মলয় রায়চৌধুরীর কাব্যনাট্য
সুর্পনখা – বাল্মীকি সংবাদসুর্পনখা।।
খুবই জঘন্য কাজ হয়েছে তোমার আদি কবি
এভাবে আমাকে পাঁকের মৃণ্ময়ীরূপে মহাকাব্যে
হেয় করা। তাই অনুরোধ করি আমাকে পাঠিয়ে
দাও, মহাভারতের গল্পে। ব্যাস আমাকে নিশ্চিত
আমার মনের মতো সুপুরুষ পাইয়ে দেবেন।
বাল্মীকি।।
কী যে বলছিস তুই স্পষ্ট করে বল সুর্পনখা ;
মহাভারতের গল্পে পাঠালে আমার রামায়ণ
টিকবে কী করে? কেনই বা ওই ভিড়ে চাস যেতে
গল্পের ভেতরে গল্পে কেউ তোকে খুঁজেই পাবে না।
ইতিহাসে তুই একমাত্র অসেতুসম্ভব সেতু —
ভুললি কী করে সৌন্দর্যের মূল হল অমরত্ব
তা তো পেয়েছিস তুই, আবার কিসের এঁড়ে-গোঁসা?'
সুর্পনখা।।
ব্যাসদেব তোমার মতন উইপোকা ঢাকা পড়ে
কাটাননি জীবন। নারীর আবেগ-আকাঙ্খা উনি
অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন। কুতসিৎ হিড়িম্বীও
রূপসীর ভেক ধরে, কুন্তির নির্দেশে, আলিঙ্গনে
পেয়েছে ভীমকে। উলুপী তো ছিল জলের তলায়,
চিত্রাঙ্গদা ছিল দূরদেশে ; তারপর সুভদ্রার
আদরের দাবি মেটাবার জন্য গেলেন অর্জুন
তার আগে স্বয়ম্বরে জিতে এনেছেন দ্রৌপদীকে;
দ্রোপদী তো কালো চকচকে-ত্বক সৈরন্ধ্রী ছিলেন।
একসাথে পাঁচজন পুরুষকে ভালোবেসেছেন।
এতজন পুরুষকে-নারীকে যে ভালোবাসা যায়
তা তুমি কখনো কবি পারোনি করতে অনুমান।
বাল্মীকি।।
বোকার মরণ, জানিস না আমি আদি কবি কেন?
ঘরে ঘরে আমার বইকে লোকে পুজো করে আজো
কিন্তু ঝগড়ার ভয়ে কেউই রাখে না ব্যাসদেব।
সুর্পনখা।।
জানি বলেই তো তাজ্জব লেগেছে। প্রেমিক পাখিকে
ব্যাধ তীরবিদ্ধ করেছিল বলে কেঁদে ফেলেছিলে,
সেই শোকে রক্তে জবজবে হল তোমার লেখনি
আর তুমি তৈরি করে ছেড়ে দিলে এমন দুজন
বনবাসী, যারা অন্যের প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে
ভয় পায়। রাম ও লক্ষ্মণ ওরা অর্জুনের পাশে
একেবারে হালকা নিষ্প্রভ। ঘুমিয়েছে লক্ষ্মণের
উর্মিলা চোদ্দটি বৎসর। কেন? পাছে সেও কোনো
যুবকের প্রেমে পড়ে ; তাকে তুমি মাদকের চেয়ে
কড়া ভ্রমে রেখেছ ভুলিয়ে। রামও কেমন লোক?
রামভিতু শব্দটার জন্মে তো ওরই অবদান
অগ্নিপরীক্ষার তাপে ঠেলে দিল নিজের বউকে।
ঘরে তাই রামায়ণ রাখে না এদেশি পরিবার–
কোথায় রামের জন্ম তাই নিয়ে চলে খুনোখুনি।
বাল্মীকি।।
আমার স্মৃতির কেন্দ্র তুই ও কৈকেয়ী দুইজন ;
স্মৃতি মানে ইতিহাস, চাইলেও বদলানো অসম্ভব
রাম-রাবণের মাঝে অসেতুসম্ভব-সেতু তুই।
সুর্পনখা।।
কী যে দোহাই পাড়ছ। স্মৃতি মুছে যায় কালক্রমে।
আমি কি জানি না ইতিহাস বানানো কাহিনি মাত্র
যে বসে সিংহাসনে তার কথা শোনে ইতিহাস
ঘটনার চক্র থেকে খুঁটে তোলা লেখনি-বিভ্রম।
যাই হোক আমাকে তোমার স্মৃতি থেকে মুছে ফ্যালো
আর যেতে দাও মহাভারতের মায়াবী জগতে।
আমাকে হতশ্রী না করলে কি ইতিহাস অশুদ্ধ
হতো? সুন্দরী হতুম যদি হরিণের পিছে নয়
আমার পিছনে ছুটে চলে আসত লক্ষ্মণ-রাম
তাহলে তোমার গল্পে যুদ্ধ ঘটাতে পারতে নাকো।
জানি না কি বিশ্বামিত্র মেনকাকে দেখে ধ্যান ভেঙে
কী-কী করলেন ! আর পুরূরবা উর্বশীর প্রেমে
হননি কি উত্তাপে সরেস? দেখেচ তো বিশ্বকর্মা
তিলে-তিলে গড়লেন তিলোত্তমা, যার প্রেমে শিব
আর ইন্দ্র দুজনেই লুকোতে পারেনি জ্বরতাপ?
শিবের গজালো মাথা দশদিকে, ইন্দ্রের শরীর
জুড়ে চোখ, স্রেফ তিলোত্তমা দর্শনের অভিলাষে !
ভোল পালটিয়ে ইন্দ্র অহল্যাকে করেছে সঙ্গম !
আমি যদি ভালোবেসে থাকি তাতে দোষটা কোথায়?
বাল্মীকি।।
তুই হলি ত্রেতাযুগী রাক্ষসী বিধবা। অর্জুনেরা
দ্বাপর যুগের। যত যুগ এগোতে থাকবি তত
পাবি মূল্যবোধহীন লোকেদের। যদি বর্তমান
যুগে যাস তাহলে দেখবি যত কলি-কালখণ্ড
কেলেঙ্কারি। দুষ্টবুদ্ধির সঙ্গে ছিলিস তো ভালোই ;
নিতে গেল সিংহাসন, শেষে ডোবালো তোকেও।
জানিস তো দ্বাপরেই সতীপ্রথা শুরু হয়েছিল
মহাভারতের গল্পে চিতার আগুনে পুড়তিস।
আমার স্মৃতিতে শুধু অঙ্গহানি হয়েছিল তোর।
সুর্পনখা।।
ওটাও তোমার কাজ ; আমার বরের নামে দুষ্ট
যোগ করা। যাই হোক, এবার আমাকে ছাড়ো।
যেতে দাও দ্বাপরের বিস্ময় জগতে। প্রেমিককে
পেতে হলে মূল্যবোধ নয়, প্রেম চাই, প্রেম, তা তো
ব্যাসদেব নিজে শুরুতেই করে দেখিয়ে গেছেন।
ওসব তোমার কর্ম নয়। রামও কেমন লোক?
সোনার হরিণ দেখে তার পিছে-পিছে ছুটে গেল
আমার প্রেমের চেয়ে কুড়ি কিলো সোনা যেন দামি !
লক্ষ্মণই বা কেমনতরো? নারীকে বিকৃত করে?
তুমি কুতসিৎ করে তুললেও আমার বাবা মা
আমাকে মীনাক্ষী নামে অপরূপা করে তুলেছেন
তাই মীনাক্ষী হয়েই যাবো মহাভারতের গল্পে।
বাল্মীকি।।
তোকে ছাড়া মুশকিল কেননা যুদ্ধের তো ওজর
দরকার। যদিও এদান্তি অকারণে খেলাচ্ছলে
বারুদ মকসো করে যুদ্ধ শুরু হয়। ঠিক আছে।
পরবর্তি সংস্করণে স্মৃতিকে শুধরে নিতে হবে ;
তবে আমি হলেও বা রাজি, রামভক্ত লোকজন
চটে যেতে পারে এই ভেবে যে অমরত্বের লোভে
একটা গল্পের নারী অন্য ইতিহাসে ঢুকে গেল।
রাম তো যুদ্ধের পর বাড়ি ফিরে গেছে। অতএব
আমার স্মৃতিতে তোর দরকার নেই সুর্পনখা–
লক্ষ্মণের কাটা অঙ্গ আমার কুটিরে রেখে আয়
দেখি যদি অন্য কোনো চরিত্রের কাজে যায় লেগে।
সুর্পনখা।।
তোমার কাহিনি বৌদ্ধ জৈন থাই ব্রহ্মদেশে গিয়ে
পাঠান্তর নিয়েছিল। কৃত্তিবাস তোমার ছায়ায়
তুলসীদাস রামচরিতমানসের কাহিনিতে
নিরক্ষর মগজের লোকেদের ভুল বোঝালেন
আমাকে সবার কাছে চরিত্রহীন করে দিয়ে।
তাই চাই মহাভারতের গল্পে গিয়ে, অর্জুনকে
প্রেম নিবেদন করি মীনাক্ষীর আসক্ত আঙ্গিকে।
বাল্মীকি।।
তবে তাই কর। আমার স্মৃতিতে যেমন হঠাৎ
তুই গল্প থেকে চলে গিয়েছিলি, রা কাড়েনি কেউ
তেমনি ওখানে গিয়ে কুরুক্ষেত্র শেষে তোকে নিয়ে
চিন্তার সময় কারোরই থাকবে না। সেসময়ে
এসে তোর কাটা অঙ্গগুলো নিয়ে যাস যদি চাস।
সুর্পনখা।।
না আমার প্রয়োজন নেই। যেটুকু নারীত্ব আছে
তাই নিয়ে যুগে-যুগে আসব প্রেমের কবিতায়
গল্পে-নাটকে-নভেলে। জানবে সবাই, কুতসিৎ
মেয়েরাও প্রেম নিবেদন করে প্রেমিককে পায় ;
হলেই বা পাঁকের মৃণ্ময়ী, কোলে কালি ছোটো-চোখ
পেছন থেকেও বুক দেখা যায় বলে লোকে হাসে
নিমপাতা মাখা গন্ধে মাছিরা বাসর পাতে দেহে
চুলও উকুনে রুক্ষ পূতিগন্ধময় পুরু ঠোঁট–
কিন্তু জানি যেকোনো পুরুষ যদু বাহুবদ্ধ করি
তরল বিদ্যুৎ বয়ে যাবে তার উত্তপ্ত শিরায়
প্রেম যে কীভাবে দেহে খেলা করে তুমি তা জানো না।
তার জন্য কবিকে প্রথমে প্রেমে প্লুত হতে হবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।