হাসিমুখে ওয়েট্রেস টেবিলে যেটা নামিয়ে দিয়ে গেল, তা দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! আমি পিটা ব্রেড-এর অর্ডার করেছিলাম, বাঁদর লাঠির নয়! যে আঁতেলরা বাঁদর লাঠির সাথে সম্যক পরিচিত নয়, তাদের আঁতলামি-ইক্যুইভ্যালেন্ট উদাহরণ হল – স্টার ওয়ার্স সিনেমায় যে সাদা রডের মত বস্তুগুলো নিয়ে ঠ্যাং ঠ্যাং করে যুদ্ধু যুদ্ধু খেলে – এই পিটা ব্রেড অনেকটা তেমন দেখতে! বাপের জন্মে এমন আকৃতির পিটা ব্রেড খাইনি, আর খেয়ে থাকলেও মনে করতে পারছি না!
আর এই পিটা ব্রেডের দৈর্ঘ্য? মেন লাইনের ব্যান্ডেল আর হুগলির মাঝের রেল লাইনে একে শুইয়ে রাখলে দুই প্লাটফর্মকেই ছুঁয়ে ফেলবে! এদিকে মেন কোর্সেরও অর্ডার দিয়ে দিয়েছি – এটা তো শুধু অ্যাপেটাইজার এল! খানিকক্ষণ প্রায় গালে হাত দিয়ে ভাবলাম, এই ব্রেড পুরোটা খেয়ে নিলে কি আর মেন ডিশ খেতে পারব? আমার থেকেও বউয়ের চিন্তা বেশি – বলল, “এগুলো সব তুমি খেলে তো টেবিল থেকে ওঠার ক্ষমতা থাকবে না!” ঠাট্টা করার চেষ্টা করলাম, “তাতে কি, তুমি রেস্টুরান্টের লোকদের হেল্প নিয়ে আমাকে ধরাধরি করে ট্যাক্সি-তে তুলে নেবে!” সেই রসিকতা ভালোভাবে নেওয়া হল না দেখলাম – “তুমি সিরিয়াসলি সব খেতে পারবে? এত খাবার দেখে ভয় করছে না?” কি উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না – হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় দেখা যাত্রায় এমন সিচ্যুয়েশনেই মনে হয় বলা হত, “আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে!” সেটাই বললাম এবং বউ আরো রেগে গেল!
যাই হোক, নিজের মধ্যে থাকা চাষার ছেলেকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাত গুটিয়ে শুরু করলাম খাওয়া। সেদিন অ্যাপেটাইজার-এর অর্ডার করেছিলাম স্পেশাল পিটা ব্রেড আর ‘খাওরেমা হামুস’। এই হামুস ডিশটা বানানো হয় চিক-পি বাটা, তাহিনি, এক্সর্টা ভার্জিন অলিভ ওয়েল, মিন্সড মিট আর নাটস্ দিয়ে। রুটি খানিক ছিঁড়ে, তার সাথে হামুস চাখনা দিয়ে খেয়েই বুঝলুম, এই জিনিস অন্য! দারুণ ভালো খেতে – পৃথিবীর নানা প্রান্তে মেডিটেরিয়ান রেস্টুরান্টে খেয়েছি, কিন্তু এমন ভালো খাবার চট করে পাইনি।
অথচ এত ভালো রেস্টুরান্ট এখানে থাকার কথাই নয় – তেমন ভেবে দেখতে গেলে। সিঙ্গাপুরে অর্চার্ড রোডে একদিন ঘুরছি – এই শপিং মল, সেই শপিং মল ঘুরে ঢুকলাম হুইলক প্লেস শপিং মলে। এটা মনে হয় না সিঙ্গাপুরের ব্যস্ততম শপিং মল গুলির মধ্যে আসে – এখানে লাঞ্চ করবো তেমন প্ল্যানও ছিল না। কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে একটা রেস্টুরান্টের গায়ে মেডিটেরিয়ান লেখা দেখেই সেখানে ঢুকে পড়লাম – সত্যি কথা বলতে কি, প্রথম বারে নামটাও ভালো করে দেখিনি। কিন্তু প্রথম দিন খেতে গিয়ে, এত ভালো খাবার খেয়ে, ভালো করে নামটা লক্ষ্য করি এবং সার্চ করে এর সম্পর্কে কিছু লিখতে ইচ্ছুক হয়ে পড়ি। অবশ্য এই রেস্টুরান্টের যে নাম আছে, তা টেবিলে বসার খানিক পরেই বুঝতে পারছিলাম – প্রায় সব কাস্টমারই স্থানীয়! এমন ট্যুরিস্ট-ভরা জায়গায় একটা রেস্টুরান্ট পুরো স্থানীয় জনতায় ভরা, এটা একটা বড় ইঙ্গিত খাবার ভালো হওয়ার!
রেস্টুরান্টের নাম “পিসতাচিও: মিডিল ইস্টার্ন অ্যান্ড মেডিটেরিয়ান গ্রিল”। এটা চালান শেফ খালেদ এলেলিমি। এনার শিকড় তো আরবিক কালচারে, সেখানকার খাদ্যাভাসে – কিন্তু তিনি এদিক ওদিক ট্রেনিং করে বেড়িয়েছেন। যেমন, আয়ুর্বেদ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন মালদ্বীপে রান্না-বান্নার কাজকর্ম করতে গিয়ে। সেখান থেকেই তিনি শিখেছিলেন বাসমতি চালের রকমারি ব্যবহার, দারুচিনি কি ভাবে ব্যবহার করতে হয় – ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এই সবের সাথে তিনি তাঁর আরবিক খাবারের দক্ষতা মিশিয়ে তৈরি করেন নানা ফিউশন ডিশ। আগের একদিনের লেখায় ফিউশন খাবার নিয়ে আমার খুঁতখুঁতে ভাব প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু এই শেফের খাবার খেয়ে বুঝলাম, ইনি ব্যাপারটা কবজা করেছেন। সাধে কি আর রিভিউ রেটিং-এ ৯ দিয়েছে লোকজন ১০-এর মধ্যে!
প্রথম দিন মেন ডিশে অর্ডার করেছিলাম ‘ইসকান্দর কাবাব’ – এই ডিশটি আমার খুব প্রিয়, তুরস্কের এক অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। আমি মেডিটেরিয়ান রেস্টুরান্টে খেতে গেলে এটা খোঁজ করি প্রায়শই, কিন্তু সব জায়গাতে পাই না। তাই এদের মেনুতে ইসকান্দর কাবাব দেখেই সাথে সাথে অর্ডার করে দিলাম।
ইসকান্দর কাবাব-এর নামকরণ হয় – এটা যিনি আবিষ্কার করেন, সেই শেফ ইসকান্দর এফেন্দি এর নামে – যিনি উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের বুরশা বলে একটি জায়গায় বসবাস করতেন। এই ডিশটি বানানো হয় ডোনার কাবাপ এবং গ্রিলড ল্যাম্বের টুকরো দিয়ে, যা বেছানো থাকবে গরম ট্যামেটো সসের মধ্যে, সাথে পিটা ব্রেড – এবং এই সবের উপর ছড়ানো থাকবে দই এবং কোনো কোনো সময় ভেড়ার দুধের থেকে বানানো বাটার।
তবে ইসকান্দর কাবাব-এর কমন ডিশ যেমন দেখতে হয়, এদিন খেতে গিয়ে দেখলাম শেফ খালেদ ঠিক তেমন ভাবে পরিবেশন করেননি – কিন্তু মূল সারবস্তু একই রকম ছিল, আর খেতে তো অপূর্ব। খাবার মাঝে শেফ খালেদ নিজে এসে প্রত্যেক টেবিলে খোঁজ নিয়ে গেলেন খাবার কেমন। আমি তো একগাল খাবার মুখে নিয়ে কি বললাম – উনি মনে হয় না বুঝতে পারলেন কিছু – তবে প্রশংসাই করতে চেয়েছিলাম!
এঁর খাবার এত ভালো লেগে গিয়েছিল, যে আরো বেশ কয়েকবার খেতে গেছি এখানে। শেফের স্পেশাল ডিশগুলি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেয়েছি বেশ কয়েকবার। শেফ খালেদ-এর স্পেশাল ডিশগুলির মধ্যে ছিল:
তোমাহক বিফ স্টেক: অন-দি-বোন বিফ স্টেক, গ্রিল করা – রোস্টেড প্যটাটো-র সাথে সার্ভ করা হয়।
হোল ল্যাম্ব শোল্ডার: স্লো-রোস্টেড ল্যাম্ব শোল্ডার – আরবিক বিরিয়ানি রাইস-এর সাথে সার্ভ করে।
বিফ বিস্কেট উ জুস: গ্রেন ফেড আঙ্গুস বিফ ব্রিস্কেট – স্লো রোস্টেড, হোমমেড বিফ স্টক আর আরবিক বিরিয়ানির সমন্বয়ে সার্ভ করে।
ইজেপশিয়ান ফিশ সিঙ্গারি: এই ডিশে একটা আস্ত রেড স্ন্যাপার-কে কাঁটা ছাড়িয়ে ওভেন-বেকড করবে। সাথে থাকবে পেঁয়াজ, গাজর, ছোট চিংড়ি।
এছাড়া আছে কিং প্রন ট্যাজিন, লবস্টার থেরমিডর ইত্যাদি।
মুখে এখনো লেগে আছে সেবারে সাঁটানো ‘স্পেশাল টিউনিশিয়ান ব্রেজড ল্যাম্ব শ্যাঙ্ক’। তবে পূর্ব-অভিজ্ঞতা অনু্যায়ী, এখন গেলে অ্যাপেটাইজার বুঝেশুনে অর্ডার করি – কারণ প্রথমবার দুইখান ‘পিটা ব্রেড’ খাবার স্মৃতি মনের কোণায় দগদগে হয়ে আছে। এদের বেশিরভাগ মেন ডিশের সাথেই কিছু রাইস বা ব্রেডের সাইড ডিশ আসে।
তো, যেটা আগে বললাম – শেফ খালেদ ফিউশন করেছিলেন হালকা, কিন্তু মেশাতে জানতেন। ঠিকঠাক ফিউশন না নামাতে পারলে, সেই জিনিস যে কি ভয়ঙ্কর হয়, তা জানতে আগের কয়েক পর্ব পড়ে নিতে পারেন।