আমরা কি ঈশ্বরের “বিশেষ পছন্দে”র সন্তান?.
১.০ প্রস্তাবনা
গত এক শতাব্দী ধরে প্রাচীন ভারতের প্রাক-ইতিহাস (pre-history) চর্চায় দুটো পরস্পর বিরোধী থিওরি একে অন্যকে টক্কর দিচ্ছে। একটা হোল আর্যদের মধ্য এশিয়া থেকে হিন্দুকুশ পেরিয়ে ভারতে আগমনের তত্ত্ব।
আরেকটি হল
[1]আর্যরা ভারতে বহিরাগত নয়, এখানেই উদ্ভূত ভারতের আদি জনগোষ্ঠী।
এই বিতর্কে রাজনৈতিক রঙ লাগায় শুরু হয়ে গেছে ঠান্ডা মাথায় পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্যের যুক্তিযুক্ত বিবেচনার বদলে চেরি পিকিং করে আংশিক তথ্য নিয়ে গলাবাজি। ইদানীং কালে হরপ্পা সভ্যতার বেশ কিছু নিদর্শন পুরাতাত্ত্বিক খননের ফলে আবিষ্কার হয়েছে। যেমন গুজরাতের ধোলাবিরা ও লোথাল এবং হরিয়ানার রাখীগড়ী।
যা পাওয়া গেছে তার থেকে কী সিদ্ধান্তে আসা যুক্তিসংগত হবে সে কথায় পরে আসছি।
বলে রাখা ভাল, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এ নিয়ে কোন বিতর্ক ছিল না। সবাই মেনে নিয়েছিলেন যে ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হল হরপ্পা সভ্যতা (মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা)। এদের বিশিষ্ট পরিচিতি ছিল নগরায়ণ। অন্যদিকে বহিরাগত আর্যরা ছিলেন যাযাবর শিকারী জনগোষ্ঠী। তাঁদের ছিল অশ্ব এবং ব্রোঞ্জের হাতিয়ার, লোহার অস্ত্র পরের দিকে এসেছে। যজ্ঞ ছিল দৈনন্দিন জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক শক্তির আরাধনা তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
সৃষ্টির উৎস খোঁজা, আধ্যাত্মিক বিমূর্ত চিন্তা অনেক পরে বিকসিত হয়।
এই হাইপোথেসিসের উৎস হল বৈদিক সাহিত্য , বিশেষ করে ঋগবেদের বিভিন্ন বর্ণনা।
এছাড়া দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীও বৈদিক আর্যদের আগমনের আগে থেকে ভারতে রয়েছে। রামায়ণের কাহিনীকে অনেক ইতিহাসবিদ উত্তর ভারতের আর্যদের দাক্ষিণাত্য এলাকা বিস্তারের গাথা মনে করেন।
সেই সময় হিন্দুত্ব ধারণার প্রবক্তা সাভারকরও বহিরাগত আর্যদের থিওরির সমর্থক ছিলেন। তাঁর “হিন্দুত্ব” বইয়ে তিনি এটাকে বৈদিক আর্যের উপনিবেশ নির্মাণের প্রমাণ হিসেবে দেখে গর্বিত হয়েছিলেন। বইয়ের উপসংহারে আশা প্রকাশ করেছেন যে আজকের হিন্দু একদিন ফের সমগ্র বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনের অভিযান শুরু করবে।
“হিন্দুস্থানের এবং হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ুক উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, গড়ে তুলুক হিন্দু উপনিবেশ; সমগ্র বিশ্বই তাদের ভৌগলিক সীমা”[2]।
কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ পাদে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও খোলাখুলি ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশের বদলে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর আহ্বানের সঙ্গে প্রচার শুরু হয়েছে যে হিন্দুধর্ম হচ্ছে ‘সনাতন’—যার কালসীমা নির্ধারণ করা কঠিন। এবং হিন্দু ছিল বিশ্বগুরু এবং ঈশ্বরের নির্বাচিত ধার্মিক জনগোষ্ঠী। কাজেই ভারতের প্রাচীন সভ্যতা মানেই হিন্দু সভ্যতা যা ভারতে আবহমান কাল থেকে অস্তিত্ববান।
অতএব, ‘বহিরাগত’ আর্যদের ভারতে আসার তত্ত্ব খারিজ।
কিন্তু এই হাইপোথেসিসকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে হলে আগে দেখাতে হবে যে হরপ্পা সভ্যতার নগরায়ণের আগে থেকে ভারতে আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল এবং তা হরপ্পার চেয়ে উন্নত ছিল।
২.০ প্রাক-ইতিহাসের খোঁজঃ তিনটি পদ্ধতি
ক) পুঁথি ও পুরাণভিত্তিক
শুরু হয়েছিল প্রাচীন পুঁথি, সাহিত্য, লোককথা, পুরাণকে সাক্ষ্য এবং উৎস মেনে।
কিন্তু দেখা গেল তার সীমা আছে। অনেকগুলিই লেখা হয়েছে ঘটনার অনেক পরে, একটি জনগোষ্ঠীর স্মৃতি , কল্পকথা ও বিশ্বাসকে ভিত্তি করে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে পড়েছে অনেকের হাত, মিশেছে লিপিকারের মনের মাধুরী। ফলে কালনির্ণয় কঠিন।
খ) পুরাতত্বভিত্তিক
এবার এল পুরাতত্ব বা পাথুরে প্রমাণ। যা সময়ের দলিল হিসেবে বেশি টেঁকসই।
গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে পুরাতত্ব বিজ্ঞান তার আধুনিক খনন পদ্ধতি, তার থেকে প্রাপ্ত মৃৎপাত্র, হাতিয়ার, জনপদের বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ এবং ফসিল তথা পুঁথির থেকে কালনির্ণয়ের আধুনিক পদ্ধতির (রেডিও কার্বন ১৪ টেস্ট) মাধ্যমে অনেক ভাল ফল দিচ্ছে।
অর্থাৎ প্রাক-ইতিহাসের আলোচনায় পুঁথির চেয়ে পাথুরে সাক্ষ্য বেশি নির্ভরযোগ্য।
রেডিও কার্বন ১৪ টেস্ট
সমস্ত জীবিত উদ্ভিদ এবং প্রাণী বাতাবরণ থেকে কার্বন -১৪ সংগ্রহ করে, কিন্তু মৃত হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায় এবং আগে থেকে সংগৃহীত কার্বন ১৪ ক্ষয় হতে হতে নাইট্রোজেন ১৪ হয়ে যায়। প্রতি ৫৭৩০ বছরে একটি স্যাম্পলে জমে থাকা কার্বন ১৪ এর অর্ধেক নষ্ট হয়ে যায়।
বৈজ্ঞানিকেরা স্যাম্পল থেকে কার্বন ১৪ ( নষ্ট এবং বাকি) তুলনামূলক অধ্যয়ন থেকে বের করতে পারেন যে কত বছর আগে এটি মারা গেছে।
এই পদ্ধতিতে ৫০০০০ বছর পুরনো স্যাম্পল অবধি সঠিক ফলাফল দেয়।
আজ পর্যন্ত হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার লিপির সঠিক পাঠোদ্ধার সম্ভব না হলেও এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিলালিপি, মূর্তি ও বাস্তুকলার কালনির্ণয় সম্ভব হয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনগুলো্র মধ্যে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সমেত অধিকাংশই সিন্ধু অববাহিকার পাকিস্তান অংশে পাওয়া গেছে।
কিন্তু এই শতাব্দীর গোড়ায় ভারতের কয়েকটি জায়গায় – লোথাল ও ধোলাভিরা (গুজরাত), কালিবঙ্গান (রাজস্থান) এবং সাম্প্রতিক যে খনন নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে, রাখীগড়ি (হরিয়ানা) তা থেকে বেশ কয়েক হাজার বছর আগে এখানে বন্দর , নৌবাণিজ্য, উন্নত জল নিকাশি ও সংরক্ষণ ইত্যাদির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
আর রাখীগড়ি হচ্ছে ভারত-পাক উপমহাদেশে সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে বড় সাইট।
গ) ডি এন এ বিশ্লেষণ বা জেনেটিক বিজ্ঞানের সাক্ষ্য
প্রাক ইতিহাসের চর্চায় এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি—জিনতত্ত্ব বা ডি এন এ বিশ্লেষণের মাধ্যমে কালনির্ণয়। আজ কয়েক লক্ষ বছর পুরনো ফসিলেরও ডি এন এ বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে। ফলে পুরাতত্ব ও জিনতত্ত্ব হাত ধরাধরি করে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের স্থায়ী সমাধান এনে দিচ্ছে।
কিন্তু এই পদ্ধতিটি বিকসিত এবং উন্নত হয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে। তাই বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ এর গুরুত্ব বিষয়ে তেমন অবহিত নন।
এই লেখার সীমিত পরিসরে বোঝার চেষ্টা হয়েছে যে এই অত্যাধুনিক পদ্ধতিটি ভারতে মধ্য এশিয়া থেকে আর্যদের আগমনের তত্ত্ব নিয়ে কী সাক্ষ্য বা প্রমাণ পেশ করছে।
গোড়াতে দরকার বিতর্কটি স্পষ্ট করে বোঝা।
৩.০ কেন বাইরের থেকে কাউকে আসতেই হবে?
আমরা কেন ধরে নিচ্ছি যে ভারতের মাটিতে প্রথম পা রাখা আধুনিক মানুষটি বাইরে থেকে এসেছিল?
ভারতের মূল জনগোষ্ঠী এদেশের মাটিতেই উদ্ভূত হয়েছিল—এটা মেনে নিতে বাধা কোথায়?
এতদিন তো এটাই ধরে নেয়া হয়েছিল যে আধুনিক মানব বিশ্বের বিভিন্ন অংশে স্বতন্ত্র ভাবে উদ্ভুত এবং বিবর্তিত হয়েছে। তাহলে ভারতের ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রম হবে?
চিনের নৃতত্ববিদেরাও মনে করতেন চিনের মানব বিশ্বের অন্য নরগোষ্ঠীর থেকে আলাদা, উদ্ভূত হয়েছে চিনেরই ভৌগলিক অঞ্চলে।
তবে চার্লস ডারউইন সেই ১৮৭১ সালেই বলেছিলেন যে সমগ্র মানবজাতির একটিই উৎস--আফ্রিকায় এক বিশেষ প্রজাতির শিম্পাঞ্জি।
গত শতাব্দীর শেষ কয়েক দশক থেকে এই প্রশ্নটি শুরু হয়েছে এবং কিছুদিন আগেও মনে করা হত --এটি একটি সংগত প্রশ্ন বটে। কিন্তু আজকে মুষ্টিমেয় কিছু নৃতত্ববিদ ছাড়া সবাই মনে করছেন আফ্রিকা থেকে প্রাপ্ত ফসিলের ডি এন এ বিশ্লেষণ নিশ্চিত ভাবে মানব জনমের উৎস নিয়ে ‘বহুত্ববাদী’ তত্ত্বকে খারিজ করছে।
কীভাবে?
৪.০ শেষ হাসি কি ডারউইনের?
বিবর্তনের ধাপে আধুনিক মানুষের নিকটতম পূর্বপুরুষদের সবরকম বৈচিত্র্যময় ফসিল পাওয়া গেছে শুধু আফ্রিকা মহাদেশে।
যেমন Sahelanthropus tchadensis (৭ মিলিয়ন বছর আগে), Ardipithecus ramidus (৪ মিলিয়ন বছর), Kenyanthropus playtyops (৩.৫ মিলিয়ন), Homo habilis (২.৪ মিলিয়ন) এবং Homo beidelbergensis ( ৭ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছর আগের)।
আর এসবের ডি এন এ বিশ্লেষণ থেকে চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে যে আফ্রিকার বাইরে বিভিন্ন মহাদেশে যে আধুনিক মানব তারা সবাই আফ্রিকা মহাদেশের একটি একক জনগোষ্ঠীর বংশধর (descendants) বা উত্তর পুরুষ।
সেই জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ প্রায় ৭০০০০ বছর আগে অভিবাসী (migrants) হয়ে এশিয়ায় প্রবেশ করে। তারপর সেখান থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
সমস্ত আধুনিক আবিষ্কার ও প্রমাণ আমাদের, অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির, আফ্রিকান শেকড়ের ধারণাকে পোক্ত করছে
[3]।
দুটো উদাহরণঃ
ইথিওপিয়ায় ওমো কিবিশে খননে প্রাপ্ত দুই মানব করোটির অংশের ফসিল , তার বয়স ১,৯৫,০০০।
আর ২০১৭ সালে মরক্কোর সাফি শহরের কাছে জেবেল ইরহুদ গুহায় প্রাপ্ত করোটির ফসিলের ডি এন এ বিশ্লেষণ বলছে বয়স ৩,০০,০০০ বছর।
কীভাবে জেনোম সিকোয়েন্সিং (genome sequencing) পদ্ধতির মাধ্যমে দুই আপাত বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর মূল সম্পর্ক খুঁজে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হয়—তার বর্ণনা এই লেখার সীমার বাইরে। কিন্তু ফসিলের ডি এন এ বিশ্লেষণের উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার আজ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীর উদ্ভবের তত্ত্বকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছে।
৫.০ ভারতে বাইরে থেকে মানুষের আগমন কখন?
পুরাতত্ত্ববিদ বলবেন প্রায় ১,২০,০০০ বছর আগে। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করা জিনতত্ত্ববিদ বলবেন প্রায় ৬৫০০০ বছর আগে।
কে ভুল, কে ঠিক?
দুজনেই ঠিক।
পুরাতত্ত্ববিদ ভারতে মানুষের পদার্পণ বলতে সেই মানুষের কথা বলেন যাদের আগমনের পাথুরে প্রমাণ আছে, কিন্তু তারা এখানে বংশবৃদ্ধি করেছিল এমন প্রমাণ নেই।
আবার জিনতত্ত্ববিদ বলবেন শুধু সেই মানব গোষ্ঠীর কথা যারা এখানে এসে রয়ে গেল এবং বংশবৃদ্ধির জেনেটিক প্রমাণ রেখে গেল।
২০০৯ সালে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের সঙ্গে যুক্ত বিশ্বের প্রায় ৯০ জন ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব এবং জিনতত্ত্বের পণ্ডিতেরা মিলে নেচার পত্রিকায় একটি রিসার্চ পেপার প্রকাশ করলেন –বিষয় ভারতের জনগোষ্ঠী নিয়ে নতুন ভাবনা
[4]।
২০১০ সালে জানা গেল আধুনিক মানব ও নিয়েন্ডারথালদের মধ্যে প্রজননের কাহিনী এবং ২০১৪ সালে সামনে এল ডেনিসোভান এবং আমাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্কের কথা।
তারপর ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের অধ্যাপক মার্টিন বি রিচার্ডস এবং তাঁর সহযোগীদের রিসার্চ পেপার বেরোল। বিষয় ভারতীয় উপমহাদেশে জনগোষ্ঠীর ছড়িয়ে পড়ার ক্রমাবলোকনের ইতিহাস
[5]।
৬.০
ভারতে আর্যদের আগমন নিয়ে দুই বিরোধী তত্ত্বঃ আজকে কী অবস্থা
আজকে হরপ্পার পরে আর্যদের আগমনকে অস্বীকার করতে গিয়ে নতুন কথা বলা হচ্ছেঃ
এক, বিগত ৪০,০০০ বছরে ভারতে বাইরে থেকে কোন অনুপ্রবেশ ঘটেনি।
দুই, আসলে আমাদের দেশে মূলতঃ দুটি আদি জনগোষ্ঠী প্রাচীন কাল থেকেই রয়েছে।
তাদের টেকনিক্যাল নাম দেয়া হয়েছে—উত্তর ভারতীয় পূর্বপুরুষ ( Ancestral North Indian or ANI) এবং দক্ষিণ ভারতীয় পূর্বপুরুষ (Ancestral South Indian or ASI)। এদের মধ্যে মেলামেশা থেকেই আমাদের ভারতীয় জনগোষ্ঠীর উদ্ভব। আর্যদের মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগমনের তত্ত্ব ভুল।
মজার ব্যাপার, এই তত্ত্বের দুই প্রবক্তা, ভারতের দুই উচ্চপদে আসীন অধ্যাপক, ২০০৯ সালের নেচার পত্রিকায় হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের সৌজন্যে প্রকাশিত গবেষক দলের অংশ এবং স্বাক্ষরকারী। সেখানে তাঁরা এসব না বলে উলটো কথাই বলেছিলেন।
কী বলা হয়েছে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত পেপারে?
ওই পেপারে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে দক্ষিণ ভারতে (ASI) নয়, উত্তর ভারতের জনগোষ্ঠী (ANI) ডি এন এ’র বিচারে পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং ককেশাস অঞ্চল থেকে
[6]আগত অভিবাসীদের মিশ্রণজাত
[7]। অর্থাৎ এই গবেষণা আর্য আগমনের তত্ত্বে শীলমোহর লাগিয়েছে।
এ বিষয়ে জুন ২০১৭ সালে দি হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত টনি জোসেফের প্রবন্ধ --‘আর্য আগমন’ তত্ত্বের পুরো বিতর্কের উপর কী ভাবে জিনতত্ত্বের প্রমাণ দিয়ে যবনিকা পতন হোল-- তার চমৎকার সারসংক্ষেপ।
এই সিদ্ধান্তের আরও পোক্ত প্রমাণ হিসেবে ২০১৮ সালে
বিশ্বের ৯২জন বৈজ্ঞানিকের সম্মিলিত রিসার্চের পেপার প্রকাশিত হোল। তার অন্তিম এবং পরিমার্জিত রূপ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে সায়েন্স পত্রিকায় বেরোল
[8]।
এতে প্রাচীন ফসিলের ডি এন এ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের স্তেপ অঞ্চল থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় আগমনের মজবুত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। যার ফলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা বোঝা গেল।
রাখীগড়ি খননের তাৎপর্য
হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম খনন স্থল রাখীগড়িতে একটি ৪৬০০ বছরের পুরনো মহিলার করোটি পাওয়া গেছে। সেটা নিয়ে ওই একই তারিখে (১৬/৯/২০১৯) ‘Cell’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। দুই পেপারের অধিকাংশ লেখক এক। কাজেই স্বাভাবিক যে ওঁদের নিষ্কর্ষ একই হবে।
তাতে বলা হোল হরপ্পা অঞ্চলের প্রাপ্ত ওই মহিলার ফসিলের জিন বিশ্লেষণে স্তেপের পশুপালক জনগোষ্ঠী এবং ইরাণীয় কৃষক জনগোষ্ঠীর কোন সম্পর্ক পাওয়া যায় নি।
ব্যস, আর্য আগমন তত্ত্বের বিরোধীরা বললেন—এই তো পেয়েছি! ভারতে স্বয়ম্ভু মানব অস্তিত্বের প্রমাণ! অনেক পত্রপত্রিকা হেডলাইন করল—রাখীগড়ি খনন আর্য আগমনের তত্ত্বকে খারিজ করেছে!
আসলে না বুঝে প্রেক্ষিত বাদ দিয়ে একটা লাইন চেরি পিকিং করলে যা হয়!
পেপারের বক্তব্য এ নয় যে রাখীগড়ী মহিলার ইরাণের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিল না। বরং এটি ইরাণের ‘কৃষক’ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অর্থাৎ এটি এত প্রাচীন যে তখন ইরাণে বা হরপ্পায় কৃষি শুরু হয় নি। এর জেনোম ইরাণ থেকে আগত শিকারী ও খাদ্য সংগ্রাহক গোষ্ঠীর
[9]।
ওই পেপারেই পরে স্পষ্ট বলা হয়েছে প্রাচীন কালের ডি এন এ অধ্যয়নের ফলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর পূর্ব ইউরোপ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম ভাগে ছড়িয়ে পড়ার বিস্তারিত খুঁটিনাটির দস্তাবেজ তৈরি সম্ভব হয়েছে।
উত্তর প্রদেশের সিনৌলিতে রথের ভগ্ন অংশ!
দিল্লির কাছে বাগপত জেলার সিনৌলির এক প্রাচীন সমাধিস্থলে তিনটে ভাঙা গাড়ি, সম্ভবতঃ ১৯০০ বি সি ই (before common era) পাওয়া গেছে। কেউ বলছেন ওগুলো আসলে রথের চাকা।
স্তেপ মাইগ্রেশনের সময়কাল হল ২০০০ থেকে ১৫০০ বি সি ই। কাজেই এটা মনে হয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার লোকজনের প্রথম দলের আগমন চিহ্ন।
কিন্তু ডিসকভারি প্লাস চ্যানেলে ২০২১ সালের গোড়ায় একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানো হোল—Secrets of Sinauli. তাতে দাবি করা হোল ভারত সরকারের পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ সেই মৃতদের কবর দেয়ার প্রাচীন স্থল থেকে একটি কংকালের ডি এন এ রিপোর্ট পেয়েছে। তাতে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের জেনেটিক সম্পর্কের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
অথচ। ওই ডকুমেন্টারি দেখানোর সময় থেকে আজ অব্দি এমন কোন ডি এন এ রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসে নি!
উপসংহার
ইহুদী, ক্রিশ্চান, আরব সবাই দাবি করে যে তারাই নাকি ঈশ্বরের ‘বেছে নেয়া’ (chosen) জনগোষ্ঠী। এটা বোঝা মুশকিল যে পরম করুণাময় ঈশ্বর কেন তাঁর সন্তানদের প্রতি পক্ষপাত করবেন! তবে এই বিশ্বাস লক্ষ লক্ষ নিরীহ ইহুদীদের হিটলারের গ্যাস চেম্বার থেকে বাঁচাতে পারে নি। জার্মানি-ফ্রান্স-পোল্যান্ডের অধিবাসীদের বিশ্বযুদ্ধের আগুন থেকে রক্ষা করে নি। আজ গাজা ও প্যালেস্তাইনের আরবদেরও গণহত্যা থেকে বাঁচাতে পারছে না।
এখন আমরা ভারতবাসীরা নাকি সেই ঈশ্বরের বিশেষ পছন্দের লোক। তাই আমরা স্বয়ম্ভু, আমাদের দেশে কোন বিদেশীর অনুপ্রবেশ হতে পারে না। আমাদের ভাষা দেবভাষা।
তাই ইতিহাস চর্চার সমস্ত মান্য পদ্ধতিকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে আমরা রক্তের বিশুদ্ধতার দাবি করি। অতএব গোঁজামিল অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু সাভারকর তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ তত্বের আধুনিক প্রণেতা তাঁর হিন্দুত্ব বইয়ের শেষভাগে এটা কী বললেন?
“আসলে সমগ্র বিশ্বে একটিই জাতি—মানব জাতি। একই শোণিত বহমান –মানব রক্ত।
বাকি সব রক্তের বন্ধন কাজ চালানোর জন্যে--provisional, a make shift and only relatively true. Nature is constantly trying to overthrow the artificial barriers between race and race.
To try to prevent the co-mingling of blood is to build on sand. Sexual attraction has proved more powerful than all the commands of all the prophets put together”
[10]==================================================
[1] সমগ্র প্রবন্ধে আর্য বলতে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হচ্ছে।[2] Savarkar, ‘Hindutva’, 2nd edition, p. 117, 136. বইটির শেষ পংক্তি।[3] Tony Joseph, “Early Indians”, p. 21; Juggernaut Books, 2021.
[4] David Reich, et al, ‘Reconstructing Indian Population History’, Nature 461: pp 489-94.
[5] Marina Silva, et al, ‘ A Genetic Chronology of the Indian Sub- continent Points to Heavily Sex-biased Dispersal’, BMC Evolutionary Biology (2017).
[6] ‘How Genetics is Settling the Aryan Migration Debate’,
The Hindu, 17
th June, 2017.
[7] Tony Joseph, “
Early Indians”, p. 10;
[8] “The Formation of Human Populations in South and Central Asia”,
Science, 16
th September, 2019.
[9] Tony Joseph, “
Early Indians”, p. 12
[10] Savarkar, “Hindutva”, p. 91