ছোটোলোকের ছোটোবেলার পুজো : মলয় রায়চৌধুরী.
এখন আমার তিরাশি বছর বয়স। শৈশবের পুজো স্মৃতিতে বিশেষ ধরে রাখতে পারিনি। তবু চেষ্টা করে দেখি। তখন পুজো বলতে ধর্মানুষ্ঠান বোঝাতো। এখনকার মতন সাংস্কৃতিক-বাণিজ্যিক উৎসব নয়। বেশির ভাগ ছিল পারিবারিক পুজো। আজকাল দুর্গাঠাকুর সপরিবারে এলেও, পুজোটা আর পারিবারিক নেই, বিশেষ করে শহরে। আমি সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্য। উত্তরপাড়া শাখার। ১৭০৩ সালে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বংশধর রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী তাঁর পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে হুগলী নদীর পশ্চিমতীরে উত্তরপাড়ায় তাঁর নতুন বাসস্থান তৈরি করেন। তখনকার দিনে জায়গাটা এরকম নাম হবার কারণ এটা বালি গ্রামের উত্তর দিকে শেওড়াফুলির জমিদারির অংশ ছিল। রত্নেশ্বর তাঁর সম্পত্তি বিনিময় করে পরিবার ও বিশ্বস্ত লোকজনদের নিয়ে উত্তরপাড়ায় চলে আসেন। উত্তররপাড়া তখন একটা জলাজমি আর মানুষ বসবাসের অনুপযুক্ত। একমাত্র জেলে সম্প্রদায়ের পাটনি, মালো ও কিছু মুসলিমের বাস ছিল। তাদের কাজ ছিল মাছ ধরা, মাছ ধরার জিনিসপত্র বিক্রি করা, খেয়া পারাপার আর ডাকাতি।
.
সাবর্ণ রায়চৌধুরী ভঙ্গ কুলীন ছিল বলে রত্নেশ্বরকে বিবাহসূত্রে অন্য কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারদের উত্তররপাড়ায় নিয়ে আসতে হয়েছে। ক্রমে অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার যেমন দুর্গাচরণ ব্যানার্জী, রামতনু চ্যাটার্জী, রামনিধি চ্যাটার্জী, নন্দলাল মুথার্জী ইত্যাদি এসে বাস করতে শুরু করেন সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ঘরজামাই হিসাবে। এঁদের মধ্যে অনেকেই উত্তরপাড়ার মনোজাগতিক ও আধ্যাত্মিক জগতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
.
উনিশ শতকে রামহরি রায়, জয়কৃষ্ণ মুখার্জী, রাজকৃষ্ণ মুথার্জী ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় এই ছোট গ্রাম একটা আটশো স্কোয়ার মিটারের জনপদে পরিণত হয়। তাঁরা সুন্দর সুন্দর প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করতে শুরু করলেন যার রাজকীয় অবয়ব আজও উত্তরপাড়ার গর্ব। তৈরি করেন চওড়া রাস্তা, আধুনিক সেনেটারি ব্যবস্থা, বালি খালের টেনসান ব্রীজ, হাসপাতাল, স্কুল, পৌরসভা, লাইব্রেরি, পুলিসথানা, পোষ্ট অফিস, রেল স্টেশন ইত্যাদি।
বাংলার রেনেসাঁর আলো প্রথম উত্তরপাড়ায় আসে। জয়কৃষ্ণ মুখার্জী, রাজকৃষ্ণ মুখার্জী ও আরও অনেকে আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন ও ব্রিটিশ শাষকদের এখানে ইংরাজী স্কুল তৈরি করার জন্য অনুরোধ করেন। জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখার্জী এর জন্যে মুক্ত হস্তে দান করেন ও তাঁর একটা বিশাল বাড়ি দান করেন। রামতনু লাহিড়ী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। সেদিনের ছোট্ট স্কুল আজ বাংলার সেরা স্কুলের অন্যতম।
জয়কৃষ্ণ ও তাঁর ভাই রাজকৃষ্ণ সরকারের কাছে একটা আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করেন। আবারও জয়কৃষ্ণ তাঁর আর একটি সুন্দর বাড়ি দান করেন।
.
উত্তরপাড়ায় আমাদের বাড়ি, অর্থাৎ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরীর বাড়িতে, দুর্গা, কালীপুজো হতো, রাস, রথযাত্রা হতো, যেমন এখন অন্য সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়িতে হয়। কিন্তু শরিকের সংখ্যা ক্রমশ এতো বেড়ে গেলো যে সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারায়, পুজোর দায়িত্ব কেউ নিতে চায়নি। উত্তরপাড়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা ভেঙে-ভেঙে অজস্র হয়ে গেছে। বড়িশা-বেহালার মূল পুজোটা এখনও হয়। সেখানেও মূল পুজো ছাড়া সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আরও কয়েকটা পারিবারিক পুজো হয়। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজোয় সিংহের মুখ এখনও ঘোড়ার মতন, যেমন শৈশবে দেখেছি। মহিষাসুরের গায়ের রঙ এখনও সবুজ রঙে রাঙানো হয়।
.
উত্তরপাড়ার পুজো বন্ধ হয়ে যাবার পর শৈশবে বড়িশা-বেহালার মূল আটচালার পুজোতে আমি একবারই গেছি। এই আটচালাতেই তিনটে গ্রাম হস্তান্তরের ফারসি দলিল সই হয়েছিল। তারপর আর যাইনি কেননা ওই পুজোয় তখন মোষ বলি হতো, ছাগল বলি হতো। দেবীর সামনে মালসায় তাদের রক্ত উৎসর্গ করা হতো। এখন অবশ্য মোষ-ছাগল বলি দেবার প্রথা উঠে গেছে। তার বদলে কলা, লাউ ইত্যাদি বলি দেয়া হয়। শৈশবে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজোগুলোয় যাবার লোভ ছিল ভোগ খাবার জন্য। তিনদিন বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে ভোগ খাওয়া যেতো। বাড়ির ভোগ। এখনকার সার্বজনীন সাংস্কৃতিক-বাণিজ্যিক পুজোর মতন কেটারারের তৈরি ভোগ নয়। যৌবনে পৌঁছোবার আগেই ধর্মে বিশ্বাস নিছক প্রবৃত্তিগত হয়ে গিয়েছিল বলে কোনো পুজোয় আর যাইনি।
শৈশবের পুজো বললেই মনে পড়ে আমার বন্ধু সুবর্ণর তিন ভাইয়ের তিন রঙের পাঞ্জাবি; গেরুয়া, সবুজ আর শাদা। সিল্কের। ওর বাবা ছিলেন জল সরবরাহের ইনজিনিয়ার। ১৯৪৮ সালে সিল্কের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল পনেরোই আগস্ট ওদের কোয়ার্টারের জলের ট্যাঙ্ক টাওয়ারে। প্রতি বছর নতুন পতাকা আসতো ওর বাবার দপতরে। সংবিধান তৈরি হবার পর একসময়ে সিল্কের বদলে খাদির পতাকা যখন আসতে লাগলো, ওরা তিন ভাই পুজোর সময়ে আর পতাকা থেকে পাঞ্জাবি তৈরি করাতো না। সুবর্ণ ছিল সবচেয়ে ছোটো ভাই তাই ওর ভাগ্যে সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি জুটতো।
.
আমাদের বাড়িতে কুড়ি জনের সংসারে বাবা ছিলেন একমাত্র রোজগেরে। বাবার দায়িত্ব ছিল পুজোর পোশাক আর জুতো কিনে দেবার। যাতে বাড়ির সদস্যদের মধ্যে ঈর্ষার সৃষ্টি না হয়, তাই বাবা সকলের জন্য একই রঙের জামার কাপড় কিনতেন, পুরো একটা থান, তা থেকে আমাদের ভাই-বোনের, কাকা-জেঠার পুজোর পোশাক তৈরি হতো। মেজ জেঠা ফতুয়া পরতেন, তা ওনার ফতুয়াও সেই একই কাপড়ের তৈরি হতো। দর্জিও ছিল বাবার পরিচিত। মজার ব্যাপার যে মুসলমান দর্জি পরিবারটার সবাই ছিল বোবা। বাবা ওদের নির্দেশ দিতে পারতেন, আমরা ইশারায় যতোটা পারি বোঝাতুম। তবে প্রতি বছর আমাদের পোশাক তৈরি করে ওদের ধারণা হয়ে গিয়েছিল কে কেমন পোশাক পছন্দ করে। পুজোর জুতো ছিল নির্দিষ্ট, তখনকার দিনে কাবলি স্যাণ্ডাল নামে একরকম জুতো হতো। সবাই বাবার বললে দেয়া দোকানে গিয়ে কাবলি স্যাণ্ডাল নিয়ে আসতো। টাকাকড়ি বাবা মেটাতেন। আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরী মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে ওনার কাবলি স্যাণ্ডাল দিয়ে গোলপোস্ট চিহ্ণিত করতেন আর বাড়ি ফেরার সময়ে প্রায়ই ভুলে যেতেন। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যে দাদা যেন খেলা শেষ হবার পর জুতো পরে ফেরে। একবার আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলুম দাদাকে মনে করাতে। সেই বছর দাদাকে বিনা জুতোয় স্কুলে যাতায়াত করতে হয়েছিল, এমনকী গরমে গলতে থাকা পিচ রাস্তাতেও। গরমে যাতে পায়ে জ্বালা না করে তাই দাদা অনেক সময়ে ফিটনগাড়ির পেছনে আর্দালি দাঁড়াবার জায়গায় বসে স্কুলে যেতো। এখন আর পুজোর পোশাক বা জুতো কেনা হয় না। বহু শার্ট আর ট্রাউজার পরা হয় না চাকরি থেকে ১৯৯৭ সালে অবসর নেবার পর।
.
উত্তরপাড়ায় জমিদার পরিবারগুলো ছিল সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের জামাইদের পরিবার। শৈশবে অমন তিনটে জমিদার বাড়িতে পারিবারিক পুজো হতো। ক্রমশ তাদের পরিবারগুলোও ভেঙে যেতে আরম্ভ করল আর বিশাল বাড়ির খারচ সামলানো কঠিন হয়ে যেতে তাদের বাড়ির পুজোগুলোও বন্ধ হয়ে গেল। দেশভাগের উদ্বাস্তুদের ঠাঁই দেবার জন্য দুটি জমিদারবাড়িকে ব্যবহার করেছিল সরকার। অন্য একটা বাড়ি এখন হয়ে গেছে বিশাল হাসপাতাল। উত্তরপাড়ায় আমি ষাটের দশকের পর আর যাইনি। সব অংশগুলো মিলিয়ে বিল্ডাররা আবাসন তৈরি করেছে। আমি আর দাদা আমাদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছি।
.
তারপর চাকুরিসূত্রে সারা ভারতের গ্রামগঞ্জ চষে বেড়িয়েছি। পশ্চিমবাংলায় গ্রামের পুজোগুলো ভালো লেগেছে। শহরের সাংস্খরতিক-বাণিজ্যিক পুজোর ছোঁয়া সেরকমভাবে পৌঁছোয়নি, যদিও কর্তাদের চেষ্টার কমতি নেই কলকাতাকে টক্কর দেবার।
.
আমার শৈশবের পুজো শৈশবেই হারিয়ে গেছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।