এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বইপত্তর

  • অসমাপ্ত ক্যানভাস 

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ২০ জানুয়ারি ২০২৪ | ৬৮২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  •  
     
    অমৃতা জীবন ভালোবাসত – অফুরন্ত জীবনীশক্তি নিয়ে সে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিল জীবনের সাথে। আরো সহজ করে বলতে গেলে সে বড় ভালোবাসা ভালোবাসত। স্বাভাবিক ভাবেই তার কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে ভালোবাসার কথা আর তার সাথে লেগে থাকা জীবনের কথা। 

    “নারী পরাজিত হতে ভালবাসে
    লতিয়ে থাকে ভালো থাকার
    ঘন সবুজ আস্তানায়”

    একমাত্র ভালোবাসার কাছেই পরাজিত ছিল সে। সেই স্বেছা পরাজয়ের পর খুঁজে নিয়েছে সে নিজের আস্তানা – যেখানে আস্তানা মানে ঘর, আস্তানা মানে আশ্রয়, আস্তানা মানে নিজের একান্তের প্রকাশ।

    এক সময় কবিতা লজিক্যাল থাকে না – আর থাকার দরকারও তো নেই মনে হয় সবসময়! সব সময় কবিতা দিয়ে সাহিত্যের বাঁকবদল নাই বা হল! কোন নতুন যুগের সূচনা করার জন্য কবিতা লিখতে চায় নি সে। কবিতা ছিল তার প্রকাশ – তার সাময়িক নিঃসঙ্গতার সাথী। 

    লেখার কালক্রম অনুযায়ী অমৃতার কবিতা পড়তে গিয়ে দেখছি, কোন কোন সময় সেগুলি যেন তার ডায়েরী হয়ে উঠেছে। দেশ ছেড়ে প্রথম বারের জন্য বিদেশ গিয়ে বসবাস শুরু করা – বাংলা এবং বাংলা ভাষা প্রবল ভাবে ভালোবেসে বড় হওয়া একজনের কাছে এই স্থানান্তর সাময়িক কত কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে তা যেন ওর কবিতা মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেয় –

    “উজ্জ্বল কালো কোটের সংলাপ,
    ফরাসি সুগন্ধে চাপা পড়ে আছে,
    অগোছালো ভালবাসার ঘ্রাণ ।
    সাতসমুদ্রের পারে কোনো নিখুঁত ঘুমন্ত-
    শহরে ও খুঁজে চলা সেই নিলাভ ধূসর তারা ।
    ওয়াইনের লাল জলে তখন ধুয়ে যাচ্ছে,
    আমার সোনার বাংলা, সবুজ ক্ষেত”।

    অমৃতার প্রথম বিদেশ বাসকালীন কবিতায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে একাকীত্বের কথা – সে যেন নিজেকে খুঁজে নিতে চাইছে প্রবলভাবে সেই নতুন পরিসরে, নতুন জানলার কাঁচে, ক্যানালের ধারে, অসমান ইঁট পাতা লাল রাস্তায় টেনে নিয়ে যাওয়া স্যুটকেসের অচেনা অসময়ের শব্দে। প্রিয়জন বাড়িতে নেই দিনের বেলায়, একাকী বেরিয়ে মেখে নিচ্ছে সে নতুন শহরের কোলাহল, শুষে নিচ্ছে সে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া ফিকে হয়ে আসা সুগন্ধ। আমাকে বলত সে, “এখানে মেয়েরা বড় সুন্দর সেজে রাস্তায় বেরোয়, জানো”! সমস্ত সুন্দরের প্রতি প্রগাঢ় দূর্বলতা লালন করে রাখা সে ক্রমশঃ ভালোবেসে ফেলছে নতুন শহর। 
     
    “আমি থামতে চেয়ে পারিনি কখনও
    রাস্তাটা দৌড়ে ফিরেছে আমার সাথে
    ভাঙ্গা ওয়াইনের বোতলের পাশ দিয়ে
    ম্যাপেল পাতায় পা রেখে ছুটে বেরিয়েছি
    গোলাপি রিবনে বাঁধা আছে উপহার
    ঝকঝক করছে সাদা পালক গুলো
    আমি লাল ভালবাসি”

    এ এক অদ্ভূত দোটানা – সে এমন শহর যে না ভালোবেসে উপায় নেই। তার উপর যদি সে সুন্দর চার্চের কারুকাজ ভালোবাসে, শুনতে যায় সিম্ফনি প্রথম বারের মত একরাশ বিষ্ময় নিয়ে, অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ভ্যান গগের ছবির সামনে, আর ক্যানালের ধারে ছড়িয়ে থাকে ক্যাফেতে সোনালী রোদ গায়ে মেখে বসে পড়ে যখন তখন! তাহলে মনের মানুষের কি হবে? কি হবে প্রিয় মানুষদের? সবার মাঝে থাকতে অভ্যস্ত কিভাবে মানিয়ে নেবে সে সারাটা দিনের একলা থাকা? মাঝে উইলি আসে কাজ করতে, তার সাথে প্রবল বন্ধুত্ব হয়ে যায় – অসম বন্ধুত্ব যেন। উইলি নাতির কথা বলে – তার নাতিকে নিয়ে অষ্ট্রেলিয়া চলে গ্যাছে তার ছেলে। উইলিরও একা লাগে। একাকীত্বের কি ভৌগলিক বিভাজন হয়! জানা নেই – শুধু জানি দুই অসম বয়সী নারী ভাগ করে নিত তাদের নতুনের সাথে মানিয়ে নেবার প্রথম কষ্টগুলি। 

    “খুব ঠাণ্ডা লাগে এখন
    খুব ঠাণ্ডা
    সাদা কলার লিলি গুলো হলুদ ঠোঁট উঁচিয়ে আছে
    খুব শীতল হলে দুঃখরাও কি পাথর হয়ে যায় ?
    যেটা জানতাম সেটা এতকাল সত্যিই তো ছিল
    যেটা সত্যি সেটা হঠাৎ একদিন মিথ্যে হয়ে যাবে
    এখন লোকটার ছেঁড়া টুপি দিয়ে জল পড়ছে
    খোঁড়া পায়ের ঠেলায় ছড়িয়ে পড়ছে কাদা
    অনেক দূর পর্যন্ত
    ওড়নার কোনে এসে লাগছে
    ওরা কেউ পিয়ানো বাজাতে পারে না
    গাছে একটাও ফুল ফোটেনি আজ”। 
     
     
    “তুমি আমাকে নিয়ে একটাও কবিতা লেখ নি” – আমাকে অনুযোগ করতে সে, প্রথম – প্রথম। এক সময় সে অনুযোগও ফিকে হয়ে এসেছিল। তুমি আবেগের প্রকাশ পারতে – আমি হয়ত পারতাম না। আমি জানতাম না বিদেশীদের মত বারবার তোমায় ভালোবাসি বলার কি প্রয়োজন! হয়ত প্রয়োজন ছিল সেই নতুন শহরে! একাকীত্বের ভৌগলিক বিভাজন না থাকলেও ভালোবাসারবাহ্যিক প্রকাশে সেই কুন্ঠা হয়ত তোমাকে প্রথম দিকে একাকী করে দিয়েছিল একটু বেশীই। আজ সেই সময়ের কবিতা পড়ে মনে হয় বুঝতে পারি তোমার চাওয়া কত সামান্য কিন্তুকি নিবীড় ছিল! তোমাকে হয়ত মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠে নি, সেই সময়েও আমার সব না লেখা কবিতার মধ্যে, না বলা ‘ভালোবাসি’ গুলির মধ্যে শুধু তুমিই ছিলে। তুমি যে সময়ে লিখেছ,

    “এই জানো আমাদের বাড়িতে আজ
    ভোর এসেছিল,
    তোমায় বলেছিলাম, ভুলে গেছো ?
    আজ আর বেরোবো না, কাল অনেক কাজ
    একটা হাজিরা দিতে হবে সময়ের খাতায়
    আমিও যে আছি
    কোথাও তো শেষ হবে জানি বড় কাছাকাছি ।
    তুমি তখনও থাকবে আমার সাথে ?” 

    আমি নৌকা পেরিয়ে অফিস যেতে যেতে সেই একই সময়ে বলেছি, “তুমি তখনও থাকবে আমার সাথে”? আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করে, “কিছু বললে তুমি”? আমি বলি কথাগুলি অমৃতার জন্য – এই ভাবে তোমাকে চিনে যায় আমার অনেক সহযাত্রী। আমি কেবল তোমায় জিজ্ঞেস করতে পারি নি, “তোমায় বলেছিলাম, ভুলে গেছ”? আমার কথাগুলি যে না বলা – সেই যেমন না বলা তোমার নিজের মুখে তোমার প্রথম দিকের একাকীত্ব! 

    তুমি তো ভালোবাসা পেতে উন্মুখ ছিলে – কিন্তু সেই প্রকাশে ছিল না অদেখলাপনা। ‘এমনই জীবন’ – ভেবে নিয়ে আমি সে সময়ে নতুন কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। আমার তখনকার কবিতায় ‘ভালোবাসা’, ‘প্রেম’ ইত্যাদি শব্দগুলি ছিল না। তাহলে কি আমি কবিতায় ওই শব্দগুলি প্রয়োগের থেকে সরতে সরতে অবচেতন মনে নিজের জীবন থেকেও ক্রমশঃ মুছে ফেলছিলাম ‘দূর্বল’ শব্দগুলি? বেশ কিছুদিন পরে জানতে পেরেছিলাম তুমি ওই ‘দূর্বল’ শব্দগুলির বড় কাঙাল ছিলে। আমি তা পুরোপুরি জানার আগেই তুমি লিখে ফেলেছিলে,

    “যে কোন কারনেই হোক 
    তোমায় ছুঁয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে,
    মনে হয় না-বলা শব্দেরা হয়ত কখনও নিঃশব্দে পৌঁছে যাবে
    তুমি দূরেই থেকো
    অনেক দূরে যেখানে ঠোঁট নীল হয়ে আসে
    ওরাও নিভৃতি ভালবাসে” 
     
    তোমার লিখে রাখা, আমার না লেখা – তোমার বলে ফেলা, আমার না বলা কথার মাঝখানেই আমরা ঘুরে নিচ্ছিলাম ইউরোপ, প্রাচীনতা – পরিত্যক্ত দুর্গ, সমুদ্রের নীল রঙ, নেশাড়ু শিল্পী হয়ে এশিয় মহাদেশের সীমান্ত দেশে তোমাকে বলিউডের নায়িকা হিসাবে বদ্ধমূল ধরে নেওয়া সেই স্থানীয় লোকজন। তুমি নিজেই বলতে ‘আমি রোমাণ্টিক’ – আর আমার নিজের কাছে তাহলে কি রোমাণ্টিকতার প্রতিশব্দ ছিল ‘দূর্বলতা’? হবে হয়ত – নিজেকে চিনতেও কত যে সময় লাগে, তোমার সাথে থেকে থেকে নিজেকে আরো যেন নতুন করে চিনে নিই। আমার জীবনের না উল্টানো জুড়ে যাওয়া পাতাগুলি তুমি সতপর্ণে খুলে দিচ্ছেলে। জুড়ে থাকা একগুঁয়ে পাতাগুলি কি সহজে খুলতে চাইছিল না? নাকি যতই সতর্পণে বহুদিনের জুড়ে থাকা পাতা উল্টাতে যাও, একটুখানি কোণা ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যায়!
     
    “অনেক কাল তোমার মধ্যে বাস করেছি
    এখন নিজের ভিতর আসন গেরে বসা দরকার
    নিয়ম মাফিক সম্পর্কে মিশে যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে
    লালচে রঙা আলোর বেলা প্রথম দেখা সবুজ পাতার
    সবই এখন খয়েরি দিন ধূসর লিখন
    আমি কিন্তু সাদা কালোয় রঙ ভরেছি যাবৎজীবন
    এবার খানিক নিজের কাছেই আসা দারকার
    এখন খানিক মুখ ফিরিয়ে জীবন ভালবাসা দরকার”। 
     
    সেই রোমাণ্টিক তুমি আর রোমাণ্টিকতার বিস্তারের পরিসীমা নির্ধারণে ব্যস্ত থাকা আমি প্রথম বার তোমার স্বপ্নের দেশে গেলাম। কি উচ্ছল দেখলাম তোমাকে – এত আবেগী এত প্রাণের প্রকাশ সেই প্রথমবার তোমাতে দেখা আমার। কিন্তু আজ খুঁজতে গিয়ে দেখি, তা নিয়ে তুমি কবিতা লেখো নি! আমি প্রথম অবাক হই, আবার তোমার খাতার পাতা উল্টোই, আবারও – দেখতে থাকি আমাদের আনন্দঘন একসাথে থাকার মুহুর্তগুলি নিয়ে তোমার কোন কবিতা নেই! তাহলে কি আমার প্রেমের কবিতা লেখার মতই, তুমিও আনন্দঘন সময়ের লিপিবদ্ধকরণেরযৌক্তিকতা নিয়ে দ্যোদুল্যমান ছিলে? আরো একবার খুঁজে দেখি – নাঃ, তোমার সেই সময়ের কবিতা ছিল তোমার আশ্রয়, তোমার একাকীত্বের আশ্রয়। আমরা যখন কাছাকাছি থেকেছি, তোমার প্রিয়জন যখন কাছাকাছি থেকেছে, তুমি মনে হয় কবিতার প্রয়োজন, অন্তত কবিতা লেখার প্রয়োজন অনুভব কর নি। নিজের জীবনকেই তুমি কবিতার মত করে নিয়েছিলে – সেই কবিতার বাঁকবদল ছিল, সেই কবিতার মাঝে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে ভাবতে ভালোলাগত, কবিতা শেষে আবার একবার পড়তে ইচ্ছা করত। কবি কি বলতে চেয়েছেন – তার মাঝে না ঢুকে তুমি নিজের মত করে নিয়েছিলে কবিতাকে – আমাদের দুজনার কবিতার জীবনকে, জীবনের কবিতাকে। 

    এক দিকে ‘প্রথম’ বিশ্বের প্রাচুর্য্যের হাতছানি, অন্যদিকে শিকড় উপড়ে আনা প্রাণবন্ত গাছের নতুন মাটিতে মানিয়ে নেবার প্রানপণ প্রচেষ্টা –

    “আমার মামার বাড়ির বকুল গাছটা
    সেই যে সেই গাছটা,
    হঠাৎই একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিল ।
    মাঠের সরু আলপথ ধরে
    পাশে ক্ষীন স্রোত সন্তর্পনে অতিক্রম
    করে গাছটার কাছে পৌঁছাতাম
    অদ্ভুত ! গাছটা একদিন উধাও হয়ে গেল।
    আর কখোনো দেখিনি”। 

    আমষ্টারডাম শহরের সবচেয়ে সুন্দর ক্যানালের ধারের বাড়ির পাঁচতলার ঘরে বসে তুমি বকুল গাছের কথা লিখছ। দেশের পরিজন তোমার চারপাশে এসে যাচ্ছে – তুমি তাদের সাথে কথা বলছ, সরাসরি আবার ফোন রেখে দেবার পরেও। তুমি এত ফুল ভালোবাসতে – আমরা দুজনে ফুলের দোকান, ফুলের জমির ভিতর দিয়ে নিয়মিত হেঁটে গেছি। আমি তবুও ডাচেদের ফুল ভালোবাসা নিয়ে কবিতা লিখেছি, কিন্তু তোমার খাতায় ফুলের উল্লেখ নেই কেন? নাকি আছে? খুঁজতে হয় – খুঁজতে খুঁজতে একবার স্যান্টোরিনির নীল জলের উল্লেখ পাই। সেই ঘন নীল –আমি জানি তুমি সেই দ্বীপ দেখার বহু আগে থেকেই ‘সী-গ্রীণ’ নামক রঙের আকর্ষণে মোহিত ছিলে। স্যান্টোরিনির নীল রঙ কি শুধু গাঢ় নীল ছিল, নাকি তোমার এই চিত্রকর চোখ কোথাও খুঁজে পেয়েছিল ওই দুই রঙের মেলবন্ধন? 

    “একপাতা ভালোবাসা লেখা
    অর্ধেক ভিজে যাওয়া পাইনের বনে
    শরীর পেরিয়ে আসা মনে
    যতটুকু চোখ পড়ে থাকে
    দেহ ভাঙা এক রাশ থৈ থৈ জলে
    ততটুকু সবুজ পিছলে পরে নীলে
    বড়ো মনে পরে সুখ
    ওরা কাছে এলে,
    যতটুকু সবুজ পিছলে যায় নীলে”।

    এই তো তুমি ভালোবাসার কবিতা লিখেছো! অন্তত আমার তো মনে হচ্ছে ভালোবাসার কবিতা – সবুজের সাথে প্রিয় নীলের মিলে যাবার কবিতা। 

    সময় এগিয়ে চলে – সময় এগিয়ে আসে ছেড়ে যাবার। যত চলে যাবার সময় আসে, তত তুমি আঁকড়ে ধর যেটুকু ভালোবাসার ছিল প্রথম বিদেশ বাসের। নতুনের হাতছানি আবার – নতুন দেশে যাবার হাতছানি। ভাবে নিতে ভালো লাগে যে তুমি দেশের কাছাকাছি অন্যদেশে থাকবে। আমি বলতে থাকি, “তুমি তো ইচ্ছে করলেই ফিরে যেতে পারবে নিজের কাছে”। “নিজের কাছে মানে?” – আমাকে প্রশ্ন করে অমৃতা। আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করি, “নিজের কাছে মানে, নিজের চেনা পরিসরে – চেনা প্রিয়জনে”। এত সুন্দর দেশ ছেড়ে যাবার একটুও কি দুঃখবোধ ছিল না তার? আমি খাতা উল্টেপাল্টে দেখি – তার কবিতার নিজের মত করে অর্থ করার চেষ্টা করি – আরোপিত ভাবনা দিয়ে হয়ত নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করি, এই তো শব্দবন্ধে লুকিয়ে আছে ছেড়ে যাবার কষ্ট! আসলে আমার নিজের আমষ্টারডাম খুব প্রিয়, সেই শহর ছেড়ে যেতে এক কষ্ট তৈরী হচ্ছিল। এখন ভাবতে ইচ্ছে করে যে, অমৃতা নিজে মুখে না বললেও, সেই সময় অন্তত আমরা দুজনেই একসাথে এক কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছি। আমি পাতা উল্টাই –

    “সাদা কুঁড়ির গা ঘেসে সবুজাভ চারটে পাপড়ি জেগে আছে
    পায়রাগুলোর নরম রোদে দল বেঁধে লুকোচুরি
    অনেক ভেজা দিনের শেষে
    এভাবেই হলুদ পাতার ক্ষোভ মিলিয়ে যাচ্ছে আজ
    সন্তর্পনে ভুল করছে পাতার ভাঁজে শুকিয়ে যাওয়া আবেগ
    এভাবেই আলো আসবে
    একপা ফেলেই ভুল ভেবে ধরবে অন্য হাত
    আমি দেখবনা শুধু
    রাত কতো বড় হয় জেনে গেছে সে
    ভোর তাই প্রিয় মনে হয়” 

    এ তো ছেড়ে যাবার কবিতা, ফেলে আসা কুঁড়ি আর খুনসুটি কপোত-কপোতির গল্প। সেই পায়রার মধ্যে আমরা লুকিয়ে থাকি, আমরা দুজন বেঁচে থাকি। আমাদের ফেলে আসার পায়রার গল্প অন্য কেউ দেখবে – অন্য কেউ হয়ত শুরু করবে নতুন ভাবে আমাদের আজকের ঘর থেকে। 

    শীত শেষ হতে শুরু করেছে, টিউলিপ ফোটার পালা প্রায় শেষ। আমরা আপাত শেষবারের মত ঘুরে নিয় প্রিয় জায়গাগুলি। নতুন দেশ নিয়ে আমাদের দু-জনের মনেই ভেসে ওঠে দুই আশঙ্কা – অমৃতা আমাকে বলে না, কিন্তু আমি ওর মনের প্রশ্ন অনুধাবন করে বোঝাতে থাকি ওখানে আরো বেশী চেনাশুনা হইয়ে যাবে হয়ত, হয়ত পেয়ে যাবে আরো বেশী বাংলায় কথা বলার লোক। একদিকে ছেড়ে যাবার দুঃখ-আনন্দ, অন্যদিকে নতুন জায়গা নিয়ে হালকা উৎকন্ঠায় আমরা দুজন পাশাপাশি শুয়ে থাকি সিলিঙের দিকে তাকিয়ে – তখন রাতের বেলা, পাশের কার্ণিশে পায়রা দুটি তবুও জানান দেয় ওদের জেগে থাকা। ওরাও কি অমৃতার আসন্ন ছেড়ে যাওয়া টের পেয়ে গ্যাছে?

    হয়ত এই প্রথম সে এক অদ্ভূত দোটানায় ভুগতে থাকে –আর তাই তো লিখে নেয়

    “কিছুটা এগিয়ে অথবা পিছিয়ে ঠিক এইখানেদাঁড়িয়েছিলাম
    একবার, দুবার অথবা বহু বহু বার
    কিন্তু একা
    চার্চ বেল আমাকে মধ্যরাত্রি মনে করায়
    আমি একা হতে ভালবাসি
    আমি নির্বাসনের ভয় পাই”।
     
    আমরা নতুন দেশে চলে আসি – নতুন দেশে অমৃতার কবিতা লেখা কমে আসে। আমি তার ডায়েরী ঘেঁটে দেখি কবিতার প্রকাশ পাল্টাচ্ছিল ক্রমাগতই। যেমন হয় আর কি – মানুষের বিবর্তনের সাথে সাথে তার কবিতা ভাবনাও পাল্টায়। ওর কবিতায় আবেগের থেকে বেশী করে আসতে শুরু করে উপলব্ধি – একাকীত্ব ক্রমশ কমে আসে। এমনি আস্তে আস্তে নতুন জায়গার ব্যস্ততায় কবিতা লেখার সময় টুকুও হারিয়ে যেতে থাকে। অঙ্ক নিয়ে আসত কেউ কেউ, আর আসত আঁকা, নাচ, আবৃত্তি, ক্রাফটস্‌ ইত্যাদি নিয়ে হাজারো জন। দিনের বেলায় সময় নেই – রাতে মাথার গোড়ায় খাতা নিয়ে বসে লিখে রাখত মাঝে মাঝে দুই চার লাইন। সে নির্বাসনের ভয় থেকে ক্রমশঃ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। আমাদের কাঠের বাড়ি, বাড়ির চারিদিকে সবুজ বাগান এবং জঙ্গল, দোরগোড়ায় সমুদ্র – অমৃতা নিজের দেশকে পেতে শুরু করে, নিজের ফেলে আসা গ্রামের সুবাস পেতে শুরু করে বাড়ির সেই বারান্দায়। বারান্দা প্রিয় হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে নিয়মিত অভ্যাস – সেই বারান্দাতেই আঁকার ক্লাস নেয় সে, নিজে ছবি আঁকে। 

    “আজ আর বারান্দায় বসা হয় নি
    মাঝরাতে কাঁচের গ্লাসে জলের আওয়াজে
    শুন্যতাটা এক পলক চমকে দিয়ে গেল
    আজ হলুদ আলো বুকে করে পিচ রাস্তায়
    বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ছলকে উঠেছে আমাকে ছাড়াই
    সবটাই বড় বেশী গোছানো কি?
    ……………………
    চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় দরজাটা খোলা আছে
    কলিং বেল টা অকেজো
    বেনামী চিঠির স্তূপে বসন্ত আসেনি তবু
    দরজাটা খোলায় আছে জানি
    সব চুরি হয়ে যাবে বলে
    সব চুরি হয়ে যাবে একদিন”।
     
    প্রবল গৃহিনী হয়ে ওঠে সে – প্রবাসী জীবনের সাথে  হয়ত সেই প্রথম বার ওতোপ্রতো জড়িয়ে পড়ে আস্তে আস্তে।হয়তবা এতোদিনের কল্পিত চুরির কল্পিত কবিতার লাইনে বাস্তবতা ঢুকে পরে। তার কবিতায় ছোট ছোট লাইনে বাস্তবতা জায়গা করে নেয় – চারপাশ থেকে শুষে নিয়ে সেই প্রথম বারের মত নিজের জারক রসে সম্পৃক্ত করে কবিতা। আর এই প্রথম বারের মত আমি মনে করতে থাকি, হ্যাঁ এই বার হয়ত ওর ‘লেখা’ কবিতা হয়ে উঠছে। পারিপার্শিক কেমন করে বদলে দেয় দৃষ্টিভঙ্গি, আমি আরও একবার তা চোখের সামনে দেখতে থাকি। অযথা শক্ত এবং আপাত কঠিন শব্দবন্ধ ব্যবহার প্রবণতা কমছে ওর কবিতায়। কবিতা স্বচ্ছ কিন্তু গভীর হয়ে ওঠে

    “শরীর ছিল
    যেমন সবার শুরু হয়
    গলে পরেছে চশমার কাঁচে
    বড় বেশি জমে যাক গল্পটা
    আমি ভিজব
    জমে যাওয়া ওমে
    আমি ভালবাসব
    তুমি থাকবে কাছাকাছি
    বড় বেশী সত্যি হয়ে”।
     
    আমরা নতুন দেশ বড় ভালোবেসে ফেলছিলাম খুব তাড়াতাড়ি – দূর্গাপুজো চলে আসে, পেরিয়ে যায় বড়দিন আবার ঘুরে পয়লা বৈশাখ। খাতা খুলে দেখি প্রতিটা উৎসবেই অমৃতা লিখে রেখেছে তার জীবনকে নতুন করে পাওয়া। তার কবিতায় আলোর ছায়া বেশী করে পরতে শুরু করে। এর পর আমাদের জীবনে নতুনের আগমনের জন্য বেশ কিছু দিন কবিতা থেকে ছুটি – অনেক পঙতি খুঁজে পাই বিছানার পাশের টেবিলে রাখা সেই খাতায় – কিন্তু পরিপূর্ণ কবিতা কম। 

    কবিতা সদ্যজাতর কথা ঘুরে ফিরে আসছে – তাকে নিয়ে স্বপ্ন, তাকে দেখে নতুন জীবন শেখা – জীবনের মধ্যে আরো এক অন্য জীবন যেন! কবিতার নাম দিচ্ছে “নতুন করে বাঁধব” – লিখে ফেলছে প্রবল আবেগে সরাসরি “আমি ভালোবাসছি ওকে”, আবার সদ্যজাতর সাথে পূর্বজন্মের টানের কথাও আসছে। লিখছে

    “এখন কিছু লিখতে গেলেই মনে হয়
    গায়ে গায়ে আটকে থাকা সোহাগের পাথরগুলো
    আলগা হয়ে যাচ্ছে”
     
    এই ভাবেই অমৃতা তার শেষ কবিতাটি এক সময় লিখে ফেলে। সে নিজে জানত না কোনটা তার শেষ কবিতা আর ঠিক কখন সে নিজের শেষ কবিতাটি লিখে ফেলেছে! আমি খাতা খুলে দেখি তার শেষ লেখা কবিতায় শেষের কথা নেই, আছে নতুন করে সাজের কথা – নতুন দেশে যাবার প্রস্তুতি। আসলে শেষের কবিতাখানি সে অনেক আগেই লিখে ফেলেছিল
     
    “যেদিন মাঝ দুপুরে আকাশ থেকে মুঠো ভোরে মেঘপাড়লাম।
    ইচ্ছা হল মস্ত রকম দেশ বানাবো । স্বচ্ছ চোখের দৃষ্টি ধরেবয়ে যাবে নদ-নদী সব। অনুভুতির গাছের ফাঁকেদুঃখ-সুখের হরেক রকম ফুল । চোরা প্রেম বাসা বাঁধবেডালে ডালে । বুক ভরে নেবে জলভরা নিশ্বাস । রামধনুগুঁড়ো হয়ে যাওয়া রঙ ছড়িয়ে দিয়ে যাবে চোখের পাতায় - 
    এতটুকু ভাবনাতেই বিভোর ছিলাম,
    হঠাৎ দেখি দেশটা পুরোই ঝরে গেল তোমার কোলে ।
    দেশটা পুরোই ঝরে গেল।
    এমন ভাবেও চলে যাওয়া যায়”?
     
    ----------------------------------------------
    অসমাপ্ত ক্যানভাস 
    অমৃতা মজুমদার
    সৃষ্টিসুখ প্রকাশন 
    ১২৫ টাকা

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • বইপত্তর | ২০ জানুয়ারি ২০২৪ | ৬৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন