সফল হতে গেলে কি লাগে? একজন মানুষের সফলতার পিছনে কি থাকে? এটা নতুন কোন প্রশ্ন নয় – তবে আজকালকার এগিয়ে যাবার প্রতিযোগীতার দৌড়ে প্রথম হবার জন্য এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য যেন হুড়োহুড়ি পড়ে গ্যাছে! ম্যাজিক ফর্মুলা ক্র্যাক করে ফেললেই যে আমিও সফল হয়ে উঠব। মার্কেটে তাই এই নিয়ে বই বা মোটিভেশনাল কথাবর্তার কোন কমতি নেই – ইন্টেরনেট সার্চ করলে এই টপিকে, মনে হয় সার্ভার ক্র্যাশ করবে, এত তথ্য! মোটামুটি কি বলা হয় সফল মানুষের সফলতার পিছনের রহস্য? সেই মানুষটির প্রতিভা, দক্ষতা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা, লেগে থাকার ক্ষমতা, আশাবাদী থাকার ক্ষমতা ইত্যাদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আমরা এই বৈশিষ্ট্যগুলি বেছে নিয়েছি কেন? কারণ এর পিছনে আমাদের অর্ন্তনিহিত অনুমান থাকে যে, এই বৈশিষ্ট্যগুলি যদি আমরা সেই সফল ব্যক্তিদের মত বা তাদের থেকে শিখতে পারি, তাহলে আমরাও সফল হব। আবার উল্লিখিত সব বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে আমরা সবচেয়ে প্রাধান্য দিই ‘প্রতিভা’ বিষয়টিকে।
কিন্তু প্রশ্ন হল এই অনুমান কি সত্যি? মানুষের সফলতার পিছনে সত্যিই কি প্রতিভা সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেয়? এই নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে বিজ্ঞানী এবং মনস্তাত্ত্বিকরা গবেষণা চালাচ্ছেন। এখনো পর্যন্ত যা জানা গ্যাছে, তাতে এটা প্রমাণিত যে শুধু প্রতিভা থাকলেই সফল হওয়া যায় না! এবার প্রশ্ন উঠতে পারে – ভাই, এ আর নতুন কথা কি শোনালি! এতো আমরা সবাই জানি!
আচ্ছা এবার যদি বলি যে, আজকের দিনের সফলতার প্রতীক হিসেবে আপনারা যাদের ধরেন, তাদের ওই অবস্থায় পোঁছনোর পিছনে তাদের প্রতিভার থেকেও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অন্য একটা জিনিস পালন করেছে – যেটা বৈজ্ঞানিক ভাবে স্টাডি করে পাওয়া গ্যাছে – তাহলে কি জানতে ইচ্ছে করবে সেই বিশেষ জিনিসটি কি?
হ্যাঁ, ঠিকই অনুমান করেছেন। সেটা হল ‘ভাগ্য’
আচ্ছা, এবার এখানে গুলিয়ে ফেলবেন না। গবেষণা বলছে না যে প্রতিভা কাজে লাগে না – যাদের প্রতিভা যাদের আছে তাদের সফল হবার চান্স বেশী এটাও দেখা গ্যাছে। কিন্তু যেটা দেখা গ্যাছে যে যাদের আমরা সফল হিসেবে মাপকাঠি ঠিক করেছি, তাদের প্রতিভা বাকি অ্যাভারেজ জনতার থেকে খুব বিশাল কিছু বেশী নয়। হালকা বেশী হলেও, তা ঠিক তাদের সফলতার সাথে সমানুপাতিক নয়। এরা আজ যেখানে পোঁছেছে, সেখানে পৌঁছানোর পিছনে প্রধান নির্ণয়ক হল এদের ভাগ্য। এরা সিম্পলি বাকি সম প্রতিভাবানদের থেকে লাকি!
আজকালকার গবেষণা কি বলছে? আপনি না জানলেও আমনার সফলতার পিছনে ভাগ্য কিভাবে জুড়ে যায় –
- আপনি কোন কোম্পানীর সর্বময় কর্তা বা সি ই ও হবার সুযোগ পাবেন কিনা তা অনেকটা প্রভাবিত করে আপনার নাম বা কোন মাসে জন্ম
- জুন এবং জুলাই মাসে জন্মানো সি ই ও এর সংখ্যা বাকি মাস গুলিকে জন্মানো সি ই ও দের সংখ্যার থেকে অনেক অনেক কম
- আপনার নামের পদবি যদি ইংরাজী বর্ণমালার প্রথম দিকের অক্ষর দিয়ে শুরু হয় তাহলে পৃথিবীর বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হবার চান্স বেড়ে যাবে
- যাদের মিডিল নেম আছে তাদের একটু বেশী নেক নজরে দেখা হয় যখন তাদের ইন্টেলেকচ্যুয়াল ক্যাপাসিটি এবং অ্যাচিভমেন্ট নিয়ে ভাবা হয়
- যাদের নাম সহজে উচ্চারণ করা হয় তাদের বেশী পজিটিভলি জাজ করি আমরা যাদের নাম উচ্চারণ করা কঠিন তাদের থেকে
- যে সব মেয়েদের নাম একটু পুরুষ ঘেঁষা, তারা আইন বিষয়ক ক্যারিয়ারে ভালো করে
- যাদের পদবী উচ্চবংশজাত শুনতে লাগে, তাদের ম্যানেজার হবার চান্স বেশী থাকে অন্য কর্মচারীদের তুলনায়
- আমরা যে সব ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই – ‘এ জিনিস কোথা থেকে এল’ এই ভাব নিয়ে, সে সব আইডিয়া প্রায় ক্ষেত্রেই আমাদের ব্রেন নেটওয়ার্কের র্যান্ডাম চলাফেরার ফসল
- এ যে ক্যান্সারে মৃত্যু নিয়ে আমরা মুহ্যমান হয়ে উঠি, বিশেষ করে যদি প্রতিভাবান কম বয়সী মারা যায় – কেন ক্যান্সার হল ইত্যাদি। এর পিছনে মূল কারণ বলে কিছু হয় না – জাষ্ট লাক!
এমন আরো অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করে দেখা গ্যাছে, আমরা অনেক দিন ধরেই যেটা বলে নিজেদের স্বান্তনা দিতাম (মানে আপাত অসফল পাবলিকদের কথা বলছি আর কি) সেটা সত্যি। প্রতিভা আর পরিশ্রম করার ক্ষমতাই সব নয় – সফল হতে গেলে ভাগ্য চক্রে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকতে হবে। মোট কথা ‘ভাগ্য’ এক বিশাল ভূমিকা পালন করে – সব সফল জিনিয়াসদের পিছনেও। আর সেই ভাগ্যের ভূমিকা আমরা আন্ডারেষ্টিমেট করি – কারণ জেনেটিক্যালি আমরা বেশির ভাগরাই ব্যক্তিপূজায় বিশ্বাসী।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ল, যখন ফুটবল খেলা মনপ্রাণ দিয়ে ফলো করতাম, তখন ফুটবলার মেসির খেলা বর্ণনা করতে গিয়ে ধারাভাষ্যকাররা একটা জিনিস প্রায়ই বলত – “সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায়” থাকার ক্ষমতা। এবং সেই নিয়ে খেলার বিরতির সময়ে আলোচনা। অনেকে ব্যাখা করত যে – এই যে মেসি সঠিক জায়গায় থাকছে সঠিক সময়ে, এটা কোন কো-ইন্সিডেন্স নয়। এটা তার প্রতিভা এবং পরিশ্রম। তো ঘটনা হচ্ছে আমরা কিন্তু ভুলে যাই আলোচনা করতে একটা ফ্যাক্টর – তা সেটা আপনি লাক বা র্যান্ডামনেস যায় বলুন না কেন – মেসির ক্ষেত্রে তা হল, বার্সিলোনা টিমের তার দুই সতীর্থ – ইনিয়েস্তা আর জাভি। এবং প্রতিপক্ষে রোনাল্ডো। এরা না থাকলে মেসি আর মেসি হত না! এটা জাষ্ট মেসির লাক যে ওরা ছিল!
যারা এই নিয়ে আরো পড়াশুনা করতে ইচ্ছুক তাঁরা ওই পেপারটা পড়ে নিতে পারেন যেটা ইতালিয়ান পদার্থবিদ আলেসান্দ্রো এবং অ্যান্দেরা লিখেছিলেন ইতালিয়ান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিও- এর সাথে মিলে। এই গবেষণাতেই প্রথম কেউ প্রচেষ্টা করে সফল ক্যারিয়ারে ভাগ্য এবং প্রতিভার ভূমিকা তলিয়ে দেখার। সেই রিচার্চ পদ্ধতির ভিতরে ঢুকবো না – কারণ বিষয় খটোমটো এবং জটিল। সরল করে বলতে গেলে এঁরা একটা প্রাথমিক ম্যাথামেটিক্যাল মডেল বানিয়ে ছিলেন এক সিম্যুলেশন স্টাডি করে যেখানে গাদা গুচ্ছের লোকের চল্লিশ বছরের ক্যারিয়ার বিবেচনা করা হয়েছিল, ২০-৬০ বছর বয়সের মধ্যে। এই সব লোকেদের তাঁরা বিভিন্ন লেভেলের ‘প্রতিভা’ দাগিয়েছিলেন এবং তারপর চল্লিশ বছর ধরে তাদের কেরিয়্যার কিভাবে খোলে তা দেখার চেষ্টা করেছিলেন। এখানে প্রতিভা মানে ওই সব আর কি – বুদ্ধি, দক্ষতা, লেগে থাকার ক্ষমতা, নতুন কিছু ভাবার ক্ষমতা, ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স ইত্যাদি – মানে যা প্রয়োগ করে সেই সব পাবলিক কোন সুযোগ তাদের সামনে এলে তার সৎব্যবহার করতে পারে আর কি।
সিম্যুলেশন-এ তাঁরা কি করেছিলেন? অনেক কিছু – তার মধ্যে যেটা প্রধান তাহল, সব পাবলিক সফলতার দিক থেকে একজায়গা থেকে শুরু করল। এবার প্রতি ছয় মাসে কিছু পাবলিক-কে ‘ভাগ্যবান ঘটনা’-র মুখোমুখি করা হল এবং কিছুজনকে ‘দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা’-র মুখোমুখি। যে পাবলিক ‘ভাগ্যবান ঘটনা’-র সম্মুখিন হল তার সফলতা বেড়ে হল দ্বিগুণ আর যে পাবলিক ‘দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা’-র মুখোমুখি হল তার সফলতার পরিমাপ হয়ে গেল অর্ধেক। এই ভাবে চলল চল্লিশ বছর। কি দেখা গেল শেষে? দেখা গেল যে খুব কম সংখ্যক জনতা বেশী সফলতার স্বাদ পেল বাকি বেশীর ভাগ জনতার থেকে। এটা অবশ্য আগে থেকে অনুমান করা গিয়েছিল – ওই ‘পেরিতো প্রিন্সিপ্যাল’ আর কি। তো সেটা মূল ফলাফল নয় – বরং নিত্যকার পৃথিবীর বাস্তব চিত্র মাত্র। যে পৃথিবীতে সবথেকে অর্থবান আট লোকের কাছে গরিবীর দিক থেকে অর্ধেক পৃথিবীর লোকের থেকে বেশী সম্পদ আছে।
মূল জিনিস যেটা দেখা গেল - প্রতিভাই সব নয় সফল হতে গেলে। কারণ সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যক্তিরা খুব কমই সব থেকে বেশী সফলতা পেয়েছিলেন। সাধারণভাবে দেখা গেল, মাঝারি-কিন্তু-ভাগ্যবান লোকেরা আরও-প্রতিভাবান-কিন্তু-অভাগা ব্যক্তিদের তুলনায় অনেক বেশি সফলতা পেল। সবচেয়ে সফল জনতা তারাই দেখা গেল যাদের প্রতিভা সাধারণ মানুষের গড় প্রতিভার থেকে সামান্য বেশি কিন্তু যারা সারাজীবন অনেক ভাগ্যের সাথ পেয়েছিল।
এই গবেষণার বিজ্ঞানীরা যা বললেন তার সারমর্ম দাঁড়ালো - মহান প্রতিভাও দুর্ভাগ্যের প্রচন্ডতার কাছে অকেজো হয়ে যায়।
গোদা বাংলায় – যাই করো, ভাগ্য সাথ না দিলে কিস্যু হবে না!
[“Talent Versus Luck: The Role of Randomness in Success and Failure”, A. Pluchino, A. Biondo and A. Rapisarda, Advances in Complex Systems, V.21, No. 3&4, 2018]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।