কবি জয়িতা ভট্টাচার্যের ‘হয়ে ওঠা’
পুরুষ কবি ও লেখকদের ‘হয়ে ওঠা’ নিয়ে নানা আলোচনা পড়ার সুযোগ হয়েছে, কোন পুরুষ লেখক বা কবির গ্রন্হে তাঁর হয়ে ওঠা বর্ণিত হয়েছে তা পড়েছি ইংরেজিতে, কেননা তাঁরা ইউরোপিয় সাহিত্যিক, এবং এই ‘হয়ে ওঠা’ ব্যাপারটির তত্ব তাঁদেরই গড়া। সাহিত্যিক নিজেই যদি লেখেন তাহলে তা বিলডুংসরোমান ( Bildungsroman )-এর সাবাজনার কুন্সটলরোমান ( Kunstlerroman ) অথবা ‘শিল্পীর নিজস্ব ন্যারেটিভ’ হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছে। অন্যের লেখা হলে তা বিলডুংসরোমান। জয়িতা ভট্টাচার্যর এই গ্রন্হের ন্যারেটিভ ওই দ্বিতীয় বর্গে পড়ে, যদিও তা কেবল ‘হয়ে ওঠা’য় সীমাবদ্ধ নয়। কিন্তু, এখানে একটা কিন্তু আছে, তা এই যে জয়িতা বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে, ইউরোপিয় পরিবারে প্রতিপালিত মেমযুবতী নন। তাঁর ‘হয়ে ওঠা’র সঙ্গে এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিঙের ‘অরোরা লেই’, মারিয়া বেনেডিটা বোরম্যানের ‘লেসবিয়া’, প্যাট্রিসিয়া হাই স্মিথের ‘দি প্রাইস অফ সল্ট’, অ্যালিস মুনরোর ‘লাইভস অফ গার্লস অ্যাণ্ড উওমেন’, মার্গারেট লরেন্সের ‘দি ডিভাইনার্স’, মার্গারেট অ্যাটউডের ‘ক্যাটস আই’, জেনিফার ডোনেলির ‘এ নর্দার্ন লাইট’ বইগুলোর তুলনা করা ভুল হবে। তার কারণ তাঁরা লড়েছেন মূলত সমাজের চাপিয়ে দেয়া সেই মূল্যবোধের সঙ্গে যা নারীর পক্ষে অস্বস্তিকর এবং একজন মহিলা কবি-লেখককে লেখার স্বাধীনতা বা বেঁচে থাকার স্বাধীনতা তেমনভাবে দেয় না, ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’র দেয় না, যা একজন পুরুষকে দেয়।
পক্ষান্তরে, জয়িতা ভট্টাচার্যকে প্রথম থেকেই লড়তে হয়েছে দশভূজার মতন, বা হয়তো আরও বেশি হাতে, এবং তিনি পা-ও চালিয়ে থাকতে পারেন। বইটি পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন যে তাঁর লড়াই এখনও শেষ হয়নি। সাহিত্যের জগতে জয়িতার প্রবেশ, কৈশোর-তারুণ্যের বাধানিষেধের বিরুদ্ধে, ব্যক্তিগত এক কনটেমপ্লেশান, নিজের অন্তর্জগতের অভিপ্রায়, আবেগ ও আকুল কামনার সঙ্গে পরিচিত হবার উদ্দেশ্যে।
ভারতীয় উপমহাদেশে, পরিবারে কন্যাসন্তান কেউ সাধারণত চান না, আর প্রথম সন্তান কন্যা হলে পাড়া-পড়শিরাও যেচে বাড়ি এসে হাহুতাশ বিলিয়ে যান। জয়িতার পরিবারে সবায়ের আশা ছিল ছেলে হবে। হল না। জয়িতার যখন ভাই হল, তখন তাঁদের চাহিদা পূরণ হলো। কিন্তু ছেলে হবার দরুন জয়িতার আদরযত্নের খেয়াল রাখার প্রয়োজন মনে করলেন না তাঁরা। পরিবারে যে একটা স্পেস বা পরিসরের প্রয়োজন হয়, মেয়েদের বিশেষ করে, তাকে গুরুত্ব দিতে চান না ভারতীয় উপমহাদেশের বয়স্ক আত্মীয়-স্বজনরা। আমার মনে হয়, যাঁরা লেখালিখি করেন না, তাঁদের মস্তিষ্কে একটি স্ট্রিম অফ কনশাসনেস বইতে থাকে, নানা খাতে বইতে থাকে। জয়িতাকে তো কেউ প্রশ্রয় দেননি লেখালিখির, তবু তাঁর মনে হয়েছে যে মগজের ভেতরে যে চেতনার ধারা বহমান তাকে প্রকাশ করা প্রয়োজন। কবিতার নীল বিষ গলায় ধরে রাখা আরম্ভ করলেন।
তিনি স্কুলে ভর্তি হলেন, কৈশোরে পৌঁছে টের পেলেন যে অযাচিত রোমিওদের মোকাবিলা করতে হবে তাঁকে, এই ধরণের অভিজ্ঞতা সচরাচর কিশোরদের হয় না। মেয়েদের কৈশোর পেরোবার পর বাড়িরে বাইরে একটা ভিন্ন জগত গড়ে উঠতে থাকে, আর যেমন-যেমন কিশোরীটি যৌবনের দিকে এগোন, তাঁর সমস্যা বাড়ে। বাড়ির বয়স্ক মহিলারা, কিশোরীকে বলেন না যে তার বয়স হয়েছে, একদিন যোনি থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে পারে, এবং তা প্রতিমাসে হবে, তাকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বাঁধতে হবে। কৈশোরে প্রথম রক্তের অভিজ্ঞতা এবং পিরিয়ডজনিত শারীরিক কষ্ট তার জীবনে একটি জলবিভাজক। এখনকার কিশোরীদের, টিভির বিজ্ঞাপন ও বন্ধুদের অভিজ্ঞতার দরুন, ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবার সুযোগ হয়, যা জয়িতার সময়ে ছিল না।
স্বাভাবিকভাবে মন ও দেহ প্রেমের ডাক জাগায়, মস্তিষ্ক ডাক দেয় কবিতার দিকে, সামাজিক বিপ্লবের দিকে। জয়িতা কবিতা লেখা আরম্ভ করেন ; তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। তিনি ‘পার্টি করা’ আরম্ভ করেন। তিনি প্রেমে পড়েন। প্রেমে পড়লে যেমন হয়, জয়িতা প্রেমিককে বিশ্বাস করে বিয়ে করার পর জানতে পারেন যে স্বামী কোনো চাকরি-বাকরি করেন না, তাঁর বিদ্যায়তনিক শিক্ষা নেই, অর্থাৎ চাকরির বাজারে তিনি অচল। শশুরবাড়ি গিয়ে, অতএব, সংসার সামলাবার আর্থিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে হলো জয়িতাকে। বাড়ির বিরক্তিকর ভাড়াটে তোলার দায়ও তাঁর ওপর বর্তালো, বহু পুরোনো বাড়ি সারাবার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তালো।
ভাগ্যক্রমেই বলতে হবে, তিনি একটি স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি পান। তিনি সন্তানসম্ভবা হয়ে ওঠেন। তাঁরও প্রথম সন্তান একটি মেয়ে, যার দরুন মা ও মেয়েকে একই সঙ্গে খোঁটা খেতে হয়। প্রথম দিকে শিশুকে কোলে নিয়ে চাকরি করতে যেতেন। পরে তাকে বাড়িতে রেখে আসতেন ;বুকে বাড়তি দুধ হবার ফলে প্রতিদিন টয়লেটে গিয়ে দুধ গেলে ফেলে দিতে হতো, এবং শিশুটির জন্য লুকিয়ে কেঁদে নিতে হতো। এইটুকু সময়ের মধ্যে কতোকিছু হয়ে উঠলেন তিনি– কবি, প্রেমিকা, স্ত্রী, রাঁধুনি, শিক্ষিকা, মা, বউমা, সংসারের আর্থিক মেরুদণ্ড, ভাড়াটেদের নিয়ন্ত্রক !
মনের ভেতরের প্রবাহ তো থামে না, তা অভিজ্ঞতার প্রহারের সঙ্গে ঢেউয়ের আছাড় মেরে এগিয়ে নিয়ে যায় পরবর্তী সংঘাতের দিকে। জয়িতার শশুর আক্রান্ত হলেন ব্রেন টিউমারে এবং শাশুড়ি আক্রান্ত হলেন ক্যানসারে, এবং জয়িতার সেবার দায়িত্ব বাড়ল। সংসারের চাপে তাঁর লেখালিখি ছেড়ে গেল, কফিহাউসে যাওয়া, কবিদের সঙ্গে সময় কাটানো, নতুন কবিতা কেমন লেখা হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করা বন্ধ হয়ে গেল। ‘পার্টি করা’ থেকে তিনি নিজেই বেরিয়ে এলেন যখন চোখের সামনে দেখলেন যে তথাকথিত নেতারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন, সাধারণ মানুষের জন্য কিছুই করছেন না। জয়িতার ঘরের দেওয়ালে ধুলোর আড়ালে ঝুলে রইলেন চে গ্বেভারা। যাপন ও প্রেম সম্পর্কে মোহমুক্তি তাঁকে বার-বার টেনে নিয়ে গেছে লেখালিখির দিকে, যার জন্য তাঁর পক্ষে সময় বের নেয়া ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। একজন লেখিকা ও মানবী হিসাবে নিজেকে আবিষ্কারের প্রয়াসে খুঁজে পাবার প্রয়াস করতে হয়েছে আত্মপ্রকাশের নিয়মনিষ্ঠ প্রণালী। জয়িতার এই ন্যারেটিভে তিনি অবজেকটিভ লেখিকা হিসাবে তাঁর নৈতিক লড়াইকে প্রতিফলিত করতে চেয়েছেন, নিজেকে প্রশ্ন করেছেন তাঁর নির্ণয়গুলো সম্পর্কে, কেননা তাঁর অন্তরজগতের বিক্ষোভ, চাঞ্চল্য, কলরোলগুলোই পরিচালিত করেছে তাঁর ন্যারেটিভকে। যেন মনে হয় ন্যারেটিভের প্রট্যাগনিস্ট এমন স্হিতিতে রয়েছেন যা তাঁকে গণ্ডির বাইরে বেরোতে দিচ্ছে না। জয়িতার এখনকার কবিতা পড়লেও একজন নারীর এই অনুপ্রাণন পাওয়া যাবে। আবার লেখালিখির জগতে প্রবেশ করে ডাঁটিয়াল ও প্রাতিষ্ঠানিক পুরুষ র্যাম্বো-সম্পাদকদের হুমকি সামলাতে হয় জয়িতাকে, যাঁরা, জয়িতার কবিতা বা গদ্য তাঁদের পত্রিকায় প্রকাশ করার পর বলেন, “যা, পাতিরাম থেকে কিনে নে”।
ওপরে যে বিদেশিনি লেখিকাদের প্রসঙ্গ তুলেছি, তাঁদের কয়েকজনের মতন জয়িতার জীবনেও শৈশব থেকেই লেখন-প্রক্রিয়ার দিগন্তকে বাঙালি গেরস্তবাড়ির নিয়মনীতি দিয়ে একটা ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলার সীমারেখা গড়ে দিয়েছিল, আশেপাশের লোকজনরাও সেই রেখাকে স্হায়ি করার প্রয়াস যে করেননি তা বলা যাবে না। এই বাঁধনকে জয়িতা অস্বীকার করেছেন উইল পাওয়ারের মাধ্যমে, এই উইল পাওয়ার প্রকৃতপক্ষে আরেকটি পরিসরে স্হান তৈরি করার কৌশল, নিজের উৎসভূমি থেকে বেশ দূরে, যেখানে নিজের স্বপ্ন এবং কাঙ্খিত বৃত্তিকে সাফল্য প্রদান করা যায়। এই গ্রন্হের ন্যারেটিভ সেই সাফল্যের খতিয়ান।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।