রাস্তা দিয়ে তরতর করে হেঁটে যাচ্ছিল সে। নৌকা যেভাবে কখনো বৈঠায় স্রোত কেটে, কখনো লগির ধাক্কায় জলকে স্থানচ্যূত করে নিজের পথ করে নেয়, সে সেভাবে মানুষ, যান, বাতাস –সামনে যা পাচ্ছিল, সব কিছুকে ঠেলেঠুলে উড়েফুঁড়ে এগুচ্ছিল। জ্যামের দৈর্ঘ্য না কমে যখন ক্রমেই আরো বিস্তৃত হচ্ছিল, তখন প্রায় মাঝপথেই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল সে।
একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নাইমের, দেরীতে উপস্থিতিকে যেখানে ক্রাইমের চোখেই দেখা হয়। অফিসে ওর পজিশনটা যে খুব উঁচু লেয়ারে, তা নয়। তবে খানিক উপরে সে থাকতেই পারত, যদি না দু’বছর ধরে প্রমোশানটা ঝুলে থাকত। অবশ্য এ নিয়ে যে ওর কোন মাথাব্যথা আছে, তা মনে হয়নি কখনো কারো। নাইমের মাথাটা যেন শুধু গুঁজে গুঁজে কাজ করা জন্যই। আর এটা তার চারপাশের লোকজনও মনে হয় মেনে নিয়েছে; সেজন্যই হয়ত তার প্রতি তাদের কৌতূহল দিনকে দিন শূন্যের কোঠায় নেমে আসছে!
অফিসটা থেকে আর মাত্র একটা রাস্তার দূরত্ব; ঠিক রাস্তাও নয়, শুধু উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার ক্রসটুকু। কিন্তু মাঝের সড়কদ্বীপ পেরুনোর আগেই একটা বিকট চিৎকারে নাইমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। যতক্ষণে সে শব্দের উৎসমুখকে খুঁজে পেল, ততক্ষণে রাস্তার গাড়িগুলি তাকে অতিক্রম করছিল তেমন করেই , একটূ আগে সে যেভাবে জনস্রোতকে কাটিয়েছে। প্রথমটা কিছু বিহবল থাকলেও পরে খেয়াল করল, লোকটির লক্ষ্যবস্তু সে-ই, আর মুহূর্তের মধ্যেই যেভাবে দৌঁড়ে এসে তাকে জাপটে ধরল সে, মনে হতেই পারে যে, নাইমের কোন বড় বিপদ, আর লোকটির উপর দায়িত্ব পড়েছে তাকে উদ্ধারের!
নাইম এতটাই হতভম্ব যে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেও ভুলে গেছে। তার কানে শুধু ভেসে আসছে মাঝ বয়সী লোকটির অস্ফুট আর ভাঙা ভাঙা ধ্বনি। অনেক কষ্টে সেগুলোকে জোড়া লাগিয়ে যখন খানিক আন্দাজ করতে পারল, সঙ্গে সঙ্গেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠল সে, আর লোকটির বাহু থেকে অনেকটা জোর করেই ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। কী আজব! লোকটি তাকে নিজের সন্তান বলে দাবী করছে! নিশ্চিত বদ্ধ উন্মাদ, পথে-ঘাটে মাঝে-মধ্যে যেমন দেখা যায়! না হলে, নিজের ছেলেকে চিনতে ভুল হয়! হ্যাঁ, হয়ত চেহারায় মিল আছে নাইমের তার ছেলের সাথে; কিন্তু কখনো কি শতভাগ মিলে? অন্তত জনকের তো সেই সূক্ষ্ম পার্থক্য মিস হওয়ার কথা নয়!
কিন্তু মুরব্বী ইতিমধ্যে একটা সালিশ বসিয়ে ফেলেছেন সেই ব্যস্ত রাস্তায়, আর গোল হয়ে দাঁড়ানো দর্শক জনতার কাছে চাইছেন ছেলেকে ফেরত দেয়ার রায়! নাইম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল বেরুতে জনতার সেই গোল চত্বর থেকে; অসহায় বৃদ্ধকে একটি ন্যয়বিচার পাইয়ে দিতে যেন তারাও বদ্ধপরিকর। এরই মাঝে এক ষন্ডামত লোক বৃদ্ধের হাত থেকে একটি মোবাইল নিয়ে এসে মেলে ধরল নাইমের সামনে।
প্রথমে হেসে উঠেছিল, কিন্তু পরে বিষয়টা তলিয়ে দেখতেই সারা শরীর দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল নাইমের! আচ্ছা, এরা সকলে মিলে তাকে ছবির ঐ যুবকটি মনে করছে না তো? কিন্তু তা কী করে হয়! একাংশ মিলও তো নেই তার সাথে! আচ্ছা, তারও তো ছবি তোলা আছে, মোবাইলটা বের করলেই হাতে-নাতে প্রমাণ করে ফেলা যায় বিষয়টা! কিন্তু পকেটে ঢুকিয়েও বের করে নিয়ে এল সে হাতটা; সামনের চোখগুলো ব্যগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তারই দিকে! তার মন বলতে লাগল, তার ছবিটাকে এরা আমলেই নেবে না, হয়ত বলবে এটাই অন্য কারো! হঠাৎ মাথাটা ভীষণ করে দুলতে শুরু করল নাইমের, হাত-পা অবশ হয়ে এল! এ কী করে সম্ভব যে, তার পুরো চেহারাটাই পালটে গিয়েছে!
২.
আপাদমস্তক কারুকাজ করা একটা অট্রালিকা, রাস্তার ধারে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। যখন কেউ রাস্তা দিয়ে যায়, আর এর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়, তখন কারো জানবারই উপায় থাকে না যে ঠিক এর পেছনেই রয়েছে একটি চৌচালা টিনের ঘর। এক চিলতে উঠোন সামনে রেখে সেও দাঁড়িয়ে থাকে একটি বনেদি ভাব নিয়ে। এই ঘর ও উঠোন ঐ অট্রালিকার মালিকেরই, একটা সময় পর্যন্ত ওখানে তিনিই থাকতেন সপরিবারে। চৌচালাটা ভেঙে আরেকটা অট্রালিকা তোলার ইচ্ছে মালিকের; তবে যতদিন না অর্থসংকুলান হচ্ছে, ভাড়ার আয়টা মনে হয় হাতছাড়া করতে রাজী নন তিনি। অবশ্য এজন্য নিত্য হাঙ্গামা সহ্য করতে হয় তাকে। আজও যেমন একটা হাঙ্গামা লেগে রয়েছে! উঠোনটা গিজ গিজ করছে মানুষে। পাড়াপ্রতিবেশীদের সাথে জড়ো হয়েছেন কাছে থাকা আত্মীয়স্বজনেরাও। চিৎকার, শলাপরামর্শ, আর কান্নার রোল বাতাসকে ভারী করে রেখেছে!
রাস্তার লাগোয়া মেইন গেটটা পার হয়ে অট্রালিকার পাশের চিপা গলিটায় নিজেকে গলিয়ে দিয়ে যখন উঠোনটায় উঁকি মারে নাইম, তখন তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়! আর কিছুক্ষণ পরে যখন তার নাম ধরে বিলাপ করতে শোনে মাকে, ক্ষুদে বুকটা কেঁপে উঠে এক অজানা আতঙ্কে! সে যে বাবার সাথে বাজারে যাওয়ার জন্য আবদার ধরেছিল, তা নয়। বরং বাবারই মনে হয়েছিল, ছেলেকে বাজার চেনাতে হবে শৈশব থেকেই; তার কাছে, সংসারকে চেনার জন্য বাজার অনেক বড় একটা স্কুল। মাছবাজারে ঢোকার পর বাবা যখন এক বিক্রেতার সাথে দরকষাকষিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, নাইমের চোখজোড়া লাটিমের মত ঘুরতে ঘুরতে আটকে গিয়েছিল কয়েক ফুট দূরের একটি গদিতে। কী মাছ বলতে পারবে না, কিন্তু ওদের চোখগুলো যেন জ্বলছিল দাউদাউ করে, আর সেই উত্তাপ দূর থেকেও টের পাচ্ছিল সে! কোন এক অপ্রতিরোধ্য টানে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে, আর সঙ্গে সঙ্গে কথা বলে উঠল ওরা! এরপর নাইম তন্ময় হয়ে শুনতে লাগল সেই কথা; ভুলে গেল সব কিছু - স্থান, সময়, লোকালয়, বাজার, বাবা!
কিন্তু এক সময় মাছগুলোর কথা থেমে গেল মাঝপথেই। হঠাৎ একটা বিশাল বপুর লোক মাছ দু’টির উপর তার কুৎসিত-দর্শন আঙুলগুলো তাক করল, আর কথা থেমে গেল মাছগুলির। শুধু তাই নয়, অচিরেই তারা একটা বিরাট বটিতে টুকরো টুকরো হয়ে লোকটির হাতের নোংরা থলেটিতে ঢুকতে লাগল। বিস্ফারিত চোখে দৃশ্যটা দেখে যাচ্ছিল শুধু নাইম। কিন্তু লোকটা বিদায় নিতেই শব্দ করে কেঁদে উঠল সে!এরপর কী হয়েছিল মনে নেই পুরো। তবে সম্বিৎ ফিরে পেতেই আবিষ্কার করল, বাবা নেই কোথাও। চালের দোকান, সবজির দোকান, মুদির দোকান যে জায়গাগুলোতে বাবার নিত্য আনাগোনা, চষে ফেলল সে। কিন্তু নেই! বাবার জন্য আরো অনেকটা সময় অপেক্ষা করে যখন বাসার পথ ধরে সে, ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে গেছে, আর সন্ধ্যে ছুঁইছুঁই করছে ।
ভীড়ের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ চিনতে না পারলেও বাবার সাথে ঠিকই চোখাচোখি হয়ে গেল, আর ভয়ে মুখটা কাঠ হয়ে গেল! কত ধরণের মারধোর যে তার জন্য অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে চোখ বুঁজে ফেলেছিল সে। অবশ্য চোখ মেলতেই বাবার কোলে আবিষ্কার করল নিজেকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে মায়ের কোলেও স্থানান্তরিত হল সে। যতদূর মনে পড়ে, হৈচৈটা অনেক রাত অবধি চলেছিল। একটা সময় অবশ্য বাসাটা খালি হয়ে যায়, আর সবাই যার যার মত শুয়ে পড়ে। এত ধকল, আর ক্লান্তির পর নাইমও শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না তার। আর এভাবেই সমস্যাটা শুরু হয়ে যায়, সেই রাত থেকেই।
সে যে কী অসহ্য যন্ত্রণা! তার কেবলই মনে হচ্ছিল, তার মাথায় দুটো লোক বসে আছে। একজন বলছে, ঘুমুতে। আরেকজন বলছে, নাহ্ কোন ঘুমুনো চলবে না। যতই চায় সে জোর করে ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করতে, ততই যেন কেউ তাকে ঠেলে বের করে দেয় সে রাজ্য থেকে! এক সময় সে বাতি জ্বেলে দেয়, আর সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দিনের ঘটনাগুলি ভাবতে থাকে। কিন্তু সিলিংয়ে চলতে থাকা ফ্যানটা হঠাৎ করেই থেমে যায়, আর পাখাগুলো রূপান্তরিত হয় দুটো মাছে! ওদের চোখজোড়া এক একটা আগ্নেয়গিরি, মনে হচ্ছে এখুনি বেরুতে শুরু করবে লাভা! অচিরেই পুরো ঘরটা গনগনে আগুনের তাতে পুড়তে শুরু করে, আর নাইমের ক্ষুদে শরীরটা সেই তাতে ভাজা ভাজা হতে থাকে!
৩.
যতই প্রহর বাড়ছে রাতের, অন্ধকার আরও তীব্র করে গিলে খেতে চাইছে পৃথিবীটাকে। চারদিকে এক হাড় কাঁপানো নিস্তব্ধতা! যেন পৃথিবীর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে এক সাথে, আর তাদের ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবখানে! আর এরই মাঝে চিৎ হয়ে পড়ে আছে নাইম তার বিছানাটাতে, আর মনে করছে আজকের দিনটাকে, কী বিচিত্র সব ঘটনায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে যার শরীর! শৈশবের সেই রাতটা অবশ্য মাঝে-মধ্যেই উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে! সেই অভিশপ্ত রাত, ভাবতেই গা শিউরে উঠে তার! সেদিন ভোরে যদিও বাবা-মা চার ডিগ্রী জ্বরে পুড়তে থাকা তার শরীরটাকে কোলের উপর শুইয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে, আর সপ্তা দুয়েক পর সেরেও উঠেছিল সে, কিন্তু মাথার সেই মানুষদুটি স্থায়ী ঘর করে ফেলে তার মাথায়! আর সেই দিন থেকেই নাইম জানে, এ পৃথিবীতে ওদের চাওয়ার বাইরে কিছুই করনীয় নেই তার, শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া।
হ্যাঁ, নীরব দর্শকই বটে। স্কুল-কলেজে তার বন্ধুরা তো জানতই, এমনকি শিক্ষকদেরও অজানা ছিল না যে, সে একজন দর্শক। এমনিতে তাকে মনে হতেই পারত ক্লাসের সব থেকে মনোযোগী ছাত্র। কারো সঙ্গে কথা-বার্তা নেই; শরীরে এতটুকু নড়াচড়া নেই; এক মনে, এক চোখে এমন তন্ময় তাকিয়ে থাকত টিচার আর তার ব্লাকবোর্ডের দিকে যে কখনো কখনো টিচারও আঁতকে উঠত সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে! অধিকাংশ টিচার সামলে নিয়ে আবার লেকচারে ফিরে গেলেও কেউ কেউ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিত, উঠে দাঁড়াতে বলত নাইমকে। আশ্চর্য হল সে গড়গড় করে বলে যেত টিচার যেগুলো বলেছে সেগুলো তো বটেই, এমনকি টিচার যা মিস্ করে গেছে তাও। আর যখন যন্ত্রের মত তার মুখখানা কেবলই নড়ত, তখন মনে হত না সে এই শ্রেণীকক্ষে আছে! তখনো সে যেন একজন দর্শক, তার মুখ আওয়াজ করতে থাকলেও চোখ যেন দেখে চলেছে! কিন্তু তারপরই শুরু হত আরো দুই অতিথির আনাগোনা, একজন তাকে তেপান্তরের মাঠে দাবড়ে বেড়াচ্ছে, আরেকজন তাকে ফিরিয়ে আনছে শ্রেণীকক্ষে… তাকে বলছে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তোমার শিক্ষক, এখানে নিয়ম আছে, ডিসিপ্লিন আছে, তোমার ইচ্ছেমত চলে না! আর তারপরেই তার মুখটা হঠাৎ করেই থেমে যেত, হঠাৎ লোডশেডিং হলে যেভাবে যেভাবে বাতি নিভে যায় সেরকম করে। এরপর যদি তাকে আবার ধরতে বলা হত, তখন সে আর কিছুতেই শুরু করতে পারত না, কারণ সে তো জানে না যে কোথায় শেষ করেছে!
নাইমকে প্রতি মুহূর্তেই ক্ষতবিক্ষত করে যাচ্ছ; অথচ তার এই সার্বক্ষণিক সঙ্গীদু’টোর সাথে তার একদমই পরিচয় নেই। অনেক ভেবেছে সে, এরা কারা? এরা কি কোন প্রাণী? তার মতই মানুষ? কিন্তু কই তাদের তো দেখা যায় না! যতই সে বড় হয়েছে, ততই তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে, এরা দুটো অশুভ আত্মা, তার মধ্যে আস্তানা শুধু গাড়েনি, দিন দিন দাপট বাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম রাতে ঘুমের মাঠেই তাদের দ্বৈরথ চললেও, একটা সময় দিনের আলোতেও তাদের লড়াই শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আজ যে ঘটনাটা ঘটল, তেমন তো আগে ঘটেনি! তাহলে কি ওদের কারো ছবিই ফুটে উঠেছিল তার …..! আর ভাবতে পারে না নাইম, পায়ের নীচের মাটিটা দু’ভাগ হয়ে হঠাৎ দেবে যেতে শুরু করে!
৪.
ধরা যাক, রাস্তার ধারে একটি কৃষ্ণচুড়া আপাদমস্তক সিঁদুর মেখে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও এতটুকু জায়গা ফাঁকা নেই আর। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকবে নাইম। ধ্যানমগ্ন মুনীর মত সে চোখ দুটো জড়ো করে জড় হয়ে পড়বে! আবার, কোন অপূর্ব নকশাকাটা দালান, তাও টানবে তাকে জন্মজন্মান্তরের বাঁধন ছাড়িয়ে! বলতে কী, পাতা বা পাথর দুই-ই সমান করে টানে তাকে। কিন্তু এখানেও সে এক দর্শক, তার কাজ যেন শুধু দেখে যাওয়া, আর ভাল লাগা! এভাবেই হয়ত তার ভাল লাগত ফুটফুটে কোন মেয়েকে। সে দেখত আর চলে যেত। কিন্তু একজন জীবন্ত মানবী পাথরের মত নয়; সেখানে জীবন্ত সাড়া থাকে, বিধি বিধান থাকে – আর এসব যেন অজানাই ছিল নাইমের। তাকে কখনো যেচে আলাপ করতে দেখা যায়নি কোন মেয়ের সাথে। অথচ সেও তো একজন জীবন্ত প্রাণী, সেও তো একটি মেয়েকে নিজের করে নেয়ার জন্য যত প্রকার বুজরুকি আছে, প্রয়োগ করতে পারত। কিন্তু নিজে থেকে মন্ত্র পড়া, তাকতুক তো দূরের কথা, কোন মেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হলেও সেই সংকেত কখনোই পৌঁছুতো না তার বন্দরে। আসলে সে তো একজন দর্শক, সে তো চলচ্চিত্রটি উপভোগ করতে এসেছে, অ্যাক্টিং করতে নয়!
কিন্তু এই দর্শকের যেন একদিন রূপান্তর ঘটল। মেয়েটি রাস্তা পার হচ্ছিল, আর তার হাতের ছাতাটা থেকে ঝমঝম করে যেন আর এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে, একটু আগের বৃষ্টিকে অবিকল অনুকরণ করে! মেয়েটি চলে যাওয়ার পর নাইমের মনে হল, এক টুকরো মেঘের ভেলা তার চোখের সামনে দিয়েই যেন বয়ে গেল! আর এই পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল, একজন দর্শক একটি মেঘের ভেলার সৌন্দর্যে বিমোহিত হতেই পারে। কিন্তু ব্যপারটা এরপর অন্যরকম ঘটল। মেয়েটি যেন এসেছিল এতদিনের একটা শৃঙ্খল ভেঙে দিতে। তাই নাইমের মনের কোণায় মেয়েটি রয়ে গেল না শুধু, সারাটি দিন ধরে তাকে জ্বালাতে লাগল। যে নাইম ছিল একজন ওয়ার্কেহোলিক, সে-ই কাজে-কর্মে ভুল করতে লাগল, কাজের মাঝপথেই বারবার উঠে যেত লাগল, বারান্দার শিকগুলো ধরে বাইরে তাকিয়ে রইল - আবার যদি দেখা মেলে!
প্রতিদিন রাস্তায় এমন লক্ষ লক্ষ মেয়ে যাতায়াত করে, আবার এমন লক্ষ লক্ষ ছেলে তাদের দেখেও। আর তারপর তারা হারিয়ে যায়। দুনিয়াটা এভাবেই চলে একটা সুনির্দিষ্ট পাঁকে। কিন্তু ঐ যে আগেই বলা হয়েছে, মেয়েটি যেন নিয়মকে ভেঙ্গেচুড়ে দিতেই দর্শন দিয়েছিল, আর এমন কাউকেই সেই দর্শন যে কিনা নিয়মের পাঁকে থেকে শুধু দেখেই যাচ্ছিল, যার ছিল না আর কোন স্পন্দন, ঝাঁকুনি! একদিন যখন মেয়েটিকে জানালায় দেখেই এতদিনের সমস্ত ঝাঁকুনিকে ফিরিয়ে আনল নাইম আর বিদ্যুত বেগে টপকাতে লাগল সিড়ি, তখন অফিস সুদ্ধ লোকই উল্টো দর্শক হয়ে পড়ল! প্রবল ধড়ফড়ানি হচ্ছিল নাইমের - যদি না পায়, না পায়! কিন্তু মেয়েটি যাকে জানালায় হাঁটতে দেখা যাচ্ছিল, সে-ই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তাটার মাথায়। নাহ, কোন কেনাকাটা নয়, বা, কোন যানবাহন ভাড়া করার আয়োজন নয়। স্রেফ সে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে-মুখে কোন টেনশানের ছিটেফোটাঁও নেই। মনে হচ্ছে, সে যেন জানে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে, আর সাতসমুদ্দর পেরিয়ে আসা মানুষটিকে দর্শন দেয়া তারও যেন একটা দায়িত্ব!
একজন মানুষ দর্শক থেকে নায়কে রূপান্তরিত হলে কী কী ঘটতে পারে? অনেক ওলটপালট, অনেক হুজ্জুৎ – এর কোন কিছুই অবশ্য ঘটল না নাইমের জীবনে। সে অফিস করতে লাগল মন দিয়ে, আর রাতে বাসায় ফিরে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে আলাপ করতে লাগল রীতার সাথে। আর এ করতে নিয়ম ভাঙতে তো হল না, কারণ না ঘুমানোটাই হয়ে উঠেছিল তার জীবনের সব থেকে সুস্থির নিয়ম! ছুটির দিনে তারা যখন রমনার লেকের ধারে হাঁটত, তখনো তারা শুধু হাত ধরাধরিটুকুই করত, আর এতে তো দুনিয়ার কোন কিছুই বদলে যেত না, কোন ঝাঁকুনি লাগত না পৃথিবীর পুরু পর্দায়।
কিন্তু পর্দাটা একদিন কিছুটা হলেও কেঁপে উঠতে দেখা গেল, যখন নাইমের ভেতরটা খুব করে মোচড়াতে লাগল। হ্যাঁ, একটুখানি ছুঁয়ে দেখার জন্য, প্রেয়সীর সোনালী ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে নিজের তপ্ত আর ঝলসানো ওষ্ঠদ্বয়কে খানিকটা ভিজিয়ে নেয়ার জন্য। রীতার দিক থেকে কোন নিষেধ ছিল না, বিধিকে লঙ্ঘনের এই চুড়ান্ত মুহূর্তটির দিকেই মনে হয় সে চেয়েছিল এদ্দিন। মনে আছে, ভীষণ এক উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিল নাইম। রীতার দেহটা নিজের লোমশ বুকের সাথে মিশিয়ে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এত কাছেকাছি ছিল তারা যে দুজনের ঘন নিঃশ্বাস-বাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে উঠছিল বায়ু, আর হঠাৎই কুয়াশা নামিয়ে দিয়েছিল চোখের সামনে সেই দিনের আলোতে, রমনার পাকুড় গাছটার গভীর তটে! তবে সেই অন্ধকারেই নাইম দেখে নিতে পারছিল রীতার মুখখানা, আর তারপর প্রায় উন্মত্তের মত চুম্বন রেখাটি এঁকে দিতে যাচ্ছিল! কিন্তু …কিন্তু… ঠিক সে সময়টিতেই যেন কেউ কথা বলে উঠল, ‘কী করছ! কী করছ! সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে! শেষ হয়ে যাবে!’
৫.
সারাজীবনই নাইম এই ব্যাপারটির মধ্য দিয়ে গিয়েছে, মানে, তার টিচাররা বলত, সে শ্রুতিধর, সব কিছু মনে রাখতে পারে। অন্যদিকে তার গার্জেনরা জানে যে, সে কিছুই মনে রাখতে পারে না। এতটা বড় হয়েও সে বলতে পারে না গাছের নামটা, বা, ফুল, পাখি, মাছ, পতঙ্গ – এদের শুধু সে শ্রেণীটাই চেনে, নাম বলে দিলেও সে ভুলে যায়। তবে সেই মাছ দু’টোকে সে কখনই ভুলতে পারেনি, ওদের চোখ জোড়াও যেন এক নীরব দর্শক, সব সময় সাথে সাথে থাকে!
সামনে বসা ডাক্তারটি অবশ্য মাছ দু’টির কাহিনিকে বিশ্বাস করছেন, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ মুহূর্তে তার চোখদুটো গভীর মনযোগের সাথে নিবদ্ধ নাইমের উপর। সেই চোখে শুধু দর্শক না, একজন গভীর সংবেদনশীল মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। সেদিনের মধ্য রাস্তার ঘটনাটার পর নাইম নিজেই একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে খুঁজতে শুরু করে। বদ্ধ পাগলের খেতাব থেকে বাঁচতে সাইকিয়াট্রিস্টের একটা সার্টিফিকেট খুব দরকার পড়েছিল তার। তারা জানাই ছিল, সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে ডিপ্রেশানের হালকা একটা ট্রিট্মেন্ট দেবে, প্রথমেই চরম কোন মেডিকেশান শুধু যে এদের বিদ্যারই বিরোধী, তা নয়, একই সাথে এদের গৌরবের সাথেও সংঘর্ষ করে। নাইম তাই খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে, আর গল্পগুলোকে এমন করে রসিয়ে বলে যেন এগুলো নিছক গল্প বলেই প্রতীয়মান হয় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে।
‘আচ্ছা, মাছ দুটো কথা কয়ে উঠছিল বলে মনে হয় আপনার, কিন্তু কী কথা বলেছিল তারা,মনে আছে?’ ডাক্তার সদ্য আসা মেসেজটায় চোখ বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞাসা করেন।
‘খুবই বিচিত্র এক স্বরে কথা বলেছিল তারা। একটা শব্দও বোঝার উপায় ছিল না। সেই শীতল, বীভৎস, আর অশরীরি স্বর -মনে পড়লে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে আমার, গা ছাপিয়ে জ্বর আসে!’ খুব শান্ত কিন্তু ভয়াল একটা কণ্ঠে কথাটা বলে নাইম তাকায় সাইকিয়াট্রিস্টের দিকে। মাছ দুটির কথাগুলি ভাল করেই মনে আছে তার। কিন্তু আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি সে কথা, আজ ডাক্তারকে বলে দিয়ে ওদের কাছে করা শপথ ভঙ্গের কোন ইচ্ছে নেই তার!
‘আর সেদিন রাত থেকেই দুটো আলাদা মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করে আপনার মস্তিষ্কে, এদের একজন চায় ঘুম পাড়িয়ে রাখতে, আর একজন জাগিয়ে? আচ্ছা, রাতে বিছানাতেই শুধু এদের আগমন ঘটে, তাই না?’ কিবোর্ডে খচখচ করে কী যেন লিখছিলেন ডাক্তার, সেই অবস্থাতেই প্রশ্নটা তীরের মত করে উড়ে আসে নাইমের দিকে।
‘হ্যাঁ, প্রথম প্রথম রাতেই হত ব্যাপারটা। কিন্তু পরে তো দিনেও হয়েছে, যেমন খুব বাথরুম চেপেছে, দৌঁড়ে গেছি, কিন্তু সক্রিয় হয়ে উঠেছে অন্য মানুষ, তারপর আর কিছুতেই বেরুচ্ছে না।‘ খুব দ্রুততার সাথে বলে থেমে যায় নাইম। ক্ষোভে থমথম করছে মুখটা তার। ডাক্তারের ইঙ্গিত বুঝতে ভুল হয়নি তার। পুরো ব্যাপারটিকেই রাতের ভ্রমের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। বিষয়টা এতটা অপমানজনক মনে হয় তার কাছে যে সে ভুলে যায় যে, একটি গল্পই বলতে এসেছিল সে, আর কিছু নয়।
‘হ্যাঁ, ব্যাপারগুলো এভাবেই আস্তে আস্তে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে।‘ আবারো ল্যাপটপের পর্দায় থেকেই উত্তর দেন ডাক্তার।
‘না, আপনি যেরকম ভাবছেন, ব্যাপারটি সেরকম না!’ কথাগুলি বলে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে নাইম। রাগে কপালের রগগুলো সব ফুলে উঠতে থাকে তার!
৬.
চেম্বারটা থেকে বেরিয়ে যখন উদ্দেশবিহীনভাবে হাঁটতে থাকে সে, একটা সময় রাগটা পড়ে যায়, আর একটা আফসোসের নিম্নচাপ ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। আহা! সাইকিয়াট্রিস্ট তো তার ভাবনা মতই এগুচ্ছিল, তার দরকার ছিল একটা ডিপ্রেশানের প্রেসক্রিপশান, যা দেখিয়ে সে দুনিয়াকে বলতে পারে যে, সে অন্তত একটা সাইকো নয়! আর সামান্য ডিপ্রেশান-টিপ্রেশান এ যুগে কার না হয়!
কিন্তু …কিন্তু …নাহ্, আর ভাবতে পারছিল না সে!হঠাৎ মাথাটা চেপে ধরে রাস্তার ধারের একটি যাত্রী ছাউনিতে বসে পড়ে! একের পর এক বিচিত্র সাজের ও সাইজের মানুষ যাচ্ছিল তার সামনে দিয়ে। হঠাৎ একটা পুঁচকে ছেলেকে চোখে পড়ল, সিগারেটের পলিথিন কাঁধে ঝোলানো। নাইমে ওকে থামিয়ে একটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বার কয়েক টেনেও একটা ধোঁয়া বের করতে ব্যর্থ হয়। অন্য সময়ের এই প্রিয় খেলাটা এখন মোটেই ভাল লাগছে না। মাথাব্যথাটা চিনচিন করে বাড়ছেই। সেই অবস্থাতেই হাঁটতে শুরু করে সে আবার।
কতগুলি রাস্তা, আর গলি পেরিয়েছিল, মনে পড়ে না। এত এত যানবাহন আর মানুষকে সে কিভাবে অতিক্রম করেছিল, তাও মনে পড়ে না। শুধু এটুকুই তার মাথাতে আছে যে, সে একটি পুরনো ঘিঞ্জি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, স্যাঁতসেতে আর কালিঝুলি মাখা সেই বাড়িটি তার খুব খুব চেনা। মূল ফটক পেরিয়ে সিড়ি বেয়ে সে উঠে যায় তেতলায়। আর সেখানে ডান কোনের ফ্লাটটির খোলা দরজায় নিজের বাহুটা গলিয়ে দিয়ে একটি মেয়ে এমন একটি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিল, যেন সে নাইমের জন্যই অপেক্ষা করছে! আর মেয়েটিকে নাইমেরও চেনা মনে হয়, তাই তো সে সোজা ঢুকে পড়ে অন্দরে আর সটান শুয়ে পড়ে বিছানাটিতে, একটুও ইতস্তত না করে!
রিতা তার ছোট ভাইকে নিয়ে থাকে এই ফ্লাটটিতে। আজ শুক্রবার, তাই রিতা বাসাতেই। আর ভাইটি মাঠে, শুক্রবারের ক্রিকেট ম্যাচ যার কখনোই মিস্ হয় না। রিতার কোলে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল নাইম, কী এক যাদু যেন রয়েছে রিতার হাতে! আস্তে আস্তে কমে আসছে ওর মাথা ব্যথাটা। এই শুক্রবার সাক্ষাৎটা প্রায়ই হয় তাদের, রীতার বাসাতেই বেশি ঘটে। আর রীতার হাতের রান্না খেয়ে গল্প গল্প করতে করতেই ছুটির অবসরটা কেটে যায়। কিন্তু আজ কী হল! হঠাৎ মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাইমের, আর সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কোল থেকে উঠে জাপটে ধরল রিতাকে। সেদিনের চুমুর ব্যর্থতাটা স্মৃতির অতল থেকে দলা পাকিয়ে উঠল দুবলা দুবলা হয়ে। হ্যাঁ, নাইম জানে আবারো হয়ত তার সঙ্গী মানুষ দুটো চলে আসবে আর তাকে কাবু করে দিতে চাইবে। কিন্তু আজ কোন বাঁধনই মানবে না! তার পৌরুষের ক্ষুধা চিবিয়ে চিবিয়ে মেটাবে!
কিন্তু প্রবল একটা আর্তচিৎকার হঠাৎ করেই তাকে হতবিহবল করে দেয়, আর কী হল বুঝতে পারার আগেই রীতাকে চিৎকার করতে করতে দরজার দিকে দৌঁড়ুতে দেখে সে। কাপড়চোপড়গুলি এলোমেলো ছিল, সেগুলোও ঠিক করার কথাও মনে নেই মেয়েটির! নাইম এতটাই বিষ্মিত হল যে মুখ দিয়ে কোন কথা সরল না! বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে রইল হাট হয়ে থাকা দরজাটার দিকে। হ্যাঁ, সে জানোয়ারের মত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রিতা তো বাঁধাও দেয়নি! তাহলে কী হল! কী হল!
৭.
‘এমনটাই যে হয়েছে কিভাবে বুঝলেন?’ ডাক্তারের চোখে সেই আগের সংবেদনশীলতা। সেদিনের অপমানটা হয় স্মৃতি থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন, অথবা ঢুকতেই দেননি স্মৃতির ঘরে।
‘না…না…ওর সাথে পরে মোবাইলে যোগাযোগ হয়! আমি সম্বিত ফিরে পেতেই খুঁজতে শুরু করি। প্রথমে দালানটির ঘরে ঘরে টোকা মারতে থাকি! কোন উত্তর না আসায় পরে রাস্তায় নেমে পড়ি। ওর ভাই পাড়ার যে মাঠটিতে ছিল, সেখানেও ধর্ণা দেই। কিন্তু ভোজবাজির মত হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল সে! এক সময় অবশ্য ওর বাসায় ফিরে আসি, আর দেখতে পাই দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো। দরজাটা ভাঙতে শুধু বাকী রেখেছিলাম। কিন্তু কোন সাড়া আসছিল না। এক সময় যখন ওর ভাই ফিরে আসে, আর সে ভাইকে ঢুকিয়েই আমার মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দেয়, আমি বুঝতে পারি যে, তার জীবনে আমার সব প্রয়োজন ফুরিয়েছে!‘ শেষের দিকে গলাটা কেঁপে উঠে নাইমের!
‘তা কখন ফোনে তার সাথে যোগাযোগ হল?’ খুব নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেও সুক্ষ্ম বিদ্রুপ আর অবিশ্বাসটুকু ঠিকই ঝরে পড়ে ডাক্তারের কণ্ঠ থেকে।
কিন্তু সেদিকে খেয়াল করার সময় ছিল না নাইমের, অস্থির কণ্ঠে বলে উঠে, ‘পুরোই ভেঙে পড়েছিলাম আমি! নিজের বাসায় ফিরেও স্থির হতে পারছিলাম না। পাগলের মত কল করে যাচ্ছিলাম ওকে, একটার পর আরেকটা। ওকে ফিরে পাওয়ার কোন আশাই আর ছিল না। শুধু কেন সে এমনটা করল, কী আমার অপরাধ - তা জানতেই হয়ত এমন উন্মত্ত আচরণ করছিলাম আমি! এক পর্যায়ে অবশ্য সে ফোন রিসিভ …’
‘তো ফোন রিসিভ করে সে বলল যে, আপনার মত একটা কামুক লোকের সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না আমি?’ ডাক্তারের ঠোঁটের কোণে যেন এবার একটা সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠে।
কিন্তু নাইম আজ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল, ডাক্তারের বিদ্রুপকে তার উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করতে দেবে না। তাই সে শান্তকণ্ঠেই উত্তর দেয়, ‘না…না…ও এমন কিছুই বলেনি… আসলে ওর কথা তো খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল…ও বলল..’
‘কী বলল…?’ ডাক্তারের কথায় রহস্যের টান। যেন প্রবল এক রহস্য মুভি দেখছেন, তেমনি ঘোর তার চোখে।
‘ও বলল…বলল…আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? আমার পেছনে লেগেছে কেন? কী ক্ষতি করেছি আপনার? কী চান আমার কাছে?’ এক নিঃশ্বাসে বলে হাঁপাতে লাগল নাইম। ওর সারা শরীরটা থরথর করে কাঁপছে তখন!
৮.
গভীর রাত। বিশ্বচরাচর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু ডাক্তারের লাইব্রেরি রুমটা টেবিল ল্যাম্পের কারণে ঈষৎ আলোকিত। ড্রইয়িং রুমের ধার ঘেঁষে সেখানেই তার এক চিলতে পড়ার ঘর। তিনদিকের দেয়াল জুড়ে শুধু সেলফ, আর সেখানে থরে থরে সাজানো বই। বেশিরভাগই মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত। এছাড়া বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সাথে কিছু সাহিত্য ও দর্শনের বইও আছে। অনেক খুঁজে আজ একটি বই হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বেশীক্ষণ থাকা সম্ভব হয়নি সেখানে। কিছু রেফারেন্স নিয়ে তাকে অচিরেই পড়তে হয়েছিল ডেস্কটপটা নিয়ে, সেখান থেকে ইবুকগুলো যোগাড় করে শুরু করলেন পাতা উল্টাতে। আজ নাইম চলে যাওয়ার পরে বেশীক্ষণ আর রোগী দেখায় মন বসাতে পারেননি। কী যেন তাকে চরম বিচলিত করে তুলেছে! কিসের যেন একটা খটকা! তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এমন বিচিত্র কেইসের মুখোমুখি আর হতে হয় নি!
আচ্ছা এ কী সম্ভব? প্রকৃতিতে কাটল ফিস, স্কুইড, অক্টোপাসের মত দ্রুত বর্ণ পরিবর্তনকারী প্রাণী আছে, চন্দ্রমল্লিকার মত বহুবর্ণ পুষ্প রয়েছে; কিন্তু একটা মানুষের মধ্যে আরো মানুষ? ফ্রয়েডের থিয়োরিতে কন্ডেন্সেশান নামে এক প্রকার স্বপ্নবিকৃতির কথা বলা আছে, যেখানে স্বপ্নগুলো এমন করে বিকৃত হয় যে দুজন মানুষের প্রতিকৃতি একজন মানুষের মধ্যে চলে আসে। কিন্তু নাইম নামের এই যুবকটি তো কোন স্বপ্ন দেখছে না। আসলে ও তো ঘুমুতেই পারছে না, স্বপ্ন আসবে কোথা থেকে! তাহলে কি ডে ড্রিমিং? প্রফেসর খলিল এক পর্যায়ে মাথার চুলে আঙুল বুলাতে শুরু করলেন, খুব বেশী টেনশানে থাকলে এমন হয় তার। নাহ্, জিনিসটা ধরা দিয়েও দিচ্ছে না! ফ্রয়েড কেটে দিয়ে তিনি অনলাইন লাইব্রেরি থেকে টেনে নিলেন একটা জ্যোতিশ শাস্ত্রের বই।
যদিও এই দুনিয়ায় শরীরটাই একটা মানুষের সবটুকু, কিন্তু জ্যোতিষ শাস্ত্রে এই দেহটাকে ‘স্থূল দেহ’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এর বাইরেও এই শাস্ত্রমতে আছে আরো কতগুলি দেহ, যেমন, জীবদেহ, অনুভূতি দেহ, চিন্তাময় দেহ। প্রত্যেকটি দেহে আবার কল্পনা করা হয় কতগুলি কোষের অস্তিত্ব, যেমন, স্থূল দেহে অম্লময় কোষ, জীবদেহে প্রাণময় কোষ, অনুভূতি দেহে মনোময় কোষ, আর চিন্তাময় দেহে বিজ্ঞানময় কোষ। এই কোষগুলির কোন একটিতে ধাক্কা লাগলে বা কেঁপে উঠলে অন্যগুলিতেও তার সাড়া পড়ে যায়, ঢেউ ছুটে চলে তরঙ্গ থেকে তরঙ্গে। আর এই ঢেউয়ের পথ হিসেবে থাকে রাশি রাশি নাড়ি ও ইন্দ্রিয়। যেমন, প্রাণময় কোষের জন্য থাকে মোটর নার্ভ, যার মাধ্যমে চলা-ফেরা বা কথা বলার মত জীবদেহের প্রাণময় কাজগুলি ঘটে। আর মনোময় কোষে উপস্থিত থাকে সেন্সরি নার্ভ যার সাহায্যে শব্দ- গন্ধ- রূপ- রস-স্পর্শ ও সুখ-দুঃখকেন্দ্রিক অনুভূতি দেহের ক্রিয়াগুলি ঘটে। শেষমেষ, মস্তিষ্কের উচ্চকেন্দ্রের নার্ভ থাকে বিজ্ঞানময় কোষে; ফলে যুক্তি-তর্ক- বিচার-বুদ্ধির মত চিন্তাময় দেহের কাজগুলি অবাধে সংঘটিত হতে পারে। আশ্চর্য হল, দেহগুলির মধ্যে স্থূল দেহ যার একমাত্র বাহ্যিক অস্তিত্ব আছে, তার কিন্তু তেমন নিজস্ব কোন কাজ নেই, অন্য দেহগুলির সংকেত বহন করা ছাড়া। স্থূল দেহের আড়ালে অন্য দেহগুলি যেন কাজ করে যায় গোপনে গোপনে।
…. এ পর্যন্ত এসে খলিল সাহেব আবার থেমে যান, কিন্তু এবার চুলে আঙুল চালানোর পরিবর্তে মাথাটা চেপে ধরেন। ঐ অবস্থাতেই চিন্তাটা উদিত হয় তার মাথায়। আচ্ছা, নাইমের ঐ যে আলাদা দুটো মানুষ, সেগুলি আবার এই বইতে কথিত অন্য দেহগুলি নয় তো?
কিন্তু না…এখুনি কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসেনি। বস্তুত নাইমের মাথাতেই ঘটে চলেছে রহস্যজনক ব্যাপারগুলো। তাই ভেবেচিন্তে মানবমস্তিষ্কের উপর একটি জনপ্রিয় বই খুলে বসলেন খলিল সাহেব। আর লেখাটা যত এগুলেন, ঘেমে উঠতে লাগলেন। ক্লান্তিতে নয়, উত্তেজনা আর শিহরণে! বইটির এক জায়গায় লেখা আছে, মানুষের মগজের দুটি বিশেষ ধর্ম আছে, ইমাজিনেশান আর ইনিটিয়েটিভ, মানে, কল্পনা আর উদ্যোগ। যেভাবে রেডিওর ভালভ নিয়ন্ত্রণ করে ইলেকট্রেনের প্রবাহ বন্ধ করা যায়, জলের কলের ভাল্ভ নিয়ন্ত্রণ করে জলের প্রবাহ প্রশমিত করা হয়, আবার সাইকেলের চাকার ভালভ নিয়ন্ত্রণ করে বায়ুর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, ঠিক সেভাবে মানব মস্তিষ্কে অবস্থান করা ভালভগুলির সাহায্যে কল্পনা বা উদ্যোগকে থামিয়ে দেয়া যেতে পারে।
… এ পর্যন্ত এসে খলিল সাহেব বইটা থেকে মুখ তুলে ফেলেন, আর এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকেন বাঁয়ের জানালাটা দিয়ে আসা চাঁদের আলোর দিকে, আপাত অন্ধকার ঘরটিতে কেমন এক রহস্যময় বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে এই এক রত্তি কণা! এ সময় তার মনের কোণে ভীড় করে ছুটতে থাকে আরো অনেক প্রশ্নের কণা! নাইমের ভালভগুলিতে তাহলে কোন দুর্গতি দেখা দিয়েছে? ধরা যাক, ঐ মানুষ দুটির একজন ইমাজিনেশান, আরেকজন ইনিটিয়েটিভ। ভালভ যখন সচল ছিল তখন মানুষ দুটো নিয়ন্ত্রণে ছিল, সীমার মধ্যে ছিল অবস্থান। কিন্তু ভালব দুর্বল হয়ে যাওয়াতেই তার মস্তিষ্কের মাঠ দখলে উঠে পড়ে লেগেছে তারা? একদিকে কল্পনা উদ্যোগকে দুর্বল করছে, অন্যদিকে উদ্যোগ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে কল্পনাকে ঠেসে ধরছে?
এতক্ষণে কিছু একটা পেয়েছেন যেন – সেরকম একটা উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে খলিল সাহেব আবার বইয়ে মুখ গোঁজেন আর তরতর করে এগিয়ে চলেন সামনের চাপ্টারে। সেখানে বলছে, একটা রেকটিফাইয়ারের মাধ্যমে ডিসি বিদ্যুতপ্রবাহকে এসির মত একমুখিন করে তোলা যায়। আর এখানেই আসে ফিডব্যাক ও লুপের ব্যাপারটা। একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী বলেছেন, আমাকে ফিডব্যাক দাও, আমি তোমার জন্য পুরো একটা পৃথিবী বানিয়ে দেব। সার্কিটের মধ্য দিয়ে যেমন বিদ্যুতপ্রবাহ চলে, তেমনি স্নায়ুর মধ্য দিয়ে অনুভূতি প্রকাশিত হয়। যেমন, মানুষ যখন খাবার টেবিলে থাকে, তখন মগজের কাছ থেকে হাতের মাংসপেশীর কাছে বার্তা আসে যে, টেবিলের খাবার প্লেটে তুলতে হবে। কিন্তু এতেই কাজটা শেষ হয়ে যায় না। তুলতে গিয়ে কতটুকু কাজ হচ্ছে, তার আবার পালটা সংকেত যায় প্লেট থেকে মগজের কাছে। এটাই ফিডব্যাক, এই ফিডব্যাকের ফলেই মগজ আবার বদলি মেসেজ পাঠাতে পারে, আর এভাবেই সম্পূর্ণ হয় একটা লুপ বা চক্র। এভাবে মগজে কাজ করে যায় ফিডব্যাক সিস্টেম ভালভ ও রেকটিফাইয়ার নামক উপকরণের মাধ্যমে, বানিয়ে চলে অনবরত লুপের পর লুপ।
…আবার থামেন ডাক্তার খলিল, আর ডেস্কটপের মেনুবার থেকে নাইমের নামে খোলা ওয়ার্ডফাইলটা বের করে ছোট্র করে নোট লেখেন, ‘লুপ সিস্টেম সিরিয়াসলি ড্যামেজড্।‘
এরপর কিছু পৌরনিক সূত্র নিয়ে বসেন প্রফেসার সাহেব। যদিও আধুনিক বিজ্ঞান এসব বিশ্বাস করে না, কিন্তু পুরাণে তো এমন ঢের নজীর আছে যে, এক মানুষের মধ্যে একাধিক শক্তির অস্তিত্ব থাকে। প্রফেসার সাহেব লিখতে থাকেন, ’হ্যাঁ, বিষয়টা হয়ত প্রতিকি,পুরাণে যেভাবে আছে সেভাবে হয়ত ঘটে না। কিন্তু এটা হয়ত অস্বীকার করা যায় না যে, বিভিন্ন শক্তির সন্নিবেশ ঘটে মানবদেহে আর মানব মস্তিষ্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে থাকে তারা, আর সব মিলিয়ে একটি নির্দিষ্ট অবয়ব ফুটে উঠে মানুষের। কিন্তু নাইম নামক ছেলেটির মধ্যে সেই শৃঙ্খলা নিশ্চিতভাবেই ধ্বংসপ্রাপ্ত। ওর ভেতরকার শক্তিগুলো নিয়ন্ত্রণবিহীন হয়ে আন্তকোন্দলে লিপ্ত, যার প্রভাব পড়ে হতভাগ্য ছেলেটির স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রণালীতে। মানুষের জীবনে যেখানে ব্যাপক জটিল সব জীবনযুদ্ধ বিদ্যমান, সেখানে এই ছেলেটি একান্তই স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মগুলিতে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। ঘুম, রেচন, বা, যৌনক্রিয়ার মত সাধারণ কাজগুলিতে এমন অব্যাহত বিপর্যয় তাকে খুব শীঘ্রই বদ্ধ উন্মাদে রূপান্তরিত করতে পারে। এটা সেই অবস্থা যখন সনাতন সমাজপতিরা মানুষকে চেইন দিয়ে বদ্ধ করে রাখার বিধান দিত। ছেলেটিকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে যেভাবেই হোক তার মধ্যে রেকটিফাইয়ারের কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? কিভাবে??????’
৯.
নিশুতি রাত। কিন্তু নাইমের বিছানাটা খালি পড়ে আছে। ও পায়চারি করছে শুধু। হিংস্র পশুর মত চেহারা। ইদানিং ওর অন্য মানুষগুলো আরো জাঁকিয়ে বসেছে। দৈনন্দিন প্রতিটা কাজেই তাদের সরব উপস্থিতি। যেমন, ক্ষুধায় পেট চো চো করতে থাকে। কিন্তু খাওয়া মুখে তুলে নিতে গেলেই কে যেন থামিয়ে দেয়, আর বলে, ‘সব বিস্বাদ, অখাদ্য।‘ মাঝে মাঝে তো শ্বাস-প্রশ্বাসেও হানা দেয় তারা, আর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চায়। এছাড়া ইন্দ্রিয় শক্তিগুলোও বিকল হতে শুরু করেছে! ঘ্রাণ নিতে চাইলে ঘ্রাণ পাচ্ছে না, শুনতে চাইলে কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দেখতে চাইলে চোখের সামনে একটা ঘোলাটে পর্দা এসে হাজির হচ্ছে! মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছে হয়, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে। বা, ঝুলে পড়ে ফ্যানের সাথে। কিন্তু মুক্তি নেই সেখানেও। কেউ যেন শেষমুহূর্তে ওকে টেনে ধরে, এগুতে দেয় না এক পাও। নিজেকে ইদানিং একটা জীবন্ত কংকাল ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না সে! পড়ার টেবিলটা আর নিজের অস্তিত্বটার মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পায় না সে!
১০.
বেশ কিছুক্ষণ ধরেই কলিং বেল বাজছিল, ঘুমের ঘোরে প্রথমে টের না পেলেও এক সময় কাঁচা ঘুম নিয়েই বিছানা থেকে নেমে পড়ে রিতা। এই ভর দুপুরে এক এল! প্রবল এক বিরক্তিতে চোখ মুখ বিকৃত আকার ধারণ করতে থাকে তার! দরজার আয়নায় এক অদ্ভুত দর্শন বৃদ্ধের মুখ দেখতে পেয়ে বিরক্তিটা ভয়ে রূপান্তরিত হয়। খুলবে কি, খুলবে না চিন্তা করতে করতে শেষমেষ দরজাটা সামান্য ফাঁক করে সে, আর সঙ্গে সঙ্গেই ওপার থেকে ভেসে আসে একটা মমতায় পরিপূর্ণ স্নিগ্ধ স্বর, ‘মা, তুমি কি রিতা?’
প্রফেসর খলিল রিতার অনুমতি না নিয়েই এক সময় ঢুকে পড়েন ঘরটিতে, তারপর টেবিলের জগ থেকে নিজেই গ্লাসে পানি ঢেলে ঢোক ঢোক করে গিলতে থাকে। পরিস্থিতির ধাক্কায় বজ্রাহত রিতার মুখে কোন কথা যোগায় না। এক পর্যায়ে খলিল সাহেব একটি চেয়ার টেনে নিয়ে রিতার সামনে বসে পড়েন আর বলতে থাকেন, ‘তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে, মা। আশা করি, এই বৃদ্ধের কথা শোনার মত কিছুটা সময় তোমার হবে!‘
১১.
নাইমের ছোট্র ঘরটি আজ হঠাৎ করেই কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে। তবে খুব বেশী মানুষ নেই। নাইম, ওর এক বন্ধু, রিতা, রিতার ভাই, আর প্রফেসার খলিল। এছাড়া একজন টুপি পরিহিত হুজুর, হাতে একটা রেজিস্টার। রিতার পরনে একটা লাল কাতান শাড়ি। কোন মেকাপের বাহার নেই। তাতেই অবশ্য তাকে স্বর্গের অপ্সরার মত লাগছে!
নাইমকেও একটা পাঞ্জাবি পরানো হয়েছে। কিন্তু ওকে দেখে কেউ বলবে না যে, সে-ই বর। শুকনো মুখ, চিমসানো দেহ, মুখ ভর্তি দাঁড়ি, রুক্ষ ও ঝুলিমাখা চোখ, অনেক চেষ্টাতেও তাকে সভ্য করে তোলা যায়নি। একটা সময় নাইম ও রিতাকে মুখোমুখি বসিয়ে হুজুর হাতের খাতাটা উল্টাতে শুরু করেন।
সব কিছু নির্বিঘ্নে চলছিল। এক পর্যায়ে কবুল বলতে আহবান জানানো হলে এতক্ষণ মাথাটা নীচু করে রাখা রিতা মুখটা সামান্য তুলে এক নজর তাকায় তার হবু স্বামীটির দিকে। আর তারপরে সেই চিৎকার, হাড়কাঁপানো, কলজে নাড়ানো - যা রাস্তা থেকেও পথচারীদের কানে আসে! উপস্থিত সবাই অবশ্য তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু ততক্ষণে চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে মেয়েটির!
১২.
নাইমের অবস্থা আরো খারাপ দিকে টার্ন করেছে। আগে নিজেকে কংকাল আর জড় পদার্থ মনে হত তার। আর এখন চারপাশের মানুষেরও তাই মনে হয়। সে শুধু চেয়ে থাকতে পারে, তাও অল্প কিছু সময়ের জন্য। সমস্ত জৈবিক ক্রিয়াকর্ম আপাতত ক্লিনিক্যাল সিস্টেমে চলছে। প্রফেসর খলিল কেন জানি ছেলেটার প্রতি তীব্র একটা মায়া অনুভব করছিলেন, তাই নিজেই ওর জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছেন হাসপাতালের একটি কেবিনে নিবিড় চিকিৎসার ব্যবস্থা। তিনি হাল ছাড়ার মানুষ নন। না হলে সেদিনের বিপর্যয়ের পর তো আশার কোন কারণ পৃথিবীর সব থেকে আশাবাদী মানুষেরও থাকার কথা না!
তার কাছে মনে হয়েছিল, রিতার সাথে নাইমের বিয়েটা একটা রেকটিফাইয়ারের কাজ করবে। ওই দুই মেল ফাংশান, নাইমের চোখে দুই মানুষ, বিদেয় হবে, বা, প্যাভিলিয়নে ফেরত যাবে। কথাগুলি যখন তিনি রিতাকে বুঝিয়ে বলছিলেন, তখন তার মনে অবশ্য খুব একটা আশা ছিল না। কোন মেয়েই বা জেনে শুনে এমন একটা পাগলকে বিয়ে করতে যাবে? নাইমের ভাল হয়ে যাওয়াটা তো শুধুই একটা সম্ভাবনা ছিল; বলা যেতে পারে, ফিফটি ফিফটি চান্স। কিন্তু প্রফেসরকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি প্রথমে অনর্গল চোখের জল ফেলল, আর তারপর শান্ত কণ্ঠে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘আপনি যদি মনে করেন, ভাল হয়ে যাওয়ার সম্ভানা আছে, তাহলে এইটুকু তো করাই উচিৎ।‘
কিন্তু যা ঘটল তার জন্য নিজেকেই দোষ দেন খলিল সাহেব। নাইমের অবস্থা আরো জটিল আকার ধারণ করেছিল, আর তা তার অজ্ঞাতই ছিল। ওর মধ্যে এ কদিনে আর দু’টো মানুষ না, বরং আরো অনেক মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল। আর তারা একসাথে আসতে শুরু করেছিল, আগের মত একজনকে সরিয়ে আরেকজন না। রিতা যখন বিয়ের আসরে ওর দিকে তাকিয়েছিল, তখন নাইমের মুখে একই সঙ্গে অনেকগুলো মানুষের ছবি ফুটে উঠেছিল। আর কী যে সেই বিভীষিকাময় রূপ! যেন একটা জীবন্ত নরক চোখের সামনে!
খলিল সাহেব অবশ্য এই অনেক মানুষের ব্যাপারটা এখনো পুরো বুঝে উঠতে পারেননি। এই অতিরিক্ত মানুষগুলো এল কোথা থেকে? মৃতদের থেকে? যদি নাইমের মাঝে তারা থাকে, তাহলে সব মানুষের মধ্যেই তো রয়েছে, হয়ত সুপ্ত অবস্থায়। কিন্তু পৃথিবীর সব যুগের সব মানুষ যোগ করেও কি প্রতিটা মানুষের সাথে এতগুলি বাড়তি মানুষের ইক্যুয়েশান মেলান যায়? তাহলে কি অন্য মানুষগুলি অন্য প্রাণী? বা, উদ্ভিদ? বা, অন্য কোন শক্তি? আলো, বায়ু? যাদের অভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে? আচ্ছা, যদি নাইমের ক্ষেত্রে এই অনেক মানুষের থিয়োরিটা সত্যি হয়, তাহলে এই মানুষগুলো আর সুপ্ত থাকছে না, বেরিয়ে পড়তে চাইছে। কিন্তু কী করে পূরণ হবে তাদের ইচ্ছে? নাইমের বংশ বিস্তারের মাধ্যমে? কিন্তু প্রকৃতি কি তা হতে দেবে? সহ্য করবে এই বিশৃঙ্খলা?
১৩.
রাত প্রায় ভোর হয়ে উঠেছে। কেবিনে নাইম একা। ডাক্তার অনেক আগেই বিদায় নিয়েছেন। হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষুধ সেবন করিয়ে নার্সও বিদায় নিয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে জেগে উঠছে নাইমের চোখ দুটো। আর রিখটার স্কেল দশকে ছাড়িয়ে কাঁপছে ওর সারা শরীর। জ্বর এমন তীব্র হয়ে উঠেছে যেন পুরো কেবিনটাতে তার ধোঁয়া উঠছে! চোখ মুখ সারা শরীর ফুলে ভয়ানক আকার ধারণ করছে। ওদিকে নাইমের ভেতরটা কিন্তু জুড়িয়ে যাচ্ছে এক অদ্ভুত শীতলতায়; যে মানুষগুলি দিন রাত তাকে জ্বালিয়েছে, তারা যেন ছেড়ে যেতে শুরু করেছে ওকে একে একে! অনেক অনেক দিন পর, ওর মনে হচ্ছে, ও আর জড় পদার্থ নয়, একটি স্বাধীন সত্তা। ওর মন হঠাৎ চলে যায় শৈশবের সেই মাছ দুটির কাছে। ওদের রয়েছে এক অপরূপ করুণ গল্প! সেই গল্পটা এখন পর্যন্ত কাউকে বলেনি সে। গল্পটা আবার শুনতে থাকে সে, আর সেই সময়টির মতই বিমোহিত হতে থাকে!
( সমাপ্ত)
………………………………………………………………………………..