১৪৫।
স্টেশন থেকে খই ছড়ানো রাস্তাটা বাঁক ঘুরে
চলে গেছে সবুজ ধান জমিকে সাথে নিয়ে
কত মোটরভ্যান চালক জানায় হাতের তালুর মত চেনে তারা অন্ধকার
শুনে লাল ছাপা শাড়ি পা বাড়িয়ে বলে
তালুটা তাহলে দেখি একবার –
মৃদু, কাঁপা, ঘেমে ওঠা হাতেও
উষ্ণতা জানান দেয়, অদ্ভূত রোমাঞ্চে এসে
আঙুল গুলো চাকা থামাতে ভুলে যায়
ওই তো মোড়লদের ধান ঝাড়া খামার থেকে জড়ো করে রাখা
খড়ের গাদা গল্প শোনায় সরস্বতী পুজোর
সেদিন আর এক লাল পাড় খামার ঘুরতে এসেছিল আচম্বিতেই
আরেকটা বাঁকের পর মরে যাওয়া
গোলাপ গাছ দেখবে দাঁড়িয়ে আসে সারি
শেষ বার যবে মরচে ধরা দরজা টেনে বেরিয়ে গিয়েছিল খোলা চোখ আর
লাল রঙ লেগে থাকা গলায়
গোলাপ ফুল বলতে চেয়েছিল কাছে এসে মাখিয়ে দিয়ে যাও
পাপড়িতে ওই লাল রঙ
তারপরের রাস্তাটা সোজা –
হাতের দরকার নেই, তালুরও
শুধু পা বাড়ানোর অপেক্ষা কেবল –
১৪৬।
ট্রেন থেকে তোলা ছবি ঝাপসা দেখায়
তবু অনেক বছর পরে সবুজ ক্যানভাস
আপার দূরে দেখা খয়েরী মাটির থেকে উড়ে
আসা ধূলো ভুলে আসা গন্ধ চেনায়
একসময় কমলা শাড়ির দেখা পাব বলে
যারা বসে থাকত কৃষ্ণচূড়ার থেকে দূরে
তারা এখন সময়ের অজুহাত দেয়
সকাল দশটা ক্রমশঃ মুছে গেছে
ভাঙা বাইকের ক্ষয়ে যাওয়া চাকায়
আর যাদের শাড়িতে ঝরে পড়ত
কৃষ্ণচূড়ার ফুল তারা এখন হাত ধরে
মেয়েদের নাক বেঁধাতে আসে
ওদের নাকের ডগায় একই রকম জমে ওঠে ঘাম একটু হাঁটলেই
শুধু কেউ আর অপেক্ষা করে না সাদা রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে
কল্পনার স্পর্শ – সকাল দশটার ট্রেন
এখন আর রাস্তায় ধুলো জমে না তেমন
কালো পিচের রাস্থায় ধরা যায় না ওদের চলে যাওয়া
অসময়ে বৃষ্টি এসে ধুয়ে দেয়
মুছে দেয় আতরের দাগ
আরো কালো ঝলমল করে ওঠে
১৪৭।
আলমারীর না খোলা দিকটায় আজ দেখলাম
অনেক দিনের চেনা কেউ বসে গল্প করছে
পাল্লা খোলার ঝটকা আলোয় সে চমকে গেল
জিজ্ঞেস করলাম কার সাথে কথা বলছিলে?
উত্তর এল - তোমার সাথেই তো!
এখানেই তো আমরা রোজ বাজারের তালিকা বানাই
জামা কাপড় মিলিয়ে বেড়াতে যাবার কথা
আরো অনেক কথা বলে চলে সে –
বলি এসো না এই সূর্যের আলোয় পিঠ দিয়ে বসি –
সে রাজি হয় না – বলে তার চেয়ে বরং পদ্মের গন্ধ মাখো
জাড়িয়ে নাও ভিয়েতনামের সি সন্ধ্যে
হঠাৎ আমার মুখে সিল্কের স্কার্ফ ঢেকে যায়
জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকে আলমারীর বন্ধ দিকটাকে নাড়িয়ে দেয়
তবুও সে বেরিয়ে আসে না –
এবার ইস্তানবুলের রঙীন লন্ঠনের গল্প শুরু করে
কেমন হেঁটে যেতে যেতে মুখের রঙ বদলাচ্ছিলো
গায়ের ছায়ার সাথে মিশে যাওয়া হাত ঢাকা চাদর –
ভাবি সরিয়ে দিই, ঠান্ডা মসৃণ ছুঁয়ে ফেলি অচম্বিতে
সে আবার অন্য শহরের গল্পে ঢুকে যায় –
যেখানে বছরের কিছুদিন সন্ধ্যে নামত গভীর রাতে
১৪৮।
এক রাতে ছাদে উঠেছিলাম আকাশ জোড়া তারা দেখতে
বদলে দেখা পেয়ে গেলাম জোছনার সাথে
অচেনা গলা প্রশ্ন করল, প্রেত আলো চেনো?
চোখের দিকে না তাকিয়েই জবাব দেবার ছলে
দেখে নিলাম হাত দুখানি মাখা রূপালি রঙ চকচক করছে
ভাঙা গলা দিয়ে বেরিয়ে এল অস্ফুটে আলোর প্রেত
ভাসলাম রূপালী তন্ত্রীতে
কালো আঁধারের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে নামছিল ওরা -
কম্পন, নাকি নিঝুম সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নামলে এমন হয়?
ডুবে যাওয়া সূর্য মাখেনি সেদিন কুয়াশা
অভিমানে তাই ভর করে বলে যায়
এই রাত অনেক গভীর হবে, এই রাতে
আকাশের একদিক থেকে অন্যদিকে খসে পড়বে আলোর ফুলকি
সেই রাতে দেখবে রঙের চাহিদা হবে
এইবেলা যদি মেখে নাও রূপালি আভা
ঘন আঁধারেও, চোখে চোখ না রেখেও দেখবে চিনে নেওয়া যাবে
অস্ফুট মুখ আর প্রেত আলো –
ঠোঁটে চুমুক দিতে চাইবে কেউ,
জোছনার ভ্রম ভেবে সিঁড়ির ঘরের আলো জ্বালালে
দেখবে রূপালি রঙ ক্রমশঃ মুছে যাবে তোমার দুহাত থেকে ।
১৪৯।
ক্লান্তি নামে
বাতাসের সাথে লেগে থাকা জলকণা ঘরে ঢুকে
ভিজিয়ে দেয় না ঝোলানো ছবির অলিভ বাগান
চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে
ইচ্ছে করে সেই নকশা কাটা ধূসর পাতায়
আঁকিবুকি করে ফুটিয়ে তুলি নরম পায়ের শব্দ
কিংবা গ্রীলের ওপাশে গল্প করতে আসা পশমের ওম
অথচ এতদিন বাতাস শুধু তোমার বারান্দাই পছন্দ করত
অযতনে সরিয়ে দিত সমুদ্রের আবরণ
কত সবুজ ঝুঁকে নিজেদের মধ্যে তর্ক করত
সমুদ্র কি সত্যিই সবকিছু ফিরিয়ে দেয়?
ক্লান্ত তখন
পায়ের জলের ছাপ, বালি না লেগে থাকা সৈকত চেনায়
এই পথে কেউ চিঠি নিয়ে যায় না, শুধু মুখোমুখি বসে
পাথরকুচির শক্ত পাতা মুড়িয়ে আনমনে আঁকিবুকি কাটে
নিঃস্ফলা বিকেল আর ডুবতে চাওয়া সূর্য
জলকণা মুছে দিই নরম কাপড়ে
দেখি অলিভ বাগানের ভিতর দিয়ে কে যেন হেঁটে আসছে
বুকে লেপ্টানো না লেখা চিঠিগুলি নিয়ে -
১৫০।
এত প্রশ্ন শেষে কি থাকে?
সেই তো শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরবে খালি জলের বোতল নিয়ে
এত রাতে কেউ আর জল ভরে না ফের,
তোয়ালে জড়ানো বোতল তোমার শরীরের সাথে
সারাদিন পাল্লা দিয়ে উষ্ণ হতে হতে একসময় শূন্য হয়েছে !
এত প্রশ্ন শেষে কি থাকে?
সেই তো জানালার উলটো দিকে বসে একাকী চিনতে চাইবে নিজেকে
শুধু সেই সামনের চোখজোড়ায় পারবে না যাচাই করে নিতে
একদিন এমন গভীর রাতের ট্রেন থেকেই নেমে গিয়েছিল
শেষ প্রশ্নের উত্তর না নিয়ে
এত জবাবের শেষে কি থাকে?
অমসৃণ কপাল দেখে বাড়িতে বলেছিল যত্ন নিস
চোখের উপরে চলে আসা চুল সরিয়ে দেবার আগেই ট্রেন থামে
সেদিনও এমনি দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেন
ঠান্ডা ঘর থেকে ফেরার পথে
কাঁপতে থাকা আঙুলগুলি মাঝে মাঝে
নিজেদের চিনে নিতে চায় ফেরার রাত গভীর হলে -
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।