কিছুদিন আগে ১লা ফেব্রুয়ারি ছিল চাইনিজ নিউ ইয়ার, আর চাইনিজ জোডিয়াক চিহ্ন অনুযায়ী এই বছর হচ্ছে ইয়ার অফ ‘টাইগার’। আমরা যেমন নিজেদের বাংলা নববর্ষে পরস্পরকে সম্ভাষণ করি ‘নববর্ষের শুভেচ্ছা’, বা ‘শুভ নববর্ষ’ বলে, তেমনি চাইনিজরা আজকের দিনে সম্ভাষণ করে “গং সি ফা চাই”।
চাইনিজ চন্দ্র ক্যালেন্ডার অনুসারে এই নতুন বছর উদ্যাপিত হয় – এবং যাঁরা চিনা বংশোদ্ভূত, তাঁদের কাছে সারা বছরের সব চেয়ে বড় উৎসব এটাই। গত দুই বছর করোনার জন্য তো সব কিছু নর্মাল নেই, তা না হলে এই সময়ে চিন সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যত লোক যাতায়াত করেন, তার তুলনা মেলা ভার। চিনে সবকিছু এক সপ্তাহ বন্ধ এই নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে – যারা দূরে দূরে থাকে, তারা সবাই ফিরে আসে পরিবারের কাছে। ক্রিশ্চান-রা যেমন ২৪শে ডিসেম্বর রাতে পরিবারের সাথে ডিনার করে ট্রাডিশন অনুযায়ী, তেমনি চাইনিজদের কাছেও এই নতুন বছরের দিনটি পরিবারের সাথে কাটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর চিনাদের কাছে এটা শুধু নতুন বছর নয় – এদের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক সামাজিক ঐতিহ্যও – এই দিন নাকি ওরা উদ্যাপন করে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে।
শুধু চিন নয় – আশপাশের অনেক দেশ – তাইওয়ান থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং এ ছাড়াও, সুদূর ইউরোপ এবং আমেরিকাতেও উৎযাপিত হয় খুব জাঁকজমক করে এই চাইনিজ নতুন বছর। চাইনিজ লুনার ক্যালেন্ডারের সাথে আবার জোডিয়াক চিহ্নগুলোর সম্পর্ক আছে – আর আছে কিছু পশুর সাথে বছরের সনাক্তকরণ। মোট ১২টি পশু ঘুরে ফিরে আসে ১২ বছর অন্তর অন্তর। এই বছর (২০২২) যেমন টাইগার (বাঘ) ইয়ার, শেষবার টাইগার ইয়ার ছিল ২০১০। পরের বছর থেকে ক্রমে হবে খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ছাগল, বাঁদর, মোরগ, কুকুর, শূয়োর, ইঁদুর, ষাঁড় এবং ২০৩৪ সালে আবার ঘুরে আসবে বাঘের বছর।
চাইনিজ জোডিয়াক চক্র শুরু হয় ইঁদুরের বছর দিয়ে, তো সেই হিসাবে বাঘ হল চক্রের তৃতীয় বছর। যাঁরা এই সব মেনে চলেন, তাঁদের মতে এই বাঘের বছরটিতে অর্থাগমের বিপুল সম্ভাবনা, চাকুরিস্থলে সিনিয়র বা ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে বাহবা পাওয়া যাবে কঠোর পরিশ্রমের জন্য, জীবনে আসবে প্রেম এবং রোমান্স, ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠবে – ইত্যাদি! আর এটা বুঝতেই পারছেন, যে এমন জমকালো ঐতিহ্যময় অনুষ্ঠান হলে, তার সাথে স্পেশাল কোনো খাবার থাকবে না – এটা তো আর হয় না! তা, চাইনিজ নিউইয়ারের স্পেশাল খাবার হল নিয়ান গাও (নিউ ইয়ার কেক), ট্যাং ইউয়ান (মিষ্টি চালের বল), ইউ (মাছ) ইত্যাদি। আর আছে এই সময়ের বিখ্যাত নাচ ‘লায়ন’ ড্যান্স’। এটা আপনারা সরাসরি না দেখে থাকলেও, কোনো না কোনো সিনেমায় দেখেছেন বৈকি! আমার নিজের অনেক বছর ধরে সৌভাগ্য হয়েছে লায়ন ড্যান্স দেখার – খুব ভালো লাগে দেখতে। এই যে সিংহ, এটাও কিন্তু একটা প্রতীক – না হলে এত জন্তু থাকতে সিংহ কেন! এদের কাছে সিংহ হচ্ছে ক্ষমতা এবং জ্ঞানের প্রতীক।
নিজের জীবনে প্রথম চাইনিজ নিউ ইয়ার পালন করা শুরু করি ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে। যে বাড়িতে থাকতাম, সেখানে প্রচুর চাইনিজ, তাইওয়ানিজ বন্ধু। তাই চাইনিজ নিউ ইয়ারের দিন ওরা আমাদের সবাইকে রেঁধে খাওয়াত নানা রকম ট্র্যাডিশনাল ডিশ। সবচেয়ে বড় কথা, সব ডিশ ওরা নিজেরাই রাঁধত, বাইরে থেকে কিনে এনে সার্ভ করা এমন কোনো ব্যাপার নয়। সেই অনেক রকম খাবার – ট্র্যাডিশনাল ডিশগুলির মধ্যে থাকত – ডামপ্লিং, স্প্রিং রোল, সুইট রাইস বল, নুডল্স, মাছ, চিকেন, নানা ভেজিটেবল, ফা-গাও (ভিজে চাল গুঁড়িয়ে বানানো – ভাপা এবং ভিতরে পুর দেওয়া) ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা সেদিন রান্না না করলেও, বাড়িটা সাজাতে ওদের সাহায্য করতাম – এদিক-ওদিকে চাইনিজ লন্ঠন ইত্যাদি লাগিয়ে যতটা পারা যায়! বাড়ি সাজানো ছাড়াও চাইনিজ নিউ ইয়ারের আরো দুই আবশ্যিক অঙ্গ ছিল ফায়ার-ক্র্যাকার এবং লাল রঙের এনভেলপ। এই নিউ ইয়ার সাধারণত জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসেই আসত বলে, আমাদের অনেক চাইনিজ বন্ধু ইংরাজি নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের সময় যে আতসবাজি বিক্রি হত, সেগুলি কিনে স্টক করে রেখে দিত। তবে চাইনিজ নিউ ইয়ারে চাইনিজ দোকানগুলিতে ফায়ার-ক্র্যাকার পাওয়া যেত কিনতে – সেখান থেকেও আমরা কিনে নিয়ে আসতাম। আর সেই লাল রঙের খামে থাকত ‘টাকা’ – এটা একটা ট্র্যাডিশন ওদের, যেখানে বাড়ির বড়রা ছোটদের এই টাকা গিফট করে, তবে ছোটদের ছাড়াও প্রিয়দের এই খাম দেওয়ারও ট্র্যাডিশন আছে। সেইমত আমরা আমাদের চাইনিজ বন্ধুদের থেকে পেতাম খুব সুন্দর হাতে নাম লেখা, চাইনিজ লিপিতে।
আর একটা জিনিস নাকি ওদের কালচারে আছে, এই বছরের প্রথম দিনে নাকি কিছু হলেও ‘জুয়া’ খেলতে হয় টাকা বাজি রেখে! নো ওয়ান্ডার, যে চাইনিজরা ব্যবসাজগতে চিরকালই সম্ভ্রম জাগানো স্থান বজায় রেখে চলেছে হাজার বছর ধরে! আমরাও সেই বিলেতের বাড়িতে (‘গ্রেস’ হাউসে) খেলতাম খানিক সিম্বলিক জুয়া।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে, এদেশ-ওদেশ ঘুরে এসে পৌঁছলাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, মানে চাইনিজ নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের প্রাণকেন্দ্রের একদম কাছাকাছি। চাইনিজ নিউ ইয়ারে সাউথ-ইস্ট এশিয়ায় ছুটি থাকে মিনিমাম একদিন – দেশ-বিশেষে দুই থেকে সাত দিন। চাইনিজরা নিজেরা এই সময়টা পরিবারের সাথে কাটালে কী হবে, যারা চাইনিজ নয়, তারা এই ছুটিটা উপভোগ করে বেড়াতে গিয়ে। ফলত, এই চাইনিজ নিউ ইয়ারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ট্যুরিস্টিক জায়গাগুলোতে বেজায় ভিড় দেখবেন। এই সময় ফ্লাইট থেকে শুরু করে হোটেল ভাড়া সবটাই বেশি – তাই যদি কেউ ভারত থেকে বেড়াতে যান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, চাইনিজ নিউ-ইয়ারের সময়টা একটু খেয়াল করে যাবেন।
আমার নিজের প্রবল ভিড়ের মধ্যে বেড়াতে একদমই ভাল লাগে না – তাই বেশিরভাগ সময়েই আমি এড়ানোর চেষ্টা করেছি এই সময়ে বেড়াতে যাওয়া। কিন্তু বছর তিনেক আগে কী মনে হল, ব্রুনাই-এর কাছে একটা ছোট্ট দ্বীপে বেড়াতে গেলাম – সেই দ্বীপটার নাম লাবুয়ান, আর মালয়েশিয়ার অধীনে আছে। সাউথ চায়না সি-র মাঝে একটা ছোট্ট দ্বীপ – মূলত তেল-সংক্রান্ত ব্যাপারেই এর প্রভাব প্রতিপত্তি। একদম ছোট্ট দ্বীপ – ৩২ বর্গ কিলোমিটারের মত জায়গা, আর লোক সংখ্যা এক লক্ষ প্রায়। এই দ্বীপ বহুদিন ছিল ব্রুনাই-য়ের সুলতানের অধীনে – পরে ব্রিটিশরা এসে জমিয়ে বসে – তারপরে বেশ কিছু বার এদিক-ওদিকে হাত ফেরত হয়ে বর্তমানে মালয়েশিয়ার অধীনে আছে।
ছোট্ট দ্বীপ বলে খুব বেশি জমকালো হোটেল নেই এখানে – ভাগ্যবশত রুম পেয়ে গিয়েছিলাম এই দ্বীপের সবচেয়ে বড় হোটেলটায়। সেবারে ছিল মোরগের বছর –
চাইনিজ নিউ ইয়ারের রাতে স্পেশাল ডিনার ছিল অনেক কিছু – লোকাল মেনুর সাথে চাইনিজ স্পেশালিটি – খাবার দেখলে আমার মাথার ঠিক থাকে না। খেতে এত ব্যস্ত ছিলাম, যে খুব বেশি ছবি তোলা হয়নি – প্রচুর খাওয়াদাওয়া – ট্রাডিশনাল ডিশগুলি তো ছিলই, সাথে ছিল আরো নানাবিধ স্পেশাল –
পেট একেবারে ভরে গেলে ছবি তোলার কথা মনে এসেছে, কিন্তু তখন হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে এত খেয়েছি – তাই আর বেশি ছবি তুলতে পারলাম না। খাওয়াদাওয়া – এইসব নিয়ে খুব ভালই কাটল সন্ধ্যা আর রাতটা।