পর্তুগাল তো অনেকেই গেছেন, বা নিদেনপক্ষে লিসবনে। কিন্তু জানি না এই অভিজ্ঞতার ব্যাপারটা কেউ এক্সপ্লোর করেছেন কি না – মানে ওই ‘ফাদু’ মিউজিকের সাথে ডিনারের ব্যাপারটা বলছিলাম আর কি। যদি না করে থাকেন, তাহলে হাইলি রেকমেন্ডেড, বিশেষ করে যদি লাইফ থেকে তখনো রোমান্স উবে না গিয়ে থেকে থাকে। আর যদি ডিনারে গিয়ে “এ মা, এত টাকা দিয়ে এই খাবার!”, “খাবারে তো কোন টেস্টই পাচ্ছি না”, “হোটেল থেকে তাড়া দিয়ে আর গাঁটের পয়সা খরচা করে তুমি আমাকে এই নাকে কান্না শোনাতে এলে!”, “এটা গান হচ্ছে? একটা কথাও বুঝতে পারছি না তো বটেই, তার থেকেও বড় কথা – এর থেকে আমাদের ওদিকে ট্রেনে বক্সে ট্র্যাক চালিয়ে ভালো গান গায় ছেলেপুলে” – এ সব শোনার চান্স থেকে যায়, তাহলে আমার মতে এ জিনিস এড়িয়ে যাওয়াই ভালো!
যাই হোক, ধরা যাক আপনি সিরিয়াসলি ‘ফাদু’ মিউজিক দেখতে চান। তাহলে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে যান – স্নান ইত্যাদি করে ফ্রেশ হয়ে একটু সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ুন কোনো একটা রেস্টুরান্টে, যেখানে ওদের বিখ্যাত ‘ফাদু’ মিউজিকের উপস্থিতিতে ডিনার করা যায়। এবার দু’টো প্রশ্ন আসতে পারে মূলত – ১) ফ্রেশ না হয়ে কি ডাইরেক্ট রেস্টুরান্টে যাওয়া যাবে না? ২) সারাদিন ঘোরাঘুরি করে রোমান্টিক ভাব গায়েব হয়ে গেলে বা তখন নিজেদের মধ্যে হালকা ঝগড়া বা টেনশন টাইপের চললে কি এমন ডিনারে যাওয়া যাবে না?
এই দুটোর উত্তরই হ্যাঁ – মানে রেস্টুরান্টে এমন কোনো ড্রেস কোড নেই যে আপনি ঢুকতে পারবেন না! তবে কিনা, ঘেমো জামায় সেই অ্যাম্বিয়েন্স তেমন উপভোগ করা যায় না বলেই আমার ধারণা। আর তাছাড়া আমি একটু ইউরোপিয়ান ধারণায় বিশ্বাসী, মানে অকেশন অনুযায়ী ড্রেস করাই বাঞ্ছনীয়। বিয়ের আগে আমি আমেরিকান ধারণার অনুসারী ছিলাম এই ব্যাপারে – যা খুশি পরে চলে গেলেই হল। কিন্তু বিয়ের পর অ্যাপ্রোচের পরিবর্তন হয়েছে – আটল্যান্টিকের ওই প্রান্ত থেকে এই প্রান্তে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরেও হ্যাঁ – পুরোপুরি রোমান্টিক ভাব মনের মধ্যে সেই মুহুর্তে না থাকলেও, একটু এফর্ট দিয়ে চলে যান – কে জানে, হয়তো সেই গান শুনে আপনার কাঁধে মাথা এলিয়ে আসবে একসময়। তবে সাথে বাচ্চা থাকলে না যাওয়াই ভালো – বাচ্চারা এ জিনিস এনজয় করতে পারবে না। কাপল্ ছাড়াও, বন্ধুবান্ধবদের সাথে যেতেও আপত্তি নেই – তবে তা সেই বন্ধুবান্ধবদের বয়সের উপর নির্ভর করবে। যেখানে ‘ফাদু’ মিউজিক হয়, সেই রেস্টুরান্ট গুলোতে দেখবেন মূলত একটু বেশি বয়সীদের ভিড়। ছেলেছোকরারা প্রেফার করে সেই ছোট্ট ছোট্ট গলিতে, বাইরে সাজানো টেবিল চেয়ারে বসে ডিনার। এ জিনিসও কম রোমান্টিক নয়। বলাই বাহুল্য এই দুই জিনিসই ট্রাই করেছি।
অবশ্য আপনি যদি ডিনার ছাড়াও আলাদা করে ‘ফাদু’ শো অ্যাটেন্ড করতে চান, সেটাও পারেন। ‘ফাদু’ হল এক টিপিক্যাল পর্তুগিজ মিউজিক, লিসবনে যার প্রথম উৎপত্তি হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এই ফাদু সংগীতে মিশে আছে লিসবনের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। বর্তমান সময়ে এই মিউজিক লিসবনের পর্তুগিজরা প্রায় রি-ভাইটালাইজড করেছে।
প্রচুর প্রচুর রেস্টুরান্ট পাবেন লিসবনে, যারা এই ফাদু মিউজিকের সাথে ডিনার অফার করে। তবে কিনা, সব ট্যুরিস্টিক জায়গার মতই, লিসবনেও ফাদু মিউজিক নিয়ে ব্যবসা চালু হয়ে গেছে পুরোদস্তুর। খুব বেশি ট্যুরিস্টের ভিড় হলে যা হয় – অনেক স্ক্যাম টাইপের আছে। মানে ফাদু মিউজিকের নামে আলতু ফালতু গান গেয়ে এবং একদম ফালতু খাবার দিয়ে প্রচুর চার্জ করবে। তাই একটু খোঁজ খবর করে যাবেন; বেস্ট হয় – যে হোটেলে আছেন, তাদের জিজ্ঞেস করলে – এরা প্রায় সব সময়েই ভালো রেস্টুরান্ট রেফার করবে আপনাকে। এদের দিয়ে টেবিল রিসার্ভ করে রাখাই ভালো, কারণ ভালো জায়গায় টেবিল রিসার্ভ করে না গেলে চান্স পাবেন না।
আমার মতে, ভালো জায়গাতে টার্গেট করাই ভালো – খরচ হবে ঠিক আছে, কিন্তু অথেন্টিক জিনিস পাবেন, ঠকার চান্স কম। আর সস্তায় বাজিমাত করতে গেলে সেই তেমন অভিজ্ঞতা হবে, যা আমার একবার হয়েছিল অন্য পাবলিকের অ্যারেঞ্জ করা ডিনার উইথ বেলি ড্যান্সিং-এ গিয়ে। পাশের ছেলে সেই নাচ দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে, বেলি ড্যান্সিং-এ কি বেলি নড়বে?” আমি বললাম, “তেমনই তো কথা!”। সে ছেলে হতাশ হয়ে বলল, “অনেকক্ষণ তো নাচ হয়ে গেল, কিন্তু বেলি তো দূরের কথা, শরীরের কোন অঙ্গ নড়ছে সেটাই বুঝতে পারলাম না!”
খাবারের দাম নির্ভর করবে – কেমন রেস্টুরান্ট চ্যুজ করছেন তার উপর। একেবারে সস্তা রেস্টুরান্টে যাবেন না – কারণ তারা কোনো ভালো এবং প্রফেশনাল ফাদু গায়ক/গায়িকা-কে আনবে না – কারণ তাদের টাকা দিতে হবে! এরা অ্যামেচার গায়ক/গায়িকা-দের রেস্টুরান্টে ডাকে – টাকা দেয় না আলাদা করে, কেবল টিপস্ থেকেই তাদের যা রোজকার। ওদিকে ভালো গায়ক/গায়িকাদের রেস্টুরান্ট পে করে, তাই খাবারের দাম বেশি হয় সব কভার করার জন্য।
বলাই বাহুল্য ফাদু গাওয়া হবে পর্তুগিজ ভাষায়, সাথে একজন পর্তুগিজ গিটার বাজাবে। আপনি অবশ্যই সেই গানের অর্থ বুঝতে পারবেন না – কিন্তু বিশ্বাস করুন, তার জন্য খুব বিশাল কিছু অসুবিধা হবে না পারফরমেন্সটা উপভোগ করতে। ফাদু কোনো ঝিনচ্যাক টাইপের বা উচ্চকিত মিউজিক নয়। বেশির ভাগ গান জুড়ে থাকে আকুতি – যেন হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে উঠছে – প্রকৃতি, সমুদ্র, মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই – এ সব কিছু গানের বিষয়বস্তু হতে পারে।
যাই হোক, আমরা একটা রেস্টুরান্ট পছন্দ করেছিলাম যেখানে পর্তুগিজ খাবার সার্ভ করা হয় মূলত – ক্ল্যাসিক্যাল সব ডিশ। তবে বিশুদ্ধবাদীরা আবার বলবেন, পর্তুগিজ ক্যুজিন আবার কি! ক্যুজিনের নাম তো মেডিটারেনিয়ান! একদিক থেকে ভেবে দেখলে ব্যাপারটা হয়তো মিথ্যে নয়। বেশির ভাগ পর্তুগিজ ডিশেই দেখবেন ছাপ আছে গ্রিক, ইতালিয়ান – এদের। কিন্তু তবুও অভ্যাস থাকলে এদের থেকে পর্তুগিজ ডিশ আলাদা করতে পারবেন। যেমন এরা ভারতের মশালা ব্যবহার করে, নুন দেওয়া কড মাছ আসে আইসল্যান্ড বা নরওয়ে থেকে, চিলি আর পেপার তো দক্ষিণ আমেরিকার দান, অলিভ ওয়েলের ইতিহাসও তো আমরা জানি, কীভাবে জড়িয়ে শতাব্দী ধরে, আরবিক, রোমান বা গ্রিক সভ্যতার সাথে।
আর রেস্টুরাণ্টের সেটিং-এর ক্লাসিক্যাল লিসবনের ছাপ আছে – খিলানের মতন ঘরের ছাদে কাজ, নানাবিধ পেন্টিং ইত্যাদি। বড় ভালো কেটেছিল সন্ধেটা – খাবার তো ছিল দুর্দান্ত – সেই নিয়ে আর আলাদা করে কিছু লিখলাম না।