সাউন্ডটা আরো বেড়েছে! তবে সে কি টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দেয়ার জন্য, না কি, সিনেমার শব্দনিয়ন্ত্রণ কৌশলের কারণে - মানে, যখন নয়ন মনোহর নৃত্য-গীতের দৃশ্য থাকবে, তখন স্বাভাবিকের চেয়েও তেতে উঠবে - পাশের ঘরে অবস্থান করায় দীপের পক্ষে রহস্যটি ভেদ করা সম্ভব হল না ! যদিও পর্দার ভেতর থেকে ধেয়ে আসা সেই শব্দতরঙ্গ তার পুরো ঘরটিতেই ঘূর্ণি তুলতে লাগল! কিন্তু এটা কী করে সম্ভব যে, একজন সত্তরোর্ধ্ব মানুষ ধ্যানমগ্ন হয়ে রয়েছেন সেই পর্দাতেই!
এই নিয়ে তিনবার প্যারাটা পড়ল দীপ, কিন্তু আগেরবারগুলোর মত এবারও শব্দগুলো তার মাথার উপর শুধু গাড়ি হাঁকিয়ে গেল, কোন ন্যূনতম বার্তা সৃষ্টি না করে! অফিস থেকে ফিরেই সে ল্যাপটপে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশান নিয়ে বসে গিয়েছিল - এক নতুন ক্যান্ডিডেইট ইতিমধ্যে চমক সৃষ্টি করেছেন নতুন সব কথা বলে। কিন্তু পাশের রুমেই বাবার হাই ভলিউমের সিনেমা-ভোগ সেই কথাগুলোকে স্ট্যাচু বানিয়ে ফেলেছিল! আচ্ছা, একজন মানুষ যার এক পা পড়ে রয়েছে কবরে, তার তো জায়নামাজ আর তসবিহ নিয়ে পড়ে থাকার কথা, তাই না!
একটা সময় অবশ্য দীপ প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেইটের ভাষণটার অর্ধেকটা পর্যন্ত চলে এল হাইলাইট আর নোট করতে করতে। তবে সে ড্রইয়িং রুমের শব্দতরঙ্গের তেজ কমে আসার জন্য, না কি তার মস্তিষ্কের শব্দ-শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে, তা নিয়ে দীপ হয়ত কিছুক্ষণ ভাবতে পারত; কিন্তু তার আগেই গলা, ঘাড়, হাত, পা, মানে, শরীরের যে জায়গাগুলি পোশাকবিহীন ছিল, সেখানে একটা কুট কুট আভাস অনুভব করল। কী মনে পড়তেই, সে ড্রইয়িং রুমে ছুটে গেল, আর তা-ই দেখতে পেল, যা অনুমান করেছিল –জানালাটা হাট করে খোলা!
এর আগেও একদিন সে বাবাকে বলেছিল, মশাগুলোর শীত উৎসবের সময় জানালা খুলে তাদের আমন্ত্রণ না জানাতে। কিন্তু বাবার শুধু সিনেমা হলে চলবে না, বাইরের খোলা বাতাসও লাগবে, আর তাতে অন্যদের কী হচ্ছে, তা নিয়ে ভাববার একদমই দরকার নেই! এই বয়সেও মানুষ কী করে এতটা আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে!
এক বছর পর। দীপ আবার ল্যাপটপে বসেছে, তবে এবার আইসল্যান্ডের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে। কিন্ত এ নিয়ে তিনবার পড়েও সে শব্দগুলোর মধ্যে ঢুকতে ব্যর্থ হল। অথচ পাশের ড্রইয়িংটিতে কোন শব্দতরঙ্গের লেশমাত্র নেই। এমনকি জানালাটাও হাট করে খোলা নেই যে কীটের আক্রমণ তার মনসংযোগে বিঘ্ন ঘটবে।
সেই শব্দহীন, কীটহীন সময়টা যতই গড়াতে লাগল, দীপের মনে হতে লাগল, একটা খুব গভীর করে খোঁড়া কবরে তলিয়ে যাচ্ছে সে!
(সমাপ্ত)
………………………………………………………………………
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।