কয়েক মাস আগে ইংল্যান্ডের কেমব্রীজ শহরে যেতে হয়েছিল একটা কাজে। স্ট্যানস্টেড এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে ঘন্টা খানেকের পথ কেমব্রীজ।
লাগেজ কালেক্ট করে গাড়িতে উঠে আবার মনে পড়ে গেল যে এই শোফার চালিত একজিকিউটিভ গাড়িতে চাপতে একদমই মন চায় না। বিদেশের সেই শোফার/ড্রাইভার গুলোর জন্য মায়া হয়। কোট-প্যান্ট-টাই পরে দাঁড়িয়ে থাকে হাতে নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে। আশে পাশে স্যুটেড-ব্যুটেড কেউ গেলে এরা প্ল্যাকার্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। সেই করে যখন হাঁপিয়ে ওঠে – আমি পিছন দিক থেকে আবির্ভূত হয়ে জানাই আমিই সেই পাবলিক! আমাকে আপাদ-মস্তক দেখে তাদের চোখে যে হতাশার ছায়া আসে, সে কি আর বলব!
কিন্তু এরা সবাই প্রফেশনাল – আর অনেক ড্রাইভারই খুব ভালো। অনেকটা পথ যেতে যেতে গল্প-টল্প হয় বেশী ক্লান্ত না থাকলে। এমিরেটস তাদের একজিকিউটিভ গাড়ি পাঠায় মার্সিডিজ – এয়ারপোর্ট থেকে ড্রপ করে হোটেলে বা বাড়ি থেকে পিক আপ করে এয়ারপোর্টে। এবারে ড্রাইভার টার্কিশ অরিজিন – অনেকদিন ব্রিটেনে বাস করে। এবার হয় কি এমিরেটস এর তো আর নিজের এত গাড়ি থাকে না – এরা কনট্রাক্ট দেয় অন্য কোম্পানিকে। এদের কোম্পানি হিথরো, গ্যাটউইক আর স্ট্যানষ্টাড মিলিয়ে প্রায় ৩০০ মতন মার্সিডিজ এমিরেটস এর একজিকিউটিভ পিক-আপ সার্ভিস দেয়।
খানিকটা গিয়ে আমাকে ড্রাইভার বলল, এই সময়েই তিনটে এয়ারপোর্টে অনেকগুলি ফ্লাইট আসে বলে মাঝে মাঝে মার্সিডিজ কমতি দেখা যায়। তখন অন্য ফাইভ সিটার টয়োটা বা হোন্ডায় সেই গুলো ব্যবহার করতে হয়। বলল,
“ভাবুন, আপনি এতটা জার্নি করে এলেন, এবার আপনাকে মার্সিডিজ এ পিক-আপ না করে, হোন্ডা সিটিতে নিয়ে যাওয়া হাচ্ছে। আপনি কি খুশী হবেন?”
কি আর বলি – ভাবলাম, মেমারী-তারকেশ্বর লাইনের ট্রেকারে চড়েছো? বা টাটা সুমো করে বর বা কনেযাত্রী? প্রতি টাটা সুমোয় ১৮ জন উঠবে হিসেব করে গাড়ি ভাড়া করা হয়!
গল্পটা সেই ড্রাইভারকে শোনানোর ইচ্ছে ছিল, হাতে সময়ও অনেকটা – কিন্তু ট্রেকারে চড়া বা টাটা সুমোয় বরযাত্রী যাবার গল্প বলা আমার ইংরাজী জ্ঞানে কুলোবে না বলে পিছিয়ে আসতে হল!
এবার ব্যাপার হল ইংল্যান্ডের খাবার নিয়ে কি লিখব নতুন করে! সেখানে বাস করেছি অনেকদিন, ইন ফ্যাক্ট কেমব্রীজেও গেছি বহুবার!
কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, "বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি" বা এমন কিছু, সেটা আবার টের পেলাম সেদিন সন্ধ্যায় একটা রেষ্টুরান্টে খেতে গিয়ে।
সোমবারের সন্ধ্যাবেলা, আমার সাথে আছে বন্ধু উইলিয়াম। তার ইচ্ছে থাই রেষ্টুরান্টে খাবে। রাতের বেলায় ভাত খাবার প্রবল ইচ্ছে না থাকলেও গেলাম তার সাথে একটা নামকরা থাই রেষ্টুরান্টে।রাত হয়ে গিয়েছিল আর রিজার্ভেশন ছিল না বলে কোন মতে একটা টেবিল পাওয়া গেল।
এবার যে খাবারই পছন্দ করি, অর্ডার নিতে আসা মেয়ে বলে সেই ডিস শেষ হয়ে গেছে!
- কোকোনাট ওয়াটার আছে?
- এই সময়ে নারকেলের জল ইংল্যান্ডে!
- তাহলে যে মেনু কার্ডে লেখা আছে?
- অমন লিখতে হয়! আগে ছিল হয়ত, এখন শেষ হয়ে গেছে
- স্পার্কলিং ওয়াটার
- কাল পর্যন্ত ছিল
- ডায়াট কোক?
- ডায়াট নেই, জিরো আছে। উইক এন্ডে প্রচুর ভীড় ছিল তো!
বললাম, "তোমাদের তো দেখি মেমারীর গণার ভেজিটেবল চপের মত কেস"!
বলাই বাহুল্য সে মেয়ে গণার কেসটা বুঝতে পারল না! কিন্তু হাসতে হয় বলে হাসল।
যাই হোক, সেই মেয়েটিকেই বললাম তোমার পছন্দ মত কিছু একটা থাই কারী এনে দাও যেটা আছে তোমাদের কাছে।
সেই মেয়ে অর্ডার নিয়ে চলে গেলে উইলিয়াম জানতে চাইল,
- হোয়াট ইজ গণা?
- হোয়াট নয়, জানতে হবে হু ইজ গণা
খাবার আসতে দেরী আছে বলে উইলিয়ামকে গণার চপের গল্প শোনানো গেল। মেমারী স্টেশন বাজারে পুরানো দিনে নীরেন ময়রার দোকানের পাশে বিকেলে গণা এক ট্রে ভেজিটেবল চপ বিক্রী করত। সেই ট্রে খালি হতে আধ ঘন্টা আর প্রচুর খদ্দের ফিরেও যেত। কিন্তু গণা কোনদিন এক ট্রের বেশী চপ বানালো না!
যত সহজে লিখলাম উইলিয়ামকে ভেজিটেবল চপ বোঝানো তত সহজ ছিল না। চপের ইংরাজি কি?? সে বোঝাতে গিয়ে যা সময় লাগল তাতে ধাড়ি ছাগলের মাংস কড়াইয়ে সিদ্ধ হয়ে যাবে!
এবং সেই ততক্ষণ বাদেই সেই মেয়ে এই কারী এনে দিল! এক চামচ খেয়ে উইলিয়ামকে বললাম, নারকেলের দুধ আর কাজু মেশালেই কি আর থাই রান্না হয়! এর থেকে নিমোর তাপস, লাল্টু বা মুকুল অনেক ভালো রান্না করে!
উইলিয়াম জানতে চাইল মুকুল কি কোন বড় শেফ? তাকে জানালাম মুকুলের গল্প করতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে, এখন খিদের মুখে সেসব হবে না। তবে এটা জেনে যাও মদের চাট বানাতে মুকুলের ধারেপাশে কেউ আসবে নে!
খিদের মুখে হামলে খেয়ে পেটের খিদে খানিক শান্ত হলে নজরে এল খাবারের পাত্রটা! এতো শালা প্রায় শানকি-তে খেতে দিয়েছে! যদিও অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র!
শেষবার এমন ফালতু চটা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে মানুষকে খেতে দেখেছিলাম আমাদের গ্রামের ঘোষেদের বরুণদাকে। শিবতলায় থিয়েটারে কয়েদীর রোল করছিল আর এমনি পাত্রে দুইখান পোড়া রুটি নিয়ে মর্মস্পর্শী ডায়লগে স্টেজ কাঁপাচ্ছিল!
খেতে খেতে মনে হচ্ছিল, সেদিন বরুণদার হাতে এই পাত্রটা থাকলে হাততালি আরো বেশী জুটতো!
কাজ চলছে, দিন কাটছে। উইক ডে এর পড়ন্ত বিকেলে। খুঁজে পেতে এক জমকালো দেখতে রেষ্টুরান্টে ঢুকলাম। ভাবলাম খাবার জম্পেশ হবে। কিন্তু ওই যে প্রবাদ বাক্য আছে না, বইয়ের মলাট দেখে ভিতরের জিনিস জাজ করতে নেই, এখানে খেয়ে সেটা আবার টের পেলাম!
যত্ন করে ওয়েটার টেবিলে নামিয়ে দিয়ে গেলেও প্লেটস্থ জিনিসপত্র দেখে কেমন যে একটা খালি খালি লাগছিল। কি যেন একটা ফান্ডামেন্টাল গলদ আছে এই প্লেটে - তাই সামনে নিয়ে ভাবলাম খানিক। অবশেষে ব্যাপারটা ক্লীয়ার হল।
এই রেষ্টুরান্টের ম্যানেজার এদিক ওদিক ঘুরে তদরকি করছিল। তাকে ডাকলাম -
- কাকা, একটা কথা ছিল
- হ্যাঁ বলুন না। আশা করছি খাবার ভালো লাগছে
- আরে খাবার শুরুই তো করি নি এখনো। আপনাদের প্লেটিং এর কনসেপ্ট-টা ভুল
- প্লেটের কনসেপ্ট ভুল?
- হ্যাঁ, দেখুন, আমি গ্রামের ছেলে। যা হোক কিছু দিয়ে গরুতে খেত বললে মানব না। যদিও বলে গরুতে কি না খায়, কিন্তু গরুতে আসলে মেথি-শাক একদম পছন্দ করে না!
- হোয়াট ইজ মেথি শাক?
- মেথি শাকের ইংরাজী আমি জানি না। কিন্তু গরুতে প্রবল খিদে না পেলে এই জিনিস খুব একটা খায় না। ইনফ্যাক্ট খিদে পেলেও দাপুটে গরুও এই জিনিস খায় না। মানে ফার্ষ্ট চয়েস নয় এই শাক
- এটা মেথি শাক নয়, এটাকে মনে হয় বলে 'মাসে'
- দেখুন মাসে হোক বা বছরে, আপনি যেমন মেথি জানেন না, আমি তেমন এ জিনিস জানি না। কিন্তু কথা হল, এ জিনিস কি গরুতে খায়?
- কিন্তু আপনি বার বার গরুতে কি খায় তার উল্লেখ করছেন কেন?
- আপনার শেফ প্লেটে এই মেথি বলুন বা মাসে বলুন তা দিয়ে তো এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে গরুটি এই খেয়ে মানুষ হয়েছে!
- তা কেন মিন করতে যাবে?
- তাহলে খামোকা দু-কুচো শাক ছড়িয়েছে কেন?
- এটা তো মাংসের সাথে ভেজিটেবল সাইড ডিস!
- অ, তাহলে ঠিক আছে। আমি ভাবলাম আপনার শেফ সিম্বলিক ভাবে প্লেটিং-এর মাধ্যমে গরুর ছেলেবেলা তুলে ধরতে চেয়েছে!
রেষ্টুরান্ট বেশ খালি ছিল তখনও বলে আমাকে এড়ানোর কোন অজুহাত দিতে পাচ্ছিল না! এবার কাকা আমার কথা শুনে আর বেশী দাঁড়ালো না! কেমন একটা ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকাতে রেষ্টুরান্টের ওদিকে সেঁটে গেল!
আমি মাংসের উপরে দেওয়া দুটো পোড়া পেঁয়াজে মন দিলাম।
তার পরের দিন একটা কাজে লন্ডন গেলাম সকালে। সেই দিনই বেশ রাতে ট্রেনে ফিরলাম লন্ডন থেকে কেমব্রীজে। ট্রেন থেকে নেমে বুঝলাম খিদে ভালোই পেয়েছে, তাই স্টেশনের পাশেই এক ইতালিয়ান কাকার দোকানে খেতে ঢুকলাম।
- কাকা, তাড়াতাড়ি চটজলদি আবার পেটও ভরবে এমন কি খাবার আছে আপনার?
- আমাদের স্পেশাল আছে ফিস আজকে
মাছ শুনে নড়েচড়ে বসলাম। একটু ঝোল ঝোল ডিস কিছু পেলে সাথে রিসোত্ত নিয়ে মাছ-ভাত হয়ে যাবে বিলেতে
- কি মাছ?
- হ্যালিবাট আছে, সাথে আলু
ভাবলাম তাই সই। অর্ডার দিলাম
যা জিনিস ডেলিভারী দিল দেখে চমকে গেলাম। মাছের উপরে কালচে রঙের ওয়াশারে ভর্তি! এখনকার ছেলেপুলেরা ওয়াশার কি জানিস জানবে না। আমাদের ছোটবেলা ছিল ওয়াশারময়। হ্যাজাকের পাম্প দেওয়ার ওয়াশার, প্রেসার কুকার, টিউবওয়েল - ওয়াশার ছাড়া দিন যাপন পান ছাড়া বার্ধক্যের মত
মাছের নীচে লুকিয়ে আছে আলু। টিপে দেখলাম পুরো কাঁচা। আমার ভাই তখন ষষ্ঠী ডাঙা জমিতে আলু বসাচ্ছিল বীজ আলু কেটে। এই শেফকে পেলে বাবু তাকে নিজের বউ, বড়মার সাথে বীজ আলু কাটার কাজে লাগিয়ে দিত! প্লেট থেকে জমিতে বসালেই কলিয়ে যাবে এমন আলু!
এবং সবচেয়ে বড় কথা মাছের উপর কয়েক গাছা গামা (বা গমা) গাছের টুকরো ছড়িয়ে দিয়েছে! গামা গাছ মানুষকে খেতে এই প্রথম দেখলাম - আগে শুধু গরুতে খেত, তাও এখন মনে হয় নিমোর বেচাদা তার জার্সিগুলোকে এ জিনিস খাওয়াবে না দুধ কমে যাবার ভয়ে!
খানিক পরে অন্য সব ইতালিয়ান রেষ্টুরান্টের মত এই কাকাও এসে জিজ্ঞেস করল খাবার কেমন। জানালাম আমি স্পিচলেস!
কাকা সেটা প্রশংসা ভেবে খুশী মনে ফিরে গেল।