ডিউরেলের উপন্যাস ‘প্যানিক স্প্রিঙ’ ( ১৯৩৭ ) এবং ‘দি ব্ল্যাক বুক’ ( ১৯৩৮ ) দুটিই ছিল ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ প্রভাবিত। ‘দি ব্ল্যাক বুক’ উপন্যাসে তিনি মিলারের অনুকরণে ইংরেজি গালমন্দ এবং যৌনতাও ব্যবহার করেছেন। ১৯৩৭ সালে ডিউরেল ন্যান্সিকে নিয়ে প্যারিসে গিয়ে মিলার আর অ্যানাইস নিনের আস্তানায় জড়ো হন আর একটি হুল্লোড়বাজ বোহেমিয়ান গোষ্ঠী গড়েন। হেনরি মিলার সম্পর্কে লরেন্স ডিউরেল লিখেছেন, “আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত মিলারের স্হান হবে ওয়াল্ট হউইটম্যান বা উইলিয়াম ব্লেকের মতন সেই সমস্ত বিশাল ব্যতিক্রমী লেখকদের মাঝে যাঁরা আমাদের জন্য কেবল শিল্পকর্মই রেখে যাননি, রেখে গেছেন আইডিয়াসমূহের ভাঁড়ার যা সমগ্র সাংস্কৃতিক নকশাকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করে।”
মিলার জানতে পারেন যে ফিলমোরের অসুখ হয়েছে আর সে হাসপাতালে ভর্তি। ফিলমোরের সঙ্গে দেখা করতে গেলে ফিলমোর হেনরিকে জানায় যে জিনেট নামের একটি মেয়ের সঙ্গদান করায় মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়েছে, এদিকে ফিলমোরের চাকরিও চলে গেছে, জিনেট এমন মেয়ে যে ও ফিলমোরের চলাফেরার দিকে নজর রাখে, এখন তাকে বিয়ে না করে উপায় নেই। জিনেটের এক বান্ধবী, ইভেট, মিলারকে জানায় যে জিনেট আসলে একজন যৌনকর্মী, ও মোটেই গর্ভবতী নয়, ফিলমোরের চেয়ে ভালো বর পাবেনা বলে ওকে গেঁথে তুলেছে। ইতিমধ্যে ফিলমোরের সঙ্গে জিনেটের এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যায়। এঙ্গেজমেন্টের পর ফিলমোর মিলারকে জানায় যে ওর অবস্হা বড়োই দয়নীয়, জিনেটকে বোধহয় বিয়ে করতেই হবে।
মিলার ফিলমোরকে জিনেটের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে তাকে লণ্ডন হয়ে আমেরিকা পাঠিয়ে দ্যায়। মিলার যখন ফিলমোরকে স্টেশানে ছাড়তে গেছে তখন ফিলমোর একতাড়া নোট মিলারে হাতে গুঁজে দিয়ে অনুরোধ করে যাতে সেগুলো জিনেটকে দিয়ে দ্যায়। একটা হাজার ফ্রাঁর নোট সূর্যের আলোয় তুলে ধরে নোটেও ফরাসীদের শিল্পকলার উপস্হিতিকে প্রশংসা করেন। টাকা পেয়ে মিলার একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে প্যারিস ঘোরেন, নিজেকে বলেন, “এই প্রথম এরকম একটা সুযোগ এসেছে। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলুম -- তুমি কি ফিরে যেতে চাও ? কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।” সিয়েন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে তিনি আমেরিকায় ফেলে আসা স্ত্রীর কথা ভাবেন। এখানেই ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’-এর শেষ।
জর্জ উইকেন্স সম্পাদিত ‘হেনরি মিলার অ্যাণ্ড দি ক্রিটিকস’ ( ১৯৬৩ ) গ্রন্হে মার্কিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কবি ও সাংবাদিক ওয়াল্টার লাওয়েনফেল্স ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “আমার পড়া বইগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক বই। এরকম হতেই হবে, যাতে অন্য ফালতু বইয়ের প্রকাশ বন্ধ করা যায়। এই বইয়ের ঔচিত্য হল এটি প্রতিটি লেখক এবং পাঠককে আগাপাশতলা ওলোট-পালোট করে দেবে। এই ধরণের ধ্বংস পৃথিবীকে পরিশীলিত করে তুলবে। জীবন আবার ফিরে যাবে তার নবত্বে। বইটা স্বাদহীন, আঙ্গিকহীন, কৌতূকহীন বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার ফসল। অ্যামিবার মতন। হেনরি মিলার একটা মাকড়সার মতন, যে মাকড়সা কোনো পোকার মাথায় একটামাত্র কামড় দিয়ে তাকে চলচ্ছক্তিহীন করে দ্যায়। তারপর মাকড়সার ভাঁড়ারে স্পন্দনহীন মাংস। যা খেয়ে সে নিজে আর তার বাচ্চারা আহ্লাদে মাততে পারে। তেমনটাই মিলারের জীবন্ত মাকড়সার জালে ঘটে চলে -- এমনই প্রাণবন্ত যে কখনও খারাপ হবার সম্ভাবনা থাকে না। মিলারের স্বগতসংলাগুলো দারুণ। দশ বছর আগে, যখন স্ত্রাভিন্সকি, ককতো, জয়েস, পিকাসো এবং আরও অনেকে, এবং সামনের সারিতে তখন পরাবাস্তববাদ, তখন থাকলে মিলার নিজের গলা কেটে ফেলতেন। কিন্তু এখন, আহা-- সেসব মিলারের কাছে মরা মাংস। আর তিনি এখন লোলুপ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকান। তাদের পক্ষাঘাতে অসাড় মাংস খেয়ে মাতন করছেন। এটাই প্রত্যেক মানুষের অন্তরের আসল কাহিনি। প্রতিটি মানুষ মিলারের কাছে একটি খোলা বই।”
দুই
১৯৩৬ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত হেনরি মিলারের “ব্ল্যাক স্প্রিঙ”, মোটামুটিভাবে “ট্রপিক অফ ক্যানসার”-এর থিমকে অনুসরণ করলেও, এই বইটির মেজাজ এবং ভাষাবুনন সম্পূর্ণ আলাদা। ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ লেখার সময়ে হেনরি মিলারের কলমে যেসমস্ত পরাবাস্তববাদী বাক্যের তোড় আসছিল সেগুলো তিনি সঞ্চয় করে রেখেছিলেন তাঁর পরবর্তী বইয়ের জন্য, কেননা “ট্রপিক অফ ক্যানসার’কে তিনি সাধারণ পাঠকের বোধবুদ্ধির বাইরে নিয়ে যেতে চাননি। “ব্ল্যাক স্প্রিঙ” বইটিতে যে দশটি পর্ব আছে, তার প্রতিটিতে তিনি ভিন্ন গদ্যবিন্যাসের নিরীক্ষা করেছেন। একে উপন্যাস, ছোটোগল্পের সংকলন বা স্মৃতিকথার সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না। বইটির দশটি পর্ব এরকম : ১) ফোরটিনথ ওয়ার্ড, ২) থার্ড অর ফোর্থ ডে অফ স্প্রিঙ, ৩) এ স্যাটারডে আফটারনুন, ৪) দি অ্যানজেল ইজ মাই ওয়াটারমার্ক, ৫) টেইলর শপ, ৬) জ্যাবারহোর্ল কন্সটাডট, ৭) ইন টু দি নাইটলাইফ, ৮) ওয়কিঙ আপ অ্যাণ্ড ডাউন ইন চায়না, ৯) বারলেস্ক, এবং ১০) মেগালোপলিটান ম্যানিয়াক।
প্রথম পর্ব আরম্ভ হয় শৈশব থেকে। তরুণ হেনরি মিলার প্রায়ই ব্রুকলিন ব্রিজ পেরিয়ে ম্যানহ্যাটনে বাবার দোকানে যেতেন। ১৯৩০ পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক ছিল তাঁর বিচরণভূমি। ‘ব্ল্যাক স্প্রিঙ”-এ তিনি লিখেছেন, “আমি আগাপাশতলা একজন শহুরে মানুষ ; প্রকৃতিকে আমি ঘৃণা করি, ঠিক যেমন আমি ঘৃণা করি ধ্রুপদি সাহিত্যকে। তাঁর সেই সময়ের দিনগুলোর কথা, ‘দি ফোরটিনথ ওয়ার্ড’ এবং ‘দি টেইলর শপ’ পর্বে মিলার বলেছেন পরাবাস্তব কবিতার মতন গদ্যকাঠামো প্রয়োগ করে। যে জগতের কথা তিনি বলেন তা হুইটম্যানের আমেরিকার নিউ ইয়র্ক নয়; তা তিরিশের দশকের সেই নিউ ইয়র্ক যেখানে এসে মিশে যাচ্ছে ইউরোপের পুরোনো পৃথিবীর নানা গন্ধবর্ণের প্রতিবেশীর দল। এই বহুভাষিক পরিবেশে হেনরি মিলার ইংরেজিতে কথা বলার আগে জার্মান ভাষায় কথা বলতে শেখেন এবং চারিপাশে শুনতে পান ইহুদি আর পোল্যাণ্ডবাসীদের পারস্পরিক কথাবার্তা।
বালক হেনরি খেলে বেড়াতেন এই এলাকার পথে-পথে, যখন কিনা তাঁর বাবা সান্ধ্য আড্ডা দিতে বেরোতেন আরামদায়ক পুরুষালি মদখোরদের, ভালোখাবার-দাবারের জমঘটে, তাঁর দোকানের অভিনেতা-সেলসম্যান-খেলোয়াড় খদ্দেরদের সঙ্গে। বাবার যে ছবি মিলার এঁকেছেন তা থেকে মনে হয় হেনরির শৈশবে তিনি ছিলেন যূথচর, নির্ঝঞ্ঝাট, পানাসক্ত লোক ; হেনরি তাঁর বাবার জীবনযাত্রাকে হিংসে করতেন। অপরপক্ষে, হেনরির মা ছিলেন গোঁড়া রক্ষণশীল মহিলা ; সম্ভবত তাঁর কারণেই মিলারের চরিত্রে দ্রোহীর বীজ গড়ে উঠেছিল। মায়ের সম্পর্কে কোথাও ভালোকথা লেখেননি তিনি। পরিবারে পাগলামির যে রেশ ছিল, যা পরবর্তীকালে দয়নীয়ভাবে ফুটে উঠেছিল মিলারের পিসিমা টানটে মেলিয়ার, এবং বোন লরেটোর চরিত্রে।
আমেরিকার আরও বহু কবি-লেখক-চিত্রকরের মতন হেনরি মিলারকে কেবল জনগণের চাপানো কুখ্যাতি সইতে হয়নি, নিজের অন্তরজগতে লালিত লজ্জাবোধও তাঁকে কুরে খেতো, কেননা তিনি বাবার তুলনায় রোজগারের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। “ব্ল্যাক স্প্রিঙ” উপন্যাসে মিলার লিখেছেন, “আমার পরিবারের পূর্বপুরুষরা সবাই নিজের হাতে কাজ করে রোজগার করেছেন। আমিই বংশের প্রথম কুত্তির বাচ্চা যার পিচ্ছিল বুকনি আর নষ্ট-হৃদয় ছাড়া কিছু নেই।” বইতে পরে অবশ্য মিলার লিখেছেন যে তাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ-কেউ কবি আর সঙ্গীতকার ছিলেন।
“ব্ল্যাক স্প্রিঙ’ নামকরণ থেকে টের পাওয়া যায় হেনরি মিলার আরেকবার পৃথিবীর ক্ষয়রোগের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। কিন্তু এই বইতে ‘’ট্রপিক অফ ক্যানসার”-এর তীব্র খোঁচাগুলো কম, ভাষাবয়নে হিংস্রতা দমিত, তিনি এখন ততো ক্ষুধার্ত নন, বরং তিনি হইচইয়ে ডগমগ। এই বইতে অমন ঘন-ঘন যৌনকর্ম নেই, গালমন্দ ও স্ল্যাঙ কম। ঘটনাগুলো এক্ষুনিকার-এক্ষুনি কালখণ্ডে এবং একটিই ভৌগলিক এলাকায় ঘটতে থাকার পরিবর্তে, স্মৃতির ন্যারেটিভ এগিয়ে যায়, পেছিয়ে যায়, কখনও ব্রুকলিন ও নিউ ইয়র্কে, কখনও ফ্রান্সে, কখনও বা অন্য অঞ্চলে, বিভিন্ন সময়ে, স্বপ্নিল ভাবাচ্ছন্নতায়, সঙ্গীতের মোহময়ী আবেশে। এই বইতে, যেমন-যেমন মিলার তাঁর উপলব্ধির বিভিন্ন স্তর ও প্রণালীগুলো পরখ করেন, ক্যানসারের ঘায়ের তুলনায় বেশি মেলে দেন কল্পজগত, স্বপ্ন, হ্যালুসিনেশান ও স্কিৎসোফ্রেনিয়ার বিভ্রম। বস্তুত “ব্ল্যাক স্প্রিঙ”-এর বিষয়বস্তু হল সাহিত্যে ভাঙচুরের সাহায্যে কল্পনার বিভিন্ন আঙ্গিকের নিরীক্ষা, অন্তর্ঘাতী আত্মবীক্ষণ।
স্বয়ংসম্পূর্ণ দশটি পর্বের প্রতিটি শিল্পমাধ্যমগুলোর অথবা কল্পনার অথবা মিডিয়াকে নিয়ে অনুশীলন। যেমন “দি অ্যাঞ্জেল ইন মাই ওয়াটারমার্ক” মনের ভেতরের ভিশান ও সাহিত্যিক প্রেরণা এবং জলরঙে আঁকার প্রক্রিয়াকে ছানবিন করে। আরম্ভ হয় মিলার যখন একটি “ডিকটেশান” দ্বারা নিশিপ্রাপ্ত হন, যা তাঁর মস্তিষ্কে চলতেই থাকে, যার ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই। যতক্ষণ না শেষ হয় তিনি কেবল লিখে নিতে পারেন যা তাঁকে ডিকটেট করা হচ্ছে। তাঁকে অত্যন্ত ক্লান্ত করে ডিকটেশানটি ফুরোয়। এরপর তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মজাদার একখানা শিল্প এবং উন্মাদনা বিষয়ের বইতে, যা তাঁকে জলরঙে ছবি আঁকতে ওসকায়। পর্বটিতে বর্ণনা করা হয়েছে কেমন করে একটি জলরঙ ছবি ঘটে, “যখন তুমি প্রবৃত্তিগতভাবে একজন জলরঙ আঁকিয়ে তখন সব কিছু ঘটতে থাকে ঈশ্বরের মর্জি অনুযায়ী।”
দ্বিতীয় পর্বটি তাঁর শৈশব আর বর্তমান আবাস ক্লিশি, যেখানে বসে তিনি বইটি লিখছেন, এই দুই জায়গার মাঝে দোল খায়। তৃতীয় পর্বে ফ্রান্সের পথে-পথে একদিন সাইকেলে ঘোরাঘুরির আনন্দ, এমনকি রাস্তায় পেচ্ছাপ করাতেও খুঁজে পান আহ্লাদ। পঞ্চম ‘টেইলর শপ’ পর্বে মিলার আমেরিকা ও আমেরিকানদের সম্পর্কে তাঁর ঘৃণার অভিব্যক্তি নিয়ে গদ্যের খেলা খেলেন। লিখছেন. “হ্যাঁ, সবকটা সিল্ক-পরা গাধাগুলোকে আমি ভালো করে চিনি -- আমেরিকার সবচেয়ে নামকরা পরিবারগুলো ছিল আমাদের খদ্দের। যখন তারা নিজেদের ফাঁদ খুলে ফেলতো তার পুঁজ আর নোংরামির কথা বলবার নয়।” অষ্টম পর্ব “ওয়াকিং আপ অ্যাণ্ড ডাউন ইন চায়না” চিন ভ্রমণের ঘটনা নয় ; তা ফ্রান্সের হেনরি মিলার আর আমেরিকার হেনরি মিলারের মাঝেকার দ্বন্দ্ব। নবম পর্ব “বারলেস্ক” তাঁর যৌবন সম্পর্কে পরাবাস্তববাদী বয়ান। দশম “মেগালোপলিটান ম্যানিয়াক” পর্বে তিনি পশ্চিমের সভ্যতা আর তার ঈশ্বরকে তুলোধনা করেছেন।
“ইনটু দি নাইটলাইফ” পর্বে পরাবাস্তব স্বতঃলিখনের মাধ্যমে মিলার তুলে ধরেছেন একটি আধুনিক দুনিয়ার দুঃস্বপ্ন। পরাবাস্তব ফিলমের মতন, যুক্তিশৃঙ্খলাহীন ছবির পর ছবি গড়ে উঠতে থাকে দুঃস্বপ্নের দুনিয়ায়, ভয়ার্ত সন্ত্রস্ত চিৎকার, ফ্রয়েডিয় অপরাধবোধ ও তর্ক, এগুলো লেখক অনুভব করছেন। একজনকে তাড়া করা হচ্ছে, সে পালাতে পারছে না, বেরোবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। পৃথিবী কাৎ হয়ে যায় আর মগজের আদুরে দ্বীপপূঞ্জে ( কোনি আইল্যাণ্ড অফ দি মাইণ্ড ) দৃশ্য অবিরাম বদলাতে থাকে, সেখানে স্মৃতিগুলোয় জট বেঁধে গেছে, গথিক ভিশনে জেগে উঠতে থাকে ব্যাখ্যাযোগ্য ক্ষ্যাপা প্রতীকেরা। বিট কবি লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির একটি কাব্যগ্রন্হের নাম “কোনি আইল্যাণ্ড অফ দি মাইণ্ড।” বিট আন্দোলনকারীরা অনেকে হেনরি মিলারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যেমন জ্যাক জেরুয়াক ( অন দি রোড ) ,উইউলিয়াম বারোজ ( নেকেড লাঞ্চ ), অ্যালেন গিন্সবার্গ ( হাউল এবং ক্যাডিশ )। বিটরা কিন্তু এই তুলনায় রুষ্ট হতেন। বিটরা ছাড়াও প্রভাবিত হয়েছেন চার্লস বুকোস্কি, কেথি অ্যাকার প্রমুখ।
সৃজনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে হেনরি মিলার অন্যত্রও লিখেছেন, কিন্তু তা “ব্ল্যাক স্প্রিঙ” পর্যায়ের স্বতোৎসারিত পরাবাস্তববাদী ব্যাখ্যার স্তরের নয়। “ব্ল্যাক স্প্রিঙ” বইটিতে তিনি কল্পনার ওপর সৃজনশীলতার রসায়নকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, “দৈনন্দিন জীবনে, লেখক স্বাভাবিক দৃষ্টিচৈতন্যে ভোগেন, কিন্তু লেখকীয় প্রবেশমুহূর্তে তিনি নিজেকে ক্ষীণদৃষ্টিযুক্ত করে তোলেন, যাতে স্বপ্নের প্রাণরসের তাৎক্ষণিকতাকে আয়ত্ব করে ফেলতে পারেন। স্বপ্নপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি তাঁর দেহমাটির নশ্বরতার খোসা ছাড়িয়ে নিজের সত্যকার ভবিষ্যদ্বাণীমূলক প্রতিস্বের মুখোমুখি হতে পারেন, তা হবে আধাতরল চরিত্রের স্তরহীনতার এলাকা। প্রকৃতির অনিয়তাকার দিকটিই তখন বলবৎ। যা দৃষ্টিগোচর তাকে চুবিয়ে লেখক হারিয়ে যান নিজের প্রায়োন্মাদ অভ্যাস-নকশার তলদেশে। লেখক বাধাবন্ধনহীন সাঁতার কাটেন মহানন্দে, স্বকীয় রসায়নে।”
“ব্ল্যাক স্প্রিঙ”-এ পৌঁছে হেনরি মিলার মনে করেন যতোটা সম্ভব লেখালিখি হওয়া উচিত স্বতোৎসারিত এবং অচেতন। সেকারণে এই বইটিতে তাঁর গদ্যবিন্যাস পারস্পরিক সংযোগহীন ও কাটাকুটিবর্জিত। বহু গদ্যাংশ পরাবাস্তববাদীদের মতন স্বয়ংক্রিয়, যাকে তিনি অনেক সময়ে বলেছেন “সুরের মূর্ছনা”-- সে-সময়ে ডিকটেশান তাঁর ওপর ভর করে। জর্জ উইকস তাঁর “হেনরি মিলার” ( ১৯৭৪ ) রচনায় বলেছেন যে, “টাইপরাইটারের সামনে মিলার যেন সেই গ্রিক দেবতার মতন যার উত্তমাঙ্গ মানুষের আর নিম্নাঙ্গ ঘোড়ার। লেখার সময়ে মিলার তাঁর সামনের টাইপরাইটারের অঙ্গ হয়ে যান আর লিখতে থাকেন বিস্ফোরণের আবেগে। ফলে গড়ে ওঠে পারস্পরিক সংযোগহীন গদ্য যা থেকে টের পাওয়া যায় কোথায় বসে লিখতে আরম্ভ করেছিলেন এবং কোথায় গিয়ে শেষ করেছেন।”
স্টাইলের দিক থেকে “ব্ল্যাক স্প্রিঙ” ধাঁধায় ঝলমলে, শব্দে মাতাল কল্পনা বইটিতে উড়তে থাকে। তাঁর গদ্যবিন্যাসের কবিত্ব একেবারে বেপরোয়া, ভাষার বয়ন সমৃদ্ধ ও অমিতব্যয়ী, অনেক সময়ে মর্মার্থের চেয়ে ধ্বনি সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োগ করেছেন মিলার, বিশেষ্যকে ভেঙে ইচ্ছেমতন বিশেষণ তৈরি করে নিয়েছেন। তিনি দুর্বোধ্য শব্দাবলী গড়ে তুলেছেন আর তার পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন ব্যঙ্গকৌতুক। বিভিন্ন অংশে ধার নিয়েছেন মার্সেল প্রুস্ত, জেমস জয়েস, হুইটম্যান, লুইস ক্যারল থেকে।
‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ গ্রন্হের এক বন্ধু, ক্রন্সটাডটকে ( প্রকৃত নাম ওয়াল্টার হুয়েনফেল ) ঠাট্টা করে লুইস ক্যারলের জ্যাবারওয়কি এবং ননসেন্স রচনার ঢঙে লিখেছেন “জ্যাবারহোয়র্ল ক্রন্সটাডট”। বাক্যাংশকে জয়েসের ঢঙে জুড়ে-জুড়ে গড়ে তুলেছেন জ্যাবারওয়কি বাক্যালাপ। মদ খেতে খেতে মাতাল হয়ে গিয়ে লোকটির ভাষাও মাতাল ও দুর্বোধ্য হয়ে যায়। অনুবাদ করা কঠিন বলে অংশটুকু তুলে দিচ্ছি : “the great vertiginous vertebration the zoospores and the leucocytes the wamroths and the holenlidens. everyone is a poem.” চরিত্রটি বলছে, “জেলিফিশও কবিতা -- সবচেয়ে উন্নতমানের কবিতা। তাকে এখানে খোঁচা দাও, তাকে ওখানে খোঁচা দাও, সে পেছলায় আর গড়িয়ে যায়, সে দোনামনা করে আর তার আছে আঁকুপাঁকুভাব, তার অন্ত্র আছে আর আছে মলাশয়, সে কেঁচোআঙ্গিকের আর তার রয়েছে সর্বব্যাপিতা।”
মিলার লিখেছেন, “আমার কাছে বইটাই মানুষ, আমার বই হল এই-আমি মানুষটা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষ, অবহেলাকারী মানুষ, দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ, লম্পট, অশ্লীল, হইচইকারী, চিন্তাশীল, খুঁতখুঁতে, মিথ্যুক, শয়তানসুলভ সত্যসন্ধানী মানুষ।” “ব্ল্যাক স্প্রিঙ” লেখার সময়ে হেনরি মিলার যেন একজন উন্মাদ লেখক যিনি সমার্থশব্দকোষ থেকে ঝরিয়ে চলেছেন শব্দের স্রোত, তিনি যেন আসন্ন ধ্বংসের ভবিষ্যবাণী করে চলেছেন এই পরাবাস্তববাদী স্মৃতিপ্রবাহের দ্বারা।
“ব্ল্যাক স্প্রিঙ”-এর শেষ প্যারায় মিলার লিখেছেন, “ কালকে তোমরা নিজের পৃথিবীর ধ্বংস ডেকে আনবে। কালকে তোমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর শহরগুলোর ধোঁয়ার ওপরে স্বর্গে গিয়ে গান গাইবে। কিন্তু আজকে রাতে আমি কেবল একজন মানুষের কথা ভাববো, একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, নামহীন আর দেশহীন, একজন মানুষ যাকে আমি শ্রদ্ধা করি কেননা তার সঙ্গে তোমাদের কোনোরকমের মিল নেই-- সেই লোকটা আমি। আজকে রাতে আমি সেই ‘বিশেষ আমি’ সম্পর্কে ধ্যান করব।”
তিন
“ট্রপিক অফ ক্যানসার”-এর সঙ্গে ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত “ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন”-এর প্রধান পার্থক্য হল গদ্যবিন্যাসের শৈলী, ন্যারেটিভ এবং বর্ণায়ন। প্রথম বইটিতে পাই তিরিশের দশকের ইউরোপে একজন আমেরিকানের বর্ণায়ন, তার মার্কিনত্ব। দ্বিতীয় বইটিতে পাই বিশের দশকে আমেরিকায় একজন আমেরিকানের মার্কিনত্ব। প্রথম বইটিতে বিদেশে স্বেচ্ছা-নির্বাসিতের জীবনযাপন, যে লোকটি বিদেশবাসী সাহিত্যিকদের প্রথাগত দৈনন্দিন থেকে বেরিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংঘর্ষ আর শারীরিক অসুবিধার কথা বলেন। পরের বইটি মার্কিন আত্মপরিচয়ের সন্ধান করে -- আমেরিকায় আমেরিকান বলতে কী বোঝায়, যে দেশের প্রতিটি মানুষের হাতে মানবহত্যার রক্ত লেগে আছে ! তিনি বলেন, “যে মুহূর্তে আপনি ‘অন্যরকম’ ভাবনা ভাববেন, আপনি আর আমেরিকান থাকবেন না।” এই বইতেও মিলার সমাজের বাধানিষেধ অমান্য করে লেখকের জীবনযাপনের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ বাদ দেননি। ন্যারেটিভ রেখিক না হলেও, এর মূল ভাবনাকে তুলনা করা যায় জেমস জয়েসের “পোরট্রেট অফ দি আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়াং ম্যান”-এর সঙ্গে। বইটির কাহিনি যিনি বলছেন তাঁর নাম হেনরি ভি মিলার।
শৈশবের নিউ ইয়র্ক শহরকে মিলার কখনও ভালো চোখে দেখেননি, এই শহরকে তিনি বার্ধক্যেও বলেছেন “গুয়ের গর্ত”। “ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন”-এ তিনি নিউ ইয়র্কের একটি রাস্তা সম্পর্কে বলেছেন, “আমি মার্টল অ্যাভেনিউ নামে একটা পথ দেখেছিলুম যেটা বরো হিল থেকে ফ্রেশ পণ্ড রোড পর্যন্ত যায়, আর এই পথে কখনও কোনো সন্ত হাঁটেননি ( হাঁটলে ভেঙে পড়ে যেতো ), এই পথে কখনও কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটেনি, কোনো কবি যাননি এই পথ ধরে, মানব প্রজাতির কোনো প্রতিভাধারী হাঁটেননি এই পথে, কোনো ফুলও ফোটে না এই পথে, রোদের আলো ঠিকমতন পড়ে না, বৃষ্টিও এই পথকে ধুয়ে পরিষ্কার করে না। প্রিয় পাঠক, মারা যাবার আগে একবার অবশ্যই মার্টল অ্যাভেনিউকে দেখে যাবেন, অন্তত জানতে পারবেন দাঁতে কতো দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত দেখেছিলেন।” মিলারের মনে হয় তিনি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, চারিদিকে কেবল বিশৃঙ্খলা, আর তা এভাবেই রয়েছে চিরকাল, তা যেন “তরল যার ভেতরে আমি বসবাস করছি, শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি কানকো দিয়ে।”
প্যারিস সম্পর্কে মিলার লিখেছেন, “এই প্যারিস শহর, যার চাবি আছে কেবল আমার হাতে, ঘুরে দেখার জন্য নিজেকে মেলে ধরে না, সদিচ্ছা থাকলেও ; এই প্যারিসে থাকতে হবে, তার অভিজ্ঞতা প্রতিদিনের হাজার অত্যাচারের মাধ্যমে পেতে হবে, এই প্যারিস শহর যা আপনার ভেতরে ক্যানসারের মতন বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে বাড়তেই থাকে, যতক্ষণ না তা আপনাকে খেয়ে ফেলছে।”
ক্যাপ্রিকর্ন আরম্ভ হয় নায়কের দার্শনিক ভাবনাচিন্তা দিয়ে, ফাঁকে-ফাঁকে জীবনের ঘটনাবলীর টুকরো-টাকরা নিয়ে নায়কের আত্মচিন্তা। জানা যায় যে একের পর এক ভবিষ্যৎহীন ফালতু কাজ করে-করে শেষকালে হেনরি একটা পাকা চাকরি পান কসমোডেমনিক টেলিগ্রাফ কোম্পানি অফ নর্থ আমেরিকায়, তাও চাকরিটা কর্মী নিয়োগ আর ছাঁটাই করার ম্যানেজারের। কোম্পানির এই দানবিক যন্ত্রে হেনরি ক্রমশ একটা অংশ হয়ে ওঠেন, দ্যাখেন আর ভাবেন কোম্পানিটার অমানবিক আর পাগলকরা নিয়মপ্রণালীর যুক্তি সম্পর্কে। কোম্পানির মালিক একদিন তাঁকে তাঁর কর্মীদের নিয়ে হোরেশিও অ্যালগারের ঢঙে একখানা উপন্যাস লিখতে বলেন। লেখার পর মিলার বুঝতে পারেন যে তা অত্যন্ত বাজে হয়েছে, সান্ত্বনা এই যে তিনি অন্তত একটা বই লেখার কাজে হাত দিতে পারলেন।
হেনরির বিয়ে হয়ে গেছে, তার একটা বাচ্চা আছে। তার স্ত্রী যৌনতার ব্যাপারে বেশ রক্ষণশীল, হেনরির একেবারে বিপরীত, ফলে স্ত্রীর সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব গড়ে ওঠে হেনরির। হেনরি বিয়ে করেছিলেন যাতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাধ্যতামূলক সৈন্য হিসাবে যাওয়াটা পেছিয়ে যায়। স্ত্রীকে নিয়ে নায়াগ্রা ফলসে হনিমুন করতে গিয়েছিলেন, তবুও স্ত্রীর যৌনরক্ষণশীলতা কাটেনি। এদিকে বাবার দর্জির দোকান চলছিল না বলে বন্ধ করে দিতে হয়েছে আর বাবা অন্য চাকরি নিয়েছেন। যোনিপাগল হেনরির অবস্হা দয়নীয়।
দ্বিতীয়বার গর্ভপাত করানোর জন্য স্ত্রী যখন হাসপাতালে তখন হেনরি তার অফিসে কৃষ্ণাঙ্গী কর্মী নিয়োগ করে, তার নাম ভ্যালেসকা। ভ্যালেসকাকে বাড়ি নিয়ে আসে বাচ্চাটাকে সামলাবার জন্য। কৃষ্ণাঙ্গী কর্মী রাখা হয়েছে দেখে মালিক চটে যায় আর চাকরি থেকে ছাড়াবার জন্য ভ্যালেসকাকে হাভানায় বদলি করে দ্যায়; মিলার তাকে স্তোক দিয়ে জানান যে ভ্যালেসকার চাকরি চলে গেলে তিনিও চাকরি ছেড়ে দেবেন।ভ্যালেসকার সঙ্গে হেনরির সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর তাঁরা দুজনে একদিন বাচ্চার খেলবার ডমিনোর মাঝে ডাইনিং টেবিলের ওপর সঙ্গম করেন, ঠিক সেই সময়েই ফেরেন মিলারের স্ত্রী আর মিলারকে প্যাণ্টের বোতাম লাগাতে দেখে তাঁর মুখ আতঙ্কে শাদা হয়ে যায়। হাভানায় না গিয়ে ভ্যালেসকা আত্মহত্যা করে। এর পর থেকে ডমিনো দেখলেই হেনরির মনে পড়ে যায় ভ্যালেসকার কথা।
পলিন জ্যানোসকি নামে উনিশ বছরের একটি মেয়ে চাকরির জন্যে এলে মিলার তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যান। মেয়েটিকে দেখে চটে যান মিলারের স্ত্রী। মিলার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পলিনকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে সঙ্গম করেন আর পেট্রল স্টেশানের কাছে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে নিজের স্ত্রীকে গালমন্দ করতে-করতে ফেরেন।
সহকর্মী ক্রনস্কি মিলারকে এক মিশরীয় যুবতীর সঙ্গে পরিচয় করায়। যুবতীটি যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন, মিলার তার ওপর চেপে সঙ্গম করেন। ক্রনস্কি এসে দরোজায় টোকা দিয়ে ডাকলে তাঁর হাসি পেতে থাকে। টোকা সত্বেও মিশরীয় যুবতীটিও সাড়া দ্যায় না। ক্রনস্কি ওর স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদ দ্যায়।
মিলার তাঁর অধিকাংশ রাত কাটান ‘গুদাকৃষ্ট’ বন্ধু ম্যাকগ্রেগরের মোদো হুল্লোড়ে। ইতিমধ্যে হেনরি সতেরো বছরের এক তরুণের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন যার চুরি-পকেটমারি করতে কোনো অপরাধবোধ নেই, তার নাম কার্লি, আর তার কাছে চাইলে সে হেনরিকেও বখরা দ্যায়। নানা প্রকারের যোনির গল্প করতে ভালো লাগে ম্যাকগ্রেগরের। একদিন তার সাথে রোজল্যাণ্ড বলরুমে যান হেনরি মিলার, সেখানে এক ‘নিমফোম্যানিয়াক’ সঙ্গিনী আছে ম্যাকগ্রেগরের, যার সঙ্গে ম্যাকগ্রেগর সঙ্গম করতে থাকে আর অসুখ ও মৃত্যুচিন্তায় আক্রান্ত হবার কথা বলে হেনরিকে। মিলার এতোসব কাণ্ডকারখানার মাঝেও লেখক হবার চিন্তা বজায় রাখেন, ডি এইচ লরেন্স পড়ে, অন্যান্য বই পড়ে।
এর পর মিলার হঠাৎই শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যান, স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেইসব দিনগুলো। তাঁর মনে পড়ে পিসিমার বাড়িতে গিয়ে পিসতুতো ভাই জিনের বন্ধুদের সঙ্গে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি খেলার সময়ে আচমকা একটি ছেলেকে তিনি পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলেছিলেন। কুড়ি বছর পরে জিনের সঙ্গে দেখা হলে মিলার ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ির খেলা আর একটি ছেলের মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুললে জিনের সেসব কিছুই মনে পড়ে না। মিলার শৈশবের স্বচ্ছ সময়ের কথা ভাবেন, বালকেরা ওই বয়সে কেমন সৎ থাকে অথচ বয়স বাড়তে থাকলে তারা নিজেদের কন্ঠরুদ্ধ মনে করে, তাদের অন্তরজগতে পরিষ্কার বাতাস আর খেলা করে না।
মিলার এর পর কয়েক বছর এগিয়ে যান যখন তাঁর বয়স বিশের কোঠায় আর তাঁর সঙ্গে রয় হ্যামিলটন নামে এক যুবকের পরিচয় হয়েছিল। রয় হ্যামিলটন নিজের জন্মদাতা বাবার খোঁজে বেরিয়েছিল। অল্প সময়ের জন্যে সে মিলারের সঙ্গী ছিল কিন্তু সেই সময়টুকুতেই মিলার হ্যামিলটনের সংস্পর্শে এসে নিজের আত্মবীক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হতে পেরেছিলেন।
মিলারের আত্মবীক্ষণের যাত্রা বজায় থাকে, হ্যামিলটনের খোঁজে একা বেরিয়ে পড়েন আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণের উদ্দেশে। হ্যামিলটন খুঁজে ফিরছে নিজের বাবাকে। এর পৃষ্ঠপটে মিলার নিজের বাবার কথা ভাবেন, যিনি একজন পাঁড় মদখোর, প্রতিদিন জুড়ি গাড়ি চেপে বেরোন মদখোর বন্ধুদের হুল্লোড়ে অংশ নিতে। একদিন জুড়িগাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে শয্যাশায়ী হন, তারপর পশ্চাত্যাপ হিসাবে আকৃষ্ট হন খ্রিস্টধর্মে। যে যাযক তাঁর বাবাকে খ্রিস্টের প্রতি সমর্পিত হতে উৎসাহিত করেছিলেন, তিনি নিউ রোচেলে চলে যাবার পর মিলারের বাবা মনোভঙ্গ আর বীতরাগে আক্রান্ত হন। মিলারের মনে হয় তাঁর বাবার সঙ্গে জীবন জোচ্চুরি করেছে। প্রতিবেশী গ্রোভার ওয়াটরস তো ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছে আর তার মতন আনন্দে আত্মহারা মানুষ মিলার দ্বিতীয়টি দ্যাখেননি জীবনে।
মিলার ভাবেন, “আমি চেয়েছি রূপান্তর, মাছ হয়ে যেতে চেয়েছি, সামুদ্রিক দানব হয়ে যেতে চেয়েছি, হয়ে যেতে চেয়েছি একজন ধ্বংসকারী। আমি চেয়েছি পৃথিবীতে ফাটল তৈরি হোক, যার ভেতরে হাই তোলার মতন হাঁ-মুখে সবকিছু ঢুকে যাবে। আমি চেয়েছি শহরটা সমুদ্রের আলিঙ্গনে গভীরতায় তলিয়ে যাক। আমি এক গুহায় বসে মোমবাতির আলোয় বসে পড়াশোনা করতে চেয়েছি। আমি চেয়েছি সেই দৃষ্টি নিভে যাক যাতে আমি নিজের দেহকে ভালোকরে জানতে পারি, আমার নিজের ইচ্ছাগুলোকে জানতে পারি। আমি হাজার বছরের জন্য একা থাকতে চেয়েছি যাতে যা-যা দেখেছি আর শুনেছি তা গভীরভাবে বিবেচনা করতে পারি -- আর ভুলে যেতে পারি।”
মিলার ফেরেন বর্তমানের যৌন সফলতার ঘটনাগুলোয়। কাদের সঙ্গে শুয়েছেন তার ফিরিস্তি দিতে থাকেন। সেই বোকাসোকা যুবতী যে ওপরতলায় তাঁর সহকর্মী হাইমির আস্তানায় ভাড়া থাকতো। ভেরোনিকা নামের যুবতী যার যোনি কথা বলতো। ইভলিন যার যোনি সবসময় খিলখিলে হাসতো। আর এক নামহীন মহিলা যার সঙ্গে মিলারের গভীর যৌন সম্পর্ক হয়েছিল, সেই “লুঠের পাখি”, সবসময় কালো পোশাক পরতো আর জাঙিয়া পরতো না, সে আর মিলার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম সঙ্গম করতো। যে যোনি সহজে পাওয়া যায় না তাকে মিলার বলেছেন ‘অত্যুৎকৃষ্ট যোনি’। যুবতীদের সঙ্গে একের পর এক যৌন সফলতার ঘটনার ফাঁকে-ফাঁকে মিলার তাঁর লেখালিখির কথাও মনে করিয়ে দ্যান, পাঠক হিসাবে তিনি নিজেকে গড়ে তুলছিলেন ডস্টয়েভস্কি আর হেনরি বার্গসঁ পড়ে। মিলার বলেন, “তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝতে পেরেছি যে পৃথিবীকে যা একসঙ্গে ধরে রাখে তা হল যৌনসঙ্গম।”
আরেকবার শৈশবে ফিরে যান মিলার। মনে পড়ে যায় পিয়ানো টিচারের কথা, যাঁর কাছে তিনি কৌমার্য খুইয়েছিলেন, এবং ভেবে আনন্দিত হন যে পরবর্তীকালে পিয়ানো শেখাটা যুবতীদের আকর্ষণ করার জন্য কেমন কাজে লেগেছে। যাকে তিনি বিয়ে করেছেন সেও ভালো পিয়ানো বাজাতে পারে। পিয়ানো শেখার ফলে নতুন এক জগতের অনুভূতি ঘটেছে তাঁর। তাঁর মগজে যে সঙ্গীত গড়ে উঠতে থাকে তা তাঁর মনে হয় যেন ওগুলো ভবিষ্যতের সঙ্গীত, এমনকিছু যা বর্ণনার অতীত এবং তার জন্য তাঁকে প্রয়াস জারি রাখতে হবে। এর চেয়েও স্পষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎক্ষণিক চমকপ্রদ উদ্ঘাটন হয় একদিন ; তিনি অপেক্ষা করছিলেন লোকসঙ্গীতের নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠানের জন্য আর তাঁর সামনে মঞ্চের পর্দা একটু-একটু করে ওপরে উঠে যায়। মিলারের মনে হয় এটা যেন মানবসমাজের একটি রূপক, তাঁর লেখালিখির বাঁধন থেকে মুক্তির ইশারা। তিনি তারপর থেকে এক “নতুন পৃথিবী” সম্পর্কে অবিরাম লেখা আরম্ভ করেন আর সেই লেখালিখিকে অনুভূতির অত্যুচ্চ স্তরে নিয়ে যাবার প্রয়াস করেন।
নিজের বোনের কথা মনে পড়ে মিলারের, যার মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেনি, শৈশবে ভুল কাজ করে ফেলার জন্য যে প্রায়ই মার খেতো , আর যার ব্যথাবেদনা মিলার নিজের সঙ্গে ভাগ করে নেবার চেষ্টা করতেন। মিলার শিল্পীদের কথা বলেন যাঁদের সহজে মেনে নেয়নি পৃথিবী, সন্তদের কথা বলেন যাঁদের স্বীকৃতি দিতে চায়নি সমাজ। তবু, তিনি মনে-মনে ভাবেন যে অন্যের দুর্দশায় অংশ নিতে গেলে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা রয়ে যায়। তাঁকে নিজের স্বকীয়তা গড়ার পথে একাগ্র হতে হবে, কেননা একজন মানুষের আত্মতাই সবকিছু। “চিন্তা আর কর্ম একই ব্যাপার”, বলেন মিলার, বেঁচে থাকার সঙ্গে কেবল চিন্তাকে একাত্ম করে, রেনে দেকার্তে যে যুক্তি দিয়েছেন তাকে খণ্ডন করে মিলার বলছেন কর্মটাই আসল, যে কর্ম বাস্তব। পৃথিবী হয়তো একটিমাত্র চিন্তা থেকে লাফিয়ে জেগে উঠতে পারে, কিন্তু সেই চিন্তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য কর্ম প্রয়োজন। মিলার বলছেন, নিজের মধ্যেই খুঁজতে হবে উদ্দেশ্য। মিলার লিখেছেন, “সারাজীবন আমি যা চেয়েছি, আবিষ্কার করলুম তা বেঁচে থাকার ইচ্ছা নয় --- অন্যেরা যা করে চলেছে তাকে যদি বেঁচে থাকা বলে -- আমি কেবল নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছি।
হেনরি মিলার ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন, তাঁর জন্মরাশি হল মকর অর্থাৎ ক্যাপ্রিকর্ন, ক্যাপ্রিকর্নের বিপরীত রাশি হল কর্কট অর্থাৎ ক্যানসার। তাঁর রচনাতেও জ্যোতিষের বর্ণনা মেলে এবং নিজের জীবনে কোনো সমস্যায় পড়লে জ্যোতিষের আশ্রয় নিতেন। মিলার মনে করতেন যে জ্যোতিষ হল মনোজগতের ভিতর এবং আত্মার সঙ্গে বাইরের জগতের গ্রহতারার আদানপ্রদানের প্রণালী। প্রথম বই দুটির নামকরণ থেকে জ্যোতিষ সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ টের পাওয়া যায়। অ্যানাইস নিনকে লেখা একটি চিঠিতে মিলার রাশিনির্ভর নামকরণ ব্যাখা করেছিলেন : “মকর রাশির জাতক ধার্মিক হয় এবং তার মৃত্যুতে আত্মার উত্তরণ ঘটে, যখন কিনা কর্কট রাশির জাতক জীবদ্দশায় মৃত্যুর চারিপাশে ঘুরঘুর করে।”
মিলারের মতামত জানার পর অ্যানাইস নিন তাঁকে প্যারিসনিবাসী জ্যোতিষী কনরাড মরিকাণ্ড-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দ্যান এবং মরিকাণ্ড মিলারের জন্মছক তৈরি করে দীর্ঘ কুষ্ঠিবিচার লিখে দিয়েছিলেন। মরিকাণ্ড লিখেছিলেন মিলারের স্হিতি হল আগুনের শিখায় ঘেরা এক দেবদূতের। পরবর্তীকালে এই কনরাড মরিকাণ্ড মিলারের বিগ সারের বাড়িতে গিয়ে গায়ে এঁটুলির মতন চিপকে থেকে একটা বইয়ের জন্ম দেবেন।
১৯৩৯ সালে ফ্রান্স থেকে কিছুদিনের জন্যে গ্রিসে গেলে মিলারের হাতে আসে ডেন রুডিয়ার-এর লেখা “অ্যাস্ট্রলজি অফ পার্সোনালিটি” বই, যা ওনাকে এতই প্রভাবিত করেছিল যে জীবনের একশটি গুরুত্বপূর্ন বইয়ের তালিকায় বইটি তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মিলার ডেন রুডিয়ারকে চিঠি লেখা আরম্ভ করেন এবং রুডিয়ারের বিশ্লেষণ থেকে তিনি মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা বিষয়ে অবগত হবার পর জ্যোতিষের মাধ্যমে নিজেকে বুঝতে পারার ব্যাপারে নিশ্চিত হন।
মিলার যখন আমেরিকায় থাকতে চলে গেলেন এবং “দি রোজি ক্রুসিফিকেশান” নিয়ে কাজ করছিলেন তখন সিডনি ওমার নামে জনৈক জ্যোতিষী তাঁকে চিঠি লিখে জানান যে মিলারের বইতে জ্যোতিষের আধিক্য পড়ার পর তিনি এই বিষয়ে একটি বই লিখতে চান। মিলারের সহযোগীতায় সিডনি ওমার লেখেন “হেনরি মিলার:হিজ ওয়লর্ড অফ ইউরেনিয়া।” ১৯৫৬ সালে তাঁর মায়ের অসুখ হলে মিলার নিউ ইয়র্কে যান কিন্তু তাঁর অসুস্হ মা মিলারের সঙ্গে মিটমাট করতে রাজি হননি। মিলার তখন ওমারের কাছে পরামর্শ চান। ওমার তাঁকে জানান যে তাঁর মায়ের মৃত্যু আসন্ন। কয়েক সপ্তাহেই মিলারের মা মারা যান এবং মিলার তাঁর ‘মাথাখারাপ’ বোন লরেটাকে নিয়ে বিগ সারে ফিরে যান।
১৯৬১ সালে যখন তাঁর ট্রপিক বইগুলো নিয়ে আদালতে মামলা চলছে, হ্যামবার্গ নিবাসী তিরিশোর্ধ জার্মান বিধবা রেনাটে গেরহার্ড-এরপ্রেমে পড়েন মিলার, যার দুটি ছেলে ছিল ; মিলারেরও দুটি ছেলে ছিল। গেরহার্ড সেসময়ে মিলারের “নেক্সাস” অনুবাদ করছিলেন। মিলার তাঁর সঙ্গে ইউরোপে গিয়ে ঘর বাঁধার কথা ভাবেন, সেই সঙ্গে এই দুশ্চিন্তাও ছিল যে তাঁর ছেলে দুটিকে একা কোথায় রেখে যাবেন আমেরিকায়। মিলার সুইজারল্যাণ্ডের এক মহিলা জ্যোতিষির পরামর্শ নেন এবং ইউরোপে গিয়ে ঘর বাঁধার পরিকল্পনা বাদ দ্যান।
শনির প্রকোপ সম্পর্কে হেনরি মিলারের প্রচণ্ড ভীতি ছিল। “ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন”-এ তিনি লিখেছেন, “শনি হল হতাশা, মারী, বিশৃঙ্খলা, সর্বনাশের জলজ্যান্ত প্রতীক। শনি নিষ্ক্রিয়তার গতির মাধ্যমে অনিষ্টসাধন করে। পণ্ডিতদের মতে, তাকে ঘিরে থাকা চক্র, যা কেবল পেপারওয়েটের মতন সরু, তা হল মৃত্যু আর দুর্দশার বিয়ের আঙটি, অথচ যার কোনো গুরুত্ব নেই। জ্যোতির্বিদদের মতে যাই হোক না কেন, পথচলতি মানুষের জন্যে শনি হল বিবেকহীন সর্বনাশ।”
মিলারের কুষ্ঠি দেখে দিল্লির কবি-জ্যোতিষী দীপঙ্কর দত্ত এই লগ্নবিচার করেছেন : “মিলারের জন্ম ২৬ ডিসেম্বর ১৮৯১ ; সময় ১২.২০ পি এম, স্হান ম্যানহ্যাটন, ইউএসএ। পাশ্চাত্য মতে সূর্যের ছকের যে রাশিতে থাকে ব্যক্তিকে সেই রাশির জাতক ধরা হয়। বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে ছকে চন্দ্রের অবস্হান দেখা হয়। হেনরি মিলারের মেষ লগ্ন ( Aries rising ) পঞ্চম ঘর বা ( 5th house-- লেখক, সৃজনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা ) এর অধিপতি হিসাবে বেস্ট বেনেফিক প্ল্যানেট সূর্য বসে আছে নবম ঘর বা ভাগ্যস্হানে। দারুণ পজিশান। কিন্তু এই নবম ঘরে সূর্যের সঙ্গে কনজাঙ্কশান হয়েছে বুধের। বুধ মেধার কারক গ্রহ হলেও মিলারের ছক অনুসারে 6th house-এর অধিপতি। 6th house থেকে বাধাবিপত্তি, বিরোধিতা, মামলা-মকদ্দমা, সন্মানহানি ইত্যাদির বিচার হয়। তাই লেখকজীবনে মিলারেকে এসবেরই সন্মুখীন হয়ে এগোতে হয়েছে। মেষ লগ্নের জাতক হিসাবে হেনরি মিলারের ছকে শনি হলো দশম ( house of profession ) ও একাদশ ( house of gain ) এই দুই ঘরের অধিপতি। যোগকারক গ্রহ। কিন্তু এদেশীয় জ্যোতিষ সিদ্ধান্ত অনুসারে মেষ লগ্নের জাতকের পক্ষে শনি “বাধক গ্রহ”। এর দশা ও অন্তর্দশায় কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায় না। ১১ জুন ১৯০৭ থেকে ১১ জুন ১৯২৬ এই উনিশ বছর হেনরি মিলার শনির মহাদশা ভোগ করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভ পর্যন্ত তাঁর প্যারিসে বসবাসের সময়ে কার্জকরী ছিল ম্যালেফিক প্ল্যানেট মহাদশা ও সর্বোপরি শনির সাড়ে সাতির ( সাড়ে সাত বছর ব্যাপী শনির নিদারুণ গোচরকাল ) ভাগ্যকাল ছিল ১৭ই নভেম্বর ১৯২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯২৮ যা নানাভাবে ট্রপিক বই দুটির ন্যারেটিভকে প্রভাবিত করে থাকবে। হেনরি মিলারের ছকে শনি বসে আছে সেই বিরোধিতা ও মামলা-মোকদ্দমার ঘর ষষ্ঠ ঘরে যার অধিপতি হলো বুধ। এই শনিকে পঞ্চম পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে দ্বিতীয় ঘরে বসে থাকা বাধা বিরোধিতা ও মকদ্দমার অন্যতম কারকগ্রহ রাহু। এই রাহু নবম পূর্ণ দৃষ্টিতে প্রফেশন ঘরে বসে থাকা শুক্রকে দেখছে ও কলুষিত করছে। শুক্র প্রেম রোমান্স ও যৌনতার কারক গ্রহ। সপ্তম ঘর হলো বিয়ে, যৌনসঙ্গিনী, যৌনাঙ্গ ও জুয়াখেলার ঘর। সেই ঘরে ফায়ারি ও ভায়োলেন্ট মঙ্গল গ্রহ ঝড় তুলেছে ও নানা যৌনসম্পর্কের অভিজ্ঞতায় জাতককে লিপ্ত করেছে। সপ্তম ঘরের আগের ঘরে, অর্থাৎ ষষ্ঠ ঘরে শনি, ও সপ্তমের পরের ঘর অষ্টমে কেতু - এই দুই ম্যালেফিক প্ল্যানেটের মাঝে পড়ে দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়েছে। একে বলা হয় ‘পাপকার্তারি যোগ’। কার্তারি মানে কাঁচি। ১৯৬১ সালে আমেরিকায় ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ প্রকাশ পাবার পর অশ্লীলতার মকদ্দমা শুরু হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ১৯৬৪ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট যখন ওই অভিযোগ খারিজ করে বইটিকে সাহিত্যিক নিদর্শন হিসাবে মান্যতা দিলো, তখন কিন্তু শুক্রের মহাদশায় শনিরই অন্তর্দশা চলছিল। অর্থাৎ বাধক গ্রহ শনি বাধা তো দিয়েছে তার স্বভাবসিদ্ধ চরিত্রে, কিন্তু ‘যোগকারক’ গ্রহ হিসাবে হেনরি মিলারের পক্ষে রায় এনে দিয়েছে, তার নিজের অন্তর্দশায়।”
গৃহযুদ্ধরত স্পেনে যাবার পথে প্যারিসে মিলারের সঙ্গে পরিচয় হয় জর্জ অরওয়েলের। ১৯৪০ সালে জর্জ অরওয়েল তাঁর “ইনসাইড দি হোয়েল” গ্রন্হে মিলার সম্পর্কে লিখেছেন, “আমার মতে গত কয়েক বছরে ইংরেজিভাষী দেশগুলোর মাঝে আবির্ভুত হয়েছেন কল্পনাশক্তির অধিকারী এই একমাত্র গদ্যলেখক। সে-কথাকে যদি বাড়াবাড়ি মনে করে বিরোধিতা করা হয়, এ-কথা স্বীকার করতে হবে যে মিলার আচমকা সাধারণের মধ্যে থেকে দেখা দিয়েছেন, যাঁর দিকে একবারে বেশি তাকিয়ে দেখতে হবে ; এবং সর্বোপরি তিনি সম্পূর্ণরূপে একজন বিরুদ্ধবাদী, অগঠনশীল, অনৈতিক লেখক, একজন সামান্য দুর্ভাগ্য-আনয়নকারী, যিনি বিনা বাধায় অমঙ্গল মেনে নেন, ঠিক যেন লাশের মাঝে একজন হুইটম্যান”। অরওয়েল আরও লিখেছেন, ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ যখন প্রকাশিত হল, সে সময়ে ইতালীয় সৈন্যরা আবিসিনিয়ায় কুচকাওয়াজ করছে, হিটলারের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পগুলো ভরে গাদাগাদি। ভাবা যায় না যে এরকম একটা সময়ে ল্যাটিন কোয়ার্টারে মদখোর মার্কিন ভবঘুরেদের সম্পর্কে অসাধারণ একটি উপন্যাস লেখা হবে। একথাও ঠিক যে জরুরি নয় যে ঔপন্যাসিককে সরাসরি সমসাময়িক ইতিহাস সম্পর্কে লিখতে হবে, কিন্তু একজন ঔপন্যাসিক যিনি তাঁর সময়ের জনগণের প্রধান ঘটনাবলীকে অস্বীকার করছেন তাঁকে লোকে বাতিল বা মূর্খ বলে মনে করবে। ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ বইয়ের স্রেফ বিষয়বস্তুর কথা যদি ভাবা হয় বেশির ভাগ লোকই তাকে মনে করবে বিশ শতকের লেখালিখির যৎসামান্য দুষ্টু প্রয়োগ। সত্যি কথা বলতে, যাঁরা বইটি পড়েছেন, এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে এটি একটি অসাধারণ কাজ। কী জন্য অসাধারণ ? তা এই জন্য যে মিলারের নতুন জগত মেলে ধরার গুণে গুণান্বিত, সে জগত অদ্ভুত অচেনা নয়, সে জগত আমাদের অতিপরিচিত। তিনি ইংরেজি ভাষাকে ব্যবহার করেছেন ঠিক যেভাবে তা বলা হয়, এবং বাগাড়ম্বর ও অচেনা কবিত্ব ফলাচ্ছেন না বলে ভয় পাননি। তাঁর গদ্য স্রোতোময়, ছন্দে উথলে ওঠে, কেননা তিনি হুইটম্যানের মতনই বলছেন, ‘আমি মেনে নিই’।
চার
‘ক্যানসার’, ‘ব্ল্যাক স্প্রিঙ’ এবং ‘ক্যাপ্রিকর্ন’ সিরিজের পর যে বইগুলো পাঠকদের প্রিয় হয়ে ওঠে সেগুলোও প্যারিসে প্রকাশিত হয়েছিল, ‘সেক্সাস’ ( ১৯৪৯ ), ‘প্লেক্সাস’ ( ১৯৫৩ ) ও ‘নেক্সাস’ ( ১৯৬০ ), যে বইগুলো ‘দি রোজি ক্রিসিফিকশান’ নামে পরিচিত। এর মাঝে মিলারের আরও অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল প্যারিসের অভিজ্ঞতা নিয়ে চটি “ম্যাক্স অ্যান্ড দি হোয়াইট ফ্যাগোসাইটস”, ছোটো-ছোটো গদ্য, কাহিনিমিশ্রণে ম্যাক্স নামের এক ভবঘুরে, প্যারিস শহরের দ্রুতগামী ছবি, ইহুদি দর্জি ইত্যাদি মিলিয়ে যে নাগরিক বিশৃঙ্খলা। তাছাড়া হ্যামলেট, জয়েস, মার্সেল প্রুস্ত নিয়ে সোল্লাস নিবন্ধ।
আরেকটি চটি বই, ছোটো-ছোটো গদ্যের, “দি কসমোলজিকাল আই” প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। এই বইতে “ম্যাক্স অ্যাণ্ড দি হোয়াইট ফ্যাগোসাইটস” আর “ব্ল্যাক স্প্রিঙ” থেকে নেয়া কাহিনি-টুকরো আছে। মিলার লিখেছিলেন এগুলো যখন তিনি “ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন” লেখেন, প্যারিসে ভিলায়, সেসময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলেন লরেন্স ডিউরেল। কোনো বিশেষ জনারে বর্গীকরণ করা যায় না গদ্যগুলোকে। ভবঘুরে ম্যাক্স এসেছে মিলারের স্মৃতিতে আর আত্মজীবনীমূলক দর্জির দোকান, কিন্তু ন্যারেটিভে তাঁর বিশেষ ধরণের গদ্যকে নিয়ে যেতে ভোলেননি মিলার। দার্শনিক কথাবার্তা বলার সময়ে আশ্রয় নিয়েছেন পরাবাস্তববাদী গদ্যে, শব্দ নিয়ে খেলায়। আসলে মনের আর দেহের জীবন নিয়ে, জনগণকে নিয়ে, আইডিয়া আর কল্পনা নিয়ে লিখেছেন মিলার
১৯৩৯ সালে মিলার প্যারিস ছাড়লেন, যে শহরে তিনি টানা দশ বছর ছিলেন, এবং গ্রিসের উদ্দেশে এক দীর্ঘ পর্যটনে বেরোলেন। প্রথমে তিনি ছিলেন তাঁর গুণগ্রাহী পাঠক ও বন্ধু লরেন্স ডিউরেলের করফুর বাড়িতে, তারপর দেখতে বেরোলেন পেলোপনেসাস, আথেন্স, ক্রিট, ডেলফি, প্রাচীন মায়সিন এবং কাওসোস। “দি কলোসাস অফ মারৌসি” ( ১৯৪১ ) বইতে পৌরাণিক জায়গাগুলো ভ্রমণের যে বৃত্তান্ত তিনি তুলে ধরলেন, তা তাঁর পুনর্জন্ম ও রূপান্তরণের খতিয়ান। আলোচকদের মতে বইটির ‘কলোসাস’ হলেন গ্রিক লেখক জর্জ কাটসিমবালিস। হেনরি মিলার গ্রিসে যাবার পর একটি কবি-লেখক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। লরেন্স ডিউরেল মিলারকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন জর্জ সেফেরিস, জর্জ কাটসিমবালিস, দিমিত্রিস অ্যানটোনিওস, থিওডোর স্টেফানিডেস, কনস্ট্যানটাইন সাতোস, নিকোস হাটজিকিরিয়াকোস-গিকার প্রমুখের সঙ্গে। বইটি বন্ধুত্বের উৎসব, বন্ধুদের মাধ্যমে হেনরি মিলারের নিজের চরিত্রচিত্রণ।
“দি কলোসাস অফ মারৌসি”তে আছে তিনটি পর্ব। প্রতিটিই “পাশ্চাত্য সভ্যতার নাভিকেন্দ্র” কোনো ধ্বংসাবশেষে, যাদের পৌরাণিক নাম তারা এখনও বজায় রেখেছে : মায়াসেনা, নোসোস, ডেলফি। প্রতিটি স্হানের রয়েছে মহিমান্বিত স্হৈর্য, তাদের শরীরে ধ্বংসের চিহ্ণ, তা সত্ত্বেও তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে নিজেদের শৌর্যে। মিলার দ্যাখেন কোথায় অ্যাগামেমননকে তার স্ত্রী হত্যা করেছিল, আর অ্যাগামেমননের ছেলে হত্যা করেছিল তার মাকে। গ্রিসে পাঁচ মাস মিলারের জীবনে শান্তি এনেছিল, এবং “দি কলোসাস অফ মারৌসি”তে তিনি শান্তিময় অবদান খুঁজে পেয়েছেন প্রাচীন গ্রিসের ঐশ্বর্যময় ইতিহাসে, সেই সময়ের বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপে, একগুঁয়েপনায়, সাহসে এবং বর্তমানের বিশুদ্ধ প্রান্তরে, সুস্পষ্ট ফিকে আলোয়, চোখধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যে, শাশ্বত অন্তরজগতে, সাধারণ মানুষের প্রশ্নহীন বন্ধুত্বে।
কেটি মাসুগা তাঁর “হেনরি মিলার অ্যাণ্ড হাউ হি গট দ্যাট ওয়ে” বইতে মিলারের বিদেশ-স্বদেশের দ্বিবিভাজিত সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে তাঁকে আর্তুর র্যাঁবোর সঙ্গে তুলনা করেছেন। স্বদেশ ছেড়ে যাবার আগে লেখা “ব্যাড ব্লাড” কবিতায় র্যাঁবোও লিখেছিলেন “আমি আমার স্বদেশকে অপছন্দ করি।” র্যাঁবো লিখেছিলেন তাঁর ত্বকের রঙের পরিবর্তনের কথা, হাত বদলে লোহার হাত হয়ে যাবার কথা। র্যাঁবোর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে ভালোবাসতেন মিলার। পরে তিনি র্যাঁবোকে নিয়ে লিখেছিলেন “দি টাইম অফ দি অ্যাসাসিনস”।
তাঁর গ্রিক ইপিফ্যানির বয়ান তিনি বইটিতে এইভাবে করেছেন : “আমি জানতুম না যে পৃথিবীতে এতোকিছু আছে ; আমি চোখবাঁধা অবস্হায় হাঁটতুম; ঠিক মতন পা পড়ত না ; আমি ছিলুম আত্মগর্বী আর উদ্ধত, শহুরে মানুষের কৃত্রিম, সীমাবদ্ধ জীবনযাপনে সন্তুষ্ট। গ্রিস আমার চোখ খুলে দিলো, প্রবেশ করল আমার রোমকূপে, আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্বের ব্যাখ্যা যোগালো, জগতসংসারে আমি নিজের বাড়িতে ফিরলুম, সত্যিকারের কেন্দ্রে, আর বিপ্লবের প্রকৃত মর্মার্থ জানতে পারলুম।”
গ্রিসকে মিলার বলেছেন, “পবিত্র ভূমি”। তিনি প্রত্নতাত্বিক ঐতিহাসিক জায়গা ভ্রমণের কাহিনি লিখতে চাননি, লিখতে চেয়েছেন পবিত্র ভূমির অতীতের সঙ্গে তাঁর একাত্ম হবার বয়ান। তখন তাঁর সাতচল্লিশ বছর বয়স, প্যারিসের সস্তা কাফে আর মাঝরাতের মোদো হুল্লোড় থেকে বেরিয়ে পড়েছেন আত্মানুসন্ধানে।
সত্যিকারের কেন্দ্র খুঁজে পেলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে গ্রিসে বেশিদিন থাকতে পারলেন না মিলার। ১৯৪১ সালে, যে বছর “দি কলোসাস অফ মারৌসি” প্রকাশিত হলো, মিলার মোটরগাড়ি করে স্বদেশকে দেখতে বেরোলেন, মার্কিন আত্মপরিচয়ের সন্ধানে বেরোলেন। আমেরিকা ঘোরার অভিজ্ঞতা হলো গ্রিসে তীর্থযাত্রার সম্পূর্ণ বিপরীত। “দি কলোসাস অফ মারৌসি”কে যদি বলা যায় গ্রিক সভ্যতা, সেখানকার মানুষ, তাদের একক প্রতিভা, জ্ঞান, এবং জীবনদর্শনের প্রতি মিলারের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, তাহলে “দি এয়ারকাণ্ডিশাণ্ড নাইটমেয়ার”কে বলতে হবে মার্কিন সমাজ সম্পর্কে মিলারের তিক্ত অভিজ্ঞতার বয়ান, মার্কিন জীবনধারার সমালোচনা, পপুলার কালচার, প্রযুক্তির প্রকোপ এবং সর্বব্যাপী ভোগবাদের প্রতি ঘৃণা।
১৯৪০ সালে আমেরিকার নানা জায়গা চষে বেড়িয়ে মিলার ফিরলেন নিউ ইয়র্কে, এই পর্যটন নিয়েই তাঁর বই “দি এয়ার কানডিশাণ্ড নাইটমেয়ার” প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৫ সালে, এবং যে বইটি আমেরিকায় প্রকাশে কোনও অসুবিধা ছিল না অথচ বইটিতে রয়েছে মার্কিন সমাজের তুমুল সমালোচনা। বইটির দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, “রিমেম্বার টু রিমেম্বার” নামে। ফ্রান্স থেকে যখন আমেরিকায় মিলার ফিরলেন, শীততাপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রকে তিনি রূপক হিসাবে এবং মানবজীবনের হতাশাজনক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণরূপে চিহ্ণিত করলেন। বইটির প্রতিটি অধ্যায় বিশেষ একটি মার্কিন এলাকা নিয়ে, এবং আলো ফেলেছেন সেই জায়গার কোনো সৃজনশীল অবহেলিত মানুষের ওপর। এগুলো ছোটোগল্প বা রম্যরচনা নয়, এগুলো পরিলেখের পর্যায়ে পড়ে। বইটিতে মিলার কখনও গভীর চিন্তা প্রকাশ করেছেন, কখনও ঠাট্টা-ইয়ার্কি, কখনও কবিত্ব, কখনও এলিটিস্ট দৃষ্টিতে তাঁর গদ্যবিস্ফোরণ। পর্যটনের সময়ে তিনি শেরউড অ্যাণ্ডারসন এবং জন ডস প্যাসস-এর সঙ্গে দেখা করেন।
বর্তমান কালখণ্ডের প্রেক্ষিতে বইটিতে মিলারের বিশ্লেষণগুলোকে মনে হয় ভবিষ্যবাণীর মতন। প্রযুক্তিদানবের কাছে আমেরিকার আত্মসমর্পণ তখনই চোখে পড়েছিল মিলারের, ১৯৩০ দশকের অর্থনৈতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও। মিলারের চোখে পড়ল নতুন শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল কারখানাগুলো, যার বাবুকর্মী আর শ্রমিককর্মীরা সবাই গাড়ি ধারে কিনে আর চালিয়ে দূর-দূরের কাঁচের অট্টালিকায় একঘেয়ে ভোঁতা বুদ্ধিহীন কাজ করার জন্য দৌড়োচ্ছে। হোটেলে বা কারোর বাড়িতে, কণামাত্র ধূলিহীন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে তিনি মনমরা বোধ করেছেন, ভয় ভর করেছে তাঁকে, আক্রান্ত হয়েছেন দুঃস্বপ্নে।
তাঁর পর্যটনে তিনি আশার আলো দেখতে পেলেন কয়েকজন ব্যতিক্রমী মানুষের জীবনে, যাদের কথা তিনি লিখেছেন, তাঁরা সাধারণ মানুষ অথবা শিল্পী কিন্তু অসাধারণ কিছু সন্ধান করে চলেছেন। বইটির শেষে একটি সংযোজন রয়েছে গাগেনহাইম ফেলোশিপ সম্পর্কে যা থেকে এই শিল্পীরা বঞ্চিত। মিলার লিখেছেন, “আমেরিকা কোনো শিল্পীর বসবাসের যোগ্য নয় ; শিল্পী হতে হলে হতে হবে নৈতিক কুষ্ঠরোগী, অর্থনৈতিকভাবে বেমানান মানুষ, সামাজিক দায়।” মিলার মনে করেন আমেরিকা আত্মাহীন হয়ে গেছে, ভোগবাদী জিনিসে সবাই ডগমগ, নিজেই নিজের ক্রীতদাস হয়ে উঠেছে মানুষ, যা থেকে তার মুক্ত হওয়া জরুরি।
আণবিক বোমা জাপানে ফেলা হবে তার কয়েক বছর পরে, কিন্তু মিলার দেখলেন যে প্রতিটি দেশই চালিত হচ্ছে একনায়কদের দ্বারা, পার্থক্য এই যে মার্কিন একনায়কের অনেকগুলো মাথা আছে হায়ড্রার মতন। বইটির বহু অংশ অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের মতন ঘটনার আগাম হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছে ; মিলার বুঝে ফেলেছিলেন আসন্ন যুদ্ধের পরবর্তী ব্যবস্হা কেমনতর হতে চলেছে। রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ধরা পড়ে না বইটিতে, একনাগাড়ে মার্কিন ব্যবস্হার সমালোচনা করে চলেছেন, কাউকে রেয়াত করছেন না। মার্কিন শহরগুলোকে ঈশ্বর-বর্জিত গহ্বর বলার পরও সেখানে গর্ব করার মতন যৎসামান্য উপাদান পাচ্ছেন।
আরেকটা ভয়ংকর আশঙ্কার বার্তা রয়েছে বইটির নামকরণে, যদিও তাঁর পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না যে আণবিক অস্ত্রশস্ত্রের জন্যে কী পরিমাণ শীততাপ প্রয়োজন আর সেই শীততাপের জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ আর সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কতো কার্বন আকাশে মিশিয়ে দেয়া হবে।
বইটিতে মিলার বারবার স্বামী বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ এনেছেন এবং বলেছেন, বিবেকানন্দ ছিলেন “এই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্ত। উপস্হিত জনগণের মুখের দিকে তাকিয়েই বিবেকানন্দ টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে তারা উপযোগীতাবাদী জীবনে আক্রান্ত।” মিলার বইটা লিখছিলেন ১৯৪০-১৯৪১ সালে, কিন্তু চিহ্ণিত করতে পেরেছিলেন গণমাধ্যমের দেউলিয়াপনা। তখন তো টিভি, ইনটারনেট ইত্যাদি আসেনি। মিলার বলেছেন সংবাদপত্র হলিউড রেডিও আর ডিজনির কথা ; তথাকথিত প্রগতির মৃত্যুদুন্দুভি শুনতে পাচ্ছিলেন। বিবেকানন্দ সম্পর্কে মিলার রমাঁ রলাঁর লেখা বই পড়েছিলেন।
মিলার বলেছেন, “আমরা নিজেদের বন্ধনমুক্ত জনসমুদায় ভাবতে অভ্যস্ত ; আমরা বলি যে আমরা গণতান্ত্রিক, স্বাধীনতাপ্রেমী, ঘৃণামুক্ত ও পক্ষপাতহীন। এটা নাকি এমন পাত্র যেখানে এসে সবাই গলে গিয়ে মিলেমিশে যায়, মানবনিরীক্ষার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স্হান। শব্দগুলো শুনতে বেশ ভালো, উদার, আদর্শবাদী অনুভূতিতে ভরপুর। আসলে, আমরা একদল ইতর, মারকুটে ভিড়, যাদের রাজনৈতিক ভাষণবাজিঅলারা, সংবাদপত্র, জনগণ, ধর্মের ধ্বজাধারীরা, খেপিয়ে তোলার লোকেরা, আর তেমন শক্তিরা সহজেই উসকে দিতে পারে। এমন একটা জমঘটকে মুক্তমানুষের সমাজ মনে করাটা ঈশ্বরনিন্দুক বকধার্মিকের বক্তব্য ছাড়া কিছুই নয়। বায়ুগ্রস্ত বিভ্রমে প্রচুর লুটের মাল সারা পৃথিবী থেকে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে জড়ো করে আনাকেই কি আমরা বলব প্রগতি এবং আলোকপ্রাপ্তি ?”
১৯৪১ সালে মিলার আরেকটি চটি বই লিখেছিলেন, “দি উইজডম অফ দি হার্ট”। “দি মিস্টিক ম্যাগাজিন” তাঁকে অনুরোধ করেছিল মনোবিদ ই. গ্রাহাম হাওয়ে সম্পর্কে লিখতে ; মূলত সেই রচনাটি এবং আরও কয়েকটি গদ্য একত্রিত করে বইটি প্রকাশিত হয়। তাঁর অতৃপ্ত লিবিডোর মতন মিলার একজন অতৃপ্ত পাঠকও ছিলেন। কয়েকটি গদ্য আলবেয়ার কামুর পর্যায়ের বলা যায়। কিন্তু তাঁর ‘ট্রপিকের’ ক্রোধ এই বইতেও মাঝে-মাঝে ঝলসে উঠেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা হল বালজাকের বিশ্লেষণ, শিল্পী হিসাবে বালজাকের অবস্হান এবং আধ্যাত্মিকতা।
“সানডে আফটার দি ওয়ার” প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে। বইটির অর্ধেক তাঁর আগের বই থেকে নেয়া টুকরো গদ্য। প্রথম দুটি গদ্য নিউ ইয়র্ক এবং হলিউডের মারাত্মক প্রভাব নিয়ে। ১৯৮০ সালে ‘নিউ রিপাবলিক’ পত্রিকায় বইটির আলোচনা করতে গিয়ে নিকোলা চিয়ারোমনটে বলেছেন, এই বইতে ‘রিটার্ন টু ব্রুকলিন’ একটি মাস্টারপিস গদ্য। তিনি বলেছেন যে এই গদ্যে পরিবারের একজন সাধারণ সদস্য হিসাবে মিলারকে পাওয়া যায়, যে মিলার ‘আমি’ নামে উপন্যাসর কোনো কৃত্রিম চরিত্র নয়, বা হেনরি মিলার নামের কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়, যার আড়ালে তাঁর জীবন সম্পর্কে তথ্য লুকিয়ে রাখা যেতে পারে, এই গদ্যের মিলার তাঁর বাবা-মায়ের ছেলে, বোনের দাদা, যে নির্বাসনের জীবন থেকে দশ বছর পর পরিবারে ফিরেছে। লুই ফার্দিনান্দ সেলিন তাঁর পরিবার নিয়ে অসাধারণ কয়েকটি অংশ লিখেছেন “জার্নি টু দি এন্ড অফ দি নাইট” উপন্যাসে, কিন্তু সেলিন পরিবার সম্পর্কে ইতস্তত, হীনম্মন্য ; নিজের পরিবারকে সেলিন ঘৃণা করতেন, তাঁর মনে হতো পরিবার তাঁর বিরোধী, পরিবারের প্রতি তাঁর বিদ্রোহে শ্রদ্ধা নেই। মিলারের গদ্যে পরিবারের প্রতি ঘৃণা নেই, বিদ্রোহও নেই। মিলারের মনে হয়েছে মরণোন্মুখ সমাজের অসহায় কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে প্রতিটি পরিবার। এই গদ্যের প্রধান চরিত্র মিলার নন, প্রধান চরিত্র হল পারিবারিক সম্পর্ক।
এছাড়া “সানডে আফটার দি ওয়ার” বইতে আছে যুদ্ধ, শিল্প, প্রযুক্তি, সমাজে নারীর ভূমিকা এবং মানবসমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ব্রুকলিনে পরিবারে ফেরা নিয়ে তাঁর রচনায় লুই ফার্দিনানন্দ সেলিনের মতন তিক্ততা নেই মিলারের। মিলার এই চটি বইগুলো প্রকাশ করছিলেন, কেননা তখনও পর্যন্ত তাঁর বিখ্যাত বইগুলো আমেরিকায় নিষিদ্ধ ছিল এবং যুদ্ধের ফলে ইউরোপ থেকে রয়ালটি আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর ফরাসি প্রকাশকেরও মৃত্যু হয়েছিল, যে কারণে বইগুলো অন্য প্রকাশকের হাতে যায়। ১৯৪৩ সালে তিনি প্রায় তিনশো ওয়াটারকালার এঁকেছিলেন, যা থেকে কিঞ্চিদধিক আয় হতো।
১৯৪৫ সালে, “এয়ারকাণ্ডিশাণ্ড নাইটমেয়ার”-এর পাশাপাশি প্রকাশিত হয় মিলার, তাঁর প্যারিসে থাকাকালীন মার্কিন বন্ধু হিলায়ের হিলার এবং মার্কিন নাট্যকার উলিয়াম সারোয়ান-এর ‘বিমূর্ত ছবি-আঁকা নিয়ে কথোপকথন, “হোয়াই অ্যাবস্ট্র্যাক্ট”। হিলার ছিলেন পেইনটার, ছবি-আঁকার তাত্ত্বিক, মনোবিদ এবং পেইনটিঙে রঙ বিষয়ক পরামর্শদাতা। আঁকায় হাত দেবার আগে হিলারের বাড়ি গিয়েছিলেন মিলার ওয়াটার কালারিঙ সম্পর্কে জানার জন্য। তারপর তিনজন একত্রে বসে তাঁরা বিমূর্ত আঁকার টেকনিক, সমাজ ব্যবস্হায় সৃজনশীল পেইনটারের ভূমিকা, “প্রতিভা” বলতে কি বোঝায় এবং তার প্রকৃতি, ছবি আঁকায় বিজ্ঞানের নব-নব প্রভাব, রাজনীতি ও ছবি-আঁকার সম্পর্ক ইত্যাদি আলোচনা করেছিলেন।
জঁ আর্তুর র্যাঁবো, যাঁকে হেনরি মিলার মনে করতেন তাঁর সবচেয়ে কাছের সৃজনশীল মানুষ, তাঁকে কেন্দ্র করে নিজের কথা বলেছেন মিলার ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত তাঁর “দি টাইম অফ দি অ্যাসাসিনস” গ্রন্হে। মিলার লিখেছেন, “র্যাঁবো আঠেরো বছর বয়সে তাঁর জীবনের ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখি হন, যখন তিনি উন্মাদ হবার কিনারায় পৌঁছে গেছেন ; এর পর থেকে তাঁর জীবন এক সীমাহীন মরুভূমি। আমি আমার জীবনে সেই অবস্হায় পৌঁছেছিলুম যখন আমার বয়স ছত্রিশ কি সাঁয়ত্রিশ, যে বয়সে র্যাঁবো মারা গিয়েছিলেন। এই সময় থেকে আমার জীবন পল্লবিত হতে থাকে। র্যাঁবো সাহিত্যে থেকে জীবনের দিকে চলে গেলেন; আমি করলুম ঠিক তার উল্টো। র্যাঁবো নিজে যে দানবিক জগত সৃষ্টি করেছিলেন তা থেকে পালিয়ে গেলেন। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে নিলুম। জীবনের নিছক অভিজ্ঞতার জঞ্জাল আর ভাগ্যের মার খেয়ে আমি থিতু হলুম, আমি থমকে দাঁড়ালুম, আর পুরো কর্মশক্তি লাগিয়ে দিলুম সৃজনশীলতায়। যে উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে জীবনে আমি ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়েছিলুম, ঠিক সেভাবেই আমি লেখালিখিতে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। জীবনকে হারাবার বদলে, আমি তাকে আবিষ্কার করলুম ; অলৌকিক ঘটনার পর অলৌকিক ঘটনা ঘটতে লাগলো, প্রতিটি দুর্ভাগ্যকে সুকর্মে পালটে ফেলতে পারলুম। র্যাঁবো যতোবেশি প্রবেশ করতে লাগলেন অবিশ্বাস্য জলবায়ু এবং ভূদৃশ্যে, কল্পজগতের মতো অদ্ভুত ও বিস্ময়কর, তাঁর কবিতা ততো তিক্ত, দুঃখময়, ফাঁকা আর নির্বাক হয়ে উঠতে লাগল।”
মিলার লিখেছেন, “র্যাঁবো সাহিত্যকে জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; আমি চেষ্টা করে গেছি জীবনকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা করতে। আমাদের দুজনের ক্ষেত্রেই স্বীকৃতির বনেদ আছে বৈশিষ্ট্য হিসাবে, সবার ওপরে রয়েছে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আবিষ্টতা। সাহিত্যের চেয়ে ভাষার ও সঙ্গীতের জন্য যে বিচারবিবেচনা, তা আমাদের দুজনেরই এক। তাঁর অন্তস্হলের আদিম প্রকৃতি যে স্বাভাবিকতায় উৎসারিত হয় তার সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছি আমি। পল ক্লদেল বলেছিলেন, ‘র্যাঁবো হলেন আরণ্যক অতীন্দ্রিয়বাদী’। এর চেয়ে ভালোভাবে তাঁকে বর্ণনা করা যায় না। তিনি কোনোকিছুর অংশ বা অঙ্গীভূত ছিলেন না -- কোনো পরিসরেই নয়। আমারও নিজের সম্পর্কে একই রকম অনুভূতি হয়েছে। গুণে শেষ করা যাবে না আমাদের সাদৃশ্য। আমি মনে করি না আমি এ-ব্যাপারে একক ; আমি মনে করি এই পৃথিবীতে অসংখ্য র্যাঁবো আছেন, এবং সময়ের সঙ্গে তাঁদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটতে থাকবে। আমি মনে করি ভবিষ্যতে হ্যামলেট টাইপ আর ফাউস্ট টাইপ মানুষকে সরিয়ে দেখা দেবেন র্যাঁবো টাইপ মানুষেরা। গভীর বিভাজনের দিকে এগিয়ে যাবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যতো দিন না পুরোনো জগতের মৃত্যু ঘটছে, ‘অস্বাভাবিক’ ব্যক্তিরা হয়ে উঠতে থাকবে আদর্শ। নতুন ব্যক্তি নিজেকে তখনই আবিষ্কার করবে যখন সামুহিকের সঙ্গে ব্যক্তির যুদ্ধ থেমে যাবে। তখনই আমরা দেখতে পাবো মানব টাইপের ব্যক্তিকে তার পরিপূর্ণতায় এবং উজ্জ্বল দীপ্তিতে।”
“দি স্মাইল অ্যাট দি ফুট অফ দি ল্যাডার” বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে এবং পরিবর্ধিত সংস্করণ ১৯৫৯ সালে। কিউবিস্ট পেইনটার ফারনান্ড লেগার বেশ কিছু ক্লাউনের ছবি এঁকে হেনরি মিলারকে অনুরোধ করেছিলেন ক্লাউনদের নিয়ে একটা গল্প লিখে দিতে। মিলার যে গল্পটি লিখলেন তা লেগারের পছন্দ হলো না। মিলার নিজে জলরঙ আঁকতেন, তিনি গল্পটির জন্য ক্লাউনের ছবি এঁকে বইটি প্রকাশ করলেন। গল্পটি অগুস্টে নামে একজন ক্লাউনকে নিয়ে, তিনি বললেন যে একজন ক্লাউন হল সক্রিয় কবি, সে যে কাহিনি অভিনয় করে সে আসলে নিজেই সেই কাহিনি। একজন ক্লাউন প্রকৃতপক্ষে আমাদের নিজের সম্পর্কে হাসতে শেখায়।
অগুস্তে প্রতি সন্ধ্যায় যে কাহিনিটি অভিনয় করে দেখাতো তাতে সে নিখুঁত হয়ে উঠেছিল। সে একটা সিঁড়ির সবচেয়ে তলাকার ধাপে বসে চাঁদে ঠেকে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে সেখানে পৌঁছোনোর অভিনয় করত, তার মুখে একটি স্মিত হাসি, ভাবতে বসে সে হারিয়ে গেছে চিন্তার জগতে, শেষে একটা শাদা ঘোড়া এসে তাকে আদর করে জাগিয়ে তুলত, যা দেখে দর্শকরা খুশিতে ডগমগ হতো, বারবার দেখতে আসতো। অগুস্তে এতে সন্তুষ্ট ছিল না, সে চাইছিল দর্শকদের সঙ্গে যাতে তার কল্পিত গল্পের সংযোগ ঘটে, আর তাদের ইচ্ছাপূরণ হয়। দর্শকদের তার এই নতুন কাহিনি ভালো লাগল না এবং শেষ পর্যন্ত অগুস্তের চাকরি গেল।
অগুস্তে অন্য একটা সার্কাসে সাধারণ কর্মচারীর চাকরি পেল। সেখানকার ক্লাউন আঁতোয়াঁর অসুখ করলে অগুস্তে তার বদলে অভিনয় করে দর্শকদের মনে আলোড়ন তুলল। অগুস্তে ভেবেছিল যে আঁতোয়াঁকে সে আনন্দ দিতে পারবে, আঁতোয়াঁকে অগুস্তে বুঝিয়েও ছিল যে ক্লাউনকে কিছুই করবার দরকার হয় না, যা মনে আসে তাই করো, সে যেমন সে যদি তেমনভাবেই নিজেকে উপস্হাপন করে তাহলে দর্শকরা আনন্দিত হয়। আঁতোয়াঁর অসুখ সারলো না, এবং তার মৃত্যু হল। অগুস্তে তার জায়গায় ক্লাউনের কাজ করতে পারলো না কেন না একদিন মাথার ওপর পুলিশের লাঠি খেয়ে তারও মৃত্যু হলো।
পাঁচ
১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হলো মিলারের “সেক্সাস”, তাঁর তিনটি বই নিয়ে “দি রোজি ক্রুসিফিকশন” সিরিজের প্রথম বই ; অন্য বই দুটো হলো “প্লেক্সাস” ( ১৯৫৩ ) এবং “নেক্সাস” ( ১৯৬০ )। নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে ছয় বছরের ইতিকথা, প্রথম স্ত্রী থাকতেও জুন ম্যান্সফিল্ডের সঙ্গে প্রেম, কসমোডেমনিক অফিসে চাকরি, লেখক হবার আপ্রাণ চেষ্টা আর নিউ ইয়র্কে সফল না হয়ে প্যারিস যাত্রা, এটাই তিনটি বইয়ের ঘটনাবলী যা মিলার নিজের জীবন থেকে নিয়ে তার সঙ্গে প্রচুর কল্পনা মিশিয়েছেন। “দি রোজি ক্রুসিফিকশন” বই তিনটে প্রথমে ফ্রান্স আর জাপানে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রোভ প্রেস “ট্রপিক” মামলা জিতে যাবার পর ১৯৬৫ সালে আমেরিকায় বই তিনটি প্রকাশিত হয়। প্যারিসে ওবেলিক্স প্রেস “সেক্সাস” প্রকাশ করলে তা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল, প্রকাশকের জরিমানা আর জেল হয়েছিল, যা পরে সাহিত্যিকদের ও পেইনটারদের চাপে নাকচ করা হয়।
‘ট্রপিক” ছিল তাঁর বর্তমান নিয়ে লেখা। “দি রোজি ক্রুসিফিকশান” বিশের দশকের ব্রুকলিনের দিনগুলোকে ফিরে দেখা। মিলার লিখেছেন, “আমি তেত্রিশ বছরের কাছাকাছি পৌঁছোচ্ছিলুম, যে-বয়সে যিশুখ্রিস্ট মারা যান।” মিলার যখন লেখকের বোহেমিয়ান জীবন কাটাবার জন্য প্যারিস রওনা হলেন, তখন পেছন ফিরে নিউ ইয়র্কের ক্রুসবিদ্ধ জীবন এবং প্যারিসে আবার জীবন ফিরে পাওয়াকে তিনি বলেছেন “রোজি ক্রুসিফিকশন”। তাঁর জীবনের এই নাটকীয় পরিবর্তন তাঁর লেখালিখির ভাবধ্বনির কাজ করেছে ; আত্মমুক্তি এবং বেঁচে থাকার সত্যের প্রাণচাঞ্চল্যের উৎসের কাজ করেছে।
“ট্রপিক” আমেরিকায় সহজলভ্য হবার পর মিলারের মনে হয়ে থাকবে যে যৌনসঙ্গম এবং যৌথফুর্তির ব্যাপারটা আরও বিশদ লিখে, পথচলতি যৌন-গালমন্দকে ন্যারেটিভে প্রয়োগ করে, সমাজের সীমাকে পরখ করে নেয়া যাক। হেনরি বা ভ্যাল নামের যুবকটি এই বইতে একের পর এক তরুণীর সঙ্গে সঙ্গম করেন, তাঁর বন্ধুনির নাম মারা, যে নাম বদলে মোনা হয়ে যায়, আর যাকে মিলার অত্যন্ত ভালোবাসেন, আর মিথ্যুক বলে মনে করেন, তার সঙ্গে সঙ্গমের গ্রাফিক বর্ণনা দ্যান, লিঙ্গ আর যোনির আকার-প্রকার বর্ণনা করেন, মনে হয় যে নারীরা তাঁর কাছে নারী নয়, কেবল লিঙ্গ ঢোকাবার মাল। জুন ম্যান্সফিল্ড, যাকে মিলার বলেছেন মারা, সে নিজের ইতিহাস সর্বদা পালটাতে থাকে, নাম পালটে হয়ে যায় মোনা, তার জন্মস্হানের গল্প পালটায়, মায়ের গল্প পালটায়, খাদ্যাভ্যাস পালটায়, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাও পালটায়।
যৌন কর্মকাণ্ডের মাঝে-মাঝে মিলার আচমকা জীবনের গতিপ্রকৃতি, সৃজনশীলতা, আনন্দ এবং নৈতিকতা নিয়ে গুরুগম্ভীর কথাবার্তা আরম্ভ করেন। যোনি, লিঙ্গ, যৌনকর্মের রকমফের বিশদে বর্ণনায় তাঁর কোনো ইনহিবিশান বা নৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে বিভিন্ন চরিত্রের আচরণ মনে হয় ইচ্ছাকৃতভাবে হাস্যকর। মনে হয় আত্মজীবনীমূলক গাঁজাখুরির উড়াল। মিলারকে দেখতেও হলিউডের ফিল্মস্টারদের মতন নয়, কিন্তু তিনি যুবতীদের আকর্ষণ করে চলেছেন আর যৌনকর্ম করে চলেছেন তাদের সঙ্গে। তখনও পর্যন্ত গর্ভনিরোধক বড়ি বাজারে আসেনি যে যুবতীরা যৌনসঙ্গমের ফলাফলের আতঙ্ক থেকে মুক্ত হবেন। পড়তে-পড়তে মনে হয় মিলারের জীবনে নারী আর মদখোরদের বড্ডো ভিড়, লেখালিখির জন্য যে একাকীত্ব দরকার তা পেতেন কখন !
“সেক্সাস” উপন্যাস হল প্রথম স্ত্রী, যাকে এই বইতে মিলার বলেছেন মড, তার কাছ থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী মারা পর্যন্ত সময়ের চৌহদ্দি। পিয়ানোবাদিকা মড, যাকে রক্ষণশীল দেখিয়েছেন মিলার, তার সঙ্গে যৌনকর্মের বর্ণনাই সবচেয়ে গ্রাফিক, সঙ্গমের সময়ে মডের যৌনচাহিদা বেশি, সঙ্গমের শেষে মিলার চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘হে যিশু আমি ফুরিয়ে গেছি, আর পারছি না’, তবে মিলার শব্দ নিয়ে অসাধারণ খেলা খেলেছেন মডের সঙ্গে সঙ্গমের সময়ে। মিলারের জীবনের উদ্দেশ্য হল যৌনতার মাধ্যমে পরমানন্দ, কিন্তু মাথার মধ্যে লেখক হবার ভাবনা ঘুর-ঘুর করতে থাকে, যৌনতার জন্য যে মেয়েই পাওয়া যাক কোনো বাদবিচার নেই। লেখক না হয়েও তাঁর বন্ধুদের চোখে তিনি একজন লেখক। “সেক্সাস” উপন্যাসের কড়া সমালোচনা করে গোর ভিডাল লিখেছিলেন, “প্রথমেই মেনে নিতে হবে যে একজন অহঙ্কারীই এরকম বই লিখতে পারে, যাতে হেনরি মিলারের মিষ্টি একঘেয়েমি ছাড়া আর কোনো বিষয়বস্তু নেই। একজন আত্মজ্ঞানবাদীর দিবাস্বপ্নের মধ্যেকার ছায়ার মতন, অন্য চরিত্ররা ন্যারেটিভের ভেতর ঢোকে আর মিলিয়ে যায়, বুড়ো আত্মপ্রদর্শনকারীর অবিরাম খেলার মতন, যার কারবার গত অর্থশতাব্দীতেও পালটায়নি। প্রথম ভঙ্গি : হেনরি মিলার, যৌনতার খেলুড়ে। দ্বিতীয় ভঙ্গি : হেনরি মিলার, সাহিত্যপ্রতিভা এবং জীবনীশক্তি। তৃতীয় ভঙ্গি : হেনরি মিলার এবং মহাজগত ( তাঁদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া আছে )।”
“প্লেক্সাস” বইটি মোনার সঙ্গে মিলারের বিয়ে, লেখক হয়ে ওঠার চেষ্টা আর কসমোডেমনিক টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে চাকরি ছেড়ে দেবার ঘটনা নিয়ে লেখা। এই বইতে “সেক্সাস”-এর মতন যৌনকর্ম বর্ণনার আধিক্য নেই, একটি যৌথ-যৌনহুল্লোড়ের বর্ণনা আছে, আরেকটি দৃশ্য কয়ারের গানের সময়ে একটি মেয়েকে পেছন থেকে যৌনসম্পর্কের কথা আছে। বহু শব্দ মিলার নিজেই তেরি করেছেন, অভিধানে পাওয়া যাবে না সেগুলো, বিশেষ করে বিশেষ্যকে বিশেষণে পালটে ফেলার খেলায়। শেষ বই “নেক্সাস”-এ মিলার নিজের বিবাহিত জীবনে বহিরাগত হয়ে যান যখন মোনা বাড়িতে তার বান্ধবী অ্যানাসতেসিয়াকে নিয়ে আসে ( জুন ক্রনস্কি ) আর দুই নারীর মাঝে নিকট সম্বন্ধ গড়ে ওঠে। তারা দুজনে মিলারকে একা ফেলে রেখে প্যারিস চলে যায়। প্যারিস থেকে মোনা ফিরে এলে মিলার আর মোনা দুজনে একসঙ্গে প্যারিসের জন্যে রওনা হন।
“দি রোজি ক্রুসিফিকশন” হলো আত্মজীবনীমূলক গল্পগাছা, সমালোচকদের অনেকে এই ট্রিলজিকে উপন্যাস বলতে নারাজ, ন্যারেটিভের সমায়ানুক্রম বা ঘটনাক্রমের যোগাযোগের বিশেষ বালাই নেই, লিখে গেছেন বিন্দাস, তাদের মাঝে যোগাযোগ বলতে কেবল মিলার নামের নায়কটির চেতনা। দ্বন্দ্বগুলো সরাসরি জীবনের ঘটনা থেকে বেছে নেয়া আর সেসব ঘটনা পার্থিব, জাগতিক -- টাকাকড়ির অভাব বা স্ত্রীর সঙ্গে অবনিবনা, বেশিরভাগ সময়ে চাইলেই সেসময়ে স্ত্রী সঙ্গমে রাজি নয় বলে ; অস্তিত্বের গভীরতা থেকে যাচাই করা নয়। দর্শন যখনই এসেছে তা কোনো দার্শনিকের ভাবনাচিন্তাকে ন্যারেটিভের ফাঁকে-ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন মিলার, রাস্তাছাপ গালমন্দ আর যৌন-বর্ণনার সঙ্গে তাল দেবার জন্য। মিলারের নীতি হলো, নিজের মতো করে জীবনে আনন্দ নাও, বাঁচো, বেঁচে নাও।
চরিত্র হিসাবে মিলার নিজের চারিপাশের লোকগুলোর বৈচিত্র্যের মজায় মশগুল, বেকায়দায় পড়েন, গোলমেলে পরিস্হিতি গড়ে ওঠে, কষ্ট সহ্য করেন, আপমানিত হন, কিন্তু কোনোকিছুকে পাত্তা না দিয়ে বেঁচে নেবার তত্ত্বে মাতালের মতন চুর। হোটেলে খেয়ে, দাম না চুকিয়ে, চুপচাপ কেটে পড়তেও দ্বিধা নেই মিলারের। মিলারের বন্ধু-বন্ধুনিরা তাঁকে শিক্ষিত বর্বর বললেও হেসে উড়িয়ে দ্যান। মোনা বা মারা চরিত্রটি বাদ দিলে মিলারের চরিত্ররা একমাত্রিক, তিনি যেমন দেখেছেন তেমনই তাদের তুলে এনেছেন “দি রোজি ক্রুসিফিকশন”-এর পাতায়, তাদের চরিত্রে লেখকীয় মাত্রা যোগ করেননি।
“নেক্সাস” বইয়ের শেষে তিনি স্বামী বিবেকানন্দের এই উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “একমাত্র পাপ হলো দুর্বলতা”। তাঁর এই জীবনযাপনকে “বোহেমিয়ান” বললে মিলার চটে যান। মিলার তাঁর লেখার প্রক্রিয়ার কথা বলেন, বই লেখার প্রথম কয়েকটি বিফল প্রয়াসের কথা বলেন, তথ্য যোগাড় করে গবেষণার কথা বলেন, প্রকাশক না পাওয়ার কথা বলেন, তাঁর বই হয়তো কখনও কেউ পড়বে না বা বইগুলোর প্রশংসা হবে না - এরকম আশঙ্কার কথা বলেন, তাঁর প্রিয় বইগুলোর কথা বলেন, মগজের মধ্যের কন্ঠস্বরের সাহায্যের কথা বলেন, মগজের ভেতরে একাধিক বই গড়ে ওঠার কথা বলেন, এক নাগাড়ে বলে চলেন।
অন্তস্হলের গভীর দর্শনের অভাবে মিলার বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানের নেকনজর তেমন পাননি যেমন তিনি আকর্ষণ করতে পেরেছেন, এমনকি প্রভাবিত করতে পেরেছেন, পরের প্রজন্মের কবি-লেখকদের। অ্যানাইস নিন, ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন যে মিলারের উপন্যাসে “সুপারস্ট্রাকচার” নেই। বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহ্য হবার জন্য এই “সুপারস্ট্রাকচার” জরুরি, যা কাফকা, প্রুস্ত, জয়েস, মার্কেজ, প্রমুখের উপন্যাসে থাকে, এবং তাকে কেন্দ্র করেই আলোচকদের বিদ্যায়তনিক আড়ম্বর তৈরি হয়।
আমেরিকায় “দি রোজি ক্রুসিফিকশন”-এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে ১৯৬৮ সালে বইটি আলোচনার সময়ে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ লিখেছিল, নিজের সম্পর্কে, প্রেম, বিয়ে এবং আনন্দ বিষয়ে পৃষ্ঠপট গড়ে তোলার জন্যে মিলার কামলালসা-লাম্পট্যের যৌনঘটনাবলীর আশ্রয় নিয়েছেন। ১৯৭০ সালে “প্লেক্সাস” সম্পর্কে ম্যাক্সওয়েল জিসমার লিখেছিলেন, “দি রোজি ক্রুসিফিকশান-এর কেন্দ্র হল প্লেক্সাস ; এই খণ্ডে মিলার নিজের মূল্যবোধ, মতামত, বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন, যখন তিনি ক্রুসিফায়েড হচ্ছিলেন সেই সময়কার এবং পরবর্তী সময়ে যখন তিনি এই বইটি লিখছিলেন। মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে মিলার তাঁর আবেগ, আইডিয়া, দূরদৃষ্টি, স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন খোলাখুলি বলেছেন এই বইতে, বলেছেন আমাদের আত্মার আশ্রয় হলো শিল্প।”
১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর “সেক্সুয়াল পলিটিক্স” গ্রন্হে কেট মিলেট, ডি এইচ লরেন্স ও নরমান মেইলারের পাশাপাশি হেনরি মিলারের সমালোচনা করে লেখেন যে মিলারের সাহিত্য কেবল যে পর্ণোগ্রাফির স্পষ্ট বর্ণনাশৈলীকে আত্তিকরণ করে নিয়েছে তা-ই নয়, তার সমাজবিরোধী চরিত্রকেও তোল্লাই দিয়েছে। “সেক্সাস” স্ক্রিপ্টের উপরিতলে নাটকীয়তা এনে্ছে হার্ড-কোর পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে এবং নারী সম্পর্কে তথাকথিত আপাত-রোমান্টিক তাড়নাকে বৈধতা দিয়েছে ; মিলার একজন প্রথম সারির নারীবিদ্বেষী। কেট মিলেট মিলারের ন্যারেটিভ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে মিলারের সাহিত্যে যৌনসঙ্গমে নারীকে দমিত ব্যক্তি হিসাবে উপস্হাপন করে হয়েছে, যা পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা-নকশাকে। যৌনকর্মকাণ্ডের রাজনীতি -- অর্থাৎ কার সঙ্গে এবং কোন পরিবেশে নারীকে যৌনসম্পর্কের অনুমতি দেয়া হচ্ছে -- তা পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা-নকশার অতিজরুরি অঙ্গ। অমন ক্ষমতা-নকশায় নারীকে কখনই নিজের প্রতিনিধিত্ব করতে দেয়া হয় না ; তারা পুরুষের যৌন স্বাধীনতাবোধের দ্বারা মুখ বন্ধ করে দেয়া মাল। মিলেট বলেছেন, মিলার হলেন নারীকে অবমাননা করার ও বিরাগ প্রকাশের কন্ঠস্বর, মিলার এমনই এক লেখক যার ন্যারেটিভ স্নায়বিক পীড়াগ্রস্ত বিরোধিতা এবং বিষাক্ত যৌনউষ্মায় ঠাশা।
ছয়
মিলার আটচল্লিশ বছর বয়সে ১৯৪০ সালে আমেরিকায় ফিরলেন, এবং মার্কিন মূল্যবোধ ও এবং নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানিবিরোধী লেখা বজায় রাখলেন। বিগ সার-এ বাড়ি নিয়ে শিল্পীদের কলোনি গড়লেন, এবং সেখানে বসেই লিখলেন তাঁর আরেকটি প্রশংসিত বই “বিগ সার অ্যান্ড দি অরেঞ্জেস অফ হায়ারোনজিমাস বশ”। তাঁর খ্যাতি বৃদ্ধির কারণে বিগ সার-এ প্রতিদিনই ভক্তদের ভিড় হতো, খ্যাতির বিড়ম্বনা বরদাস্ত করতে না পেরে, এবং প্রতিদিনের জনসমাগমের ফলে প্রতিবেশীদের নিন্দায় আক্রান্ত হয়ে, তিনি আর তাঁর স্ত্রী চলে গেলেন দক্ষিণ ক্যালিফর্নিয়ার প্যাসিফিক প্যালিসাডেস-এ থাকতে, এবং এখানেই জীবনের শেষ সতেরো বছর কাটিয়েছেন।
বই প্রকাশ বজায় রাখলেও বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হিসাবে মিলার তাঁর সময় কাটাতেন ছবি আঁকায়। প্রায় প্রতিদিন তাঁর পাঠকরা আর উদীয়মান লেখক-লেখিকারা জড়ো হতো তাঁর বাড়িতে। মিলার তাই একটা টেবল-টেনিসের খেলার ঘর রেখেছিলেন, ভক্তরা এসে তাঁকে প্রশ্ন-প্রশ্নে যাতে বিরক্ত না করে তাই তাদের পিংপং খেলতে ডাকতেন। তরুণীদের প্রস্তাব দিতেন পোশাক খুলে পিংপং খেলার, তাতেও তারা রাজি হয়ে যেতো, মিলার উলঙ্গ তরুণীদের সঙ্গে পিংপং খেলে ফালতু প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন। এটা তিনি প্যারিসে থাকার সময়ে পরাবাস্তববাদীদের কাছে শিখেছিলেন, যাঁরা উলঙ্গ তরুণীদের সঙ্গে দাবা খেলতেন।
১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় হেনরি মিলারের “দি বুকস ইন মাই লাইফ”। মারিয়া পোপোভা তাঁর “ব্রেইনস পিকিংস”-এ জানিয়েছেন যে মিলার ছিলেন গোগ্রাস পাঠক, এবং অন্যের ভাবনাচিন্তা ও আইডিয়া তুলে ব্যবহার করায় কুন্ঠিত বোধ করতেন না। মিলার মনে করতেন যে, “আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্হায় গলদ আছে। শিক্ষার তত্ত্ব এই বনেদের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে যে জলকে সামলাবার আগে একজনকে প্রথমে ডাঙায় সাঁতার কাটতে শিখতে হবে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন তেমনই শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয় এই মানদণ্ড।” “দি বুকস ইন মাই লাইফ” বইটি প্রকৃতপক্ষে মিলারের আত্মবীক্ষণ। তাঁর বার্তা হল, “পাঠককে প্রচুর বই পড়ার দরকার নেই ; আমি গবেষকদের ও বইপোকাদের মতন বই পড়িনি, এমনকি ‘শিক্ষিতদের মতো’ও বই পড়িনি। তবু আমি নিজের জন্য যতোটা পড়া প্রয়োজন তার চেয়ে একশোগুণ বেশি পড়েছি। বলা হয় যে, আমেরিকায় পাঁচজনের মধ্যে একজন ‘বই’-এর পাঠক। কিন্তু এই কম সংখ্যক পাঠকও বড্ডো বেশি পড়েন। কেউই জীবনকে সম্পূর্ণ বাঁচায় প্রয়োগ করেন না, জ্ঞানকে কাজে লাগান না।”
মিলার বলেছেন, “বই পড়া হলো মানুষের জীবনে একটি ‘অনুষ্ঠান’, বই পড়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল নিজেকে উপভোগ করা, যার মানে অস্তিত্বকে ধনী, কর্মকে সক্রিয় করে তোলার প্রক্রিয়াকে প্রণোদিত করা।” “প্লেক্সাস” বইতে এলি ফাউরিকে শোনানো একটি গানে ব্লাইজি সঁদরা ( যাঁকে মিলার বলেছেন লেখকদের লেখক ), ডস্টয়েভস্কি, নুট হামসুন, থোরো প্রসঙ্গ যেভাবে আসে তাতে টের পাওয়া যায় মিলার কিভাবে বই পড়েন আর তা থেকে লেখার মশলা জড়ো করেন। কিছুই মিলারের স্মৃতি এড়ায় না, তা গ্রন্হের ঘটনা হোক বা জীবনে ঘটনা, এবং তিনি তাদের এমনকরে মিলিয়ে-মিশিয়ে দ্যান যে বোঝার উপায় থাকে না যে ব্যাপারটা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতাপ্রসূত কিনা। তাঁর বইয়ের তালিকায় যেমন আছে আরব্য রজনী, ড্যানিয়েল ডিফো, গ্রিম ব্রাদার্স, ওয়াল্টার স্কট তেমন আছে ভ্যান গঘের চিঠি, মাদাম ব্লাভাটস্কি, জেমস জয়েস, রামকৃষ্ণর উক্তিসংগ্রহ, নিৎশে, প্লুটার্ক, অসওয়াল্ড স্পেংলার।
জুন ম্যান্সফিল্ড ছাড়া, নারীদের হেনরি মিলার প্রধানত সঙ্গমের মাল হিসেবে চিত্রায়ন করেছেন ‘ট্রপিক’ এবং ‘রোজি’ সিরিজের বইতে, পরিকল্পিত ফোর প্লের কোনো বালাই নেই, যাঁর সঙ্গে সঙ্গম করছেন তার অরগ্যাজমের সঙ্গে সামঞ্জস্যের চিন্তা নেই। কিন্তু “দি বুকস ইন মাই লাইফ”-এ ওয়াল্ট হুইটম্যান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মিলার লিখেছেন, “ তাঁর কবিতায় হুইটম্যান এক বিরল সততার পরিচয় রেখেছেন, নারী আর পুরুষকে সমানভাবে মহিমান্বিত করেছেন। তিনি তাদের মধ্যে পার্থক্য করেননি। তিনি তাদের সমানভাবে পুরুষের আর নারীর স্তরে রেখেছেন। পুরুষের অন্তরে যে নারী বাস করে আর নারীর অন্তরে যে পুরুষ বাস করে তার কথা বলেছেন তিনি তাঁর কবিতাজুড়ে। প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই দ্বৈততা উপস্হাপনের জন্য হউইটম্যানকে রূঢ় সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল। পুরুষ তখনই সম্পূর্ণ হবে যখন তার অন্তরে একজন নারী বাস করবে।”
১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হল মিলারের পাঁচটি ছোটো গল্পের সংকলন, “নাইটস অফ লাভ অ্যাণ্ড লাফটার”: দি অ্যালকোহোলিক ভেটেরান উইথ ওয়াশবোর্ড ক্রেনিয়াম, ভায়া ডিপ্পে - নিউ হেভেন, অ্যাসট্রোলজিকাল ফ্রিকাসে, দি ব্রুকলিন ব্রিজ, মাদামোয়াজেল ক্লদ এবং পোরোর হারবর। পোরোর হারবর গল্পটি ‘দি কলোসাস অফ মারৌসি” থেকে নেয়া একটি ঘটনা। দি অ্যালকোহলিক ভেটেরান গল্পটি একজন মাতালের অবিরাম বকবক যার মাধ্যমে সে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সিরিয়াস অথচ হাস্যকর কথা বলে চলেছে। অ্যাসট্রোলজিকাল ফ্রিকাসে গল্পটি একটি পার্টিতে জনৈক জ্যোতিষির নানারকম গাঁজাখুরি বুকনির কাহিনি, যা সম্ভবত মিলারের জীবনের জ্যোতিষিদের বিফল ভবিষ্যবাণী থেকে সংগ্রহ করা।
১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ‘কোয়ায়েট ডেজ ইন ক্লিশি’ ফোটোগ্রাফার বারাসসির তোলা ফোটোর সঙ্গে মিলারের নভেলা। ১৯৩৪ সালে প্যারিসে কাটানো এক বছরের ঘটনা নিয়ে ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’-এর সময়কার মনকেমন আর ভাবপ্রবণ কাহিনি। পৃথিবী যে সময়ে ছিল সরল এবং ধীরগামী, হেনরি মিলার প্যারিসে একজন নিষ্কপর্দক অখ্যাত লোক, যিনি লেখক হবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময়কার বোহেমিয়ান জীবন, শিল্প এবং প্রেমের উৎসব বলা যায় নভেলাটিকে। তাঁর বন্ধু আলফ্রেড পেরলেস, যার নাম এই নভেলায় কার্ল এবং মিলারের, যাঁর নাম জোয়ি, তাদের বন্ধুত্বের গল্প। প্লট বলতে বিশেষ কিছু নেই। বন্ধুর সঙ্গে শহরে চরে বেড়ানো, ক্লাব মেলোডি নামের বেশ্যালয়ে নিয়মিত ঢুঁ মারা, সুযোগ পেলে কোনো বেশ্যাকে ঠকিয়ে সঙ্গম করে নেয়া, আর মগজের ভেতরে তৈরি গল্প কবে লিখবেন তার চিন্তা। নারীদের যেভাবে চিত্রিত করেছেন সকলেই যেন সহজলভ্য, দুইপা ছড়িয়ে রেডি, টাকার জন্য, রমণাসক্তির জন্যে বা নেহাৎই উদাসীনতা কাটাবার জন্যে।
কোলেট নামে, পথভ্রষ্ট, পনেরো বছরের একটি মেয়েকে আশ্রয় দ্যায় তারা, যে তাদের সিনডারেলা, রাঁধুনি আর শয়নসঙ্গিনী। কোলেটের বাবা-মা শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে খুঁজে পায় কার্ল আর জোয়ির আস্তানায়, কিন্তু যখন জানতে পারে যে কার্ল আর জোয়ি মার্সেল প্রুস্ত আর গ্যেটের বই পড়ে, লেখক হতে চায়, তখন পুলিশে নালিশ করেনা। কার্ল মন্তব্য করে, ফরাসিদের চোখে লেখকরা সাধারণ অপরাধী নয়।
১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ‘এ ডেভিল ইন প্যারাডাইস’ বইটি ১৯৫৭ সালে প্রকাশিতব্য মিলারের ‘বিগ সার অ্যাণ্ড দি অরেনজেস অফ হায়রোনিমাস বশ’ বইয়ের একটি অংশ। ‘এ ডেভিল ইন প্যারাডাইস’ হল সেই সুইজারল্যাণ্ডের প্যারিসবাসী জ্যোতিষি কনর্যাড মরিক্যাণ্ড, যে প্যারিসে মিলারের ভাগ্যগণনা করতো। তাকে কিছুদিনের জন্য বিগ সার-এ অতিথি হিসাবে এনেছিলেন মিলার যাতে সে প্যারিসের দুরবস্হা থেকে বেরিয়ে জীবন উপভোগ করতে পারে। লোকটা মাদকসেবী আর কমবয়সী মেয়েদের ফোসলাবার দোষে ভোগে। এই বইতে মরিক্যাণ্ডের চরিত্রই প্রধান, মিলারের ভূমিকা কেবল গৃহস্বামীর। মিলার বলেছেন, “মরিক্যাণ্ড লোকটা সংশোধনের অসাধ্য একজন ফুলবাবু যে ভিকিরির জীবন কাটায়”। এই বইতে কোনো যৌনদৃশ্য নেই এবং গালমন্দও নেই বললেই চলে। মিলারের সমস্যা হল যে লোকটাকে তিনি ভাড়া দিয়ে অতিথি হিসাবে আনলেন, সেবাযত্ন করলেন, অথচ তার ফিরে যাবার নাম নেই, বরং সে তার দুর্বুদ্ধির অস্ত্র প্রয়োগ করে মিলারের কাছ থেকে নিজের যাবতীয় চাহিদা মিটিয়ে চলেছে। তাকে ফেরত পাঠাবার চেষ্টা করেন মিলার এবং অন্য অতিথিরা কিন্তু মরিক্যাণ্ড চিপকে থাকে জোঁকের মতন।
১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় মিলারের ‘বিগ সার অ্যাণ্ড দি অরেনজেস অফ হায়রোনিমাস বশ’; এই গ্রন্হে মিলার তাঁর ক্যালিফোর্নিয়ায় বিগ সারের জীবনযাপনের কথা বলেছেন। এই অঞ্চলে তিনি পনেরো বছর কাটিয়েছিলেন এবং ‘এয়ারকাণ্ডিশান্ড নাইটমেয়ার’-এর আমেরিকার তুলনায় এক ভিন্ন শান্তিময় গ্রহণযোগ্য আমেরিকার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। তাঁর তৃতীয় স্ত্রী জেনিনা মার্থা লেপসকা, যিনি তাঁর উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পোল্যাণ্ড থেকে এসেছিলেন এবং ১৯৪৪ সালে মিলারকে বিয়ে করেন, মিলারের দুই সন্তান, মেয়ে ভ্যালেনটিন এবং ছেলে টনির জন্ম দ্যান, তিনি মিলারের সঙ্গে বিগ সারের বাড়িতে থাকতেন। মিলারের মায়ের মতন রক্ষণশীল ছিলেন তিনি এবং ছেলেদের মানুষকরা নিয়ে দুজনের মতের মিল হচ্ছিল না। তাছাড়া প্রতিদিন অতিথিদের আগমনে বিরক্ত বোধ করতেন জেনিনা। মিলারের চেয়ে তিনি তিরিশ বছরেরও বেশি ছোটো ছিলেন। জেনিনার বুদ্ধিমত্তা আর ব্লণ্ড চেহারায় আকর্ষিত হয়েছিলেন মিলার ; জেনিনা ছিলেন দর্শনের ছাত্রী। বিয়ের সাত বছর পর ১৯৫১ সালে তিনি মিলারকে ডিভোর্স দ্যান।
১৯৫৩ সালে মিলার বিয়ে করেন চিত্রাভিনেত্রী ও পেইনটার আঠাশ বছরের ইভ ম্যাকক্লুরকে। মিলারের বই পড়ে ইভ ম্যাকক্লুর তাঁকে চিঠি লেখা আরম্ভ করেন, চিঠি আদানপ্রদানের মাঝে ইভ একদিন বিগ সার-এ এসে উপস্হিত হন, আর মিলারকে বিয়ে করতে চান। মিলারের বয়স তখন বাষট্টি ; ইভ তাঁর চেয়ে সাঁইত্রিশ বছরের ছোটো। ভালোই চলছিল দুজনের সংসার, কিন্তু বুড়ো হেনরি মিলার অভ্যাসদোষে ১৯৫৯ সালে ক্যারিল হিল নামে এক যুবতীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক পাতান, যা ইভ সহ্য করতে পারেননি, এবং প্রচুর মদ খাওয়া আরম্ভ করেন। ১৯৬০ সালে তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায়। অত্যধিক মদ্যপানের কারণে ইভ ১৯৬৬ সালে মারা যান।
১৯৬০ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে বিচারকের আমন্ত্রণ পেয়ে মিলার আবার ইউরোপ যান। সেখানে তাঁর সঙ্গে রেনাটে গেরহার্টের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রেনাটে ছিলেন মিলারের জার্মান পাবলিশারের সহায়ক। রেনাটে বিগ সার-এ যেতে রাজি হলেন না। ততদিনে সেখানে এসে পৌঁছেছেন ক্যারিল হিল।
বিগ সার জায়গাটাকে মিলার মনে করতেন আমেরিকার বাইরে একটা শান্তিপূর্ণ জায়গা। এখানেও তিনি একজন জুনকে খুঁজে পেয়েছিলেন, জুন ল্যাংকাস্টার, যিনি তাঁকে প্রথম জুনের মতন আনন্দ দিতে পারেননি। বিগ সার-এর প্রতিদিনকার সাংসারিক কাজকর্মের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি জুন ল্যাংকাস্টার। তাছাড়া মিলারের আর্থিক অবস্হাও ভালো হয়নি তখনও পর্যন্ত। বিগ সার-এ লেপসকার সঙ্গে থাকার সময়ে তাঁদের মেয়ের জন্ম হয় ; সংসার চালাবার খরচের জন্য মিলার অনেকের কাছে টাকাকড়ি, জামাকাপড়, ডায়াপার ইত্যাদির জন্য চিঠি লিখে আবেদন করেছিলেন। জার্মান দখল থেকে ফ্রান্স মুক্ত হবার পর জ্যাক কাহানের ছেলে মরিস জিরোদিয়া মিলারকে চিঠি লিখে জানান যে তাঁর বইগুলোর ভালো বিক্রি আরম্ভ হয়েছে। মিলারের অবস্হা কিছুকালের জন্যে ফেরে যখন তিনি বই বিক্রি বাবদ চল্লিশ হাজার ডলার পান।
বিগ সারে মিলারের সঙ্গে পরিচয় হল অনেকের, যাঁরা সেখানে আগে থাকতে ছিলেন, যেমন এমিল হোয়াইট---যিনি মিলারের মৃত্যুর পর সেখানে মিলারের স্মৃতিতে একটি গ্রন্হাগার খুলেছিলেন, জেইমে ডি অ্যাঙ্গুলো, লিসান বসো রস, এফরাইম ডোনোর প্রমুখ। মিলার পাকাপাকি বসবাস আরম্ভ করায় অনেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, মিলারের ‘ট্রপিক’ পড়ে যুবকের দল যৌনহুল্লোড়ের আশায় এসে দেখতেন একজন প্রায়বুড়ো মিলার, সংসারত্যাগীরা, প্রতিভাধররা, আধপাগলরা, বৈভবশালী পরিবারের যুবকেরা, গাইয়ে, বাজিয়ে, চিত্রশিল্পী, সবাই।
বিগ সার-এ বসে মিলার লিখে গেছেন চেতনাপ্রবাহের শৈলীতে, যেমন-যেমন মনে এসেছে। সমালোচনা করেছেন হেমিংওয়ে এবং স্টিনবেকের। তিনি সম্পাদনা পছন্দ করতেন না বলে বইটি সাজানো-গোছানো নয়। বাচ্চাদের মানুষ করা, বাস্টার কিটন হলিউড থেকে এসে তাঁর বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। রামকৃষ্ণের বাণী। ভালো জীবনের সন্ধান করে গেছেন মিলার। দুটি আইডিয়া দিয়ে তথাকথিত ‘ভালো জীবনকে’ তিনি পরিমাপ করতে চেয়েছেন। স্বার্থপর পরমানন্দ একাকীত্বের আনন্দ অথবা আত্মবলিদান ও নিঃস্বার্থ পরোপকার। শেষ পর্যন্ত দুটির কোনোটিতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
“অবাধ যৌনতা ও নৈরাজ্যের আখড়া” হিসাবে বিগ সার-এর কথা লোকমুখে প্রচারিত হবার ফলে সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে এবং ১৯৬১ সালে একদিন জ্যাক কেরুয়াক এসে পৌঁছোন, তবে তিনি বিগ সার-এ পৌঁছে মিলারের সঙ্গে দেখা করেননি। মিলার বলতেন যে, “বিগ সার কোনো শিল্পীকলোনি নয়, কলোনি হয় পিঁপড়েদের।”স্হানীয় নেপেনথে বার-এ বসে-বসে অত্যধিক মদ খেতেন কেরুয়াক। বিগ সারে বিট কবি ও সিটি লাইটস বুকস-এর প্রকাশক লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির একটি লগ কেবিন ছিল, সেখানে প্রচুর মদ খেয়ে হুল্লোড়ের শেষে অজ্ঞান হয়ে যান কেরুয়াক। মিলার লোক পাঠিয়ে জানান যে তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন এবং তাঁকে অপেক্ষা করানো অনুচিত। কেরুয়াক মিলারের সঙ্গে দেখা করতে যাননি, তার কারণ তাঁর লেখাকে আলোচকরা বলছিলেন মিলারের দ্বারা প্রভাবিত।
কেরুয়াক ‘বিগ সার’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন, মহানগরবাসীর বিগ সার-এর মতন গ্রামাঞ্চলে গিয়ে অত্যধিক মদ খেয়ে মৃত্যুর বিভ্রমে কাটাবার অভিজ্ঞতা। বিট আন্দোলনকারীদের মাঝে জনপ্রিয় ছিলেন না হেনরি মিলার, তার কারণ বিটদের রচনায় মিলারের প্রভাব আছে, এমন তর্ক ছড়িয়ে পড়ছিল আলোচকদের মাঝে। উইলিয়াম বারোজ অস্বীকার করেছেন যে তাঁর গদ্যে মিলারের প্রভাব আছে ; মিলারের সঙ্গে দুবার দেখা হলেও বারোজ উৎসাহ দেখাননি। অ্যালেন গিন্সবার্গের “হাউল” নিয়ে যে মামলা হয়েছিল, তাতে দর্শকদের মাঝে মিলারও ছিলেন। কেরুয়াকের “ধর্মা বামস” বইটির প্রশংসা করে আলোচনাও লিখেছিলেন মিলার। মিলারের ফরাসি প্রকাশক মরিস জিরোদিয়া বিভিন্ন লেখক, কবি ও সংস্হাকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তাঁরা হেনরি মিলারের সমর্থনে নোবেল কমিটিকে চিঠি লিখে জানান যে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হোক। বিট কবি-লেখকরা তেমন চিঠি পাঠাতে অস্বীকার করেছিলেন। ১৯৬০ সালে “টু সিটিজ” পত্রিকায় কার্ল শাপিরো লিখেছিলেন, “হেনরি মিলার ইজ দি গ্রেটেস্ট লিভিং অথর”, যা বিট আন্দোলনকারীদের পছন্দ হয়নি।
তখনকার দিনে বিগ সার-এ যাওয়া সহজ ছিল না বলে মিলার বেছেছিলেন জায়গাটাকে, তবুও অতিথিদের যাতায়াত লেগেই থাকতো, তার কারণ আমেরিকা জুড়ে তখন আরম্ভ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কমিউনিস্ট বিরোধিতা, লেখক-শিল্পীদের জন্যে শীতযুদ্ধের দমবন্ধকরা আবহাওয়া। অতিথিদের চাপে বিরক্ত হয়ে ১৯৬৩ সালে মিলার বিগ সার ছেড়ে চলে গেলেন লস অঞ্জেলেসের প্যাসিফিক প্যালিডাস-এ, যেখানে জীবনের শেষ সতেরো বছর কাটান মিলার।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় হেনরি মিলারের প্রবন্ধ, সমালোচনা ও গল্পের সংকলন “স্ট্যাণ্ড স্টিল লাইক এ হামিংবার্ড”। বইটিতে জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে সংগ্রহ করে মিলার তাঁর জীবনবীক্ষা তুলে ধরতে চেয়েছেন। এজরা পাউন্ড তাঁকে একটি পোস্টকার্ডে, “আপনি কি টাকার কথা ভাবেন”, এই প্রশ্ন করলে মিলার তার উত্তরে লিখেছেন “মানি অ্যাণ্ড হাউ ইট গেটস দ্যাট ওয়ে”। সমাজে শিল্পীর অবস্হান পর্যালোচনা করেছেন “অ্যান ওপন লেটার টু অল অ্যাণ্ড সান্ড্রি” গদ্যে। “অ্যাঞ্জেল ইন মাই ওয়াটারমার্ক” তাঁর পূর্বের একটি রচনার পুনর্মুদ্রণ। সেনসরশিপ নিয়ে আলোচনা করেছেন “দি ইমমরালিটি অফ মরালিটি” প্রবন্ধে। “ফার্স্ট লাভ” তাঁর নিজের প্রথম প্রেম নিয়ে আত্মজীবনীমূলক রচনা। এছাড়া আছে “চিলড্রেন অফ দি আর্থ”, “হোয়েন আই রিচ ফর মাই রিভলভার”, “মাই লাইফ ইজ অ্যান ইকো”, “কোয়েস্ট”, “টু রিড অর নট টু রিড”, “প্যাচেন:ম্যান অফ অ্যাঙ্গার অ্যান্ড লাইট” এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান, ডেভিড থোরো, শেরউড অ্যাণ্ডারসন, ইউজিন আয়োনেস্কোর সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন। তাঁর ‘ট্রপিক’ এবং ‘রোজি’ সিরিজের বইয়ের ইমেজ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যতো বয়স হয়েছে, মিলার ততো সিরিয়াস রচনার দিকে ঝুঁকেছেন।
১৯৬৭ সালে মিলার বিয়ে করলেন তাঁর পঞ্চম স্ত্রী জাপানি যুবতী হিরোকো ( ডাকনাম হোকি ) টোকুডাকে, যিনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন গায়িকা হবার জন্য। টোকুডা মিলারের বইয়ের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, কেননা মিলারের কোনো বই জাপানে নিষিদ্ধ ছিল না, বাবাকে চিঠি লিখে জাপানি ভাষায় অনুদিত মিলারের বই আনিয়েছিলেন, কিন্তু বই পড়ায় তাঁর আগ্রহ ছিল না। মিলারের ইচ্ছে ছিল জাপানের গেইশাদের মতন সুন্দরী এক যুবতীকে বিয়ে করেন, সে আশা পুরো হল পঁচাত্তর বছর বয়সে। হলিউডের ইমপিরিয়াল গার্ডেনস রেস্তরাঁর পিয়ানো বার-এ দেখা হয়েছিল হোকি টোকুডার সঙ্গে, সদ্য এসেছেন টোকিও থেকে। মিলার তাঁর প্রতি ইনফ্যাচুয়েশানে বসে থাকতেন যতক্ষণ গান গাইতেন হোকি। মেয়েটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগে ভুগতেন মিলার। এই উদ্বেগের কারণে ১৯৬৫-৬৬ জুড়ে রাতে তাঁর ঘুম আসত না, সারারাত জেগে ছবি আঁকতেন। হোকি টোকুডাকে প্রেমপত্র লিখতেন, এমনকি টোকুডাকে রাজি করাবার জন্য তার বাবা-মাকেও চিঠি লিখতেন জাপানে। টোকুডার দেয়া ইনসমনিয়ায় আঁকা ছবিগুলো নিয়ে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হল তাঁর ছোটো একটি বই “ইনসমনিয়া, অর দি ডেভিল অ্যাট লার্জ”। মিলার লিখেছেন যে, ছবিগুলো রাত তিনটের সময়ে তাঁর মানসিক অবস্হার প্রতিফলন, কোনো ছবি জৈব, কোনওটা অজৈব, কিন্তু তারা সকলেই “আবরাকাডাবরার বাগানে” তাদের নিজস্ব জীবনযাপনের জন্য আঁকা।
বিয়ে করে প্যারিসে গেলেন হনিমুন করতে। হোকি টোকুডার টাকার দরকার হলেই বিলোতেন মিলার। তাঁকে একটা জাগুয়ার গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে জাপানেও গিয়েছিলেন মিলার তাঁর গানের প্রচারের জন্য। হোকি টোকুডার জন্যে হলিউডে একটা বার খুলতে সাহায্য করেন মিলার। মেয়েটি মিলারকে বিয়ে করেছিলেন গ্রিন কার্ড পাবার জন্য, মিলার মারা যাবার পর টোকুডা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তাঁরা দুজনে একসঙ্গে শুতেন না, কেননা বিয়ের সেরকমই চুক্তি ছিল, কেবল একবার চুমু খেয়েছিলেন, আর সেই চুমুর ফলে তিনি ভিজে গিয়েছিলেন, ইত্যাদি।
মিলারের বদান্যতায় টোকুডা থেকে গেলেন তাঁর সঙ্গে, বুড়োর পরিচর্যা করতেন, যত্ন নিতেন যতোদিন ছিলেন। মিলারের সন্দেহ ছিল যে জাপানি যুবতিটি একদিন তাঁকে ছেড়ে পালাবে, তাই হোকিকে খুশি করার জন্য প্রচুর ডলার খরচ করতেন। সেষ পর্যন্ত ১৯৭৮ সালে মিলারের সঙ্গে হোকির ডিভোর্স হয়ে যায়। টোকিওয় ফিরে ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ নামে নাইট ক্লাব খোলেন হোকি টোকুডা। মিলারের জীবনীকাররা মনে করেন যে হোকি টোকুডা পরিকল্পনা করেই ফাঁসিয়েছিলেন মিলারকে, যাতে আমেরিকায় বসবাস করা সহজ হয় আর টাকাকড়ি রোজগার করে দেশে ফিরে যাওয়া যায়।
মিলার তারপর ইউরোপে নানা শহরে একবছর কাটিয়ে প্যাসিফিক প্যালিডাসের বাড়িতে ফিরলেন অবসরের জন্য। প্যাসিফিক প্যালিডাসের বাড়িতে প্রায়ই ডিনার পার্টি দিতেন মিলার, সেখানে জড়ো হতেন হলিউডের লোকজন আর কবি-লেখকরা। তাঁর রাঁধুনি আর কেয়ারটেকার ছিলেন টুইংকা থিবো নামে শিল্পীদের মডেল, যিনি পরে মিলার আর তাঁর সান্ধ্যভোজের অতিথিদের কথাবার্তা নিয়ে একটা বই লিখেছেন।
১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় মিলারের “মোলক : অর, দি জেনটাইল ওয়র্লড”, ১৯২৭-২৮ সালে স্ত্রী জুন ম্যান্সফিল্ডের নামে লেখা, প্রকাশিত হয়নি তখন, জুনের প্রেমিক রোনাল্ড ফ্রিডম্যানের বদান্যতায় লেখা, কিন্তু তখন প্রকাশকরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । প্রথম ব্যর্থ উপন্যাস “ক্লিপড উইংস”-এর পর এটি মিলারের দ্বিতীয় ব্যর্থ উপন্যাস। বাইবেলে বর্ণিত একজন দেবতার নাম মোলক, যার কাছে বাচ্চাদের বলি দেয়া হতো। এই উপন্যাসের নায়কের নাম ডিয়ন মোলক ; সে ইহুদিবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষী, লম্পট এবং সমকামীদের ঘৃণা করে। প্রথম পুরুষে লেখা কাহিনি নায়ককে অনুসরণ করে, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে সুখি নয়, মনে করে তার স্ত্রীর সঙ্গে আগের প্রেমিকের বিয়ে হলে ভালো হতো। নিজেও মনে করে প্রথম প্রেমিকাকে বিয়ে করলে সুখি হতো। মিলার প্রথম স্ত্রী বিয়েট্রিসের সঙ্গে জীবনযাপন, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন অফিসে ( এই বইতে তার নাম গ্রেট আমেরিকান টেলিগ্রাফ কোম্পানি, যাকে পরের বইগুলোতে মিলার বলেছেন কসমোডেমনিক টেলিগ্রাফ কোম্পানি ) মেসেঞ্জার নিয়েগের চাকরি, সন্ধ্যায় বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মদ খাবার আড্ডা আর বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন। পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাবার পর গ্রোভ প্রেস বইটি প্রকাশ করে। এই বইটির কারণে অনেকে মনে করেন যে কৈশোরে মিলার ইহুদিবিদ্বেষী ছিলেন, অত্যন্ত সুন্দরী ইহুদি যুবতী জুন ম্যান্সফিল্ডের সঙ্গে পরিচয়ের পর তাঁর বিদ্বেষ আর কখনও ফুটে ওঠেনি।
মিলারের একমাত্র নাটক “জাস্ট ওয়াইল্ড অ্যাবাউট হ্যারি” প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। আয়োনেস্কো এবং আঁতোয়া আর্তোর দ্বারা প্রভাবিত এটি একটি ট্র্যাজিকমিক হইচইপূর্ণ প্রহসন। হৃদয়হীন হ্যারির গল্প, যে নারীদের আকৃষ্ট করতে পারে আর তাকে ঘিরে যুবতীরা হইচইয়ে মত্ত হয়। হ্যারির দেখা হয় জিনের সঙ্গে, কিন্তু তার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে শুঁড়িখানার এক যুবতীর দিকে ঝোঁকে। ব্রুকলিনে মদখোরদের হইচই এই নাটকের প্রধান আকর্ষণ। নাটকটি প্রায় পরাবাস্তববাদী এবং শেষ পর্যন্ত হ্যারি জীবন, মৃত্যু ও প্রেম সম্পর্কে তেতোমিষ্টি শিক্ষা পায়।
১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় মিলারের “মাই লাইফ অ্যাণ্ড টাইমস”। এটি একটি কফিটেবিল বই, ভারি চকচকে কাগজে ছাপা আর পাতায় পাতায় মিলার, তাঁর বন্ধু-বন্ধুনি, প্রেমিকা, স্ত্রীরা, নগ্নিকাদের সঙ্গে ষাট বছরের বুড়ো মিলারের জলকেলি, পাণ্ডুলিপি, মিলারের আঁকা রঙিন জলরঙের ছবি, পরিবারের সদস্যরা, যে জায়গাগুলোয় থেকেছেন তার অজস্র সাদা-কালো ফোটো ; সঙ্গে মিলারের স্বয়ংসংলাপ এবং প্রশ্নোত্তর। বইটির সাতটি অধ্যায়ের আরম্ভ ১৯৭০ সালে এবং শেষ হয় গিয়ে তাঁর শৈশবে। অধ্যায়গুলো হলো, নাও, রাইটিং, বিগ সার, পেইনটিং, প্যারিস, প্যারিস রিভিজিটেড এবং চাইল্ডহুড। জীবনের মনকেমনের ঘটনাবলী নিয়ে সত্যকথা বলেছেন মিলার, কোনোকিছু না লুকিয়ে। তাঁর মনে হয়ে থাকবে পাঠকরা তাঁকে তাঁর বইগুলোয় যেভাবে পেয়েছেন তার থেকে যে তিনি কিছুটা আলাদা তা তাদের জানা দরকার।
প্রায় কুড়িটির মতন প্যামফ্লেট লিখেছেন মিলার, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
মিলারকে নিয়ে চারটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম হয়েছে এতাবৎ। ওয়ারেন বেটি’র ফিল্ম “রেডস”-এ মিলার একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ ফিল্মে রিপ টর্ন অভিনয় করেছিলেন হেনরি মিলারের ভূমিকায়। “কোয়ায়েট ডেজ ইন ক্লিশি” বইটি নিয়ে দুটি ফিল্ম হয়েছে, একবার মিলারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পল ভ্যালজিন, আরেকবার অ্যানড্রিউ ম্যাককার্থি। অ্যানাইস নিনের ডায়েরি থেকে অংশ নির্বাচন করে দুটি ফিল্ম হয়েছে, “হেনরি অ্যান্ড জুন” যাতে মিলারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফ্রেড ওয়ার্ড এবং “দি রুম অফ ওয়র্ডস” ফিল্মে ডেভিড ব্র্যানডন।
হেনরি মিলার অষ্টআশি বছর বয়সে ৭ই জুন ১৯৮০ তারিখে প্যাসিফিক প্যালিসাডেসের বাড়িতে মারা যান। তাঁর শবদাহ করা হয় এবং দাহশেষের ছাই ছেলে ও মেয়েকে ভাগাভাগি করে দেয়া হয়।
সাত
হেনরি মিলারের বইয়ের গদ্যাংশ :
‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ থেকে ( সাহিত্যিক-শিল্পীদের পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কে )--
আমার শব্দগুলোর পেছনে রয়েছে এই সমস্ত দন্তবিকশিত হাসি, বঙ্কিম কটাক্ষ, চুগলিখোর করোটি, অনেকে বহুকাল মৃত আর এখনও দাঁত কেলিয়ে চলেছে, কেউ কেউ এমন দাঁত কেলাচ্ছে যেন তাদের চোয়াল আটকে গেছে, কয়েকজন দাঁত বের করে দাঁতক্যালানে ছ্যাদলা নিয়ে হাসছে, যা হয়ে গেছে আর যা হবার তার স্বাদ ওই মুখে। সবচেয়ে স্পষ্ট আমি দেখতে পাই নিজের দাঁত বের করা করোটির হাসি, দেখতে পাই হাওয়ায় নাচছে আমার কঙ্কাল, পচা জিভ থেকে বেরিয়ে এসেছে সাপের দল, আর ফুলে ঢোল পৃষ্ঠাগুলোয় আমার শিকনি, আমার গু, আমার পাগলামি, আমার আহ্লাদ জমপেশ গ্যাঞ্জামের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে ধরাছোঁয়ার বাইরের মাংসের আঁস্তাকুড়ে। এই সমস্ত স্বতঃকৃত, অবাঞ্ছিত, মাতালের বমি পুরো বয়ে যাবে সেই লোকগুলোর মগজের ভেতর দিয়ে, যারা এই দৌড়ের ইতিহাসের সীমাহীন গামলায় জায়গা নিয়েছে।
‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ থেকে ( সাহিত্য সম্পর্কে )--
একজন লোক যে এই জাতটার অংশ তাকে মুখের ভেতর আবোলতাবোল বুকনি নিয়ে আর পেট ফাঁসিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে উচিত জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। এটাই ঠিক, আর লোকটাকে তা করতেই হবে। আর এই ভয়াবহ প্রদর্শনীর চেয়ে যদি কিছু কম হয়, কোনোকিছু যা কম কাঁপুনি জাগায়, কম আতঙ্কজনক, কম উন্মত্ত, কম নেশাগ্রস্ত, কম বিষাক্ত, তাহলে তা শিল্প নয় ! বাদবাকি সব নকল, বাদবাকি সব মানবতাবাদী। বাদবাকি সব জীবনের আর জীবনহীনতার।
‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ থেকে ( নিজের সম্পর্কে )--
হ্যাঁ, আমি নিজেকে বললুম, আমিও সেইসব জিনিস ভালোবাসি যা বয়ে যায় ; নদী, নর্দমা, লাভা, বীর্য, রক্ত, পিত্ত, শব্দ, বাক্য। গর্ভের থলি ফেটে বেরোনো রস আমার ভালো লাগে। কষ্টকর গলস্টোনসুদ্দু কিডনি আমার ভালো লাগে ; তার ভেতরকার কাঁকর আর যাবতীয় যা থাকে ; আমি পেচ্ছাপ ভালোবাসি যা মাটি সরিয়ে অবিরাম ভেসে যায় ; আমি হিস্টিরিয়া রোগিদের বকবকানি ভালোবাসি, আর বাক্যগুলো, যা পাতলা পায়খানার মতন বইতে থাকে এবং পৃথিবীর রুগ্ন দৃশ্যগুলো মেলে ধরে।
‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ থেকে (জারমেইন নামে এক যৌনকর্মী সম্পর্কে )--
ও যখন দু’পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে আর কাতরাতে থাকে, তা অমন কাতরানি ও এর-তার সবার সঙ্গে শোবার সময়ে করলেও, বেশ ভালো লাগে, তা ভাবপ্রকাশের যথাযথ প্রদর্শনী। ও উদাসীন চাউনি মেলে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে না কিংবা দেয়ালের ছারপোকাদের গোনে না ; ও যা করছে সেই দিকেই মন দ্যায়, ওর ওপরে ওঠার সময়ে একজন পুরুষ মানুষ যা শুনতে চায়, সেসব কথাই ও বলতে থাকে।
‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ থেকে ( ক্লদ নামে এক যৌনকর্মী সম্পর্কে )--
ক্লদের সঙ্গে সবসময়ে আদবকায়দার ব্যাপার থাকবে, এমনকি যখন তোমার সঙ্গে চাদরের তলায় ঢুকেছে, তখনও। আর অমন আদবকায়দা অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করে। কে-ই বা চায় একজন আদবকায়দাউলি বেবুশ্যে মাগিকে ! ক্লদ যখন পায়খানায় গিয়ে বসে, তখন তোমায় বলবে অন্য দিকে চেয়ে থাকো। একেবারে বাজে ব্যাপার। একজন পুরুষ, যখন সে আসক্তির আগুনে পুড়ছে, দেখতে চায়, সবকিছু দেখতে চায়, এমনকি কেমন করে হিসি করে। আর একজন নারীরও মগজ আছে জানতে পারা ভালো, কিন্তু বেশ্যার ঠাণ্ডা শব যদি বিছানায় সাহিত্য পরিবেশন করে তা হবে একেবারে ফালতু ব্যাপার ।
‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ থেকে ( নামহীন এক যৌনকর্মী সম্পর্কে )--
মাঝরাতের পর কালো জোব্বায় ও ওখানে শেকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর পেছনের সরু গলিতে ঝলমল করে নরকের আগুন। হালকা মেজাজে এখন ওর পাশ দিয়ে যেতে যেতে ও আমাকে একটা রাজহাঁসের কথা মনে পড়িয়ে দ্যায় যাকে খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়েছে, একটা রাজহাঁস যার লিভারে অসুখ। ওর কাঠের নকল পা সুদ্দু ওকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াটা বেশ অদ্ভুত দেখাবে।
‘ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন’ থেকে ( নামহীন এক কাজের মেয়ে সম্পর্কে ) --
একদিন রাতে যখন ও বাথরুমে ছিল, সন্দেহজনকভাবে অনেকক্ষণ সময় কাটাচ্ছিল, আমাকে প্ররোচিত করছিল কল্পনায়। আমি ঠিক করলুম চাবির ফুটো দিয়ে নিজের চোখে দেখি কি ব্যাপার চলছে। আরিব্বাস, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ছোট্টো পুটকিতে হাত বোলাচ্ছে আর আদর করছে। ঠিক যেন কথা বলছে ওটার সঙ্গে, বলছে নিশ্চিত। আমি এত উত্তেজিত হয়ে উঠলুম যে প্রথমে বুঝতে পারলুম না কি করি। আমি বড়ো ঘরটাতে ফিরে গেলুম, আলোগুলো নিভিয়ে দিলুম, আর বিছানায় শুয়ে ওর বেরিয়ে আসার অপেক্ষা করতে লাগলুম। আমি বিছানায় শুয়ে ওর পুটকির ঝোপ দেখতে পাচ্ছিলুম, ওটাকে আঙুল দিয়ে বাজনার মতন বাজিয়ে চলেছে। আমি প্যান্টের বোতাম খুলে ঠাণ্ডা অন্ধকারে আমার ঠুঁটিকে নড়াচড়া করতে দিলুম। বিছানায় শুয়ে আমি ওকে সন্মোহিত করার চেষ্টা করলুম, কিংবা চাইলুম আমার ঠুঁটি ওকে সন্মোহিত করুক। “কুত্তি এখানে আয়”, নিজেকে বলতে থাকলুম, “এখানে আয় আর আমার ওপর বিছিয়ে দে তোর ওই পুটকি।” বার্তাটা ও তক্ষুনি পেয়ে গিয়ে থাকবে, কেননা এক মুহূর্তে ও দরোজা খুলে বেরিয়ে এসে বিছানার উদ্দেশে অন্ধকার হাতড়াতে লাগল। আমি একটা কথাও বলিনি, একটুও নড়াচড়া করিনি। আমি শুধু আমার মনকে অন্ধকারে কাঁকড়ার মতন ওর পুটকির নিঃশব্দ আগমনের জন্য তৈরি রাখলুম। শেষ পর্যন্ত ও এসে বিছানার পাশে দাঁড়ালো। ও-ও মুখফুটে একটা কথাও বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল আর আমি যখন আমার হাত ওর পায়ে নিয়ে গেলুম, ও এক পা এগিয়ে এসে নিজের ফাটলকে আরেকটু মেলে ধরল। আমার মনে হয় না সারা জীবনে এর আগে এমন রসালো ফাটলে কখনও হাত দিয়েছি। ওর পা বেয়ে যেন আঠার ঝরণা নামছিল আর হাতের কাছে যদি কোনো পোস্টার লাগাবার বোর্ড থাকতো তাহলে ওই আঠায় আমি এক ডজনের বেশি পোস্টার লাগাতে পারতুম। কয়েক মুহূর্ত পরে, গোরু যেমন ঘাস খাবার জন্য মাথা নামায়, ও মাথা নামিয়ে ওটা মুখে পুরে নিল। আমার চারটে আঙুলই পুরো ওর ভেতরে ছিল, ফেটিয়ে ফেনা তৈরি করছিল। ওর মুখ পুরো ভরে গিয়েছিল আর রস বয়ে যাচ্ছিল পা বেয়ে। বলছি তো, আমাদের দুজনের মাঝে একটাও কথা নয়। অন্ধকারে কবর-খুঁড়িয়েদের মতন খ্যাপা একজোড়া বুনো মানুষ-মানুষী।
‘ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন’ থেকে ( ইহুদি স্ত্রী সম্পর্কে, উপন্যাসে যার নাম মোনা )--
ও ছিল দুনলা বন্দুক, গর্ভে অ্যাসিটিলিন টর্চ জ্বালিয়ে একজন নারী ষাঁড়। উত্তেজিত হলে ওর দৃষ্টি আটকে যেতো মাটিতে, চোখ পাকিয়ে শাদা, ঠোঁটে আঠা। যৌনতার অন্ধ গলিতে ও নাচতে শেখা ইঁদুরের মতন হাঁটতো, ওর চোয়াল সাপের মতন খোলা, আর ত্বকের লোম কাঁটাদার পালকের মতন খাড়া। ওর লালসা ছিল ইউনিকর্নের মতন তৃপ্তিহীন, সেই চুলকানি যা মিশরীয়দের তাঁবে রাখতো।
‘ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন’ থেকে ( যৌনকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন সম্পর্কে )--
অন্ধকারে আমি বাড়াবাড়ি করে ফেললুম। সীমাহীন যৌনতার জলে আমি নতুন পালতোলা নৌকো ভাসালুম, একে দিয়ে হোক, বা তাকে দিয়ে প্রতিষ্ঠা-করা খালের পাকে পাকে। দুপুরের খানিকক্ষণের জন্যে জর্জিয়ানা, মিশরীয় বেশ্যা থেলমা, কারোলোটা, আলান্না, ইউনা, মোনা, মাগডা, ছয় বা সাতের মেয়েরা, যৌনকর্মীরা, আলেয়ার মতন জ্বলজ্বলেরা, মুখ, দেহ, উরু, সাবওয়েতে হঠাৎ, একটা স্বপ্ন, একখানা স্মৃতি, একটা ইচ্ছে, একটা মনকেমন। এক রবিবারের দুপুরের ঘটনা দিয়ে আমি জর্জিয়ানার গল্প শুরু করতে পারি।
‘ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন’ থেকে ( ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে )--
আমি টের পেতে লাগলুম যে ভাবনাচিন্তা, যখন তা স্বমেহনকারী নয়, তা শান্তিদায়ক, উপশমকারী, আনন্দদায়ক। যে ভাবনাচিন্তা তোমায় কোথাও নিয়ে যায় না তা তোমায় সর্বত্র নিয়ে যায় ; অন্য সমস্ত ভাবনাচিন্তা পথ মেনে এগোয়, আর সেই পথ যতোই দীর্ঘ হোক, শেষপ্রান্তে চিরকাল “থামো’ চিহ্ণের একটা লাল আলো জ্বলবে ! কিন্তু লিঙ্গ যখন ভাবনাচিন্তা আরম্ভ করে তখন কোনো থামার বা যেতে দেওয়ার প্রশ্ন উঠে না : তখন তা শেষহীন ছুটির দিন, বঁড়শির টোপ জ্যান্ত আর ছিপের শেষে মাছ কামড় বসিয়ে চলেছে, যা থেকে আমার মনে পড়ে যায় আরেক যোনির কথা, ভেরোনিকা বা অন্য কেউ।
‘সেক্সাস’ থেকে ( স্কুলের সহপাঠিনী মিরিয়াম সম্পর্কে )--
ওর সম্পর্কে আমার কখনও অশুদ্ধ ভাবনা ছিল না ; কখনও ওকে চাইনি, কখনও আদরের জন্যে লালায়িত হইনি। আমি ওকে এতো গভীরভাবে ভালোবাসতুম, এতো সমগ্রতায়, যে যখনই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে মনে হয়েছে পূণর্জন্ম হল। যেটুকু আমি চাইতুম তা হল ও বেঁচে থাকুক, এই পৃথিবীর হয়ে থাকুক, কোথাও, কোনোখানে, এই জগতে, আর কখনও যেন মারা না যায়। আমি কিছুই পেতে চাইনি, আমি ওর কাছ থেকে কিছুই চাইনি। ওর অস্তিত্বই ছিল যথেষ্ট। হ্যাঁ, আমি বাড়ির ভেতরে দৌড়ে চলে যেতুম, লুকিয়ে পড়তুম, আর জোরে জোরে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতুম, আমাদের এই পৃথিবীতে মিরিয়ামকে পাঠাবার জন্য। কি এক অলৌকিক ঘটনা। আর এভাবে ভালোবাসা কতো পবিত্র।
‘সেক্সাস’ থেকে ( নামহীন এক যুবতী সম্পর্কে )--
“প্লিজ, প্লিজ”, আমার আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে ও বেরিয়ে যেতে চাইল। “আপনি আমার মর্যদাহানি করছেন”। আমি জানতুম ওকে যেতে দিতে হবে, আমি তাড়াতাড়ি করলুম, চেষ্টা করলুম, “আমি তোমায় যেতে দেবো”, বললুম আমি, “ব্যাস আরেকটা চুমু”। বলার পর ওকে দরোজায় চেপে ধরলুম আর পোশাক তোলার ব্যাপারে না গিয়ে আমি চালিয়ে গেলুম ওজনদার ঠোক্কোরের পর ঠোক্কোর, ওর কালো সিল্কের পোশাকের সামনে দিকে।
‘দি কসমোলজিকাল আই’ থেকে ( শিল্প সম্পর্কে )--
সৃজনশীল সত্তাগুলোর মধ্যে সৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ হিসাবে শিল্প হল অন্যতম। প্রতিটি মহান শিল্পী তাঁর কাজের মাধ্যমে যা করতে চান তা হল জীবনকে আরও মহৎ করে তোলা ; তাঁর কাজ সেই সব সম্ভাবনার বর্ণনামাত্র। শিল্পীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো পাপ হবে তাঁর কথাগুলো মেনে নেয়া, তাঁর কাজে দিগন্ত খোঁজার বদলে আশাপূর্তি খোঁজা।
অ্যানাইস নিনকে লেখা হেনরি মিলারের প্রেমপত্র ( নিনের স্বামীর অবর্তমানে তাঁর বাড়িতে কয়েকটা দিন অবিরাম যৌনসম্পর্ক কাটিয়ে আসার পর লেখা )--
১৪ আগস্ট ১৯৩২
অ্যানাইস
আমাকে আর সুস্হমস্তিক বলে মনে কোরো না। নিজেদের আর বোধবুদ্ধিসম্পন্ন বলে মনে কোরো না। লোভেসিয়েঁতে যা ঘটেছিল তা বিবাহ -- তুমি এর বিরোধিতা করতে পারো না। তোমার দেহের অংশ গায়ে এঁটে নিয়ে আমি ফিরে এলুম ; আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি, সাঁতার কাটছি, রক্তের সমুদ্রে, তোমার আন্দালুশিয় রক্তে, চোলাই- করা আর বিষাক্ত। আমি যা কিছু বলছি আর ভাবছি তা ফিরে-ফিরে ওই বিবাহের কাছেই চলে যাচ্ছে। তোমার বাড়ির গৃহকর্তৃীর রূপে তোমাকে দেখলুম, ভারি মুখশ্রীর এক মুসলমাননি, শাদা ত্বকের এক নিগ্রোনারী, সারা গায়ে অজস্র চোখ, নারী, নারী, নারী। জানি না কেমন করে তোমার থেকে দূরে থাকবো, এই মাঝের সময়গুলো আমার মৃত্যু। হিউগো যখন বাড়ি ফিরে এলো তখন তোমার কেমন লেগেছিল ? তখনও কি আমি সেখানে ছিলুম ? আমি দেখতে পাচ্ছি ওর সঙ্গে সেভাবেই চলাফেরা করছ যেমন আমার সঙ্গে করেছ। পা একের সাথে আরেক। কমনীয়। মিষ্টি, বিশ্বাসঘাতী মৌনসন্মতি। পাখির সহজবশ্যতা। আমার সঙ্গে তুমি হয়ে উঠেছিলে নারী। আমি তার জন্য প্রায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলুম। তুমি কেবলমাত্র তিরিশ বছরের নও -- তুমি হাজার বছরের।
আমি এখানে ফিরে এসেছি আর এখনও ধিকিয়ে-ধিকিয়ে আসক্তিতে জ্বলছি, ধোঁয়াওঠা মদের মতন। মাংসের আসক্তির জন্য তা কিন্তু নয়, তোমাকে পাবার সম্পূর্ণ ক্ষুধায়, গিলে ফেলার ক্ষুধায়। কাগজে আত্মহত্যা আর হত্যার সংবাদ পড়ি আর আমি তা ভালো করে বুঝতে পারি। আমি কাউকে হত্যা করার মতো বোধ করি, আত্মহত্যা করার ইচ্ছা হয়। আমার মনে হয় চুপচাপ বসে থাকাটা অবমাননাকর, সময় কাটানো, দার্শনিক দিক দিয়ে ভাবলে, বোধবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া। সেই দিনকাল কোথায় গেলো যখন পুরুষরা একখানা দস্তানার জন্য, একটা চাউনির জন্য পরস্পর লড়তো, মেরে ফেলতো, মরে যেতো ? ( মাদাম প্রজাপতির সেই ভয়ংকর গানটা কেউ বাজাচ্ছে -- “একদিন সে-পুরুষ আসবেই !”)
আমি এখনও শুনতে পাচ্ছি তুমি রান্নাঘরে গান গাইছো -- একধরণের সঙ্গতিহীন কিউবার গোঙানির রেশ। আমি জানি রান্নাঘরে তুমি আনন্দ পাও, আর যে খাবার রান্না করছ তা দুজনে একসঙ্গে বসে খাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো খাবার। আমি জানি তুমি নিজেকে ছ্যাঁকা লাগিয়ে ফেলবে কিন্তু নালিশ করবে না। আমি সবচেয়ে বেশি শান্তি আর আনন্দ পাই তোমার খাবার ঘরে বসে যখন চলাফেরার দরুণ তোমার পোশাকের শব্দ শুনতে পাই, তোমার পোশাকে যেন ইন্দ্রের হাজার চোখের কারুকাজ করা।
অ্যানাইস, আমি এর আগেও তোমার কথা ভেবেছি, কিন্তু এখন আমার মধ্যে যা ঘটছে তা নিশ্চিত আর সেরকম নয়। ব্যাপারটা এই জন্যেই কি আহ্লাদের যে তা ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আর লুকিয়ে-চুরিয়ে করা ? আমরা দুজনে কি পরস্পরের জন্য অভিনয় করছিলুম, পরস্পরের প্রতি ? আমি কি কম আমি ছিলুম, নাকি বেশি আমি, আর তুমি কম না বেশি তুমি ? এটা কি মাথাখারাপের ব্যাপার যে বিশ্বাস করতে হবে এই ভাবেই চলবে ? কবে আর কোথায় একঘেয়ে মুহূর্তগুলো আরম্ভ হবে? আমি তোমায় লক্ষ করি সম্ভাব্য খুঁত বের করার জন্য, দুর্বল বিষয়ের জন্য, বিপজ্জনক এলাকার জন্য, আমি কিছুই খুঁজে পাই না -- কিচ্ছু নয়। তার মানে আমি প্রেমে পড়ে গেছি, অন্ধ, অন্ধ। সারাজীবন অন্ধ থাকার ( এখন ওরা ‘হেভেন অ্যাণ্ড ওশান’ গাইছে লা জিওকোণ্ডা থেকে )।
আমার চোখে ভাসছে তুমি গ্রামোফোন রেকর্ড বার বার বাজাচ্ছ -- হিউগোর রেকর্ড, “পারলে মোই দ আমোর”। দুজন দুমুখো মানুষের বাঁচা, দুজন দুমুখো মানুষের স্বাদ, দুজন দুমুখো মানুষের আনন্দ ও কষ্ট। এর ফলে তুমি যে কেমনভাবে হলরেখায় কেটে যাচ্ছ আর চষে যাচ্ছ। আমি সবই জানি, কিন্তু তা বন্ধ করার জন্য করতে পারি না কিছুই। আমি সত্যিই চেয়েছি যে ওগুলো আমিই সহ্য করি। আমি জানি এখন তোমার দুই চোখ খোলা। কিছু ব্যাপারকে তুমি আর বিশ্বাস করতে পারবে না, বিশেষ অঙ্গভঙ্গী তুমি দ্বিতীয়বার আর করবে না, কিছু বিশেষ দুঃখ, ভুলবোঝাবুঝি তুমি আর দ্বিতীয়বার অনুভব করতে পারবে না। এক ধরণের ফাঁকা অপরাধী আলোড়ন তোমার কোমলতায় দেখা দেবে আর তার সাথে ক্রুরতা করবে। পশ্চাত্তাপ নয়, প্রতিশোধ নয়, দুঃখ নয়, গ্লানি নয়। একটা বেঁচে নেবার উপায় যা তোমায় অতল থেকে টেনে তুলবে না, কিন্তু এক উচ্চতর আশা, এক বিশ্বাস, এক আনন্দ, যার স্বাদ তুমি পেয়েছ, তা ইচ্ছে করলেই আবার পেতে পারো।
সারা সকাল আমি আমার নোটগুলো নিয়ে বসেছিলুম, আমার জীবনের তথ্যগুলো ঝালাই করছিলুম, ভেবে পাচ্ছিলুম না কোথা থেকে শুরু করি, কেমন করে আরম্ভ করি, আমার সামনে কেবল একটা বই দেখতে পাবার জন্যই কেবল নয়, বরং বইয়ের জীবনসমগ্র চাই। কিন্তু আমি আরম্ভ করতে পারছি না। দেয়ালগুলো একেবারে ফাঁকা -- তোমার সাথে দেখা করতে যাবার আগে আমি সবই নামিয়ে নিয়েছিলুম। যেন আমি সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাবার জন্য তৈরি ছিলুম। দেয়ালের দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে -- যেখানে আমরা দুজনে মাথা রেখেছিলুম। বাইরে যখন বাজ পড়ছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আমি বিছানায় শুয়ে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি। আমরা রয়েছি সেভাইল-এ আর তারপর ফেজ-এ আর তারপর কাপ্রিতে আর তারপর হাভানায়। আমরা অবিরাম বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি, কিন্তু রয়েছে টাইপরাইটার আর বই, আর তোমার শরীর সবসময় আমার পাশে আর তোমার চোখের দৃষ্টি কখনও বদলাচ্ছে না। লোকে বলাবলি করছে যে আমরা দুর্দশায় আক্রান্ত হবো, আমরা পরে পশ্চাত্তাপ করবো, কিন্তু আমরা খুশি, আমরা হাসাহাসি করছি, আমরা গান গাইছি। আমরা স্প্যানিশ আর ফরাসি আর আরবিয় আর তুর্কি ভাষায় কথা বলছি। আমাদের প্রবেশ সর্বত্র অবাধ আর আমাদের চলার পথে ফুল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমি বলছি এ এক অদ্ভুত স্বপ্ন -- কিন্তু এই স্বপ্নকে আমি বাস্তবে পেতে চাই। জীবন ও সাহিত্য একযোগে, বিদ্যুৎপ্রবাহ উৎপাদন যন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা, তুমি তোমার রঙবদলানো গিরগিটির আত্মা নিয়ে আমাকে দিচ্ছ হাজার ভালোবাসা, সবসময়ে নোঙরে বাঁধা, তা যেকোনো রকমের ঝড়জলই হোক বা বাড়িতে বা যেখানে আমরা দুজনে থাকবো। সকালবেলায়, যেখানে আমরা শেষ করেছিলুম, সেখান থেকে আবার শুরু করবো। পুণর্জন্মের পর পুণর্জন্ম। তুমি দৃঢ়ভাবে নিজেকে জাহির করছ, জীবনের বৈভবশালী বৈভিন্ন্য তোমার চাই, আর যতো তুমি নিজেকে জাহির করো ততো তুমি আমাকে চাও, আমার প্রয়োজন বোধ করো। তোমার কন্ঠস্বর ভেঙে পড়ে, গভীর হয়ে ওঠে, চোখ আরও কালো, তোমার রক্ত আরও ঘন, তোমার দেহ আরও সুঠাম। এক ইন্দ্রিয়সুখী আজ্ঞা আর পীড়নশীল প্রয়োজনীয়তা। আগের থেকে বেশি নিষ্ঠুর -- সচেতনভাবে, ইচ্ছাকৃত নিষ্ঠুরতা। অভিজ্ঞতার তৃপ্তিহীন আহ্লাদ।
আট
১৯৬৩ সালে জর্জ উইকেস “হেনরি মিলার অ্যাণ্ড দি ক্রিটিকস” নামে একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন, তাতে হেনরি মিলারের প্যারিসের জীবনযাপন আর বিগ সারের বসবাস নিয়ে তাঁর বন্ধুদের স্মৃতিচারণ আছে, আর সেই সঙ্গে আছে মিলারের “ট্রপিক অফ ক্যানসার” বইয়ের মামলায় তিনজন বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্য, আদালতের কাঠগড়ায় দীর্ঘ সাক্ষ্য। বইটির ভূমিকায় আরও অনেক কথার সঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “এমন একটা গুজব শুনতে পাওয়া যায় যে ইংরেজিভাষী দেশগুলোয় হেনরি মিলার সিরিয়াস সমালোচকদের দ্বারা উপক্ষিত রয়ে গেছেন ; ব্যাপারটা সত্য নয়। গত তিন দশকে সিরিয়াস ভাবুকদের দৃষ্টি বেশ ভালোই আকর্ষণ করতে পেরেছেন মিলার, ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকায়। তবে একথা সত্যি যে অ্যাংলোস্যাক্সন দেশগুলোর বাইরে তাঁকে শ্রদ্ধার আসন দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, তাঁর খ্যাতিকে দুঃখজনকভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে সমাজত্ত্বের সঙ্গে। হেনরি মিলার হয়ে দাঁড়িয়েছেন একটা বিতর্ক, একটা প্রসঙ্গ, একটা উদ্দেশ্য এবং তাঁকে যতোটা সমর্থন করা হয় ততোটাই তাঁর বিরোধিতা করা হয়।”
এরিকা জঙ ১৯৯৩ সালে হেনরি মিলারকে নিয়ে একটি বই লেখেন “দি ডেভিল অ্যাট লার্জ” নামে। বইটিতে এরিকা জঙ লিখেছেন যে, “সবচেয়ে বেশি যদি কোনো লেখককে ভুল বোঝা হয়ে থাকে তো তিনি হেনরি মিলার -- তাঁকে হয় পর্নোগ্রাফির লেখক হিসাবে দেখা হয়েছে অথবা একজন গুরু হিসাবে, একজন যৌনক্রিতদাসীর মালিক হিসাবে অথবা যৌনমুক্তির হোতা হিসাবে, একজন জ্ঞানী হিসাবে অথবা দুশ্চরিত্র হিসাবে। এই জগতে একজন সৃজনশীল লেখকের নিজেকে প্রকাশ করার এবং তার ভূমিকাকে উদাহরণ হিসাবে উপস্হাপন করার দায়িত্ব তাঁর ওপরেই বর্তেছিল, যে জগতে মতবিরোধিতার, শিল্পের ( বিক্রয়যোগ্য জিনিস ছাড়া ), সততার আর কোনো প্রয়োজন নেই। আমেরিকায় একজন সৃজনশীল শিল্পীর প্যারাডাইম হিসাবে মিলারের জীবন আতঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর বিরুদ্ধে সাহিত্যিক এসট্যাবলিশমেন্ট এবং অ্যান্টি-এসট্যাবলিশমেন্ট, দু’পক্ষেরই প্রতিরোধ তখনই ভাঙলো যখন তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ ; তাঁর কাছে প্রান্তিকরূপে বসবাস করা এবং ব্যাপারটাকে পছন্দ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না”।
২০১৪ সালে প্রকাশিত “দি আননোন হেনরি মিলার” গ্রন্হে আর্থার হায়েল লিখেছেন, “ তাঁর নিষিদ্ধ বইগুলো আমেরিকায় প্রকাশিত হবার পর যদিও ষাটের আর সত্তর দশকে তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সেলিব্রিটি হবার ও কুখ্যাতির আনন্দ উপভোগ করেছিলেন, আজ, তাঁর মৃত্যুর তিরিশ বছর পরে, তিনি একজন প্রান্তিক লেখক হিসাবে ও ভুলে-যাওয়া মার্কিন লেখক হিসাবে বেঁচে আছেন। এটা ঘটেছে মিলারের প্রচুর সংখ্যক এবং উত্তেজনা প্রণয়নকারী বই প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও, যাঁর লেখালিখি এবং সাহিত্যিক উদাহরণ বহু খ্যাতনামা লেখককে প্রভাবিত করেছে, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য জ্যাক কেরুয়াক, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, পল থেরোজ, নরম্যান মেইলার, ফিলিপ রথ, কনর্যাড ম্যাককার্থি, কুর্ট ভনেগাট, উইলিয়াম বারোজ, এরিকা জঙ প্রমুখ এবং বব ডিলান ও বিটলসদের মতন পপ আইকনদের।
১৯৭২ সালে ‘লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’-এর জন্য ডিগবি ডিয়েলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মিলার বলেছিলেন, ‘যতো দিন যাচ্ছে আমি আমার পাঠকদের সম্পর্কে বিরক্ত হয়ে পড়ছি। আমি নিজের সম্পর্কে সবকিছুই খোলাখুলি বলেছি, কিন্তু আমি দেখছি তারা কেবল জীবনের সেনসেশানাল ব্যাপারগুলোতেই উৎসাহিত। অথচ আমি তার থেকেও বেশি দিয়েছি’। নিজের লেখার মাধ্যমে এবং উদাহরণের দ্বারা মিলার যা দিতে চেয়েছেন তা একটি পথের হদিশ যাতে মানুষ নিজের আত্মার অন্ধকারে হারিয়ে না যায়, যদি মানুষ সত্যিই দেবদূতদের উচ্চতায় পৌঁছোতে চায়।”
স্যার হারবার্ট রিড, কবি, শিল্পসমালোচক ও শিল্পের ইতিহাস লেখক, ‘নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায়’ ‘দি রিয়্যালিটি অফ হেনরি মিলার’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “মিলার অবিরাম লিখে গেছেন এবং তার ফলাফল, আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের সময়ের সাহিত্যে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দ্যায়। মিলার একটা শব্দ প্রয়োগ করেন যা সেজানে ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন -- ‘উপলব্ধি’। দেখা, জানা, আবিষ্কার করা, উপভোগ করা -- এই ব্যাপারগুলো জীবনহীন হয়ে যায় যদি উপলব্ধি করার ক্ষমতা না থাকে। শিল্পীর কাজ হলো বাস্তবে প্রবেশ। এটা শুনতে বেশ সহজ মনে হয়। কিন্তু ব্যক্তি হিসাবে, মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায়, বেশ কঠিন প্রক্রিয়া। তার কারণ নিজের সময়ে মানবসভ্যতা হিসাবে যা উপস্হাপিত, তা থেকে ভেঙে আলাদা করে দ্যায় উপলব্ধি। সভ্যতা আর উপলব্ধি পরস্পরবিরোধী, যা ট্রিগান বারোর মতন মনোবিদরা বহু আগেই বলেছেন, এবং তা পাওয়া যাবে ডি এইচ লরেন্সে যিনি ট্রিগান বারোর চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। একইভাবে বহুক্ষেত্রে হেনরি মিলারও, যাঁকে ডি এইচ লরেন্সের উত্তরাধিকারী বলা যায়, এবং মিলার নিজেও স্বীকার করেন যে তিনি লরেন্সের অনুরাগী পাঠক। আন্ডারগ্রাউন্ড পর্ণোগ্রাফির প্রচারের জগতে, সাহিত্যে সম্ভবত সবচেয়ে অশ্লীল লেখক হলেন হেনরি মিলার। অন্তত তিনি কাতুল্লুস, পেট্রোনিয়াস, বোকাচ্চিও এবং র্যাবেলের সীমাকে অতিক্রম করে গেছেন। কিন্তু মিলার অশ্লীলতার খাতিরে অশ্লীল নন -- অশ্লীলতার জন্যে তিনি কোনো ইচ্ছাকৃত চেষ্টা করেননি-- ব্যাপারটা উপলব্ধির অঙ্গ মাত্র, তাঁর বিধ্বংসী সততার ও প্রেরণার স্বাভাবিক সমধর্মিতা। ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’এর ভূমিকায় অ্যানাইস নিন যেমন বলেছেন, ‘এই বইতে কোনো নকল আদিমতা নেই যে তা থেকে বুনো কাব্যিকতা পয়দা হবে, এই বই হল যে পথে কেউ চলেনি সেই পথে এগিয়ে যাওয়া’। লরেন্স স্টার্নের মতন, মিলারও অশ্লীল লেখক নন, এবং ডি এইচ লরেন্সের মতন ইচ্ছাকৃতভাবে মিলার অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করেন না, করেন ন্যারেটিভের জরুরি প্রতিফলনরূপে।”
এজরা পাউণ্ড ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ এর একটি আলোচনা লিখে টি.এস.এলিয়টের “ক্রাইইটেরিয়ন”-এ প্রকাশ করার জন্য পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সেসময়ে বইটা ইংল্যাণ্ডে নিষিদ্ধ করার কথা চিন্তা করা হচ্ছিল বলে প্রকাশ করেননি। আলোচনাটি ১৯৯২ সালে রোনাল্ড গটেসম্যান সম্পাদিত “ক্রিটিকাল এসেজ অন হেনরি মিলার” গ্রন্হে অন্তর্ভুক্ত হয়। গাই স্টিভেনসন ২০১৫ সালে তাঁর “ব্লাস্ট অ্যান্ড ব্লেস : র্যাডিক্যাল ইসথেটিকস ইন দি রাইটিংস অফ হেনরি মিলার অ্যান্ড এজরা পাউণ্ড” ( ইউনিভার্সিটি অফ লণ্ডন ) গবেষণাপত্রে লিখেছেন যে, পাউণ্ড মনে করেন, ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’-এর নায়ক আমাদের কালখণ্ডের নিয়তির কারণে নিচেরতলার জীবনে পড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল, আর সেই নিয়তি হল মুদ্রানির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো। নায়কের দৃষ্টির এলাকা অনেকটা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কেননা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে নেমে গেছে সমাজের তলদেশে। পাউণ্ড মনে করেন যে ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ হল সাহিত্যিক বিবর্তনের শেকলের একটি জরুরি জোড় যা জেমস জয়েসের “পোরট্রেইট অফ অ্যান আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়াংম্যান ( ১৯১৬ ) যা পরে “ইউলিসিস” ( ১৯২২ ) উপন্যাসের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে গেছেন জেমস জয়েস এবং “টার” ( ১৯১৪-১৫ ) উপন্যাসের মাধ্যমে উইনঢ্যাম লিউইস। পাউণ্ড বলেছেন যে অতিসিরিয়াস সমালোচকদের থেকে হেনরি মিলার সাহিত্যকে মুক্ত করেছেন কেননা তাঁর প্রগতিবাদী ও সত্যবাদী বই জয়েস আর লিউইস-এর পাশাপাশি রাখা যায়।
জেমস জয়েসের সঙ্গে হেনরি মিলারের তুলনা বেশ সমস্যামূলক। জয়েসের এই উক্তি যে, “এমন সৌন্দর্য সম্ভব নয় যা বিরক্তি জাগায় না এবং আপাতসৌন্দর্যের ভেতরের কলুষকে আর আপাতকলুষের ভেতরে সৌন্দর্যকে চিহ্ণিত করার ক্ষমতার জন্য” পাউণ্ড মিলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন জয়েসের। মিলার যুগপৎ গেছেন ও ফিরেছেন চোখে দেখা সৌন্দর্যে এবং সত্যিকার নোংরা ও কলুষিত জগতে, দেয়ালে ঠেসান-দেয়া দুস্হ বেশ্যাদের থেকে এক লহমায় মাতিসের অবিস্মরণীয় ছবিতে। পাউণ্ড বলেছেন যে এরকম দ্বৈতদৃষ্টি একই চাউনিতে তিনি আর কোথাও পাননি। পাউণ্ড মনে করেন যে মিলার জয়েসের নান্দনিক প্রতিভার অংশ সংগ্রহ করতে পেরেছেন অর্থাৎ জয়েস যেভাবে একই বস্তুতে বা ঘটনায় পরস্পরবিরোধিতা দেখতে পান, বহির্জগতের কলুষের মাঝে অন্তরজগতের কবিতা খুঁজে পান, মিলার তা উত্তরাধিকারসুত্রে জয়েসের কাছ থেকে পেয়েছেন।
এজরা পাউণ্ডের বক্তব্য হলো যে ‘পোরট্রেট’ এবং ‘ইউলিসিসে’ জেমস জয়েস জনগণের মস্তিষ্কের ভেতরে যে চিন্তাপ্রক্রিয়া চলছে তার সাহিত্যিক সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর রোগনিদান করতে চাইছেন, যখন কিনা মিলার তাঁর নিজের মস্তিষ্কের ভেতরে চলতে থাকা চিন্তাপ্রক্রিয়াকে সততার রঙে রাঙিয়ে চলেছেন। পাউণ্ড বলেছেন যে মিলার কাফে ইনটারনভাশানালের ভিড়ের জীবনের মাঝখানে , সুস্পষ্ট বোধের দ্বারা বজায় রাখতে পারছেন ক্রমোচ্চ মূল্যবোধের ভালো-খারাপের পার্থক্য। মানব মস্তিষ্কের অবস্হা সম্পর্কে যুগারম্ভের প্রতিবেদন হিসাবে জয়েসের যে অবদান ছিল ১৯০০ আর ১৯১০ এর বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী কালখণ্ডে, মিলারের ভূমিকা তেমনই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কালখণ্ডে, মনে করেন পাউণ্ড। তিনি বলছেন যে মিলারের ক্রমোচ্চ মূল্যবোধর কাঠামো বেশ পোক্ত।
হেনরি মিলার পুঁজিবাদের জেলখানা ভেঙে ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষপাতি, তিনি তাকে শোধরাবার বা নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবেননি, কিন্তু এজরা পাউণ্ডের সঙ্গে তাঁর চিন্তার মিল এই হিসাবে আছে যে দুজনেই মনে করেন পুঁজিবাদ হলো মস্তিষ্কবিকৃতির একটি আইনসন্মত ও সংস্হাগত ব্যবস্হা। ন্যারেটিভের মাঝে মিলারের পুঁজিবাদবিরোধী বিষোদ্গার ও শ্রমিকদের অবৈধ শোষণ পাউন্ডকে টেনে এনেছে মিলারের ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’এর সমর্থনে।
পাউণ্ড মনে করেন, জেমস জয়েস যেমন হ্যারল্ড ব্লুমের ভাবনাচিন্তাকে নিজের অভিজ্ঞতায় নিয়ে এসেছেন, তেমনই হেনরি মিলার যিনি ‘ট্রপিক’ এর বর্ণনাকারী, অবিরাম প্রতিটি ব্যাপারকে নিজের ভাবনার ভেতরে জায়গা করে দিচ্ছেন। মিলার তাড়িত হচ্ছেন এক গন্ধ থেকে আরেক গন্ধে, এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে, তাঁর চোখ পরপর দেখে চলেছে আর তা লিখে চলেছে। মিলার হয়তো উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু তাঁর চিন্তাধারা সুসঙ্গত, নিজস্ব মতের দ্বারা চালিত, ফলে তিনি প্রশ্নে জর্জরিত নন।
হেনরি মিলার ছিলেন লুথেরান প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টধর্মী পরিবারের। শৈশব থেকে ধর্মের প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না, যদিও তাঁর মা তাঁকে প্রটেস্ট্যান্ট গির্জায় নিয়ে যেতে চাইতেন। মিলারের প্রথম স্ত্রীও ধার্মিক ছিলেন এবং তাঁর ধার্মিক রক্ষণশিলতার কারণে মিলার বিরক্ত হতেন। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন ইহুদি, ফলে খ্রিষ্টধর্মের কোনো আচরণ পালন করার দরকার হতো না। তাঁর শেষ স্ত্রী ছিলেন বৌদ্ধধর্মী, তিনিও জাপান থেকে আমেরিকায় গিয়ে মিলারের ওপর জোরাজুরি করেননি। মিলার তাঁর ছেলে-মেয়েকেও ধর্ম থেকে মুক্ত রাখতে চাইতেন। প্যারিসে গিয়ে ভবঘুরের জীবনে নিজের থেকেই ধর্মের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ২০০৭ সালে মিলারের ধর্মাচরণ নিয়ে টমাস নরবিট লেখেন “হেনরি মিলার অ্যাণ্ড রিলিজিয়ান”। নরবিট লিখেছেন যে সারাজীবন ধরে হেনরি মিলার যে ধর্ম পালন করেছেন তা হল নিজের মুক্তির ; তাঁর বইগুলোতে যে ধর্মগুলো সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ প্রতিফলিত হয়েছে তা প্রধানত মূল সমাজের প্রান্তিকতার, যেমন গুর্জিয়েফ, রোসিক্রুনিয়ানিজম, থিওজফি, জেন বৌদ্ধধর্ম, স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাণী, যা থেকে তিনি নিজের লেখার পক্ষে রসদ সংগ্রহ করেছেন এবং আত্মসমর্থনের জন্য অন্তরজগতে গড়ে তুলেছেন সৃজনশীল আইকনোক্লাজম। ‘ট্রপিক’ সিরিজ লেখার সময়ে মিলার জেকব বোহেমে ও তাও দর্শন, হেনরি বার্গসঁর “টু সোরসেস অফ মরালিটি অ্যাণ্ড রিলিজিয়ন” ( ১৯৩২ ) দ্বারা প্রভাবিত হন।
টমাস নেসবিট তাঁর বইতে মিলারকে উপস্হাপন করেছেন বিশ শতকের প্রথমার্ধের আভাঁ গার্দ, রহস্যমূলক ধর্মচিন্তার সন্তান হিসাবে। ডি এইচ লরেন্স এবং ডাবলু বি ইয়েটসও রহস্যমূলক এবং আদিম ধর্মাচরণের প্রতি একইভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বিকল্প ধর্মগুলো থেকে সূত্র আহরণ করেছেন মিলার, যেগুলো বলে যে জগতসংসারে দেবত্ব অন্তর্নিহিত, আধ্যাত্মিক মুক্তির সাধনী হিসাবে প্রয়োজন যৌনতা, এবং প্রতিস্বের উত্তরণের জন্য নৈতিকতা অবশ্যই অনুজ্ঞামূলক।
১৯৪৬ সালে ফ্রান্সে, ফরাসি ভাষায় যাতে হেনরি মিলারের ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’, ‘ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন’ এবং ‘ব্ল্যাক স্প্রিঙ’ প্রকাশিত না হয়, তাই ড্যানিয়েল পার্কার নামে এক পাঠক, মিলার ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে একটি মামলা ঠুকেছিলেন। এই মামলায় মিলারকে সমর্থনের জন্য এবং সাহিত্যে সেনসরশিপের বিরুদ্ধে ফরাসি লেখকরা ‘ডিফেন্স কমিটি ফর মিলার অ্যাণ্ড ফ্রি এক্সপ্রেশান’ গঠন করেন যার সদস্যদের অন্যতম ছিলেন আঁদ্রে জিদ, জাঁ পল সাত্রে, আঁদ্রে ব্রেতঁ, পল এলুয়ার, রেমন্ড কোয়েন্যু, জর্জ বাতাই প্রমুখ। খ্যাতিমান লেখকরা মিলারের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন দেখে ড্যানিয়েল পার্কার মামলা তুলে নেন। জর্জ বাতাই ১৯৪৬ সালে তাঁর পত্রিকা ‘ক্রিটিক’-এ মিলারের সমর্থনে দুটি প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু তার পরও মিলারের সঙ্গে জর্জ বাতাইয়ের কখনও পরিচয় হয়নি। তার প্রধান কারণ মিলার ছিলেন বুদ্ধিজীবিবিরোধী, এবং দার্শনিক-বুদ্ধিজীবি হিসাবে বাতাই প্যারিসে বিখ্যাত ছিলেন। আশ্চর্য যে মিলারের সঙ্গে কখনও বাতাইয়ের পরিচয় হয়নি, এবং মিলারের লেখায় বাতাইয়ের কোনো উল্লেখ নেই, যখন কিনা পরিচিত প্রতিটি সাহিত্যিক ও শিল্পীদের কথা তিনি কোথাও না কোথাও ঠিকই লিখেছেন।
জাঁ পল সার্ত্রে অতীন্দ্রিয়বাদী হিসাবে জর্জ বাতাইকে নাকচ করে দিলেও ১৯৬২ সালে বাতাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর দার্শনিক চিন্তায় প্রভাবিত হয়েছিলেন মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা, ফিলিপ সোলার্স, জাঁ বদরিলার, জ্যাক লাকাঁ, জুলিয়া ক্রিস্তেভা প্রমুখ পরবর্তী প্রজন্মের ভাবুকরা। ১৯২৮ সালে জর্জ বাতাই ‘স্টোরি অফ দি আই’ নামে একটা নভেলা লিখেছিলেন, বেনামে, লর্ড আউচ নামে, আউচ অর্থাৎ পায়খানা। এছাড়াও, ডিয়ানাস, পিয়ের অঞ্জেলিক, লুইস ট্রেনটে ইত্যাদি ছদ্মনামে ইরটিক উপন্যাস লিখেছেন বাতাই। সেসময়ে বইগুলোকে পর্ণোগ্রাফি বলা হলেও, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট ভাবুকরা বইগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। জর্জ বাতাই স্বনামেও কয়েকটি ইরটিক নভেল লিখে গেছেন। স্বনামে তিনি হেনরি মিলারের আলোচনা ছাড়াও, সাহিত্য, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, এবং শিল্পের ইতিহাস বিষয়ে বই লিখেছেন। পরাবাস্তববাদী আন্দোলন থেকে আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁকে বের করে দিয়েছিলেন। মিলারের সঙ্গে পরাবাস্তবাদীদের ভালো যোগাযোগ ছিল কিন্তু তিনি আন্দোলনে যোগ না দিয়ে তাদের নিরীক্ষাগুলোকে চুপচাপ নিজের গদ্যে প্রয়োগ করে গেছেন, আমেরিকায় ফিরে গিয়েও।
আলোচক ও বিষয়ের মাঝে যে দেয়াল বিদ্যায়তনিক এবং রক্ষণশীল তাত্ত্বিকরা তুলে রেখেছেন তা ভেঙে ফেলার ব্যাপারে বাতাই এবং মিলার একমত। যেমন মিলারের ক্ষেত্রে, তেমনই বাতাইয়ের ক্ষেত্রে, লেখালিখি ব্যাপারটা লেখকের নান্দনিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টির সামগ্রিক সহজাত অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করে। মিলার জানতেন যে নিজেকে ন্যারেটিভের কেন্দ্রে উপস্হাপনের দরুন এবং সেই লোকটির পার্সোনার মাধ্যমে সাহিত্য-দর্শন-শিল্প ইত্যাদির সমালোচনায় বিপদ আছে, তবু তিনি তা বিন্দাস করে গেছেন। কিন্তু বাতাই প্রথমত নিজেকে বেনামের পেছনে লুকিয়েছেন এবং ফিকশানের মাধ্যমে সাহিত্য-দর্শন-শিল্পের মূল্যায়ন এড়িয়ে গেছেন। মিলার যে আক্রান্ত হয়েছেন তা কেবল অশ্লীলতার জন্য নয়, উপন্যাসের ভেতরেই সাহিত্য-দর্শন-শিল্পের মূল্যায়নের কারণেও ; অনেকেই আহত বোধ করেছেন সেকারণে। বুদ্ধিজীবি বাতাই যাবতীয় মূল্যায়ন করেছেন পৃথক-পৃথক গ্রন্হে।
জর্জ বাতাই মিলারের প্রচণ্ড যৌন পারসোনার সমালোচনা করছেন কেননা মিলারের যৌনতা, বাতাইয়ের মতে, কলুষিত অশ্লীলতায় নির্ভর ; কলুষিত অশ্লীলতা এইজন্য যে মিলারের যৌনতা তাঁর লালসার শিকারদের হীন প্রতিপন্ন করে, বিশেষ করে মহিলাদের। মিলারের যৌনতা বাতাইয়ের বিশেষভাবে অশ্লীল মনে হয়েছে তার কারণ তাঁর যৌনসঙ্গিনীদের মূল্য কেবল লালসার আধার হিসাবে দেখানো হয়েছে। মিলারের সংবেদন সবসময় তাঁর সঙ্গিনীদের কলুষিত করার সঙ্গে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে। প্রলুব্ধ এবং শ্রদ্ধা করা থেকে নিজেকে আলাদা রাখার দরুণ মিলার যা করছেন তাকে অশ্লীলতার কলুষ বলা যায়. মনে করেন বাতাই।
সাহিত্য ও অমঙ্গলের ( Evil ) তুলনামূলক আলোচনায় বাতাই সেই স্হিতির সন্ধান করছেন, যাকে তিনি বলছেন চরম ব্যক্তিগত সার্বভৌমত্ব ; এবং সাহিত্য নির্ভর করবে সীমালঙ্ঘনের ওপর এবং অমঙ্গল প্রকৃত জ্ঞানের ওপর। বাতাই মনে করেন আধুনিক সভ্যতা ভেতর থেকেই ফোঁপরা, কেননা তা কোনোরকমে টিকে থাকাকে প্রোৎসাহিত করে। অমন সমাজব্যবস্হায় ‘শুভ’কে ‘অশুভ’র তুলনায় গ্রহণযোগ্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়, উপযোগীতাবাদকে অপচয়ের তুলনায় গ্রহণযোগ্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়, ফলে অশুভ বা অমঙ্গলের প্রতি আকর্ষণকে মৃত্যুর পর্যায়ে ফেলা হয়। ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব, মনে করেন বাতাই, জীবনধারণের নিয়মকানুনের ঊর্ধে। তিনি বলেন যে সাহিত্য যেন নিয়মকানুন লঙ্ঘনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে, যা নিষিদ্ধ তার বিরুদ্ধে, অশুভ ও অমঙ্গলের পক্ষে, কেননা তা-ই হল ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব। বাতাই শুভ ও অশুভ বা মঙ্গল ও অমঙ্গল, অশ্লীলতা ও নৈতিকতার যে দ্বৈততার টেনশনে আক্রান্ত, হেনরি মিলার অমন টেনশন থেকে একেবারে মুক্ত। বাতাইয়ের তত্ত্ব লেখালিখিকে একেবারে অসম্ভব একটা জায়গায় নিয়ে যায় ; বাতাই মনে করেন যে এই অসমম্ভবকে আয়ত্ত করাই সাহিত্য।
জর্জ বাতাই যে মিলারের উপন্যাসে কলুষিত অশ্লীলতা খুঁজে পেয়েছেন তা বিস্ময়ের কেননা তিনি নিজেই বেশ কয়েকটি উত্তেজক ইরটিক উপন্যাস লিখেছেন। পার্থক্য এই যে বাতাই সেই উপন্যাসগুলোয় রাজনীতি, সমাজে পবিত্র হিসাবে পরিগণিত চিন্তা ও আচরণকে ইরটিকের সঙ্গে বুনে দিয়ে লেখালিখির একটি ভিন্ন ধারা গড়ার প্রয়াস করেছেন। পক্ষান্তরে হেনরি মিলার, শব্দদের ভালোবাসতেন, কোনো শব্দকে উপেক্ষা করতেন না, তিরিশ বছর নিজের দেশে নিষিদ্ধ ছিলেন এবং বিপজ্জনকভাবে অর্ন্তঘাতী লেখক হিসাবে একের পর এক বইতে নিজেকে তুলে ধরেছেন। বাতাইয়ের দৃষ্টিতে মিলারের কলুষিত অশ্লীলতা গ্রহণযোগ্য না হলেও, মিলার নিজেকেই উপস্হাপন করে গেছেন, এমনকি প্রধান চরিত্রের নামও হেনরি মিলার, যার মাধ্যমে তিনি একটি বৈপ্লবিক ও দ্রোহী কন্ঠস্বরের জন্ম দিয়েছেন, এবং বাতাই-কথিত বক্তিগত সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে পেরেছেন।
২০১৩ সালে ইনড্রেক ম্যানিসটে হেনরি মিলারের জীবনদর্শন নিয়ে একটি বই লিখেছেন “দি ইনহিউমান আর্টিস্ট : এ ফিলোজফিকাল এনকোয়ারি” নামে। ম্যানিসটে বলেছেন যে, মিলারের একটি নিজস্ব জীবনদর্শন আছে, যা তাঁর অধিকাংশ টেক্সটকে নির্মাণ করে। এই দর্শন, জীবনের আধিবিদ্যক বোধ হিসাবে, তাঁকে বুঝতে পারার একটি প্রণালী গড়ে তোলে। মিলারের বুনিয়াদি বক্তব্যগুলো ঠাহর করার জন্য প্রণালীটির সমাধান জরুরি। আধুনিক কালখণ্ডকে মিলার আক্রমণ করেছেন তাঁর এই আধিবিদ্যক বোধের দ্বারা। আধুনিকতার শেষ পর্যায়ে ইতিহাস, প্রযুক্তি এবং শিল্পের নান্দনিক ব্যাখ্যা যেভাবে উপস্হাপিত, মিলারের দর্শন তাকে আঘাত দিতে চেয়েছে, এবং পাশ্চাত্য অধিবিদ্যাকে অতিক্রম করে যেতে চেয়েছে। মিলারের দর্শনের উদ্দেশ্য হল আধুনিকতাবাদী সমাজের সংকট ও তার অমানবিক লক্ষ্যকে ছাপিয়ে নিজের মুক্তি।
১৯৮৪ সালে ‘গ্রানাটা’ পত্রিকায় জর্জ অরওয়েলের প্রবন্ধ ‘ইনসাইড দি হোয়েল’-এর সমালোচনা করে সালমান রুশডি ‘আউটসাইড দি হোয়েল’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। রুশডির বক্তব্য হল আশেপাশে যে রাজনৈতিক ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে তা থেকে লেখক দূরে থাকার জন্য তিমির পেটের ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারেন না, তিমির পেট বিশাল, মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়ে দুনিয়ায় কি ঘটে চলেছে তা দেখতে আর শুনতে পাবে না, হেনরি মিলারের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে, ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ বইটি লেখার সময়ে ও প্রকাশিত হবার সময়ে দ্বিতীয় যুদ্ধের উথালপাথাল শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু মিলারের ন্যারেটিভে তার কোনো আভাস নেই।
জিলেস মেইনে ১৯৯৩ সালে তাঁর “ইরটিসিজম ইন জর্জ বাতাই অ্যান্ড হেনরি মিলার” গ্রন্হে সালমান রুশডির বক্তব্যকে খণ্ডন করার প্রয়াস করেছেন। মেইনে বলেছেন, উদারপন্হার আড়ালে মিলারের জগত অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অসূয়ক বাস্তবকে লুকিয়ে রেখেছে। তিনি যে অশুভকে শুভতে পালটে দিচ্ছেন, তা থেকে অশুভকে হীন করে তুলছেন না, তাকে করে তুলছেন অতীব অশুভ : এই অশুভ, অশুভ হিসাবে অনুভবেদ্য নয়, এবং কর্মটি করা হচ্ছে তার অবগতি ছাড়াই ( যদিও যৎসামান্য আনন্দের রেশ থাকছে তাতে ) ; এই অশুভ বর্বর অত্যাচারের অশুভ ; এই অশুভকে সংস্হাগত অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, আইনের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে এবং বৈধতা প্রদান করা হচ্ছে -- অর্থাৎ একটি একনায়কতন্ত্রী বা সর্বগ্রাসী ব্যবস্হার স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে।
ক্যারোলিন বিনডার তাঁর “দি সেল্ফ মেড সুররিয়্যালিস্ট : আইডিওলজি অ্যাণ্ড ইসথেটিক্স ইন দি ওয়র্ক অফ হেনরি মিলার” ( ২০০০ ) গ্রন্হে বলেছেন যে মিলার ১৯৩৮ সালে তাঁর ‘অ্যান ওপন লেটার টু সুররিয়্যালিস্ট এভরিহোয়্যার’ রচনায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে তিনি স্বপ্নের উপাদানকে স্বীকৃতি দিলেও অটোমেটিক রাইটিংকে মেনে নেননি। মিলার বলেছিলেন তা সম্ভব নয়, ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত , লেখা এমন হওয়া দরকার যা পাঠক বুঝতে পারবে। তিনি ‘ইজম’ ব্যাপারেরও বিরোধী ছিলেন। কয়েকজন পরাবাস্তববাদী কমিউনিস্ট হয়ে গেলে মিলার বলেছিলেন ফ্যাসিবাদ আর সাম্যবাদে ব্যক্তির অবস্হা একই, তার স্বাধীনতা থাকে না। ফ্রয়েডকে নিয়ে পরাবাস্তববাদীদের বাড়াবাড়িকেও নাকচ করেছিলেন মিলার ; বলেছিলেন ফ্রয়েড যা বলেছেন তা কোনো তত্ব নয়, তা হল শিল্পবস্তু, তাঁর তত্ত্বকে মানবার প্রয়োজন নেই।
“দি ভারচুজ অফ দি ভিশাস” ( ১৯৯৭ ) গ্রন্হে কিথ গ্যাণ্ডেল বলেছেন, হেনরি মিলারের পথে পরবর্তীকালে হেটেছেন জ্যাক কেরুয়াক, উলিয়াম বারোজ, কেথি অ্যাকার, চার্লস বুকোস্কি, নরম্যান মেইলার প্রমুখ লেখকেরা, যাঁরা প্রটেস্ট্যান্ট মূল্যবোধের সীমা ভাঙচুর করে এক নতুন ব্যক্তিত্ব গড়তে চেয়েছেন। প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মের যে সীমা ছিল আবেগ, আসক্তি, যৌনতা, আত্মসংবরণ সম্পর্কে, যাকে বলা হতো চরিত্র পরিষ্কার রাখা, তা এনারা অস্বীকার করে সাহিত্যের নতুন দিশা দিলেন এবং সমাজের পরিধিতে বিস্তার ঘটালেন। এ ভাঙা হল ভাঙার জন্যই ভাঙা , কেননা ভাঙা আর গড়ার মধ্যে এনাদের কাছে কোনো পার্থক্য নেই। এনারা ব্যক্তিত্বের পরিভাষায় পরিবর্তন এনেছেন ।
হেনরি মিলার যখন বিগ সার-এ ঘাঁটি গাড়েন তখন এমিল হোয়াইট নামে তাঁর এক প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। হোয়াইট ষাটের দশকে বিগ সার-এ প্রতিষ্ঠা করেন ‘হেনরি মিলার মেমোরিয়াল লাইব্রেরি’। হোয়াইট ১৯৮৯ সালে মারা গেলেও লাইব্রেরিটি এখনও আছে এবং সেখানে প্রতি বছর ছোটো ফিল্ম উৎসব, কবিতা পাঠ, গ্রন্হপ্রকাশ, মিউজিক ব্যাণ্ড, বক্তৃতা ইত্যাদির আয়োজন হয়। মিলারের আঁকা জলরঙের প্রতিলি্পিও পাওয়া যায়।
আলোচনাটা আরম্ভ করেছিলুম মিলারের প্রতি কবি উইলিয়াম কারলস উইলিয়াম-এর শ্রদ্ধা দিয়ে। শেষ করছি বিটলস দলের গায়ক জন লেননের এই গান দিয়ে :
Most of us,
Quite a lot of us anyway,use four letter words.
#
I know most of men do.
#
Usually they don’t
when there are women around,
which is hypocritical,
really.
#
Words can’t kill you.
#
The people that banned words
In books didn’t stop people
from buying those books.
#
If you couldn’t buy Henry Miller
In the early sixties
You could go to Paris or England.
#
We used to go to Paris
and everybody would buy Henry Miller books
because they were banned,
and everybody saw them,
all the students had them.
#
I don’t believe words can harm you
[ রচনাকাল : এপ্রিল-মে, ২০১৬ ]