১৪ই জানুয়ারি যখন ডাক্তারবাবু মায়ের ব্যপারে আমাদের বলে দিলেন “ইট ইজ নাউ ম্যাটার অফ টাইম”... তারপর মোবাইলের পাতায় এগুলো লেখা হয়েছিল। এর সম্পাদনা হওয়ার নয়।
১৪.০১
১
সিগনাল পেরোচ্ছ হয়ত,
এক একটা মোড় সবুজ
কোনোটায় লাল —
অপেক্ষা কিছুক্ষণের
কি ভাবছ বল তো? মনে মনে?
২
মোচা রান্না করা শিখেছিলাম
পটলের দোলমা, ধোঁকা।
শুনে খুশি হয়েছিলে
রেঁধে খাওয়াতে পারলে
কত ভালো লাগত বল তো…
৩
কত কত ঠাকুর দেবতা তোমার
উপরন্ত অবাধ্য বাবা —
তোমার জিম্মায় রাখা
তাদের কে দেখবে এখন?
৪
আচারের বোয়েমেরা
আমলকি মুখশুদ্ধির শিশি
আরও উনকোটি চৌষট্টি
মুখবাঁধা প্লাস্টিকে রাখা
“পরে কাজে লাগতে পারা” জিনিসেরা
থেকে গেল আমাদের মতোই..
তুমি আর ছুঁয়েও দেখবে না।
৫
হয়ত অবাধ্য হয়েছি বহুবার
মারধরও খেয়েছি অনেক
জ্ঞানত জ্বরজ্বালা হলেই তবে
আদর করেছ — তাও
সব্বার মা ভাল, আমার মা ও…
৬
ট্রেনে উঠে পড়েছ তুমি
আমরা ছাড়তে এসেছি
যে কোনও সময়ে গাড়ি ছেড়ে দেবে বলে
নেমে আসতে হ'ল ট্রেন থেকে
এই সফরের কথা আচমকা
জানলে কোত্থেকে?
৭
বাংলায় টাইপ করা শিখে
এত আনন্দ পেতে কাউকে দেখিনি
মাতৃভাষায় টাইপ করা যে শিখিয়েছে মা'কে
মা তাকে “মুন” বলে ডাকে।
৮
চোদ্দই জানুয়ারি নির্ঘুম কাটে
খুব সকালে বা শেষরাতে
কেউ আসে, কেউ চলে যায়
ঢেউ ওঠে সব ভেসে যায়।
৯
একমাত্র মেঘ ডাকলেই ভয় পেতে তুমি
আজ তাই মেঘমুক্ত নির্ঘুম মাতৃভূমি।
১০
অবহেলার অভিযোগ জানাওনি কখনও
নিজে থেকে ফোন করতে না —
আমি পাছে বুঝে যাই তোমায়
কবিতার মতো, তুমি তা চাইতে না।
১১
চা বানিয়ে ডেকে দেব তোমায়
মহালয়ার ভোরে —
যখন দেখা হবে ফের অক্ষরে অক্ষরে…
১২
ঘর-বার করি, চায়ের জল বসাই
ট্রেন কি ছেড়েছে সময়ে? পৌঁছলে?
এখানে কুয়াশারা হাওয়ার কথা বলে।
১৩
ঐখানে? যেখানে হাওয়া নেই বলে
সময়ের নৌকা থেমে যায়?
১৪
এত টুকিটাকি গল্প কাঁথা-কানি
মুহূর্ত দিন সপ্তাহ মাস বছরের
ধুমসো লেপকম্বল নিয়ে বেরোলে
আর ফোনটা নিলে না?
তুমি খুব বুদ্ধু তো মা!
১৫
সব লেখা মুছে যাক
সব কথা যা বলেছি এযাবৎ
একা ভোরবেলা
যদি ফেরে সবকিছু ফের
বলে যায় তোমার শাবক
১৬
এই কথা থাক তবে
যতক্ষণ বকবক করে যাব
তুমি হাতটা ধরেই থাকবে..
১৭
যাবতীয় ক্লান্তি, জড়তা, বয়সের লোল বল্কল
মুহূর্তে খসে পড়ে
যখন তোমার আঙুল
আমার মাথায় খেলা করে।
১৮
বাচ্চা মেয়ের মতো কখনও
অবুঝ অভিমানী —
এক কাপ চায়ে গলে যাবে
বিস্কুট মা এমনই।
১৯
আসলে শক্ত ভীষণ
শিকড়ে শিকড়ে
নইলে কীভাবে সে
দিল্লি-কলকাতা রাজত্ব করে?
২০
কেটেছে আধো নির্ঘুম রাত
এখন সকাল হ'ল। তবে —
তুমি ঘুম থেকে উঠলেই
আলোটি ফুটবে।
২১
তোমার মতো মা
আমার আর ভাইয়ের ছাড়া
কারও হয় না..
২২
অনেক কষ্ট পেলে মা
এবার ঘুমোও
আমি বন্ধ করি খাতা
এই পর্যন্ত সমাপন যত কথকতা।
সংযোজন২৯শে জানুয়ারি
১
একটা ঢাউস ঘুড়ি হবে আমার
অনেকটা উড়িয়ে তার ভেতরে
ঢুকে যাব — বাড়ির মতো
একটা রং-পেন্সিলের ঘর
একটা বাদ্যযন্ত্রদের, আর একটা
খোলামকুচি হাবিজাবি
সিঁড়ির তলার রান্নাঘরটাও আছে, মা।
২
তোমাকে যা যা বলা হয়নি —
ভাবতে গিয়ে চুপ করে যাই
কিছুই তো আটকায়নি কখনও
বলে গেছি যতক্ষণ শুনতে আমায় —
বলব, যদি ফের শোনো।
৩
সুদীপরা এসে মালা দিয়ে গেল
সাদা আর হলদে গ্লাডিওলি
মিষ্টিও অনেক এনেছিল সাদা সাদা
তুমি তো দেখলেই না..
অনেকদিন মাংসের কিমা দিয়ে
ঘুগনি খাওয়া হয়নি, না মা?
৪
কীসব যে ছাইপাঁশ লিখি — লোকে বলে
তুমি বলতে — পড়তে হবে আরও
এমন করে ছেড়ে যেতে পার?
৩১শে জানুয়ারি
রাতবিরেতে গাড়ি দরকার হ'লে পাঠাতে পারবে এমন একজনের সঙ্গে আগেই কথা ছিল, তাকেই ফোন করলাম। সে তুলল না। ভাইকে ফোন করলাম। ওকে একটা উবের করে আসতে বলা যেত — ভেবেও বললাম আমরা আসছি, বেরোলে ফোন করব, গলির মুখে আয়।
জামা-প্যান্ট চেঞ্জ করলাম। বেশ ঠান্ডা বাইরে, রেশমীর বাবার হুডি দেওয়া মোটা জ্যাকেট পরলাম। লাল টুপিটাও নিলাম। মা দিয়েছিল। সেই প্রথমবার অতীতকাল ব্যবহৃত হ'ল।
রেশমীর মা অনেক রাত অবধি জেগে থাকে, সেদিন আলো বন্ধ, হয়ত কিছু আগেই শুয়েছেন। তাই ওদের কাউকে ডাকলাম না। বাড়ির চাবি পকেটে নিয়ে নেমে এলাম আমরা।
হিম রাত্রি। নীল। কালো রাস্তায় এক একটা লাইটপোস্ট জ্বলছে। আইল্যাণ্ডের সিগনাল একা একা লুডোর দান চালছিল। না খেললেও চলত, তাও দাঁড়ালাম লালবাতি দেখে। এখন আর তাড়াহুড়ো নেই।
সরু গলির মুখে ভাই দাঁড়িয়ে আছে। এরপর আর লালবাতি নেই, মানে ছিল কিন্তু তার আগেই বাঁদিকের সার্ভিস লেন দিয়ে এগোলাম। দিনের বেলা এখানে এত গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে — এখন ফাঁকা। একটাও গাড়ি নেই।
পার্কিঙে গাড়ি রেখে তিনজনে নামলাম। গাড়িবারান্দাও ফাঁকা। কাচের পাল্লাটা দুটো বন্ধ। ওয়ার্ডের দিকে এগোতে দেখলাম একজন সিক্যুরিটি গার্ডও নেই। লিফটটাও গ্রাউন্ড ফ্লোরে, অপেক্ষায়।
আই সি ইউ এর সামনে অবশ্য গার্ড ছিল, কিছু বলার আগেই সে জিজ্ঞেস করল — ১৩৪? মাথা নামাতেই সে ইন্টারকামে ফোন করল। ভেতরে যেতে বলেও কী একটা কথা আবার শুনে বলল অপেক্ষা করতে। আইসিইউ এর অপেক্ষাঘরে। সেখানে বসার জায়গা থাকে না — চেয়ারগুলো সব ফাঁকা এখন। অপেক্ষা — আমাদের আর কোনও তাড়া নেই।
কিছু পরে একজন ডাকতে এল। আমরা ওয়ার্ডের দিকে এগোলাম। গত তেরোদিন এসেছি এখানে — প্রতিবার ভাবতাম কী বলব আজ মা'কে। আজ সেসব নেই।
১৩৪ নম্বর বেডের সামনেটা নিস্তব্ধ। অন্যান্য বেড থাকে মৃদু শব্দরা এসেও সে স্তব্ধটা কাটাতে পারছে না। মা শুয়ে আছে। আগের দিন সকালে যেমন প্রতি শ্বাসে কেঁপে উঠছিল, তেমনটা নেই। কপালে সাপোর্ট দিয়ে নাকে লাগানো নলটা রয়েছে। গালে হাত রাখলাম। মাথায়। চাদরের তলায় হাতটা ছুঁলাম। আলাদা কিছু নয়। মনিটরে চোখ যায় আমার, সেখানে তিনটে সমান্তরাল সোজা রেখা, তার পাশে আর কোনও সংখ্যা নেই। নেই, আর কিচ্ছু নেই…
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।