গোটা গম হাফ কিলো, আর সব মেশানো ডাল হাফ কিলো কিনে রাখতে বলি গোবিন্দকে। এর বাইরে ভাবার মতো সময় থাকে না এখনকার কাজের চাপে। তখন শুধু মাথায় রাখার যে অফিস থেকে ছ'টার মধ্যে বেরোতে হবে, পট্টকে তুলতে হবে ওখলা স্টেশন থেকে।
ওখলা পখিরালয়ের মেট্রো স্টেশনের ব্রিজে উঠে দাঁড়াই। পড়াশোনা শেষ করা যুগল কীসব গল্প করে একধারে। সূর্যাস্ত হ'তে তখনও দেরি আছে খানিক। ব্রিজের রেলিঙের ছায়া বড় হ'তে শুরু করেছে।
একটা ট্রেন আসে বটে, এটাতে সে নেই। উল্টোদিকের ট্রেনও একটা যায় দিল্লি অভিমুখে। পরের ট্রেনে পট্ট পৌঁছয়। আর দেখা হয় না রেলিঙের ছায়া কতটা বড় হয়েছিল শেষ অবধি।
জ্যামে আটকে, জ্যাম ছাড়িয়ে এক সময়ে মাংসর দোকানে পৌঁছই। সোওয়া কিলো মাংস নিয়ে অল্প চর্বিও দিতে বলি।
বাড়ি ফিরে সবার আগে সেই গম জলে ভেজাই। বেজায় ময়লা তাতে। ধুতে হয়, গমের খোসা, খড়ের টুকরো ইতস্তত ভেসে ওঠে। দু-তিনবার ধোয়ার পরে তার সহবত শিক্ষা হ'ল। ডালগুলো সে তুলনায় পরিষ্কার ছিল। তাও ধুই অভ্যাসে। তারাও ভিজতে থাকে সারারাত পাশাপাশি ডেকচিতে। মাংস প্যাকেট সমেত চালান গেল ফ্রিজারে। না, ডিপ ফ্রিজে নয়। সাধারণ ফ্রিজেরই ওপরের তাকে।
খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙে এ সব ক্ষেত্রে নিজে থেকেই। এবারও অন্যথা নয়। চারটে পনেরো। গম খানিকটা ফুলেছে। ডালগুলো তো ডেকচি ভরিয়ে দিয়েছে। গম গুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে মিক্সারের মাঝারি বাটিতে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে চালাই। একটানা চার পাঁচ সেকেন্ডের বেশি নয়। এতে গমগুলো ভেঙে যায়, অথচ আটা হয় না। সেই আধভাঙা গম আর ভেজানো ডাল একটা বড় পাঁচ লিটারের কুকারে বেশ খানিকটা জল আর এক খাবলা নুন নিয়ে বসাই।
মাংস বের করে পরিষ্কার কাপড়ে মুছে নিই। অন্য কুকারে খানিক নুন-হলুদ আর লঙ্কা গুড়ো দিয়ে ফুটন্ত জল ঢালি। হাতা দিয়ে নেড়ে কুকার চাপাই পাশের ওভেনে।
বাকি ফুটন্ত জলে চায়ের পাতা মিশিয়ে ভিজিয়ে চা খেতে খেতে শুনি দুই কুকারের গান। একবার বেজে উঠলে আঁচ একেবারে কমিয়ে দিই। ট্রেনের মতো কিছুক্ষণ পরপর সিটি ওঠে। মিনিট পনের রেখে গ্যাস বন্ধ করি। এখন বিরতি কিছুক্ষণের।
বড় বড় পাঁচটা পেঁয়াজ সরু লম্বা ফালি করে কেটে বাদামি করে ভাজি। অনেকটা সময় যায় এতে। শেষদিকে আঁচ ঢিমে করি নয়ত সামলানো যায় না। কড়া থেকে খুন্তি দিয়ে নিখুঁত করে ভাজা পেঁয়াজ তুলতে পারে মা। আমি পুরোটা ছাকনির ওপর ঢেলে দিই। ওই তেল ফের কড়াইতে ঢেলে তাতে গোটা জিরে ফোড়ণ দিয়ে আদা রসুন বাটা দিয়ে কষাই। অল্প জল দিয়ে ঢিমে আঁচে নাড়ি যতক্ষণ না আদা রসুনের কাঁচা গন্ধ চলে দিয়ে তেল ছেড়ে দেয়। এতে মাংস দিয়ে কিছুক্ষণ কষিয়ে মাংস সেদ্ধর জল দিয়ে ফুটিয়ে নিই খানিক।
বড় দুই ডেকচি বেরোয়। তাদের একটু সাফ করে নিয়ে বসাই উনুনে। আলো ফুটেছে ততক্ষণে।
বড় কুকারের ভেতর অত জল দেওয়া সত্ত্বেও গম আর ডাল সেদ্ধ হ'তে গিয়ে নিজেরা পুরোটা প্রায় এক মন্ড পাকিয়ে নিয়েছে। বেশি আঁচ থাকলে তলা ধরে যেত। সামান্য বাদামি রঙ দেখি তলায়। কালো হ'লেই চিত্তির। দু'টো ডেকচিতেই প্রায় দুই দুই চার লিটার জল দিয়ে সেই মন্ড দুই ভাগে করে দিই ডেকচিতে। প্রায় একশো গ্রাম মতো গোবিন্দভোগ চালও দেব ভেবেছিলাম ভেজাতে। রাতে মনে ছিল না। যাই হোক এখনই তা দিয়ে দিই দুই ডেকচিতে।
তারা গরম হ'তে হতে মাংসের কুকার খুলি। সেখানে জলের সমস্যা নেই। মাংস নিজেও জল ছেড়েছে। রানের হাড় থেকে মাংস খুলে খুলে এসেছে। চর্বি কিছুটা গলে গিয়ে ওপরে তেলের হালকা স্তর।
গম আর ডাল ফুটতে শুরু করে। গমটা না ভেঙে দি'লে এখন তারা বেশ ছোট ছোট বলের মতো ফুলে উঠত। এখন আস্তে আস্তে মিশ্রণের সান্দ্রতা বাড়িয়ে তারা নিজ অস্তিত্ব বিসর্জনে ব্যস্ত। একটা ডালকাঁটা আর একটা লম্বা গোল হাতা — এই দু'টো নিয়েই দুই ডেকচিতে বৈঠা মারার পালা শুরু ঠিক এখনই।
মাংস আর ঝোলও ভাগ করে দিয়ে দিই দুই ডেকচিতে। একসঙ্গে ফোটে সকালের আলোও। ফ্লাস্কে রাখা বাকি চায়ে চুমুকু দিতে থাকি কিন্তু নাড়া থামিয়ে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টানার অনুমতি ওরা দেয় না।
অনেকটা পথ পেরোতে হয়। শনিবার বলেই এ সময়টা পাওয়া গেছে। রেশমী ও পট্ট কেউই ন'টার আগে উঠবে না। রেখার আসার সময় সকাল আটটা সপ্তাহান্তে।
মিশ্রণ ঘন হয়ে আসে ক্রমশঃ। হাতা দিয়ে বড় হাড়ের টুকরো তুলে আনি। হামানদিস্তায় তাদের ভেঙে, ফের ফের মিশিয়ে দিই হালীমের পাত্রে। যা পেঁয়াজ ভাজা হয়েছিল, তার অর্ধেকের কিছু বেশি মিশিয়ে দিই। সেই হালিমের পাত্রে এখন গম ডাল মাংস এমনকি জিরের দানাটি অবধি আলাদা পাওয়ার জো নেই। টগবগ করে নয়, মাঝে মাঝে বুড়বুড়ি কেটে ফোটে হালিম। ডেকচি থেকে হাতায় কিছুটা তুলে ঢেলে দিলে আস্তে আস্তে সিন্নির মতো পড়ে। শেষ দিকে সরু সরু সুতোর মতো — মাংসের ফাইবার।
এতক্ষণ এতটা রান্নায় তেল ঘি কিছুই পড়ে নি। যখন প্রায় সবকিছু মিশে গেছে তখন একটা পাত্রে কিছুটা ঘি খুব গরম করে ছড়িয়ে দিই দুই হালীমের ডেকচিতে। ডালকাঁটা হাতা যুগপত চলে। সেই ঘি ও আর আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না হালীমে।
রেখা এর মধ্যে এসে বাসন মেজে ফেললে — ওকে ডেকচিতে হাতা ডালকাঁটা চালানো শিখিয়ে জিরোই বারান্দায়।
এ পদ্ধতির শুরু থাকে। শেষ নেই। যতক্ষণ হাত চলে ততক্ষণ রান্না করাই নাকি ভাল — এমনটা শুনেছি। তবে আমাকে ক্ষান্তি দিতে হয়। সকালের জলখাবার বানাতে প্রীতি আসে সকাল সাড়ে ন'টায়।
পরিবেশনের সময় লম্বা সরু আদা ফালি, ভাজা পেঁয়াজ, সামান্য পাতি লেবুর রস আর ভাঙা কাজু দিয়ে গার্নিশ করলেই চলে।
আগে হালীম বেশ কয়েকবার বানিয়েছি। তবু বানানর আগে এখনও ইউটিউব খুলে দেখি কয়েকটা রেসিপি আরও একবার "করাচী হালীম" দিয়ে সার্চ মেরে। চোস্ত উর্দু শুনতেও খাসা। সেখানে সবাই নিজের নিজের মতো হালীম বানান তবে একটা ব্যাপারে সবাই একমত — হালীম অতি সামাজিক খাদ্য। এত পরিশ্রমলব্ধ প্রাপ্তি চট করে ফুরিয়ে যেতে দিতে ইচ্ছে হয় না। তাই এ রান্না ঠিক কম করে বানিয়ে শান্তি হয় না।
এক কেজি মাংসের হালিম শেষ অবধি পাঁচ কিলো অবধি পৌঁছে যায় গম-ডাল ও সুপক্ক হওয়ার বাসনায় জল টেনে। প্রায় জ'না কুড়ি মানুষের পেট ভরানর মতো আয়োজন রুটি ভাত বা পরোটার সঙ্গে।
জমিয়ে খাওয়া হয়। আশেপাশের বন্ধুদের বিলোই। ভাইকে ডাকি রবিবারের লাঞ্চে। তাও যা বাকি থাকে তা ডিপ ফ্রিজে রাখা যায় মাস দুয়েক নিশ্চিন্তে।
ঠিক রান্না নয় এটা কাজেই নিখুঁত অনুপাত বলতে ওই শস্য ও মাংস সমান সমান রাখা। বাকি সব স্বাদবোধ অনুযায়ী। তাই সবকিছু মেশানর শর্তসাপেক্ষেও প্রতিটি হালীম রান্না নিজস্ব স্বাদ গন্ধে আলাদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ।
খানিকটা বেড়াতে যাওয়ার মতোই যেন অভিজ্ঞতা হালীম রান্নায়। যেখানে অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্য, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ অনুভূতি গুলো বদলাতে থাকে। শুধু, থামা চলে না মাঝরাস্তায়।
প্রতিবার হালীমের পরে অনেকটা হালকা লাগে নিজেকে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।