ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিক – প্রচুর ঠান্ডা পড়ে গেছে বাইরে ইতিমধ্যে, তবে এখনো বরফপাত হয়নি, যদিও সকালে ঘাসের উপর ফ্রস্ট দেখা দিতে শুরু করেছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ছুটি শুরু হয়ে যাবে ইউনিভার্সিটির – ক্রিসমাস ব্রেক। এই সময়টা এলেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। ইউরোপের বন্ধুরা ফিরে যাবে নিজের বাড়ি, পরিবারের সাথে ছুটি কাটাতে। আমাদের ওই অত বড় বাড়িটা অনেকটা খালি হয়ে যায় – অবশ্য সবাই যে চলে যায় তা নয়, কিছু জন থেকে যায় বাড়িতে – আর সেই আমরাই ক্রিসমাস একসাথে কাটাই, বাইরে তখন হয়তো বরফ পড়া শুরু হয়ে যাবে।
আমাদের যেমন দুর্গাপুজো, ক্রিশ্চান ধর্মাবলম্বীদের তেমন সেই ক্রিসমাস। এ তো শুধু এক ছুটি কাটানো বা ধর্মপালনের ব্যাপার নয় – সেই সময় পরিবারের সাথে মিলনের। এই কলকাতাতে আমরা পার্ক স্ট্রিটে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লেও, বাইরের বিদেশীরা – যাদের পরিবার আছে – তারা ২৪ ডিসেম্বর রাতে কিন্তু প্রায় বেরোয়ই না! খুব ট্যুরিস্টে ভরা জায়গা না হলে, আপনি ২৪ তারিখ রাতে রেস্টুরান্ট এমনকি ফ্লাইটও ফাঁকা পাবেন।
ইংল্যান্ডে এই ক্রিসমাস ইভ (মানে ২৪ তারিখ রাত আর কি) কেমন হয় তার খুব ভালো উদাহরণ আপনি অনেক সিনেমায় পেয়ে যাবেন। যদি এখনো দেখে না থাকেন, আমি বলব দেখে ফেলুন ‘লাভ অ্যাকচুয়্যালি’ আর ‘দি হলিডে’ সিনেমা দু’টি। সেই কবে তেমনি এক ক্রিসমাসের ছুটিতে সব বন্ধুদের সাথে ‘গ্রেস’ হাউসে বসে দেখা ‘লাভ অ্যাকচুয়্যালি’ – তারপর থেকে প্রতি বছর ক্রিসমাসের ছুটির একদিন না একদিন এই সিনেমাটা দেখে এসেছি। ভালোবাসার সিনেমা – পরিবার যে মানুষের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা যেন নতুন করে বুঝে নেওয়া যায়।
ক্রিসমাসে ছুটি পড়ে গেলে ইউনিভার্সিটিও বন্ধ হয়ে যায় – ডিপার্টমেন্ট গিয়ে কাজকর্মও করা যাবে না! কারণ প্রধান সমস্যা হচ্ছে প্রবল ঠান্ডা – দীর্ঘদিনের ছুটি বলে হত কী, বিল্ডিং-এর হিটিং-সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হত। তার ফলে যা ঠান্ডা হত, অফিসে বা ল্যাবে আপনি কাজ করবেন কি, পকেট থেকে হাত বের করতেই ভয় লাগত!
আমরা যারা সেই ছুটিতে বাড়ি যেতে পারতাম না, তাদের জন্য গ্রেস হাউসে ক্রিসমাস-ইভে ডিনারের আয়োজন করা হত। আসলে আমরা একটা পরিবারের মতই ছিলাম – তাই আমাদের ওয়ার্ডেন ক্রিস এবং অফিস-কর্মী অ্যালেন-ক্যাথি তাদের পরিবার নিয়ে আমাদের সাথেই ওইদিন ডিনার করত, ক্রিসমাস ট্র্যাডিশনাল ডিনার। ডিনার করে রাতের দিকে আমি যোগ দিতাম জেন আর যোসেফের সাথে, মধ্যরাতের চার্চ সার্ভিসে। রাত বারোটায় চার্চে ওই দিন এক স্পেশাল প্রার্থনার আয়োজন করা হত – আমরা বাড়ি থেকে হেঁটে যেতাম হারবোর্ন চার্চে। সেই রাতের প্রার্থনা আমাকে বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছে মানুষের ধর্ম নয়, নিজেদের মধ্যে ভালোবাসাটাই বড় ব্যাপার – আর সমস্ত ধর্মের মূল কথা তাই। একই ভাবে আমার প্রিয় বন্ধু আহসানের সাথে রমজানের মাসের সময় ইফতার করতে যেতাম স্টুডেন্ট গিল্ডে – সেও সেই ভালোবাসার গল্প, ধর্মের ভেদাভেদের উর্দ্ধে। তবে সেই সব নিয়ে অন্য একদিন লিখব।
একটা কথা বলে নিই, এই বৃটিশ ক্রিসমাস মিল-এর মত প্রায় জঘন্য খেতে খাবার আমি জীবনে খুব কম খেয়েছি। আর আমি পৃথিবী জুড়ে খেয়েছি অনেক এটা-সেটা, তাই আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন। আমার তো রীতিমত ভয় লাগত, কিভাবে প্লেটের খাবারটা শেষ করব! দেশের বাড়িতে মায়ের এমন অবস্থার বক্তব্য, “যা খাবি খা, বাকিটা গরুর ডাবায় দিয়ে দেব” – এটা তো আর বিদেশে চলবে না! আর তা ছাড়া, বাইরের দেশে প্লেটে খাবার ফেলে রাখা বা নষ্ট করা একটা বাজে এটিকেট-এর মধ্যে পড়ে, বিশেষ করে তা যদি আবার ক্রিসমাস ডিনার হয়!
ট্রাডিশনাল ব্রিটিশ ক্রিসমাস ডিনারে কি থাকে? থাকে আপনার – রোস্টেড টার্কি, ব্রাসেলস্ স্প্রাউটস্, সেই টার্কির ফ্যাটে রোস্টেড আলু, ক্র্যানবেরি সস্, ছোট ছোট সসেজ্ - যা বেকন দিয়ে জড়ানো (‘পিগস্ ইন এ ব্ল্যাঙ্কেট’), ইয়র্কশায়ার পুডিং – আর গরম গ্রেভি টাইপের কিছু একটা।
ক্রিসমাস ডিনারের দিন সকাল থেকে আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে যেত – সকালে বাজারে গিয়ে টার্কি এবং বাকি সব জিনিসপত্র কিনে আনা। টার্কির সাইজ তো দেখেছেন আপনারা? বিশাল গাব্দা গাব্দা সাইজের হয় – আমাদের ওভেনের সাইজ অনুযায়ী আমরা কিনতাম, মোটামুটি ৫ কেজির টার্কি ঢুকে যেত আমাদের কিচেনের ওভেনে। এবার টার্কি রোস্ট করা নিয়ে কেরামতি। কিন্তু রোস্ট করার আগে টার্কিটিকে কিছু মালমশলা তো মাখাতে হবে নাকি! রোস্ট হয় চামড়া সমেত – হালকা করে চামড়ার নীচে আঙুল চালিয়ে আপনার সিজনিং এবং মশলা যা আছে মিশিয়ে, চারিয়ে দিন। খেয়াল রাখবেন, যেন চামড়া ছিঁড়ে না যায় – তাহলেই কেলো কেস হয়ে যাবে, টার্কি আর প্রপার রোস্টিং হবে না। বৃটিশরা আর কি বেশি মশলার ব্যবহার জানবে! সেই নুন আর গোলমরিচের গুঁড়ো! আর তা ছাড়া, টার্কির গাব্দা পেটটায় ঠুসে দিতে হয় স্টাফিংগুলি – বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পেটে গুঁজে দেওয়া হয় থাইম-এর ছোট ছোট পাতা/ডাল এবং রসুনের কোয়া। এবার রেসিপি-ভেরিয়েশনে আপনি অন্য অনেককিছুই সঙ্গে ঠুসে দিতে পারেন – সেটা আপনার ব্যাপার। তারপর টার্কির গায়ে বাটার ইত্যাদি মাখিয়ে ঢুকিয়ে দিন প্রি-হিটেড ওভেনে। মোটামুটি প্রতি কেজি মাংসের জন্য ৩০-৪০ মিনিট লাগে রোস্ট হতে – মানে ৫ কিলো মাংসের টার্কি প্রায় রোস্ট হবে ২০০ মিনিট – ঘন্টা-তিনের ধাক্কা। তিন ঘন্টা পরের দিক থেকে স্কিনের রঙ দেখে আপনাকে থার্মোমিটার টার্কির ভিতরে ঢুকিয়ে দেখে নিতে হবে যে ভিতর পর্যন্ত ঠিকঠাক রোস্ট হয়েছে কি না।
রোস্ট হবার সময় টার্কির ফ্যাটগুলো গলে গলে জড়ো হবে সেই রোষ্টিং প্যানে। সেই গলা ফ্যাট এবার ছড়িয়ে দিন অন্য জায়গায় রোস্ট হতে থাকা আলুর উপর, সেই রোস্টেড আলুর স্বাদ এবং রঙ দু’-ই খুলবে বেশি করে। বাকি জিনিসগুলিও আমরা সবাই মিলে রান্না করতাম। রান্নাবান্না শেষ করে সব রুমে ফিরে গিয়ে গা-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে নামতাম। সবাই বেশ সাজুগুজু করত – মাথায় ক্রিসমাস টুপি লাগিয়ে, ক্রিসমাস পটাকা ইত্যাদি ফাটিয়ে হত খাওয়া দাওয়া।
বড় মধুর কাটত সেই সন্ধেটা – হাসি, ঠাট্টা, গল্পে – আনন্দে। অনুভব করতাম যেন আমরা সবাই নিজেদের দেশ থেকে অনেক দূরে, কিন্তু এক পরিবারের মধ্যেই আছি!