, মাত্র সেই কারণেই শুধু নয়, লেখক পালাতে চায় নিজের দুরারোগ্য বা অব্যক্ত ডিপ্রেশন্ থেকে রেহাই পেতে, অমিয়ভূষণ বারবার যাকে ট্রমা বলে উল্লেখ করেছেন। আমি গভীর ও ব্যাখ্যাতীত ডিপ্রেশনে যখন ভুগি মাঝেমধ্যে, তখন স্ক্রু ড্রাইভার খুঁজি, খুরপি, হাতুড়ি, স্কেচপেন বা বোতল। সেমনি, কলমও খুঁজি। অমিয়ভূষণ ট্রমা বলতে অবশ্যই গ্রিক শব্দকোষে যে-অর্থে, সাইকিক ট্রমা, কবি-লেখকদের মধ্যে অব্যক্ত প্রতিকারহীন না-ইলাজ মানসিক কষ্ট, অন্তহীন ব্যথা। লেখকরা এই ট্রমা থেকে মানসিক মুক্তি পেতেই স্বপ্নবৃত্ত রচনা করে, লেখা, গল্প-উপন্যাস, সেই স্ব-সৃষ্ট স্বপ্নবৃত্তে পাক খেয়ে চলে। স্বপ্ন নির্মিতি পেলে, মানে লেখাটা বেরিয়ে এলে সে সুখও পায়। ঐ সুখ হল রস। রস না-পাওয়া কোন লেখক ‘সাহিত্যিক’ নয়, কবি নয়, স্রষ্টা নয়। সেই তার পরিপাশ আর সময় থেকে বেরিয়ে, বন্ধনমুক্ত প্রাণের এহ্সাস। কবি তখন শিশুর মতো। তার মৃত্যুভয়ও লোপাট তখন।
তনুময় গোস্বামী : আপনি লেখালেখিকে কখনও ‘spiritual practice’ হিসেবে দেখেছেন ?
অজিত রায় : জীবনে হয়ত অনেক কিছুই করতে পারতাম, কিন্তু, অন্যদিকে না ‘পালিয়ে’ আমি যে লেখালেখিকেই আত্মস্ফুরণের আধার বা আধেয় হিশেবে ধরেছি, লেখালেখি ঘিরেই আমার জীবনের যা-কিছু যখন, জীবনের অর্থ বা শেষ-অর্থও, বলা বেশি আমার সমস্ত ভাবনা এবং খনন এই নর্মজীবন, যা আসলে কর্মজীবন,--- একেই ঘিরে। তাতে যদি জীবনের ‘অনর্থ’ বেরোয়, তা-ও সই। আগেই বলেছি ব্যাখ্যাতীত ডিপ্রেশান্ বা অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা- লেখালেখি, একমাত্র লেখালেখিই সে-থেকে আমাকে মানসিক উপশম দেয়। এখন আমি জীবন আর সাহিত্যের মাঝে হাইফেনটুকুও রাখবার পক্ষপাতি নই। ফলত আমি যদি নিজেকে জানতে চাই, সম্পূর্ণ আবিষ্কার করতে চাই, লেখার মাধ্যমেই আমাকে তা করতে হবে।
তনুময় : নতুন উপন্যাস শুরু করার আগে আপনার কী ধরণের প্রস্তুতি থাকে? কোন নির্দিষ্ট গবেষণা ? হলে, তা কতদিনের? উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নাম আপনি কীভাবে নির্বাচন করেন? আপনি কি কখনও রাইটার্স ব্লকে পড়েছেন?
অজিত রায় : লেখালেখি খরিশ জিনিশ। জগদ্দল পাথর দেওয়া হয়েছে হাতে, তাকে ঠেলে-ঠেলে তোলা। প্রস্তুতি এটুকুই যে পাথরটা কখন হাতে আসবে। ওটা না-পাওয়া-অব্দি লেখা খোলস ছাড়ে না। তীব্র যন্ত্রণার অনুভূতি, সেটাই লেখার ভাবনাকে প্রেগন্যান্ট করে। উপন্যাসের মূল চরিত্রই আমি। সুতরাং পাণ্ডুলিপির প্রথম খসড়ায় ‘অজিত’ নামটাই বসাই। ফের হঠাৎ লাগসই নাম মাথায় এলে অজিত কেটে ওটাকে পেস্ট করে দিই। হ্যাঁ, রাইটার্স ব্লক একসময় হয়েছিল বইকি! আমার শেষ-চাকরিটা করার বছরগুলোতে, ১৯৮৯ থেকে ’৯৫- এই কাল পরিধিতে। মায় বাংলাভাষা ভুলে, বাংলা ভুলে , চাদ্ধার কেমন লোপাট আর থম্-মারা। সুতরাং বিষণ্ন ও মৃত্যুমুখী, নিজেকেও কেমন অকেজো ও মৃত ঠেকতো, তদুপরি ফতুর।
.
স্ত্রীর মৃত্যুর পর অজিত লিখেছিল, “বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এ এক নতুন প্রত্যাবৃত্তি। এসেছিলাম তিন, ফিরছি দুজন। হয়ত আরও-কিছু মুছে ফিরছি। এতদিন অনেকখানি বোহেমিয়ান জীবন তো কাটালাম, অনেকে সঙ্গও দিয়েছেন। এবার অন্তর্মুখী হওয়ার পালা। এটা সত্যিই অনুভব করছি। একটু গুছনো জীবনে ফেরার তাগিদ। স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে তো তেমন উপভোগ করতে পারিনি জার্নিটা, এবার প্রান্তসীমা অবধি একা মেয়ের সঙ্গলাভে কাটিয়ে দেখি। সব সময় একক থাকাই লেখার রসদ জোগায় এমনটা এখন আর মনে হচ্ছে না। অর্থাৎ, যথাসম্ভব নিজেকে পাল্টানোর পালা, জীবনকে নতুনভাবে দেখার পালা। হ্যাঁ, আমার পক্ষে এও এক চ্যালেঞ্জ, আমিই গ্রহণ করলাম। জীবনকেই কামনা করি, শেষে ও প্রথমে। জীবন একটাই, দেখা অনেকরকম।”
তা আর হলো না।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।