এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • ভাঙায় গড়া অজন্তা ইলোরা 

    ফরিদা লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ১১ জানুয়ারি ২০২৪ | ৯৭৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • ১ যাত্রা শুরু 

    হাওড়া থেকে ভায়া এলাহাবাদ (প্রয়াগরাজ বললে হয়ত নিজেই চিনতে পারব না), মুম্বাই মেল আর মুম্বাই থেকে একই পথে ফেরা হাওড়া মেল এর দেখা হয় ভোর পাঁচটায় জলগাঁও স্টেশনে।  যাত্রা শুরুর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে যথাক্রমে। হাওড়া থেকে আপ ট্রেন রাত এগারটায় ছেড়ে পরের সারাদিন চলে তারপরের ভোরবেলা। অন্যদিকে মুম্বাই সি এস টি থেকে রাত সোওয়া দশটায় ছেড়ে পরদিন ভোর ভোর।
    হাওড়া থেকে বাবুইদিরা আর অয়নরা আসছে। এদিকে মুম্বাই থেকে যাওয়ার কথা ছিল জয়ন্তর। এই প্ল্যানে আমরা পরে জুড়তে মুম্বাইতে একটা দিন কাটিয়ে ওই ট্রেনের টিকিট কেটেছিলাম। যাত্রার আগের দিন লোপার হঠাৎ তেড়ে জ্বর আসায় জয়ন্তরা ক্যানসেল করাতে মুম্বাই থেকে শুধু আমরাই, অগত্যা।

    ট্রেনে উঠে অখাদ্য আই আর সি টি সি'র খাবার খেয়ে লাইভ লোকেশন “কৈলাশে ক্রিসমাস” গ্রুপে শেয়ার করে বললাম ওদেরও সেটা করতে — বেশ একটা ম্যাপের মধ্যে দুটো বিন্দু কতটা এগোলা — দেখা যায়। খুব একটা কাজে এল না তা, রোরো তা শেয়ার করল মাত্র একঘন্টার জন্য।  তখন অন্য ব্যবস্থা — ট্রেন রানিং স্ট্যাটাসে দেখতে থাকা ট্রেনের অবস্থান — পরপর দুটো ক্রোম জানলায় — কে কোথায় দাঁড়িয়ে। 

    অনেকদিন পর ট্রেনে উঠে এই নতুন খেলায় খুব মজা লাগল। আগে তো পরপর ক'টা টেলিগ্রাফ পোস্ট পেরোতে ক'সেকেন্ড নিচ্ছে — সেই হিসেবে ট্রেনের স্পিড মাপতাম। টাইম টেবিল থেকে পর পর স্টেশন পেরোলে - গড় গতিবেগ। রাতে অবশ্য এ খেলা চলত না। তখন বড় ব্রিজ এলে ভাবতে চাইতাম — ঠিক কোন নদী পেরোচ্ছে এখন! 
    যেহেতু জলগাঁও তে গাড়ি থামবে দু'মিনিটের জন্য।  সেই জন্য রেশমী আর পট্ট কে বললাম ফোনে অ্যালার্ম সেট করে ঘুমোতে। আমাদের রওনা হওয়ার সময়ে অয়নদের ট্রেন প্রায় একঘন্টা লেট। হয়ত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ভাবছিলাম। এদিকে আমাদেরটিও লেট করতে শুরু করল — ফলত: রেশমী ও পট্ট র কিছুক্ষণ অতিরিক্ত ঘুম জুটল। 
     
    ২ প্রথম দিন 
     
     
     

     ওরা পৌঁছে গেছে, আমরা পাশের ট্রেন থেকে নামব। 
     
    ট্রেন থেকে নামতেই দেখি ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। জলগাঁও স্টেশনে রিটারিং রুম বলতে একটাই। জয়ন্ত তা বুক করে রেখেছিল। অত ভোরে কে আর বেরোবে — ওদিকে অজন্তার এমটিডিসি টি জংশনে চেক ইন তো এগারটায়। 
     
    জয়ন্তর সেই বুকিং এর সূত্রে আমরা উঠলাম সেখানে। দেখা গেল ডর্মিটারিও আছে সেখানে। আমি, পট্ট, অয়ন, রোরো, রুনার আর সৌরভ দা সেখানে নিজ নিজ খুপরি তে ঢুকে পড়লাম — কমন বাথরুমে একে একে আস যাওয়া চলল।  রেশমী, মানসী, বাবুইদি আর আমন জয়ন্তর বুক করা ঘরে থাকল। বছরের সবচেয়ে ছোট দিন আর পশ্চিমে অবস্থিত হওয়ায় সকাল সাড়ে ছ'টাতেও বাইরে নিকষ অন্ধকার। প্লাটফর্ম চৌহদ্দির বাইরে শুনশান পার্কিং লটে অবান্তর আলোকিত বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং এর নিচে আগুন জ্বালিয়ে স্থানীয় মানুষের জটলা। দু'একটা বাইক চলা শুরু হয়েছে রাস্তায়।
     
    সাড়ে সাতটা নাগাদ গাড়িওলা কে ফোন করা হ'ল। সে আসতে সব লটবহর নিয়ে চেপে বসলাম তাতে। রোরো আর রুনারের স্নিকারের সোল খুলে গেছে — কাজেই সকাল আটটার মিঠে রোদ্দুরে দশজনের প্রাথমিক কাজ হ'ল জানলায় চোখ রাখা যাতে একটা জুতোর দোকান বা জুতো-সারাইওলা বা নিদেন পক্ষে একটা মুদির দোকান খোঁজা যাতে একটা ফেভি-কুইক পাওয়া যায়। 

    দিল্লির তুলনায় ঠান্ডা তেমন নয়। কিন্তু মুম্বাইয়ের মতো গরম নয় তা। একটা মোড়ে বাস থামলে রোরো রুনার কে নিয়ে সৌরভদা জুতো-সন্ধানে গেলে বাকিরা খোঁজ লাগালাম খাদ্য অন্বেষণে। মুগডালের পাকোড়া, ঢোকলা, জিলিপি, আলূ বোন্ডা রা হাতে হাতে ঘুরে ফুরোতে লাগল। 
    জলগাঁও থেকে অজন্তা প্রায় ষাট কিলোমিটার — দেড় ঘন্টার রাস্তা। আমাদের সতেরো সীটের টেম্পো ট্রাভেলারে রাস্তার মাঝখানে থেমে জুতো কিনে জিলিপি ইত্যাদি খেয়েও তা সোওয়া দু'ঘন্টার বেশি কাটানো গেল না। কাজেই অজন্তার অদূরে আরেক জায়গায় থামতে হল ঠিকঠাক প্রাতরাশের জন্য। পেঁয়াজের তরকারিতে চানাচুর মিশিয়ে তার সঙ্গে সার্ভ করা মাখনে ভাজা পাও — মিসাল পাও নামে এল। স্বাদেও বেশ ভাল। 
    অজন্তা গুহায় ঢোকার আগে চার কিলোমিটার একটা বাসযাত্রা আছে। সেই বাস যেখান থেকে ছাড়ে, সেখানেই এমটিডিসি'র টি জাংশান। বিশাল এলাকা জুড়ে পাহাড়ের মাথায় পাঁচটা কটেজ নিয়ে এর অবস্থান। প্রতি কটেজে একটা ডবল বেড, ও একটা সিংগল বেড, ছোট পার্টিশন ঘেরা এক ডাইনিং স্পেস ডাইনিং টেবিল ও দু'টো চেয়ার, অ্যান্টি রুম সহ এক বাথরুম, তার পাশেই পাথরের স্ল্যাব ও সিংক সহ এক কিচেন স্পেস প্রমাণ সাইজের। ঘরের ঠিক বাইরে এক বড় বারান্দা — যাতে একটা আরামদায়ক দোলনা ছাড়াও রয়েছে দু'টো চেয়ার সহ এক টেবিল। সামনের প্রশস্ত প্রান্তরে কিছু ঘাসজমি ছাড়িয়েই জঙ্গল। দূরে পাহাড়ের সারি গাঢ় সবুজ ও ঘন নীলের মিশেলে। 
    ২৫শে ডিসেম্বর, যেদিন পৌঁছলাম সেটা একটা সোমবার। অজন্তার গুহা বন্ধ থাকে। কাজেই একটু হাত-পা ছড়িয়ে আড্ডা মেরে স্নান সেরে বেরোলাম লাঞ্চ সারতে এক কাছাকাছি জায়গায়। খাওয়া সেরে সেই সকালের গাড়িতেই গেলাম প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে “ভিউ পয়েন্ট” দেখতে। জায়গাটা এক পাহাড়ের মাথায়। সেখান থেকে দূরের অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়ের শ্রেণীর মধ্যে অবস্থিত সারিবদ্ধ গুহাগুলি দেখা যায়। ভিউ পয়েন্ট থেকে একটা কুড়ি মিনিটের ছোট ট্রেক করে নেমে আরেকটা পাহাড়ে পৌঁছন যায় দেখলাম — সেখান থেকে “ভিউ” আরও ভাল। অনেকে নেমেছেও দেখলাম। যেহেতু এটাও শুনলাম কুড়ি মিনিট নিচে নামলে উঠতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগে — তাই আমরা ঝুঁকি না নিয়ে বলটা যেতে দিলাম উইকেট কিপারের দস্তানায়। 
    পাঁচটা ঘরের চারটেই আমাদের দখলে। মুন্না যদি আসার একমাস আগে ক্যান্সেল না করত তো পাঁচটা ঘরেই থাকতাম আমরা। জয়ন্তরা না আসায় পট্ট রোরো রুনার সেই ঘরে ঢুকে পড়ল। তার পাশের ঘরে আমি-রেশমী, তার পাশে বাবুইদি-সৌরভ দা, তার পাশের ঘরে আমনকে নিয়ে অয়ন-মানসী।
     

     ভিউ পয়েন্ট থেকে অজন্তার গুহাগুলি যেভাবে দেখা গেল। 
     
    টি - জংশনে কর্মী সীমিত। খাবারের অর্ডার আগে দিয়ে দিতে হয়। সেই অনুযায়ী রান্না-বান্না। ভিউ পয়েন্ট থেকে ফেরার পথে রাস্তায় ছাগল চড়তে দেখে অয়নের জিভে প্রেম উথলে উঠল। কাজেই পরের দিনের ডিনারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়ছিল। 
     
     
     
    ৩ দ্বিতীয় দিন 

    মহারাষ্ট্র সরকারি পরিবহণের বাস আসা যাওয়া করে টি জংশন থেকে মাথা পিছু পঁচিশ টাকা ভাড়ায়। যেতে -আসতে পঞ্চাশ টাকা। চল্লিশ টাকা টিকিট অজন্তা গুহার গেটে। ভিতরে ভিডিও ফোটোগ্রাফি মানা। বাসে ওঠার আগে অজন্তার ছবির ফেরিওয়ালারা বলেছিল ভিতরে নাকি ফোটোগ্রাফি মানা। তাই নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলাম। ওখানে আবার ফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যা কাজেই গুগুলকাকুর সাহায্য পাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ওখানে পৌঁছে দেখলাম দিব্যি ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে রিলওলা ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া মানা। ভিডিও নেওয়া বারণ তাও গেটে মনে করান হচ্ছে। 

    গেট থেকে কিছুটা চড়াই উঠে গুহাগুলি শুরু। বেলা দশটা প্রায়। এই অঞ্চলে শীতকাল বলতে সকালে ন'টা অবধি আর রাতে ফের সাতটা থেকে শুরু। বাকি সময় হাফ হাতা জামার ঋতু। প্রচুর ইস্কুলের বাচ্ছাদের দল এসেছে। স্থানীয় ট্যুরিস্ট ছাড়া অন্যান্যরা বেশিরভাগই বাংলাভাষী। 
    এক নং গুহার সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর গাইড পাওয়া গেল। 

    অজন্তার গুহাগুলি খ্রীস্টপূর্ব ২০০ থেকে এদিকে ৭০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে বানানো হয়েছে। তখনকার ব্যবসায়ীরা ছিলেন এইসব গুহানির্মাণ কাজের পৃষ্ঠপোষক। তাদের উল্লেখ রয়েছে প্রতিটি গুহায়। বুদ্ধ ও তাঁর পূর্বজন্মের জাতক কাহিনী বিবৃত গুহার দেওয়ালে, ভিতরের ছাতে। বুদ্ধের পুরনো অনুগামীরা হীনযান সম্প্রদায়ের।  তাঁরা বুদ্ধের মূর্তি বানাতেন না। বুদ্ধ কে বোঝানর জন্য পদ্ম, বৃক্ষ ইত্যাদি নানান চিহ্ন ব্যবহৃত হ'ত। পরবর্তীতে মহাযান সম্প্রদায়ের চিত্রে বুদ্ধ ও তাঁর পূর্বজন্মের অবতারদের (এনারা বোধিসত্ত্ব নামে পরিচিত) চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে প্রাচীন গুহায় শুধুই অবয়বহীন চিহ্ন পাওয়া যায়। পরের দিকের গুহায় অবয়বযুক্ত কাহিনী। আরও পরে দেখা যাবে দ্বিমাত্রিক চিত্রের চেয়ে শিল্পীরা উৎসাহিত হলে ভাস্কর্যের দিকে। 
    গুহার ক্রমোল্লেখে এই সময়সারণী মানা হয়নি। বরং যেখান থেকে গুহার প্রবেশপথ,  সেখান থেকে পর পর নম্বর দেওয়া আছে। প্রথম গুহাতে যেমন দেখা যাবে বোধিসত্ত্ব জাতকের কাহিনী — যা মোটামুটি ভাবে অজন্তা নির্মাণের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা।
    পাহাড়ের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে গুহাগুলি বানানো হয়েছে। ভিতরের দেওয়াল ও ছাত মসৃণ করা হয়েছে। তারপর তা প্লাস্টারিং হয়েছে — এর পরে চলেছে চিত্রায়ণ ও বর্ণলেপন। রঙ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে খনিজ উপাদান। দুই রকমের গুহা দেখা যায় এখানে। প্রথমটি হ'ল “বিহার”, যা বুদ্ধ শ্রমণদের আবাসগৃহ। দ্বিতীয়টি “চৈত্য” বা উপাসনাগৃহ। 
    অজন্তার এই গুহাগুলি সৃষ্টির পরে বহুকাল অবধি মানুষের অজ্ঞাত ছিল। ইংরেজ সৈন্যের একটি দল ঘটনাচক্রে গুহাগুলি দেখতে পায় দূরের এক পাহাড় শ্রেণী থেকে। এই আবিষ্কারের পর অনেকটা সময় গেছে এর তাৎপর্য অনুধাবন করতে। পরে রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির তত্ত্বাবধানে এই গুহাচিত্রের অঙ্কিত অনুলিপি প্রকাশিত হ'লে তা ক্রমশ: শিল্পরসিক তথা ঐতিহাসিক কে আকৃষ্ট করে।

     অজন্তা, প্রথম গুহা
     
    অঙ্কিত ছবির অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গিয়েছে মানুষের লোভে ও আবহাওয়ার প্রকোপে। তবু যা এখনও দেখা গেল তার আবেদন মনোমুগ্ধকর।  পর পর সাজানো ছবিগুলি অনেকটা যেন সংলাপহীন কমিক স্ট্রিপের কায়দায় গল্প বলে যায়। সেই গল্প আগে থেকে জানা থাকলে মিলিয়ে দেখার সুবিধা সেই চিত্রকলার খুটিনাটি। নারায়ণ সান্যাল রচিত গ্রন্থ “অজন্তা অপরূপা” বইতে এর বেশিরভাগই খুবই যত্ন সহকারে বিধৃত। এমনকি ওখানকার প্রতিটি গাইড অবধি এই বইয়ের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা স্মরণ করেন।  আমি অবশ্য অজন্তা ইলোরা নিয়ে জানতে প্রথমেই "গুরু" স্মরণাপন্ন হই ও হুচির টই (https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=25359&srchtxt=%E0%A6%85%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE) থেকেই প্রাথমিক ধারণা পাই। 
     
    কিছু গুহা অসম্পূর্ণ।  হয়ত মাঝপথে পৃষ্ঠপোষক বণিকের অনুদান বন্ধ হয়ে গেছে। হয়ত বা পাহাড়ের এমন কোনও অঞ্চল সামনে এসেছে যাতে আর এগোন সম্ভব হয় নি। এমন গুহায় অবশ্য তাদের কাজের পদক্ষেপগুলির আভাস পাওয়া সম্ভব।
    দিনের বেলাতেও গুহার ভিতর অন্ধকার, ঠান্ডা। ভিতরের দেওয়ালে মশাল রাখার গর্ত দেখালেন গাইড। এখনকার পর্যটকেরা মোবাইলের টর্চ দিয়ে দেখেন, গাইডের হাতেও থাকে টর্চ। জোনাকির আলোর মতো সেই আলো ঘুরে বেড়ায় প্রাচীন গুহাচিত্রের শরীরে। সেই আলোতে উদ্ভাসিত হ'ন বোধিসত্ত্ব, ঝলমল করে ওঠেন সুন্দরী নায়িকারা ও তাঁদের দাসদাসী পরিবৃত প্রাসাদ।

    ২৬ নং গুহা, মহা-পরিনির্বাণ 
     
    ক্যামেরায় ছবি তোলার এত উপাদান সামনে, অথচ প্রায় পাশাপাশি প্যানেলেও আলোর ফারাক অনেকটাই। ক্যামেরা কে বেশিরভাগ সময়েই তাই ম্যানুয়াল মোডে রাখতে হচ্ছিল। ISO আর শাটার স্পিড কমিয়ে বাড়িয়ে — এদিকে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুনতে হচ্ছিল গাইডের ধারাবিবরণী — ছবি তোলার পর তা একবার দেখে — আর একটু অ্যাডজাস্ট করার সময় পেলে ছবি ভালো পাওয়া যেত। কিন্তু তা হয়ে উঠল না। এখনকার মোবাইল ক্যামেরা নিজে থেকেই সে সব খুঁটিনাটি ঠিকঠাক করে ছবি তোলে।  দলের মধ্যে পিছিয়ে পড়ছিলাম তাই বারবার।

     অজন্তা গুহাচিত্র
     
    গুহাগুলি প্রায় কাছাকাছি একে অপরের সঙ্গে। কয়েকটা জায়গায় অবশ্য ওঠা নামা আছে। কিন্তু পরের দিকে সেটুকু আর গায়ে লাগছিল না। মোট ৩০ টি গুহার মধ্যে ২৬ নং গুহা দেখেই আমাদের ক্ষান্ত দিতে হ'ল। বাকিগুলি অসম্পূর্ণ ও দুর্গম। ২৬ নং গুহাতে আছে বুদ্ধের মহা-পরিনির্বাণ শায়িত মূর্তির ভাস্কর্য, গুহার ভিতর বাঁ দিকের দেওয়ালে। জাতকের গল্প থেকে শুরু বুদ্ধের পরমার্থ-পর্যটন। মহা-পরিনির্বাণে সে অধ্যায় সম্পূর্ণ হ'ল। এখানেই বুদ্ধের মূর্তির চারপাশে প্রদক্ষিণ করা যায়। এটিও একটি চৈত্য বা উপাসনা গৃহ হিসেবে নির্মিত। 
     

     মহা-পরিনির্বাণে বুদ্ধ, পায়ের কাছে আনন্দ, রেশমীর তোলা ছবি।
     
    পড়লাম বাগোড়া নদী ঘিরে পাহাড়ের শ্রেণীর মধ্যে অবস্থিত গুহাগুলি যতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল, তার অতটা ক্ষতি হয় নি — যতটা তার পরে হয়েছে।  বেশ কয়েকটা গুহায় দেখলাম রাসায়নিক প্রয়োগ করে ভিতরের চিত্রগুলির আয়ু বাড়ানর প্রচেষ্টা। 
    ফেরার সময়ে গুহার সামনের পাথুরে পথে না গিয়ে আমরা ছোট্ট সেতু পার হয়ে নদী পেরিয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরলাম। সুস্বাদু আনারস,  পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে। আর আছে হনুমানের ঝাঁক। টানা ঘন্টা তিনেকের চড়াই উতরাই গুহা সফরে দলের সবাই বেশ অল্পবিস্তর কাহিল। যেখানে গুহায় উঠতে শুরু করেছিলাম — সেখানেই MTDC  পরিচালিত রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেই সুযোগ মিলল খাওয়ার। 
    সেদিন আর কোথাও যাওয়ার নেই। আস্তানায় ফিরে সায়মাশে আলু দেওয়া মাংস আর ভাতের ব্যবস্থা করতে বলে জিরিয়ে নিলাম।
     

    মিষ্টি আনারসওলা।
     
     
    প্রচুর পাখির আনাগোণা এই অঞ্চলে তাদের সম্মিলিত হাঁকডাক সারাক্ষণই আবহসঙ্গীত হয়ে বাজে। সেইসকাল ও সন্ধ্যায় তা ওঠে সপ্তমে। রাতে একেবারে শুনশান। তখন আমাদের আড্ডা বিতর্ক পান ভোজন চলল অনেকক্ষণ। 
     
    ৪ তৃতীয় দিন 
    পরের দিন একটা দশ আসনের ফোর্স ক্রুইজার ঠিক করা হয়েছিল যাতে ঔরাংগাবাদ দেখে ইলোরা পৌঁছনর কথা। প্রথমে থামা হ'ল বিবি কা মকবারায়। ঔরঙ্গজেবের স্ত্রী দিলরাস বানু বেগমের স্মৃতিসৌধ বানিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেবের ছেলে আজম শাহ। তাজের কারিগরের নাতি কে ডাকা হয়েছিল নির্মাণকার্যে। তাজমহলের ব্যাপ্তি ও দীপ্তি এতে পাওয়া যায় না। তবে সেই তুলনা সরিয়ে রাখতে পারলে জায়গাটা ভালো লাগে। গেট থেকে মূল সৌধের দিকে এগোতে দু-পাশের বিরাট বাগান একটা পাঁচিলের আড়ালে থেকে গেছে। সেটা না থাকলে ভাল লাগত। 

     বিবি কা মকবারায় সস্ত্রীক সপুত্র।
     
    সেটা দেখে বেরোতেই দুপুরের খাবারের জন্য থামলাম সাগর রেস্তোরাঁয়। নামের মধ্যে সাগর থাকায় তা এক নিরামিষ ভোজনের ইঙ্গিত দিলেও রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডের উর্দু অক্ষর ভরসা দিল। বীফের পদও পাওয়া গেল। তবে বিরিয়ানির ধরণ হায়দ্রাবাদী, তা আবার আমার কাছে তাজমহল বনাম মিনি তাজমহলের তুলনায় নিয়ে আসে। 

    বিবি কা মকবারায় জাফরির কাজ
     
    এবার গাড়ি চলল দৌলতাবাদ দুর্গের দিকে। যা কিনা ঔরাঙ্গাবাদ ছাড়িয়ে ইলোরার পথে। আগে এ জায়গার নাম ছিল দেওগিরি। যাদব বংশের (দক্ষিণের যাদব) রাজা ভিলামা এই দুর্গের পত্তন করেন ১১৮৭ সালে।  ১৩০৮ সালে এই দুর্গ দখলে নিয়েছিলেন আলাউদ্দিন খলজী। তার পরেই নাম পরিবর্তন হয়ে দৌলতাবাদ হয় এর নাম। 

     দৌলতকবাদ কেল্লার মুল দরজার সামনে।
     
    দু'শো মিটার উঁচু এই কেল্লা পাহাড়ের ঢালকে ব্যবহার করে এক অপরাজেয় দুর্গ হিসেবে নির্মিত হলেও সে অর্থে খুব বেশিদিন সে গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে নি। প্রতি পদক্ষেপে গাইড আমাদের বলে চলেন — শত্রু এদিক থেকে এভাবে আসলে ঠিক এইভাবে কচুকাটা হবে — এতে অনেকটা আমার “যদি ব্যাটা কোনও পাজি, বসে যদি মাঝামাঝি” ধরণের সমস্যার কথা মনে করিয়ে দেয়।
     

    এই সিঁড়ি বেয়ে ওঠা প্রাণান্তকর ভরাপেটে।
     
    অনেকটা হাঁটা ও বেশ খানিকটা খাড়া চড়াই ছিল কেল্লার টপে উঠতে। এদিকে দুপুরের গুরুভোজনের পর তা এক কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা। আমরা অনেকেই ধারণা করতে পারিনি সে কেল্লা এত বিশাল ও চড়াই সংকুল। ভিতরে প্লাস্টিকের বোতল ফেলে রাখা বন্ধ করার জন্য প্রতি প্লাস্টিক বোতল পিছু কুড়ি টাকা জমা নেওয়া হচ্ছে। যা ফেরৎ পাওয়া যাবে ফেরার পথে সে বোতল দেখালে। কেল্লার ভিতর রাজাদের মূল বাসস্থান মেরামত চলছে। আমরা শুধু তাই শত্রু যে পথে এসে পদে পদে বিপদে পড়বে — তাতেই চলাফেরা করলাম।
     

    কেল্লার ভিতর, পট্টর তোলা ছবি
     
    ১৩২৭ সালে এই দৌলতাবাদেই রাজধানী স্থানান্তর করেন মহম্মদ বিন তুঘলক। দিল্লির প্রতিটি রাজকর্মচারী তথা বহু সাধারণ নাগরিককেও বস্তুতপক্ষে বাধ্য করা হয় দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে যেতে। পরে এই রাজধানী পরিবর্তন প্রক্রিয়া বদলে ফেলেন নবাব। ভোগান্তি দ্বিগুণ হয় প্রত্যেকের। 

    দৌলতাবাদ কেল্লার পার্কিং থেকে সূর্যাস্ত।
     
    দৌলতাবাদ কেল্লা থেকে বেরিয়ে গাড়ির পার্কিং অবধি পৌঁছতেই সূর্যাস্ত হয়ে গেল। সেখান থেকে দশ বারো কিলোমিটার দূরের ইলোরায় কৈলাশ হোটেলে পৌঁছে চেক ইন করতে করতে রাত নামল। ইলোরা গুহার প্রবেশপথের সবচেয়ে কাছের হোটেল এটি। হাঁটা পথে দু'শো মিটারও হবে কি না সন্দেহ। অজন্তার তুলনায় এখানে ছোট বড় দোকানপাট মানুষজনের ভিড় বেশি। 
    কৈলাশ হোটেলেও কটেজ ধরণের ঘর। প্রতি ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা ও তাতে ডাইনিং টেবিল ও চেয়ার রয়েছে। ঘরের ভিতরও যথেষ্ট প্রশস্ত। রাতে ভেজ খাওয়া স্থির হ'ল সকালের গুরুভোজনের পর। সে সব বিশদে আর লেখার মতো নয়। 
     
    ৫ চতুর্থ দিন
    চাঁদ ডুবল। আলো ফুটল। দেখলাম হোটেলের একপাশের লন থেকে দূরের পাহাড়ের গায়ে ইলোরার গুহা দেখা যাচ্ছে। খুব সকালে ইলোরায় ঢোকার প্ল্যান থাকলেও টিকিট কেটে ভিতরে যেতে যেতে দশটা বেজে গেল। এখানেও গুহার ক্রমাঙ্ক অবস্থান অনুযায়ী। যদিও এখন যে গেট দিয়ে ঢোকা বা বেরোন হয় তা ১৬ নম্বর গুহার সামনে। সেখানেই কৈলাশ মন্দির।
    ইলোরার গুহাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় কৈলাশ মন্দির। এ মন্দির সে অর্থে কোনও কিছু জুড়ে জুড়ে তৈরি নয়, বলা ভালো একটা আস্ত পাহাড়কে কুড়ে কুড়ে সম্পূর্ণ মন্দির কে বের করে আনা হয়েছে। 
    ৩২ মিটার উঁচু, ৭৮ মিটার দৈর্ঘ্য কৈলাশ মন্দিরের। রাষ্ট্রকূট রাজা কৃষ্ণের আমলে এই মন্দিরের কাজ শুরু হয় খ্রীস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে। গাইড জানালেন মন্দির সম্পূর্ণ হতে লেগেছিল প্রায় ২০০ বছর। পরপর কয়েক প্রজন্ম ধরে চলা এই নির্মাণযজ্ঞ একসুরে কাজ করে গেছে মূল নকশা অনুযায়ী। যখন ভাবি একটা ছেনি ও হাতুরির আঘাতের হেরফের ভুল করার সুযোগ ছিল না কখনও। সেই সময় থেকে আজ অবধি এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মনোলিথিক স্ট্রাকচার হয়ে দাঁড়িয়ে। 
     
     

    কৈলাশ : পিছনের পাহাড় থেকে তোলা

    মন্দিরটি রথের আকৃতির। অন্যান্য গুহাগুলির মতো এটি সামনে থেকে পিছনে পাথর কেটে এগিয়ে যাওয়া নয়।  পাহাড়ের মাথা থেকে বনজঙ্গল সাফ করে খুঁড়ে তার খনিজ স্তর পার করে মূল পাথর কুঁদে বানানো। কীভাবে নকশা তৈরি হয়েছিল, কী ভাবে নির্ধারিত হয়েছিল ওই বিরাট মন্দিরের বিভিন্ন অংশের মাপ — তখন অটোক্যাড তো দূরস্থান, সামান্য ক্যালকুলেটর অবধি নেই — তবে?

    এই ছবিটা বাবুইদি'র তোলা শিব-পার্বতীর বিবাহ, কৈলাশ মন্দির
     
     
    মূল মন্দিরের ভিতরের ছাতেও নানান নিখুঁত বুননের নকশা কাটা। অজন্তার ধাঁচে কিছু আঁকা ছবিও দেখা গেল তাতে। মন্দির টি তার পার্শ্ববর্তী পাহাড় থেকে আলাদা করে পথ করে দেয় দর্শনার্থীরা যাতে মন্দির প্রদক্ষিণ করতে পারেন। মন্দিরের বাইরে পাহাড়ের দেওয়াল কুঁদে বানানো আছে এক করিডোর যা আবার পাথরের স্তম্ভ দিয়ে ঘেরা। ভিতরের দেওয়ালের ভাস্কর্যে শিবঠাকুর সংক্রান্ত নানান গল্পের চিত্ররূপ। শিব- পার্বতী র বিয়ের ভাস্কর্যের ডিটেল সাংঘাতিক। 
    সব মিলিয়ে ৩৪ টি গুহা আছে ইলোরায়। গুহা নং ১ থেকে ১২ অবধি বৌদ্ধ গুহা। ১৩ নং থেকে ২৯ নং হিন্দু গুহা। গুহা নং ৩০ থেকে ৩৪ জৈন গুহা। বৌদ্ধ গুহাগুলির নির্মাণকাল মোটামুটি খ্রীস্টীয় ৫ম থেকে ৮ম শতাব্দী। হিন্দু গুহাগুলি নির্মিত ৭ম থেকে ১০ম শতাব্দীতে। জৈন গুহাগুলি অপেক্ষাকৃত নতুন — তৈরি হয়েছে ৯ম থেকে ১২শ শতাব্দীতে। অজন্তার সময়সারণী মাথায় রেখে বলা যায় — ঠিক যে সময়ে শিল্পীরা রঙ তুলি ছেড়ে ছেনি হাতুড়ি তুলে নিলেন তার ঠিক পরেই ইলোরার পত্তন। স্থানীয় শাসকের ও পুঁজির ভরকেন্দ্রের ধর্মীয় অবস্থান কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তাও এই গুহানির্মাণের সময়সারণী তে বিধৃত।
     

     বৌদ্ধ গুহার সামনে ঝর্ণা
     
    অজন্তার ২৬ নং গুহার সঙ্গে আশ্চর্য মিল ইলোরার ১০ নং গুহার। এটি ইলোরার বৌদ্ধ গুহার মধ্যে একমাত্র চৈত্য। এখানকার বাকী বৌদ্ধ গুহাগুলির সঙ্গে অজন্তার ভাস্কর্যবহুল গুহাগুলির মিলও প্রচুর। তারা প্রায় সমবয়স্ক। একটি চৈত্য বাদ দিলে বাকিগুলি বৌদ্ধ শ্রমণদের বাসস্থান বা বিহার। একটা তিনতলা স্কুলের মতো বৌদ্ধবিহারও দেখা যাবে এখানে। বলা বাহুল্য এটিও পাথর কুঁদে তৈরি, সামনে থেকে খুঁড়ে পিছনে এগিয়ে যাওয়া হয়েছে। মাঝে থামের আকৃতির পাহাড়ের অংশ রেখে দেওয়া হয়েছে অবলম্বণের জন্য।
     
     
    তিনতলা বৌদ্ধ বিহার, ইলোরা
     

    এ'দিন অবশ্য এর বেশি আর দেখা হ'ল না। খাওয়া দাওয়ার লাগাতার অনিয়মে পট্ট একটু কাবু। আমাদের হাতে আরেক দিন অতিরিক্ত সময় ছিল, বাকিদের পরের দিন খুব সকালে বেরোনর কথা। তাই কৈলাশ হোটেলেই দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা তিনজনে বিশ্রামে গেলাম, বাকিরা ফের গুহায় ফিরে গেল। 

    ৬, পঞ্চম দিন
    খুব সকালেই অয়নরা আর বাবুইদি-রা ইলোরা ছাড়ল। ঔরাঙ্গাবাদ থেকে ওদের ট্রেন সাড়ে ন'টায়, যাবে মুম্বাই। পট্ট একবেলার বিশ্রাম ও খাবারের পরিবর্তনে অনেকটাই ফিট। এদিন সকাল ন'টার কিছু পরেই আমরা তিনজন ইলোরার টিকিট কাউন্টারে।  জৈন গুহাগুলি মূল গেট থেকে অনেকটা দূরে। ব্যাটারিচালিত গাড়ি তিরিশ টাকার টিকিটে গেট থেকে চৌত্রিশ নম্বর গুহায় নামিয়ে দেয়, ওখানে পাশাপাশি চারটে গুহা দেখে বেরোলে ঘুরতে থাকা গাড়িতে উঠে নামা যায় উনত্রিশ নম্বরের সামনে, সেখান থেকে আবার ষোল নম্বরে ফিরে আসা যায় বা হেঁটে হেঁটে দেখা যায় মাঝের গুহাগুলি।

    জৈন গুহাগুলি বয়েসে নবীনতর বাকিদের চেয়ে। তাই এখানে দেখা গেল গুহার মধ্যেকার স্তম্ভে জাফরি কাটা কাজ। জৈন গুলির কাজ আরও সূক্ষ্মতর। 
     
    ৩২ নং গুহায় স্তম্ভের জাফরিকাটা কাজ

    ৩৪ নং গুহায় আছে পার্শ্বনাথের মূর্তি, তাকে ঘিরে যক্ষ ও যক্ষী। ৩৩ নং গুহা জগন্নাথ সভা। দোতলা, বারোটি পিলার দিয়ে বানানো। ভিতরের উল্লেখযোগ্য মূর্তি আছে মহাবীর ও পার্শ্বনাথের। 
    ৩২ নং গুহাটি সবচেয়ে বড়। দোতলা এই গুহাটি খুব সম্ভবত রাষ্টকূট রাজার শাসনকালে তৈরি। দোতলাটি প্রশস্ত ও জাফরিকাটা স্তম্ভ দিয়ে সাজানো। পুজো আচ্চার কাজ দোতলাতেই হ'ত বলে অনুমান করা যায়। সারা দেওয়ালের প্যানেলে জৈন দেবদেবীর মূর্তি আছে। মূল মূর্তিটি মহাবীরের।
    ৩৩ নং গুহায় পার্শ্বনাথ ও মহাবীর
     

    ৩১ নং গুহাটি অসম্পূর্ণ।  ছোট। চারটে স্তম্ভের মধ্যে পার্শ্বনাথের মূর্তি দেখা যায় যক্ষ ও যক্ষী র পাহারায়।
     

    ৩০ নং গুহাটি কৈলাশের আদলে বানানো। হিন্দু ও জৈন ধর্মমতের এক সমন্বয়ের চিহ্ন পাওয়া যায় এখানে। 
    ৩০ নং গুহা, কৈলাশের আদলে

    এখান থেকে ব্যাটারি গাড়িতে চড়ে পৌঁছন গেল ২৯ নং গুহায়। এটি হিন্দু গুহা। ভিতরে শিবের মূর্তি। বাইরের প্যানেলে গঙ্গা ও যমূনা মূর্তি দেখা যায়। যমূনার পাথরের মূর্তিতে ভেজা শাড়ির নিখুঁত পরিস্ফুটন বিস্ময়কর।  এই গুহা থেকে বেরিয়ে পায়ে চলা হাঁটা পিথে পৌঁছন যেত ফের ১৬ নং গুহার সামনে। তা আর দেখা হ’ল না।
    ইলোরায় দেখলাম একবার টিকিট কেটে বেশ খানিক্ষণ কাটানর পর। টিকিটের টোকেন গেটে জমা দিয়ে বাইরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে ফিরে আসা যায়। আগের দিন অয়নরা এমনই করেছিল। 
    ২৯ নং গুহা, পাথরের সিক্ত বসনে যমূনাদেবী

    তেমনই ফিরে এসে আমরা আরও একবার বৌদ্ধ গুহাগুলি ঘুরে দেখে কৈলাশ মন্দিরের পাশের পাহাড়ের মাথায় চড়লাম। ওই পাহাড়টি থেকেই কৈলাশ মন্দির কেটে বের করা হয়েছে। কে যে পরিকল্পনা করেছিল, কে যে এই নিঁখুত হিসেব করেছিল, কীভাবে তা শতাব্দী পেরিয়েও পরবর্তী অনেক প্রজন্মের কারিগরের কাছেও অক্ষুণ্ণ থাকল — এত বিস্ময়কর যে ভাবতে থাকলে পাগল পাগল লাগে। 
    ক্রমে সূর্যাস্ত হ'ল। কৈলাশ মন্দির সন্নিহিত পাহাড় থেকে নেমে ফিরলাম হোটেলে। 

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ১১ জানুয়ারি ২০২৪ | ৯৭৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যোষিতা | ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:১০527559
  • ফরিদাকে দেখতে কেমন এক্সপ্লোরার শিবাজির মত লাগল।
  • প্রশ্ন  | 165.225.***.*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:৩৬527560
  • কি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে? রিল ক্যামেরার কথা একবার উঠল মনে হল। ভেতরের ছবিগুলো, বিশেষ করে, অতি ভাল হয়েছে। 
  • hu | 2607:fb91:1748:c4d9:ac39:5ff7:affc:***:*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৪:২৪527563
  • লেখা এবং প্রতিটা ছবিই দারুণ হয়েছে। বিশেষ করে মহাপরিনির্বাণের ছবিতে আনন্দকে দেখে খুবই উৎফুল্ল হলাম। আমার মতে ঐ ভাস্কর্য এক অন্য মাত্রা পেয়েছে আনন্দের উপস্থিতিতে। লোকে এত ফুট লম্বা, এক পাথরের তৈরি এসব বলে। সেসব তো টেকনিকাল ব্যাপার। শিল্পীর জাত চেনা যায় আনন্দের গালে হাত দেওয়া শোকাহত ভঙ্গীতে।
  • Pad Gaon | 118.103.***.*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:২৮527565
  • অসাধারণ মানস ভ্রমণ হলো । অনেক ধন্যবাদ 
  • ফরিদা | ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৪৮527566
  • যোষিতা, 
    smiley
     
    "প্রশ্ন" র উত্তরে জানাই — আমার DSLR, ক্যানন। অজন্তায় গেটে বলল ওখানে রিল ক্যামেরা নিষিদ্ধ — ঠিক কী কারণে তা আর CRPF কে জিজ্ঞেস করে লাভ হ'ত না, তাই করিনি। 
     
    Hu 
    বাবুইদি ওই বইটা নিয়ে যাওয়ায় খুব সুবিধে হয়েছে। তোমার টই ধরে ধরে টিক দিয়ে গেছি আমরা। 
     
    Pad Gaon 
    স্বাগত। 
  • | ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪০527568
  • সিকিউরিটি ছড়িয়েছে। রিল ক্যামেরা নয় রিল করা (টিকটক বা ইনস্টা) নিষিদ্ধ। লোকে নেচে কুঁদে রিল বানাতে গিয়ে দেয়ালে হাত দিয়ে এবং আরো নানাভাবে ক্ষতি করে অন্যদেরও বিরক্তির চুড়ান্ত। 
  • সমরেশ মুখার্জী | ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:৩২527574
  • ২০১১ তে দেখেছি‌লাম অজন্তা‌য় গুহার অভ‍্যন্তরে আলোগুলো খুব কম। ফ্ল‍্যাশ দিয়ে বা ট্রাইপড লাগিয়ে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। আমার কাছে একটা ছ ইঞ্চি মিনি ট্রাইপড ছিল। তাতে Sony DSC H1 5MP Prosumer  ক‍্যামেরা‌টা ফিট করে Manual মোডে f4,  ISO 100 দিতে সম্ভবত 3 সেকেন্ড শাটার স্পীড নিয়ে ‌‌ছিল। ট্রাইপডটা পাথরের পিলারে সেট করে তুলেছিলাম ক‍্যামেরা শেক এ্যাভয়েড করতে। ট্রাইপড‌টা এতোই পুঁচকে ছিল যে সিকিউরিটি গার্ড বুঝতেই পারেনি আমি ট্রাইপড ব‍্যবহার করেছি। ভালো‌ই উঠেছিল। এক বিদেশি পর্যটকের বেশ মন খারাপ হয়ে গেল। বেচারা‌র কাছে ফ্ল‍্যাশ, ট্রাইপড ছিল, কিছুই‌ ব‍্যবহার করতে পারলো না।
  • এলেবেলে | ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:৫৯527575
  • সদ্য অজন্তা-ইলোরা ও অন্যান্য জায়গা ঘুরে আজই বাড়ি ফিরলাম। লেখা ও ছবি অনবদ্য হয়েছে। পরে আমার তোলা কয়েকটা ছবি এই টইতে চিপকে দেওয়ার ইচ্ছে রইল।
     
    সমরেশবাবুকে বলার, অজন্তার বিভিন্ন গুহায় ইদানীং সরকারি তরফে আলোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেই মৃদু আলোয় দিব্যি ছবি তোলা যায়। আমার ট্রাইপড লাগেনি। তবে ISO বাড়িয়ে কম অ্যাপারচারে ছবি নেহাত মন্দ আসেনি। এই বয়সে যে ইলোরার কৈলাসের চূড়ায় উঠে ছবি তুলতে পারব, সেটা ছবি না তোলা ইস্তক নিজের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।
     
    তবে খুলদাবাদে আওরঙ্গজেবের সমাধি দেখে স্রেফ হুব্বা হয়ে গেছি। ওই একটা ছবিই অনেক কথা বলতে সক্ষম।
  • kc | 37.39.***.*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:১৯527576
  • হুচি আমাদেরকে বারবার বলে দিয়েছিলো যেন অবশ্য অবশ্যই টর্চ নিয়ে যাই নয়তো সব বৃথা। ঔরঙ্গাবাদ গুহায় ঘুরছি, একেই পাহাড়ে চড়ে অস্থির রকম ক্লান্ত তারপর বেশিরভাগ গুহায় বিশেকরে ফার্স্ট ফেজে, খুবই বাজে গন্ধ, বর্ষা, বিশেষ কেউ নেইও। আমার আবার সাপখোপে হেব্বি ভয়, হ্যাঁচর প্যাঁচর করে ঢুকেছি, তথাগতের ডানগালে বিশ্রী আঘাত, মন খারাপ করে বেরিয়ে আসছি, ছেলে বলল টর্চটা জ্বেলে উল্টো দিকটা দেখো। সেদেখে মন খারাপ নিমেষে ভ্যানিশ।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন