তখনো চিকেন রোলের ‘চিকেন’ হিসাবে সয়াবিনের টুকরো মাংসের ঝোলে ডুবিয়ে চালাবার দিনকাল শুরু হয়নি – মিড-ডে মিলের ব্যাপার স্যাপারও অনেক দূর। তাই ছোটবেলায় সয়াবিন খাওয়া মানে, মাঝেমাঝেই বাড়িতে যা রান্না করত মা। সত্যি বলতে কি, সয়াবিনের ঝোল খারাপ খেতে লাগত এমন নয় – আবার সয়াবিন খাওয়ার জন্য মায়ের কাছে আবদার করব এমন পিরিতি-ও ছিল না সে জিনিসের সঙ্গে! আর একটু বড় হয়ে জেনেছিলাম, যে সেই সয়াবিন হচ্ছে প্রোটিনের খুব বড় ভাণ্ডার – এবং নিরামিশাষী মানুষদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই বেশ জনপ্রিয়। ব্যস, এটুকুই – অবশ্য আর একটা ব্যাপার এখানে পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার, আমরা সয়াবিন বললেও, আসলে কিন্তু সয়াবিন গাছের ‘বিন’ বা বীজটা খেতাম না – খেতাম সেই রেডিমেড ছিবড়ে টাইপের সয়াবিনের গুটুলি, যা জলে ভিজিয়ে রাখলে তবেই নরম হত।
সয়াবিন আদপে কোথা থেকে এল সেই নিয়ে ধোঁয়াশা আছে – তবে মোটামুটি এটা প্রচলিত, যে প্রায় ৫০০০ হাজার বছর আগে চীন দেশে প্রথম এই সয়াবিনের চাষ হয়। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে চীন থেকে সয়াবিন যায় জাপানে – কিন্তু জাপানে সয়াবিনের চাষাবাদ শুরু হয় ১২শ শতাব্দী থেকে। প্রথম দিকে সয়াবিন তত সহজলভ্য ছিল না – কেবল উচ্চবিত্ত লোকজনেরাই খেত। ১৭শ শতাব্দীর পর থেকে ব্যপকভাবে চাষ হতে শুরু করলে সয়াবিন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আসে।
দিন গেছে – ক্রমে সয়াবিন খাওয়া কমে এসেছে নিজের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাতায়াত করতে শুরু করেছি – টোফু-র স্বাদ পেয়েছি। কিন্তু খেয়াল করতেই ভুলে গিয়েছিলাম, যে সেই টোফু এবং সয়াবিন একদম প্রবলভাবে সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, কারণ টোফু তৈরি হয় সয়াবিন থেকেই!
কিভাবে তৈরি হয় টোফু? সয়াবিন জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে সারারাত – সারারাত বললাম বটে, কিন্তু জাপানীরা বাকি অনেক জিনিসের মত টোফু বানানোকেও জটিল করে ফেলেছে! তাদের দাবি, সয়াবিন ভিজিয়ে রাখতে হবে ৮ থেকে ১৪ ঘণ্টা – বাকি কিছু ব্যাপারের উপরের নির্ভর করে – কি সেই বাকি ব্যাপার? আবহাওয়া, আপেক্ষিক আদ্রর্তা, যে জলে ভিজিয়ে রাখবেন, তার তাপমাত্রা – ইত্যাদি ইত্যাদি। তো যাই হোক – সেই ভেজানো সয়াবিন এবার সিদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধ হয়ে গেলে সয়াবিন চাপ দিতে হবে প্রেসে – যেমন ভাবে আমরা তেল বের করি সর্ষে বা তিল থেকে। সয়াবিনের শাঁসকে জাপানী ভাষায় বলা হয় ‘ওকারা’ – সেই শাঁস আলাদা করতে হবে সয়া-মিল্ক থেকে। এবার সেই সয়া-মিল্কে যোগ করে দিন কিছু ‘নিগারি’ (যা আদপে ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড) – ছানা কাটার মত কেটে গিয়ে যা দাঁড়াবে, তা-ই হল টোফু।
তাহলে কি দাঁড়াল সারমর্ম? গরু / মোষ / ছাগলের দুধ থেকে আমরা বাড়িতে যেমন ছানা বানাই, ঠিক তেমনই, সয়ামিল্ক থেকে বানানো হয় টোফু! সয়া থেকে তিন প্রকারের খাবার বানানো হয়, বা সয়া-কে তিন ভাবে ব্যবহার করা হয় –
১) গোটা সয়াবিন: গোটা বীজ জলে সিদ্ধ করে খাওয়া হয় নানা ডিশে। এ জিনিস ফাইবারের ভাণ্ডার, সাথে লিপিডেরও। কিন্তু সমস্যা একটাই, এ জিনিস হজম করা বেশ শক্ত।
২) সয়ামিল্ক: এর ভাগে পড়ছে গিয়ে আপনার টোফু, ইউবা (ড্রায়েড বিন কার্ড), আৎসুয়াজ (ডিপ ফ্রায়েড টোফু) এবং সয়ামিল্ক। ডায়েটারি ফাইবার কম থাকে এই খাবারগুলোতে, কিন্তু সহজ ভাবে গ্রহণ করা যায় – এমন প্রোটিনে ভর্তি।
৩) ওকারা: হল মোদ্দাকথায় সয়াবিনের শাঁস – আগে যেমন উল্লেখ করেছি। এতে ডায়েটারি ফাইবার প্রচুর, কিন্তু প্রোটিন বা লিপিড কম থাকে।
এ তো গেল কাঁচা এবং সিদ্ধ সয়াবিনের গল্প, কিন্তু সয়াবিন গেঁজিয়েও (ফার্মেন্টেড সয়াবিন) বেশ কিছু জনপ্রিয় খাদ্য বানানো হয় – তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে – মিসো, সয়া সস এবং নাটো।
গড়পড়তা জাপানীদের আপনি জিজ্ঞেস করেন, “ভাই, টোফু খাবার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উপায় কি?” অনেকের মত আমিও নিশ্চিত, তারা বলবে ‘হিয়ায়াক্কো’। এ একেবারে অথেন্টিক জাপানিজ টোফু ডিশ, যা বানানো হয় ঠান্ডা টোফু দিয়ে। উপরে টপিং থাকবে সয়া সস-এর, সাথে বোনিটো ফ্লেকস্ (বেনিটো মাছ, যা কিনা টুনা মাছের জ্ঞাতি-গুষ্টি, তার থেকে বানানো) আর পেঁয়াজকলি। যদি আপনার ছুৎমার্গ না থাকে টোফু খাওয়া নিয়ে – তাহলে এ জিনিস একদম অপূর্ব লাগতে বাধ্য।
অনেক দিন আগে কোম্পানির কাজে গিয়েছিলাম জাপান। সেই কোম্পানির গেস্ট-হাউসে একদিন রাতে স্পেশাল জাপানিজ ডিনার আয়োজন করা হয়েছিল। যাঁরা জাপান যান বা জাপানীদের সাথে ওঠাবসা করেন, তাঁরা জানবেন – সেই দেশে আতিথেয়তার এক বিশেষ প্রথা আছে। কেউ কিছু অফার করলে পশ্চিমা দেশের মত দুম করে ‘না’ বলে দেওয়া যায় না – তাই ওরা যখন বলল, তাদের কোম্পানির গেস্ট-হাউসের কিচেনে এক বিখ্যাত স্থানীয় শেফ বহুদিন ধরে কাজ করে এবং সে-ই রান্না করে খাওয়াবে –আর না করার প্রশ্নই উঠল না। সারাদিন সেই ফ্যাক্টরিতে কাজ মিটিয়ে সন্ধ্যেবেলা যাওয়া হল গেস্ট-হাউসে।
আমার যেমন হয় – সন্ধেবেলা হলেই খিদে পেয়ে যায়! গেস্ট-হাউসে ঢুকেই খাবার টেবিলে বসে পড়ার ধান্ধা করছিলাম, যে কোনো একটা চেয়ারে। পিছন থেকে টান দিল এক কলিগ – সেই প্রথম জাপানে বসার এটিকেটের সাথে পরিচয়। এই নিয়ে আলাদা করে একটা লেখা হয়ে যাবে – পদমর্যাদা অনু্যায়ী বসার ব্যবস্থা করা হয়। যারা সর্বোচ্চ পদমর্যাদার লোকজন – তাদের বসার ব্যবস্থা প্রথমে এবং তারা যেখানে বসবে, সেগুলোকে বলা হয় ‘কামিজা’। কম পদমর্যাদার লোকেরা যে স্থানে বসবে, সেগুলোকে বলা হয় ‘সিমোজা’। যাই হোক, ডিনার সেদিন তত ফার্মাল ছিল না বলে, আমাদের (অর্থাৎ গেস্টদের) বসার চেয়ার আগে থেকে নির্দিষ্ট করা ছিল না। কিন্তু আমাদের বসতে বলল সেই ঘরে ঢোকার দরজার থেকে দূরের চেয়ার গুলোতে। এটাও একটা রীতি – অতিথিদের বসতে দেওয়া হয় দরজার থেকে দূরে, আর দরজার কাছে থাকবে হোস্ট। এর কারণটাও বেশ ইন্টারেস্টিং – এই রীতি চালু হয় বহু বহু আগে, জাপানের ফিউডাল পিরিওডে – যেখানে দুমদাম শত্রুর আক্রমণের বেশ চল ছিল। আমাদের মত জাপানীদেরও বিশ্বাস অতিথি নারায়ণ – তাই অতিথিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রবেশদ্বারের থেকে সবচেয়ে দূরে বসতে দেওয়া হত। মানে হোস্টকে ডিঙিয়ে তবেই কেউ অতিথিকে স্পর্শ করতে পারবে।
সেদিন ডিনারে বেশ কিছু অথেন্টিক জাপানী ডিশ জাপানী কায়দায় খাওয়া হয়েছিল – আর বলাই বাহুল্য, টোফুর সেই বিখ্যাত ডিশ ‘হিয়ায়াক্কো’ পরিবেশিত হয়েছিল প্রথমেই! খুবই উপভোগ করেছিলাম সেই রাতের খাবার –