রবিঠাকুর আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিলেন
মলয় রায়চৌধুরী
ইমলিতলার বাড়িতে, পাটনায়, আর উত্তরপাড়ার বসতবাটিতে, এবং মামার বাড়ি পাণিহাটিতে, রবিঠাকুর নিষিদ্ধ ছিলেন; তাঁর লেখা ও গানের প্রবেশাধিকার ছিল না। পাটনা আর উত্তরপাড়ায়, বড়ো জ্যাঠা-জেঠিমার ও ঠাকুমার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার সাহস বয়স্কদেরও ছিল না। রবিঠাকুর লোকটি যে ঠিক কে, আর কেনই বা তাঁর নাম বা কাজ মুখে আনা যাবে না সে কৌতুহল নিরসনের প্রয়াস বয়স্করাও করতেন না।
রবিঠাকুর লোকটিই যে রবীন্দ্রনাথ, তাও আমরা, ভাই-বোনরা, টের পাই বেশ পরে। আমি প্রাথমিক-স্তরে ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম, যেখানে ইউরোপীয় সিস্টার ও ফাদাররা পড়াতেন, যাঁরা ইউরোপীয় মনীষী ও খ্রিস্টান সন্তদের কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যান করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ইমলিতলা পাড়াও ছিল কাহার কুর্মি পাসি মুসহর চামার দুসাধ ও অতি-গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত বস্তি ।
রবিবাবুদের সম্পর্কে উষ্মার বীজ দাদু-ঠাকুমা বয়ে এনেছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের রাওলপিন্ডি লাহোর কোয়েটা ইত্যাদি কোনো একটা শহর থেকে। দাদু লক্ষ্মীনারায়ণ ভারতের প্রথম ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার-পেইনটার ছিলেন, এবং নিমন্ত্রণ পেয়ে তখনকার প্রিন্সলি স্টেটের নবাব-বেগম-রাজা-রানিদের ফোটো ব্রোমাইড কাগজে তুলে অর্ডার অনুযায়ী পেইনটিং এঁকে দিতেন। তিনি ফোটো তুলতে শিখেছিলেন লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটর জন লকউড কিপলিঙের কাছে। পাকিস্তানের ওই অঞ্চলটিকে সে-সময়ে বলা হতো আপার ইনডিয়া।
প্রথম আভাস মেলে একটি গানকে কেন্দ্র করে। বড়ো জ্যাঠামশায়ের দুই মেয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতেন পন্ডিত বুলাকিলালের কাছে। জ্যাঠাইমা সংক্রান্তির দিন সত্যনারায়ণের পুজো করতেন, আর সেই উপলক্ষে ইমলিতলার বাড়িতে ব্রাহ্মণ-সমাবেশ হতো। পুরুতমশায় সতীশ ঘোষালের চাঁদ সদাগরের হিতোপদেশ শেষ হলে ঈশ্বরবন্দনার গান গাইতেন দিদিরা, ব্রজ ভাষা বা হিন্দি বা সংস্কৃতে। সতীশকাকার অনুরোধে পন্ডিত বুলাকিলাল একটি বাংলা ঠুংরি, ভৈরবী রাগিনীতে, শিখিয়েছিলেন ছোড়দি ধরিত্রীকে:
কে ভুলালে হায়
কল্পনাকে সত্য করি জান, এ কি দায় ?
আপনি গড়হ যাকে,
যে তোমার বশে তাঁকে
কেমনে ঈশ্বর ডাকে কর অভিপ্রায় ?
কখনো ভূষণ দেও, কখনো আহার;
ক্ষণেকে স্হাপহ, ক্ষণেকে করহ সংহার ।
প্রভু বলি মান যারে,
সম্মুখে নাচাও তারে—
হেন ভুল এ সংসারে দেখেছ কোথায় ?
ছোড়দি সেতার বাজিয়ে গেয়েছিলেন, সঙ্গতে তবলায় পন্ডিতজি। গান শেষ হতে, বড়ো জ্যাঠা আর সতীশ কাকা দুজনেই দুষলেন পন্ডিতজিকে, অমন ম্লেচ্ছ গান শেখাবার জন্য। পন্ডিতজি তর্ক দিয়েছিলেন যে শহরের বহু গণ্যমান্য বাঙালি পরিবারে তিনি এই গান শিখিয়েছেন। তাঁকে জানানো হয়েছিল যে, তারা সব ম্লেচ্ছ পরিবার, অব্রাহ্মণ। গানটা নিয়ে সমবেত প্রসাদপ্রার্থিরা যে একমত নন, তা স্পষ্ট হয়েছিল বড়িশা-বেহালার জ্ঞাতি দাশরথিজেঠুর এই মন্তব্যে, “ওহে আমরা নিজেরাই তো ভঙ্গকুলীন, সিরাজদৌলার চাকর, আমাদের আবার মেলেচ্ছো”! ইমলিতলা পাড়ার কোনো বাসিন্দাকে কিন্তু ম্লেচ্ছ তকমা দেয়া হতো না। আমরা পাড়ার সমবয়সীদের সঙ্গে, চোর-পুলিশ খেলার সময়ে, যার বাড়িতে ইচ্ছে ঢুকে যে-কোনও ঘরে লুকিয়ে থাকতে পারতুম, এমনকি নাজিমদের পোড়ো বাড়িতে বা ওদের বাড়ির সামনের মসজিদে। নাজিমের দিদি কুলসুম আপা আমাদের বাড়িতে হাঁসের ডিম বিক্রি করতে এসে, মা আর কাকিমাদের সঙ্গে গল্প করতেন।
একটা গান কেন সত্যনারায়ণের পুজোয় খাপ খাবে না, সে বোধশক্তি তখন আমার ছিল না। তাছাড়া, গানটিরই বিরোধিতা করা হয়েছিল; যার মানে বাড়ির কেউই ভবিষ্যতে গাইবে না। গানটা ভুলে যেতুম। কিন্তু গানটা আবার শোনার সুযোগ হল সেই সময়ে যখন ক্যাথলিক স্কুলে ফোর্থ স্ট্যান্ডার্ড পর্যন্ত পড়ে রামমোহন রায় সেমিনারিতে গিয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলুম। সে-সময়ে পাটনায় ওই স্কুলটিই ছিল বাংলা মাধ্যম স্কুল।
রামমোহন রায় সেমিনারিতে এই জন্যে ভর্তি হয়েছিলুম যে, ক্যাথলিক স্কুলে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় কথা বললে শাস্তি পেতে হতো, এবং সে কারণে আমার মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলুম। দ্বিতীয়ত বাবা আলাদা বাড়ি তৈরি করায়, ইমলিতলার একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গিয়েছিল। ইমলিতলার সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে দাদাকে (সমীর রায়চৌধুরী ) ম্যাট্রিক পাস করার পর কলকাতার সিটি কলেজে পড়ার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল মামার বাড়ি পাণিহাটিতে।
রামমোহন রায় সেমিনারিতে প্রতি বছর ভাদ্রোৎসব হতো, আশ্বিন মাসের কোনও এক রবিবারে। ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকারা অংশ নিতেন নৃত্যগীত ও নাটকের ওই সন্ধ্যানুষ্ঠানে, যাকে বলা হতো বসন্ত উৎসব, এবং অভিভাবকদের আসতে বলা হতো সেই সন্ধ্যানুষ্ঠান দেখার জন্য। আমি ভর্তি হবার প্রথম বছরে, বড়দি-ছোড়দি আর মা-কাকিমারা ছিলেন দর্শকাসনে। তাঁদের স্তম্ভিত ও আনন্দিত করে সেই একই গানটি গেয়ে অনুষ্ঠানের সূত্রপাত করেছিল গায়ক-গায়িকা ছাত্রছাত্রীরা। ক্ষেত্রমোহন পোদ্দার যতদিন প্রিন্সিপাল ছিলেন, এই অনুষ্ঠানটি হতো প্রতিবছর। তাঁর অবসরের পর, হিন্দিভাষীদের সংখ্যাধিক্যে, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বসন্ত উৎসব।বাংলা-মাধ্যমে আর পড়ানো হয় না, শিক্ষকদের অভাবে ।
বহুকাল পর, বাবার কাছে জানতে পারি যে, যে-সময়ে দাদু-ঠাকুমা লাহোর ইত্যাদি আপার ইনডিয়ার অঞ্চলে ট্যুর করে বেড়াচ্ছিলেন, সে-সময়ে ধর্ম-প্রচারক নবীনচন্দ্র রায়ও ওই অঞ্চলে ব্রাহ্মধর্মের প্রচারে গিয়েছিলেন, এবং তাঁর মতাদর্শ দাদু ও আরও বহু বাঙালি ও পাঞ্জাবি মেনে নিতে পারেননি। দাদু-ঠাকুমা নিজেদের গোঁড়ামি চাউর করে দিতে পেরেছিলেন বড়োজ্যাঠার মনে। আর আমার বড়োজ্যাঠাইমা এসেইছিলেন পুরুতবাড়ি থেকে।
আমার শৈশবে পাটনার অধিকাংশ বাঙালি এলিট পরিবার—ভদ্রলোক—ছিলেন ব্রাহ্ম, আদিধর্মের ব্রাহ্ম। পন্ডিত নবীনচন্দ্র রায় সেই অংশেরই প্রতিনিধি ছিলেন। দাদু যখন আপার ইনডিয়ায় ছিলেন, তখনই পাঞ্জাব হাইকোর্ট এবং ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিল রায় দিয়েছিল যে আদিধর্মের বা ‘আনুষ্ঠানিক’ ব্রাহ্মরা হিন্দু নয়। কেশবচন্দ্রের নববিধান ব্রাহ্মরা ছিলেন ‘অনআনুষ্ঠানিক’ ।
প্রথমত, আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের গৃহকর্তা ও কর্ত্রীর ধার্মিক গোঁড়ামির কারণে, ও দ্বিতীয়তে বাঙালি এলিটসমাজ থেকে দূরত্বের দরুন, যাবতীয় ব্রাহ্মদের ‘বেমমো’ তকমা দিয়ে পরিত্যাজ্য করে দিয়েছিল ইমলিতলার বাড়ি। রামমোহন রায়ের লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত সম্পর্কে সে কারণেই উষ্মা। বড়ো জ্যাঠা মেজো জ্যাঠার নাটকের দল ছিল পাটনায়। ওই দলের আড্ডায় সংস্কৃতিচর্চা হতো, হিন্দুদের সংস্কৃতিচর্চা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বর্জিত।
ইমলিতলার বয়স্করা কেউই স্কুলের গন্ডি পেরোননি, সে কারণে পাটনার শিক্ষিত এলিটসমাজে প্রবেশাধিকার পাননি। রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মকে ভেতর থেকে শুধরোতে চেয়েছিলেন; তাঁর ব্রাহ্মসভার প্রতিটি সদস্যই ছিলেন ব্রাহ্মণ; তাঁর লেখা গানকে ‘বেমমো’ তকমা দেয়া উচিত হয়নি। তিনি ব্রিটেনে মারা যান ১৮৩৩ সালে, যখন কিনা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথক ধর্ম হিসাবে ব্রাহ্মধর্মের নথি প্রকাশ করেন ১৮৫০ সালে।
ব্রাহ্ম-বিরোধিতার আরেকটি কারণ—‘বেমমো’দের হেয় করার বীজ— আমার মা এনেছিলেন পাণিহাটির মামার বাড়ি থেকে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের বিরোধিতা করে ব্রাহ্মসমাজের প্রায় প্রতিটি ট্রাস্টি ইংলন্ডেশ্বরকে সমর্থন করে বিদ্রোহী সেপাইদের কড়া শাস্তি দাবি করেছিলেন। ১৮৭১ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা প্রথমে ব্রাহ্ম, তারপর ভারতীয়। ১৮৭২-এর স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিয়ে করার সময়ে একজন ব্রাহ্মকে লিখে দিতে হতো যে, “আমি হিন্দু বা মুসলিম বা খ্রিস্টান বা ইহুদি নই”।
পাণিহাটিতে দাদামশায়ের প্রজন্ম থেকে পুরুষরা সবাই ছিলেন স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর, যখন কিনা আমাদের পরিবারে তা শুরু হয়েছে দাদার কলেজে যাওয়া থেকে। সম্ভবত কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্মসমাজে অনুপ্রবেশের পর, ‘বেমমো’দের সম্পর্কে মামারবাড়িতে দার্শনিক আবহাওয়া পালটে গিয়ে থাকবে, কেননা শৈশবে দেখেছি, এবং আমার সেজমামা লক্ষ্মীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে একটা গদ্যর ( ‘ছ্যান’ শিরোনামে ‘অপ্রকাশিত ছোটোগল্প’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ) তথ্য সংগ্রহ কালে জেনেছি যে মামারবাড়িতে ‘ইনডিয়ান মিরর’ পাক্ষিক পত্রিকা কলকাতা থেকে আনাতেন দাদামশায় কিশোরীমোহন।
তখনকার দিনে, যে সময়ে হিন্দু বাড়ির লোকেরা দেয়ালে দেবী-দেবতার এবং ইংল্যান্ডেশ্বরের ছবি টাঙাত, পাণিহাটির বারমহলের পেল্লাই বৈঠকখানায় টাঙানো থাকত অ্যান্টিক ফ্রেমে বাঁধানো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ জ্ঞানীগুণীর ছবি। আশ্চর্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁকে মামারবাড়িতেও বলা হতো রবিবাবু, তাঁর ছবি, তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়া সত্ত্বেও, টাঙানো হয়নি।
পাণিহাটির বৈঠকখানাটি ছিল বিশাল, একটা ছোটখাট গ্রন্থাগার। অংশটি বিক্রি করে দেবার পর তার ওপর এখন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের একাধিক বই ছিল কাঠের আলমারিগুলোয়। বয়স্কদের বক্তব্য ছিল যে রবিবাবু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে বিকৃত করছেন। বড়োদাদু অনাদিনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন আমি ওই বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতে বা কাউকে গাইতে শুনিনি। ছোটো রেফরিজারেটারের মাপের একটা বাক্স-রেডিও রাখা থাকত দালানে, তার মাথায় কলের গান বসানো। অনাদি ও কিশোরী দুজনেই ভারতীয় শাস্ত্রসঙ্গীতের বোদ্ধা ছিলেন। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ।
পাটনায়, ইমলিতলার বাড়িতে, চোঙ-লাগানো কলের গান, সেতার তবলা অর্গান ক্ল্যারিনেট হারমোনিয়াম আর বেহালা ছিল। বড়ো জ্যাঠা ক্ল্যারিনেট বাজাতে জানতেন, তবলায় সঙ্গত দিতে পারতেন। দিদিরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতেন, এবং বাড়ির আসরে গাইতেন। কিন্তু রবিবাবুর গান গাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। বস্তুত ঠাকুমা এবং বড়ো জ্যাঠা যদি জানতে পারতেন কোনও গান ব্রাহ্মদের গেয় ব্রহ্মসঙ্গীত তাহলে তা নিষিদ্ধ হয়ে যেত।
একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাবার পর চোঙা-লাগানো কলের গান, আঙুরবালা-গহরজানদের গ্রামোফোন রেকর্ড, এবং সঙ্গীতযন্ত্রগুলো দিদিরা শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বছর খানেক ভায়োলিন বাজানো শিখেছিলুম, কিন্তু আয়ত্ত করতে না পেরে ছেড়ে দিই। আমার সহপাঠী সুবর্ণ উপাধ্যায়কে দিয়ে দিয়েছিলুম বেহালাটা। সুবর্ণ আরও কয়েক বছর চেষ্টা করেছিল, তারপর ছেড়ে দিয়েছিল। আসলে, আমার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য গিটার শেখা উচিত ছিল ।
কালক্রমে ইমলিতলার বাড়ি, কাকারা কোতরং আর উত্তরপাড়ায় চলে যাবার দরুন, মেজো জেঠিমাও মারা গিয়েছিলেন, প্রায় ভুতুড়ে হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের দেখা-শোনার কেউ ছিল না বলে ইমলিতলার তিন তলা বাড়ি ভাড়া দিয়ে বড়ো জ্যাঠা-জেঠিমাও চলে গিয়েছিলেন দিদিদের ভোমরপোখরস্হিত সিলভ্যান হাউসে থাকতে। দুই জ্যাঠতুতো দিদি, সাবিত্রী ও ধরিত্রীর একই বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল। এখন ওই পাটনাইয়া জমিদার বাড়ির পেছনের অংশ ভেঙে শতাধিক ফ্ল্যাটের এগারোতলা আবাসন গড়ে উঠেছে। দিদিদের বাড়িতে প্রায়ই গানের আসর বসত। বিট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গকে আমি অমন এক গানের আসরে নিয়ে গিয়েছিলুম দিদিদের বাড়ি।
কলেজে ঢোকার পর, দরিয়াপুর পাড়ায় আমাদের নতুন বাড়িতে এসে, দিদিদের বাড়ি আমি বড়ো একটা যেতুম না, ভাইফোঁটা ছাড়া বা বড়ো জেঠিমার ডাক পড়লে। কেননা তখন আমার নিষেধভঙ্গের সময় আরম্ভ হয়ে গেছে। দিদিরা আমার দেখা পেলেই বলতেন, ‘তোর বিষয়ে অনেক কথা কানে আসছে’। বড়ো জেঠিমাও বার-বার বলতেন, ‘কুপথে যেওনি বাপু।’
পাটনা মিউজিয়ামে কিপার অব পেইনটিংস অ্যান্ড স্কাল্পচারের চাকরি থেকে বড় জ্যাঠা অবসর নেবার পর দিদিদের বাড়িতে ওনার পরিচিতজনদের ডেকেছিলেন সত্যনারায়ণ পুজোর সান্ধ্যবাসরে। গিয়ে দেখি হলঘরের কার্পেটে বসে গান গাইছে বড়ো ভাগ্নি মঞ্জুশ্রী, ছোড়দি সেতার বাজাচ্ছেন, হারমোনিয়ামে বড়দি, আর তবলায় সঙ্গত দিচ্ছিন বৃদ্ধ পন্ডিত বুলাকিলাল। ইজিচেয়ারে চোখ বুজে গান শোনায় বিভোর বড়ো জ্যাঠা। বড়ো জ্যাঠাইমা দেয়ালে ঠেসান দিয়ে হাতজোড় করে বসে আছেন। গানটা এই, গীতবিতান পূজা পর্যায় থেকে, এখন সর্বত্র গেয়, ব্রহ্মসঙ্গীত:
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো
সুন্দর করো হে ।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
নির্ভয় করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত্ত নিস্পন্দিত করো হে,
নন্দিত করো, নন্দিত করো,
নন্দিত করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
বাড়ির সবার অজান্তে রবীন্দ্রনাথ, রবিবাবু থেকে রবিঠাকুর হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে পৌঁছে আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে গিয়েছিলেন। ভারতীয় সংবিধান লাগু হবার পর, পাটনার সমাজেও ক্ষমতা-নকশায় রদবদল ঘটছিল; বাঙালিদের মধ্যেও। পাটনার বাঙালি সমাজের কেন্দ্র থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন ব্রাহ্মরা; অনেকে কলকাতা আর শান্তিনিকেতনে বাসা বাঁধতে চলে যাচ্ছিলেন। পাটনার ব্রাহ্মমন্দিরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মেয়েদের স্কুল এবং সে জায়গায় গড়ে উঠেছে মার্কেট কমপ্লেক্স। বিধানচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত তাঁর বাবা-মায়ের নামাঙ্কিত হাতের-কাজ শেখার সংস্হা ‘অঘোর-কামিনী বিদ্যালয়’ ছাত্রী ও অর্থের অভাবে ধুঁকতে আরম্ভ করেছিল। ইতিমধ্যে, কেবল আমাদের বাড়িতেই নয়, ব্রহ্মসঙ্গীত বাঙালি সমাজের ওপরতলা থেকে চুয়ে গরিব বাঙালিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
রামকৃষ্ণ মঠের প্রভাবে, স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত ছাড়াও, মীরাবাঈ, গুরু নানক ও কবিরের ভজন আর বেদ-উপনিষদ থেকে বিভিন্ন স্তোত্রও ব্রহ্মসঙ্গীত হিসেবে গাওয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল পাটনায় । পাটনার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোয়, বড়ো জ্যাঠা-জেঠিমার প্রজন্মের কাছে, খ্যাতনামা ‘বেমমো’দের সংবাদ পৌঁছোতে আরম্ভ করেছিল, যেমন জগদীশচন্দ্র বসু, সরোজিনী নাইডু, সুচেতা কৃপলানি, অরুণা আসফ আলি, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ। আমার ও আমার নিকটতম বন্ধু সুবর্ণ উপাধ্যায়, বারীন্দ্রনাথ গুপ্ত ও তরুণ সুরের কাছে, আমাদের বাড়ির বহুবিধ নিষেধভঙ্গ ও সীমালঙ্ঘনের নানা কাজকারবারের মধ্যে ছিল রেকর্ড-প্লেয়ারে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা। দরিয়াপুরের বাড়িতে বা বারীনের বাড়িতে সবাই একত্রিত হয়ে শুনতুম আমরা। বারীন ভালো গাইতেও পারতো। নিজের বিয়েতে বাসর ঘরেও রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিল বারীন।
দেবব্রত বিশ্বাসের ওপর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার নিষেধাজ্ঞা শুনে, সুবর্ণ উপাধ্যায় ( বৈদিক ব্রাহ্মণ ) বলেছিল, “বামুনরা ‘বেমমো’দের গানকে অশ্রাব্য করে রেখেছে, তা বোধহয় টের পেয়ে শান্তিনিকেতনের কত্তারা উঁচুজাতগিরি ফলাচ্ছে।” সুবর্ণ, ‘অন্তরমম বিকশিত করো’ গানে ‘চরণপদ্ম’ শব্দ সম্পর্কে বলত, “নিরাকারের যদি চরণপদ্ম হয়, তাহলে পুরো শরীরটা থাকতে ক্ষতি কি?” বলাবাহুল্য, ওর বাবা, মা আর বড়দা আমাদের বাড়ির বয়স্কদের চেয়ে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ছিলেন। আমাদের প্রজন্মে শার্ট-ফুলপ্যান্ট পরা শুরু হয়ে গেলেও, ওদের বাড়িতে তখনও পর্যন্ত অনুমোদন পায়নি।
পাণিহাটিতেও, একান্নবর্তী পরিবার যখন ভেঙে গেল, মামারা সবাই একে-একে আলাদা হয়ে গেলেন, মাসিদের বিয়ে হয়ে গেল, দাদুদের প্রজন্মের তিরোধানের পর, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন । দালানে রাখা সারিয়ে-তোলা বাক্স রেডিওতে, আর তার ওপরে বসানো কলের গানে, ওই অট্টালিকায় প্রবেশের সুরেলা ঘোষণা করতেন রবীন্দ্রনাথ, প্রধানত পঙ্কজ মল্লিকের বা শান্তিদেব ঘোষের কন্ঠে। রবিবাবুর গান ততদিনে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে গেছে।
গত কয়েক দশকে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকেরা, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, আমায় অনুরোধ করেছেন একটা গদ্য লিখে দিতে। আমার পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা অসম্ভব। আমার রবীন্দ্রনাথ-পাঠ, তাঁর গান শুনে উপলব্ধি করা, নৃত্যনাট্য দেখে হৃদয়ঙ্গম করা, তাঁর আঁকা ছবি দেখে নির্ণয়ে পোঁছানো, কলকাতার মেট্রো রেলযাত্রীদের রবীন্দ্রসদন স্টেশনে নামার অভিজ্ঞতার মতন সীমিত। তবে, দাদা সমীর রায়চৌধুরী যখন পোস্টমডার্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটা কবিতা লিখতে বলেছিলেন, তখন ‘কী বিষয় কী বিষয়‘ শিরোনামে এই কবিতাটা লিখেছিলুম:
আররে রবীন্দ্রনাথ
তোমার সঙ্গেই তো নেচেছিলুম সেদিন
আঙুলের ইতিহাসে একতারার হাফবাউল ড়িংড়াং তুলে
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের জমঘট থেকে সদর স্ট্রিটের লবঙ্গবাজারে
যেতে-যেতে তুমি বললে, আমাগো শিলাইদহ থিকা আসতাসি
আলুমুদ্দিন দপতর যামু
আগুন আর জলের তৈরি তোমার ঠোঁটে
তখনও এক চিলতে ব্রহ্মসঙ্গীত লেগেছিল কী গরম কী গরম
গ্যাবার্ডিনের আলখাল্লা ফেলে দিলে ছুঁড়ে
দেখলুম তোমার ফর্সা গায়ে জোঁক ধরেছে
বড়ো জোঁক বর্ষার জোড়াসাঁকোয়
সেলিমের দোকানে শিককাবাবের গন্ধে
নেড়েগুলা কী রান্ধতাসে ? জানতে চাইলে
ও বললে, না বুঝলুঁ ? ষাঁড়কে ছালন ছে !
আহাঁ দেখুঁ না চখকে
চায়ের ঠেকে টাকমাথা চুটকি-দাড়ি
ভ্লাদিমির ইলিচ আর সোনালিচুল ভেরা ইভানোভা জাসুলিচ
আর তোমার মতন রুপোলি দাড়িতে অ্যাক্সেলরদ আর মারতভ
যার গাল আপনা-আপনি কাঁপছিল দেখে তুমি বললে
উয়াদের ধড়গুলা কুথায় ?
আমি আমার নাচ
থামাতে পারছিলুম না বলে তুমি নিজের একতারাটা দিতে চাইলে
কেননা তোমার পা থেকে নাচ যে পেরেছে খূলে নিয়ে গেছে
আর এখন তো দিনের বেলাও লাইটপোস্টে হ্যালোজেন জ্বলে
কী আনন্দ কী আনন্দ
সদর স্ট্রিটের বারান্দায়
তোমার তিন ঠেঙে চেয়ারখানা পড়ে আছে
হুড়োহুড়ি প্রেম করতে গিয়ে পায়া ভেঙে ফেলেছিলে
তারিখ-সন লেখা আছে জীবনস্মৃতিতে
কী ভালোবাসা কী ভালোবাসা
তোমার ফিটনগাড়ির ঘোড়া তো
কোকিলের মতন ডাকছে দাদু রবীন্দ্রনাথ
আর তোমার বীর্যের রেলিক্স থেকে কতজন যে পয়দা হয়েছিল
মাটি থেকে ছোলা ভাজা তুলে খাচ্ছে
ওগুলা কী ? আমি বললুম, কাক ।
ওগুলারে কী কয় ? আমি বললুম, সেলিমকেই জিগেস করো
ও এই অঞ্চলে তোলা আদায় করে।
কী ঐশ্বর্য কী ঐশ্বর্য
_________________XXXXXXXXXX________________
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।