আম না থাকলে ভারতের ইতিহাসই অন্যরকম হত! কথিত আছে বাবর নাকি মেওয়ারের রাজা রাণা সিংহের সঙ্গে টক্করে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না, ভয়ে ভয়ে বেশ গুটিয়েছিলেন। ওদিকে দৌলত খান লোদি লোভ দেখিয়েই যাচ্ছেন বাবরকে – এই যুদ্ধে জিততে পারলে আমার সাম্রাজ্যের অনেকটা তোমাকে দেব, যুদ্ধের লুঠের মাল সব তোমার ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবর তবু গুঁইগাঁই করছেন – শেষ চেষ্টা হিসাবে দৌলত লোদি নাকি বাবরকে আমের লোভ দেখান! ভারত জয় করলে শুধু যে ধন-দৌলত নয়, নিজের ইচ্ছেমত হরেক রকম আম খেতে পারবেন বারান্দায় হাত পা ছড়িয়ে – এই ফিউচার সম্ভাবনা দেখেই নাকি বাবর ঝেড়েমেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডাক দিয়েছিলেম, “থালে পরে, দে তলোয়ারটা – আর যুদ্ধু করার যা কিছু আছে বের করতে বল”।
অন্য কেউ এই গল্পে বিশ্বাস না করলেও আমি পুরোপুরি করি – আমের বিরহ যে কী জিনিস তা প্রায় দেড় দশকের উপর মর্মে মর্মে অনুভব করেছি বিদেশে। এই বছর ভারতে থাকলেও গ্রামের বাড়িতে তো আর নেই! তাই কিছু কিছু আম হাতের কাছে পেলেও, অন্যভাবে চরম মিস করছি আম – বাড়িতে গাছে আম হয়েছে, মামার বাড়িতে আম খাবার লোক নেই। যাঁরা আম ভালোবাসেন এবং হাতের কাছে ভালো আম যদি পাওয়া না যায় তাহলে তাঁদের জন্য এই সময়টা যে কী কষ্টের সেটা যিনি অনুভব করেছেন সেই জানবে কেবল!
ব্যাঙ্গালোরের বুকে 'মল্লিকা' আম মার্কেটে বাকিদের থেকে একটু আগে এসেছিল – তবে এখন বাকি আম ভাইরা সবাই চলে এসেছে মরশুম প্রায় শেষ হবার দিকে। মল্লিকা আম কলমের মাল - নীলম এবং দশেরীকে মিশিয়ে নাকি একে নামানো হয়েছে!
কিন্তু তা হলেও ভারতে বসে একটা আম ১০৪ টাকা দিয়ে কিনতে কেমন লাগে। নিজেকে বঞ্চিত, অসাম্যের স্বীকার - ভিয়েতনাম, কিউবা কী সব আরো মনে এসে যায়। বিশেষ করে 'প্রকৃত' গ্রামের ছেলে বলে আরো ‘আঁত কড় কড়’ করে ওঠে। বাগানের হিমসাগর বা মামার বাড়ি থেকে পাঠানো আম খাবারই তেমন লোক নেই বাড়িতে।
তো যাই হোক সেই মালিকাই আমকে আপাতত ফ্রিজে রেখে দিয়েছি - একটু অর্ধপক্ক দেখে কিনেছি, কদিন মাঝে মাঝে বের করে চেয়ে চেয়ে তেনাকে দেখব।
আপেলের মত এখন আমও ঘুমিয়ে আছে শীতের গভীরে।
আমের ইতিহাস বা ভূগোল নিয়ে আজ লিখতে বসিনি – আম নিয়ে লেখা নেহাত কম নয়, একটু কষ্ট করে গুগল করে খুঁজে নিতে পারলেই হল! তবুও একটু হালকা করে বলে রাখি – আম নিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে দেখলাম, যত রকমের আম খেয়েছি তার থেকে আরো অনেক বেশি রকমের আম খাবার সুযোগ বা সৌভাগ্য হয় নি এখনো! কিছু কিছু আমের নাম শুনলেই তো মনে হয় একবার অন্তত ছুঁয়ে দেখি! –
মিশ্রিদানা, কালোপাহাড়, রাজলক্ষ্মী, গোল্লাছুট, স্বর্ণলতা, বউভোলানি, মিছরিমালা, মোহনবাসি, রাজভোগ, মধুকুলকুলি, হাঁড়িভাঙা, লক্ষ্মণভোগ, কালিদাসবাবু খায়, মাধুরী, আচাররাজ, ফালুয়া, বেগমবাহার, রত্না, গৌড়মতি, সূর্যডিম, কমলাভোগ, বেলখাস, বিশ্বনাথ, বনখাসা, ভারতী, রাখালভোগ, নাকফজলি, মনোহরা, সিঁদুরে, গুটুলে, নিলাম্বরী, তোতামুখী, রস খাজা, তিলে বোম্বায়, আলতাবানু, সাহেবখাস, চম্পা, শীতলপাটি, দুধস্বর, আলমশাহী, জামাইপসন্দ, আশ্বিনা, জগৎমোহিনী, রানিভোগ, বাতাসা, রাজভোগ, কোহিতুর, দাদাভোগ, ক্ষীরমোহন – এমন কত আমই তো খাওয়া হয় নি!
যেগুলো হাতের কাছে পাওয়া যায় সহজে বা একটু কষ্ট করলে এবং ভাগ্য ভালো থাকলে সংগ্রহ করা যায় তেমন আমের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ আছি তো আজকাল – এদের মধ্যে আছে - ফজলি, আলফানসো, ল্যাংড়া, হিমসাগর, বাদামী, বেগানাপল্লী, নিলম, দশেরী, কেশর, তোতাপুরী, বোম্বাই, চৌষা, মল্লিকা, কৃষাণভোগ, গোপালভোগ, খিরসাপাত, গোলাপখাস, আম্রপালি ইত্যাদি।
নিজে মূল বইটি ‘গালিব – লাইফ অ্যান্ড লেটারস’ এখনো পড়ি নি, কিন্তু শুনেছি তাতে নাকি লেখা আছে মির্জা গালিব সাহেব একদিন ভরদুপুরে বারান্দায় তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে এক বিশাল ঢেঁকুর তোলার পর বলেছিলেন “আম আমি ততক্ষণ পর্যন্ত খেয়ে যেতে পারি যতক্ষণ না পেট ফুলে জয়ঢাক আর শ্বাস নিতে কষ্ট শুরু হয়!”
মুঘল সম্রাটদের সঙ্গে নাকি আমের বিশাল পীরিতি ছিল – বাবর থেকে বাহাদুর শাহ। অনেকে তো এও মনে করেন যে ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণে আম ছড়িয়ে পড়তে দুটি জিনিসের অবদান ছিল বিশাল – এক তো বৌদ্ধধর্ম, আর দ্বিতীয় হল এই মুঘল সম্রাটেরা। যেখানেই এঁরা গিয়েছেন আম সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন – আমবাগান লাগিয়েছেন – এদিক ওদিকে নানা দেশের রাজাদের দেদার আম উপহার দিয়েছেন। মোট কথা ভারতকে আম-ময় করে তুলতে এঁদের হাত ছিল বিরাট।
সেবারে কুয়ালালামপুরের বুকিং বিনতাং এলাকার বিখ্যাত শপিং মলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, ঘুরতে ঘুরতে বেশ ক্লান্ত – ভাবছি কোন একটা স্টলে বসে একটু কফি/জুস/শেক কিছু একটা খেয়ে নিলে বেশ হয়। তাই আশে পাশে চোখ রাখছি – হঠাৎ করে চোখে পড়ে গেল একটা দোকানের খাবারের অ্যাডে আমের ছবি দেওয়া! মানে রসে ভরে উঠেছে, একটা পাত্রে টুপটাপ করছে কাঁচা হলুদ বা কমলা যাই বলেন তেমন রঙের আম! ব্যাস আর কী ভাবতে হয়! টুক করে ঢুকে পড়লাম সেইখানে – চারদিক খোলা বসার অ্যারেঞ্জমেন্ট, শপিং মলের ভিতরে।
এটাকে প্রায় ডেসার্ট স্টল বলা যেতে পারে – মেনু কার্ড বিশাল কিছু বড় নয়, উলটে পালটে শুধু আম নিয়ে ডিস গুলোয় নজর রাখলাম – চোখে পড়ে গেল একটা ডিস যার নাম ‘ম্যাঙ্গো রোমান্স’! প্রায় চোখ বুঁজে সেটা অর্ডার দিয়ে দিলাম। ছবি দেখে কি আর সাইজ বোঝা যায়! আমি শিওর ছিলাম যে আমের নামে যাই দিক আমি খেয়ে ফেলব – তাই সঙ্গে আরো দুটো আমের ডেসার্ট দিয়ে দিলাম অর্ডার।
সেই আমার ভালো লাগার শুরু – তাই এর পর থেকে প্যাভেলিয়ান মলে গেলেই এই দোকানে খেয়ে এসেছি আমের ডেসার্ট। দোকানটির নাম – ‘হুই লাউ সান’। ক্রমে জেনেছি এটা একটা চেন টাইপের দোকান। পৃথিবীর নানা দেশে এর শাখা আছে। প্যাভিলিয়ান মলের এই শাখাটি নিয়ে মিক্সড রিভিউ থাকলেও, আমি কোনদিন খারাপ কিছু পাইনি। অবশ্য এটাও হতে পারে যে আমি শুধু আমের ডেসার্ট অর্ডার দিতাম বলে অন্যগুলো কেমন ছিল সেই সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না!
হুই লাউ সান নামক চেন দোকানটির শুরু হংকং-য়ে সেই ১৯৬০ সালের আশেপাশে – তখন অবশ্য এই দোকান শুধু নানা প্রকার হার্বাল চাইনিজ টি এবং হার্বাল জেলি বিক্রি করত। কিন্তু ১৯৮০ সালের পর থেকে বিজনেসে আরো বেশি ভ্যারাইটি বাড়াবার জন্য এরা নানা রকমের ডেসার্ট বানাতে শুরু করল – যেমন রেড বিন জেলি, প্যান ফ্রায়েড র্যাডিস কেক উইথ কোকোনাট মিল্ক ইত্যাদি।
এর পরে ১৯৯২ সাল নাগাদ এল সেই বিখ্যাত ইনোভেশন ‘ম্যাঙ্গো সাগু’ (এখানে সাগু অর্থে ওই সাবুদানা আর কী) – হংকং শহরে এটা একটা বিশাল হিট। এই ডিসের সঙ্গে সঙ্গেই হুই লাউ সান নাম করে ফেলল ফ্রেস ফ্রুট ডেসার্টের প্রায় পায়োনিয়ার হিসাবে! সারা হংকং ছড়িয়ে পড়ার পর এরা চিনে ব্রাঞ্চ খুলল ২০০৮ সালে এবং ২০১২ সাল থেকে এরা মালয়েশিয়ায় আছে। এখন গোটা মালয়েশিয়া জুড়ে প্রায় ২০টি দোকান আছে এদের – প্যাভেলিয়ান মলের সেই দোকানটা এদের মধ্যেই একটা।
এদের নানারকম ডেসার্ট আছে সেটা আগেই বলেছি – তবে আজকের লেখায় শুধুই আমের ডেসার্টের দিকে ফোকাস। এরা নাকি আম ইমপোর্ট করে ফিলিপিন্স থেকে একদম ফ্রেস – প্রজাতির নাম ক্যারাবাও, এ আম খুব মিষ্টি এবং রসালো হয়। এইবার আমের সঙ্গেই শুরু হয় কেরামতি – আমের সঙ্গে কম্বিনেশন হয় কৃস্টাল জেলি, চিউ বল ইত্যাদির। প্রধান ডিসগুলির নাম – ম্যাঙ্গো রোমান্স, ম্যাঙ্গো চিউ বল, ম্যাঙ্গো কোকোনাট মিক্স, ম্যাঙ্গো সাগু, ম্যাঙ্গো কৃস্টাল জেলি, ম্যাঙ্গো কোকোনাট নুডলস।
ম্যাঙ্গো রোমান্স হচ্ছে আসলে তিনটে ডিশের মিশ্রণ – ম্যাঙ্গো চিউ বল, ম্যাঙ্গো মোচি আর ম্যাঙ্গো কৃস্টাল জেলি।
পাবলিকের কাছে নাকি ম্যাঙ্গো চিউ বল হল সবচেয়ে ফেভারিট – এতে আপনি পেয়ে যাবেন আমের টুকরো, আর আমের বেস-ডিশের সঙ্গে আমের আইসক্রিমও!
আর কী চাই! জানি না আপনাদের অন্য কিছু দরকার কিনা – আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এরা আম ছাড়া আর কী বানায় তা নিয়ে বেশি তল্লাশ করিনি! আমরা আমজনতা – আমেই আমাদের মোক্ষ।
এই সিরিজটা খুব ভালো হচ্ছে। এত আমের মধ্যে 'বৌ-ভোলানি'টাই সবচেয়ে সুন্দর :-))
বাপরে। অর্ধেকের বেশি আমের নাম বোধহয় এখানে প্রথমবার শুনলাম। আমাদের দেশের আমের স্বাদ অনন্য।
আমার নিজের মালয়েশিয়া বা ওর আশেপাশের দিকে বাজারের ফ্রেশ আম খেয়ে ইন্ডিয়ার মত অতটা ভালো লাগেনি। একটু বেশি রকমের কিটকিটে মিষ্টি লেগেছে। আঁশ ও একটু বেশি।
খুব বেশি ভ্যারাইটি চেষ্টা করিনি যদিও। আর স্বাদ জিনিসটা সবসময় ই রিলেটিভ।
আরে আমি যা আম পাই সব আপেলের মত শক্ত। ডালে দিয়ে দিই বা চাটনি করে ফেলি।
আমি আবার যেখানে থাকি , ওখানে সুপারমার্কেটে আবার আমের এক খান ক্যাটাগরি আছে - R2E2. আমি তো প্রথমবার সেই স্ট্যাম্প দেখে ষ্টার ওয়ারস র রোবট R2D2 ভাবছিলাম। তারপর লোকে বোঝালো এ হলো গিয়ে "Ready to eat in 2 days". তাও আবার বাইরে রাখতে হবে। ফ্রিজ এ রাখলে পাকবেনা।
:) :)
কেকে, অনেক ধন্যবাদ। ঠিকই আমারও বৌ-ভোলানি নামটা খুব সুন্দর লেগেছে :)
অমিতাভদা, বল কি! R2E2 লেখা আছে আমের পাশে! ভয় পেয়েই তো চলে আসতাম। তবে শুনেছি ইদানিং এমন সব উদ্ভট ডিজিট দেওয়া আম আমদানি হচ্ছে ফিলিপিন্স থেকে
অ্যান্ড/অরঃ আহা, আম ডাল বড়ই চমৎকার জিনিস!
হায়, আমও চিনেরা নিয়ে গেলো। বিহারি হিসেবে কষ্ট পেলুম।
বেশ হয়েছে,
আমি মধুকুলকুলি আর কোহিতুর আম . খেয়েছি . ।অপূর্ব . ।কোহিতুর aam মুর্শিদাবাদ e খেয়েছি . ।
ফলের রাজা আম। বাংলা থেকে মোঘল সম্রাটদের কাছে প্রত্যেক সিজনে ভেট যেত। এলফানস্য আম আদতে গোয়ার। এলফানসো আসলে এক পর্তুগিজ এর নাম। তার বাগিচার আমের নাম হয়ে যায় এলফানসো।