আগের অংশ https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=17804
১ লা এপ্রিল
১
বিষাদ আজ কতদিন পরে আমরা একত্রে ক'দিন রয়েছি।
এতদিন সুখে ছিলে খুব? আজকাল প্রায়শই নিস্প্রভ থাক
আগে কি এমনই ছিলে? দু'বেলাই দেখা হ'ত খেতে বসে
পরস্পরের থালায় হাত দিয়ে খেলা শেষেও অনেকটা কথা
বেশি হ'লে জল দিয়ে রাখতাম। পরে তারই মৌতাতে বুঁদ -
মনে আছে তোমার? কথা খিদে, দু'বেলা ভান্ডার ভেঙেছি।
১১ এপ্রিল
১
কবিতার কাছে মনে হয় পৃথিবীর সব ঝড় ঝাপটা
কিছুটা থমকে দাঁড়ায়, রাস্তার কুকুর যেন চৌকাঠে
ইতস্ততঃ, ভাবছে উচিৎ নয় সীমানা পেরোনো।
পৃথিবী ঘুমোলে, কবিতাও নেমে আসে ধীর পায়ে
রাস্তায় একা একা ফের, দেখে গাছের দেওয়ালে পাখি
দেখে মাটিতে রোদ্দুরে পাতার আল্পনা, মাঝে মধ্যে
অদৃশ্য ছোট ছেলেমেয়ের মতো দমকা হাওয়ার ঝাঁক
অজস্র ফুলের সুগন্ধ নিয়ে ছূটে যায় ইতিউতি।
ঘুমন্ত পৃথিবীটি কবিতারই, সাধ করে পাওয়া বিচ্যুতি।
২
লকডাউনে বালক বালিকারা
ল্যাপটপের পাতায় ফুটে ওঠে
বহুদিন অদৃশ্য থাকা
আকাশের তারার মতো -
পলকে সময় পার
জুটমিলের ভোঁ রাত্রি পৌনে দশটায় বাজলে
লোডশেডিং হ'ত। মাদুর নিয়ে সোজা ছাতে গিয়ে
যাদের মুখোমুখি হতাম -
তারা ঠিক তেমনই রয়েছে -
এর ঘরে সকালের চা, ওর কাছে বিস্কুটের কৌটো
একে একে তারা সক্কলে ফোটে
সুগন্ধি বেলফুল সন্ধ্যায়, বালক বালিকারা
কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে ফের একত্র যেন নয়া পর্যটনে
ফোনে, ল্যাপটপে পৃথিবীর নানা কোণে সন্ধ্যাতারা শুকতারা -
এ লকডাউনে….
২৯ এপ্রিল
১
কাকে যে ডুগিতবলা বলি
কাকে বলি কাচের বাসন
কার কাছে নিভৃতি কুহক
কোথাকার অনৃতভাষণ
উড়ে যায় মেঘ জন্মভর
উড়ে যায় পীরিতি সকাল
কার ভয়ে পিছমোড়া বাঁচা –
কার চিঠি? কার ফোন?
কার ফের পুড়ল কপাল?
৩০ এপ্রিল
১
এ সবেরও শেষ হবে
বৈষম্য থাকবে, তাই চলাচলও
তারা এক রাস্তা পার করে
অন্য রাস্তায় হাঁটবে -
আগেরটাই যদি পিছলে পড়ার সমস্যা ছিল
অন্য রাস্তায় পাথরে হোঁচট খেতে হবে
তাও শেষ হবে একদিন।
খিদে মিটে গেলে ঘুমের সমস্যা আসবে
সেটা গেলে সকালের চায়ের নিশ্চয়তা
পাকা করার জন্য চেষ্টা করা যাবে
তারপরে দেখা হবে খবরের কাগজ
সবাই পড়তে পারছে কি না নিয়মিত।
কিছু ফুলগাছে জল দিয়ে বাবা বাছা বলে
ইস্কুল পাঠিয়ে শেখাতেও হবে
যাতে তারাই বাদবাকি গাছের জন্য নিয়মিত
জলের সংস্থান করতে পারে।
তারপরে অন্য কাজে আশ্রয় পাওয়া যাবে।
যখন সবই থেমে আছে মনে হয়
জেনো, অন্তত রক্ত-চলাচল জারী থাকবে।
৩ রা মে ২০২০
২
কাউকে স্পষ্ট করে মনে পড়ে না
কয়েক মুহূর্ত বিদ্যুতচমকের মতো
এসেই মিলিয়ে গেল -
কলতলায় অজান্তে জল আসে সময়ের কিছু আগে
বসানো পাত্র একলাই উপছিয়ে জলের রেখাটি
আঁকাবাঁকা আনাড়ি পথে নেমে গেছে অসীম নর্দমায়।
অথবা পাহাড়ের পাকদন্ডী পথ বেয়ে
ধোঁয়া ওঠা বাড়ি থেকে উঠে আসে ইউনিফর্ম পরা মেঘ।
যাও ঋনশোধ কর, যদি পার,
ভেঙে দাও স্মৃতি ষড়যন্ত্র একে একে -
কাউকে স্পষ্ট মনে পড়ে না
যতটা তুমি দেখ, সে তোমাকে ততটুকু দেখে।
৪ ঠা মে
১
সবাই দুর্বোধ্য বলে -
আমি নাকি নদীকে পাখি, পাখিকে ইঁদুর আর -
ইঁদুরকে অষ্টআশি বলি।
বিস্কুটকে কালোজিরে বলতেও শুনেছে অনেকে
এই অনেককে আমি চিনি দই চিঁড়ে হিসেবে
যারা আমায় দেখার আগে চোখে দাঁড়িপাল্লা পরে নেয়।
১৩ ই মে
১
মাঝে মাঝে নষ্ট ভালোবাসাদের ছাইগাদা ঘুরে আসি
দেখি চিঠিপত্তর, পাখির ঝুটো বাসা শুকনো ডাল
দেওয়ালের পলেস্তারা খসা ইঁট বের করা হাঁ
তাকিয়েই রয়েছে - বলছে খাবি না? খা..
আমি তার তেষ্টার জল পারি না যোগাতে
শুধু এক মুণ্ডমাত্র, যতটুকু জল যাবে
ততখানি রক্ত ঘিলু মজ্জা মিশ্রিত
থ্যাকথ্যাকে পদার্থ বিয়োবে নিমেষে
তাড়া করে আসবে কীটপতঙ্গ দল
সুচতুর আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষারত শিকারীর মতো
নিঃশব্দে অথচ দ্রুতপদে।
তবু তার কাছে ফিরে আসতেই হয়েছে আমাকে
অন্তত রাতের আশ্রয়ে যারা প্রতিদিন পৌঁছয়
অনেকেই তাদের মধ্যে জিরোতেই আসে -
অভ্যাসবশত কুকুরের মতো মাথা হেঁট করে
তালা খোলে, আলো জ্বালে, জল ভরে
অন্ধকারে ভদ্র টিউকল থেকে -
আর কেউ নয় -
অনেকেরই নষ্ট ভালোবাসার কবন্ধ থাকে অপেক্ষায়।
২
সারাদিনে এক আঁজলা ভালোবাসা না জুটলেও সারা দিনে
তিনবেলা খিদে পায়, মিনিটে আঠেরো কুড়িবার বাতাস
মশা কামড়াতে শুরু করলেই হাত ওঠে হত্যার আকাঙ্ক্ষায়।
হকের পাওনা চাইলে লোকে বলে অর্থপিশাচ (মৃদুস্বরে)।
তাগাদায় জোর দিলে খসখসে কাগজের মখমল স্পর্শে
মুদি দোকানের নন্দীবাবু, বাড়িওলা সান্যালমশাই
কত সজ্জন ভদ্রলোক হয়ে যান, ফুরফুরে হাওয়া বারান্দায়
বিড়িটিও দুর্দান্ত জ্বলে রেল সিগন্যালের মতো -
থেমে যাও হে মৃত্যু আরও একদিন বেঁচে গেছি আমি
স্নেহ ভালোবাসা ভালো, নেমন্তন্ন এলে তবে গায়ে মাখি
পরিবারের তিনবেলা ভরা পেট বিড়ির আগুনের মতো দামী।
৩
আজ কিছু বলতে এসেছি
আজ আমি জলের বিষয়ে কিছু বলতে এসেছি -
জানেন, রাস্তায় আসার পথে আজ খুব কাদা ছিল
যখন ছোটবেলায় ইস্কুলে যেতাম তিন মাইল উজিয়ে
বেশির ভাগ দিনই কাদা থাকত, নয়ত একহাঁটু ধুলো
সব বই ছিঁড়ে যেত, পোশাক নষ্ট, অসুখেও ভুগতাম খুব,
কিন্তু সে সব নয়, আমি আজ বলতে এসেছি
মাস্টারমশাইরা কী সুন্দর পড়াতেন তখন
চারের ঘরের নামতা মাত্র ছ'মাসে শিখে গেছিলাম সবাই
বিশু তার মধ্যেই ধান রোয়া শিখে ফসল কেটে ফেলল
ধুলো- ধুসারিত রাস্তা জল কাদা ডিঙিয়ে পুজোর ছুটি।
ছুটিতে সেবার আবার কলকাতা হয়ে শ্রীক্ষেত্র পুরীধাম যাব।
বেড়ানর কথা, যা আমি বলছিলাম - রেলে তখন
যা সব লটবহর নিয়ে চড়তে হ'ত, বেড়াতে যাওয়া না হাতি।
হাতি অবশ্য পুরীতে নয়, চিড়িয়াখানাতেই প্রথম দেখি
পায়ে মোটা লোহার শেকল, যদি ছিঁড়ে ফেলে -
কতরাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি -
তাই আমি আবারও বলছি, যাবতীয় দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচতে
নিয়মিত বীমার প্রিমিয়াম টুকু দিয়ে যান -
বাকিটুকু আমরাই দেখে নেব।
২১শে মে
১
ঝড়ের পরদিন সকাল সকাল উঠে
বারাব্দায় দোকান খুলব ফের
সকালের রোদ্দুর অল্প ঝুঁকে দরদস্তুর করবে
কিন্তু বেশিক্ষণ না, তাড়া আছে তার
অল্প হাওয়ারা এ ওর গায়ে ঠেস দিয়ে
দোকানের মালপত্তর দেখে ফিসফিস কথা বলে
হেসে গড়িয়ে পড়বে – আমাকে অপ্রস্তুত রেখে।
কয়েকটা অফিস টাইমের শালিখ
ফেরিওলা পায়রা যাতায়াতের ফাঁকে
দোকানে রাখা খবরের কাগজে তাকিয়ে
হেডলাইনটা চট করে দেখে চলে যাবে।
বিক্রিবাটা নেই, দোকান দেওয়ার নেশা
যদি তার মনে পড়ে, একদিন পথেই বসাবে।
২৩ শে মে
১
কালও অশান্তি হয়েছিল
ব্যাপার বড় কিছু নয় -
বাইরের ঘরের আলো কে নেভাবে
তাই নিয়ে চাপান উতোরে
পরস্পরের পরিবার ধরে টানাটানি -
লাগোয়া ঘর, আমরা জানি
কেউ কাউকে সহ্য করত না ইদানীং
দেখা হ'লে শুকনো হাসতেন ভদ্রলোক
কিছু বলতেন না, জিজ্ঞেসও করতাম না।
করা যায়?
মহিলাও বুঝতে দিতেন না, বাচ্চাদের পড়াতেন
এঁচোড়ের ডালনাও পাঠালেন গেল হপ্তায়
আমার তিনি পছন্দ করেন কি না,
গেলবার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে নাটক করালেন
ছোটদের নিয়ে "রোগের চিকিৎসা" -
আমরা হাসতে হাসতে মরি…
দেখুন তো, কী থেকে কি হয়ে গেল
কপাল মশাই কপাল - কে জানত
এত শিক্ষিত মানুষ, বড় চাকরি, ছেলেরা বিদেশে
এখন তো ঝাড়া হাত-পা
সিনেমা থিয়েটার দেখে ভালো মন্দ খেয়ে
ঘুরে বেড়ানর সময় -
পৃথিবীর এখন কি ঝগড়াঝাঁটি লকডাউন মানায়?
২
বিপদ আপদে কাজে লাগবে বলে
দাদু মৃত্যুশয্যায় আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন
কাগজে মোড়া কয়েকটা লোহার বিস্কুট।
অনেক ছোট তখন আমি - বুঝিনি
তাও রেখে দিয়েছিলাম। সঙ্গেই ছিল -
বিপদ আপদের জন্য ঠিক নয়,
দাদুর স্মৃতিচিহ্ন হয়ে।
গেল দু'মাস অফিস যাইনি, বাড়ি থেকে কাজ
নিশ্চিন্তে ঘুম হয়না বহুদিন, ভালো মন্দ খেয়ে
নিজেকে চাঙ্গা রাখি বটে, তাতে লজ্জাও করে
তদুপরি মারাত্মক ঝড়ে প্রিয় সুন্দরবন মায়
ডিহি কলকাতা তছনছ, লণ্ডভণ্ড।
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে চুপি চুপি স্টোর রুমে
এসে সেই পাঁপড়ভাজা কাগজে মোড়া
লোহার বিস্কুটগুলি নিজে থেকে কথা বলে ওঠে -
যত নিকষই হোক রাত্রি,
যতই বিরক্তিকর লম্বা হয় দিন। জেনো,
রোদ্দুরে সবুজ পাতা যদি ছাতা দেয়
তখনই কোথাও না কোথাও নিশ্চয় ফুল ফোটে।
২৯ শে মে
১
ভাবি লিখেই ফেলি দু'কথা বনের মধ্যে,
যদিও সপত্র একটিই, চারপাশে দেওয়াল
আর অনেকটা আকাশ বড় উঁচুতে।
লিখে ফেলি ইস্কুলে পড়তে
ক্লাসে অন্যমনস্ক হয়ে গার্জেন কল হয়েছিল
আচমকা চটুল গানের লাইন ঠোঁটে এসেছিল
টিফিন টাইমে করিডোরে,
পিছন থেকে কানে মোচড় দিলেন প্রত্যুষবাবু
প্রথমেই মনে হয়েছিল, সুর লাগেনি কি ঠিকঠাক?
ভাবি লিখে ফেলি, তোমার মুখ দেখে
পরজন্মে বিশ্বাস করা শুরু করেছিলাম।
জুনের প্রথম দিন ফোন করতেই
একরাশ অভিমান - কাল সবাই ফোন করেছিল
এই দাদা ওই দিদি ওই মামা - আরও কত নাম।
"ঠোঁট পুড়ে গিয়েছিল মোমবাতিটায়" -
ভাবি লিখে ফেলি - বলেছিলাম।
৩১শে মে
১
ডেকচিতে দুধ চাপিয়ে অ্যালবাম খুলে বসি
কী অবাস্তব সব কাণ্ডকারখানা ছিল আমাদের
বাসের সবচেয়ে পিছনের আগের সীট দু'জনের
ওটা খালি না পেলে টার্মিনাসে পরের বাসটা..
একটু চা পেলে বেশ হ'ত ভেবে চোখদুটো
ডেকচিতে রেখে মাইক্রোওয়েভে এক কাপ জল
পরে তাতে টী-ব্যাগ ভিজিয়ে দিলেই -
প্রথম চিঠি পাওয়া সেই সেই গ্রীষ্ম বিকেল আসে।
সেবার পুজোতেই প্রথম গান শুনেছিলাম একা।
দুধ বসালে প্রথমদিকে উথলোতে চায় -
পরে সয়ে এলে নিজে নিজে ফুটে গাঢ় হয়
তখন সে উথলোবে না, তবু চোখ আর
কিছুতে সরে না।
অল্প ভেজান গোবিন্দভোগ ঘিয়ে নেড়ে নিই
পাশের বার্নারে, সেটা আর আলাদা রাখি না
ঢেলে দিই ফুটন্ত দুধে - বিয়ের ঠিক আগে আগে
কী ভীষণ মনখারাপ করত তোর।
বিয়ের পরে অত বড় খাঁ খাঁ বাড়িতে দু'জনে
এককোণে পড়ে থাকতাম, বেয়াক্কেলে প্রতিবেশি
ভাইবোন ভেবেছিল। বন্ধুরাও আসত কত।
ক্রমে চাল সেদ্ধ হয়ে বাড়ে আর দুধ কমে
আরও ঘন হয়ে ওঠে। কাজু কিশমিশ নিয়ে
সেই চাল ভাজা ফ্রাইপ্যানে অল্প ঘিয়ে নাড়িচাড়ি।
কিশমিশ অল্প রং বদলালে গ্যাস বন্ধ করে
ওখানেই রেখে দিই ওদের।
দুধ চাল আরও কাছাকাছি এসেছে এতক্ষণে
ভাবি তোর হাতের ব্যথা কমে যাক
সামান্য কারণে বড়ই উতলা হোস -
আমি কেন এত ভুল করে ফেলি বারবার -
বলি আর একটু ধৈর্য্য হোক -
আরও বেশিক্ষণ খুশি থাক -
তোর যা করতে ভালো লাগে তা নিয়েই।
অনেকটা হয়ে এসেছে এতক্ষণে দুধ আর চালটা
গুড় বের করে আনি ফ্রিজ থেকে
সামান্য দুধ তুলে তাতে গুড় মেশাই অন্য বাটিতে
দু'লিটার দুধ এখন অর্ধেকেরও কম।
আধ কাপ চিনি মিশিয়ে কিছুক্ষণ পরে
গ্যাস বন্ধ করে দিই, তাতে কাজু কিশমিশ দিয়ে
ডেকচি নামিয়ে আনি। দু-মিনিট অপেক্ষা করে
গুড় মেশাতেই সে যেন নতুন পোশাকে
ঝলমলে সেজে ওঠে - ডাইনিং টেবিলে রাখি
পাখা ফুল স্পীডে চালিয়ে ঝুড়ি চাপা দিয়ে
ঠান্ডা হতে। বারান্দায় এলে দেখি
সকাল বড়ই রঙিন।
ঘুমিয়ে আছিস - উঠলেই আলো ঝলমলে -
শুভ জন্মদিন।
দ্বিতীয় ও আপাতত শেষ পর্ব দিয়ে দিলাম।
ভালো থাকুন সব্বাই...।
বাহ খুব ভা! শেষ্টার জন্যে হাত্তালি !!
অদ্ভুত লেখা...