এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  কাব্য  তর্জমা

  • জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো : নরকে এক মরশুম

    Malay Roychoudhury লেখকের গ্রাহক হোন
    কাব্য | তর্জমা | ১৩ নভেম্বর ২০২২ | ১২৩৩ বার পঠিত
  • 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 | 30 | 31 | 32 | 33 | 34 | 35 | 36 | 37 | 38 | 39 | 40 | 41 | 42 | 43 | 44 | 45 | 46 | 47 | 48 | 49 | 50 | 51 | 52 | 53 | 54 | 55 | 56 | 58 | 59 | 60 | 61 | 62 | 63 | 64 | 65 | 66 | 67 | 68 | 69 | 70 | 71 | 72 | 73 | 74 | 75 | 76 | 77 | 78 | 79 | 80 | 81 | 82 | 83 | 84 | 85 | 86 | 87 | 88 | 89 | 90 | 91 | 92 | 93
    জঁ আর্তুর র‌্যাঁবো-র ‘নরকে এক মরশুম’ 
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    index

    আগে কোনো এক সময়ে,  যদি ঠিকমতম মনে থাকে, আমার জীবন ছিল ভুরিভোজের উৎসব যেখানে প্রতিটি হৃদয় নিজেকে মেলে ধরত, সেখানে অবাধে বয়ে যেতো সব ধরণের মদ ।

    একদিন সন্ধ্যায় আমি সৌন্দর্য্যকে জড়িয়ে ধরলুম — আর তাকে আমার তিতকুটে মনে হলো — আর আমি ওকে অপমান করলুম । 

    বিচারের বিরুদ্ধে নিজেকে করে তুললুম ইস্পাতকঠিন ।
     
    আমি পালালুম । ওহ ডাইনিরা, ওহ দুর্দশা, ওহ ঘৃণা, আমার ঐশ্বর্য্য ছিল তোমাদের হেফাজতে।
     
    যাবতীয় মানবিক আশা আমি নিজের মধ্যে নষ্ট করে ফেলেছি । বিরূপ জানোয়ারের নিঃশব্দ লাফ নিয়ে আমি গলা টিপে মেরে ফেলে দিয়েছি প্রতিটি আনন্দ ।
     
    আমি জল্লাদদের আসতে বলেছি ; আমি তাদের বন্দুকের নল চিবিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে চাই। আমি বালি আর রক্তে রুদ্ধশ্বাস হবার জন্য নিম্নত্রণ করেছি মহামারী রোগদের । দুর্ভাগ্য ছিল আমার ঈশ্বর । আমাকে পাঁকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে, আর নিজেকে শুকিয়ে নিয়েছি অপরাধাত্মক হাওয়ায়। আমি উন্মাদনার সীমায় নিজেকে নিয়ে গিয়ে মূর্খের খেলা খেলেছি ।
     
    আর বসন্তঋতুর দিনগুলো  আমাকে এনে দিয়েছে বোকার আতঙ্কিত হাসি ।
     
    এখন কিছুদিন হলো, যখন আমি নিজেকে ভবিষ্যত অমঙ্গলের বার্তাবাহক হিসাবে আবিষ্কার করলুম, আমি ভাবতে লাগলুম পুরোনো দিনকালের ভোজনোৎসবের উৎসসূত্রের কথা, যেখানে আমি খুঁজে পাবো আবার নিজের বাসনার আকাঙ্খা ।
     
    সেই উৎসসূত্র হলো সর্বজনে প্রীতি — এই ধারণা প্রমাণ করে যে আমি স্বপ্ন দেখছিলুম !
     
    যে দানব একসময়ে আমাকে অমন সুন্দর আফিমফুলের মুকুট পরিয়েছিল, চিৎকার করে বলে ওঠে:  “তুমি হায়েনা ইত্যাদি জানোয়ার হয়েই বেঁচে থাকবে”…। “মৃত্যুকে খুঁজবে তোমার আকাঙ্খাপুর্তির মাধ্যমে, আর যাবতীয় স্বার্থপরতা দিয়ে, আর সাতটি মারাত্মক পাপ দিয়ে।”
     
    আহ ! আমি সেসব অনেক সহ্য করেছি : তবু, হে প্রিয় শয়তান, অমন বিরক্তমুখে তাকিও না, আমি তোমার কাছে আবেদন করছি ! আর যতোক্ষণ অপেক্ষা করছি কয়েকটা পুরোনো কাপুরুষতার খাতিরে, কেননা তুমি একজন কবির মধ্যে সমস্ত রকমের চিত্রানুগ কিংবা নীতিমূলক স্বাভাবিকতার অভাবকে গুরুত্ব দাও, আমি তোমাকে এক অভিশপ্ত আত্মার রোজনামচা থেকে এই কয়েকটা অপবিত্র পৃষ্ঠা পাঠিয়ে দিচ্ছি ।
     
    বদ রক্ত
     
    ফরাসি দেশের প্রাচীন অধিবাসী গলদের থেকে আমি পেয়েছি আমার ফিকে নীল চোখ, একখানা ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক, আর প্রতিযোগীতায় আনাড়িপনা । আমার মনে হয় আমার জামাকাপড় তাদের মতনই অমার্জিত ।
     
    কিন্তু আমি চুলে তেল লাগাই না ।
     
    সেই প্রাচীন অধিবাসী গলরা ছিল তাদের সময়ের অত্যন্ত মূর্খ  চামার আর খড় পোড়ানোর দল। তাদের কাছ থেকে আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি : প্রতিমা-উপাসনা, আর যা-কিছু পবিত্র তাকে নোংরা করে দেবার প্রতি টান ; ওহ ! যতোরকমের কদভ্যাস হতে পারে, ক্রোধ, লাম্পট্য, — ভয়ানক ব্যাপার, এই লাম্পট্য ; — তাছাড়া মিথ্যে কথা বলা, আর সবার ওপরে আলস্য ।
     
    যাবতীয় ব্যবসাপাতি আর কাজকারবার সম্পর্কে আমি বেশ আত্ঙ্কে ভুগি । কর্তাব্যক্তিদের আর খেটে-খাওয়া লোকেদের সম্পর্কে, ওরা সব্বাই চাষাড়ে আর মামুলি । যে হাত কলম ধরে থাকে তা লাঙল ধরে থাকা হাতের মতনই শুভ। — হাতের ব্যাপারে একটা শতাব্দী বলা যায় ! — আমি কোনোদিনও আমার হাত ব্যবহার করতে শিখবো না । আর হ্যাঁ, পারিবারিক ঝুঠঝামেলা তো আরও এক কাঠি বাড়া । ভিক্ষা চাওয়ার মালিকানা আমাকে লজ্জা দেয় । অপরাধীরা অণ্ডকোষহীন পুরুষদের মতোই নিদারুণ বিরক্তিকর : আমি আছি বহাল তবিয়তে, আর আমি কাউকে পরোয়া করি না ।
     
    কিন্তু ! কে আমার জিভকে এতো বেশি মিথ্যা-সুদর্শনে ভরে তুলেছে, যা কিনা আমাকে এতোদিন পর্যন্ত পরামর্শ দিয়েছে আর অলস করে রেখেছে ? আমি তো আমার জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে শরীরকেও ব্যবহার করিনি । ঘুমন্ত কোলাব্যাঙের আলস্যকে ছাপিয়ে, আমি সব রকমের জায়গায় বসবাস করেছি । ইউরোপে এমন কোনো পরিবার নেই যাদের আমি চিনি না। — পরিবার বলতে, আমি বোঝাতে চাইছি, যেমন আমার, যারা  মানুষের অধিকারের ফতোয়ার জোরে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে । — আমি প্রতিটি পরিবারের সবচেয়ে বড়ো ছেলেকে চিনি!
     
    ——————————-
     
    যদি ফ্রান্সের ইতিহাসের কোনো একটা সময়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকতো !
     
    কিন্তু তার বদলে, কিছুই নেই ।
     
    আমি ভালো করেই জানি যে আমি চিরটাকাল এক নিকৃষ্টতর জাতির মানুষ । আমি দ্রোহ ব্যাপারটা বুঝতে পারি না ।  নেকড়ের পালের মতন কোনো জানোয়ারকে ছিঁড়ে খাবার জন্য, যা তারা নিজেরা মারেনি, আর লুঠপাচার বাদ দিলে, আমার জাতি কখনও উঠে দাঁড়ায়নি ।
     
    খ্রিস্টধর্মের বাড়ির বড়ো মেয়ে ফ্রান্সের ইতিহাস আমার মনে আছে । পবিত্র ভূমির জন্যে ক্রুসেডে লড়তে, আমিও চলে যেতে পারতুম, একজন গ্রাম্য চাকর হিসাবে ; আমার মগজের ভেতরে ব্যাভেরিয়ার বনানীর ভেতর দিয়ে অজস্র পথ রয়েছে, বসফরাসের বাইজেনটিয়াম সাম্রাজ্যের ছবি, জেরুজালেমের কেল্লা ; মেরির পুজোপদ্ধতি, ক্রুশকাঠে ঝোলানো যিশুর সম্পর্কে দুঃখদায়ক চিন্তা, আমার মগজের ভেতরে হাজার অবজ্ঞায় পুলকিত হতে থাকে। — রোদ্দুরের কামড়ে ধ্বসে পড়া দেয়ালের কিনারায়, ভাঙাচোরা মাটির বাসনকোসন আর বিছুটিবনের মাঝে আমি একজন কুষ্ঠরোগির মতন বসে থাকি । — আর তাছাড়া, আমি একজন উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে ভাড়াটে সৈনিক, জার্মান রাত্রির আকাশের তলায় সময় কাটাতুম ।
     
    আহ ! আরেকটা ব্যাপার : বুড়ি আর বাচ্চাদের দলের সঙ্গে অত্যুজ্জ্বল লালচে ফাঁকা মাঠে আমি স্যাবাথছুটির নাচ নেচে চলেছি ।
     
    আমি এই দেশ আর খ্রিস্টধর্মের বিষয়ে বিশেষ কিছুই মনে রাখতে পারিনি । আমি নিজেকে চিরটাকাল অতীতে দেখতে পাবো । কিন্তু সবসময়ে একা ; পরিবারহীন ; প্রকৃতপক্ষে, কোন সেই ভাষা, যাতে আমি কথা বলতুম ? আমি কখনও নিজেকে যিশুখ্রিস্টের পারিষদবর্গের সদস্য হিসেবে দেখি না ; সন্তদের সভাতেও নয়, — যারা যিশুখ্রিস্টের প্রতিনিধি ।
     
    এক শতক আগে আমি ঠিক কী ছিলুম : আজকে আমি কেবল নিজেকে খুঁজে পাই । টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো সেইসব লোকগুলো, ধূসর যুদ্ধগুলো উধাও হয়ে গেছে । নিকৃষ্ট জাতি চেপে বসেছে সবার ওপরে — যাকে লোকে বলে  জনসাধারণ, যুক্তিপূর্ণতা ; রাষ্ট্র এবং বিজ্ঞান ।
     
    আহ ! বিজ্ঞান ! সমস্তকিছু অতীত থেকে নিয়ে আসা হয় । শরীর আর আত্মার জন্যে, — শেষ আধ্যাত্মিক সংস্কার, — আমাদের রয়েছে ওষুধ আর দর্শনতত্ব, বাড়িতে সারিয়ে তোলার টোটকা আর নতুনভাবে বাঁধা লোকগান । এবং রাজকীয় আমোদপ্রমোদ, আর যে সমস্ত খেলাধুলা রাজারা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে ! ভূগোল, আকাশবিদ্যা, যন্ত্রবিদ্যা, রসায়ন !…
     
    বিজ্ঞান, নবতর আভিজাত্য ! প্রগতি । জগতসংসার এগিয়ে চলেছে !…. আর কেনই বা তা করবে না ?
    আমাদের রয়েছে গণিতের দৃষ্টিপ্রতিভা । আমরা এগিয়ে চলেছি প্রাণচাঞ্চল্যের দিকে । আমি যা বলছি তা অমোঘ রহস্যপূর্ণ এবং ধ্রুবসত্য । আমি বুঝতে পারি, আর যেহেতু আমি পৌত্তলিকতার নিকৃষ্ট শব্দাবলী ছাড়া নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না, আমি বরং চুপ করে থাকবো ।
     
    পৌত্তলিকতার নিকৃষ্ট রক্ত ফিরে বইতে থাকে শরীরে ! প্রাণচাঞ্চল্য এখন আয়ত্বে, যিশু কেন আমাকে সাহায্য করেন না, কেন আমার আত্মাকে আভিজাত্য আর স্বাধীনতা দেন না । আহ ! কিন্তু যিশুর উপদেশাবলী তো অতীতের ব্যাপার ! খ্রিস্টের উপদেশাবলী ! খ্রিস্টের উপদাশাবলী !
     
    আমি হাঘরের মতন ঈশ্বরের জন্যে অপেক্ষা করি । আমি চিরকালের জন্যে, চিরকালের জন্যে, এক নিকৃষ্ট জাতের মানুষ ।
     
    আর এখন আমি উত্তরপশ্চিম ফ্রান্সের ব্রিট্যানির সমুদ্রতীরে । শহরগুলো সন্ধ্যায় তাদের আলোকমালা জ্বালিয়ে দিক । আমার দিনকাল ফুরিয়ে গেছে ; আমি ইউরোপ ছেড়ে চলে যাচ্ছি । সমুদ্রের হাওয়া আমার ফুসফুসকে গরম করে তুলবে ; হারিয়ে-যাওয়া আবহাওয়া আমার ত্বককে পালটে ফেলবে চামড়ায় । সাঁতার কাটার জন্যে, ঘাসভূমি মাড়িয়ে চলার জন্যে, শিকার করার জন্যে, সবচেয়ে প্রিয় ধোঁয়াফোঁকার জন্যে ; কড়া মদ খাবার জন্যে, সে মদ গলিয়ে ফেলা লোহার মতন কড়া, — আগুনের চারপাশে  আমার প্রণম্য পূর্বপুরুষরা যেমন ভাবে বসে থাকতেন ।
     
    আমি লোহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ফিরে আসবো, কালো ত্বক, আর রাগি দুটো চোখ : এই মুখোশে, ওরা সবাই মনে করবে আমি উৎকৃষ্ট জাতির মানুষ । আমার কাছে থাকবে স্বর্ণভাঁড়ার : আমি হয়ে উঠবো নৃশংস আর শ্রমবিমুখ । যে দুর্ধষ্য পঙ্গুরা গ্রীষ্মমণ্ডলের দেশ থেকে ফিরে আসে, তরুণীরা তাদের সেবা করে । আমি রাষ্ট্রনীতিতে জড়িয়ে পড়বো । বেঁচে যাবো ।
     
    এখন আমি অভিশপ্ত, আমি আমার নিজের দেশকে অপছন্দ করি । সবচেয়ে ভালো হলো মাতাল অবস্হায় ঘুমোনো, চিলতেখানেক কোনো সমুদ্রতীরে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়া ।
     
    ————————–
     
    কিন্তু কেউই ছেড়ে চলে যায় না । — আরেকবার বেরিয়ে পড়া যাক আমাদের এলাকার পথে-পথে, আমার অধার্মিকতার ভার সঙ্গে নিয়ে, সেই অধার্মিকতা যা যুক্তিপূর্ণতার যুগ থেকে আমার অস্তিত্বে দুঃখকষ্টের শিকড় পুঁতে দিয়েছে — স্বর্গ পর্যন্ত উঠে যাওয়া, আমাকে বিদ্ধস্ত করে, ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দ্যায়, আমাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যায় ।
     
    চরম পাপহীনতা, শেষ মায়া । সবকিছু বলা হয়ে গেছে । পৃথিবীতে আমার জঘন্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতা  আর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবার নয় ।
     
    চলে এসো ! কুচকাওয়াজ করে, ভার কাঁধে তুলে, মরুভূমি, একঘেয়েমির বিরক্তি এবং ক্রোধ নিয়ে।
     
    কার কাছে গিয়ে ভাড়া করা মজুর হবো ? কোন সে জানোয়ারদের আদর করি ? কোন পবিত্র মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করি ? কেমনতর হৃদয়কে ভাঙি ? কোন মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিই ? — কোন সে রক্তের নদী হেঁটে পার হই ? বরং বিচার থেকে দূরত্ব রাখা ভালো । — এক কঠিন জীবন, সুস্পষ্ট বিস্ময়, — কফিনের ঢাকা তোলার জন্যে একটা শুকনো মুঠো, শুয়ে থাকো, আর দম বন্ধ হয়ে যাক । এইভাবে বার্ধক্যে পৌঁছোবার কথা নয়, কোনো বিপদ নেই : সন্ত্রাস ব্যাপারটা অ-ফরাসী।
     
    –আহ ! আমি এমন পরিত্যক্ত যে নিজেকে কোনও না কোনও স্মৃতিমন্দিরে গিয়ে নিখুঁত হবার আবেগ  উৎসর্গ করব ।
     
    ওহ আমার আত্ম-অস্বীকৃতি, আমার মনোমুগ্ধকর বিশ্বপ্রেম ! আমার নিঃস্বার্থপর ভালোবাসা ! অথচ তবু আমি এই তলানিতে !
     
    গভীর অতল থেকে কেঁদে উঠি, আমি আসলে একটা গাধা !
     
    ———————————-
     
    যখন আমি এক ছোট্ট শিশু ছিলুম, আমি সেই দণ্ডিত অপরাধীকে শ্রদ্ধা করতুম যার মুখের ওপর কারাগারের দরোজা সদাসর্বদা বন্ধ থাকবে ; আমি সেই সমস্ত মদের আসর আর ভাড়াদেয়া ঘরগুলোয় যেতুম যেগুলোকে তার উপস্হিতি পবিত্রতায় উন্নীত করেছে ; আমি তার চোখ দিয়ে নীলাকাশ আর ফুলে ছাওয়া মাঠের কর্মোন্মাদনা দেখতুম ; শহরের রাস্তায় আমি তার সর্বনাশা সুগন্ধকে অনুসরণ করেছি । তার ছিল সন্তদের চেয়েও বেশি ক্ষমতা, যেকোনো অনুসন্ধানকারীর চেয়েও বেশি বোধশক্তি — আর সে, কেবল সে-ই ! নিজের মহিমা  এবং নিজের ন্যায়পরায়ণতার সাক্ষী ছিল ।
     
    শীতের রাতের ফাঁকা রাস্তা-বরাবর, ঘরছাড়া, ঠাণ্ডায় কাতর, আর ক্ষুধার্ত, একটা কন্ঠস্বর আমার হিমায়িত হৃদয়কে আঁকড়ে ধরল : “দুর্বলতা হোক বা শক্তিমত্তা : তুমি টিকে আছো, তাইই হলো শক্তিমত্তা । তুমি জানো না তুমি কোথায় চলেছো কিংবা কেন তুমি কোথাও যাচ্ছো, যেদিকে চাও যাও, সবাইকে জবাব দাও । কেউই তোমাকে মেরে ফেলবে না, তুমি শবদেহ হলে যেরকম করতো তার চেয়ে বেশি কিছু নয় ।” সকালবেলায় আমার চোখদুটো এতো বেশি ফ্যালফ্যালে হয়ে উঠেছিল আর মুখ শবের মতন ফ্যাকাশে, যে যাদের সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছিল তারা যেন আমায় দেখতে পাচ্ছিল না ।
     
    শহরগুলোয়, কাদার রঙ আচমকা বদলে গিয়ে লাল আর কালো হয়ে উঠল, পাশের ঘরে আলোর শিখা কাঁপলে আয়নায় যেমন হয়, জঙ্গলে গুপ্তধনের মতন ! আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, গুড লাক, আর আমি দেখতে পেলুম আগুনশিখার সমুদ্র আর ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে ; এবং বাঁদিকে আর ডানদিকে, কোটি-কোটি বজ্রবিদ্যুতের মতন সমস্ত ঐশ্বর্য্য বিস্ফোরণে ফেটে পড়ছিল।
     
    কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল পানোমত্ততা এবং নারীসঙ্গ ছিল আমার পক্ষে অসম্ভব । এমনকি কোনো বন্ধুসঙ্গও নয় । আমি দেখলুম আমি একদল রাগি মানুষদের সামনে পড়ে গেছি, ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি, তারা যে দুঃখে কাঁদছিল তা তারা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারছিল না, আর ক্ষমা করে দিচ্ছিল ! ঠিক যেন জোয়ান অব আর্ক ! — “যাজকরা, অধ্যাপকরা আর ডাক্তাররা, আপনারা আমাকে আইনের হাতে তুলে দিয়ে  ভুল করছেন । আমি কখনও আপনাদের একজন ছিলুম না; আমি কখনও খ্রিস্টধর্মী ছিলুম না ; আমি সেই জাতির মানুষ যারা ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গায়; আমি তোমাদের আইনকানুন বুঝি না ; আমার নৈতিক জ্ঞানগম্যি আছে ; আমি ভালোমন্দজ্ঞানশূন্য ; তোমরা একটা বড়ো ভুল করে ফেলছো…”
     
    হ্যাঁ, তোমাদের ঝলমলে আলোয় আমার চোখ বন্ধ । আমি একটি পশু, একজন কৃষ্ণাঙ্গ । কিন্তু আমার পরিত্রাণ সম্ভব । তোমরা সব নকল কৃষ্ণাঙ্গ ; বাতিকগ্রস্ত, বুনো, কৃপণ, তোমরা সবাই । ব্যবসাদার, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; জজসাহেব, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; সেনাপতি, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; সম্রাট, বুড়ো চুলকানো-মাথা, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; তুমি শয়তানের হেফাজত থেকে যে মদ খেয়েছো তাতে কেউ কর বসায় না । — এই দেশকে উৎসাহিত করে জ্বরের তাপ আর কর্কটরোগ । পঙ্গু আর বুড়ো মানুষেরা এতো বেশি শ্রদ্ধার পাত্র যে তারা চায় তাদের উষ্ণতাপে সেদ্ধ করা হোক । — সবচেয়ে ভালো হবে এই মহাদেশ ছেড়ে বিদায় নেয়া, যেখানে এই হতভাগাগুলোকে প্রতিভূ সরবরাহ করার জন্যে পাগলামি জিনিশটা ঘুরঘুর করে বেড়ায় । আমি প্রবেশ করবো ক্যাম্বোডিয়ার সত্যকার চাম রাজার সন্তানদের দেশে ।
     
    আমি কি প্রকৃতিকে বুঝতে পারি ? আমি কি নিজেকে বুঝতে পারি ? কোনও বাক্য আর আয়ত্বে নেই । আমি মৃত মানুষদের নিজের পাকস্হলিতে পুরে রাখি…হইহট্টোগোল, ঢোলঢোলোক, নাচো, নাচো, নাচো ! আমি সেই মুহূর্তের কথা চিন্তাও করতে পারি না যখন শ্বেতাঙ্গ মানুষরা পোঁছেচে, আর আমি শুন্যতায় তলিয়ে যাবো ।
    পিপাসা আর ক্ষুধা, হইহট্টোগোল, নাচো, নাচো নাচো !
     
    —————————–
     
    শ্বেতাঙ্গরা তীরে নামছে । কামানের গোলার আওয়াজ ! এখন আমাদের নির্ঘাত খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হবে, পোশাক পরে তৈরি হও, আর কাজে বেরোও ।
     
    আমার হৃৎপিণ্ডকে ঈশ্বরিক করুণায় বিদ্ধ করা হয়েছে । আহ ! আমি কখনও ভাবিনি যে আমার জীবনে এই ঘটনা ঘটবে !
     
    কিন্তু আমি কোনও অন্যায় তো করিনি । আমার দিনগুলো হয়ে উঠবে স্বস্তিময়, এবং পশ্চাত্তাপ থেকে আমাকে মুক্তি দেয়া হবে । যেখানে আনাড়ম্বর আলোকমালা শোকসভার মোমবাতির মতন আরেকবার জ্বলে ওঠে, আমাকে আধমরা আত্মার শুভত্বে পীড়ন করা হবে না । প্রথম সন্তানের অদৃষ্ট, সময়ের আগেই জন্মানো কফিন যা ঝিলমিলে কান্নাফোঁটায় ঢাকা । কোনও সন্দেহ নেই, ন্যায়ভ্রষ্টতা হলো বোকামি, কদভ্যাস হলো বোকামি ; পচনবিকারকে সদাসর্বদা দূরে সরিয়ে রাখতে হবে । কিন্তু দেয়ালঘড়িকেও শিখতে হবে বিশুদ্ধ যন্ত্রণার সময়নির্দেশের চেয়ে বেশিবার কাঁসরঘণ্টা কেমন করে বাজাতে হয় ! এই সমস্ত দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে, আমাকে কি শিশুর মতন তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, যাতে স্বর্গোদ্যানে গিয়ে খেলা করতে পারি ! তাড়াতাড়ি করো ! সেখানে কি অন্যান্য জীবনও আছে ? — বৈভবশালীদের পক্ষে শান্তিতে ঘুমোনো অসম্ভব । ঈশ্বর্য্য চিরকাল সবায়ের সামনে খোলামেলা থাকে । কেবল জ্ঞানের চাবিকাঠি দিতে পারে দেবোপম প্রেম। আমি তো দেখতে পাচ্ছি প্রকৃতি একধরণের দয়ামায়ার প্রদর্শনী । বিদায় বিশপের আঙরাখায় ঢাকা আগুনের নিঃশ্বাস-ওড়ানো দানব, আদর্শবোধ আর ভুলভ্রান্তি ।
     
    উদ্ধারকারী জাহাজ থেকে ভেসে আসছে দেবদূতদের উদ্দেশ্যময় গান : এ হলো দেবোপম ভালোবাসা। — দুটি ভালোবাসা ! আমি জাগতিক প্রেমে মরে যেতে পারি, আনুগত্যের কারণে মরে যেতে পারি । আমি পেছনে ফেলে যাচ্ছি সেই সমস্ত প্রাণীদের, আমি চলে যাবার পর যাদের যাতনা ক্রমশ বাড়তে থাকবে  ! বাতিলদের মধ্যে থেকে তুমি আমাকে বেছে নিয়েছো, যারা রয়ে গেলো তারা কি আমার বন্ধু নয় ?
     
    তাদের অমঙ্গল থেকে বাঁচাও !
     
    আমি নিমিত্তসিদ্ধির খাতিরে দ্বিতীয়বার জন্মেছি । জগৎসংসার বেশ শুভময় । আমি জীবনকে আশীর্বাদ করবো । আমি আমার ভাইবেরাদরদের ভালোবাসবো ।  বাল্যকালীন প্রতিজ্ঞার ব্যাপার আর নেই। বার্ধক্য আর মৃত্যুকে এড়িয়ে যাবার আশা নেই । ঈশ্বর আমার শক্তি, এবং আমি ঈশ্বরের বন্দনা করি ।
     
    —————————-
    একঘেয়েমি-জনিত বিরক্তিকে আমি আর পছন্দ করি না । দুর্বার-ক্রোধ, বিকৃতকাম, উন্মাদনা, যাদের সব কয়টি স্পন্দনাঘাত আর দুর্বিপাকের সঙ্গে আমি পরিচিত, — আমার সম্পূর্ণ ভার লাঘব হয়েছে । এবার আমার অপরাধশূন্যতার সীমাকে ঠাণ্ডা মাথায় মূল্যায়ন করা যাক।
     
    প্রহারের সন্তুষ্টি চাইবার মতন অবস্হায় আমি আর নেই । আমি কল্পনা করি না যে আমার শ্বশুর যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে আমি মধুচন্দ্রিমায় বেরিয়েছি ।
     
    আমি আমার নিজের যুক্তিজালে আটক জেলবন্দি নই । আমি তো বলেছি । হে ঈশ্বর । আমি উত্তরণের মাধ্যমে স্বাধীনতা চাই : আমি কেমন করে সেই দিকে যাবো ? ছেলেমানুষির সেই স্বাদ আর নেই । আর দরকার নেই দেবোপম ভালোবাসার কিংবা কর্তব্যের প্রতি উৎসর্জন। আমি ছেলেবেলার আবেগ ও অনুভবের ত্রুটিকে দোষ বলে মনে করিনা । যে যার নিজের যুক্তিপূর্ণতায়, অবজ্ঞায়, সর্বজনপ্রীতিতে রয়েছে : শুভবুদ্ধির দেবদূতোপম সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে নিজেকে রেখেছি আমি ।
     
    আর যদি সুস্হিত আনন্দের কথা বলতে হয়, গার্হস্হ হোক বা না হোক…। না, আমি পারবো না। আমি বড়ো বেশি তুচ্ছ, অত্যন্ত দুর্বল । কর্মকাণ্ড জীবনকে কুসুমিত করে তোলে, ওটা পুরোনো ধ্যানধারণা, আমার নয় ; আমার জীবন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা কর্মকাণ্ডের থেকে দূরে লক্ষ্যহীন ভেসে চলে যায়, পৃথিবীর সেই তৃতীয় মেরুঅঞ্চলে ।
     
    বুড়ি চাকরানি হয়ে যাচ্ছি আমি, মৃত্যকে ভালোবাসার সাহস হারিয়ে ফেলেছি !
     
    ঈশ্বর যদি আমাকে সেই দিব্যশান্তি দিতেন, নির্মল প্রশান্তি, এবং প্রার্থনা, — প্রাচীনকালের সন্তদের মতন  — সেই সন্তরা ! তাঁরা ছিলেন শক্তিমন্ত ! নোঙোর, এমনই এক ধরণের শিল্পী যাঁদের প্রয়োজন আর আমাদের নেই !
    এই প্রহসনের কি এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন ? আমাকে কাঁদাবার জন্যে আমার শুদ্ধতা যথেষ্ট। জীবন নামের প্রহসনে সবাইকে খেলতে হবে ।
     
    ————————–
     
    এবার থামাও ! এটা তোমার শাস্তি । — কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যাও !
     
    আহ ! আমার ফুসফুস জ্বলছে, কপাল দপদপ করছে ! রাত্রি ঘনিয়ে আসছে আমার চোখে, এই সূর্যের তলায় ! আমার হৃদয়….আমার দুই হাত আর পাদুটো….
     
    আমরা কোথায় চলেছি ? যুদ্ধ করতে ? আমি বেশ দুর্বল ! অন্যেরা এগিয়ে চলেছে । যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র…আমাকে সময় দাও !
     
    গুলি চালাও ! আমাকে তাক করে গুলি চালাও ! নয়তো আমি তোমাদের হাতে ছেড়ে দেবো নিজেকে । — ভিতুর দল ! — আমি নিজেকে খুন করবো ! আমি নিজেকে ঘোড়ার খুরের তলায় নিক্ষেপ করবো !
     
    আহ !
     
    –আমি এ-সবে অভ্যস্ত হয়ে যাবো ।
     
    সেটাই হবে ফরাসি উপায়, শৌর্যের পথ ।
     
    নরকে এক রাত  
       
    আমি এক্ষুনি মুখভরা ভয়ানক বিষ গিলে ফেলেছি । — আমাকে যে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল তাতে আমি মহিমান্বিত, মহিমান্বিত, মহিমান্বিত ! — আমার নাড়িভূঁড়িতে আগুন ধরে গেছে । বিষের ক্রিয়াক্ষমতায় আমার দুই হাত আর পাদুটো মুচড়ে উঠছে, পঙ্গু করে দিচ্ছে, মাটিতে থুবড়ে ফেলে দিয়েছে । তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে, আমি কাঁদতে পারছি না । এ হলো নরক, অনাদি-অনন্ত যন্ত্রণাভোগ ! দ্যাখো আগুনের শিখা কেমনভাবে ওপরে উঠে যাচ্ছে ! আমার যাওয়া উচিত, আমি জ্বলেপুড়ে মরছি । চালিয়ে যাও, হে শয়তান !
     
    আমি একবার শুভের সঙ্গে আর প্রকাশসৌষ্ঠভের সঙ্গে কথা কইবার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলুম, পাপের শাস্তি হিসাবে নরকভোগ থেকে মুক্ত । কেমন করেই বা আমি নিজের দৃষ্টিপ্রতিভা বর্ণনা করবো, নরকের বাতাস বন্দনাগান গাইবার পক্ষে বড্ডো গাঢ় ! সুসংবদ্ধ আত্মিক ঐকতান, বলিষ্ঠতা এবং শান্তি,  অভিজাত উচ্চাশা, তাছাড়া জানি না আরও কি ছিল সেখানকার লক্ষ-লক্ষ পরমানন্দিত প্রাণীদের ?
     
    পরমানন্দের উচ্চাশা !
     
    কিন্তু তবু আমি বেঁচে আছি ! — মনে করো নরকযন্ত্রণা হলো শাশ্বত ! একজন মানুষ যে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতে চাইছে সে নিশ্চয়ই অভিশপ্ত, নয়কি ? আমার বিশ্বাস আমি নরকে রয়েছি, তার মানে আমি বেঁচে আছি । এই প্রশ্নোত্তরপর্বই কাজ করে চলেছে । আমি আমার খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত কেনা-গোলাম । তোমরা, আমার বাপ-মা, আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছো, আর নিজেদের জীবনও । বেচারা খোকা ! — পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে নরক ক্ষমতাহীন । — আমি তবু বেঁচে আছি! পরে, নরকযন্ত্রণার মহানন্দ হয়ে উঠবে আরও নিগূঢ় । একটা অপরাধ, দ্রুত, আর মানুষের আইনে দণ্ডাদেশ পাওয়া আমাকে শূন্যতায় তলিয়ে যেতে দাও ।
     
    চুপ করো, তুমি কি চুপ করবে !…এখানে সবকিছুই লজ্জাকর আর কলঙ্কিত ; শয়তান বলছে যে আগুনটার কোনও মানে হয় না,  বলছে যে আমার ক্রোধ হলো হাস্যকর এবং নির্বোধ। — আহ, থামো দিকিনি !…কেউ ফিসফিস করে ওই ভুলগুলোর কথা বলেছে, ইন্দ্রজালের সন্মোহন, বোকা-বানানো গন্ধ, শিশুতোষ সঙ্গীত । — আর এই কথা ভাবা যে আমিই সত্যের অধিকারী, যে আমার আয়ত্বে চলে আসতে পারে বিচারের দৃষ্টিপ্রতিভা : আমার নির্ণয় বিচক্ষণ আর দৃঢ়, নিখুঁত হয়ে ওঠার জন্যে আমি শ্রেষ্ঠগুণসম্পন্ন… গর্ববোধ । — আমার করোটি চেপে বসছে । দয়া করো ! হে নাথ, আমি সন্ত্রস্ত ! জল দাও, আমার তেষ্টা পাচ্ছে, আমার তেষ্টা পাচ্ছে ! আহ, শৈশব, ঘাসভূমি আর বৃষ্টি, পথের পাথরে জমা জল, যখন রাত বারোটা বাজে তখনকার চাঁদের আলো….শয়তান দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘড়িমিনারের ছাদে, ঠিক এখনই ! মেরি । পবিত্র অক্ষতযোনি !…ভয়ংকর মূর্খতা।
     
    ওই দিকে তাকাও, ওরা কি মাননীয় মানুষ নয়, যারা আমার ভালো চেয়েছে ?…এসো…মুখের ওপরে বালিশ, ওরা আমাকে শুনতে পাবে না, ওরা তো কেবল প্রেত।
     
    যাই হোক, কেউ আর অন্য কারোর কথা ভাবে না । ওদের কাছে আসতে দিও না । আমার গা থেকে নিশ্চয়ই পোড়া মাংসের গন্ধ বেরোচ্ছে ।
     
    আমার অলীকদৃশ্যগুলো অসংখ্য । এগুলোই আমাকে সব সময় সহ্য করতে হয়েছে : ইতিহাস সম্পর্কে আমার বিশ্বাসহীনতা,  আদর্শগুলোকে উপেক্ষা । আমি এই বিষয়ে আর কোনও কথা বলব না : কবিরা এবং দ্রষ্টারা ঈর্ষা করবে । আমি সকলের চেয়ে ধনী, কয়েক হাজার গুণ, আর আমি তা সমুদ্রের মতন আগলে রাখবো ।
    হে ঈশ্বর — এক মুহূর্ত আগে জীবনের ঘড়ি থেমে গেছে । আমি আর পৃথিবীর অন্তর্গত নই। — ব্রহ্মবিদ্যা সঠিক ; নরক নিশ্চয়ই নিচের দিকে — এবং স্বর্গ ওপরদিকে । — ভাবাবেশ, দুঃস্বপ্ন, ঘুম, আগুনের নীড়ের ভেতরে ।
    দেশের মধ্যে কেমন করে অলস ঘুরে বেড়ায় মন…শয়তান, ফার্দিনান্দ, বুনো বীজের সঙ্গে উড়ে যায়…যিশুখ্রিস্ট ময়ূরপঙ্খী রঙের কাঁটার ওপর দিয়ে হেঁটে যান কিন্তু তাদের নত করেন না…যিশু হেঁটে যেতেন চঞ্চল সমুদ্রের ওপর দিয়ে । লন্ঠনের আলোয় আমরা ওনাকে সেখানে দেখেছি, শ্বেতবসনে, দীর্ঘ বাদামি চুল, পান্নারঙা এক ঢেউয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন ।
     
    যাবতীয় রহস্যের চাদর আমি ছিঁড়ে ফেলবো : ধর্মের রহস্য হোক কিংবা প্রকৃতি, মৃত্যু, জন্ম, ভবিষ্যৎ, অতীত, সৃষ্টির উৎপত্তিতত্ব, এবং শূন্যতার রহস্য । আমি হলুম মোহাবিষ্ট চোখে-দেখা অলীক ছায়ামূর্তিদের মালিক ।
    শোনো !…
     
    প্রতিটি কর্মদক্ষতাই আমার ! — এখানে কেউ নেই, ওখানে কেউ রয়েছে : আমি আমার ঐশ্বর্য নষ্ট করতে চাইবো না । — আমি কি তোমাকে আফরিকার বাঁশি শোনাবো, তলপেট-নাচিয়েদের ? আমি কি উধাও হয়ে যাবো, আমি কি চেষ্টা করবো গসপেল-কথিত আঙটি খুঁজে আনার । যাবো? আমি তৈরি করব সোনা আর ওষুধ ।
    তাহলে,  আমাকে বিশ্বাস করো । বিশ্বাস আরাম দ্যায়, তা পথনির্দেশ করে এবং সারিয়ে তোলে। তোমরা সবাই আমার কাছে এসো, — ছোটো বাচ্চারাও — এসো তোমাদের সান্তনা দিই, তোমাদের সামনে আমার হৃদয়ের কথা মেলে ধরি — আমার অলৌকিক হৃদয় ! — হে দরিদ্রগণ, হে দরিদ্র শ্রমিকবৃন্দ ! আমি বন্দনাগান চাইছি না : তোমরা কেবল আমাকে বিশ্বাস করো, আর তাহলেই আমি আনন্দিত হবো ।
     
    — এবার, আমার কথা ভাবো । এই সবকিছু পৃথিবীকে হারানোর ব্যাপারে আমাকে তাড়িত করে না । আমি ভাগ্যবান যে আমাকে আর যন্ত্রণা পেতে হবে না । আমার জীবন, দুর্ভাগ্যবশত, মিষ্টি বোকামি ছাড়া আর কিছুই ছিল না ।
     
    বাহ ! যতো রকমের কুৎসিত মুখভঙ্গী হতে পারে আমি তা করবো ।
     
    আমরা জগৎসংসারের বাইরে, নিঃসন্দেহে । কোনও শব্দ নেই ।  স্পর্শের বোধশক্তি আমার চলে গেছে । আহ, আমার দুর্গভবন, আমার স্যাক্সনি, আমার উইলোবনানী ! সন্ধ্যা ও সকাল, রাত আর দিন…আমি কতো ক্লান্ত !
    আমার ক্রোধের জন্যে একটা বিশেষ নরক থাকা উচিত ছিল, একটা নরক গর্ববোধের জন্যে, — এবং একটা নরক যৌনতার জন্যে ; নরকের এক পরিপূর্ণ ঐকতান-সঙ্গীত !
     
    আমি পরিশ্রান্ত, আমি মরে যাচ্ছি । এটাই কবর আর আমি কীটে পরিণত হয়ে চলেছি, আতঙ্ক ছাপিয়ে গেছে আতঙ্ককে ! শয়তান, ভাঁড় কোথাকার, তুই নিজের চমৎকারিত্ব দিয়ে আমাকে গলিয়ে ফেলতে চাইছিস । ঠিক আছে, আমি তাইই চাই । আমি তাই চাই । কোদালকাঁটা দিয়ে আমাকে গিঁথে ফ্যালো, আমার ওপরে আগুনের ফোঁটা ঝরাও ।
     
    আহ ! জীবনে ফিরে যাওয়া ! আমাদের বিকলাঙ্গতার দিকে তাকিয়ে দ্যাখা । আর এই বিষ, এই শাশ্বত অভিশপ্ত আলিঙ্গন ! আমার দুর্বলতা, এবং জগতসংসারের নির্দয়তা ! হে ঈশ্বর, দয়া করো, আমাকে লুকিয়ে ফ্যালো, আমি নিজেকে একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না — আমি আড়ালে রয়েছি, আর আমি নেইও ।
     
    আর যেমন-যেমন অভিশপ্ত আত্মা জেগে উঠতে থাকে, ঠিক তেমনই আগুনও ।
     
    প্রথম ডিলিরিয়াম : সেই বোকা অক্ষতযোনি মেয়ে     
     
    নরকবাসী একজন পুরোনো বন্ধুর আত্মস্বীকৃতি শোনা যাক, “হে প্রভু, হে দিব্য বিবাহের বর, তোমার সবচেয়ে সমব্যথী পরিচারিকাদের আত্মস্বীকৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না । আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি । আমি মাতাল । আমি অশুদ্ধ।
     
    এই কি জীবন !
     
    “ক্ষমা করো, স্বর্গের নিবাসী হে প্রভু, ক্ষমা করে দাও ! আহ ! ক্ষমা করো । এই কান্নার জল। এবং আরও যে অশ্রু পরে ঝরতে থাকবে, অনুমান করি !
     
    “পরে, আমি দিব্য বিবাহের বরের সঙ্গে দেখা করবো ! আমি তো জন্মেছিলুম তাঁর কেনা-গোলাম হবার জন্যে । — ওরা এবার আমাকে পিটুনি দিতে পারে !
     
    “ঠিক এখনই, জগতসংসারের শেষ ! ওহ, মেয়েরা…আমার বন্ধুনিরা !…না, আমার বন্ধুনিরা নয়…আমি কখনও এমনতর অবস্হা সহ্য করিনি, ডিলিরিয়াম, পীড়নসমূহ, সমস্তকিছু…এটা এমন অর্থহীন ।
     
    “ওহ ! আমি কাঁদছি, আমি কষ্ট পাচ্ছি । আমি সত্যিই যন্ত্রণাভোগ করছি । তবু আমার যা ইচ্ছা করার অধিকার রয়েছে, যখন কিনা আমাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে সবচেয়ে অবজ্ঞেয় হৃদয়গুলোর অবজ্ঞা দিয়ে ।
     
    “ঠিক আছে, আমাকে আত্মস্বীকৃতি করতে দেয়া তো হোক, যদিও আমাকে হয়তো তা কুড়িবার নতুন করে আওড়াতে হবে, — এমনই নীরস, এবং এমনই গুরুত্বহীন !
     
    “আমি নারকীয় বিয়ের বরের একজন কেনা-গোলাম, সেই লোকটা যে বোকা অক্ষতযোনি মেয়েদের ফুসলিয়ে সতীত্বহানি করেছিল । ও একেবারে সেই রকমেরই শয়তান । ও মোটেই মায়াপুরুষ নয়, ও প্রেতও নয় । কিন্তু আমি, যে কিনা নিজের কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি, জগতসংসারের কাছে অভিশপ্ত আর মৃত ,– কেউই আমাকে খুন করতে পারবে না ! কেমন করে তোমার কাছে তার বর্ণনা করি ! এমনকি আমি কথাও বলতে পারছি না । আমি পরে আছি শোকের পোশাক, আমি কাঁদছি, আমি বেশ ভয়ার্ত । দয়া করো, হে প্রভু, একটু টাটকা বাতাস, যদি তোমার খারাপ না লাগে, দয়া করো !
     
    “আমি এক বিধবা…– আমি এক সময় বিধবা ছিলুম…–ওহ, হ্যাঁ, তখনকার সময়ে আমি ভীষণ গম্ভীর থাকতুম, আমি কংকাল হয়ে ওঠার জন্য জন্মাইনি !…ও ছিল কচিখোকা কিংবা বলা যায় প্রায়…ওর কোমল, রহস্যময় চালচলন আমাকে পুলকিত করেছিল । ওকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমি আমার সব কর্তব্য ভুলে গেলুম । কি যে এক জীবন আমরা কাটাই ! সত্যকার জীবনের অভাব রয়েছে । আমরা এই জগতসংসার থেকে নির্বাসিত, সত্যি — ও যেদিকে যায় আমিও সেই দিকে যাই, আমাকে যেতেই হয় । আর বেশির ভাগ সময়ে ও আমার ওপর ক্ষেপে যায়, আমার প্রতি, বেচারা পাপিষ্ঠ । সেই শয়তানটা ! ও সত্যিই একটা শয়তান, তুমি জানো, এবং মোটেই মানুষ নয় ।
     
    “ও বলে : “আমি মেয়েদের ভালোবাসি না । ভালোবাসাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে, আমরা তা জানি । মেয়েরা যা শেষপর্যন্ত চায় তা হল সুরক্ষা । একবার ওরা তা পেয়ে গেলে, প্রেম, সৌন্দর্য্য, সবই জানালার বাইরে কেটে পড়ে : যা তাদের কাছে রয়ে যায় তা হলো তাচ্ছল্য, আজকাল বিবাহ তার ওপরই টিকে থাকে । অনেক সময়ে আমি এমন তরুণীদেরও দেখেছি যাদের খুশি থাকার কথা, যাদের সাথে আমি সঙ্গলাভ করতে পারতুম, কিন্তু তাদের তো আগে থেকেই মাস্তানরা এমন গিলে খেয়েছে যেন কাঠের গুঁড়ি ছাড়া তারা আর কিছুই নয়…”
     
    “আমি ওকে শুনি, বদনামকে শৌর্যে পালটে ফেলছে, নিষ্ঠুরতাকে মায়ায় । “আমি প্রাচীন এক জাতির সদস্য : আমার পুর্বপুরুষরা ছিল ভাইকিং যোদ্ধা : তারা নিজেদের দেহ ফালাফালা করে ফেলতো, নিজেদের রক্ত পান করতো ।—আমি আমার সমস্ত শরীর ফালাফালা করে ফেলবো, উল্কি দেগে দেবো সারা শরীরে , আমি মোঙ্গোলদের মতন কুৎসিত হয়ে উঠতে চাই : তুমি দেখো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করতে চাই । আমি সত্যিই রাগে ফুঁসিয়ে উঠতে চাই । আমাকে হীরে-জওহরত দেখিও না ; আমি চার হাতেপায়ে জাজিমের ওপরে হামাগুড়ি দিয়ে দুমড়ে উঠবো । আমি চাই আমার ধনসম্পত্তি রক্তে জবজবে হয়ে উঠুক । আমি কখনও কোনো কাজ করবো না… “বহুবার, রাতের বেলায়, ওর দানব আমাকে কাবু করেছে, আর আমরা কুস্তির দাঁওপ্যাঁচে গড়াগড়ি খেয়েছি ! — অনেক সময়ে রাতের বেলায় যখন ও মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যায় তখন ও রাস্তার আনাচে-কানাচে কিংবা দরোজার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়, যাতে আমাকে ভয়ে আধমরা করে দিতে পারে ।– আমি নির্ঘাৎ আমার গলা কেটে ফেলবো ; তা কি বিরক্তিকর হবে।” আর, ওহ ! সেই দিনগুলো যখন ও খুনি হবার ভান করে !
     
    “অনেক সময়ে ও ওর দেশোয়ালি বুলিতে কথা বলে, তা একেবারে আবেগে ঠাশা, মৃত্যু সম্পর্কে, আর তা কেমন করে আমাদের অনুতপ্ত করে, এবং জগতসংসারে নিশ্চয়ই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ আছে, শ্রমে পরিশ্রান্ত, আর বিদায় জানাবার প্রসঙ্গ তোলে এবং তা কেমন করে তোমার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে ফ্যালে । যে নোংরা পানশালাগুলোতে ও মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যেতো, তখন আমাদের চারিপাশের লোকজনদের দেখে কাঁদতো — যেন বস্তি-অঞ্চলের গোরুমোষ । অন্ধকার রাস্তায় মাতালদের তুলে নিতো । ছোট্ট খোকাদের জন্য নির্দয় মায়ের দয়ামায়া ছিল ওর । রবিবারের স্কুলের পথে এক ছোট্ট খুকির মতন মধুরস্বভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াতো । ও ভান করতো যেন সবকিছুই জানে, ব্যবসাপাতি, শিল্প, ওষুধ । — আর আমি সবসময় ওর সমর্থন করতুম, আমাকে করতে হতো !
     
    “ও নিজের কল্পনাজগতে যেসব ঝালর ঝুলিয়ে রাখতো তা আমি সুস্পষ্ট দেখতে পেতুম ; পোশাক-পরিচ্ছদ, কারিগরি, আসবাবপত্র….আমিই ওকে অস্ত্র ধার দিয়েছিলুম, আর মুখভঙ্গীতে রদবদল । ওকে যাকিছু প্রভাবিত করতো তা আমি টের পেতুম, ঠিক যেমনভাবে ও নিজেকে কল্পনা করে নিতো । যখনই ওকে মনে হয়েছে হতোদ্যম, আমি ওকে অদ্ভুত দুর্বোধ্য অভিযানে অনুসরণ করতুম, চলেছি তো চলেইছি, শুভ হোক বা অশুভ : কিন্তু আমি সবসময়ে জানতুম যে আমি ওর জগতের অংশীদার হতে পারবো না । ওর প্রিয় দেহের পাশে, শুয়ে থাকার সময়ে, জেগে থাকতুম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রাতের পর রাত, ভাবতে চেষ্টা করতুম যে কেন ও বাস্তব থেকে পালিয়ে যেতে চায় । এর আগে আর কোনো লোকের এই রকম ইচ্ছে হয়নি । আমি বুঝতে পেরেছিলুম, ওর সম্পর্কে বিনা ভয়ে — যে, সমাজের পক্ষে ও ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে । ওর কি, হয়তো, এমন কিছু গোপন ব্যাপার ছিল যা ওর জীবনের নবীকরন ঘটাবে ? না, আমি নিজেকে বলেছি, ও কেবল সেগুলোকে অনুসন্ধান করছিল । কিন্তু তবু, ওর বদান্যতা এক সন্মোহনে আবৃত, এবং আমি তাতে বন্দী । আর কারোর অমন শক্তিক্ষমতা থাকতে পারে না — হতাশার শক্তিক্ষমতা — তা সহ্য করবার, ওর ভালোবাসা আর শুশ্রুষা সহ্য করার ক্ষমতা । তাছাড়া, অন্য কারো সাথে আমি ওকে কল্পনাও করতে পারি না : আমাদের সকলের রয়েছে নিজস্ব কালো-দেবদূতের চোখ, অন্য লোকেদের দেবদূতদের নয়, — অন্তত আমি তাইই মনে করি। আমি ওর আত্মার ভেতরে বাসা বেঁধেছিলুম,  যেন তা ছিল এক ফাঁকা প্রাসাদ যাতে সবচেয়ে অযোগ্য লোক হিসাবে তুমিই তাতে থাকো : ব্যাস এইটুকুই । আহ! সত্যি বলতে কি আমি ওর ওপর শোচনীয়ভাবে নির্ভর করতুম । কিন্তু আমার নিষ্প্রভ, আমার ভিতু অস্তিত্ব থেকে ও কিই বা চাইতো ? ও তো আমার উৎকর্ষসাধন করতে পারতো না, যদিও ও কখনও আমাকে মেরে ফেলার ব্যবস্হা করতে পারেনি ! আমি এমন ভেঙে পড়ি আর হতাশ হই : অনেকসময়ে আমি ওকে বলি: “আমি তোমাকে বুঝতে পারি।” ও তাতে কেবল কাঁধ নাচায় ।
     
    “আর তাই আমার হৃদয়ের বেদনা বাড়তেই থাকলো, আর আমি দেখলুম যে বেশি করে ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছি — আর সবাই তা হয়তো দেখতে পেয়েছে, নিশ্চয়ই, আমি যদি এতোটা অবজ্ঞেয় না হতুম তাহলে কেউই আর আমার দিকে তাকিয়ে দেখতো না ! আর তবু আমি ওর অনুরাগের জন্যে আকুল কামনা করেছি…ওর চুমুগুলো আর ওর বন্ধুত্বের আলিঙ্গন ছিল স্বর্গীয়– অন্ধকার স্বর্গ, যার মধ্যে আমি প্রবেশ করতে পারতুম, আর যেখানে আমি চাইতুম আমাকে রেখে দেয়া হোক — গরিব, বধির, বোবা, এবং অন্ধ । আমি ইতিমধ্যে ওর ওপর নির্ভর করা আরম্ভ করেছিলুম । এবং আমি কল্পনা করতুম যে আমরা দুজন সুখী বালক দুঃখের স্বর্গোদ্যানে স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি । আমাদের মধ্যে ছিল চরম সামঞ্জস্য । গভীর সমবেদনায়, আমরা পাশাপাশি খেটেছি । কিন্তু তারপর, এক ছিঁড়েফেলা আলিঙ্গনের শেষে, ও বলে উঠবে : “কতো মজার মনে হবে এই সমস্ত কাণ্ড, যা তুমি সহ্য করেছো, যখন আমি আর এখানে থাকবো না । যখন তুমি তোমার কাঁধ ঘিরে আমার বাহু অনুভব করবে না, তোমার তলায় আমার হৃদয়কেও পাবে না, তোমার চোখের ওপর আমার এই মুখ । কেননা একদিন আমাকে চলে যেতে হবে, অনেক দূরে । তাছাড়া, অন্যদেরও তো আমার সহচর্যের প্রয়োজন : সেই জন্যেই আমি এখানে রয়েছি, যদিও আমি সত্যিই তা চাই না…প্রিয় হৃদয়…”আর সেই মুহূর্তে আমি নিজেকে অনুভব করতে পারি, ও চলে যাবার পর, ভয়ে বিহ্বল, ভয়ঙ্কর কালোগহ্বরে তলিয়ে যাওয়া : মৃত্যুর দিকে । আমি ওকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালুম যে ও আমাকে কখনও ছেড়ে চলে যাবে না । এবং ও প্রতিজ্ঞা করলো, কুড়িবার ; প্রেমিকের মতন প্রতিজ্ঞা করলো । ব্যাপারটা যেন ওকে বলা আমার এই কথার মতন অর্থহীন “আমি তোমায় বুঝতে পারছি”।
     
    “ওহ, আমি কখনও ওর সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত হইনি । ও আমাকে কখনও ছেড়ে চলে যাবে না, আমি সে বিষয়ে নিশ্চিত । কিই বা ও করবে ? কোনো লোককেই ও চেনে না ; ও কোনও কাজও করতে পারবে না । ও ঘুমে-হাঁটা মানুষের মতন বাঁচতে চায় । ওর দয়া আর বদান্যতা কি বাস্তব জগতে ওকে ঠাঁই দেবে ? এমন মুহূর্তও আসে যখন আমি ভুলে যাই যে কোনও জঘন্য নোংরামিতে আমি জড়িয়ে পড়েছি : ও আমাকে শক্তি যোগাবে, আমরা দেশান্তরে যাবো, মরুভূমিতে শিকার করতে যাবো, অচেনা শহরের পথের ধারে ঘুমোবো, পিছুটানহীন আর মজায় । কিংবা হয়তো কোনোদিন জেগে উঠলুম আর — ওর ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা যাবতীয় আইনকানুন ও নীতি-নৈতিকতায় বদল ঘটিয়ে ফেলেছে, — কিন্তু জগতসংসার ঠিক আগেকার মতনই রয়ে যাবে আর আমাকে রেখে যাবে আমার আকাঙ্খা আর আমার আনন্দ আর আমার উদ্বেগহীনতায়।
     
    ওহ! অভিযানের সেই বিস্ময়কর জগৎ যা আমরা বাচ্চাদের বইতে পেতুম — তুমি কি সেই জগৎ আমাকে দেবে না ? আমি অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছি, আমি একখানা পুরস্কারের যোগ্যতা রাখি। ওর তা নেই । আমি সত্যিই জানি না ও ঠিক কী চায় । ও বলে যে ওর রয়েছে নানাবিধ আশা এবং পশ্চাত্তাপ : কিন্তু সেসব ব্যাপার নিয়ে আমার কিছুই করার নেই । ও কি ঈশ্বরের সঙ্গে কথা কয় ? আমারও উচিত ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলা । আমি অতলের তলানিতে, আর আমি ভুলে গেছি কেমন করে প্রার্থনা করতে হয় ।
     
    “মনে করো ও আমাকে নিজের দঃখকষ্ট ব্যাখ্যা করলো, আমি কি তা ওর ঠাট্টা-ইয়ার্কি এবং অপমানের চেয়ে ভালো করে বুঝতে পারবো ? ও আমাকে আক্রমণ করে, ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে লজ্জায় ফেলার জন্য সেইসব ব্যাপার যা আমার কাছে কখনও গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা নিয়ে বকে যায়, আর তারপর আমি যখন কাঁদি তখন ক্ষেপে যায়।
     
    “– তুমি কি ওই সৌম্যকাক্তি যুবকটিকে দেখতে পাচ্ছো সুন্দর, শান্তিপূর্ণ বাড়িটায় ঢুকছে? ওর নাম দুভাল, দুফো, আরমান্দ, মরিস, যা তুমি মনে করো। ওখানে এক মহিলা আছেন যিনি ওই অশুভ প্রাণীটাকে ভালোবেসে সারাজীবন কাটিয়েছেন : উনি মারা গেলেন। আমি নিশ্চিত উনি এখন স্বর্গবাসী একজন সন্ত । তুমি আমাকে সেইভাবেই খুন করবে যেভাবে ও ওই মহিলাকে খুন করেছে । যাদের রয়েছে পরার্থবাদী হৃদয় তাদের এটাই ভবিতব্য…”। হে প্রিয় ! এমনও দিনকাল ছিল যখন ওর মনে হতো উদ্যমী মানুষেরা ওর গ্রটেস্ক উন্মাদনার খেলনা : ও তারপর ভয়ানকভাবে হাসতেই থাকবে, হাসতেই থাকবে ।—তারপর ও কমবয়সী মায়ের মতন বা বয়স্কা বোনের মতন অভিনয় করায় ফিরে যাবে । ও যদি অমন বুনো জিনিস না হতো, তাহলে আমরা বেঁচে যেতুম । কিন্তু ওর মধুরস্বভাবও সাঙ্ঘাতিক । আমি একজন কেনা-গোলাম। — ওহ, আমি আমার চিন্তাক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি !
     
    “কোনও দিন হয়তো ও অলৌকিকভাবে লোপাট হয়ে যাবে, কিন্তু আমাকে তা নিশ্চিত করে বলে যাওয়া দরকার, মানে আমি বলতে চাইছি ও যদি স্বর্গে বা অন্য কোথাও ফিরে যেতে চায়, যাতে আমি গিয়ে এক মুহূর্তের জন্যে দেখতে পারি অক্ষতযোনি মেরির ঢঙে আমার সোহাগের খোকাটার স্বর্গারোহন ।
     
    একটা নারকীয় গৃহস্হালী বটে !
     
    দ্বিতীয় ডিলিরিয়াম : শব্দের অপরসায়ন        
      
    এবার আমার পালা । আমার উন্মাদনাগুলোর এক কাহিনি ।
     
    অনেককাল যাবত আমি এই ভেবে দম্ভোক্তি করতুম যে সমস্ত সম্ভাব্য ভূদৃশ্যের আমি গুরু এবং আমি মনে করতুম যে আধুনিক তৈলচিত্র আর কবিতার মহান ব্যক্তিদের কাজগুলো হাস্যকর।
     
    যা আমি পছন্দ করতুম তা হলো : কিম্ভুতকিমাকার তৈলচিত্র, চৌকাঠের মাথার ওপরের ছবি, মঞ্চের সজ্জা, কার্নিভালের পশ্চাতপট, সাইনবোর্ড, রঙচঙে ছাপা ; পুরোনোদিনের সাহিত্য, গির্জার লাতিন, ভুল বানানে ভরা যৌনপুস্তক, যে ধরণের উপন্যাস আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা পড়েন, পরিদের গল্প, বাচ্চাদের বই, পুরোনো অপেরা, ফালতু পুরোনো গান, দেশোয়ালি গানের ঠুনকো তাল ।
     
    আমি ক্রুসেডের স্বপ্ন দেখতুম, এমন আবিষ্কারযাত্রায় বেরিয়েছি যা কেউ কখনও শোনেনি, ইতিহাসহীন গণরাজ্য, মুছে-ফেলা ধর্মযুদ্ধ, নৈতিকতায় বিপ্লব, মহাদেশ ও জনজাতির প্রসারণ : আমি সমস্ত রকমের ইন্দ্রজালে বিশ্বাস করতুম ।
     
    আমি প্রতিটি স্বরবর্ণের রঙ আবিষ্কার করেছি ! –A  কালো, E শাদা, I লাল,O নীল, U সবুজ।
     
    —আমি আঙ্গিকের নিয়ম তেরি করেছি এবং প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণের বিচলন, এবং আমি নিজের অন্তরজগত থেকে ছন্দ আবিষ্কারের দম্ভোক্তি করতুম, এমনই এক ধরণের কবিতা যাকে প্রতিটি ইন্দ্রিয়, এখন হোক বা পরে, স্বীকৃতি দেবে । এবং কেবল আমিই হবো তার অনুবাদক।
     
    এটা আমি অনুসন্ধান হিসাবে আরম্ভ করেছিলুম । আমি নৈঃশব্দ আর রাতকে শব্দে পরিবর্তিত করে দিয়েছিলুম । যা উচ্চারণ করা যায় না, আমি তা লিখে ফেলতুম । আমি ঘুরন্ত পৃথিবীকে এক জায়গায় স্হির করে দিয়েছিলুম ।
     
    —————-
     
    ঝাঁকের থেকে দূরে, পাখিদের আর গ্রামের খুকিদের,
    ওই পাতা-সবুজের ভেতরে আমি কী পান করেছিলুম
    কচি বাদামগাছে ঘেরা
    দুপুরের উষ্ণসবুজ কুয়াশায় ?
    এই নতুন ওয়াজ নদী থেকে আমি কী পান করতে পারি
    –জিভহীন গাছেরা, ফুলহীন ঘাসভূমি, অন্ধকার আকাশ !–
    এই হলুদ কুমড়োখোসা থেকে পান করব, সেই কুটির থেকে দূরে
    যা আমি ভালোবাসতুম ? একটু সোনালি চুমুক যার দরুন আমি ঘামছি।
    আমাকে দেখে কোনো সরাইখানার সন্দিগ্ধ প্রতিনিধি মনে হতে পারতো ।
    — পরে, সন্ধ্যার দিকে, আকাশ মেঘেয় ভরা…
    বনের ভেতর থেকে জলধারা ছুটে চলেছে বিশুদ্ধ বালিয়াড়িতে,
    আর পুকুরের ওপরে স্বর্গীয় বাতাসে বরফের পুরু সর ;
    তারপর আমি দেখতে পেলুম স্বর্ণ, আর ফোঁপালুম, কিন্তু পান করা হলো না।
     
    গ্রীষ্মকালে, সকাল চারটের সময়ে
    ভালোবাসার খোঁয়ারি তখনও থেকে গেছে…
    ঝোপঝাড় ছড়িয়ে দিচ্ছে সুগন্ধ
    রাতের পানভোজনোৎসবের
    উজ্জ্বল নদীকন্যাদের ওইদিকে
    সূর্যের পশ্চিমা কারখানার মধ্যে,
    ছুতোরেরা তাড়াহুড়ো করছে — শার্টের হাত গুটিয়ে —
    এবার কাজ আরম্ভ হবে ।
    কাজ শুরু হয়ে গেছে ।
    আর ফাঁকা, শেওলা-ওপচানো পাথুরে জমিতে
    তারা তাদের দামি জিনকাপড় মেলে ধরছে
    যেখানে শহর
    এঁকে দেবে এক ফোঁপরা আকাশ
    ছবি আঁকা নিয়ে সেইসব মনোরম শখের চর্চাকারীদের জন্যে
    যারা ব্যাবিলনের কোনো রাজার জন্যে পরিশ্রম করছে,
    ভিনাস ! একটু সময়ের জন্য ছেড়ে চলে যাও
    প্রেম-করিয়েদের উজ্বল হৃদয় ।
    হে মেষপালকদের রানি !
    শ্রমিকরা যেখানে জিরোচ্ছে
    আর দুপুরের সমুদ্রে স্নান করছে
    সেখানে নিয়ে যাও ফলের বিশুদ্ধতম মদ ।
     
    ————————–
     
    আমার শব্দের অপরসায়নে পুরোনো দিনের কবিতার ক্ষয়ে-যাওয়া ধারণাগুলো গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ।
    আমি প্রাথমিক সন্মোহনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলুম : কারখানা দেখার বদলে আমি সুস্পষ্ট দেখতে পেতুম মসজিদ, দেবদূতদের ড্রামবাদকদল, আকাশের রাজপথে ঘোড়ার গাড়ি, ঝিলের জলের তলায় বৈঠকখানা ; দানবদের,  আর রহস্যগুলো ; এক প্রমোদানুষ্ঠানের নামপত্র আমাকে শ্রদ্ধায় ভীত করেছিল ।
     
    আর তাই আমি শব্দগুলোকে দৃষ্টিপ্রতিভায় বদলে দিয়ে আমার ঐন্দ্রজালিক কুতর্কগুলোকে  ব্যাখ্যা করলুম !
    শেষ পর্যন্ত আমার মগজের বিশৃঙ্খলাকে আমি পবিত্র বলে মনে করতে লাগলুম । গা এলিয়ে শুয়ে থাকতুম, জ্বরে গিলে খেয়ে ফেলছে শরীর : আমি জানোয়ারদের শান্তিময়তাকে হিংসে করতে লাগলুম — গুটিপোকা, যারা দ্বিতীয় শৈশবের পাপহীনতাকে সুস্পষ্ট করে তোলে , গন্ধমুষিক, অক্ষতযোনি মেয়েদের  তন্দ্রাভাব !
     
    আমার মন বিষিয়ে উঠলো । আমি জগতসংসারকে গাথাসঙ্গীতের মতন কবিতায় বিদায় জানালুম :
     
    সবচেয়ে উঁচু মিনার থেকে গাওয়া একটি গান
    তাকে আসতে দাও, তাকে আসতে দাও,
    যে ঋতুকে আমরা ভালোবাসতে পারি
    আমি বহুকাল অপেক্ষা করেছি
    যা আমি ভুলে যেতে পারি ;
    আর স্বর্গে রেখে দিতে পারি
    আমার ভয় ও পশ্চাত্তাপ ।
    এক অসুস্হ তৃষ্ণা
    আমার শিরাগুলোকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে ।
    তাকে আসতে দাও, তাকে আসতে দাও,
    যে ঋতুকে আমরা ভালোবাসতে পারি
    তাই সবুজ মাঠ,
    অনেক ছড়িয়ে পড়েছে, ফুলে ছেয়ে গেছে,
    সুগন্ধ আর বুনোঝোপে
    আর নোংরা পোকাদের
    নিষ্ঠুর আওয়াজে ।
    তাকে আসতে দাও, তাকে আসতে দাও,
    যে ঋতুকে আমরা ভালোবাসতে পারি
     
    আমি মরুভূমিকে ভালোবাসতুম, পোড়া ফলবাগানকে, ক্লান্ত পুরোনো দোকান, গরম পানীয়। আমি নিজেকে দুর্গন্ধ গলির ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে গেলুম, আর দুই চোখ বন্ধ করে আমি  সূর্যের কাছে, যিনি আগুনের দেবতা, নিজেকে উৎসর্গ করলুম ।
     
    “সেনাধিপতি,  যদি তোমার বিদ্ধস্ত পাটাতনের ওপরে একটা কামানও টিকে থাকে, আমাদের ওপরে শুকনো মাটি দিয়ে গড়া গোলা চালাও । দামি দোকানগুলোর আয়নাগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দাও ! এবং বৈঠকঘরগুলো ! শহরের মুখে তারই ধ্বংসধুলো ঢুকিয়ে দাও । মরচে পড়ে যেতে দাও ছাদের সিংহমুখো নালিগোলোয় । পদ্মরাগমণির আগুনগুঁড়ো দিয়ে বন্ধ করে দাও মহিলাদের গোঁসাঘরগুলো….”
     
    ওহ ! গ্রামের সরাইখানার পেচ্ছাপঘরের ছোট্ট মাছিটা, পচা আগাছার প্রেমে মশগুল, আলোর একটা রশ্মিতে ঝিমিয়ে পড়ে !
     
    ক্ষুধা
     
    আমি আমার হাড়ের ভেতরে কেবল খুঁজে পাই
    পৃথিবীর মাটি আর পাথর খাবার স্বাদ ।
    যখন আমি খাই, আমি বাতাস খেয়ে টিকে থাকি,
    নুড়ি আর কয়লা আর আকরিক লোহা ।
    পরিবর্তে, আমার ক্ষুধা । ক্ষুধা, খাওয়াও
    খেতভরা ভূষি ।
    যতো পারো যোগাড় করো সেই উজ্বল
    বিষের আগাছা ।
    একজন ভিখারির হাত দিয়ে ভাঙা পাথর খাও,
    পুরোনো গির্জার দেয়ালের পাথর ;
    নুড়িশিলা, বানভাসির শিশুরা,
    কাদায় পড়ে থাকা রুটি ।
     
    ———————————-
     
    ঝোপের পেছনে ডেকে উঠবে এক নেকড়ে
    মোরগের মাংসখাবার উৎসবে
    ঝলমলে পালকগুলো ছিঁড়ে :
    ওরই মতন, আমি নিজেকে গিলে ফেলি ।
    জড়ো করার জন্যে অপেক্ষা করে
    ফল আর ঘাস তাদের সময় কাটায় ;
    বেড়ায় যে মাকড়সা জাল বোনে
    শুধু ফুল খায় ।
    আমাকে ঘুমোতে দাও ! আমাকে সেদ্ধ হতে দাও
    সলোমনের পূজাবেদির ওপরে ;
    আমাকে শুষে নিতে দাও ছাতাপড়া মাটি,
    আর বয়ে যেতে দাও কেন্দ্রনে ।
     
    সব শেষে, হে যৌক্তিকতা, হে মহানন্দ, আমি আকাশ থেকে তার নীল সরিয়ে ফেলেছি যা আসলে অন্ধকার, আর আলোর প্রকৃতির সোনালি স্ফূলিঙ্গে বসবাস করেছি । আমার আনন্দের আতিশয্যে, আমি আমার মুখকে যতোটা পারি মজাদার আর আদিম করে তুলতে চেয়েছি:
     
    ওটা খুঁজে পাওয়া গেছে ।
    কী ? — অনন্তকাল ।
    ঘুরন্ত আলোয়
    সমুদ্রের সূর্যে ।
    হে আমার চিরকালীন আত্মা,
    আকাঙ্খা আঁকড়ে ধরে থাকো
    রাত হওয়া সত্ত্বেও
    এবং আগুনের দিন ।
    তোমাকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে
    মানবের কঠোর সংগ্রাম থেকে
    আর জগতসংসারের সকলরব প্রশংসা থেকে
    তোমাকে উড়ে যেতে হবে যতোটা তুমি পারো….
    –চিরকালের আশা নেই
    নেই উথ্থানের অবকাশ ।
    বিজ্ঞান আর ধৈর্য,
    যাতনা অবশ্যম্ভাবী ।
    তোমার অন্তরের আগুন,
    মোলায়েম রেশম-অঙ্গার,
    আমাদের সমস্ত কর্তব্য
    কিন্তু কেউই তা মনে রাখে না ।
    তা খুঁজে পাওয়া গেছে ।
    কী ? অনন্তকাল ।
    ঘুরন্ত আলোয়
    সমুদ্রের সূর্যে ।
     
    ——————-
     
    আমি হয়ে উঠলুম নীতিকাহিনির অপেরা : আমি দেখলুম জগতসংসারে সকলেই আনন্দে দণ্ডপ্রাপ্ত। কর্মশক্তি প্রয়োগই জীবন নয় : তা কেবল ক্ষমতাকে বরবাদ করার একটা উপায়, স্নায়ুকে ধ্বংস করার  নিমিত্তমাত্র । নৈতিকতা হলো মস্তিষ্কে ভরা জল।
     
    আমার মনে হয়েছে যে প্রত্যেকেরই আরও বেশ কয়েকটা জীবন থাকা উচিত ছিল। ওই লোকটা জানে না ও কি করছে : ও একজন দেবদূত । ওই পরিবারটা কুকুর-বাচ্চাদের গাদাঘর । কয়েকজনের ক্ষেত্রে, আমি অনেকসময়ে তাদের কোনো এক অপরজীবন থেকে চেঁচিয়ে কথা বলেছি। — ওই সূত্রেই আমি একটা শুয়োরকে পছন্দ করেছিলুম ।
     
    উন্মাদনার একটিও মেধাবী যুক্তিতর্ক নয়, — যে উন্মাদনাকে তালাচাবি দিয়ে আটক করা হয়, — আমি কি ভুলে গেছি : আমি আবার তার কোটর দিয়ে যেতে পারি, পুরো প্রণালীটা আমার হৃদয়ে খোদাই করা আছে ।
    তা আমার স্বাস্হ্যে প্রভাব ফেলেছিল । সামনেই যেন সন্ত্রাস । আমি বারবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তুম, যা এক লপ্তে অনেকদিন স্হায়ী হতো, আর যখন আমি জেগে উঠতুম, আমার দুঃখি স্বপ্নগুলো বজায় থাকতো । মারাত্মক ফসল তোলার জন্যে আমি ছিলুম তৈরি, আর আমার দুর্বলতা আমাকে জগতসংসারের বিপজ্জনক রাস্তার কিনার পর্যন্ত নিয়ে যেতো, সিমেরিয়ার সমুদ্রতীর পর্যন্ত, ঘুর্নিঝড় আর অন্ধকারের স্বর্গে ।
     
    আমাকে ভ্রমণ করতে হতো, যাতে মগজে জড়ো হওয়া জাদুগুলো উবে যেতে পারে । সমুদ্রের ওপরে, যা আমি এমন ভালোবাসতুম যে তা যেন আমার অশুদ্ধতা ধুয়ে দেবে, আমি দেখলুম দয়াময় ক্রুশকাঠ ওপরে উঠে এলো । আমি ছিলুম রামধনু দ্বারা শাপিত । প্রকাশসৌষ্ঠব ছিল আমার শাস্তি, আমার কুরে-খাওয়া মনস্তাপ, আমার কীট : তারপর আমার জীবন শক্তিমত্তা এবং সৌন্দর্যের তুলনায় অনেকটাই বড়ো হয়ে উঠবে ।
     
    আনন্দধারা ! তার মারাত্মক মিষ্টতার হুল আমাকে কাকডাকা ভোরে জাগিয়ে তুলবে, –রাত বারোটায়, যিশুর পুনরুথ্থানের মুহূর্তে, — বিষণ্ণতম শহরে :
     
    হে ঋতুসকল, হে পল্লীদুর্গেরা !
    কোথায় আছে সেই নিখুঁত আত্মা ?
    আমি শিখলুম ইন্দ্রজাল
    আনন্দধারা, আমাদের সবাইকে সন্মোহিত করে।
    আনন্দধারা তোমাকে, জীবনের জয়গান করো
    যখনই ফরাসিদেশের কাক ডেকে উঠবে ।
    এখন সমস্ত আকাঙ্খা বিদায় নিয়েছে :
    আমার জীবনকে তা নিজের করে নিয়েছে ।
    সেই সন্মোহন প্রভাবিত করেছে আমার হৃদয় ও আত্মা
    আর প্রতিটি যোগ্যতাবিচারকে লণ্ডভণ্ড করেছে ।
    হে ঋতুসকল, হে পল্লীদুর্গেরা !
    আর, ওহ ! যেদিন তা মিলিয়ে যাবে
    সেইদিনই হবে আমার মৃত্যুর দিন ।
    হে ঋতুসকল, হে পল্লীদুর্গেরা !
     
    ———————-
     
    তা সবই শেষ হয়ে গেছে । আজকে, আমি জানি সৌন্দর্যকে কেমন করে উদযাপন করতে হয় ।
     
    সেই অসাধ্যসাধন
     
    আহ ! বালক হিসাবে আমার জীবন, প্রতিটি আবহাওয়ায় খোলা রাস্তার মতন ; আমি ছিলুম অস্বাভাবিকভাবে মিতাচারী, সবচেয়ে ভালো ভিখারির চেয়েও উদাসীন, কোনো দেশ না থাকার চেতনায় গর্বিত, বন্ধুহীন, তা যে কি বোকামি ছিল । — আর আমি এখন তা উপলব্ধি করছি!
     
    — বুড়ো লোকগুলো যারা আদর করার সুযোগ ছাড়ে না তাদের অবিশ্বাস করার ব্যাপারে আমি সঠিক ছিলুম, আমাদের নারীদের স্বাস্হের গায়ে আর নির্মলতায় পরগাছা, যখন কিনা আজকে নারীরা আমাদের থেকে আলাদা এক জাতি ।
     
    যা কিছু আমি অবিশ্বাস করতুম সে ব্যাপারে আমি সঠিক ছিলুম : কেননা আমি পালিয়ে যাচ্ছি!
     
    আমি পালিয়ে যাচ্ছি !
     
    বলছি বিশদে ।
     
    এমনকি কালকেও, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছি : “ঈশ্বর ! এখানে এই তলানিতে আমাদের মতন প্রচুর অভিশপ্ত রয়েছে ! তাদের সারিতে আমি ইতিমধ্যে যথেষ্ট দুর্দশায় ভুগেছি ! আমি ওদের সবাইকে চিনি । আমরা পরস্পরকে চিনতে পারি ; আমরা পরস্পরকে বিরক্ত করি । আমাদের কেউই পরার্থবাদীতার কথা শোনেনি । তবুও, আমরা মার্জিত ; জগতসংসারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ নিয়মানুগ ।” তা কি অপ্রত্যাশিত ? এই জগতসংসার ! ব্যবসাদারের দল, আর মূর্খেরা ! — এখানে থাকায় কোনো অসন্মান নেই । — কিন্তু নির্বাচিত লোকজন, তারা আমাদের কীভাবে আপ্যায়ন করবে ? কেননা তেমন লোকজনও তো আছে, খুশমেজাজ লোকজন, নকলভাবে নির্বাচিত, কেননা তাদের সান্নিধ্যে যাবার জন্যে আমাদের সাহসী ও বিনয়ী হতে হবে। ওরাই প্রকৃত নির্বাচিত ।  মোটেই কপটাচারী সন্ত নয়, ওরা !
     
    যেহেতু দুই পয়সা দামের যুক্তিপূর্ণতা ফিরে পেয়েছি — কেমন তাড়াতাড়ি তা চলে যায়! — আমি দেখতে পাই যে আমার ঝঞ্ঝাটের উৎস হলো আগেই টের না পাওয়া যে এটা পাশ্চাত্য জগৎ । এগুলো পাশ্চাত্য জলাভূমি ! এমন নয় যে আলো ফিকে হয়ে গেছে, আঙ্গিক ক্ষয়াটে, কিংবা অগ্রগমন বিপথে চালিত…। ঠিক আছে ! প্রাচ্যের পতনের পর থেকে  আমার মনের মধ্যে যে রদবদল ঘটেছে আমার মন এখন নিশ্চিতভাবে সেই সব নিষ্ঠুর ঘটনার মোকাবিলা করতে চায়…। আমার মনের সেটাই চাহিদা !
     
    …আর সেখানেই আমার দুই পয়সা দামের যুক্তিবোধের সমাপ্তি ! নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মন, তা দাবি করছে যে আমি পাশ্চাত্যজগতেই থাকি । যেমনটা আমি চিরকাল চেয়েছি, আমি যদি এটা শেষ করে ফেলতে চাই তাহলে একে চুপ করিয়ে দিতে হবে ।
     
    আমি আগে বলতুম, চুলোয় যাক শহিদদের করতল, শিল্পের যাবতীয় আলোকসঙ্কেত, আবিষ্কারকের গর্ববোধ, লুন্ঠনকারীর উত্তেজনা ; প্রাচ্যদেশে এবং মৌলিক, শাশ্বত জ্ঞানে আমার ফিরে যাবার কথা । কিন্তু এসবই নিঃসন্দেহে কলুষিত আলস্যের স্বপ্ন !
     
    আর তবুও আধুনিক যন্ত্রণাবোধ থেকে পালাবার ইচ্ছে আমার ছিল না । কোরানের মিশ্রিত পাণ্ডিত্য সম্পর্কে আমার গভীর কৌতূহল নেই। — কিন্তু এই জ্ঞানে কি প্রকৃত পীড়ন নেই যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রদোষ থেকে, খ্রিস্টধর্ম, মানুষ নিজেকে মূর্খ প্রতিপন্ন করে চলেছে, যা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান তাকে প্রমাণ করতে চাইছে, বারবার প্রমাণ দেখিয়ে গর্বে বুক ফোলাচ্ছে, আর কেবল তা নিয়েই বেঁচে আছে ! এটা একরকমের সূক্ষ্ম, বোকা পীড়ন ; আর এটাই আমার আত্মিক অসংলগ্নতার উৎস । প্রকৃতি হয়তো এই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে বিরক্ত ! যিশুর সঙ্গেই জন্মেছিলেন প্রুধোম ।
     
    তা কি এই জন্যে নয় যে আমরা কুহেলিকার চর্চা করি ! জোলো শাকসবজির সঙ্গে জ্বরকে গিলে ফেলি । এবং মাতলামি ! আর তামাক । আর অজ্ঞানতা ! আর অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ! — এই সমস্তকিছুই কি প্রাচ্যের জ্ঞান, আমাদের আসল পিতৃভূমি, তার দর্শন থেকে দূরে নয় ? আধুনিক জগতসংসার নিয়ে কিই বা করার আছে, যদি অমন বিষ আবিষ্কার হয় !
     
    যাজকরা আর ধর্মোপদেশকরা বলবেন : নিশ্চয়ই । কিন্তু তুমি তো আদম আর ইভের নন্দনকাননের প্রসঙ্গ তুলছো । প্রাচ্য জাতিদের অতীত ইতিহাসে তোমার জন্য কিচ্ছু নেই…। সে কথা সত্যি । আমি নন্দনকাননের কথাই বলতে চাইছি ! প্রাচীন জাতিদের বিশুদ্ধতা কেমন করেই বা আমার স্বপ্নকে প্রভাবিত করবে ?
     
    দার্শনিকরা বলবেন : জগতসংসারের কোনো বয়স নেই । মানবতা স্হান থেকে স্হানান্তরে যায়, ব্যাস । তুমি একজন পাশ্চাত্য মানুষ, কিন্তু তুমি তোমার নিজস্ব প্রাচ্যে বসবাসের জন্য স্বাধীন, যতো পুরোনো তুমি চাও ততোই, — আর সেখানে তুমি যেমন ইচ্ছে থাকতে চাও । হেরো হয়ে যেও না । দার্শনিকগণ, আপনারা পাশ্চাত্য জগতের পাকাপাকি অংশ !
     
    মন, সাবধান হও । উত্তরণের পেছনে পাগলের মতন ছুটো না । নিজেকে শিক্ষিত করো! –আহ!
     
    বিজ্ঞান আমাদের থেকে কখনও এগিয়ে থাকে না !
     
    –কিন্তু আমি দেখি আমার মন ঘুমিয়ে পড়েছে ।
     
    এই মুহূর্ত থেকে যদি তা পূর্ণসতর্ক থাকে, আমরা দ্রুত সত্যকে পাবো, যা হয়তো এখনই ফোঁপাতে থাকা দেবদূতদের দিয়ে আমাদের ঘিরে রেখেছে !….– যদি তা এই মুহূর্ত পর্যন্ত পূর্ণসতর্ক ছিল, তাহলে, অনেককাল আগেই, আমি তা নীচ প্রবৃত্তির কাছে সোপর্দ করতুম না !…–যদি তা চিরটাকাল পূর্ণসতর্ক থাকতো, আমি প্রজ্ঞায় ভাসতুম!…
     
    হে বিশুদ্ধতা ! বিশুদ্ধতা !
     
    এই জাগরণের মুহুর্তে, আমার ঘটে গেল বিশুদ্ধতার দৃষ্টিপ্রতিভা ! মনের মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোই !
     
    কী যে এক ঠুঁটো দুর্ভাগ্য !
     
      সৌদামিনী
    —————-
     
    মানুষের শ্রম ! সেই বিস্ফোরণ আমার অতলকে সময়ে-সময়ে আলোকিত করে।
     
    “জ্ঞান আহরনের পথে : কোনো ব্যাপারই আত্মশ্লাঘা নয়!” চেঁচিয়ে বলে ওঠেন আধুনিক ধর্মপ্রচারকদল, যার অর্থ সব্বাই । আর তবুও বজ্জাত ও অলসদের চাপ গিয়ে পড়ে বাদবাকিদের হৃদয়ের ওপরে….। আহ ! তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি ওইখানে চলুন ; রাতের ওই পারে…ভবিষ্যতের সেই পুরস্কার, সেই শাশ্বত পুরস্কার…আমরা কি তা থেকে নিষ্কৃতি পাবো?
     
    —এর থেকে বেশি আমি কিই বা করতে পারি ? শ্রমের কথা জানি ; এবং বিজ্ঞান বড়োই মন্হর।  প্রার্থনা দ্রুতগামী আর আলোকমালার গর্জন…আমি তা ভালো করে জানি। ব্যাপারটা খুবই সহজ, আর আবহাওয়া বেশ তপ্ত ; আমাকে ছাড়াই তোমাদের চলে যাবে । আমার রয়েছে কর্তব্য ; একে একপাশে সরিয়ে রাখতে, আমি গর্ববোধ করবো. যেমন অন্যেরা করেছে ।
     
    আমার জীবন নিঃশেষিত  । ঠিকই, চলো ভান করা যাক, আমরা কোনো কাজই করবো না ! ওহ ! দুঃখদায়ক ! আর আমরা বেঁচে থাকবো, আর নিজেদের মনোরঞ্জন করবো, দানবিক প্রেম আর খেয়ালি জগতের স্বপ্ন দেখবো, পৃথিবীর আদল-আদরা নিয়ে অভিযোগ আর ঝগড়া করবো, দড়াবাজিকর, ভিখারি, শিল্পী, ডাকাত, — যাজক ! আমার হাসপাতালের বিছানায়, ধুপকাঠির সুগন্ধ তীব্রভাবে আমার কাছে ফিরে এলো ; পবিত্র সৌরভের অভিভাবক, আত্মস্বীকৃতিকারী, শহিদ…।
     
    শৈশবের মলিন শিক্ষা সেখানে আমি চিনতে পারি । তারপর কী !…কুড়ি বছর বয়সে পৌঁছোও: আমি কুড়িবছর পালন করবো, অন্য সকলে যদি তা করে…।
     
    না ! না ! এখন আমি মৃত্যুর বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াচ্ছি ! আমার গর্ববোধের তুলনায় শ্রমকে মামুলি মনে হয় : জগতসংসারের কাছে আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়াটা আমার শাস্তির পক্ষে যৎসামান্য হবে। শেষ মুহূর্তে আমি আক্রমণ করব, একবার ডানদিকে, আরেকবার বাঁদিকে….।
     
    —ওহ ! — বেচারা প্রিয় আত্মা, তাহলে অমরত্ব হয়তো হাতছাড়া হবে না !
     
     
     সকাল
     
    আমার কি একসময় তেমন যৌবন ছিল না যা মনোরম, বীরোচিত, কিংবদন্তিপ্রতিম, যা সোনার কাগজে লিখে ফেলা যায় ? — আমি ছিলুম খুবই ভাগ্যবান ! কোন সে অপরাধ, কোন ভুলের কারণে আমার ওপর বর্তেছে বর্তমান দুর্বলতা ? তোমরা যারা মনে করো যে জানোয়াররাও দুঃখে ফোঁপায়,  অসুস্হরা বিষাদগ্রস্ত হয়, মৃতেরা খারাপ স্বপ্ন দ্যাখে, এবার আমার পতনের সঙ্গে আমার ঘুমের সম্পর্ক খোঁজো । যে ভিখারিটা পাখির মতন এবং প্রভুর বন্দনাগান গায়, আমি নিজেকে তার চেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না । কীভাবে কথা কইতে হয় তা আমি আর জানি না !
     
    অথচ তবু, আজকে, আমার মনে হয় এই নরকের হিসাব আমি শেষ করে ফেলেছি । আর তা নরকই ছিল : সেই পুরোনোটা, যার সিংহদরোজা খুলে দিয়েছিল মানবপুত্র ।
     
    সেই একই মরুভূমি থেকে, সেই একই আকাশপানে, আমার ক্লান্ত চোখ রূপালি নক্ষত্রের দিকে সবসময় চেয়ে থাকে, সব সময়ের জন্যে ; কিন্তু সেই তিন জ্ঞানী মানুষ একেবারও নিজেদের জায়গা থেকে নড়াচড়া করেন না, জীবনের মহারাজারা, হৃদয়, আত্মা, মন । আমরা যখন যাবো, পাহাড়ের ওপর আর সমুদ্রের তীরে, নতুন শ্রমের, নতুন জ্ঞানের জন্মের গুণগান করার জন্যে, অত্যাচারী এবং দানবরা  পালাবে , কুসংস্কারের সমাপ্তি ঘটবে, — আমরাই হবো প্রথম ভক্ত ! — পৃথিবীর মাটিতে খ্রিস্টের জন্মোৎসব !
     
    স্বর্গসমূহের গান, রাষ্ট্রদের অগ্রগমন ! আমরা কেনা-গোলাম , জীবনকে অভিশাপ দেয়া আমাদের উচিত নয় !
     
    বিদায়
     
    হেমন্ত এসে গেছে ! — আমরা যদি দৈব উজ্বলতা অনুসন্ধানের জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাহলে চিরকালীন সূর্যের জন্যে কেনই বা দুঃখপ্রকাশ করা , — ঋতুবদলের সঙ্গে যাদের মৃত্যু হয় তাদের থেকে বহু দূরে ।
     
    হেমন্ত । আমাদের নৌকা, ঝুলন্ত কুয়াশা থেকে উঠে এসেছে, বাঁক নেয় দারিদ্রের বন্দরের দিকে, দানবিক শহর, তার আকাশ আগুন আর কাদায় নোংরা । আহ ! সেইসব কটুগন্ধ কাঁথা, বৃষ্টিতে ভেজা রুটি, মাতলামি, আর হাজার প্রেম যা আমাকে ক্রুশকাঠে বিঁধেছে !  লক্ষকোটি মৃত আত্মা আর দেহের পিশাচিনী রানির দিন কি কখনও ফুরোবে না, আর কবেই বা তাদের সবায়ের বিচার হবে ! আমি নিজেকে আবার দেখতে পাই, নোংরায় আর রোগে আমার গায়ের চামড়া ক্ষয়ে গিয়েছে, মাথার চুলে আর বগলে পোকারা কিলবিল করছে, আর তাদের চেয়েও বড়ো-বড়ো পোকা চরে বেড়াচ্ছে আমার হৃদয়ে, আয়ূহীন, হৃদয়হীন, অচেনা আকারে ছেয়ে ফেলেছে…। আমি সেখানে অনায়াসে মরে যেতে পারতুম…। কি ভয়ানক স্মৃতি ! দারিদ্র্যকে আমি খুবই ঘেন্না করি।
     
    আর শীতকালকে আমি ভীষণ ভয় পাই কেননা তা বড়োই আরামদায়ক !
     
    —অনেকসময়ে আমি আকাশে দেখতে পাই বালিছড়ানো সীমাহীন তীর শাদা উদ্দীপনাময় রাষ্ট্রে ছেয়ে গেছে । একটা সোনালি জাহাজ, আমার ওপরদিকে, সকালের হাওয়ায় নানা রঙের নিশান ওড়াচ্ছে । প্রতিটি ভোজনোৎসব, প্রতিটি বিজয়, প্রতিটি দৃশ্যকাব্যের আমি ছিলুম স্রষ্টা । নতুন ফুল, নতুন গাছপালা, নতুন মাংস, নতুন ভাষা আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলুম আমি । আমি ভেবেছিলুম আমি অর্জন করেছি অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা ।
     
    হাঃ ! আমাকে আমার কল্পনা আর আমার স্মৃতিকে গোর দিতে হবে ! শিল্পী আর গল্পকার হিসাবে জমকালো কর্মজীবনের কেমনতর সমাপ্তি!
     
    আমি !  নিজেকে ম্যাজিশিয়ান, দেবদূত, নৈতিকতার বাঁধন থেকে মুক্ত বলে মনে করেছিলুম ।
     
    আমাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে যাতে চাষের জমির প্রতি কৃতজ্ঞতা শোধ করতে পারি, বাহুতে মুড়ে নিতে পারি গ্রন্হিল বাস্তবতা ! একজন চাষি !
     
    আমি কি প্রতারিত ? পরার্থবাদিতা কি হয়ে উঠবে মৃত্যুর বোন, আমার জন্যে ?
     
    ঠিক আছে, মিথ্যা আশ্রয় করে বেঁচে থাকার জন্য আমি  ক্ষমা চেয়ে নেবো। আর তাইই শেষ ।
     
    কিন্তু বন্ধুত্বের একটাও হাত নেই ! আর কোথায়ই বা আমি সাহায্য খুঁজবো ?
     
    ¯¯¯¯¯¯¯¯
    সত্যি, নতুন যুগ রূঢ় ছাড়া আর কিছুই নয় ।
     
    কেননা আমি বলতে পারি যে আমি একটা বিজয় পেয়েছি ; দাঁতের ওপর দাঁত চেপে, নরকের আগুনের ফোঁসফোঁসানি, দুর্গন্ধিত দীর্ঘশ্বাস ফুরিয়ে এসেছে । আমার রাক্ষুসে স্মৃতি মিলিয়ে যাচ্ছে।
     
    বিদায় নিচ্ছে আমার শেষ আকাঙ্খাগুলো, — ভিখারিদের, ডাকাতদের, মৃত্যুর বন্ধুদের, যে জগত পাশ দিয়ে চলে গেছে, তার সম্পর্কে ঈর্ষা । — অভিশপ্ত আত্মারা, যদি আমি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারতুম !
     
    চরম আধুনিক হওয়া দরকার ।
     
    ধন্যবাদোৎসবের স্তবগানকে গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নেই : একবার যে ধাপে পা রেখেছো তা ধরে রাখো । এক দুঃসহ রাত ! আমার মুখের ওপরে শুকনো রক্তের ধোঁয়া, আর আমার পেছনদিকে ওই ছোট্ট বীভৎস গাছ ছাড়া আর কিছু নেই !…মানুষের সংগ্রামের মতনই আত্মার জন্য সংগ্রামও পাশবিক ; কিন্তু বিচারের আনন্দদর্শন কেবল ঈশ্বরের একার ।
     
    তবু এটাই রাত্রিকালের জাগ্রদবস্হা । চলো আমরা নতুন শক্তিক্ষমতাকে, আর প্রকৃত প্রেমপরায়ণতাকে মেনে নিই । এবং সকালে, দীপ্তমান ধৈর্যকে বর্ম করে, আমরা মহিমান্বয়ের শহরগুলোয় প্রবেশ করবো ।
     
    আমি কেন বন্ধুত্বের হাতের কথা বলেছিলুম ! আমার সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো যে মিথ্যায় ভরা পুরোনো ভালোবাসা আমি হেসে উড়িয়ে দিতে পারি, আর অমন প্রতারণাভরা যুগলকে কলঙ্কে দেগে দিতে পারি, — সেখানে আমি নারীদের নরকের অভিজ্ঞতাও পেয়েছি ; — আর এবার আমি একই দেহ ও একই আত্মায় সত্যকে ধারণ করতে সক্ষম হবো ।
     
    [ রচনাকাল : এপ্রিল-আগস্ট, ১৮৭৩ ]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 | 30 | 31 | 32 | 33 | 34 | 35 | 36 | 37 | 38 | 39 | 40 | 41 | 42 | 43 | 44 | 45 | 46 | 47 | 48 | 49 | 50 | 51 | 52 | 53 | 54 | 55 | 56 | 58 | 59 | 60 | 61 | 62 | 63 | 64 | 65 | 66 | 67 | 68 | 69 | 70 | 71 | 72 | 73 | 74 | 75 | 76 | 77 | 78 | 79 | 80 | 81 | 82 | 83 | 84 | 85 | 86 | 87 | 88 | 89 | 90 | 91 | 92 | 93
  • কাব্য | ১৩ নভেম্বর ২০২২ | ১২৩৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন