গাড়িটা কাশছিল। রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে হাঁ করালাম। সবই সাফসুতরো, জিজ্ঞেস করতে বলল - কাল রাতে গরম লাগছিল বলে গ্যারেজের দরজা খুলে দিয়েছিল। খুব রাগ হ’ল প্রথমে। এত টাকা দিয়ে “বন্ধু” সিরিজের গাড়ি কেনার মানে কি? হ্যাঁ, গাড়ি আজকাল অনেক বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। একবার গাড়িতে চড়ে বললেই হ’ল কোথায় যেতে চাই – নিজে নিজেই চলে যাবে, কোন রাস্তায় কতটা জ্যাম সেসব নিজেই বুঝে নেয়। সে ঠিক আছে। কিন্তু এই নতুন “বন্ধু” সিরিজ দাবি করেছিল – এ নাকি মানুষের মতো অনুভূতি সম্পন্নও বটে। তার হ্যাপা এখন সামলাও।
ঋতু বদলাচ্ছে। এ সময়ে হুটহাট ঠান্ডা লাগানর কোনও মানে হয়? সিকি শতাব্দী আগেই করোনা নিয়ে পৃথিবী জেরবার হয়ে গেছিল। প্রাণহানি তো ছিলই, কিন্তু তার থেকেও কী সাঙ্ঘাতিক ছিল সেই মন্দা। লোকের কাজ নেই, অবসাদে ডুবে যাচ্ছে, কথায় কথায় রেগে উঠছে, দেশে দেশে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা – সে এক বিতিকিচ্ছিরি দিন। কিন্তু তার মূলে ছিল ওই হাঁচি-কাশির মতো নিরীহ উপসর্গ। পঁচিশ বছর পরেও যে কেউ একটু গলা খাঁকরানি দিলেও আতঙ্ক মনে হয়। যদিও পৃথিবী তখন যে দিকে যাচ্ছিল ওই ঘটনার পর থেকেই সামলে গেল, না হ’লে এতদিনে একজনও বেঁচে থাকত না।
অনেকদিন পরে এভাবে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমেছি। বাতাস অনেক ঠান্ডা হয়েছে বটে। সময় হয় না কারোর, নয়ত এই হালকা ঠান্ডা আর ঝকঝকে রোদ্দুরের দিনে এই একটা সাধারণ রাস্তার ধারে কী ভাল লাগে। গাড়ি চলাচলের রাস্তার দু-পাশে বড় বড় গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে গোল গোল রোদ্দুরে ছুটে যাওয়া গাড়ির পিছু পিছু খসে পড়া পাতারা কিছুদূর দৌড়ে থেমে যায়। বড় গাছের সারির পিছনে কিছুটা ঘাসজমি সেখানে তো ফুলগাছের ঝোপে রঙের ছয়লাপ আর তারপরেই জলাভূমি।
দেখছিলাম সেই পাতাদের ওড়উড়ি, বুনোফুলে প্রজাপতিদের খেলা, জলে বাতাসের তোলা হালকা হালকা ঢেউ – যাতে মনে হয় মেঘের ছায়াতে সুড়সুড়ি লাগে। তখনই খুব আস্তে গাড়িটা বলল – এখন অনেকটা সুস্থ লাগছে। আমি ডেটা চেক করে ওষুধ নিয়ে নিয়েছি। একটু ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতেও বলল, আমার খেয়ালের জন্য আজ দেরি হয়ে গেল। নতুন গাড়ি, তায় বুদ্ধিসুদ্ধি সমেত। বিরক্ত হয়েছিলাম বলে খারাপই লাগল। যদিও কিছু বলিনি, তবু আমার জিনকোড কেনার সময়েই ওর ন্যানোপ্রসেসরে দেওয়া আছে বলে আমি যা যা ভাবছি তার অনেকটাই ওর জানা। যাতে খুব সামান্য উচ্চারণেই ও ধরে নিতে পারে আমার কথাটা। কী ভাবল কে জানে? বললাম – কিছু মনে কোরো না, রাস্তার পাশে থামার জন্য আগে বিরক্ত হলেও এখন অনেক তরতাজা লাগছে। আমাকে অবাক করে সে বলল – সে আমি জানি, আমি ত আর নির্দেশ দিতে পারি না, তাই যাতে দাঁড়াতে হয়, সেই বুঝে কাশছিলাম। চমকে হলাম। এই ক’দিনে কাজকর্ম নিয়ে এত ঘেঁটে আছি। এক লক্ষ কাস্টমারের জিনকোডে ডেটা আপডেট করে রিপোর্ট বানাতে হবে একটা চালু পিপারমেন্টের নয়া প্যাকেটের রঙ কী হবে। নয়া সীমানাহীন পৃথিবীতে সবাই যে যার কাজের সুবিধামতো ক্যাপসুলে থাকে। পৃথিবীর তিন প্রান্তে আমার বউ, ছেলে আর আমি থাকি – প্রয়োজনে ছ’ঘন্টার মধ্যেই যে কেউ যে কোনও জায়গায় পৌঁছতে পারে যদিও। আমাদের সবার ক্যাপসুলেই সারাক্ষণ দেওয়ালজোড়া থ্রি ডি স্ক্রীন অন করা থাকে। ছেলের কুকিং সিস্টেমে ঢুকে ওর জন্য রান্নাও করে দিতে পারি – তবু কী একটা যেন নেই নেই অভাববোধ পীড়িত করে। এই গাড়িটা সে সব বুঝল। আশ্চর্য!
আসলে ওইখানে ওই ঘাস, প্রজাপতি আর গাছের ঝরা পাতা উড়ে যাওয়া দেখে খুব মনে পড়ছিল সেই কতদিন আগে আমরা বান্ধবগড় অভয়ারণ্যে গিয়েছিলাম। তখন সব যান্ত্রিক গাড়ি। তাও জঙ্গলে যাওয়ার আলাদা ট্রেনিংপাওয়া ড্রাইভার। এই রকমই শিরশিরে হাওয়া লাগছিল খোলা গাড়িতে ক্যামেরা তাক করে। তখন ক্যামেরাও দৃশ্য দেখে ফোকাস করে শাটার মারলে তবে ছবি উঠত। সঙ্গে সঙ্গে রেশমী আর সাম্পানকে ধরলাম ফোনে। রেশমীর ওখানে তখন রাত, বেচারি ঘুমিয়েছে সবে আর সাম্পান ল্যাবে বেরোবে। রেশমী তো অসময়ের ফোন দেখেই চেঁচামেচি শুরু করল – বিপদ আপদের আশংকায়। একটু সামলে নিয়ে বলতেই ওরা দেখলাম রাজি হ’ল। আমারই জন্য এই একসঙ্গে দেখা হওয়াটা আমাদের কমে গেছে। সাম্পানের ল্যাবে অনেক ছুটিছাটা। আর রেশমীর দলে এত ভাল ভাল রিসোর্স, চাপ কম।
কথা হ’ল, আর বারো ঘন্টার মধ্যেই আমরা দেখা করছি টাবো মনাস্ট্রির পিছনের হেলিপ্যাডে।
যতই সীমানাহীন হোক না পৃথিবী। যতই মানবকল্যাণমুখী হোক না সে যাবতীয় সামরিক খরচ মানুষের দরকারে খরচ করে – এখনও ছুটির দিনগুলো ঝটপট ফুরোয়।
আমাদের তিনদিনের ছুটি আপেল বাগানের ধারে মনাস্ট্রির ধারে যেন এক লহমায় ফুরিয়ে গেল। সেই দু-হাজার আট সালে এসেছিলাম – ভার্চুয়াল স্ক্রীনে সেই দলের সব কটাকেই ডেকেছিলাম। এসেওছিল সবাই – আফশোস করছিল আগে থেকে জানালে ওরাও সশরীরে আসতে পারত। বললাম আমাদের প্ল্যানও চটজলদি হয়েছিল। কথা হল ফের একবার প্ল্যান করে বেরোতে হবে।
তিনদিনের ছুটি কাটিয়ে অফিস যেতে ভালোই লাগছিল। আবার কাশির শব্দ। রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে হাঁ করালাম গাড়িটাকে। সবই সাফসুতরো। কী হ’ল, এমন রসিকতার মানে কী – যখন ভাবছি। তখনই গাড়িটা বলে উঠল – কিছু মনে করবেন না, এই ক’দিনে আপনার অফিসের কাজ অনেকটাই সড়গড় হয়ে গেছে আমার। যে কাজটার রিপোর্ট আপনার কাল জমা দেওয়ার কথা সেটা গতকালই দিয়ে দিয়েছি। না, চিন্তা করবেন না, ওটা ফুলপ্রুফ। আমাদের আসল ভাষা তো যান্ত্রিক, তাই ওতে ভুল নেই। ভাবছিলাম – কতদিন কিছু লেখেন না আপনি। যারা লিখতে পারে তারা এইসব যান্ত্রিক কাজকর্ম করলে খারাপ লাগে না, বলুন? কতদিন একটা ভালো কবিতা লেখেন নি বলুন? আপনার অফিস সামলে নিচ্ছি আমি। চিন্তা নেই, মাইনে টাইনে আপনারই থাকবে। আপনি লিখুন – কতদিন নতুন লেখা পড়ি নি আমি। লিখবেন না?
আমার সামনে সেই রাস্তা জোড়া গোল গোল রোদ্দুরে ঝরা পাতারা চলন্ত গাড়ির হাওয়ায় দৌড়োদৌড়ি করছে, গাছের সারির পিছনে কিছুটা ঘাসজমি, সেখানে ফুলের ঝোপ রঙে ছয়লাপ। প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে – আমি লিখছিলাম।
গাড়িটা চলে গেল।
একজন প্রকৃত কবি যখন গদ্য লেখে ------!
ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিতে বলেছে, তাই দিয়েই দিলাম| দিব্য লাগল
রঞ্জন দা ও রেশমী কে অনেক ধন্যবাদ।
চমৎকার লাগল,বিশেষ করে শেষ টা।
স্ফটিক স্বচ্ছ ভাষা...কবিতার গাড়ি চড়ে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে একবার দেখে আসা যায়। যান্ত্রিক দুনিয়ায় মধ্যেও এক ঝলক তাজা বাতাসের আশ্বাস পেয়ে মন ভরে গেল।
কবির গদ্য অসাধারণ লাগল। আরও পড়ার আশায় থাকব।
সৌম্য
কুমু দি,
অনেক ধন্যবাদ। ভরসা পেলাম।
সৌম্য দা,
খুব ভাল লাগছে তোমায় এখানে দেখে। গুরুতে স্বাগত জানাই তোমায়। তোমার লেখা এখানে দেখতে পেলে খুবই খুশি হব।
কবি মানে তো সত্যদ্রষ্টা। সুমন মান্না প্রথমতঃ কবি। তাই বোধহয় সামনেটা দেখতে পাচ্ছেন।
মৈত্রী দিদি,
কী যে বলি তোমায়...!!
এখানে এবার থেকে নিয়মিত এসো, এখানে দারুণ সব লেখাপত্তর আছে।
আর লিখতে থাকলে তো কথাই নেই...
লেখাটা ভালো লাগলো ,তবে লেখকের কবিতার মতো ইমপ্যাক্ট পেলাম না , তা সে ঠিক আছে
একটা শব্দ চোখে লাগল , "পিপারমেন্ট" , ওটা বোধহয় পেপারমিন্ট হবে (এক যদি না ইচ্ছাকৃত হয় )
আসলে সুমনের সেই গান টা শোনার পর থেকে এটা মাথায় গেঁথে গেছে :)
'সত্যদ্রষ্টা' হতে চাইলে কবিতা ফুরিয়ে যায়। কবিতা মায়াবী। কবিতা 'সত্য' হতে চাইলে হয়তো কোথাও পৌঁছোবে না। আমরা তো খণ্ডসত্যের জগতে বাঁচি। দুহাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁতে চাওয়া আমাদের 'অবসরের গান'। ঐ পাড়াগাঁর ভাঁড়দের হাড় নিয়ে বাঁচা। যুবরাজ হতে চাওয়া কি আমাদের সাজে? :-)
লেখাটা সুমনের মতো'ই সৎ, তৃপ্ত, সংহত।
অল্প শব্দের মাধ্যমে কাজের মধ্যে জীবন জীবনের মাঝে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার হদিস পেলাম ...
কাব্যিক রোমান্টিসিজম আর সরল জীবনদর্শনের মায়াবী মেলবন্ধন -বেশ ভালো লাগলো
anandB,
আমি "পিপারমেন্ট" ই বলি, তাই ওই ব্যবহার।
আর লেখা প্রকাশের পর তার মূল্যায়ন শুধুই পাঠকের ব্যাক্তিগত, তাতে কিছু বলি না তাই
শিবাংশু দা,
তোমার উচ্চারিত কথাগুলো বড় ভরসার জায়গা।অসময়ের সঞ্চয় বলে তুলে রাখি।
Oirabot,
এ পাতায় তোমাকে দেখাটাই বিরাট প্রাপ্তি। "ভালো লাগা" র অংশটা পুজো বোনাস হিসেবে নিলাম।
গুরুর পাতায় তোমার বিচরণ আরও নিয়মিত, স্বচ্ছন্দ ও সুখপ্রদ হোক, তাই চাইব...