ভেবে দেখলাম আটল্যান্টিক এর এপারের খাবারের গল্প তেমন লেখা হয় না খুব একটা। তাহলে কি চাষা যায় না আমেরিকা? মাঝে মাঝেই তো যায়! তো এই পর্বে ভাবলাম মাস দুয়েক আগের ডেনভার এবং হিউষ্টন ঘুরে এসে খাবার অভিজ্ঞতা কিছুটা ভাগ করে নেওয়া যাক। এক পর্বে তো আর হবে না, সুযোগ পেলে পরে না হয় আবার লেখা যাবে। যখন ডেনভারে পোঁছলাম তখন সেখানকার তাপ মাত্রা মাইনাস আট-এর কাছে ঘোরাফেরা করছে রাতের দিকে – তারপর সেখান থেকে হিউষ্টন এলে প্রবেশ করলাম ২৩ ডিগ্রীর কাছাকাছি। তো এই তাপমাত্রা প্রভেদের সাথে খাবার উপভোগের কি কোন সম্পর্ক আছে? আমার কাছে তো অবশ্যই আছে – তবে সে গল্প অন্যদিন।
(১)
এই খাবারের নাম আমাদের গ্রামের আশে পাশের রেষ্টুরান্টে হলে হত, “নিমোর গবার ডোবার কালো ছাপ গোটা শোল মাছ”
এখানে যেহেতু আমেরিকার বিদেশী ব্যাপার স্যাপার, তাই নাম নাম রেখেছে রেষ্টুরান্টে “হোল আলামোসা কলোরাডো স্ট্রাইপড বাস”।
এই ডিসের নামের মধ্যে একদম চেনা শব্দ বলতে ‘হোল’। আমরা ছোটবেলায় যে জিনিকে হোল বলতাম, এটা সেটা নয় যদিও, এখানে সেটার মানে গোটা। আর অল্প চেনা শব্দের মধ্যে আছে কলোরাডো – আমেরিকার এক রাজ্যের নাম। স্ট্রাইপড মানে না হয় দাগকাটা সেটাও অনুমান করে নিলাম। কিন্তু পাতে মাছ এলে সেই মাছের চর্মরোগ ছিল কিনা বা তার গায়ে তিল ছিল কিনা সেগুলো কিভাবে বিচার্য হয় ভেবে পেলাম না! ‘বাস’ মানে এখানে মাছের প্রজাতি – যেমন সী-বাস, যাকে ভেটকি মাছ বলে বিদেশে বসবাসকারী বাঙালীরে আতুপুতু করে।
তাহলে বাকি রইল আলামাসো – সে কি জিনিস? গোটা সর্ষে দিয়ে ইলিশের মত হোল আলামোসা দিয়ে কি মাছটা জমবে নাকি? গুগুল সার্চ করা হল – ও হরি, আলামাসো হল এক জায়গার নাম কলোরাডোর পাশে। সেখান থেকেই মাছ ধরে আনা হয়েছে – আমাদের দীঘা/মন্দারমণি চিঙড়ির ভেড়ির মত কেস আর কি!
সেদিন মাছ খেতে ইচ্ছে করছিল বলে, ডেনভার শহরের এক আপস্কেল রেষ্টুরান্টে ডিনার করতে গিয়ে এটাই অর্ডার করলাম। কিন্তু সেই মাছ কি এমন ভাবে পাতে পরিবেশিত হবে সেটা ভাবতে পেরেছিলাম? এমন মাছ তো চাইনীজ রেষ্টুরান্টে খেয়েছি – পুরো ভাজা, যেখানে আবার মাছের চোখ কে খাবে সেই নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়।
এই অঞ্চলে, মানে রকি মাউন্টেইনের আশে পাশে তখন প্রচুর ঠান্ডা, মাইনাস ৬ থেকে মাইনাস ৭ ডিগ্রি ঠান্ডা চলছিল। ডিনারের আগেই কিছু লেকের আশে পাশে ঘুরে এলাম যেগুলো। সব জমে গেছে। নিজেকে প্রবোধ দিলাম এই বলে যে ঠান্ডায় মাছ ভাজা খুব একটা খারাপ হবে না!
আশেপাশের পাবলিক সব জমকালো ডিস খাচ্ছে, আর আমি গোটা মাছের গা থেকে ছাল ছাড়ালাম – বললাম, “কি দারুণ খেতে”! এর পর কাঁটা বেছে মাছের মাংস – গলায় কাঁটা লেগে গেল। কেউ শুনতে চায়নি, কিন্তু তবুও শুনিয়ে দিলাম সবাইকে যে মাছের কোন দোষ নেই, কাঁটা লাগার দোষ আমার নিজের, মাছের মাংস খুব সুস্বাদু। এই ভাবে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে মাছ পেটে চালান করলাম।
প্লেটের উপর মাছের পাশে আবার খয়েরী রঙের কি একটা লেপা আছে। কি জিনিস খেয়ে বুঝতে পারলাম না - মনে হয় যে চার দিয়ে মাছটা ধরা হয়েছিল, তারই কিছুটা প্লেটে মাছের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ছড়ানো আছে। ওই সেই মিশরেরে ফারাও-রা মারা যাবার পর তাদের সমাধিতে মমির সাথে তাদের প্রিয় জিনিসও কিছু রেখে দেওয়া হত - অনেকটা তেমনই আর কি!
এ জিনিস খেয়ে কি যে পেট ভরল সেটা বলাই বাহুল্য – পকেট থেকে মোবাইল বের করে সার্চ দিলাম ‘ম্যাকডোনাল্ডস’ – আমার গা হাত পা হিম করে দিয়ে সবচেয়ে কাছের ম্যাক ষোল মাইল দূরে দেখালো আর সাথে সাথেই বুঝে গেলাম আপস্কেলে জাতে উঠতে গেলে কিছু কিছু মূল্য তো চোকাতেই হয়!
(২)
খুবই নষ্টালজিক হয়ে উঠলাম এ জিনিস দেখে - অবশ্য তার বেশী আর কিই বা করতে পারতাম এই ঠান্ডায়!
ডেনভার শহরের হোটেল থেকে সেদিন যখন বেরুলাম বাইরের তাপমাত্রা তখন মাইনাস আট ডিগ্রী। এই ঠান্ডায় সব প্রায় সব কিছু জমে যাচ্ছে, মুখের চামড়া, ঠোঁট, ইয়ে - সব কিছু! হোটেল থেকে রেষ্টুরান্ট মিনিট দশেকের পথ। এর মধ্যে হাঁটতে গিয়ে শরীর গরম করার পদ্ধতি পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা করা যায় সব করলাম।
রেষ্টুরান্টে খেতে গিয়ে কি অর্ডার করলাম? সেই বড় ঝিনুকের মাংস। একবার খাবারের গল্প লিখে এর সমন্ধে ফীডব্যাক পেয়েছিলাম এই মর্মে যে - এরে কয় 'স্ক্যালপ' এবং খেতে নাকি খুব ভালো। তাই কপাল ঠুকে আবার অর্ডার করে সামনের প্লেটে এই জিনিস পেলাম!
কত স্মৃতি চলে এল মনে। সেবারে গ্রামের কার একটা বিয়ে খেতে গিয়ে দেখলাম সব কিছু ক্যাটারিং এর মাধ্যমে হচ্ছে। এক ছেলে শালপাতার প্লেটের মাঝখানে ঠকাস করে এক পিস ভেজিটেবল চপের মতন কি একটা দিয়ে গেল! পরে পরেই স্যালাড - দিলি দিলি, কিন্তু পাতের মাঝখানে?? এরা কি জানে না এমন জিনিস দিতে হয় পাতের সাইডে!
আমাদের ছোটবেলায় কারো শ্রাদ্ধ বাড়ি খেতে গেলে প্রথমেই পাতের কোণে বোঁটা সমেত বেগুনের ফালি যত্ন করে শুইয়ে দিয়ে যেত, সাথে দানা পোস্ত ছড়ানো শাকভাজা। পাতের কোণে থাকতেন তাঁরা - মাঝের জায়গায় আসল খাবার
সেদিন আমেরিকান রেষ্টুরান্টে এই প্লেটের কোণে ঝিনুকের মাংস আর ভাত দেখে মনটা খুশী হয়ে গেল। দেশের কেটারিং রীতি ভুলে গেলেও এরা মনে রেখেছে! ভাবছি পুরো প্লেটটাই খালি, এবার এখানে আসল খাবার আসবে।
ভাতের আকার দেখে আমি ধ্বন্দে পড়ে গেলাম - এ কি চাল? রত্না বা বাঁশকাঠিও তো এমন হয় না! তাহলে কি এগুলো ছোট কাঁকুড়ের বীচি? যে কাঁকুড় বড় হতে পারে না, তাদের বীজ এমনই হয়। টেনশন দূর করতে দাঁতে কেটে দেখলাম সেই চাল - আরে বীজ নয় তো! এ চালই বটে, কিন্তু অর্ধসিদ্ধ
প্লেট নিয়ে বসে আছি, তখনো সন্দেহ হয় নি। খেয়াল হল প্লেটের বাকি খালি জায়গায় আঁকাবুকি কাটা কেন?? তাহলে কি?
ভাবতে চাইছি না আর, এমন সময় পাশের জন প্রশ্ন করল আমায়,
- অ্যাই তুমি খাচ্ছ না কেন?
- না মানে আসল খাবার আসুক, সবে তো পাতের কোণে শাক পড়ল!
- আরো খাবার আসবে কেন?
- আসবে না?
- না, এই ডিসটাই তো তুমি অর্ডার করেছিলে!
- তাহলে খামোকা প্লেটের কোণে দিয়েছে কেন?
- হয়ত প্লেটিং এ স্টাইল আনতে!
আমি আর কিছু বলতে সাহস করলাম না! মুখ থেকে রাগে কি বেরিয়ে আসবে কে জানে!
মাইনাস আট ডিগ্রীর ঝাপটা মুখে নিয়ে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে ইয়ে টিয়ে করে শরীর গরম করে এসে এই শ্রাদ্ধ বাড়ির বেগুন ভাজার মতন পাতের কোণের ছলনা??
এখান থেকে বেরিয়েই কোথায় যেতে হবে বুঝতেই পারলাম - আশা করছি আপনারাও পারছেন!
(৩)
তার পরের দিন খেতে গিয়ে যা বুঝলাম - বিজনেস আইডিয়া থাকে তাহলে তাড়াতাড়ি সেটা বাস্তবায়িত করে ফেলবেন। না হলে ওই - "তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে" - এমন টাইপের ব্যাপার হয়ে যাবে! আপনি জানতেও পারবেন না পৃথিবীর কোন প্রান্তে কে আপনার বিজনেস আইডিয়ার অনুরুপ আইডিয়া নিয়ে অলরেডি প্রচুর ফুলেফেঁপে বিজনেস করে ফেলেছে। অবশ্য অন্যেরা করছে বলে আপনি করবেন না, এমন তো ব্যাপার নয়! তবে কিনা ওই যে, বিজনেসের ইউনিকনেস হারিয়ে ফেললেন আর কি!
সেদিন ওই হোটেল থেকে বেরিয়ে শহরের আশাপাশে ঘুরছি। আগেই বলেছি যে প্রচুর ঠান্ডা তখন। তো সেদিন আর অন্য ধরনের রেস্টুরেন্টে যাওয়া হল না, যেতে হয়েছিল এক ভারতীয় রেস্টুরেন্টে। গিয়ে বুঝলাম ভারতীয় না, নেপালি পাবলিক সেটা চালায় । যে সার্ভ করছে সে মেক্সিকান। তাকে 'ভিন্ডালুতে বেশী ঝাল হবে না তো!" জিজ্ঞেস করা আর পাঁচ টাকা দিয়ে লটারি কেটে কোটি টাকা পুরষ্কারের আশায় বসে থাকা একই ব্যাপার। যেতে হয়েছিল কারণ আমাদের সাথে একজন কাতারের পাবলিক ছিল যে ধর্মীয় কারণে হালালের জিনিসপত্র ছাড়া খায় না।
এবার আমেরিকায় প্রবলেম হচ্ছে শুধু মাংস হালাল দেখলেই তো হবে না, অনেক রান্নাতে ওয়াইন দিয়ে দেয় ওরা বা একই পাত্রে পর্কের পর হালাল চিকেন রান্না হচ্ছে, সেই রিস্কও থেকে যায়। তো যাই হোক সেদিন কলিগ বলল যদি খেতেই হয় তাহলে আমি একটু ভালোভাবে খেতে পারব কোন ভারতীয় রেস্টুরেন্টে যাওয়া হয়।
গেলাম আমরা সেই ভারতীয় কাম নেপালি রেষ্টুরান্টে। গিয়ে স্টার্টারে দেখি কি বাঙালি ঝাল মুড়ি! এটা দেখে প্রচন্ড নস্টালজিক হয়ে গেলাম। কেননা আমাদের নিমো গ্রামের দুটো বিখ্যাত ঝাল মুড়ি বিক্রেতা হাওড়া বর্ধমান মেন লাইনে দাপিয়ে খেলে। এক তো ময়রা পাড়ার তপনদা, আর দ্বিতীয় বাউরি পাড়ার হারা।
বহুদিন আগে আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন বর্ধমান থেকে পাঁচটা চল্লিশে একটা ডাউন ট্রেন ছাড়তো। এক মুড়ি মশলা বিক্রেতা পুরো রেভুলেশন করে ফেলেছিল - সে শুধু বিক্রি করতো আম তেল দিয়ে ঝালমুড়ি। আর তাতে সরু সরু একদম পাতলা মানে এই পাশ থেকে ওপাশ দেখা যাবে এমন নারকেল টুকরো তো। সেই জিনিস কি মার্কেটে হিট হয়েছিল বলার কথা না - এই নিয়ে আমি আমার বইতে লিখেছি
সেই মুড়ি মশলার মার্কেট দেখে ভেবেছিলাম যে যদি কোনদিন রেস্টুরেন্ট বিসনেসে আমি নামি তাহলে অন্তত ঝাল মুড়িটা রাখবো মেনুতে! সারা পৃথিবীর অনেক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টই ঝাল মুড়ি এই নামে আগে আমি খুব একটা বেশি বিক্রি দেখি নি। বিজাতীয় নামে দেখেছি - যেমন 'পাফড রাইস'। কিন্তু বাঙালি ঝাল মুড়ি এই নামে বিক্রি হচ্ছে সেটা আমি ভাবতেই পারিনি। যা বুঝলাম পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে অলরেডি দেদার বিজনেস করছে। রেস্টুরেন্ট পুরো ভরা - অবশ্য ঝাল মুড়ি খুব একটা বেশি লোককে খেতে দেখলাম না। একজন নিয়ে সে যা স্ট্রাগল করছে তাকে দেখে মনে হয় অন্য কেউ সেই জিনিস অর্ডার করা সাহস পায়নি!
এখানে যেটা আমি দেখলাম সেটা হচ্ছে ঝাল মুড়ির সাথে আভোকাডো! এই একটা ওভার হাইপড সবজি বা ফল যাই বলেন - সারা পৃথিবীতে আর নেই! এবার এই ঝালমুড়িতে আভোকাডো আর আলু এই দুটো জিনিস দেওয়ার কি অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না! চন্দ্রমুখী আলু হলে তাও না হয় কথা ছিল। আভোকাডো এক মার্কেটিং স্ট্রাটিজি - ঝালমুড়িতে তেল দেখে কেউ যদি বলে অস্বাস্থ্যকর, তাই আভোকাডো আছে বলে সামাল দেবার ব্যবস্থা আছে।
সেদিনের খিদে পেয়েছিল - রাত আটটা প্রায়। ঝালমুড়ি চিবিয়ে আর সেই ফ্রান্সের রেষ্টুরান্টে বসে ঝুড়িতে রাখা ঝিনুকের খোল ছাড়িয়ে মাংস বের করে খিদে মেটাবার অসহনীয় স্মৃতি ফেরাতে চাইলাম না।
তাই আজ আর ঝালমুড়ির ছবি নেই, শুধুই মেনুর ছবি। নিজের কল্পনা দিয়ে মুড়ির থালা কল্পনা করে নিন
(৪) মাঝে মাঝে কানাঘুঁষো শুনতাম যে কিছু কিছু পাবলিক বলছে, “আমি নানা মুহুর্তে, তা সে দুঃখ হোক বা আনন্দ, ঘরের কোণে বা ঘুরতে বেড়িয়ে, রবি ঠাকুরের গানের মধ্যে দিয়ে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাই”। বলাই বাহুল্য সেই সব শুনেই, ‘ন্যাকা এল আমার’ বলে সরে যেতাম।
কিন্তু সেই দিন বুঝলাম এত দিন কি প্রবল ভুল করেছি! কারণ সামনে রাখা ডিসটা নানা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখে নিজের অবচেতনেই মৃদু স্বরে রবি ঠাকুরকেই গুনগুনিয়ে উঠলাম,
“মনেরে আজ কহো যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে”।
এবার প্রশ্ন হল ‘সত্যটি’ আসলে কি!
এই যে খাবার-দাবারের গল্প লিখি এদিক-ওদিক বেড়াতে গিয়ে - তাতে অনেকে অনেক কিছু বলে। কেউ বলে আপনার ভাগ্যটাই খারাপ, কেউ বলে এসব জায় গায় যান কেন যেখানে এত খাবার কম দেয় ? কেউ আরো কাছের মানুষের মতন জানতে চায়, ‘গলা দিয়ে নামল?”
তবে ব্যাপার হলো ভাগ্য যে সব সময় খারাপ খাবার ব্যাপারে এমন নয় । আর সব জায় গায় যে পুরো পাখির আহার দেয় এমনও নয় । এই যেমন সেদিন হিউষ্টন শহরে এক ইরানিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। ওদের খাবার তো ভারতের সাথে অনেকটাই মিল আছে। যেমন কাবাব টাবাব, বা ওরকম বাসমতি চালের ভাত।
খিদে পেয়ে গিয়েছিল অর্ডার দিলাম কম্বো কাবাব টাইপের - তার মধ্যে চিকেন ছিল, মাটন ছিল, এটা সেটা অনেক কিছু ছিল আর ছিল বাসমতি রাইস বা ওদের অন্যরকম স্পেশাল রাইসের কিছু প্রিপারেশন। সাথে বেগুন, পেঁয়াজ, স্কোয়াশ, ট্যমেটো এর সব পোড়া যাদের কথা ছেড়েই দিলাম। এগুলোকে সদগতি করার উপায় একটাই – ওয়েটারকে ডেকে, “ভাই/বোন, একটা বাড়তি প্লেট হবে?” সেই বাড়তি প্লেট এলেই সঙ্গে সঙ্গে এঁটো হিসেবে বেগু, স্কোয়াশ ইত্যাদিকে স্থানান্তরিত করা। আর ছবি দেখলেই বুঝতে পারবেন যে খাবারের পরিমাণ কম ছিল সেদিন এমনও নয় ।
তাহলে এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন উঠতে পারে, আমার সমস্যাটা কি?
ভেবে দেখলাম, ‘সত্য’ অনুসন্ধান করতেই যাই বা ‘সমস্যা’ – এর সব কিছুর গোড়ায় আছে আছে আমার নষ্টালজিয়া! ফিরে এলো আমার মনে সেই সব স্মৃতি মধুর দিনগুলি, বিশেষ করে বেড়াতে যাবার।
সে অনেক দিন আগের কথা – তখন শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা পুরানো জায়গায় হত (এখন মনে হয় অন্য জায়গায় হয়)। আমরা তখন ক্লাশ নাইন – যেতাম পৌষ মেলায় ‘মেমারি-বোলপুর’ বাসে করে যে বাসটি কিনা আমার এক বন্ধুর ফ্যামিলির। তা ড্রাইভারের পাশে আর কেবিনে বসে চেপে পড়লেই হল। রাতের থাকার জায়গার ঠিক নেই – সাথে কম্বল নিয়ে সারা রাত বাউল গান শুনে সেই ছাউনির তলাতেই শুয়ে পড়া। শুধু আমরাই নয় – আমাদের মতন এমন অনেক পাবলিকই শুয়ে থাকত। সমস্যা হত পরের দিক সকালে উঠে – তখনকার দিনে এত ব্যবস্থা ছিল না। ঘুম থেকে উঠে পাবলিক খোয়াই-য়ের দিকে হাঁটা লাগাতো।
প্রথম বার গিয়ে এটা বেশ কেমন লাগলো – বন্ধুকে জিজ্ঞাসিলাম, ‘এই ভাবে, হ্যাঁরে?’ সবে ক্লাস এইটে সংস্কৃত শেষ করে উঠেছি। বন্ধু উদাস মুখে জবাব দিল, “কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ, অর্থাত, এই খোলা মাঠে কেউ কারো নয়। শুধু তুই দেখে সামনে পা ফেল”
সেদিনের খাবার ডিস-টা দেখে বন্ধু যার জন্য দেখে সামনে পা ফেলতে বলত সেটা ভেবে নষ্টালজিক হয়ে গেলাম। স্মৃতিমেদুর হবার একটা বিশাল প্রবলেম হচ্ছে একবার মেদুর হয়ে উঠলেই, মেদুরতা ক্রমশঃ গভীর হতে লাগলো। ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল - খোলা প্রকৃতি এল মনের গহীন থেকে উঁকি মেরে।
মনে পড়ে যায় ভারত সরকারের যোজনায় গ্রামে অনেক কিছু করে দেওয়া হল – কিন্তু লোকজনের মাঠে যাতায়াত কমানো গেল না। কেউ স্লোগান দিল, ‘এই বদ্ধ ঘর আমাদের জন্য নয় – আমাদের চাই উন্মুক্ত প্রান্তর’। যারা ক্লাস এইট পর্যন্ত গেছে, তারা বলল মাঠে যাওয়া আমাদের নাগরিক অধিকার। পঞ্চায়েত প্রধান নীরবতা নিল কারণ সকালে মাঠে না গেলে তার নিজের ব্যাপারটা ক্লীয়ার হয় না।
এটাকে অনেকের মনে হতে পারে বাড়াবাড়ি কথাবার্তা - কিন্তু যারা খোলা মাঠে অভ্যস্ত, তাদের বদ্ধ ঘরে বন্দী করে রাখা যে কি চাপের সে যারা জানে তারাই জানে
এর ফলে হত কি পরে যারা মাঠে যেত তখন একটা কথাই বলতে হত বারবার - "এ্যাই, দেখে চল আল দিয়ে। চোখ খোলা রাখ।"
সেদিন এই খাবারে প্লেটটা সামনে নিয়ে পুরনো এসব কথা অনেক বেশী মনে এসে গেল। আর মনে পড়ে গেল যে চোখ খোলা রাখলে সামনেই এই প্লেটে যেগুলো আছে, তেমন রঙের আর আকারের বেশীর ভাগ জিনিস দেখতে পেতাম।
তো ‘সত্য’ আসলে কি এর জবাবে এটুকু বুঝলাম যে, আর যাই হোক সত্য সব সময় দৃষ্টিনন্দন হবে এমন গ্যারান্টি নেই।
ভাবলাম ওয়েটারকে ডেকে জিজ্ঞেস করি – ‘আচ্ছা, হলুদটা কি চিকেন’? সাহসে কুলালো না -
নির্লিপ্ত হয়ে খাওয়া-দাওয়ায় মন দিলাম – গুনগুন করতে করতে,
“মনেরে আজ কহো যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে”।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।