আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগটির এক বিশেষ স্থান আছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই বিষয়ে পশ্চিম ইউরোপের বাইরে পৃথিবীর আর কোথাও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই স্তরের নক্ষত্রসমাবেশ ঘটেনি। এই নক্ষত্রদের নাম আমরা সকলেই জানি, তাঁদের কাজ সম্বন্ধেও কিছু ধারণা আছে। মেঘনাদ সাহা এখানে বসেই তাঁর বিখ্যাত তাপ আয়নন সমীকরণটি আবিষ্কার করেছিলেন। সি. ভি. রামন ষোল বছর এই বিভাগে অধ্যাপনা ও গবেষণা করেছেন; যখন তিনি নোবেল পুরস্কার পান, তখন তিনি এই বিভাগেরই বিভাগীয় প্রধান। সত্যেন্দ্রনাথ বসুও দু-দফায় দীর্ঘদিন এই বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া দেবেন্দ্রমোহন বসু বা শিশিরকুমার মিত্র তাঁদের গবেষণা দিয়ে বিভাগটিকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। এঁদের একত্রে বিভাগের পঞ্চপাণ্ডব বললে অত্যুক্তি হয় না।
এঁদের পাশেই এক বিস্মৃত চরিত্র হয়ে থেকে গেছেন বিভাগের প্রথম যুগের অন্যতম গবেষক ও অধ্যাপক বিধুভূষণ রায়। তাঁকে এখন কেউ মনে রাখেনি। পাদপ্রদীপের আলো তাঁর ওপরে পড়েনি, পদার্থবিদ্যা বিভাগের ইতিহাসে তিনি বরাবরই পঞ্চপাণ্ডবের ছায়ায় ঢাকা। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন ক্লাসঘরে বিধুভূষণের একখানা পোর্ট্রেট টাঙানো থাকতো, এখন সেই চিহ্নটুকুও নেই, হয়তো কোথাও ধুলোমাখা অবস্থায় অনাদৃতভাবে সেই তৈলচিত্রটি পড়ে আছে। উইকিপিডিয়ায় বিধুভূষণের সম্বন্ধে যে পাতাটি আছে, তাতে অবশ্য মাঝবয়সী মানুষটির সেই তৈলচিত্রের একটি ছবি পাওয়া যায়। বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে সম্প্রতি জার্মানির ওল্ডেনবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজিন্দার সিং তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন, বহু ভারতীয় বিজ্ঞানীকে নিয়ে তিনি বই লিখেছেন, বিধুভূষণকে নিয়ে লেখা বইটিও তার মধ্যে আছে। কিন্তু এই অন্ধকার একেবারেই বিধুভূষণের প্রাপ্য নয়। তাঁর গবেষণাজীবন যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিল, এবং এ দেশে এক্স-রশ্মি বর্ণালীবীক্ষণের চর্চা তাঁর হাতেই শুরু হয়েছিল। ১৯৪৪ সালে মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁর অকালপ্রয়াণ হয়, সেই সময়ে তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগের খয়রা অধ্যাপক ছিলেন, এবং এক্স-রশ্মি বর্ণালীবীক্ষণ বিষয়ে ভারতের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
আর এগোবার আগে এক্স-রশ্মি বর্ণালীবীক্ষণ নিয়ে দু-চার কথা বলে নিই। বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা কলেজের ল্যাবরেটরিতে বর্ণালীবীক্ষণ বা স্পেকট্রোমিটার যন্ত্র হয়তো দেখেছেন। কোনো গ্যাসের অণু-পরমাণুর মধ্যে থাকা ইলেকট্রন যখন ওপরের শক্তিস্তর থেকে নিচের শক্তিস্তরে নেমে আসে, তখন আলো বেরিয়ে আসে। গ্যাসের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই সে আলো আমরা চোখে দেখতে পাই (সত্যি বলতে, আমাদের চোখ সেভাবেই গড়ে উঠেছে)। কখনো কখনো দেখার পাল্লার বাইরে, অবলোহিত বা অতিবেগুনি আলোও বেরোয়। এই আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে পরমাণুর গঠন সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। এ নিয়ে পৃথিবীতে বহু বিজ্ঞানী অসাধারণ সব কাজ করেছেন, কলকাতাতেই বসে করেছেন সি. ভি. রামন। বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র, বর্ণালী বিশ্লেষণ করে, তার মধ্যে ঠিক কী কী রঙের আলো আছে – তা আমাদের জানিয়ে দেয়। প্রত্যেক মৌলের নিজস্ব বর্ণালী আছে, একের সঙ্গে অন্যের মেলে না, অনেকটা মানুষের আঙুলের ছাপের মতো। কাজেই বর্ণালী বিশ্লেষণ করেই আমরা বলে দিতে পারি, সে আলো কোন মৌলিক পদার্থের থেকে এসেছে, সে যত দূরের তারার আলোই হোক না কেন।
কঠিন পদার্থের কেলাসে অণুগুলো খুব কাছাকাছি থাকে, মোটামুটি এক মিলিমিটারের এক কোটি ভাগের এক ভাগ দূরত্বে। দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এর থেকে অনেক বেশি, তাই সাধারণ আলো দিয়ে কেলাসের আণবিক গঠন দেখা সম্ভব নয়, এর জন্যে চাই আরো অনেক ছোটো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো, যেমন এক্স-রশ্মি। এক্স-রশ্মি তৈরি করা হয় কোনো ধাতুর সঙ্গে দ্রুতগতির ইলেকট্রন স্রোতের সংঘর্ষে, আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার বিপরীত পদ্ধতি বলা যায়। গ্যাসের বর্ণালীর মতো, এক্স-রশ্মির বর্ণালীতে কিছু লাইন দেখা যায়। এই লাইনগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কত, তা নির্ভর করে কোন ধাতু ব্যবহার করা হয়েছে, তার ওপরে। টাংস্টেন হলে এক রকম, নিকেল হলে আরেক রকম, তামা হলে আবার অন্য রকম। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে ধাতুর পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কতগুলো প্রোটন আছে, তার একটা সম্পর্ক থাকে, সেটা বের করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অকালপ্রয়াত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি মোজ়লে। এক্স-রশ্মি দিয়ে কীভাবে কেলাসের গঠন বোঝা যায়, তার নিয়ম আর পদ্ধতি বের করার জন্যে ১৯১৫ সালে পিতাপুত্র – উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ ও উইলিয়াম লরেন্স ব্র্যাগ নোবেল পান। লরেন্স ব্র্যাগ নোবেল পেয়েছিলেন পঁচিশ বছর বয়সে, তিরিশের আগে বিজ্ঞান সাহিত্য বা অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার আর কোনো নজির নেই।
এক্স-রশ্মি দিয়ে কেলাসের গঠন বের করার কাজ আমাদের দেশে রামনের গবেষণাগারেই প্রথম শুরু হয়। রামনের দুটি গবেষণাগার ছিল – একটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অন্যটি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ দা কালটিভেশন অফ সায়েন্সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রামনের পদের নাম ছিল স্যার তারকনাথ পালিত অধ্যাপক, সেই সূত্রে গবেষণাগারটির নাম পালিত ল্যাবরেটরি। কালটিভেশন তখনো যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়নি, বৌবাজারে একটি ভাড়াবাড়িতে তার অবস্থান। রামনের ছাত্ররা দু-জায়গাতেই কাজ করেছেন। বিধুভূষণের কাজের শুরু পালিত ল্যাবরেটরিতেই।
রামন যে আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার নাম রামন বিক্ষেপ। সেখানে, কোনো অণু থেকে আলোর বিক্ষেপের পর ফোটনের শক্তি পালটে যায়। রামন তখনই বলেছিলেন, যে, এক্স-রশ্মি দিয়েও এই বিক্ষেপ দেখতে পারা উচিত। ১৯২৮ সালে কৃষ্ণন বলেন, যে, তিনি এক্স-রশ্মি দিয়ে রামন বিক্ষেপ দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু খুব সম্ভবত তিনি যেটা দেখেছিলেন, সেটা কম্পটন বিক্ষেপ বলে আরেকরকম বিক্ষেপের অংশ, রামন বিক্ষেপ নয়। আরো অনেকেই দেখার চেষ্টা করেছেন, সফল হননি। তার একটা বড় কারণ, এক্স-রশ্মির ক্ষেত্রে এই দু-ধরনের বিক্ষেপ আলাদা করা সোজা নয়, অন্তত সে সময়ে যে সব যন্ত্রপাতি ছিল, তা দিয়ে। পরে আমরা দেখবো, বিধুভূষণও একই ভ্রান্তির শিকার হয়েছিলেন। পৃথিবীতে প্রথম সন্দেহাতীতভাবে এক্স-রশ্মি দিয়ে রামন বিক্ষেপ দেখার কৃতিত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গবেষক কমলাক্ষ দাশগুপ্তের। এই লেখার শেষে সে কথায় আসবো।
বিধুভূষণের কথায় ফিরে আসি। ১৮৯৪ সালের পয়লা জুলাই ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। বয়সের দিক থেকে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বা মেঘনাদের সমসাময়িক। পড়াশুনো করেছেন কটকের র্যাভেনশ কলেজে, তারপর প্রেসিডেন্সি থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাস করেন ১৯১৮ সালে। বিধুভূষণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন, বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের চাকরি প্রত্যাখ্যান করে আশুতোষের অনুপ্রেরণায় তিনি গবেষণাকেই জীবনের পথ বলে বেছে নেন।
১৯১৮ সালে রামনের গবেষণাগারে যোগ দেন বিধুভূষণ। প্রথমে পেতেন মাসিক ৫০ টাকা। কিন্তু তাঁর কাজে রামন এতই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, যে এক বছরের মধ্যেই রামনের সুপারিশের ফলে তাঁর মাসিক বেতন ১০০ টাকা হয়। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ হল, “অপটিকাল অ্যানালগ অফ হুইস্পারিং গ্যালারি”। হুইস্পারিং গ্যালারি কী, সেটা একটু বুঝিয়ে বলা যাক।
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্থপতি সার ক্রিস্টোফার রেনের হাতে তৈরি হয়েছিল লন্ডনের অন্যতম প্রতীক – নতুন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। পুরোনো ক্যাথিড্রালটি আগুনে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে নতুন ক্যাথিড্রালের কাজ শুরু হয়। ক্যাথিড্রালের মূল কক্ষটি উপবৃত্তাকার, মাথায় গম্বুজ। এখানে দেওয়ালের ধারে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বললে ঘরের অন্যপ্রান্তে শোনা যায়। শব্দতরঙ্গ দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে পৌঁছে যায় অন্য প্রান্তের দেওয়ালে, তাই এর নাম হুইস্পারিং গ্যালারি। কিন্তু হুইস্পারিং গ্যালারির উদাহরণ আমাদের দেশেই আছে, আর তার বয়েসও সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের চেয়ে কিছু বেশি। এটি বানিয়েছিলেন বিজাপুরের সুলতান মহম্মদ আদিল শাহ, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। স্থাপত্যটির নাম গোল গম্বুজ, আদিল শাহ এখানেই শায়িত আছেন। গোল গম্বুজের ভেতরেও দেওয়ালের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শব্দ প্রতিফলিত হয়, দেওয়াল অবতল আয়নার কাজ করে। আর হুইস্পারিং গ্যালারির সন্ধানে অতদূর যদি আপনার যেতে ইচ্ছে না করে, কলকাতা ময়দানে তুলনায় অনেক অর্বাচীন ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধটি তো আছেই।
বিধুভূষণ দেখতে চেয়েছিলেন, শব্দের ক্ষেত্রে যেরকম, আলোর ক্ষেত্রেও তা ঘটে কি না। তিনি দেখলেন, আলোর ক্ষেত্রেও প্রায় একই জিনিস ঘটছে। পরে রামন স্বয়ং এ বিষয়ে আরো অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। যে কারণে এই গবেষণাটি উল্লেখযোগ্য, তা হল, এখান থেকেই রামনের আলোকবিজ্ঞানে উৎসাহের শুরু। স্বনবিদ্যা থেকে তিনি আস্তে আস্তে আলোকবিজ্ঞানের দিকে সরে এলেন, তাঁর ছাত্ররাও এল। বিধুভূষণ রামনের গবেষণাগারে কাজ করেই ডি.এস.সি. পান, কোলয়েড দ্রবণের ওপর তাঁদের একটি কাজ ১৯২১ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির কার্যবিবরণীতে ছাপা হয়েছিল।
ডি.এস.সি. করার পর ১৯২৩ সালে বিধুভূষণ প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ গবেষক বৃত্তি পেলেন। তাছাড়াও পালিত ফান্ড থেকে বিদেশযাত্রার জন্যে বৃত্তি পেলেন, বার্ষিক ৫০০০ টাকা হিসেবে দু-বছরের জন্যে। বিধুভূষণ ঠিক করলেন, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ইউরোপ যাবেন। কিন্তু পালিত ট্রাস্টের নিয়মানুযায়ী তাঁকে দশ হাজার টাকার বন্ড দিতে হত। সাধারণ ঘরের একজন ছাত্রের পক্ষে সেটা প্রায় অসম্ভব, তাই বিধুভূষণ এই শর্তে রাজি হলেন, যে, ফিরে এসে তিনি অন্তত পাঁচ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবেন। আমরা এক্ষুনি দেখবো, যে এই শর্তটা বিধুভূষণের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।
রামন পরামর্শ দিয়েছিলেন নিলস বোরের কাছে যেতে। বিধুভূষণ বোরকে তাঁর প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধের কপি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে বোর আমেরিকায়; তিনি বিধুভূষণকে বললেন পরের বছর আসতে। বিধুভূষণ তাই প্রথমে গেলেন সুইডেনের উপসালায়, সেখানে এক বছর মানে সিগবানের সঙ্গে এক্স-রশ্মি বর্ণালীবীক্ষণ নিয়ে কাজ করলেন। ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ কাটালেন বোরের সঙ্গে, কোপেনহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ইন্সটিটিউট অফ থিওরেটিকাল ফিজিক্সে। এক্স-রশ্মি বিষয়ে বিধুভূষণের আগ্রহ ও গবেষণার শুরু উপসালা ও কোপেনহাগেনে।
১৯২৬ সালে বিধুভূষণ কলকাতায় ফিরলেন, সঙ্গে স্বয়ং বোরের জোরালো সুপারিশপত্র। বোর লিখেছেন, এক্স-রশ্মি বিষয়ে এই ভারতীয় তরুণটির পাণ্ডিত্যের কথা। একখানা নয়, বোর তিন তিনখানা চিঠি লিখেছিলেন, বিধুভুষণের প্রশংসা করে। ভাবলে অবাক হতে হয়, নিলস বোরের মতো বিজ্ঞানীর সুপারিশপত্র থাকা সত্ত্বেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধুভূষণ নিজের ল্যাবরেটরি বানাবার জায়গা পেলেন না। চেয়ার অধ্যাপক ছাড়া আর কারো নিজস্ব গবেষণাগার থাকতে পারে, এই ধারণাটাই তখন ছিল না। হয়তো এই সময় থেকেই রামনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। তাঁর স্বাস্থ্যও এই সময় থেকেই ভাঙতে শুরু করে।
পরের বছর বিধুভূষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডারের পদে মনোনীত হন। মাসিক বেতন ৬০০ টাকা, কলকাতায় পেতেন ৩৭৫। স্বভাবতই বিধুভূষণ চলে যেতে চাইলেন, কলকাতায় দু-বছর বিনা বেতনে ছুটি চাইলেন। কিন্তু সেই যে বিদেশ যাবার সময়ে বন্ড দিয়েছিলেন, তার ফলে কলকাতা ছাড়া আটকে গেল। ঢাকায় চলে গেলে বিধুভূষণ শুধু যে মাইনে বেশি পেতেন, তাইই নয় – কাজও হয়তো অনেক ভালো করতে পারতেন। তখন সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন; সদ্য ইউরোপ থেকে ফিরেছেন, এক্স-রশ্মি নিয়ে তাঁরও আগ্রহ ছিল। তাছাড়া, কলকাতায় পদে পদে যে সব বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন, তার থেকেও মুক্তি পেতেন। অনেক দর কষাকষির পর কলকাতা বিধুভূষণের মাইনে ৫০ টাকা বাড়াতে রাজি হল।
এক্স-রশ্মি দিয়ে রামন বিক্ষেপ দেখার কথা আগে বলছিলাম। বিধুভূষণ ১৯৩০ সালে এই বিক্ষেপ দেখার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, তিনি এক্স-রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য সামান্য বেড়ে যাওয়া (অর্থাৎ ফোটনের শক্তি সামান্য কমে যাওয়া) ধরতে পেরেছেন। ইউরোপ বা আমেরিকার বিজ্ঞানীরা কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেন না, তাঁরা বললেন, যে সেরকম কোনো চিহ্ন তাঁরা দেখতে পাননি। বিধুভূষণ তাঁর কাজের ফলাফল নিলস বোরকেও পাঠিয়েছিলেন, তবে যতদূর জানা যায়, বোরের থেকে কোনো জবাব আসেনি। শেষে সমারফেল্ড এই বিতর্কের ইতি টানেন। তিনি দেখান। যে বিধুভূষণ সত্যিই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন দেখেছেন—তাঁর পরীক্ষায় ভুল নেই, কিন্তু তার প্রকৃত রূপটা চিনতে ভুল করেছেন। আসলে যেটা দেখেছিলেন, সেটা—কৃষ্ণনেরই মতো—কম্পটন বিক্ষেপের অংশ, রামন বিক্ষেপ নয়। তবে বিজ্ঞানে এ রকম হয়েই থাকে, তাতে করে বিধুভূষণের কৃতিত্ব খাটো হয় না। ভারতে এক্স-রশ্মি বর্ণালীবীক্ষণের পথিকৃৎ যে বিধুভূষণ, তাতে কোনো দ্বিমত নেই।
তবে এই সময়ে বিধুভূষণের দুটি তাত্ত্বিক কাজও আছে – তার একটি মেঘনাদ সাহার সঙ্গে – তার কারণ পরীক্ষামূলক কাজের জন্যে যথেষ্ট সাহায্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাচ্ছিলেন না, আর্থিক সহায়তার আবেদন নামঞ্জুর হয়েছিল। বাধ্য হয়েই তাঁকে তাত্ত্বিক কাজের দিকে মন দিতে হয়। আবার রামনকে নিয়ে কিছু অবাঞ্ছিত বিতর্কেও তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সে কথায় না গেলেও আমাদের চলবে। তাছাড়া সত্যিই যে তিনি জড়িত ছিলেন, তার কোনো অকাট্য প্রমাণও নেই।
১৯৩৩ সালে দ্বিতীয়বার ইউরোপ থেকে ফেরার পর পরিস্থিতি কিছুটা পালটাল। ১৯৩৫ সালে শিশির মিত্র, ঘোষ অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হলেন, ফলে খয়রা অধ্যাপক পদটি ফাঁকা হল। ১৯৩৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিধুভূষণ খয়রা অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হলেন। নির্বাচক ছিলেন জগদীশচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ, ও মেঘনাদ। মাসিক বেতন বেড়ে হল ৭৫০ টাকা। এবার তিনি নিজের গবেষণাগার বানাবার দিকে মন দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪০০০ টাকা অনুদানও পেলেন। সুধীররঞ্জন দাস ও সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরী তাঁর কাছে গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সে যুগের তুলনায় তাঁর গবেষণাগারটিও ছিলো অত্যন্ত আধুনিক।
বিধুভূষণ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমির ফেলো ছিলেন। এলাহাবাদে মেঘনাদ সাহার হাতে তৈরি এই অ্যাকাডেমিটি ভারতের তিনটি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির মধ্যে প্রাচীনতম। তাছাড়া বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজেও তাঁর উৎসাহ ছিল, দীর্ঘদিন সায়েন্স অ্যান্ড কালচার পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিধুভূষণ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না। অনেকদিন ধরেই ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য নানারকম অসুখে ভুগছিলেন। কাজের প্রতি আগ্রহ তাতেও কমেনি, কিন্তু শরীর আর টানতে পারছিল না। ১৯৪৪ সালে, মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে বিধুভূষণের জীবনাবসান হয়। তাঁর মৃত্যু বিষয়েও একটা কাহিনী আছে। তিনি নাকি বিদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানীকে নিজের গবেষণাগারে ডেকেছিলেন, তাঁদের সামনে এক্স-রশ্মি রামন বিক্ষেপের পরীক্ষাটি হাতেনাতে করে দেখাবেন বলে। কিন্তু যন্ত্রের গোলমালে পরীক্ষাটি ব্যর্থ হয়, অপমানিত বিধুভূষণ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই আঘাতই তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত করে। রাজিন্দার সিং দেখিয়েছেন, এই গল্পের বিশেষ কোনো ভিত্তি নেই। তাঁর মৃত্যুর অনেক আগেই সমারফেল্ড দেখিয়েছিলেন, বিধুভূষণের দাবি ধোপে টেঁকে না। বিতর্কের মীমাংসা তখনই হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া, এই সব পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করতে সময় লাগে, লোকজনকে ডেকে এনে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখানো যায় না। তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই মৃত্যুর কারণ।
১৯৪৪ সালে বিধুভূষণের মৃত্যুতে খয়রা অধ্যাপক পদটি শূন্য হয়। ঢাকা থেকে সেই পদে যোগ দিতে ফিরে আসেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বিধুভূষণের গবেষণাগারটিও তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। তিনি তখন এক্স-রশ্মি নিয়েই বেশি উৎসাহী – যে কাজের জন্যে তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি, তার থেকে তখন তিনি অনেক দূরে সরে গেছেন। ১৯২৪ সালে দু-বছরের জন্য ইউরোপ যান সত্যেন্দ্রনাথ। ফ্রান্সে কাটান এক বছর, মাদাম কুরি ও মরিস দ্য ব্রয়ির ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছিলেন। বিশেষ করে বলতে হয় দ্বিতীয় জনের কথা, তাঁর ক্রিস্টালোগ্রাফি ল্যাবরেটরি ছিল ইউরোপের অন্যতম সেরা। মরিসের ভাই লুই কোয়ান্টাম তত্ত্বে যুগান্তর এনে দিয়েছিলেন, কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে নয়, বেশি সময় কাটান মরিসেরই গবেষণাগারে। আবার এক বছর পরে যখন জার্মানিতে যান, বেশি সময় তিনি কাটান কাইজার উইলহেল্ম ইন্সটিটিউটে হেরমান মার্কের এক্স-রশ্মি ক্রিস্টালোগ্রাফি ল্যাবরেটরিতে। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই জ্ঞান তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন, কে. এস. কৃষ্ণনের মতো এক্স-রশ্মি বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞও স্বীকার করেছিলেন, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় তিনি সত্যেন্দ্রনাথের কাছে অনেক কিছু শিখেছিলেন।
বিধুভূষণ খয়রা ল্যাবরেটরিতে মূলত এক্স-রশ্মি নিয়ে গবেষণা করতেন, সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর পুরানো অভিজ্ঞতার থেকেই সেই কাজকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ও তাঁর ছাত্ররা মিলে এক্স-রশ্মি ক্যামেরা, ডিফারেনশিয়াল থার্মাল অ্যানালাইজ়ার, স্ক্যানিং স্পেকট্রোফটোমিটারের মতো আধুনিক যন্ত্র বানিয়েছিলেন। খয়রা গবেষণাগার থেকেই পৃথিবীতে প্রথম এক্স-রশ্মি রামন বিক্ষেপ সন্দেহাতীতভাবে দেখা যায়। কৃতিত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গবেষকের। তাঁর নাম কমলাক্ষ দাশগুপ্ত। ১৯৫০ সালে পদার্থবিদ্যা বিভাগের খয়রা অধ্যাপকের গবেষণাগারে তিনি এই পরীক্ষাটি করেছিলেন। বিধুভূষণের সাজানো গবেষণাগার না পেলে এ কাজ কতদূর সফল হত—বলা মুশকিল। ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালে নেচার পত্রিকায় কমলাক্ষের দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি একাই প্রবন্ধ দুটির লেখক। যে জিনিস দেখার জন্যে গত কুড়ি-বাইশ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন, যে প্রবন্ধ সরাসরি নেচারের মত পত্রিকায় প্রকাশিত হবে, সেখানেও কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ—যাঁর গবেষণাগারে কমলাক্ষ গবেষণা করেছেন, যিনি নানারকম ভাবে সাহায্য করেছেন, এবং কমলাক্ষ প্রবন্ধে কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর নামোল্লেখ করেছেন—তাঁর নিজের নামটি প্রবন্ধকার হিসেবে দিলেন না। অথচ চাইলেই দিতে পারতেন। এমনকি ছাত্রকে কোনো কৃতিত্ব না দিয়ে নিজেই পুরো কৃতিত্বের দখল নিতে পারতেন; কলকাতাতেই এরকম একাধিক উদাহরণ আছে। কমলাক্ষ পরে আমেরিকা থেকে এক্স-রশ্মি রামন বিক্ষেপ নিয়ে আরো উন্নত মানের গবেষণা করেন।
বিধুভূষণ তাঁর অনেক সহকর্মীর মতো অসামান্য প্রতিভাবান ছিলেন না, কিন্তু তাঁর বিষয়ে তিনি এ দেশে পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছিলেন – সে সম্মানটুকু তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য। ভুলে যাওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব তিনি নন। অন্য কোনো সময়ে বিভাগে যোগ দিলে তিনি হয়তো উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের সম্মান পেতেন। রয়ে গেলেন পার্শ্বচরিত্র হয়ে, আর ইতিহাস পার্শ্বচরিত্রদের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন।