এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  লিঙ্গরাজনীতি  অন্য যৌনতা

  • না বাঁচাবে আমায় যদি, মারবে কেন তবে? 

    দধীচি মুনি লেখকের গ্রাহক হোন
    লিঙ্গরাজনীতি | অন্য যৌনতা | ২৮ এপ্রিল ২০২৫ | ২১৪ বার পঠিত
  • দাঙ্গা নারী ইস‍্যু নয়। সাম্প্রদায়িক ইস্যুও নয়। জমি দখলের ইস্যু। সম্পদ দখল করার, অধিকার কেড়ে নেবার ইস্যু। কিন্তু তবে দাঙ্গা হলেই প্রতিপক্ষ কৌমের নারীর সম্ভ্রমে হাত পড়ে কেন?

    এই ‘কেন’র ভিতরে অন্তর্লীন পুরুষতন্ত্র ঘুমিয়ে আছে। নারীকে শস‍্যের মতই, সম্পদ হিসেবে ভাবার এবং ভাবাবার উভয়-মাত্রিক কল হাজার হাজার বছর ধরে এমন ভাবে মানসিকতায় মিশিয়ে ফেলা হয়েছে যে, যারা ঘোষিত ভাবে দাঙ্গা-বিরোধী, অসাম্প্রদায়িক, তারাও কলটি কেটে বার হতে পারছেন না। সেই কলের শেওলাতে পা পিছলাচ্ছেন।

    এই কলটির প্রধানত দুটি অভিমুখ। প্রথম মুখটি প্রত্যক্ষ‍। ক্ষমতা দখলের সময়, বিপরীত কৌমের মানুষকে শেষ করার জন‍্য বিশেষ ভাবে নৃশংসতার সংগঠন। সেটা ছকমাফিক। ভয়াবহতার ছবি দিয়ে ভয়টা আরও আরও করে বাড়িয়ে তোলা, আর সেটা দিয়ে মজিয়ে প্রতিপক্ষকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে ফেলাটাই লক্ষ‍্য।এতে আগ্রাসনের পথ সুগম হয়। একই সাথে, হাতের নাগালে পাওয়া অপর কৌমের সম্পদ (পড়ুন নারী) নিজের অধিকারে আনার আরেক রকম জিঘাংসাও কাজ করতে থাকে। যোনি, এক্ষেত্রে জমি। তাতে বীজবপন করতে পারার মানে, সেই জমির (পড়ুন শরীর) অনাগত ফসলে নিজের চিরকালীন ছাপ ফেলতে পারা।

    পরের মুখটি পরোক্ষ, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী। এই স্তরে, সেই ভয়াবহতার স্মৃতি উসকে উসকে অনন্তকাল জিইয়ে রাখা হয় আধিপত‍্যবাদটিকে কায়েম রাখার জন্য। আর সেটি রাখার জন্য, মাছের তেলে মাছ ভাজবার মতন, আবার সেই পুরুষতন্ত্রেরই প্রয়োজন পড়ে। তবে, তা সূক্ষ্মভাবে।

    পুরুষতন্ত্রের সিংহাসনের পায়া শুধুমাত্র একটি তো নয়। হলে, তা নড়বড়ে হত। শতাব্দীর পর শতাব্দী এমন করে টিকে থাকতে পারত না। দমিয়ে রাখা যেমন, তেমনই রক্ষণশীলতা, দুর্বলকে রক্ষা করার তাগিদও এখানে সমপরিমাণ। তবে সেই তাগিদ সর্বজনীন নয়। সীমিত, এবং পছন্দমাফিক। কোন কোন পরিস্থিতিতে দুর্বলতরের রক্ষা কর্তব্য‍, আর কোন পরিস্থিতিতে নয়, তার জন্য নীতিবোধের সংগঠন করা হয়। অক্ষগুলি ধূসর করে ফেলে, একটি নির্ধারিত অক্ষে যাবতীয় আলোকপাত করা হয় জেনে বুঝেই। এই নীতি-তন্ত্রের ভিত সমাজে শক্তপোক্ত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির উদ্ভব। আর সেই সাথে রমরমাও।

    জটিল লাগছে? লাগলে, তা স্বাভাবিক। গিঁটগুলো এমন ভাবেই ফেলা, যেন একবার ফিতে টানলে তার ফাঁস খুলতে না পারা যায়। বরং, আরো বেশি করে জট পাকিয়ে বসে। সহজে বলতে গেলেও অবশ‍্য কঠিনই লাগবে। তবে একলাইনে এটুকু বলাই যায়, রেললাইনে নারীর শরীর কাটা পড়ার জনমানসে যা অভিঘাত, তার চাইতেও ধর্ষণের অভিঘাত বেশি।

    কিন্তু এমন কেন? অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ বুঝি ছিন্নভিন্ন হয়ে মরার চাইতেও বেশি যন্ত্রণা দেয়?

    তা তো নয়। আসলে কষ্টটা এক্ষেত্রে মানসিক। আর একটু তলিয়ে ভাবলে, এর পিছনে রয়ে গেছে কৌমযোনি (পড়ুন উর্বরা জমি) সংরক্ষণের সেই আদিম দায়বদ্ধতা, যে দায় থেকে যৌন নিগ্রহের কথা শুনলেই, আমাদের যুক্তিবোধ, বিচার-বিবেচনার খেই হারিয়ে যায়!

    এই খেই হারাবার তন্ত্রটির হদিস রাজনীতির কারবারীরা জানেন। আর জানেন বলেই, খেয়াল করবেন আপনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধাচারণ করলেই রাষ্ট্রবাদীরা বার বার এসে মনে করিয়ে দেন আপনার মা বা বোনের সাথে এমনটি ঘটলে কী হত! তারা যে নিছক নারীর সম্ভ্রমরক্ষার্থেই এতটা ভাবনা চিন্তা করছেন তা তো নয়। তারা চান, ভয়াবহ সেই যৌন নিগ্রহ আপনার পরিবারের নারীর সাথে ঘটে যাবার কাল্পনিক চিত্রকল্প আপনার মধ্যে জাগাতে। 
     
    সেই জাগরণে লাভ কার? আপনার কি?

    একটু ভেবে দেখবেন, এতে আপনার লাভ তেমন কিছু কিন্তু নেই। আছে অন‍্য কারো। সচেতন হবার অছিলায় আপনার মধ‍্যে যা জমছে তা হল ভয়। এক প্রগাঢ, অনুচ্চারিত আর কাল্পনিক ভীতি।সেই ভীতি আপনাকে পরোক্ষে এমন কোন সংগঠনের অংশ হবার জন্য ঠেলছে, যেখানে আপনি সংখ্যাগুরু।

    সেই সংগঠন হলেও যে আপনি সুরক্ষিত, তাও কিন্তু নয়। যদি হত, তবে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে ধর্ষণের মত অপরাধ কম হত। আদতে, সেটা হয়েছে কি? তথ‍্য কী বলে?

    যে প্রগতিশীলরা বলেন দাঙ্গায় নারী নির্যাতনকে জমির লড়াই বলে দাগিয়ে প্রথমটিকে খাটো করে দেখানোটি বিশেষ সুবিধাবাদী রাজনীতি, তারা এই গদ্য এই পর্যন্ত পড়ে মত বদলাবেন, নারীনিগ্রহের গহনে যে জমিদখলের মনোবৃত্তিই রয়ে গেছে তা মানুষকে বোঝাবেন, এমন দুরাশা করি না। তবু আশা করব, কিছু মানুষ সচেতন হবেন। বাংলার সংসদীয় রাজনীতির যেরূপ গতিপ্রকৃতি, তাতে সাংস্কৃতিক কলতলার এই বিবাদ সহজে মিটবার নয়। বরং, আরও বাড়বে বলেই মনে হয়। তবু, বাদী এবং বিবাদীপক্ষ এটুকু যেন মনে রাখেন যে, দাঙ্গায় সম্পন্ন নারী পুরুষ মরেন না। তাই, তারা সম্পন্ন বলেই, যদি মূল কলটিকে জনমানসের কাছে ধূসরতর করে, শুধু জিতে যাবার জন্য সাধারণকে আরো খাদের মুখে ঠেলে দেন, তবে ইতিহাস হয়তো তাদের দুই পক্ষকেই ক্ষমা করবেন না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • লিঙ্গরাজনীতি | ২৮ এপ্রিল ২০২৫ | ২১৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • . | ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ১১:২৭542716
  • হত‍্যার পরে মৃতার নাম বলতে বাধা নেই, অথচ হত‍্যা হোক বা না হোক ধর্ষণ ঘটলে সেই মেয়েগুলোর নাম চিরতরে মুছে দেওয়া হয় ভারতবর্ষে। এটাই আইন। জমি দখল তো অনেক গুরুগম্ভীর ব‍্যাপার, কিন্তু বেঁচে থাক বা মরে যাক ধর্ষণ হয়েছে জানালেই নামটুকু হুশ ভ‍্যানিশ হাওয়া হয়ে যাওয়া চমৎকার ম‍্যাজিক না? রাষ্ট্রীয় ম‍্যাজিক। নামটুকু নেই হয়ে যাবার ভয় থাকলে কেস রিপোর্টই হবে না।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন