এ কী কাণ্ড!
পরের ছবিটা উঠছে না কেন!
রিমোট শাটারটা লক করা আছে তো? তা আছে, কিন্তু তাকে ছুঁতেই আবার একটা এক্সপোজার চালু হ'ল — এ আবার কেন হচ্ছে?
ভুলটা কোথায় হ'ল — বুঝতে পারছিলাম না। কেমন একটা অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে।
……….
পুজোর সময়ে শহরে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। ছেলেটাও এখানে নেই, আমাদের এখানেও কেউ আসছে না এইবার। কাছের লোকজন কাছাকাছি না থাকলে ব্যাপারটা কেমন হবে ভেবেই দমে যাচ্ছিলাম, তাই পুজোর সময়ে রাণীক্ষেত আসার প্ল্যান আমার ও রেশমীর।
উত্তরাখন্ডের আকাশ অক্টোবরের দিকে পরিষ্কারই থাকে মোটামুটি। কাজেই স্টার ট্রেইল বা তারা-পথ পাওয়া যেতে পারে যদি অপেক্ষাকৃত কম আলোক-দূষিত জায়গায় গিয়ে পড়তে পারি। এর আগে নেট ঘেঁটে দেখেছি তারা-পথ এর ছবি তোলার প্রকৃষ্ট জায়গা লেহ্ উপত্যকা, স্পিতি উপত্যকা ও মাঝখালি — ম্যাপে দেখলাম এই মাঝখালি হ'ল রাণীক্ষেত থেকে আলমোড়া যাওয়ার পথে একটা গ্রাম।
সেই ভাবনা অনুযায়ী থাকার জায়গা নির্বাচন করা গুগুল ম্যাপ থেকে। ম্যাপে মোটামুটি বোঝা যায় জায়গাটির অবস্থান। সে অনুযায়ী দু'একটা জায়গা দেখে পছন্দ করলাম “অ্যালপাইন র্যাপসডি” কে। হ্যাঁ, এর নামটা একটু বেশি পছন্দ হয়েছিল, সেটা সত্যি। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম সত্যি একটা ছাদ্দের ঘর আছে তাদের। যা উত্তরদিকের অনেকটা উপত্যকা, দূরে নন্দাদেবীর শৃঙ্গ সহ অনেকটা আকাশ একলপ্তে সামনে নিয়ে আসে। সেই ঘর পাওয়া গেল তিন দিনের জন্য।
প্রায় চার শো কিলোমিটার রাস্তা যেতে প্রায় ন'ঘন্টা লাগার কথা। সময় বেশি লাগল আমাদের, কিছুটা জ্যামের জন্য হলদোয়ানি পৌঁছতেই বেলা দেড়টা প্রায় কাজেই রাস্তাতেই লাঞ্চ সারলাম সারথি গোবিন্দ কে নিয়ে রেশমী আর আমি।
ঘরের লোকেশন একেবারে যা প্ল্যান করেছিলাম — ঠিক তাই। অনেকটা বড় ছাদ টাইলসে বাঁধানো। শুধু তাই নয়, তাতে একটা বড় কাঠের টেবিলও আছে। বিকেলের আলোয় নন্দাদেবীও দৃশ্যমান। ছাদ থেকে নেমে যাওয়া ঢালু উপত্যকায় প্রচুর গাছ, বিকেলের আলোয় ঝাঁকে ঝাঁকে আসা পাখির ডাকে মুখরিত। যদিও বেশিরভাগই ছটফটে দুর্গা-টুনটুনি, বুলবুলি আর হিমালয়ান টিট। ভেরিডিটার ফ্লাইক্যাচারও দেখলাম কয়েকটা।
চা খেতে খেতেই সূর্যাস্ত হ'ল। শুক্লা সপ্তমীর চাঁদ প্রায় মাথার ওপরে তখন, ভদ্রতা করে দক্ষিণ আকাশ ঘেঁসে। আমি অপেক্ষা করছি, আকাশ তো পরিষ্কার — তারারা উঠবে কখন!
রাত বাড়লে তারা এল ঝাঁকে ঝাঁকে। বিকেলের ১০০-৪০০ লেন্স খুলে নিয়ে ১০-১৮ লাগল ক্যামেরায়। ট্রাইপড বেরোল ব্যাগ থেকে প্রায় বছর দুয়েক পর। টেবিলের ওপরেই ট্রাইপড সহ ক্যামেরা বসালাম, পাশে টিকির মতো ঝুলছে রিমোট শাটার। অটো ফোকাসে দূরের আলো ফোকাস করে উত্তর দিগন্তে ক্যামেরা বসিয়ে টেস্ট শট নিলাম শাটার স্পিড ৩০ সেকেন্ড, আইএসও ৬৪০। বাহ, এইত তারাদের দেখা যাচ্ছে, এবার চালু হোক —
তারপরই ওই কাণ্ড!
পরের ছবিটা উঠছে না কেন!
রিমোট শাটারটা লক করা আছে তো? তা আছে, কিন্তু তাকে ছুঁতেই আবার একটা এক্সপোজার চালু হ'ল — এ আবার কেন হচ্ছে?
ভুলটা কোথায় হ'ল — বুঝতে পারছিলাম না। কেমন একটা অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে। বেশ কয়েকবার ক্যামেরার সেটিং চেক করলাম — নয়েজ কারেকশন ডিস-এবেলড, কন্টিনুয়াস শাটার মোড — করা আছে। শাটার স্পিড আর আইএসও যথাযথ, এমনকি টেস্ট শট অনুযায়ী হোয়াইট ব্যালেন্স ক্লাউডে করা — তাহলে!
তখনই ভুলটা ধরা পড়ল। অটো ফোকাস করে টেস্ট শট নেওয়ার পর তা আর ম্যানুয়াল করে রাখিনি। ফলে ক্যামেরা বেচারা পরের শট নেওয়ার আগে ফোকাস করতে গিয়ে সময় লাগাচ্ছে, তাকে একটু নাড়াতেই সে একটা পয়েন্ট পেয়ে এক্সপোজার চালু করছে।
এর পরে সব ঠিকঠাক। ছবি উঠছে একের পর এক। তখন খেয়াল হ'ল মোবাইলে কী এমন ছবি তোলা সম্ভব? একটু নেট ও ফোন ঘেটে দেখলাম মোবাইলে ত্রিশ সেকেন্ড অবধি শাটার স্পিড সিলেক্ট করা যায়। তাছাড়াও টাইম-ইন্টারভ্যাল শট এর সুবিধা আছে। চট করে ওই একই সেটিং এ আকাশমুখী ফোন রেখে শাটার ট্যাপ করতে ভালোই ছবি এল। এবার প্রশ্ন মোবাইলে তোলা ছবি স্ট্যাক করব কীভাবে? ক্যামেরায় তোলা ছবি ল্যাপটপে তুলে StarStax সফটওয়্যারে জুড়ি আমি। মোবাইলে তা দেখলাম কাজ করে না। আবার কিছুটা খুঁজতে তাও পাওয়া গেল Star Trail নামক অ্যাপে।
পাঁচটা ছবির একটা সিরিজ নিয়ে সেই নতুন নামানো অ্যাপে দেখলাম হ্যাঁ এইতো লাইন জুড়ছে ভালোই।
কিন্তু তা করব পরের দিন। সেদিন তাই শুধু ক্যামেরায় ছবি তুলেই ক্ষান্তি।
প্রথম দিনের ছবি।
ভাল ঠান্ডা। সৌভাগ্যের বিষয় হাওয়া তেমন ছিল না। জোরে হাওয়া দিলে ট্রাইপডে ওজন ঝুলিয়ে রাখতে হ'ত যাতে ক্যামেরা কেঁপে না ওঠে।
সকালের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। যথাসম্ভব কম শব্দ করে ও আলো না জ্বালিয়ে ক্যামেরার লেন্স বদলে, চায়ের জল গরম করে তাতে টি-ব্যাগ ঝুলিয়ে, জ্যাকেট আর জুতো গলিয়ে ঘরের বাইরে আসি — নন্দাদেবীর চূড়ায় আঁচ পড়েছে তখন। বাকি সব ছায়াচ্ছন্ন। সেই চূড়ায় রূপো রঙ ধরতে তবে দূরের পাহাড়ে আলো এল। এদিকে পাখিদের ডাকাডাকি সুর চড়াচ্ছে।
উপত্যকায় ধীরে ধীরে আলো এল।
কালো বুলবুল ধরা পড়ল ক্যামেরায়। একাকী ডাভ। ছটফটে বুলবুলি, টিট। রেশমীও উঠল একসময়ে। একটা বাঙালি পরিবার এসে উঠেছে গত রাতে। ছোট বাচ্চাটা ছাদময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে পিছু পিছু তার ঠাকুমা, বাবা, মা — যে যতক্ষণ পারছে। সকালের জলখাবার খেয়ে বেরোব শীতলক্ষেত দেখতে।
রাণিক্ষেতের উল্টোদিকে যে রাস্তাটা মাঝখালির দিকে গেছে সে দিকেই শীতলক্ষেত। কিছুদূর যেতেই চমক। কুমায়ুনের পুরো রেঞ্জ — বাঁ দিক থেকে শুরু করে পর পর ত্রিশূল, নন্দাদেবী, নন্দাকোট, থেকে পঞ্চচুল্লি পুরো পশরা নিয়ে হাজির।
আলমোড়া যাওয়ার সে রাস্তা যেতে যেতে টুক করে বাঁদিকে ঢুকে গেল সরু হয়ে — আর চড়াই শুরু হ'ল। কিছুক্ষণ পর দেখি পাইনের আলো ছায়ায় মাখামাখি রাস্তা উৎসব লাগিয়ে দিয়েছে যেন। জঙ্গলের নিজস্ব গন্ধে নেশা ধরে যায়। ঝিঁঝিঁর কলতান সঙ্গত করে চলে।
কে এম ভি এন এর একটা রেস্ট হাউস আছে শীতলক্ষেতে, বাকি বলতে একটা ছোট গ্রাম সরু পাহাড়ি রাস্তার ধারে, আরও সরু সরু পথ বেরিয়ে সেঁধিয়েছে ছোট ছোট ঘরের দিকে। তেমনই এক ঘরে সামিয়ানা খাটানো। পুজো বা বিয়ে কিছু একটা হবে হয়ত।
সেই কে এম ভি এন এর গেস্ট হাউসের সামনেই থামলাম আমরা। খাওয়ার অর্ডার দিলে পাওয়া যাবে তবে ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। ভালোই হ'ল। জঙ্গলের শুড়িপথে নামা হ'ল সেই সুবাদে।
জঙ্গলের শুঁড়িপথে রেশমী।
ফেরার পথে রাণিঝিল দেখে বেশ দমে গেলাম যদিও। অপরিচ্ছন্ন ডোবা প্রায়। বোটিং এর ব্যবস্থা আছে — তবে প্রায় গাঢ় সবুজ জল আর বোটের স্বাস্থ্য দেখে ভরসা হয় না। ছোট ঠোঙায় মুড়ি বিক্রি হয় — যা সেই ঝিলের পাশে ছড়ালে লাল লাল মাছের ঝাঁক আসে খেতে।
আগের দিন ক্যামেরা প্রায় আনুভূমিক অবস্থায় ছিল। আজ মনে হ'ল যদি একটু মুখ তুলে তাকানো যায়। মোবাইলে দেখে নিয়েছি একলপ্তে পঞ্চাশটা অবধি ছবি তোলা সম্ভব।
ক্যামেরার জন্য তো ট্রাইপড আছে, মোবাইলটা তাই প্রায় ষাট ডিগ্রি কোণ করে ঠেকনা দিলাম একটা জলের বোতলে, মোবাইলটা যাতে স্লিপ করে শুয়ে না পড়ে তাই উল্টোদিকে রাখলাম অ্যাশট্রে। আজ অষ্টমী-নবমী তিথি, চাঁদ তাই আরও একটু বেশিক্ষণ জ্বালাবে। তাই রাতের খাবার খেয়ে এসেই শুরু করলাম প্রায় রাত দশটা নাগাদ।
মোবাইলের পঞ্চাশটা ছবি মাঝে তিন সেকেন্ডের ইন্টারভ্যাল দিয়ে তুলতে লাগে আঠাশ মিনিট, তারপর সাবধানে মোবাইলের শাটার ছুঁয়ে দিলে আরও পঞ্চাশ — ব্যস আজকে ঠেকায় আমায় কে!
এমনিতে স্টার ট্রেইলের ছবিতে কিছুটা দিগন্ত দেখা যাওয়া বাঞ্ছনীয়, কিন্তু যেহেতু এখানে ক্যামেরাকে মুখ তুলে তাকাতে বলা হয়েছিল তাই শুধুই তারারা এল ছবিতে। ঠিক মাঝখানে ধ্রুবতারা যেন চোখের মণিটি হয়ে আছে।
শুধুই তারারা…
মোবাইলে পর পর দেড়শোটা ছবি তুললেও দেখলাম সফটওয়্যারবাবু একশোর বেশি ছবি নিতে নারাজ। ঠিক আছে, তাও যদিও বা নিলাম — দেখলাম ক্যামেরা লম্বালম্বি রাখার কারণে ছবিটা সুবিধার হয় নি। তাই আর এখানে দিলাম না।
পরদিন দশেরা। এই দিনে কোথায় যাব তা ঠিক করা ছিল না। হোটেলে কথা বলে জানলাম রাণীক্ষেতেই চৌবাতিয়া বলে এক জায়গা আছে যা নাকি আপেল বাগান। তার পাশেই এক জঙ্গল আছে। হোটেলের ভদ্রলোক আমাকে সাবধান করে দিতে বললেন — ওখানে নকি লেপার্ড আছে। তাতে আমার উৎসাহ বেড়ে যেতে অল্প ক্ষুণ্ণ হলেন মনে হ'ল।
সেই আপেল বাগানের দশা খারাপ। বরং জঙ্গলটা ঘন। শুরুতে হাঁটার রাস্তা বেশ সরু হলেও ভেতরে চমৎকার সমান রাস্তা। বেশ তিনজনে যাচ্ছি, আমি পাখির খোঁজে গাছে গাছে মুভমেন্ট লক্ষ করছি। তখনই রেশমী থামাল। কুকুর রেগে গেলে যেমন একটা গোঁ গোঁ বা ঘর্ঘর আওয়াজ করে তেমনই এক ডাক — অদূরেই কোথাও। কিছুই চোখে পড়ল না, তাও যেহেতু আগের রাতেই হোটেলের ভদ্রলোক সাবধান করে দিয়েছিলেন, তাই রেশমী আর এগোতে দিল না। পরে নেট যোগাযোগ এলে ইউটিউবে শুনলাম লেপার্ডের ডাক — ঠিক যেমনটা আমরা জঙ্গলে স্বকর্ণে শুনে এলাম।
আজকের রাতই শেষবার সুযোগ ট্রেইল তোলার। আজ ক্যামেরা ও ফোন মাঝামাঝি, যদিও টেবিলের ওপর ফোন রাখায় ছাদের কার্ণিশের রেলিঙে রাখা টবের আভাসটুকুই স্থলভাগ।
শেষদিনে মোবাইল
তার পরের দিন রবিবার খুব সকালে বেড়িয়ে রাজ্যের জ্যাম ঠেলে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে ও ফের সপ্তাহের অফিসে জুতে গিয়ে তবে ফাঁক পাওয়া গেল শেষদিনের ক্যামেরার ছবি নিয়ে বসার। যা পাওয়া গেল সব দিয়ে দিলাম।
ফাইনালি যা পাওয়া গেল।