আজকাল আর বড় করে ফেনিয়ে লেখার সময় নেই, আর রয়ে সয়ে লেখার এলেম-ও মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে যাচ্ছে চারিপাশের ডিমান্ডে। তাই অনেক দিন এই সিরিজটা লেখা হয় না। আজ ভাবলাম, বড় করে না হলেই বা, টুকরো ব্যাপার গুলোই থাক না! (১)
এ জিনিস দেখার পর আমার মুখের ভাব যা হল, তা দেখলে মা নির্ঘাত বলত, "গোপাল আমার, থাক আর কষ্ট করে খেতে হবে না, গরুর ডাবায় দিয়ে আয়"।
আর সেই প্রথমবার হয়ত মাকে মনে করাতে হত, এ জিনিস গরুর ডাবায় দেওয়া অত সহজ নয়! গরু যদিও মেনে নেয়, কিন্তু তার পাশেই গোঁজে বাঁধা ষাঁড় দুখানি কি এই প্লেটের লাল রঙ ভালো মনে নেবে? লাল রঙ দেখে উত্তেজিত হলে থামাবে কে?
এই সব হাবিজাবি বসে ভাবছি রেষ্টুরান্টে। সেবারে ইউরোপ ট্যুরের শেষের দিক। মাংস খেয়ে খেয়ে পেট টাইট হয়ে গেছে - ওদিকে এক বন্ধু বেশী পাকামো করে 'হেলথি জিনিস খাও অন্তত কিছু' বলে পিছনে লেগেছে! কাশ্মীর দিয়ে দাও টাইপের অবাস্তব দাবী আর কি! কিন্তু সেন্সিটিভ টপিক বলে আমাকে ভাবতে হল খানিক। পেট টাইট হয়ে যাওয়া কাশ্মীর সমস্যার থেকেও জটিল, সে যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন।
এমন ফেরে এসে আমাকে বাধ্য হয়ে স্যালাড অর্ডার দিতে হল। পেটে সবুজ কিছু গিয়ে যদি সবুজ বিল্পব ঘটিয়ে টাইট পেট নরম করতে পারে! কিন্তু স্যালাড মেনু দেখে টাইম নষ্ট করার ইচ্ছে একদম ছিল না বলে, বললাম ওয়েটারকে, "তোমাদের রেষ্টুরান্টের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্যালাড ডিসটি আমাকে এনে দাও"
ফাষ্ট ফরোয়ার্ড মিনিট পনেরো - এই ডিস আমার সামনে নামল। কেমন মনে হচ্ছিল জানেন? সেই ধর্মতলা থেকে পিওর লেদার বলে রেক্সিনের জিনিস কিনে নিয়ে যাবার মত! বাড়িতে পৌঁছেই বউ বলেছে, "এতো রেক্সিন!" আপনি ততক্ষণে টের পেয়ে গেছেন কি বিশাল ছড়িয়েছেন বলে। কিন্তু নিজেকে প্রবোধ, আর বউকে সাফাই দিচ্ছেন, "রেক্সিনটা কিন্তু ভালো কোয়ালিটির, তাই না?"
আমিও তেমনি এই স্যালাড দেখে বলছি, "ট্যামাটোগুলো কিন্তু ফ্রেস হবেই, ইমপোর্টেড মনে হচ্ছে ইতালি থেকে। আর ঘাসপাতা গুলো নিশ্চয়ই ভালো করে ধুয়েছে।"
কিন্তু ট্যামাটোর উপর সাদা সাদা ওগুলো কি? জাঁক ছানা নাকি পনীর? এই দুই জিনিসেরই ইংরাজী আমার জানা নেই বলে ওয়েটারকে ডেকে জিজ্ঞেসও করতেও ইতস্তত করছি!
আর ভাবছি, ছোট বেলায় বিজ্ঞান মঞ্চ নিয়ে লাফালাফি করতাম বলে আজকাল কি ভগবান আমার উপর এই ভাবে শোধ নিচ্ছে! বারবার আমার সাথেই কেন এমন হচ্ছে!
সাহস করে ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম সেই সাদা জিনিস আসলে কি! বলল "মোজারেল্লা"। হোটেলে ফিরে গুগুল করব ভেবে নিয়ে খাওয়ায় মন দিলাম।
কেমন খেতে এই স্যালাড? নিজেরা একটু কল্পনা করে নিন!
(২)
ঘুরতে ঘুরতে এক মেডিটেরিনিয়ান রেষ্টুরান্টে ঢুকে পড়লাম হল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের মাঝের এক জায়গায়। বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিল যেমন আমার পায় আর কি কাছেপিঠে ভালো রেষ্টুরান্ট দেখলেই। এই রেষ্টুরান্টের রেটিং আবার ৪.৭ পাঁচের মধ্যে, মানে যা তা ব্যাপার নয় আর কি!
খেতে গিয়ে মেনু দেখেই বুঝলুম যা তা ব্যাপার কেন নয়! বিশাল বড় কিছু মেনু নয় তেমন – মাত্র চার পাতার! কিন্তু সেই মেনু পড়ে বোঝে কার কি সাধ্য কি খাবার অর্ডার দেওয়া হচ্ছে! এদিকে ডাচ, ওদিকে ফ্রেঞ্চ এবং মাঝে মাঝে ইংরাজী – একেবারে ডেডলি সব কম্বিনেশন!
মেন কোর্সের আগে কিছু একটা অর্ডার দিতে হবে – তা নাহলে খাবার আসতে যা দেরী হবে ততক্ষণ পেটে কিল চেপে বসে থাকতে পারব না! পাতা উলটে দেখি, স্মল প্লেটের পাশে লেখা আছে ‘ডিপস্’ – মানে বুঝলুম ডুবিয়ে খেতে হবে। যাই হোক ভাবলাম আজ ডিপস দিয়েই শুরু করা যাক। উপর দেখে চোখ নামাতে নামাতে দেখি একটা ডিসের নাম ‘বাবা গণেশ’! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না! দেশ থেকে এর দূরে এসে গণেশের নামে ডিস! প্রবল উত্তেজনার মধ্যে ওয়েটার-কে ডেকে বললাম –
- আমাকে ‘বাবা গণেশ’ ডিসটা জলদি এনে দাও। পরে বাকি অর্ডার করছি।
- স্যার, ওটা ‘বাবা গণেশ’ নয়, ওটার নাম ‘বাবা গণুশ’ – দেখুন তাই লেখা আছে।
- সে তো দেখতেই পাচ্ছি প্রিন্টিং মিষ্টেক! আমি ভারতের লোক। গণেশ আমাদের বিশাল বড় দেবতা। তোমরা মনে হয় সঠিক উচ্চারণ জানো না, তাই ভুল করে গণুশ লিখে ফেলেছো গণেশ এর জায়গায়। নেভার মাইন্ড, তোমাদের রেষ্টুরান্টে ভারতীয় নামে খাবারের নামকরণ হয়েছে দেখে আমি এমনিতেই আপ্লুত। তাই আর ছোটখাট ভুল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। যাও, চট করে ‘বাবা গণেশ’ এনে দাও প্লীজ। খেয়ে দেখি কেমন লাগে।
সে ওয়েটার আমার দিকে কেমন অদ্ভুত তাকাতে তাকাতে অর্ডার নিয়ে চলে গেল। আমার তখন মনে হল আচ্ছা উত্তেজনার বশে বাবা গণেশ তো অর্ডার করে দিলাম। কিন্তু জিনিসটা আদপে কি!
এবারে মেনুতে ‘বাবা গণুশ’ নামের তলায় ডিসের ডেসক্রিপশন দেখতে গিয়ে নজরে এল – এ আর কিছুই নয়, বেগুন পুড়িয়ে চটকানো! সর্বনাশ – শেষে বেগুন পোড়া অর্ডার করলাম! কিন্তু একটু আগেই ওয়েটার-কে দেশের সেন্টিমেন্ট দিয়ে অর্ডার করেছি – তাই আর বদলাতে চাইলাম না। ভাবলাম আর কি আছে দেখা যাক – লেখা আছে বেগুন পোড়ার সাথে থাকবে বেদানা আর আখরোট। স্বান্তনা দিলাম নিজেকে এই ভেবে যে বেগুনের সাথে আর যাই হোক বেদানা আর আখরোট তো আসছে – এই দুটো জিনিস দামী!
এবার যখন বাটিতে করে ‘বাবা গণেশ’ দিয়ে গেল দেখলাম তাতে সাকুল্যে এগারোটি বেদানার দানা আর দুই খানি আখরোটের টুকরো আছে! বেদানার রস বলে লাল রঙের কি ছড়িয়ে দিয়েছে কে জানে! আড়ে আটশো টাকা দিয়ে বাদানার সাথে বেগুন পোড়া খেয়ে এলাম সেদিন!
(৩)
সেদিন ব্যাঙ্গালোরের বুকে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি - ভারতীয় ফিউশন টাইপের রেস্টুরেন্ট। ভারতবর্ষের যেসব বিখ্যাত ডিস আছে সেই ডিসগুলোকে একটু হালকা মুচড়ে ফিউশন টাইপের বানিয়েছে।
সেদিন গেছি একটা বন্ধুর সাথে খেতে। টেবিলে বসে আছি সামনে মেনু দিয়ে গেছে। ড্রিঙ্কসের অর্ডার হয়ে গেছে, কিন্তু আমি তখনো মেনু কার্ড দেখছি না বলে বন্ধু জিজ্ঞেস করল - "কিরে, মেনু দেখবি না?"
আমি গেলাম অবাক হয়ে! ব্যাঙ্গালোরের বুকে রেস্টুরেন্টে খেতে বসে মেনু দেখব এটা আবার কি কথা!
জবাব শুনে বন্ধু আবার উল্টে আরো বেশী অবাক হয়ে গেল! প্রশ্ন ছুঁড়ল,
- তুই কি তাহলে এখানে মাঝে মাঝে এসে মেনু মুখস্ত করে ফেলেছিস?
- তা কেন?
- তাহলে কিভাবে অর্ডার করবি?
- শুদ্ধ বাঙলায় অর্ডার করব! আবার কি?
- তার মানে?
- ভাই, ব্যাঙ্গালোরের রেস্টুরেন্টের প্রায় সব ওয়েটারই পশ্চিমবাংলার ছেলেপুলে। তো এখানে ফালতু মেনু দেখে সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয় না!
- কি করবি তাহলে?
- সিম্পল ওয়াটারকে ডাকব এবং জিজ্ঞেস করব আলতো করে, ভাই যে ডিস ভালো আর টাটকা হবে সেটা একটু সাজেস্ট কর।
- ধুর এমন আবার হয় নাকি?
- হয় না মানে? দিনের পর দিন হচ্ছে!
কথা না বাড়িয়ে ওয়েটার ছেলেটাকে ডাকলাম। প্রশ্ন করলাম যে ভাই বাঙালি তো? ছেলে একগাল হেসে উত্তর দিল হ্যাঁ দাদা।
- তা তোমার বাড়ি কোথায়?
- দাদা আমার বাড়ি নদীয়ার করিমপুরের দিকে
- নদীয়ার করিমপুর? তুমি তো আমার ঘরের ছেলে হে!
- আপনার বাড়ি কোথায়?
- আমার তো দেশের বাড়ি বর্ধমান
এই ওয়েটার ছেলে আবার একটু হালকা পাকা, উল্টে আমাকে প্রশ্ন করল
- কিন্তু দাদা বর্ধমান থেকে নদিয়া বেশ অনেকটাই!
- ভাই সে জানি! কিন্তু আমার ভগ্নিপতি যে করিমপুরে ১২ বছর ধরে মাস্টারি করে এলো তাহলে সেটাকে আমি যদি কাছের না বলি আর কোথায় বলবো!
এবার সে একমত হয়ে মাথা নাড়ল।
- যাই হোক ভালো এখানে কি হবে তাই নিয়ে এসো
- আপনি দাদা তাহলে প্রণের ডিসটা নেন, আর কলকাতার ফিশ ফ্রাই আছে সেটাও খুব ভালো
- রাঁধুনি কি বাঙালি নাকি?
- না না দাদা, রাঁধুনি হচ্ছে ইউপি এর!
- বলো কি ভাই! ইউপির ছেলে কলকাতার ফিসফ্রাই বানাচ্ছে! ভালো হবে তো তুমি বুকে হাত দিয়ে বল!
- আপনি বিশ্বাস করে অর্ডার দিন না! আপনি বললেন তো আপনার ভগ্নিপতি করিমপুর এতে মাস্টারি করত। সেই আপনাকে আমি এইভাবে কি আর মিথ্যা বলব!
সেই ভাবে অর্ডার দিয়ে দিলাম - সে ছেলে অর্ডার নিয়ে চলে গেল। আর এদিকে আমার বন্ধু তো উল্টোদিকে বসে বাংলায় কথা কিছু বুঝতে পারিনি! অর্ডার নিয়ে চলে যাবার পর সে খুবই ইম্প্রেসড হয়ে গেল
তাকে জানালাম এতে ইমপ্রেসড হবার কিছুই নেই। এতো শুধু খাবারের অর্ডার করলাম আরো অনেক কিছু আমি ওর সাথে গল্প করব খাবার দিতে এলে!
বন্ধু আমার কথা বিশ্বাস করল না। তখন ওয়েটারকে আবার ডাকতে হল। এবার জিজ্ঞেস করলাম
- যভাই কাজকর্ম কেমন চলছে? মাইনা কি ঠিকঠাক দিচ্ছে?
- আর বলবেন না এখানকার ব্যাপার। তেমন পয়সা নেই, কিন্তু খাটনি প্রচুর। তবে আমার সিঙ্গাপুরে যাবার কথা পাকা হয়ে গেছে
- বলো কি?
- ভিসা ভিসা সব রেডি। ওখানে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কাজ করব, মাইনে ভালই। এখন তো এক ডলার মানে ষাট টাকা। আমার খরচা কিচ্ছু লাগবে না
- মাঝের দালালকে কিছু টাকা দাও নি তো?
- না দাদা ওই রেস্টুরেন্টে আমার বন্ধু আছে। সেই সুপারিশ করে পাঠিয়েছে। ওই রেস্টুরেন্টে ভিসা করে দিচ্ছে
এই বলে ছেলেটি মেন ডিস আনতে গেল। সাথের বন্ধুকে সেই বাংলা কথোপকথন বুঝিয়ে দিলাম। এইসব শুনে তো এই বন্ধুর মুখে যা ভাব দেখলাম তাতে বুঝতে পারলাম যে এরা রেস্টুরেন্টে শুধু খেতেই আসে। কথাবার্তা ওয়েটারদের সাথে তেমন একটা বলে না।
খাবার খুব ভালো ছিল এটুকু বলে রাখি। মানে ফিউশন ডিস হলেও খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। বিল পে করবার পর ছেলেটা অনুরোধ করলো
- দাদা একটা কথা বলব কিছু মনে না করলে
- মনে করার তো কিছু নেই বলো। খাবার ভালো ছিল বলে মুড এখন ভালো
- একটু যদি ফিডব্যাক কমেন্ট করেন তাহলে ভালো হয় আর আমার নামটাও একটু লিখে দেবেন
- তা তোমার নাম কি?
- ডেভিড
- ডেভিড মানে! তুমি এই কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে কাজ করতে এসেই নাম পাল্টে ফেললে! এখনও তো তুমি সিঙ্গাপুরে পৌঁছালেই না, তাতেই ডেভিড হয়ে গেলে
- সত্যি ওটাই আমার ভালো নাম দাদা! বাবা ভালোবেসে রেখেছিল।
শুনে আমি হুব্বা হয়ে গেলাম আর তার চোখ মুখ দেখে মনে হলো না যে সে মিথ্যা কথা বলছে।
বাড়ি ফিরছি তখন আমার হট করে মনে হলো - আচ্ছা এই ছেলের বাপ তাহলে ডেভিড নামটা রাখল কেন? মানে কোঘা থেকে পেল ডেভিডের রেফারেন্স? এ কোন ডেভিড!
তাহলে কি সেই মাইকেলেঞ্জেলো-র সেই বিখ্যাত মূর্তি ডেভিড থেকে পেয়েছে?
বিশ্বাস হলো না! করিমপুরে বসে কেউ ওই ডেভিড থেকে নাম পাচ্ছে বলে।
তাহলে কি ডেভিড গাওয়ার? ডেভিড বেকহ্যাম?
আমি বেশ ভেবেই যাচ্ছি ভেবেই যাচ্ছি।
জাস্ট বাড়ি ঢোকার আগে আমার বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হল যে ডেভিড ধাওয়ানকে কেন আমি বাদ দিচ্ছি!
আমি নিশ্চিত হলাম যে সেই ছেলের নাম ডেভিড ধাওয়ান থেকেই এসেছে!
আপনাদের কি মনে হয়? নদীয়ার বুকে একটা ২৫ বছরের ছেলের নাম হয়েছে ডেভিড - তার বাবা দিয়েছে ভালোবেসে। তো সেই ডেভিডের সোর্স কি?
(৪)
সেবারে বিদেশে রেষ্টুরান্টে খেতে গিয়ে যখন এই ডিসটা সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল, আমি খুবই নষ্টালজিক হয়ে পড়লাম। না খেয়ে তাকিয়ে রইলাম বিহ্বল হয়ে।
আমার সেই অবস্থা দেখে বিদেশী বন্ধুরা জিজ্ঞেস করল -
- কি হল?
- আসলে গ্রামের কথা মনে চলে এল
- তোমাদের গ্রামে এই জিনিস পাওয়া যায় বুঝি?
কি আর বলি! সকালের দিকে জমি দেখতে বেরুলেই জমির আলে এই জিনিসের ছড়াছড়ি! আলের সবুজ কচি ঘাসের মাঝে সকালের কারো ভালোবেসে ছেড়ে যাওয়া এই রূপ।
কিন্তু বন্ধুরা তো আর জমির আল জানে না, তাই খালি বললাম,
- পাওয়া যায় তো আমাদের গ্রামে পর্যাপ্ত! তবে শরীরের ইনপুট হিসেবে নয়, আউটপুট বলা যেতে পারে বরং!
(৫)
সেদিন বাইরে একটা কাজে বেরিয়ে ফিরলাম ভাঙা অটো করে ১২৫ টাকায় রফা, তিন বার স্টার্ট বন্ধ হল। ক্লাচের তারও কেটে গেল একবার। রেটিং দেওয়া নিয়েও ঝামেলা হল।
আর কাল যখন এয়ারলাইনস থেকে ফোন করে বলল বাড়ি থেকে পিক আপের জন্য সেডান কার অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে - ফোন রেখে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মার্সিডিজ পাঠাবে না? অন্যবারে পাঠায় তো! সুজুকি সুইফটে এয়ারপোর্ট যাব!
তবে শান্তি হল মনে যখন দেখলাম মার্সিডিজই এল পিকআপ করতে। তবে চাপার পর হালকা দু:খও হল দেখে যে ড্রাইভার অ্যাপেল ওয়াচ পরে আছে, যা আমি অনেক দিন কিনতে পারছি না ফাইনান্স এর চক্করে!
এয়ারপোর্টে এসে এই খাবার গুলো নিয়ে বসলাম বিজনেস লাউঞ্জে। অনেকক্ষণ পরেও হাত দিই নি দেখে অ্যাটেনডেন্ট জিজ্ঞেস করল -
- স্যার, তাহলে কি প্লেট ক্লীয়ার করব?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই! ছবি তুলে নিয়েছি অলরেডি।
সে ছেলে ঘাবড়ে গিয়ে
- মানে?
- ফেসবুকে ছবি দেব তো 'ইটিং হেলথি', তাই নিয়েছিলাম। কাজ হয়ে গ্যাছে।
(৬)
সেদিন একটা রেষ্টুরেন্ট খেতে গেছি অফিস ফেরত। বলাই বাহুল্য প্রচুর খিদে পেয়েছে। ভাবলাম এত খিদে যখন তখন স্টার্টার, মেন ডিস আর ডেসার্ট, মানে পুরো দস্তুর তিন কোর্স মিল খেতে হবে।
কিন্তু বিশাল ভুল করে ফেললাম স্ট্রাটেজী-তে। ইউরোপে তিন কোর্স ডিনার মানে আশুতোষ গায়কোয়াড়ের সিনেমা! শেষ দিকে এসে প্রথম দিকে কি হয়েছিল ভুলে যাবেন!
তা সেই ঐতিহ্য মেনে স্টার্টারে এটা সেটার সাথে এই স্যালাড দিয়ে গেল। পেট কি আর ভরে। এখানকার নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে মুখফুটে জিজ্ঞেসও করে ফেললাম যে মেন ডিস কখন আসবে! বলল আসছে এখুনি।
কিন্তু ক্লাশ টেনের ছেলেদের প্রেমে যেমন হত ঠিক তেমন, মানে কেউ এল না আর কি!
হতাশ হয়ে ওয়েটারকে ডেকে বললাম,
- ভাই, এই স্যালাডের বাটিটা পাল্টে দাও
- কেন স্যার, কেন স্যার? আমাদের তো ফ্রেশ স্যালাড, খারাপ হবার তো কথা নয়
- বলছিলাম কি, এটা ফেরত নিয়ে গিয়ে, গোটা বাঁধাকপিটা বরং এনে দাও। হাতে তো অঢেল সময়, টেবিলে বসে বরং বাঁধাকপির খোলা ছাড়িয়ে টাইম পাস করি!
(৭)
আমি বিদেশী আপ্যায়নে আপ্লুত হয়ে বললাম,
- হেঁ হেঁ, ভাজা মাছ তো আর এত যত্ন করে সাজিয়ে আনার দরকার ছিল না! পাঁচ ছয় পিসের বেশী আজকাল আর খাবার ক্ষমতা নেই। তাহলে আবার মেন ডিস খেতে পারব না!
ওয়েটার দেখলাম হাঁ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে! সে জানালো,
- স্যার, স্টার্টার তো খানিক আগেই খেলেন। এটাই মেন ডিস।
এটা মেন ডিস! বিদেশীরা কি এই ভাবেই আমাদের বুদ্ধু বানিয়ে ২৫০ বছর ভারতে ছড়ি ঘুরিয়েছে!
হলুদ রঙের ফুলটা দেবারই বা মানে কি! খুবই মনকষ্টে শুধু এটুকু জানাতে পারলাম ওয়েটারকে -
- বুঝলে, আমাদের ওদিকে ছেলেরা অন্নপ্রাশনে এর থেকে বড় পিসের মাছ খায় স্টার্টারে। আর তুমি এনেছো মেন ডিস!
- স্যার অন্নপ্রাশন কি?
- যা খাবার দিয়েছো তাতে অন্নপ্রাশনের গল্প করার জোর পাচ্ছি না! দুর্বল লাগছে। রাতে হোটেলের মিনিবার থেকে খাবার সাঁটাতে হবে মনে হচ্ছে আজ!
(৮)
সেবারে আমেরিকার কোন এক জায়গায় সী-ফুড রেষ্টুরান্টে খেতে গেছি। সে দেশে রেষ্টুরান্টে বখশিস এর ব্যাপার থাকে বলে ওয়েটার- ওয়েট্রেস ছেলে-মেয়েগুলি বেশ ফ্রেন্ডলি হয়।
তাই টেবিলে ডিস-টি নামিয়ে বলল,
- স্যার কেমন মনে হচ্ছে?
কি আর বলি!
- বলছিলাম কি, মাছের অর্ডার দিয়েছিলাম; অ্যাকোয়েরিয়ামের নয়!
- মানে?
- শ্যাওলা, ঝিনুক - ফিলিং পুরো এসে গ্যাছে। তবে ছয় পিস ঝিনুকের মাংস খেয়ে কি আর পেট ভরবে?
- স্যার, আসল মাছ তো নীচে রয়েছে!
- তাই বলো, বাঁচালে। আমি তো ওটা অ্যাকোয়েরিয়ামের নীচে সাজানোর পাথর ভেবেছিলাম!
(৯)
এবারে বেড়াতে গিয়ে দিল্লীতে থাকাকালীন একদিন মেহুল বলল বিরিয়ানি খাব! বললাম, এই ফাইভ স্টার হোটেলে থেকে এদের ইন্ডিয়ান রেষ্টুরান্টে বিরিয়ানি খেতে ঢোকার কোন মানে হয়! বাড়িতে তো দিদা বানাচ্ছে, ওদিকে আমিনিয়া, দাদা-বৌদি, এমনকি ডি-বাপি আছে! তার থেকে বরং এদের ইতালিয়ান রেষ্টুরান্টটায় চল, জমিয়ে খাওয়া যাবে!
কিন্তু মেহুলের সেদিন বিরিয়ানিই চাই! আমিও ভাবলাম তাহলে দিল্লীর জিনিস খেয়েই দেখা যাক!
তো সেই মত সন্ধ্যে ৭টায় রেষ্টুরান্টে ঢুকে এই অবস্থা! সাতটায় আর রাতের খাবার কে খেতে আসবে আমি ছাড়া! খাবার তাই মোটামুটি তাড়াতাড়িই এল। আস্তে আস্তে খাচ্ছিলাম। কিন্তু খানিক পরেই যা দেখলাম, চক্ষু চড়ক গাছ! মেহুলকে তাড়া লাগালাম -
- খেয়ে নে তাড়াতাড়ি, উঠে পড়তে হবে।
- কেন? রেষ্টুরান্ট তো ফাঁকা!
- ওই আন্টিকে দেখছিস? ব্যাগ থেকে তবলা বের করছে।
- তবলা কি করবে?
- বাজাবে
- আমিও তো তবলা বাজাই! ভালো লাগবে শুনতে
- সোনা, ব্যাপারটা তবলার নয়। সাথের আঙ্কেলটা গজল শুরু করবে সেই ভয় পাচ্ছি।
- গজল কি?
- ঘুম পাড়ানোর গান বাবা।
- ধুর আমার ঘুম পাবে না!
- তোর বাপের পর্যন্ত ঘুম পেয়ে যায় তুই তো কোন ছাড়! এই টেবিলে ঘুমিয়ে পড়লে কে তোকে রুম পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে!
তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে গজল শুরু হবার আগেই বেরিয়ে এলাম রেষ্টুরান্ট থেকে। লিফটে ওঠার সময় মেহুল-কে বললাম,
- আর একটু উঁচু ক্লাশে ওঠ, টেনশনে যখন ঘুমের সমস্যা হবে তখন তোকে জগজিৎ সিং এর গান শোনাবো। তিনটে গান শুনলেই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়বি।
(১০)
টেবিলের ওপাশে এক বিদেশী বন্ধু - দুই জনে দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যে বেলা সামনে যে রেষ্টুরান্ট পেলাম সেটাতেই ঢুকে পড়েছিলাম। খাবারও সেই বন্ধু অর্ডার করেছিল কারণ সে ছিল স্বঘোষিত এক্সপার্ট!
দুজনের মাঝে এই ডিসটা নামানো হলে, আমার মুখ ভরে গেল আনন্দে এবং জিব ভরল জলে। খুশী চেপে রাখতে না পেরে বলে উঠলাম -
- ভাবতেই পারি নি এখানে বিদেশে বসে দুধ চা পাব, তাও দামী রেষ্টুরান্টে!
- চায়ের কথা এখানে আসছে কেন?
- চা ছাড়া এই 'লেড়ো' খাব কি করে? চায়ে ডুবিয়েই তো আজন্ম খেয়ে এসেছি!
- 'লেড়ো' কি জিনিস?
এবার আমি ব্যাকফুটে - পাতি বাংলা মিডিয়ামের ছেলে। লেড়োর ইংরাজী বলতে পারলে আমাকে স্কুল থেকে বৃত্তি দেওয়া হত নিশ্চিত! তা যখন হয় নি, তখন চেপে যাওয়াই ভালো। বললাম,
- বাদ দাও! শুধু জেনে রাখো লেড়ো এক বাঙালী ডেলিকেসির নাম। কিন্তু তাহলে এগুলো কি?
- এগুলো তো ব্রেড!
- ব্রেড?? তাহলে মাঝের ওটা কি?
- ওগুলো তো ট্যমাটো কুচো
সেই শুনে আমার মুখে আর কথা সরল না যতক্ষণ না মেন ডিস এলো। কোথায় লেড়ো আর কোথায় সেঁকা পাউরুটির সাথে ট্যমাটো!
চুপচাপ কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে 'লেড়ো' কিভাবে ইংরাজীতে বোঝানো যায় ভাবছিলাম।
সেইদিন এই প্রশ্নটা অনত্র করতে অনেকে বলল লেড়ো-র ইংরাজী নাকি রাস্ক!
তবে কিনা লেড়ো-কে রাস্ক বলা আর এঁচোড়-কে 'গাছ পাঁঠা' বলা একই ব্যাপার!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।