'হাওয়া-৪৯' পত্রিকার সম্পাদক দাদা সমীর রায়চৌধুরী
দাদা সমীর রায়চৌধুরী ২২শে জুন ২০১৬ তারিখে মারা গেলেন।
সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ছিল দাদার। বাঙালি বন্ধুরা মিলে বড়দির শশুরবাড়ির জমিদারির বিশাল হলঘরে নাটকের অভিনয়, কবিতার আবৃত্তি ইত্যাদি অনুষ্ঠান করতো। দাদার আগে আমাদের বাড়িতে কেউ স্কুল-কলেজে যাননি। ঠাকুর্দা যখন মারা যান তখন বাবা আর জেঠা-কাকারা কৈশোরে, তখন থেকেই জীবিকার জন্য লড়তে হয়েছে ওনাদের। স্কুলের শিক্ষা না থাকায় কোনো ভাইই চাকরি পাচ্ছিলেন না। বাবা ফোটোর দোকান খোলেন, ঠাকুর্দার কাছে যেটুকু ফোটোগ্রাফি আর ছবি আঁকা শিখেছিলেন সেই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে। বড়োজেঠা পাটনার মিউজিয়ামে পেইনটিঙ আর মূর্তি ঝাড়পোঁছের কাজ পেয়েছিলেন। কুড়িজনের সংসারকে এনারা দুজনেই টানতেন। ঠাকুমা আর বউদের গয়না বেচে অন্ত্যজ অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ায় বাড়ি কেনেন বড়জেঠা। ১৯৫০ সালে কলেজে যাবার আগে পর্যন্ত দাদা ইমলিতলার বাড়িতেই থেকেছে। পরে দরিয়াপুরে বাবা বাড়ি তৈরি করলে আমরা সেখানে চলে যাই।
দাদার জন্ম মায়ের মামা, অনাদিনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি, পাণিহাটিতে, উত্তর চব্বিশ পরগণায়, ১৭ই আগস্ট, কিন্তু স্কুলে ভর্তির সময়ে জন্মতারিখে বদল হয়ে গিয়েছিল, ১লা নভেম্বর ১৯৩৩ সাল, তার কারণ যে বছর দাদাকে মহাকালী পাঠশালায় ভর্তি করা হল, সেই বছর, পুরুতমশায় সতীশ ঘোষালের মতানুসারে শুভ দিন ছিল না, তাই একটি শুভদিন দেখে দাদার জন্মদিন নির্ধারিত হল। মহাকালী পাঠশালার পড়া শেষ করলে দাদাকে ভর্তি করা হয় পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে, ক্লাস ফোরে ; বাড়ি থেকে আধকিলোমিটার দূরত্বে বলে দাদা হেঁটেই যাতায়াত করতো।
পাণিহাটিতে দাদার নাম রাখা হয়েছিল বাসুদেব, মা দাদাকে বাসু বলে ডাকতেন। দাদার জন্ম মীনরাশিতে বলে জাঠতুতো দিদিরা দাদাকে মিনু বলে আদর করতেন। ইমলিতলার বাড়িতে আর পাড়ায় দাদার ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল মিনু। সমীর নামকরণ হয়েছিল জন্মছকের কারণে। আমার জন্মছকে ‘ম’ অক্ষর উঠেছিল বলে মিলিয়ে রাখা হয় মলয়। জাঠতুতো দিদিরা বড়োজেঠিমাকে মা বলে ডাকতেন বলে দাদাও ওনাকে মা বলে ডাকতো আর দিদিদের দেখাদেখি মাকে ‘কাইয়া’ বলে ডাকতো।
বাবা দাদাকে একটা ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন, দাদা পাড়ার সমবয়সীদের নিয়ে ফুটবল দল গড়েছিল, খেলতে যেতো মাঠে, দাদার জুতো দিয়ে একদিকের গোলপোস্ট হতো, আর অন্য দিকেরটা দাদার খোঁড়া বন্ধু বিরজুর জুতো দিয়ে। দাদা যদি পরে ফিরতে ভুলে যেতো, তাহলে আগামী পুজো পর্যন্ত খালি পায়েই স্কুলে যেতো, কেননা বাড়িতে সবায়ের জন্য বছরে ওই একবারই জুতো কেনা হতো।
মা রান্নাঘরের ইনচার্জ ছিলেন বলে কয়লা ভাঙার আর উনোনের জন্য প্যাকিং বাক্সের টুকরো করার কাজ ছিল দাদার, অনেক সময়ে উনোনও ধরিয়ে দিতো দাদা।
আমাদের বাড়ির কাছে গোলা রোড দিয়ে শব নিয়ে যেতো শববাহকরা, ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ বলতে-বলতে। শববাহকের আত্মীয় খইয়ের সঙ্গে তামার পয়সা ছুঁড়তো। ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ শুনতে পেলেই দাদা বলত, চল চল, পয়সা কুড়োবো। দাদার দেখাদেখি আমি আর মেজদা দুজনে ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ ধ্বনি দিয়ে পয়সা কুড়োতুম। যদি ছয় আনা জমে যেতো তাহলে দাদা সিনেমা দেখতে যেতো। কলকাতায় কলেজে পড়তে গিয়ে দাদার সিনেমা দেখার অভ্যাস ছেড়ে গিয়েছিল।
ইমলিতলার বাড়িতে বাবা-মা আগেই উঠে যেতেন বলে দাদাকে বিছানা গোটাতে হতো, মশারি খুলতে হতো, পরে আমরা দুজনে কাজটা করতুম। পড়ার টেবিল বলতে দাদার ছিল বাবার দোকান থেকে আনা বড়ো মাপের একটা প্যাকিং বাক্স, যার ওপর মায়ের পুরোনো-ছেঁড়া শাড়ি পাতা, দাদার বইপত্র বাক্সের ভেতরে আর বাক্সের সামনে মেঝেতে বসে পড়ত দাদা। রাতে লন্ঠনের আলোয়। লন্ঠনের ভুষো দাদাকেই পরিষ্কার করতে হতো।
ইমলিতলা পাড়ায় থাকলে কুসঙ্গে পড়ে খারাপ হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করে বাবা-মা দাদাকে পাঠিয়ে দেন মায়ের মামার বাড়ি পানিহাটিতে। মায়ের বড়োমামা অনাদিনাথ চট্টোপাধ্যায় দাদাকে সিটি কলেজে আই এস সি পড়ার জন্য ভর্তি করে দ্যান : অনাদিনাথের ছোটো ভাইয়ের শালা সিটি কলেজে অধ্যাপক ছিলেন, তিনি দাদার ওপর নজর রাখতে পারবেন এই ধারণায়।
পাণিহাটিতে ছোটোমামা বিভাস চট্টোপাধ্যায় কলেজে পড়ার সময়ে ছিলেন মার্কসবাদী, প্রচুর বই ছিল মার্কসবাদ সম্পর্কে, দাদাকে বামপন্হী চিন্তায় প্রভাবিত করতে সফল হন, পরে ছোটোমামা বামপন্হীদের কাজকারবার দেখে চটে গিয়ে গালমন্দ করতেন। মামার বাড়ির বৈঠকখানায় বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের ভালো সংগ্রহ ছিল, বৈঠকখানায় উনিশ ও প্রথম দিকের বিশ শতকের মনীষীদের ছবি টাঙানো ছিল। দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন রোনাল্ড রস-এর সহগবেষক, অন্য দাদুরা ছিলেন ইরেজিতে স্নাতকোত্তর। মামার বাড়ির লাইব্রেরির বইগুলো দাদাকে উনিশ শতকের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করাতে পেরেছিল।
মামারবাড়ির তুলনায় পাটনায় আমাদের বাড়ির কেউই, দাদার আগে, স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোননি।
অনাদিনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কড়া অনুশাসনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিল না দাদা। পাণিহাটি থেকে প্রতিদিন প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যাতায়াতও গোলমেলে ছিল, কেননা ট্রেনগুলো সময়ে চলাচল করতো না। দাদা চলে গেল উত্তরপাড়ার বসতবাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে বারোঘর-চারসিঁড়ির বিশাল খণ্ডহরে থাকতে ; এখন ভেঙে আবাসন হয়েছে। তিনতলায় চিলেকোঠার ঘরটা দাদা নিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবার সুবিধার জন্য, ঠাকুমাকে এড়িয়ে সিগারেট ফোঁকার জন্য। কলকাতা থেকে না ফিরলে ঠাকুমা ততো চিন্তা করতেন না যতোটা অনাদিনাথ চট্টোপাধ্যায় করতেন। কলকাতা থেকে ফিরতে না পারলে দাদা পিসেমশায়ের আহিরিটোলার বাড়িতে কিংবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে রাতটা থেকে যেত।
উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে দাদা আর অমিতাভ মৈত্র দুজনে “লেখা” নামে একটা পত্রিকা আরম্ভ করেছিল। সিটি কলেজের দেয়াল পত্রিকায় একজন ছাত্রের কবিতা পড়ে ভালো লাগায় দাদা আর্টস বিভাগের ছাত্রটির সঙ্গে আলাপ করে, ছাত্রটির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ক্রমে দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচী, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, শিবশম্ভু পাল, শংকর চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায় প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় হয়। দীপক মজুমদারের অনুরোধে দাদা ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় লেখা আরম্ভ করেছিল। সেই সময়ে যে-ধরণের কবিতা লেখা হতো তেমনই লেখার প্রয়াস ছিল। দাদার ‘কৃত্তিবাস’ পর্বের একটা কবিতা দিলুম এখানে :
হণির ভিতর দিয়ে দেখা যায়
জাহান্নমে যাক গ্রহনক্ষত্রসমূহ ভেঙে পৃথিবীও যাক জাহান্নমে
লাথি মেরে সব ভেঙে চুরমার করে দিলে কাল আমি সহাস্যবদনে
হাততালি দিয়ে মঞ্চে কোনোরূপ গ্লানিহীন নুরেমবার্গের আদালতে
তুড়ি মেরে কাঠগড়া মুঠোয় গুঁড়িয়ে তোমাদেরও পারতাম ভেল্কি সবিস্তারে।
সৌরমণ্ডলের পথে তছনছ পৃথিবীর অন্ধকার ফেরি আবর্তন
কোনোরূপ রেখাপাত সম্ভব ছিল না গ্রন্হে হৃদয়ে মেধায়
আমার শরীর ঘিরে ইহুদির হিন্দু শিখ মুসলিমের আততায়ী আদর্শের ঘৃণ্য রক্তপাত
আমাকেও জয়োল্লাস দিয়েছিল মূত্রপাতে পোষা রাজনীতি।
তোমাদের আস্ফালনে বিনয়ী মুখোশ ঘিরে আমার হনির জন্মদিন
আমারই মুখোশ ধরে টান মেরে ছিঁড়ে ফ্যালে আর্ত চিৎকারে--
ধান উৎপন্ন হওয়ার গন্ধ এখন পেয়েছি শুঁকে কৃষকের উর্বর শরীরে
কুমারী মহিলাদের উজ্জ্বল মসৃণ দেহে বহুবার হাত রেখে উত্তরনিশীথে
পরাগ চমকে উঠে স্পর্শ করে নারীর সমগ্র দেহ জুড়ে
আশ্রয় ছড়ানো আছে প্রীত এক ধরণের মিহি রুখু বালি।
ক্রমে সেই সমস্তই নাভির ভিতরে আনে রুদ্ধ আলোড়ন,
জেগে ওঠে মৃগনাভি, চেয়ারে টেবিলে গ্রন্হে অম্লান মাঠের ভিতরে
ধু-ধু রিক্ত প্রান্তরের দিকে শাবক প্রসব করে রঙিন প্রপাত,
চারিদিক ফলপ্রসূ হয়ে গেছে রাশি-রাশি প্রতিহারী ধান--
মনে হয় বহুক্ষণ মাঠে-মাঠে গড়াগড়ি দিয়ে বিছানায় উঠে আসে নারী
ক্ষুধার্ত শিকড়গুলি ঢেকে যায় নীড় আস্বাদনে ;
তখনই উৎপন্ন হওয়ার গন্ধ জাগে, কৃষকের উর্বর শরীরে
প্লুত আবছা আঁধারে তাই বারংবার মনে হয় পৃথিবীর সহজ সুদিন
ফিরে এলো সুধাশান্তি
আমার হনির জন্য তোমাদের কাছে আমি ঋণী চিরদিন।
বি এস সি পাশ করার পর দাদা বাবার ডাকে পাটনা ফিরল। বাবার দোকানে ওনার পরিচিত যাঁরা আসতেন তার মধ্যে ছিলেন বিহার ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি ; তাঁর সহৃদয়তায় দাদা বিহার সরকারে ফিশারিজ ইন্সপেক্টরের চাকরি পেয়ে গেল। পরে পদোন্নতি হয়ে ডায়রেক্টর অফ ফিশারিজ হয়েছিল।
মাইনে পেয়ে দাদা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “একা এবং কয়েকজন” কাব্যগ্রন্হটি নিজে প্রকাশ করে, ‘সাহিত্য প্রকাশক’ নামে একটা প্রকাশন সংস্হা খুলে। দাদার “ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি” এবং “আমার ভিয়েৎনাম” কাব্যগ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছিল কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে। পরের কাব্যগ্রন্হ “জানোয়ার” প্রকাশিত হয়েছিল হাংরি প্রকাশনী থেকে। এর পর দাদার বইপত্র প্রকাশিত হয় নব্বুই দশকের শুরুতে অবসর নিয়ে কলকাতায় ফিরলে।
১৯৬০ সাল থেকে আমি আর দাদা একটা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলুম, যা অলস অকেজো ঘুমন্ত ব্যবস্হাটাকে নড়িয়ে দিতে পারবে। স্পেংলারের ‘ডিক্লাইন অফ দি ওয়েস্ট’ বইটা পড়িয়েছিলুম দাদাকে। উত্তরঔপনিবেশিক বাংলার সেই সময়ের অবস্হায় স্পেংলারের বক্তব্য দাদার মনে হয়েছিল যুৎসই। চসারের কবিতা থেকে ‘সাওয়ার হাংরি টাইম’-এর হাংরি টাইম বাক্যবন্ধও পছন্দ হয়েছিল দাদার। হাংরি আন্দোলনের পরিকল্পনা দাদা নিজের বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আর আমি আমার বন্ধু দেবী রায়ের সঙ্গে আলোচনা করে প্রথম দিকে পাটনা থেকে বুলেটিন ছাপিয়ে আরম্ভ করেছিলুম। হাংরি পর্বে দাদার কবিতায় বাঁকবদল এলো। হাংরি পর্বে দাদার লেখা একটা কবিতা এখানে দিলুম :
পালামৌ - ১৯৬৬
পাঁচ হাজার কেঁচোর সঙ্গে মাটি খুঁড়ে ভেবেছিলাম
ঘুম ভেঙে উঠে দেখব সবুজ বিশাল ভারতবর্ষ
হঠাৎ সঞ্জীবচন্দ্র ডেকে উঠবে সমীর পালামৌ সমীর
অথচ ভোটবাক্স নিয়ে আমি খুঁজে বেড়ালাম ভারতবর্ষের ভালোবাসা
আমার গোপন তকমার লোভে কৃষকের লাঙল থেকে খুঁটে তুললাম প্রভূত ন্যাপথালিন
কেননা পৃথিবীর সবচেয়ে নগ্ন আর মজবুত স্ত্রীলোকের নাম ভিয়েৎনাম
এখন স্রেফ পাঁচ বস্তা চাল কিনে রেখে আমি দুর্ভিক্ষের দায়দায়িত্ব সেরে নিচ্ছি
কয়েকটা ব্যাপারে কেবল মহিলার আধিপত্য সহ্য হচ্ছে না
আত্তিলার রক্তেও ছিল না একশো ভাগ নিরেট পৌরুষ
বুঝতে পারছি না কেন আমার গর্ভধারণের ইচ্ছে হয়
কেন আমার মসৃণ বুকে হাত রেখে মাঝরাতে হঠাৎ ককিয়ে উঠেছি
আমারই যৌনতার মধ্যে খুঁজে দেখছি নিজস্ব গোলাবাড়ি একান্ত বীজধান
আমারই বীর্য থেকে স্রেফ আমারই শরীরে প্রসব চেয়েছি আমি
অথচ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অভাবে মহিলাকে দিয়ে এলাম প্রেম আর কোকাকোলা
ঠিক এই কারণেই কোথায় কতখানি সমীর পরখ করতে
এক মহিলা থেকে ঘুরে বেড়ালাম অন্য শরীরের আনাচে-কানাচে
আমার বাঁ-চোখ থেকে খুঁটে তুললাম তিনশো জোনাকির হঠাৎ জ্বলে ওঠা
গোলাপের চতুর্দিকে নিয়ন্ত্রিত কীটের উদ্বেগ অভিযান লক্ষ্য করে
আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার বিবেকের তরপেট
নিজের তৈরি বাস্তবিকতার সঙ্গে পৃথিবীর বাস্তব৮ইকতা মিলিয়ে দেখতে গিয়ে
আমি টের পেলাম আমার ব্যক্তিগত ছাপাখানা
কেননা প্রত্যেকবার একটা চৌরাস্তার কাছ-বরাবর এসে আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাচ্ছি
বাম আর দক্ষিণ কম্যুনিস্টের খেল কসরৎ দেখতে মার্কসের জরায়ু থেকে
বের করে আনছি তিন লক্ষ সমীরকে
ভোরে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে কামরাজ পাতিল যেমন চোখে পড়ামাত্র
আমার মুখ তেতো হয়ে উঠছে
স্বপ্নের প্রথম শর্ত
মনে করো জেগে আছো তুমি
শব্দ আর শব্দ বিনিময়ে কবিতার ধর্ম হয়ে ওঠে
শপথের চেয়ে ঘৃণ্য কোনো পাপ নেই
প্রতিটি গলির মোড়ে অন্য এক প্রতিজ্ঞায় রুখে
এখন সাপের খেলা
ভ্রূ-আঁকা পেন্সিলে আমি মহিলার চোখের পাতায় লিখছি অশ্লীলতা, নার্সারি রাইম…
চাইবাসার মধুটোলার সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মেজ মেয়ে ডলির সঙ্গে দাদার ভাগলপুরের বন্ধু বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিয়ে উপলক্ষে মধুটোলার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দাদার পরিচয় হল। চাইবাসার পাহাড়টিলার ওপরে নিমডির চালাঘরে একা থাকতে ভালো লাগত না বলে দাদা কলকাতা থেকে চাকুরিহীন বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে নিয়ে যায়। শক্তি চাইবাসায় ছিলেন আড়াই বছর। শক্তি চট্টোপাধ্যায় মধুটোলার বাড়ির একটি মেয়ের প্রেমে পড়েন, এবং দাদা ট্যুরে গেলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে তাঁদের বাড়িতে অতিথি হিসাবে রেখে যেত। ১৯৬০ সালে দাদা এই বাড়ির সেজ মেয়ে বেলাকে বিয়ে কর। কবি শান্তি লাহিড়ি বিয়ে করেন সবচেয়ে ছোটো বোন খুকুকে।
হাংরি আন্দোলন মামলায় দাদাও গ্রেপ্তার হয়েছিল। চাইবাসার মতন ছোটো শহরে ঘটনাটা বেশ অপমানজনক ছিল, যদিও জেলার ম্যাজিস্ট্রেট দাদার সাহিত্যপ্রীতির কথা জানত বলে হ্যাঙ্গাম পোয়াতে হয়নি, কিন্তু এই সূত্রে বন্ধুদের আচরণে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়েছিল। সেই সঙ্গে সুভাষ-শৈলেশ্বর ঘোষ প্রমুখ যারা রাজসাক্ষী হয়েছিল তারা হাংরি আন্দোলন কেবল উদ্বাস্তুদের আন্দোলন ধুয়ো তুলে অনেককে বাদ দিয়ে ‘ক্ষুধার্ত’ নামে পত্রিকা প্রকাশ আরম্ভ করেছিল। আমার এবং আরও কয়েকজনের মতন দাদাও বিরক্ত হয়ে লেখা ছেড়ে দিয়েছিল বহুকাল।
চাকুরিসূত্রে বিহারের প্রায় প্রতিটি জেলা সদরে দাদার পোস্টিঙ হয়েছে এবং বিহারি ও উপজাতি মাঝি-মাল্লা-জেলে-জালবুনিয়ে তাঁতি-নৌকোর ছুতোরদের জীবন দেখেছেন অনেক কাছ থেকে, তাঁর কাজই ছিল নিম্নবর্গের এই মানুষদের উন্নয়ন, বিহারের গোলমেলে জাতিপ্রথানির্ভর রাজনীতি সত্ত্বেও। ১৯৭১ সালে ভায়রাভাই শান্তি লাহিড়ির পরামর্শে, বাঁশদ্রোণী অঞ্চলে ষোলো কাঠা জমি কিনে বাড়ি তৈরি করায়, যে বাড়িতে পুরো বারান্দার মাপের মশারি তৈরি করিয়ে, তার ভেতরে চেয়ার-টেবিল পেতে, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ‘দারা শিকো’ লিখেছিলেন।
নব্বুই দশকের শুরুতে দাদা যখন কলকাতায় ফিরল তখন পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করেছিল, “হাওয়া৪৯” নামে একটা দার্শনিক-সাহিত্যিক পত্রিকা প্রকাশ করতে চলেছে জানিয়ে, কিন্তু কেউই আগ্রহ দেখাননি, এমনকি যাঁরা দাদার পোস্টিঙের জায়গায় প্রায়ই সস্ত্রীক বেড়াতে যেতেন, তাঁরাও নয়। সম্ভবত নতুন যে ‘অধুনান্তিক’ দার্শনিক-সাহিত্যিক ভাবনা নিয়ে জগতজুড়ে তর্কাতর্কি চলছে, তাঁরা সেবিষয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন না। একদিক থেকে ভালোই হল ; দাদা তরুণ আর অতিতরুণদের সঙ্গ-সাহচর্য পেল, যারা নতুন ভাবনা ভাবছিল। “হাওয়া৪৯” পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যাই বিতর্ক গড়ে তুলতে সফল হয়েছে। অধুনান্তিক পর্বের একটা কবিতা এখানে তুলে দিচ্ছি :
নিজস্ব রোদের জন্য
নতুন বাড়িটাতে যেদিন প্রথম বিকেলের রোদ এসে
জীবনের খোঁজ নিয়েছিল সেদিন থেকেই এবাড়ির নিজস্ব রোদ
নিজস্ব হাওয়া বাতাস নিজস্ব মেঘলার জন্ম
সবকিছু যা একান্তই এবাড়ির
যেভাবে কিছু রোদ কিছু বৃষ্টি নিয়ে বেঁচে থাকা সংসার পাতে
যেভাবে স্হানিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় মহাভাষ্য থেকে
যেভাবে ব্যক্তিগত রোদের কাতরতা নিয়ে একসময়
পশ্চিমের বারান্দার অতসীলতাকে বাঁক নিতে দেখেছিলাম---
দেখেছিলাম রোদের জন্য ঠাকুমার হাপিত্যেশ
এখনও মনে পড়ে যায় দ্বারভাঙায় আমাদের ডাইনিং টেবিলে
চা পানের সঙ্গী এক চিলতে রোদ্দুর
স্কুলের ছুটির ঘণ্টার সঙ্গে চলে যাওয়া রোদের অন্য এক সম্পর্ক ছিল
যেমন কিছু কিছু ছায়ার সঙ্গে আমাদের নিভৃতের যোগাযোগ
যেভাবে কিছু রোদ কিছু ছায়া ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে জমা পড়ে
যেভাবে স্হানিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতধে চায় মহাভাষ্য থেকে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।