এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নীরবতা কি নিরপেক্ষ? মৌলবাদ ও আমাদের নৈতিক দায় । অয়ন মুখোপাধ্যায়।

    Ayan Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১১১ বার পঠিত
  • নীরবতা কি নিরপেক্ষ? মৌলবাদ ও আমাদের নৈতিক দায়।
    অয়ন মুখোপাধ্যায়
     
     
    আমি অনেকদিন ধরেই একটা অস্বস্তি বয়ে বেড়াচ্ছি। এবং কথা বলতে গিয়ে বারবার নিজেকে সংযত করতে হচ্ছে। কখনো কখনো মস্তিষ্কের মধ্যে একটাই ভাবনা চলে শব্দ বেছে বলতে হবে, বাক্য নরম করে বলতে হবে—যেন একটু বেশি স্পষ্ট হলেই কেউ আঘাত পেয়ে যাবে। 
     
    কিন্তু আজ মনে হয়, এই সংযমটাই আমাদের সময়ের সবচাইতে বড় সমস্যা। কারণ যে বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে নরম ভাষা আর সাবধানী উচ্চারণ আসলে সত্যকে ঢেকে রাখার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
     
     
    আমরা এখনও বলতে ভালোবাসি—“সন্ত্রাসবাদের কোনও ধর্ম নেই।” কথাটা নৈতিকভাবে ঠিক, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় অসম্পূর্ণ। কারণ আজকের পৃথিবীতে যে সন্ত্রাসবাদ সবচেয়ে সংগঠিত, সবচেয়ে আদর্শগত ভাবে কঠোর এবং সহিংসতাকে ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়—তার একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শিক কাঠামো আছে। তাকে কেবল “কিছু বিচ্ছিন্ন উন্মাদ লোকের কাজ” বলে এড়িয়ে যাওয়া মানে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। আমি আর সেই ভান করতে পারি না।
     
    আমাকে সবচেয়ে ভয় লাগে সেই জায়গাটায়, যেখানে খুন আর পাপ থাকে না—খুন হয়ে ওঠে পুণ্য। যেখানে বলা হয়, “ঈশ্বর চেয়েছেন।” এই যুক্তির সামনে সাধারণ নৈতিকতা ভেঙে পড়ে। কারণ তখন আর মানুষ মানুষকে মারছে না সেখানে ধারণা বিবর্তিত হয় এবং মানুষের কাছে এই ভাবনা পৌছয় মানুষ মারা একটা মিশন আর সেই ‘মিশন’ এখন সম্পন্ন হচ্ছে। আর যে সমাজ এই যুক্তিকে প্রশ্রয় দেয়, সে সমাজ ধীরে ধীরে নিজেই  নিজের কবর খোঁড়ে। আর তখন প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়, সন্দেহ করা অপরাধ হয়, আর মানবিকতা হয়ে ওঠে বিলাসিতা।
     
     আমি দেখেছি—মৌলবাদ কখনও হঠাৎ রক্ত নিয়ে আসে না। সে আসে ভাষার ভেতর দিয়ে। প্রথমে কিছু শব্দ নিষিদ্ধ হয়, কিছু প্রশ্ন ‘অশোভন’ হয়ে ওঠে। তারপর আসে পোশাক, আচরণ, জীবনযাপনের বিধি নিষেধ। শেষে আসে শাস্তি—আর শাস্তির চূড়ান্ত রূপ রক্ত। আফগানিস্তানে মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ হওয়া, ইরানে নৈতিক পুলিশের নামে নারীদের ওপর নির্যাতন, পাকিস্তানে আইনের অজুহাতে গণপিটুনি—এই ঘটনাগুলো কোনো আলাদা আলাদা ঘটনা নয়। একই গল্প, শুধু জায়গার নাম বদলায়। প্রতিবারই যুক্তি এক—ধর্ম বিপন্ন, তাই সহিংসতা বৈধ।
     
     
    কিন্তু এই মৌলবাদের সবচেয়ে বড় শিকার কারা? মুসলমানরাই। সাধারণ মুসলমান—যারা স্বাভাবিক জীবন চায়, গান চায়, প্রেম চায়, পড়াশোনা চায়, হাসতে চায়। মৌলবাদ সেখানে ঢুকে বলে—এগুলো হারাম। তুমি আগে মুসলমান, পরে মানুষ। এই অমানবিক শ্রেণিবিন্যাসই মৌলবাদের মূল শক্তি। আর এর বিরুদ্ধে কথা বললেই যদি আমাকে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলা হয়, তাহলে সেই তকমা আসলে প্রশ্ন করার অধিকারকেই অপরাধ বানায়। ধর্মের সমালোচনা আর মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ—এই দুটোকে এক করে দেখানোটাই মৌলবাদী দের সবচেয়ে বড় কৌশল।
     
     
    আমি বিশ্বাস করি—ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। বিশ্বাস মানুষের ভেতরের বিষয়। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন সেই ব্যক্তিগত বিশ্বাস সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। যখন বলা হয়—এই আইন মানতেই হবে, এই জীবনযাপন করতেই হবে, না হলে মৃত্যু। তখন আর সেটা বিশ্বাস থাকে না; সেটা রাজনৈতিক সন্ত্রাস হয়ে ওঠে। আর রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিরোধিতা করা কোনও বিদ্বেষ নয়—এটা নাগরিক দায়িত্ব।
     
    অনেক সময় শুনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধ উপনিবেশবাদী নিপীড়ন নাকি এই সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ। হ্যাঁ, এই ইতিহাসের সমালোচনা জরুরি। কিন্তু অন্যায়ের ব্যাখ্যা কখনই অন্যায়ের বৈধতা হতে পারে না। কেউ যদি আমার ওপর অত্যাচার করে, তার মানে এই নয় যে আমি ও পাল্টা তার গলা কেটে পাল্টা নৈতিকতা দেখাবো। নৈতিকতা যদি এতই সস্তা হত, সভ্যতা অনেক আগেই ভেঙে পড়ত।
     
    তবে আমাকে সবচেয়ে হতাশ করে তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনীতির নীরবতা। পরিচয়ের রাজনীতির চাপে ইদানিং কালে বুদ্ধিজীবীরা সাংবাদিকরা প্রায় প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফল যা হওয়ার তাই—মৌলবাদীরাই একচেটিয়া প্রতিনিধি হয়ে বসেছে। মনে রাখবেন আজকের দিনে যারা ধর্মের নামে সবচেয়ে বেশি চেঁচায়, তারাই যেন পুরো ধর্মের মালিক। আর যারা ভিন্নভাবে ভাবতে চায়, তারা চুপ করে থাকে—ভয়ে, দ্বিধায়, কখনও সুবিধার জন্য। কিন্তু ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে—নীরবতা কখনও নিরপেক্ষ নয়। নীরবতা সবসময় শক্তিশালীর পক্ষেই যায়।
     
     
    আজ যদি আমরা স্পষ্ট করে না বলি—গলা কেটে হত্যা কোনও ধর্মের সম্মান হতে পারে না, নারীকে বন্দি করা ঈশ্বরের ইচ্ছা নয়—তাহলে কাল এই নীরবতার দাম আমাদেরই দিতে হবে। “সময় উপযুক্ত নয়”—এই অজুহাত আর মানা যায় না। মৌলবাদ সময় নেয় না, সে সুযোগ নেয়। আর আমরা যদি এখনও শব্দ বাছতে বাছতে থেমে যাই, তাহলে সেই সুযোগটাই তাকে দিয়ে দিই।
     
    মানবতা কোনও ধর্মের শাখা নয়। কোনও ঈশ্বর বা আল্লাহ মানুষ মারতে বলেন না। আর যে আদর্শ তা দাবি করে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বিদ্রোহ নয়—ন্যূনতম বিবেক। এই কথা বলা থামানো যাবে না। কারণ এখানে চুপ থাকা মানে শুধু চুপ থাকা নয়—এখানে চুপ থাকা মানে পাশে দাঁড়ানো। আর আজ, এই সময়ে, নিরপেক্ষ থাকার বিলাসিতা আমাদের নেই।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:d933:82be:bc9a:***:*** | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ০১:৪১737199
  • জরুরী লেখা 
  • Ranjan Roy | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ০১:৪৯737201
  • মূল বক্তব্যটি ভাল লেগেছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন